#ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো
(১০০)
দাবার গুটি কখন উল্টে চোখের পলকে দেখতে দেখতে বুঝে উঠাই গেলো না। কয়েক ঘণ্টা আগে যে বেডে তানভীর লাবিবাকে জড়িয়ে কাঁদছিলো তার পাশের বেডেই এখন লাবিবা তানভীরকে জড়িয়ে কাঁদছে। খুব হালকা করে জড়িয়ে। মেজাজ ঠান্ডা হতে না হতেই গরম। লাবিবা বললো,’ আপনি আমাকে ডাইনি ডেকেছেন। আমার থেকে দূরে দূরে থাকবেন । কখন না যেনো আপনার ঘাড় মটকে দেই। ‘
তানভীরের মায়া হলো। অপরাধ বোধ জাগলো। আলতো হাতে গাল ছুঁলো। বললো, ‘ সেটা তো রেগে বলেছি। সরি। কতটুকু প্রেসার নিয়ে হসপিটাল অব্দি এসেছি তুমি যদি জানতে! দেখো হার্ট এখনো ফার্স্ট বিট করছে। ‘ হাত টেনে বুকের উপর রাখলো। লাবিবা বুঝলো আসলেই খুব দ্রুত বিট করছে। তবুও নিজেকে দমাতে পারলো নাই।
‘ আপনি আসলেই আমাকে ডাইনী ভাবেন। যদি আপনার ব্রেইনে এটা নাই থাকতো তাহলে মুখে আসলো কিভাবে? শব্দটা উচ্চারণ তো এমনি এমনি হয়নি। ‘
‘ আচ্ছা সরি। তুমি ডাইনী আর আমি রাক্ষস। হেপি?’
তানভীরের লেইম ফাজলামোতে লাবিবার গা আরো জ্বলে উঠলো। তানভীরকে ছেড়ে দাম কিটমিট করলো,
‘ কাপুরুষ কথাকার। গায়ে হাত তুলেন! যেখানে আমার বাপ ই আমার গায়ে হাত তুলে না সেখানে আপনি কিভাবে সাহস করেন?’
‘ তোমার ঐ বাপ ই তো যতো সমস্যার গোড়া। ‘
‘ একদম আমার বাপের নামে কিছু বলবেন না। সমস্যা আমার বাপ না। সমস্যা আপনি। আপনিই বাপ হতে চাননা। এখন কিসের এতো আগ্ৰহ? এই বাচ্চা আমি রাখবোনা। ‘
লাবিবা রাগ দেখিয়ে বলল বেড়িয়ে যায়। পরক্ষনেই কেবিন থেকে নার্স চিৎকার করে ডেকে উঠে। লাবিবা আসতে আসতে তানভীরকে ধরে ইমার্জেন্সি তে নিয়ে যাওয়া হয়। নার্স বলে আপনার স্বামীর বুকের ব্যাথা উঠেছে।
তানভীরের যে এতো বড় একটা রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে জানতো কে! শক্ত পোক্ত মানুষটার হার্টের অসুখ মানতেই পারছেনা লাবিবা। ডাক্তার এক পাতা ঔষধ লিখে দিয়েছে। রাত টুকু লাবিবা মোটেই তানভীরের কাছ ছাড়া থাকলো না। তামিম অনেক বুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। তানভীরের চোখ গরম করা দেখেও লাবিবাকে সরাতে পারলোনা। এদিকে ইসমাইল অস্থির হয়ে আছে। তিনি না পেরে তানভীরকেই বললো, ‘ ওকে বোঝাও। পেটে নাকি মৃদু ব্যাথা। ডাক্তার ও দেখানো হলো না। এখন হসপিটালে রাতে থাকলে শরীর খারাপ করবে। ভালো করে তো খেলোও না। চল মা আমরা বাড়ি যাই। সকালেই চলে আসবি। এখন চল।’
লাবিবা উত্তর দিলো না। সে যে যাবে না এটা সবাই বুঝতে পারলো। তামিম ইসমাইল কে নিয়ে চলে গেলো । যাওয়ার আগে একটা নার্সকে যাওয়ার আগে পার্সোনালি হায়ার করে গেলো। ভীষন নীরবতার মাঝে লাবিবা বললো, ‘ আপনি কি আগে কোনো সিনড্রম পাননি? কিভাবে বাঁধলেন এই রোগটা? অবশ্য রোগ কেউ ইচ্ছে করে বাঁধায় না। ইন্টারনাল পার্টস গুলোতে তো কারো হাত থাকেনা।’
‘ হার্টের রোগ হবে নাতো কি হবে? হার্ট টা তো তোমার হাতে। তোমার আব্বু নিতে সেখানে রিতীমতো স্পিং করলো। তাও যা ফিরিয়ে দিলো একটু ভালো থাকলো। তারপর শুরু হলো তোমার খুচাখুচি। এতো কিছুর পরেও বিট করতে এটাই তো বড়!’
‘ ধ্যাত! কিসব কথা!’
‘ সত্য কথা। এখন বিন্দু মাত্র চাপ নিতে কষ্ট হয়। তার উপর তুমি পাথর ছুঁড়ে চলেছো। হসপিটালের বেডের উপর রাত না কাটিয়ে উপায় আছে!’
লাবিবা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো । তানভীর কি বলবে? সে তো নিজেই জানতো না তার হার্টের রোগের কথা। লাবিবাকে টেনে পাশে শুইয়ে দিলো। ঘাড়ে আদর করতে করতে বলল, ‘ সাবধান! আমাকে আর টেনশন দিবে না। রাগ করো জেদ করো মারো কাটো সব সইবো। টেনশন নিতে পারবোনা। ‘
লাবিবা চুপ থাকলো। তানভীর হুট করেই নিজের মুখ ঘুরিয়ে নিলো। গলায় এক সমুদ্র মায়া ঢেলে বললো,
‘ আমার রাণী! কয়টা মাস থেকে আমার উপর রাগ দেখাচ্ছো তুমি। তোমার এই রাগ আর অবহেলায় আমি ক্ষয়ে যাচ্ছি। আমাকে ক্ষমা করো। আমার বুকে যন্ত্রনা হয়। তোমার একটু অভিমান আমার বুকে পাথর তুলে দেয়। সেখানে তুমি তোমার রাগের গভীরতা দেখিয়ে যাচ্ছো। আর কোনো ভুল হবেনা। আমার জীবন তোমাতেই উৎসর্গ। ‘
লাবিবা কথায় কথায় ঝগড়া করে। এটাকে ঝগড়া বলে নাকি ত্যাড়ামি বলে তানভীর ধরতে পারেনা। প্রথমে ভেবেছিলো তানভীরকে ক্ষমা করতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তীতে বুঝতে পারলো বিষয়টা সেটা না। প্রেগন্যান্সি জনিত ব্যাপার। মুহুর্তেই মুড সুয়িং হয়। এই ভালো এই ত্যাডামো। একটু আগেই ঝগড়া করেছে। তানভীর বলেছে তার হাত পায়ের নখ কেটে দিতে।কথা শুনিয়েছে এক গাদা। যেই উঠে যাবে তখনি দেখে হাতে টুল আর নেইল কাঁটার নিয়ে আসছে। তানভীরকে সোফায় বসতে বলে টুল টেনে বসে। জবেদা কে বলে লাল গামলায় ঠান্ডা পানি দিতে। পা ভিজিয়ে নখ নরম করে কোলের উপর নিয়ে নখ কাটে। ড্রয়িংরুমে এমন দৃশ্য সকলের কাছেই এখন নরমাল। ফিরোজ খান সামনেই বসে আছে। তার কোলে চার মাসের নাতনী টুকুর টুকুর চোখে তাকিয়ে আছে। পাশের সোফায় তাফিফকে জোর করে খাওয়ানো হচ্ছে। সে খাবে না কিছুতেই। রোজী তাকে বুঝ দিচ্ছে, ‘ তুমি যদি না খাও তাহলে তোমার যে একটা জুনিয়র আসবে সে তোমাকে পঁচা ভাইয়া ডাকবে। ‘
‘ জুনিয়ল কোতা থাতে? ‘
‘ ছোটমার পেটে থাকে। ‘
‘ দেতবো দেতবো। ‘
‘ তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে বড় না হলে তোমাকে তো দেখা দিবে না।বলবে ভাইয়া পঁচা ভাইয়াকে দেখবো না। তাড়াতাড়ি মুখে নাও ধরো ধরো। জুনিয়রকে দেখবে না?’
তাফিফ ভাত মুখে নেয়। কয়েক লুকমা অনেক কিছু বলে খাওয়ালেও শেষ না করেই দৌড় দেয়। এক দৌড়ে ফারাহ এর কাছে আসে। দাদুর আরেক কোলে উঠে ফারাহকে আপু আপু বলে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। ওহহো! ওহহো! করে কেঁদে উঠে ফারাহ। ফিরোজ তাড়াতাড়ি তাফিফকে সরিয়ে দেয়। ‘ বোনকে ব্যাথা দিও না দাদু ভাই। ‘
‘ কাঁদে। ‘
রোজী এসে কোলে নিয়ে চুপ করাতে চায়। মেয়ের কান্না থামে না। ঘর থেকে তামিম বেরিয়ে আসে। ফারাহকে এইভাবে কাঁদতে দেখে বলে, ‘ কি হয়েছে?’
‘ আপনার মেয়েকে চুপ করাতে পারছিনা। ভাইয়ের আদর খেয়ে কিভাবে কাঁদছে। ‘
‘ জানোই তো গালে চুমু সহ্য করতে পারেনা আমার মেয়েটা। দাও আমাকে। ‘
তামিম কোলে নিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষন পর আর কান্নার আওয়াজ না পাওয়া গেলে ফিরোজ বলে, ‘ ঐযে চুপ হয়েছে এবার। ‘
নাকিবের হাতে দশ হাড়ি মিষ্টি। একা মানুষের দুই হাতে সামলানো সম্ভব নয়। সেজন্য ড্রাইভার হেল্প করছে। এসময় নকিব আসবে ব্যাপারটা পুরোপুরি সারপ্রাইজিং। নাকিবকে দেখে লাবিবা হা করে তাকিয়ে থাকলো। এদিকে লাবিবাকে দেখে নাকিব পর পর দুবার মাথায় হাতে বাড়ি দিলো।
‘ একি অবস্থা তোর? এসময়েও তোকে এই ভাবে খাটাচ্ছে? চল চল তোকে আর এখানে রাখা যাবেনা। আমার সাথে চল। ‘
‘ নাকিব। ‘ তানভীরের গম্ভীর স্বর পেয়ে সে মেকি হাসলো। সেন্টারে মিষ্টির হাড়ি রেখে তানভীরের পাশে ভদ্র ছেলে হয়ে বসলো।
‘ হাড়ি কোথা থেকে আনলে? আজকাল হাড়িও পাওয়া যায়?’
‘ অনেক খুঁজে খুঁজে এনেছি স্যার। শেষমেষ বুড়ির দোকানে পেলাম। ‘
লাবিবা জিজ্ঞেস করলো, ‘ এটা তো তোর তো ছুটির সময় নয়। তাহলে ব্যাপার কিরে? এতো মিষ্টি এনেছিস কেনো?’
‘ উর্মিলার ছেলে হলো তাই বিশ হাড়ি মিষ্টি নিয়ে দেখে আসলাম। তোর টা পেটে তাই দশ হাড়ি নিয়ে দেখতে এলাম। বাকি দশটা ভাগিনাকে কোলে নিয়ে দোকান থেকে নিয়ে আসবো। মামা ভাগিনা কাজে কর্মে ফটাফট। ‘
‘ কয়দিনের ছুটিতে আসছোস?’
‘ জানিনা। ‘
‘ মানে কি? চাকরী কি আছে নাকি গেছে?’
‘ ক্যাডার আমি ওকে?’
‘ ভাব কমা তোর। আগে বল হুটহাট কাহিনী কি?’
নাকিব হাসে। তানভীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নাকিব বলে, ‘ লাব্বু। তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে। সেজন্যই এসেছি। ‘
‘ আজ থাকবিতো?’
‘ তুই থাকতে দিলে আরকি। ‘
লাবিবা চড় উঠায়। নাকিব পিছু ঢুললে হেসে ফেলে। তানভীর তাড়া দেয়, ‘ নাকিবের ফ্রেশ হবার ব্যবস্থা করো। নাস্তা করাও। ‘
লাবিবা টুল ছেড়ে উঠতে যায়। ওমনি পিঠে চাপ পড়ে। তানভীর চট করে পেছনে এসে ধরে দাঁড়ায়। তানভীরের উপর ভর করে লাবিবা উঠে।
রাতে নাকিব লাবিবাকে নিয়ে গোপন আলোচনায় বসে।
লাবিবা চিন্তিত মুখে বলে, ‘ কি হয়েছে তোর বলতো সব খুলে। ‘
‘ শুনলাম ফাহাকে নাকি তোর খালা শ্বাশুড়ি এখনি বিয়ে দিয়ে দিবে। পাত্র খুজছে। ‘
‘ হুম। ছেলেও মোটামুটি ঠিক করা হয়ে গেছে। পেশায় ডাক্তার। মেয়েটাকে তাড়াতাড়ি ই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। একটা ছেলের প্রতি ফিলিংস জন্মেছিলো। মনির হাতে বিষয়টা ধরা পড়েছে। খালামনি তাই বিয়ে ঠিক করছে। লেখাপড়া বিয়ের পরেই করবে। কিন্তু আগে মান সন্মানের সাথে বিয়ে দিতে পারলেই হলো। ‘
‘ জিজ্ঞেস করিস নি ছেলেটাকে তোর ননদ ভালোবাসে কিনা? গভীর সম্পর্ক আছে কিনা? জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিস কেনো?’
‘ আমার এই অবস্থায় ঐ বাসায় যাওয়া হচ্ছেনা। তার উপর অনেক চাপে ছিলাম। জবের জন্য এক্সাম দিলাম।
ফাহার যদি গভীর কোনো রিলেশনশিপ থাকতো তাহলে আমাকে বলতো। সে না বললে আমি জানবো কিভাবে?তুই কেনো এসব বলছিস?’
‘ কারন তোর ননদ আমাকে এর কারণেই চাকরী থেকে ছুটি নিয়ে রাতারাতি টেনে এনেছে। ‘
‘ কি বলিস?’
লাবিবা হিসাব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। রেজাল্ট বের করেই চিৎকার করে উঠে। ‘ ও মাই গড! ও মাই গড! নকিব তুই?’
নাকিব অসহায় দৃষ্টি ফেলে। লাবিবার সামনে আর বসে থাকতে পারেনা। পকেট থেকে ফোনটা বের করে লাবিবার হাতে দিয়ে বেরিয়ে যায় । ফোনে স্টিল একটার পর একটা টেক্সট আসছে। লাবিবা অপেন করেই চোখ উপরে। এতো ফাহা! গত তিন চারদিনের ম্যাসেজ দেখেই লাবিবা যা বোঝার বোঝে যায়। রাতে নাকিব আর ঘরেও এলো না। লাবিবা খোঁজ নিয়ে জানে আউট হাউজে আছে। থাকুক। সকালে তার সাথে বসতে হবে। ছেলেটা খুব চাপে আছে বোঝা যায়।
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(১০১)
তানভীরের হাতে নাকিবের ফোন। ম্যাসেজিং গুলো দেখে আর টিকতে পারলো না। লাবিবার উপর চিৎকার করে উঠলো, ‘ তোমার ননদ কতো বড় মাপের মাফিয়া হয়েছে? এতো বড় একটা কাজ করার আগে একবারো ফ্যামিলি নিয়ে ভাবলো না? আমি তার সাহসের পরিমাপ না নিয়েই ছেড়ে দিবো? সপ্নেও ভেবো না। ‘
‘ শুনুন আগে আমার কথাটা। ‘
‘ কোনো কথা না। একহাতে তালি বাজে না। আগে তোমার ননদকে দেখছি তারপর তোমার বন্ধুর পিঠের ছাল তোলার ব্যবস্থা করবো। ‘
তানভীর ফোন ওয়ালেট গাড়ির চাবি নিয়ে বাসার পোশাকেই বেরিয়ে পড়লো। লাবিবা আটকাতে গিয়েও পারলোনা। দৌড় সে একদমি এখন দিতে পারেনা। একটুতেই পেটে ব্যাথা অনুভব হয়।
এই ভয়টাই লাবিবা পাচ্ছিলো। সেজন্য তানভীরের আগে জানিয়েছে তামিমকে। তামিম ঠান্ডা মাথার মানুষ। তার সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করলে হয়তো একটা ব্যবস্থা করা যেতো। কিন্তু ইচ্ছাবোধক কাদাতে পা বোধহয় সে না জেনেই ফেললো। ফাহার বিয়ে ঠিকঠাক। সামনের সপ্তাহে আপু, দুলাভাই, ভাইয়েরা আসছে আমেরিকা থেকে। একত্রে বসে বিয়ের ডেট ফিক্স করবে। লাবিবার জানা ছিলোনা যে ডাক্তারের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে সেই ডাক্তার তামিমেরই ক্লোজ ফ্রেন্ডের ছোট ভাই। আলাপটা তামিমের মাধ্যমেই। তামিম এবং তানভীর বিয়েটা ঠিকঠাক করার সময় দুজনেই ফাহার থেকে জেনে নিয়েছে ফাহা রাজি কিনা। বড় দুই ভাইকেই ফাহা ভীষন ভয় করে।তানভীরকেই বেশি। তার মধ্যে নাকিব মোটেও এমন কোনো কথা বলেনি যে তার সাথে একটা সম্পর্কে যাবে। অথবা তাকে বিয়ে করবে। নিজের ফিলিংস বার বার নাকিবের কাছে প্রকাশ করেও কোনো কাজ হচ্ছেনা। অথচ নিতু ইসলাম ফাহাকে নিয়ে গভীর সন্দেহ বাধিয়েছেন মনে। এমতাবস্থায় ফাহা আর নাকচ করেনি। নিজের ফিলিংস ধরে রাখার চেষ্টা করেছে গোপনে। এই সমন্ধের আলাপ চলেছে মাস দুয়েক আগে থেকে । ফাহা নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি। প্রতিনিয়ত নাকিবকে ফোন টেক্সট করে গেছে। শেষ মেষ হাত কেটে রক্ত বের করে ব্ল্যাকমেইল করেছে। নাকিব এটা দেখেই ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছে। ফাহা কিছু ঘটিয়ে ফেললে নাকিবেরই বেশি প্রব্লেম হবে। সরকারি চাকরি তার। তার উপর আত্মীয়ের মধ্যে মেয়েটার সাথে এতোদিন যাবৎ কথা বলে মায়াও পড়ে গিয়েছে। তামিম জানতে পেরে ঠান্ডাই ছিলো। লাবিবা ভেবেছিলো এবার তামিমের সাথে বিষয়টা সমাধান করার চেষ্টা করবে। কিন্তু তামিমের এই ঠান্ডা রাগ বুঝতে লাবিবার সময় লেগে গিয়েছে। নিতু ইসলামকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে তামিম। তার মুখ থাকবেনা ফাহা যদি এখনো লাগাম না টানে। হুশিয়ারি করে দিয়েছে ফাহাকে। তানভীরকে সেই জানিয়েছে। লাবিবার থেকে ফোন তানভীর নিজেই নিয়েছে।
লাবিবা কি করবে বোঝে উঠতে পারছেনা। বাধ্য হয়ে সোহানাকে সবটা খুলে বলেছে। সোহানার মেয়ের বড্ড শখ ছিলো। আল্লাহ তাকে মেয়ে দেননি। ভাগ্নী অন্তপ্রাণ। লাবিবা এবং রোজী সহ দুটো বাচ্চাকে নিয়ে তিনি বোনের বাড়ি পৌঁছালেন। ড্রয়িংরুমে পৌঁছতেই বুঝতে পারলেন ছোট খাটো একটা ঝড় বয়ে গেছে। ফাহা ফ্লোরে বসে চিৎকার করে কাঁদছে। সোহানার মনটা হো হো করে কেঁদে উঠে। দৌড়ে গিয়ে ফাহাকে বুকে জড়ায়। নিতু ইসলাম এবং তামিমকে ইচ্ছে মতো বকাঝকা করতে থাকে। তানভীর কর্ণারের সোফায় বসে। রাগন্বিত দৃষ্টি লাবিবাকে দেখেই মেজাজটা আরো খারাপ হয়। নিজেকে আয়ত্তে এনে লাবিবার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।শুভ্র রঙের শাড়ি পড়নে তাফিফের আঙুল ধরে দাঁড়িয়েছে। তানভীর পেছন থেকে পেটে হাত রাখে। লাবিবা চমকে তাকায়। লাবিবাকে বলে,’ বাচ্চাদের নিয়ে উপরের ঘরে যাও। নামবে না নিচে। ‘
লাবিবা কাকুতি মিনতি করে, ‘ কিছু বলবেন না ওকে প্লিজ। আমি বুঝিয়ে বলবো ওকে। ‘
‘ তোমাকে মাতাব্বরি করতে হবেনা। সেজন্য আছি আমরা। ‘
লাবিবা এক পলক তাকালো ফাহার হাতের দিকে। সত্যিই হাত কেটেছে মেয়েটা। ব্যান্ডেজ অব্দি করেনি। মেয়েটার মনে কতোনা যন্ত্রনা! কেউ খেয়ালটাও করলো না?
উপর থেকে ফাহার কান্না শুনে শুধু ছটফট করেছে লাবিবা। ফাহার গায়ে কেউ হাত তুলেনি। হাত তুলেছে নিতু ইসলাম।
‘ তুই যদি রিলেশনে থাকতি আমি মোটেই বাধা দিতাম না। ছেলেটা তোকে বিয়ে করতে রাজি হতো তাতেও আমার কোনো সমস্যা হতো না। একতরফা পাগলামি করেছিস ছেচড়ামি করেছিস তাতেও আমি কিছু বলতাম না। কিন্তু আমার মেয়ে হয়ে তুই আমার সম্মানটা কেনো দেখলিনা? আমি তোকে ফ্রিডম দিয়েছি যথেষ্ট ম্যাচিউর তুই আমার সম্মান নিয়ে খেলে কি পেলি বল? তুই কি চাষ আমি মরে যাই? তোর মতো কু সন্তানের জন্য আমি কেনো মরবো? মর তুই মর। ‘
সোহানা প্রাণপনে নিতুকে আটকায়। ঘটনাস্থলে তামিম তানভীর কাঠিন্য মুখে তাকিয়ে। খইরুল ইসলামকে খবর দেওয়া হয়েছে। সেই একমাত্র পারে নিতুকে আটকাতে। ফাহা মার খেয়ে ঘর ফাটিয়ে কান্না করছে। রোজী এসব সহ্য করতে পারছেনা। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সেও চলে আসে উপরের রুমে। যেখানে তার ছেলে মেয়ে আর জা আছে।
ফাহার গায়ে এক টুকরো সাদা কাপড়। গায়ের দাগ গুলোতে যত্ন নিয়ে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে লাবিবা। জ্বলে জ্বলে উঠছে বারবার। আর কেউ না পেয়ে শেষ মেষ লাবিবাকে পাঠিয়েছে ফাহাকে বোঝাতে পরিবারের পছন্দ করা ছেলেকেই যেনো বিয়ে করতে রাজি হয়। নিতু ইসলাম কাল দিনের মধ্যেই মেয়ের বিয়ে দিতে চান। ফাহার কোনো ফিউচার নেই। না তার পছন্দের ছেলেটা তাকে বিয়ে করবে না যার সাথে বিয়ে ঠিক করা হয়েছে তাকে না করে নিলে মান সম্মান টিকবে। একজন সচেতন মা হিসেবে নিতু ইসলাম মোটেই তার মেয়েকে জলে ফেলতে পারবেন না। খইরুল ইসলাম বললেন, ‘ এসব প্রেম ঘটিত ব্যাপার আমাদের ফ্যামিলিতে কি প্রভাব পড়ে তা তোমার অজানা না। ছেলে মেয়ে গুলোকে নিয়ে অনেক ভোগান্তি হয়েছে। আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছেন এখন তারা সুখে আছে আলহামদুলিল্লাহ। আবার এরকম কিছু হোক আমি সেটা চাইনা। তুমি এবার কি করবে নিতু?’
নিতু সোফায় গা ছেড়ে দিলো। যেনো মুর্ছা যাচ্ছেন তিনি। ‘ আমি জানিনা ভাইজান। কিচ্ছু জানিনা। ‘
মামা মামী ভাই ভাবী ভিডিও কলে বোন ভাই দুলাভাই কেউ ফাহাকে বোঝাতে সক্ষম হলোনা। তামিম তানভীর ভীষন চিন্তায়। একে নিয়ে কি করবে এখন বোঝে উঠতে পারছেনা। তামিম বার বার ফেস লসের ভয় পাচ্ছে। বাড়ির কারো চোখে ঘুম নেই। ফারাহ একটু পর পর কেঁদে উঠছে। নতুন জায়গা নিতে পারছেনা। রোজী তাকে সামলাচ্ছে। তাফিফ ঘুমিয়ে আছে লাবিবার পায়ের উপর। পায়ের উপর বালিশ রেখে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়েছে। ফিরোজ খান এলেন গভীর রাতে। রাত তিনটায়। সবটা শুনে বুঝে তিনি দরজা থেকে ফাহাকে দেখে লাবিবাকে ডেকে পাঠালেন। লাবিবা মলম লাগাতে লাগাতে কথা বলছে।
‘ তুমি আসলে কি চাও ফাহা? তুমি ম্যাচিউর মেয়ে। যা চাইবে তা নিশ্চয় বুঝে শুনেই চাইবে। আমরা তোমার উত্তরের অপেক্ষায় বসে আছি। তোমার হাতে সময় নেই শুধু এই টুকুই মনে রাখবে। ‘
ফাহা চুপ থাকে। দীর্ঘসময় নিয়ে বলে, ‘ তোমার বন্ধুকে বলো আমাকে যেনো একটু ভালোবাসে। আর কিচ্ছু চাইনা এই মুহূর্তে। ‘
‘ নাকিব আর তুমি মোটেও ম্যাচ করোনা। তুমি দৃষ্টপৃষ্ট লম্বা চওড়া একটা মেয়ে। কতো সুন্দর! ফর্সা টকটকা। আর নাকিব তোমার থেকে লম্বাতেও বেশি এগুবেনা হ্যাংলা পাতলা একটা ছেলে। তুমি যা বলছো এতে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবোনা। তুমি আরেকটু ভাবো ফাহা। ‘
লাবিবার বুকে পড়ে হু হু করে কেঁদে উঠে।
‘ ভাবী আমার বুকে ভীষন যন্ত্রনা। কবে কখন কিভাবে ঐ হ্যাংলাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি জানিনা। আমার ঐ হ্যাংলাকেই চাই ভাবী। আমার কোনো দাবী নেই তার প্রতি। শুধু বলো আমার পাশে থাকলেই চলবে। তাকে দেখে আমি আমার হৃদয় শান্ত করবো। আর কিছুই চাইনা। ‘
‘ তুমি হয়তো একটা বিষয় জানোনা। নাকিবের একটা সম্পর্ক ছিলো। খালাতো বোনের সাথে। অনেক বছরের সম্পর্ক। অনেক গভীরেও চলে গিয়েছিলো তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা স্ট্রে করলোনা। নাকিব ভেঙে পড়লোনা। নিজের পরিচয় গড়লো। কিন্তু সেই মেয়েকে ভুলতে পারলোনা। ভুলতে পারবেওনা। সে চায় ও না কাউকে আবার ভালোবাসতে। তুমাকে সেজন্য ই রিজেক্ট করেছে। ‘
‘ আমার নিজের প্রতি কনফিডেন্স আছে ভাবী। আমি নিজেই নিজেকে ভরসা করি। সে কাকে ভালোবাসলো, মনে রাখলো সেসবে আমার কিছুই যায় আসেনা। ভালোবাসাটাও আমি সেক্রিফাইস করলাম। তাকে শুধু আমার সাথে থাকতে বলো। সে যদি না চায় আমি তাকে কখনোই ডিস্টার্ব করবোনা। ‘
‘ তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ফাহা। তোমার মম, ভাইয়া, মামা এখন এসব মানবেনা। ‘
‘ তাহলে আমাকে জবাই করে দিতে বলো। এমনিতেই একতরফা ভালোবাসায় আমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি। তার থেকে একবারে মরা ভালো। ‘
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তামিম, তানভীর, ফিরোজ সবটাই শুনলেন। লাবিবাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ নাকিব ছেলেটা কেনো আমাদের মেয়েকে বিয়ে করতে চায়না? আগের প্রেমে দেবদাস হয়েই থাকতে চায় নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে ঘটনায়?’
লাবিবা বলে, ‘ নাকিব আমার খুব ভালো বন্ধু পাপা। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হলেও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাছাড়া আমাদের বিশ্বস্থ। বেইমানি করতে চায়না। আর তার মনের খবর না জানালে আমি তো কিছু বলতে পারবোনা। ‘
‘ ছেলেটার সাথে কথা বলো। তুমি না বলতে চাইলে তানভীর বলুক। আর তামিম তোমার আর তোমার বন্ধু বা তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার প্রয়োজন নেই। ঝামেলা মিটে যাক তারপর নাহয় যোগাযোগ করে সম্পর্ক ঠিক করে নেবার চেষ্টা করবে । আপাতত তাঁদের সুন্দর ভাবে না জানানোর ব্যাপারটা তানভীরই সামলাক। সবার আগে আমি মেয়ের সুখের কথা ভাববো। এই বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
খইরুল ইসলাম মত দিলেন। নিতু ইসলাম সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছেন। শরীর খারাপ করেছে তার ।
ফিরোজ খান বিশ্রাম নিবেন। উঠে যাওয়ার আগে আবার তানভীরকে বলে গেলেন।
‘ কেসটা সুন্দর ভাবে সামলানোর দায়িত্ব তোমার। নাকিব যদি বিয়ে করতে রাজি হয় তাহলে বিয়ের ব্যবস্থা করো। যদি রাজি না হয় কি করে রাজি করাবে তুমি সেটা আমি জানিনা। সবার আগে ফাহার ভালো থাকা। তার উপর কোনো ঝামেলার ই আমি স্থান দিবোনা। ‘
নাকিবকে ফোন করা মাত্রই জানালো সে রংপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। ফাহাকে বিয়ে করবেনা।
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা