#ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো
(৯৮)
সোহানার অবর্তমানে দায়িত্ব চেপেছে লাবিবার উপর। সোহানার সাথে ক্লাবে তার আগে থেকেই আনাগোনা। কোনো একদিন তানভীর তাকে বলেছিলো ‘আজকের লাবিবা আগামী দিনের সোহানা। ‘ তখন থেকেই তার সোহানার সাথে কাজ করা। এমনো হয়েছে দীর্ঘ মাইল পথ হেঁটে গবীর দুঃখী মহিলাদের নিকট সাহায্য পৌঁছিয়ে দিয়েছে। এই ওমেনস ক্লাবের প্রত্যেকটি কর্মীই খুব একটিভ। লাবিবা এখন বিজি থাকে এইসব মহিলাদেরকে নিয়েই। পড়াশোনা সে ছেড়েছে। মানসিক অশান্তি নিয়ে সেটা আর হবার নয়। তানভীর তাকে বলে দিয়েছে যেখানেই থাকুক না কেনো তানভীর যতক্ষন বাড়িতে থাকবে ততোক্ষন তাকে বাড়িতে থাকতে হবে। লাবিবা চেষ্টা করেও সবদিন পেরে উঠে না। দায়িত্ব ব্যাপারটা অনেক কঠিন। সবাই সামলাতে পারেনা। সোহানা সুস্থ হওয়া পর্যন্ত তো তাকে এই দায়িত্ব পালন করতেই হবে। আজো লাবিবার লেট হয়ে গেলো। তানভীর বাসায় থাকবে চারটার পর। আর এখন পাঁচটা বেজে গেছে প্রায়। লাবিবা ব্যাগ গুছিয়ে ঝটপট বেরিয়ে পড়লো। ফোনটা বের করলো ড্রাইভারকে কল দেবার জন্য। ফোনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই কপালে শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেলো। চোখ তুলে দেখে আর কেউ নয়। যার জন্য এতো তাড়া সেই ব্যক্তি। তানভীর শুধু জিজ্ঞেস করলো,
‘ কাজ শেষ?’
‘ হুম। ‘
‘ চলো। ‘
হাতটা মুঠোয় নিয়ে ধীরে এগুলো। লাবিবা এখন বরাবরই শাড়ি পড়ে বের হয়। ফর্মাল শাড়িতে তাকে খুব একটিভ লাগে। তানভীরের অবশ্য ভালোই লাগে।
গাড়িতে বসার পর লাবিবা জানালার বাইরের দিকে তাকালো। আজ আকাশে গোধূলি রং ধরা দিয়েছে। কেমন অদ্ভুত মায়াবী লাগে দেখতে। তানভীর লাবিবার দৃষ্টি খেয়াল করলো। মার্কেট এরিয়া পাস করে বললো,
‘ ওয়েদার টা চা খাওয়ার জন্য পারফেক্ট। ‘
লাবিবা চট করে ফিরে তাকালো। ঝটপট বলে দিলো,
‘ চাচীর চায়ের দোকানের মালাই চা। শহরের বাইরে। ঝিনাই ব্রিজের পরেই। বেশি দূরে না। ‘
তানভীর একগাল হাসলো। বললো,
‘ মালাই চা টা আমার। র চা টা তাহলে তোমার। নাহলে যাচ্ছি না। ‘
‘ ব্রিজে যাবো। চলেন না!’
‘ মনে থাকে যেনো। ‘
ব্রিজে দাঁড়িয়ে গোধূলি বেলা শেষ করে সন্ধ্যায় এলো চায়ের দোকানে। মালাই চা দাম প্রতি পয়ত্রিশ টাকা। তানভীর একটাই অর্ডার করলো। লাবিবা একহাত কোমড়ে রেখে তাকিয়ে আছে। লাবিবার জন্য এলো র চা। তানভীরের জন্য মালাই চা। লাবিবা চালাকি করে মালাই চা হস্তক্ষেপ করতে চাইলো। তানভীরের জন্য পেরে উঠলো না। আবদার জানালো, ‘ একবার খেলে কিছুই হবেনা। ‘
তানভীর মাথা নাড়ালো।
‘ ফ্যাট জাতীয় কিছুই আমি তোমাকে খেতে দিবো না। ‘
লাবিবা মুখ অন্যদিকে ঘুরালো।
‘ এতো সপ্ন দেখা ভালো না। ‘
তানভীর শুকনো হাসলো। মনে মনে প্রার্থনা করলো আর কখনোই বউকে বুঝতে ভুল যেনো করে না। একবারের ভুলে শাস্তি তাকে বছরের পর বছর টানতে হচ্ছে। এইতো পাঁচটা মাস হয়ে গেলো লাবিবার চিকিৎসা চলছে। চলছে বললে ভুল হবে। তার সহিত ছলনা করা হচ্ছে। লাবিবার সিদ্ধান্ত পাল্টানোর না। মেডিসিন খাওয়াচ্ছে তানভীর লাবিবাকে খুবই গোপনে। সেজন্য অনান্য কাজ ছেড়ে লাবিবাকে সময়টা বেশিই দিতে হচ্ছে। বড় কোনো স্বার্থে ছোট স্বার্থগুলো ছেড়ে দেওয়াই যায়। তানভীর তার পরেও সরাসরি লাবিবাকে বোঝায়। লাবিবা না শোনার ভান করে থাকে। সেজন্য বলতে বলতে আর বলাই ছেড়ে দিয়েছে। ইসমাইল খুবই দুঃখ পায়। মেয়ের সাথে এসব ব্যাপারে তিনি কথা বলেন না। আল্লাহকে ডাকেন শুধু।যদি তার উপর একটু দয়া করেন তাহলে নানা ডাক শুনতে পায়।
রোজীর আটমাস চলছে। এইতো সামনে মাসেই ঘর আলো করে চাঁদের দেখা মিলবে। কন্যা সন্তান হবে রোজীর। ইতিমধ্যে মেয়ের নাম ও ঠিক করা হয়ে গেছে। নামটি রেখেছে ফাহা। তার নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছে ‘ সিদ্রাতুল ফারাহ খান। ‘ রোজীর নামটা বেশ লাগলো। প্রসংসা করলো,’ ফুফু ভাতিজির এক অক্ষরে নাম । বাহ!’ ফাহা উচ্ছসিত হলো। বললো, ‘ ভাবী আমার বেবীর নাম ও আমি ঠিক করে রেখেছি। নিক নেম। মেয়ে হলে রাখবো নাফা আর ছেলে হলে নাফ। পুরো নাম এখনো ঠিক করিনি। ‘
‘ ফ তে বুঝলাম তুমি। ন তে কে ননদিনী? হুম?’ রোজী বলতে বলতেই ভ্রু নাচালো। ফাহা দাতে জিব কাটলো। ইনোসেন্ট ফেস করে বললো, ‘ কেউ না ভাবী । এমনি ভাল্লাগে। হে হে। ‘
‘ কাকে ভাল্লাগে?’
‘ দন্তীয় ন কে। হে হে। ‘
‘ এই ফাহা, তোমার হাবভাব তো ভালো ঠেকছেনা। বলো কাকে?’
রোজী চেপে ধরলে ফাহা উঠে দরজা দিকে দৌড় দেয়। রোজী হতভম্ব হলেও মাথা নাড়ে।
বাড়িতে থাকলে তাফিফ লাবিবার কাছেই থাকে। এইযে রাতে এখানেই ছিলো। সকাল আটটা বাজতে চললেও বেটার হুস নেই। পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছে। তানভীর উকি দিয়ে বলে, ‘ উঠেনি?’
‘ না ঘুমুচ্ছে । ঘুমাক যতক্ষন ঘুম হয়। ‘ তানভীর গালে ছোট্ট আদর দিয়ে বেড়িয়ে যায়। সারারাত তার বিছানায় ঘুমিয়েছে ভাতিজা। আর ভাতিজার চাচ্চু আর ছোট মা ঘুমিয়েছে _! কোথায়? জানেনা। চন্দ্রবিলাস করেই তো রাত কেটে ভোর হলো। পূর্ণশশীর আলোয় বাহু বন্দি নিজস্ব পরী! ঘুমের ঘ টাও মাথায় আসে না। আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া তার ঘরে একটা চাঁদের টুকরো পড়ুক। তার ঘরকে আরো আলোকিত করে তুলুক। তানভীর এখন এটাই চেয়ে যায়।
তানভীর লাবিবার মাঝে ভালোবাসার সম্পর্ক হয়ে উঠেছে আরো মধুর। কে বলে বিয়ের বয়স বেশি হলে ভালোবাসা আকর্ষন কমে যায়? কে বলে বাচ্চা না থাকলে মন উঠে যায়? সেসব নিতান্তই ভোয়া কথা।
জীবনের কোনো তিক্ততা তাদের ভালোবাসায় আচর কাটতে পারেনি। তানভীরের ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। লাবিবার প্রাণ তানভীর। তাঁদের মাঝে যত ঝগড়া বিবাদ ই হোকনা কেনো দিন শেষে তারা মিলে মিশে একাকার। যদিও মেজর কোনো বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়না। যা হয় সব ভালোবাসার খুনশুটি। তবে বাচ্চা নেওয়া নিয়ে লাবিবার জেদ কমার নয়। সেই ব্যপারেই তাঁদের বালিশ ছুড়া ছুড়ি ঝগড়া হয়। তবে তানভীর সামলে নেয়। তার চেষ্টায় সে ব্যর্থ হবেনা।
যত কষ্ট ই হোক ধৈর্য্য ধরেছে। লাবিবার জেদ একবার পড়বেই আর তানভীর কে ক্ষমা করবে। সে বিশ্বাস করে।
সারাদিন খেটে খুঁটে খুঁটে নয়টার দিকে সে বাড়ি ফিরে। ঘরে এসে ফ্রেশ হতে যাবার আগে লাবিবাকে ডাকে। তানভীর এলে লাবিবা যেখানেই থাক দৌড়ে চলে আসবে। তানভীর চেঞ্জ করে এসে লাবিবাকে পেলো না। দরজা খুলে গলা বাড়িয়ে আবার ডেকে এলো। মিনিটের পর মিনিট চলে যাচ্ছে লাবিবা আসার নাম গন্ধ নেই। তানভীর বিরক্তি নিয়ে ঘরে ছাড়লো। কিচেন,ড্রয়িং, সহ প্রত্যেকটা রুমে রুমে খুঁজে ছাদ থেকেও ঘুরে এলো। লাবিবাকে পেলো না। তাহলে কি সে নেই? রাণীমহলে আছে? সেখানে গেলে তো টেক্সট করে দিতো। তানভীর রুমে এসে ফোন হাতে নিলো। লাবিবাকে ফোন করে জানতে চাইবে সে কোথায় আছে। যদি এ বাড়িতে নাই থাকে তাহলে বকেও দিবে তাকে না জানিয়ে অন্যত্র থাকার কারণে। কল দিতেই ওয়ার্ডোবের উপর ফোনটা বেজে উঠে। তারমানে লাবিবা বাড়িতেই আছে। তানভীর কল কেটে আবার ডাকার জন্য বাইরে হাঁটা দেয়। সেই মুহূর্তে ছম ছম শব্দ শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে। এই শব্দ তানভীর চিনে। তার রাণীর পায়ে যে এঙ্কলেট শোভা পেয়েছে তার সুর যা তানভীরকে দিন দুপুরে হটাৎ হটাৎ গভীর ভাবে বিমোহিত করে। লাবিবা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে পর্দার আড়ালে। সেজন্যই বোধহয় তানভীরের নজরে আসেনি। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দেয়। দৃশ্যমান হয় কালো শিপন শাড়ী পড়নে এক রুপবতী। কিন্তু তার মুখ থমথমে। গলার হাড় গুলো ফুলে ফুলে উঠছে। তানভীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। রক্তহীন গালে হাত রেখে ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘ কি হয়েছে?’
লাবিবা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পারেনা। তার চোখ ভরে আসে। কিন্তু শক্তভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। তানভীর উত্তর না পেয়ে ছটফট করে উঠে। ফের জিজ্ঞেস করে,
‘ এমন দেখাচ্ছে কেনো তোমাকে? জান! বলো তোমার কি হয়েছে? ‘
লাবিবার হাতে প্রেগনেন্সি কীট হাত আগলা হয়ে ফ্লোরে পড়ে। টং করে শব্দ হয়। তানভীর সেদিকে লক্ষ্য করতেই লাবিবা কাঁপা হাতে তার হাত আগলে ধরে। শাড়ি ভেদ করে উম্মুক্ত পেটে হাত টেনে রাখে। তার শরীর রিতীমতো কাঁপছে। ফ্যাচফ্যাচ গলায় বললো,
‘ আমরা তো কোনো বেবী প্লেনিং করিনি। কি করেছেন আপনি? খান সাহেব! আপনার সন্তান এখন আমার পেটে। ‘
তানভীর শান্ত দৃষ্টিতে লাবিবার অশান্ত আদলে তাকিয়ে থাকে। চোখে মুখে অবিশ্বাস। জিহ্বায় ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। জিজ্ঞেস করে, ‘ সত্যি?’
লাবিবা ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে। তানভীর কীটটা ফ্লোর থেকে তুলে নেয়। পর পর দুটো দাগ দেখে তার শরীরে ঘাম হয়। এইযে কপালে বিন্দু বিন্দু জমছে। লাবিবা কে বলে, ‘ চলো জলদি হসপিটালে। এক্ষুনি টেস্ট করাবো। আমাকে এক্ষুনি সিউর হতে হবে। ‘
লাবিবার হাতে টান লাগে। লাবিবা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়। বাজখাঁই গলায় বলে, ‘ কীটে দুটো দাগ দেখতে পাচ্ছেন না? এই রাতের বেলা আপনার টেস্ট করতে যেতে হবে? আমি বুঝতে পারছি আমি প্রেগন্যান্ট। আমার আর সিউর হতে হবেনা। ‘
তানভীর কি করবে ভেবে পায়না। দুহাতে জাপটে ধরে গালে মুখে ঠোঁটে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। মিনতি করে, ‘ জান প্লিজ ক্ষমা করে দাও। বাবুর হিসু,পটি সব আমি সাফ করবো তুমি তাও শান্ত হও। আমার বাবুর আম্মু রাগ করে না। ‘
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৯৯)
ফিরোজ খানের পাশেই বসে আছে তানভীর। তার পাশেই ইসমাইল। বাকিরা বিছানায় বসে। জবেদা মিষ্টি বিতরণ করছে । পরিবারের প্রত্যেকেই খুশি। সব থেকে বেশি খুশি সাবিনা। কি ভয় টাই না পেয়েছিলো! কিন্তু যাকে নিয়ে এতো খুশি সেই দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার এক কোণে। মিশ্র অনুভূতিতে পা ঢুবিয়েছে। কেইনা মা হতে চায়! লাবিবা তো অনেক বছর আগে থেকেই এই দিনটার অপেক্ষা করে এসেছে। তানভীর যেদিন বেবি নেবার কথা বললো সে তো সেদিন থেকেই পিল নেওয়া বাদ দিয়েছে। তারপরেও যখন কোনো কাজ হচ্ছিলো না ডক্টরের দেওয়া মেডিসিন গুলো সে সেচ্ছায় খেতো। আগে বোকা থাকলেও এখন সে এতোটাও বোকা নয় যে তানভীর তাকে মেডিসিন দিচ্ছে সে বুঝবেনা। সময় মাসের পর মাস যাচ্ছিলো লাবিবার মনে হলো সত্যিই সে কনসিভ করতে পারবেনা। আল্লাহ কে ডাকতে ডাকতে আজ তিনি রহম করেছেন । কদিন থেকেই শরীর খারাপ লাগছিলো। আজ দুপুরে মুখ ভরে বমি করেছে। মাছের গন্ধ মোটেও নিতে পারছেনা। ড্রাইভারকে দিয়ে কীট আনিয়ে তারপর সিউর হলো সে মা হতে যাচ্ছে। মা হওয়া বুঝি এতোই সুখের! দু চোখে জল উপচে আসে লাবিবার। পেটে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুহুর্তেই চোখ নামিয়ে নেয়। অভিমান ঠেলে বলে, ‘ তোর পাপার সাথে আমার কোন কথা নেই বুঝছিস মা? স্বৈরাচারী একটা লোক। তোর নানুর সাথে তো আমি কথাই বলবোনা। স্বৈরাচারীর শ্বশুড়! তুই তো অনেক আগেই আমার কাছে আসতিস এখন আমার কোলে বসে আদর খেতিস। ওরাই তো আসতে দিলো না। শত্রু, শত্রু। সব শত্রু ওরা। ‘
ভেতর থেকে ইসমাইল ডাকে, ‘ লাবিবা। বাইরে হাওয়া দিচ্ছে। ভেতরে এসো। ঠান্ডা লাগানো যাবেনা। ‘
লাবিবার সাড়া নেই। তানভীর উঠে আসে। লাবিবার পাশে দাঁড়াতেই চেঁচায় ‘ দূর হ স্বৈরাচারী লোক। ‘
তানভীর পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আদুরে গলায় বলে, ‘ জান! প্লিজ এরকম করো না। ‘
‘ ছাড়। ঠকবাজ লোক। ঠকিয়েছে আমাকে। ‘
‘ আমার নরম নরম বউটা এতোটা হ্রাস বিহেব কেনো করছে? কাঁদছিলে? প্লিজ জান। আমি সরি তো। সবকিছুর জন্য সরি। কখনোই আর তোমার অবাধ্য হবোনা। ঢের হয়েছে আমার। তুমি যা বলবে তাই হবে। শান্ত হও আমার পাপা এসব জানতে পারলে খারাপ ভাববে তো। আসো আদর করে দেই। উম্মাহ।’
এতো আদিক্ষেতা মোটেই ভালো লাগছে না। গা জ্বলে যাচ্ছে। নিজের মতো সব হলে উম্মাহ বের হয় অথচ না হলে বউ কষ্টে মরে যাক দেখার বিষয় নয়।
‘ ছাড় আমাকে। তোর তো বাচ্চা লাগবেনা। তোকে আমি কিছুতেই বাচ্চা দিবোনা। ‘
‘ তুই তোকারি করছো কেনো?’
‘ একশ বার করবো। খবরদার আমার ধারে কাছে আসবেন না। ‘
‘ জান কথা শোনো। ‘
‘ প্লিজ! আমার কাছে আসবেন না।আপনাকে আমার একটুও সহ্য হচ্ছেনা। প্লিজ। ‘
তানভীর ভীষন অসহায়ত্ব ফিল করে। একেবারে চলে না গিয়ে কাচের দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লাবিবার কান্না তার সহ্য হচ্ছেনা। আজ এতোবড় একটা খুশির খবর সময়টা অন্য রকম হতে পারতো এই যুগলের। লাবিবার ভেতরে যা হচ্ছে তানভীর কি আঁচ করতে পারছেনা? অবশ্য ই পাচ্ছে। কিন্তু কি করে তার মনে শান্তি প্রবেশ করাবে সে জানেনা। শুধু সময় দিচ্ছে। সময় সবকিছু ঠিক করে দিবে। লাবিবা ঠিকই ক্ষমা করবে তাকে।
সকাল সকাল লাবিবা বেরিয়ে যায়। তানভীর কলেজে আগেই চলে গিয়েছে। লাবিবার পাশে জোরে জোরে হাটে ইসমাইল। হাত মুঠোয় নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ কোথায় যাচ্ছো?’
‘ যাচ্ছি এক জায়গায়। ‘
‘ চলো আমিও সাথে যাচ্ছি। ‘
‘ নো নিড। আমার ড্রাইভার আছে। ‘
‘ তা তো আছেই। আমিও যাচ্ছি । একা একা এখন কোথাও যাবে না। আমাকে ডাকবে নয়তো তোমার আম্মুকে বলবে সাথে যাবে। ‘
‘ কেনো? আমি কি লুলা? হাত পা নেই? চলা ফেরা করতে পারবো না?’
‘ কি বলে! সময়টাই এরকম মা। আমি জানি তোমার আমার প্রতি অনেক রাগ। তোমার রাগ কমাতে কি করতে পারি? চলো আমরা দূরে কোথাও ঘুরে আসি। পাহাড় থেকে। পাহাড়ে উঠলে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে। আব্বু সব দিবে। দেখবে আর আব্বুর প্রতি রাগ নেই। ‘
‘ আব্বু হাত ছাড়ো। তোমাকে মোটেই এখন আমার ভালো লাগছে না। যেতে দাও আমাকে। ‘
‘ শুধু শুধু রাগ করে। আমি আসছি। ‘
‘ লাগবেনা। থাকো তুমি। একদম আমার সাথে আসবেনা। ‘
‘ এরকমটা করে না মা। ‘
‘ তুমি যদি আসতে চাও আমি যে যাবো আর ফিরবোনা।’
লাবিবার সাথে নিলোই না। ইসমাইল ড্রাইবারকে বলে দিলো, ‘ সাবধানে গাড়ি চালাবেন ভাই। আমার মেয়ে কিন্তু এখন আর একা না। আপনাদের স্যার আসতে চলেছে। ‘
‘ মিষ্টি রাতেই খেয়েছি স্যার। ‘
‘ দেখে রাখবেন।’
‘ ইনশাআল্লাহ। ‘
লাবিবা অফিসে বসে আছে। প্রিন্সিপালের সাথে সে দেখা করতে এসেছে। কলেজটি এমপি ভুক্ত। সেখানে সে এই আসনের এমপির ছেলের বউ। ব্যাপারটা কেমন যেনো অসস্তি দিচ্ছে। ভাগ্য যখন সহায় না হয় তখন হাল ছেড়ে দিলে তো আর চলবেনা। কিছু একটা করতেই হবে। প্রিন্সিপাল লাবিবাকে দেখে নিজেও সমানে মাথা নাড়াচ্ছে। লাবিবার প্রস্তাবে আপত্তিও জানালো,
‘ মিসেস খান। আপনি এতোদূর অব্দি এসেছেন তাই আমরা খুবই সৌভাগ্যবান মনে করছি। ফিরোজ স্যার আমাকে একটা কল দিলেই হয়ে যেতো। প্রয়োজনে আমি তার সাথে দেখা করতাম। আপনার সিজিপিএ বরাবরই ভালো। আপনি আমাদের কলেজে পড়ালে অবশ্যই কলেজের জন্য ভালো হবে। ‘
‘ চাকরীটা পার্মানেন্ট করতে চাই। আপনাদের সার্কুলার দেখে এসেছি। আমি আবেদন করে দিয়েছি অবশ্যই এক্সাম দিয়ে তারপর জয়েন করবো। ‘
‘ আপনি চাইলে এভাবেও জয়েন করতে পারেন। ‘
‘ আমি এক্সাম দিয়েই জবটা পেতে চাই। অন্যদের জন্য যে রুলস আমার জন্য ও সেটা হোক। পারিবারিক কোনো এডভান্টেজ নিতে চাইছি না। ‘
‘ আমি ফিরোজ স্যারের সাথে কথা বলে নিবো। ‘
‘ পাপাকে এখানে না টেনে আনাই ভালো হবে মনে করি। সাধারণ কেন্ডিট হিসেবে দেখলেই খুশি হবো। আমি এপ্লাই করেছি শুনে আপনি এক্সাম ছাড়াই আমাকে নেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলবেন সেটা বুঝতে পেরেই আমি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। গতানুগতিক নিয়মেই আমি পার্মানেন্ট ভাবে এই কলেজে জয়েন করতে চাই। ‘
‘ আপনি চাইলে তাই হবে ম্যাম। কফি প্লিজ। ‘
লাবিবা কফির কাপ হাতে তুলে নেয়। এক চুমুক মুখে দিয়েই বুঝে সুগারের পরিমাণ অতিরিক্ত। হট কফিজুস নাকি কফি মেলানো যাচ্ছে না। অল্প একটু ফ্রুটস ও মুখে দেয়। ক্ষিধে পেয়েছে বেশ ।
রাস্তায় বসে অনেক টুকু বমি হয়। ড্রাইভার পানি বোতল নিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে। লাবিবা পুরো বোতল পানিতে হাত মুখ ধোয়। ড্রাইবারকে বলে আরেক বোতল নিয়ে আসতে। সে পানি খাবে। ড্রাইবার দৌড়ে গাড়ির দিকে যায়। ঝটপট কলে তানভীরকে জানায়,’ স্যার ম্যাম চন্দ্রা গাড়ি থামিয়ে বমি করছে। ‘
‘ ম্যামকে কিছুক্ষন বাইরেই রাখো। একটু ফ্রেশ এয়ার পাক তারপর গাড়িতে বসাবে। ‘
‘ ওকে স্যার। ‘
লাবিবাকে বাইরে দাঁড়াতে বললে লাবিবা দুই মিনিট দাঁড়ায়। তারপর গাড়িতে উঠে বসে। মোড় ছাড়াতেই ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে, ‘ আজ আপনার বড় স্যার কোথায় হসপিটাল নাকি শো রুমে গিয়েছে?’
‘ শো রুমে ম্যাম। ‘
‘ শাহাজালালের দিকে টানেন। হসপিটালে আমার কিছু কাজ আছে। পৌঁছে দিয়ে আপনি অন্যত্র যেতে পারেন। আমার লেট হবে । ‘
‘ ওকে ম্যাম । ‘
লাবিবাকে নামিয়ে দিয়ে খবরটা ড্রাইভার তানভীরকে পৌঁছে দেয়,’ স্যার ম্যাম বাসায় না ফিরে হসপিটালে এসেছে। ‘
‘ হসপিটালে? একাই এসেছে?’
‘ জি স্যার। ‘
‘ তোমার ম্যাম কোন ডিপার্টমেন্টে গিয়েছে দেখো। ‘
‘ আমাকে সাথে নেয়নি স্যার। ম্যাম বলেছে লেট হবে। আমাকে চলে যেতে। ‘
‘ মানে টা কি? ওকে তুমি যাও আমি দেখছি। ‘
ফোন রেখে তৎক্ষনাত বেরিয়ে যায় তানভীর। পিয়নকে শুধু জানিয়ে যায় আজ আর ব্যাক করবেনা। আধঘন্টার রাস্তা বিশ মিনিটে শেষ করে। মেইন রোডে কয়েকবার অন্য গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগেছে। লোকজন গালি দিলো নাকি না দিলো সেদিকে ভাবার সময় নেই। মাথার ভেতর হাজারো দুশ্চিন্তা খেলা করছে। এক হাতে চুল টেনে ধরে। বিরবির করে অভিযোগ জানায়।
‘ এতো জেদ তোমার রাণী সাহেবা! সন্ধ্যায় আমি কি তোমাকে নিয়ে ডক্টর দেখাতাম না? প্লিজ জান আমার বেবীর কোনো ক্ষতি করোনা। আমার উপর রাগ তোমার আমার বেবীর উপর মিটিও না। প্লিজ। ‘
চোখ দুটো কোটর ভরে আসে। দম যেনো আঁটকে আসবে তানভীরের। এই রাস্তা শেষ ও হয়না।
রিসিপশনে খবর নিয়ে জানতে পারে গাইনী ডাক্তার বসবে দুটো সময়। আরো দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। তার উপর সিরিয়াল ও অনেক হয়ে গেছে।বাইরে বেরিয়েছে যখন তখন লাবিবা ভাবলো ডক্টর দেখিয়েই যাওয়া হোক। তানভীরের কখন না কখন সময় হয়! বেবীর সময়ের হিসাবটাও রাখতে হবে। কিন্তু এখন তো শুধু শুধু বসে থাকতে হবে। লাবিবা রিসিপশনিষ্ট কে বলে তাকে প্রথমেই সিরিয়ালে দিতে বলে। হসপিটালে লাবিবা চেনামুখ। তাকে যথোপযুক্ত সুবিধাও দেওয়া হয়। ওয়েটিং চেয়ারে বসে থাকা লাবিবার কর্ম নয়। পেশেন্টদের ভিড়ে এখনি গা কেমন করছে। লাবিবা নার্সকে বলে তাকে একটা ফাঁকা কেবিনের ব্যবস্থা করে দিতে। একটু শুয়ে থাকবে। বেশী সময় বসে থাকলেই পেটে হালকা ব্যাথা করে। শুরুর দিকেই কেনো এই ব্যথা সেটাও ডক্টরের থেকে জেনে নিতে হবে। হসপিটালের লোকগুলো শুনেই খোঁজ নেয়। তিনতলায় একটা পরিষ্কার কেবিন তৈরী আছে। লাবিবাকে সেখানে রেখে আসা হয়। টেবিলে পার্স রেখে লাবিবা বেডে শুয়ে পড়ে। এখন একটু শান্তি লাগছে। আধ ঘন্টা পরেই হুড়মুড় করে কেবিনে ঢুকে তানভীর। লাবিবা চোখ বন্ধ করে ছিলো। শব্দ পেয়ে চোখ খুলে বসতে অব্দি পারে না। তার আগেই গালে দানবীয় এক থাপ্পড় পরে। চিন চিন ব্যাথায় লাবিবার চোখে পানি চলে আসে। অবাক হয়ে তাকায় তানভীরের দিকে। সে কি করেছে বুঝে না উঠতেই পেটের উপর ঠান্ডা স্পর্শ পায়। ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে জানতে চায়, ‘ আমার বাচ্চা আছে?’ লাবিবা কি উত্তর দিবে? বড় বড় চোখ করে তানভীরকেই দেখছে। দুই গালে সমান্তরাল রেখায় জল গড়িয়ে পড়ছে। অধৈর্য তানভীর নিজেই যেনো কি চেক করে। আবার জানতে চায়, ‘ কিছু করোনিতো আমার বাচ্চাকে?’ কি করবে? তানভীর যখন শিউর হয় তখন গলার জোড় বেড়ে যায়।
‘ হসপিটালে আমি নিয়ে আসতাম না? বাসায় না ফিরে এখানে শুয়ে থাকার মানে কি? কি চাস? আমি মরে যাই? তোর জেদে আমার হার্ড এট্যাক হোক তাইনা? আজ যদি আমার বাচ্চার কিছু করতি না ডাইনি আমিও মরে যেতাম দেখিস। তোর জেদ নিয়েই তুই থাক। আমি_ আমি _আমি’
পেটে মুখ গুজেই কেঁদে উঠে তানভীর। লাবিবার এতোক্ষনে টনক নড়ে। ঝটপট উঠে বসে তানভীরকে বুকের উপর টেনে নেয়। দরজাটাও খোলা। লাবিবা চোখ মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ কাঁদছেন কেন আপনি? কি হয়েছে?’
তানভীর মুখে কুলুপ এঁটে বসে। লাবিবা দু গালে হাত রেখে চোখে চোখ রাখে। জানতে চায়,
‘ কষ্ট হচ্ছে? ভীষণ কষ্ট। ‘
‘ মুক্তি দাও প্লিজ। আবার আমার কোমল নরম আদুরে বউ হয়ে যাও। আমি তোমার এই ব্যবহার আর নিতে পারছিনা। ‘
‘ আমিও পারিনি। আমার চোখের জল গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য আপনি দেখেছেন আজ আমিও দেখলাম। খান সাহেব আজ প্রথম আমি আপনাকে কাঁদতে দেখলাম। সত্যি। একটা বছর ও এই যন্ত্রনা সহ্য করতে পারলেন না? আর আমি চারটা বছর সহ্য করেছি। আমার মুক্তি কে দিবে?’
‘ খুব ভালোবাসি জান। ভীষন ভালোবাসি। ‘
তানভীর অসহায় দৃষ্টি। লাবিবা বেড ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তানভীরকে বলে, ‘ খোঁজ নিন ডাক্তার এসেছে কিনা। বাসায় যাবো। আর ভালো লাগছে না। ‘
‘ ডাক্তার দেখাও নি?’
‘ না। আপনি তো ভেবেছিলেন আমি বাচ্চাটাই রাখিনি। তাইনা? বাপরে কি কান্না! আমার জন্য তো কখনো কাঁদেন নি। চোখের জল তো একদিন ও দেখলাম না। বাচ্চার দরদ ই বেশী হয়ে গেলো তার। ‘
‘ জোরে কথা বলে না জান। ‘
‘ একশ বার বলবো। বের হন। ‘
তানভীর দরজা অব্দি যায়। ফিরে এসে আবার গালে চুমু বসায়। ‘ ক্ষমা করে দাও জান। ‘
‘ টানা দশদিন হাউমাউ করে কাঁদবেন। তারপর ক্ষমা পাবেন। এর আগে না। ‘
‘ কি ছেলেমানুষী করছো?’
‘ যাবেন আপনি? ‘
‘ যাচ্ছি যাচ্ছি। ‘
‘ কাঁদুনে লোক কথাকার। চোখের পানি ফেলে। কাঠগড়ায় তুলে আমাকে। হিসাব গুলো কে দিবে? পাপী আমি? পাপী করে রাখতে চায় আমাকে। ‘
‘ তুমি এতো ঝগড়ুটে কবে হলে?’
‘ এখনো যাননি আপনে?’
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা