ভালোবাসার চেয়েও বেশি পর্ব-১৪+১৫

0
2670

#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি 💞💞
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-১৪
( ডাইরি স্পেশাল)

★রাত ১০ টা বাজে, আদিত্য সেই কখন থেকে নূরের ডাইরিটা হাতে নিয়ে বসে আছে বেডের ওপর। পড়বে কি পড়বেনা বুঝতে পারছে না।আদিত্য ভালো করেই জানে, এভাবে কারোর পার্সোনাল ডাইরি পড়াটা ঠিক না। নূর জানতে পাড়লে যদি রাগ করে? কিন্তু নূরের ব্যাপারে জানতে হলে ওকে এটা পড়তেই হবে। আদিত্য আর না ভেবে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে যা হয় দেখা যাবে।

আদিত্য ডাইরিটা খুলতেই দেখতে পেল। সুন্দর করে লেখা “নূরের আত্মকথা”। আদিত্য লেখাটার ওপর আলতো করে হাত বোলালো। তারপর পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আসল লেখার পৃষ্ঠায় গেল।

আদিত্য প্রথম পৃষ্ঠা খুলতেই সর্বোপ্রথম যে শব্দটা দেখতে পেল তা হলো ” অপয়া”। আদিত্য একটা ধাক্কা খেল।ভ্রু কুঁচকে তাকায়ে পড়া শুরু করলো।

#প্রথম পৃষ্ঠা
অপয়া।
হ্যা আমিই অপয়া। সবাই হয়তো ভাববে এটা আবার কেমন নাম?নাম আমার অবশ্য একটা আছে। যেটা আমার দাদি রেখেছিলো আমার জন্য। মেহরুমা নূর।তবে সেটা শুধু নামমাত্রই রাখা। সেই ছোট্ট বেলা থেকে এই অপয়া কথাটা এতোবার শুনেছি যে নিজের নামটাও এতোবার শুনিনি।

ছোট বেলায় যখন সবাই আমাকে অপয়া বলতো।তখন আমি বুঝতে পারতাম না।ভাবতাম এটা হয়তো আমার কোনো নাম। যেমন সবার বাবা মা তাদের ছেলেমেয়েদের আদর করে সোনা যাদু বলে ডাকে।হয়তো আমাকেও সবাই আদর করে ওই নামে ডাকে।
কিন্তু ধীরে ধীরে যখন একটু বড়ো হতে লাগলাম তখন বুঝলাম এটা কোনো আদরের ডাক না। কারণ সবার বাবা মা যখন তাদের ছেলেমেয়েদের সোনা যাদু বলে ডাকতো। তখন তারা তাদের ছেলেমেয়েদের অনেক আদর সোহাগও করতো। কিন্তু আমার সাথে এমন কিছুই হতোনা। উল্টো আমাকে সবসময় বকাঝকা আর মার দিতো
যখন বড়ো হলাম তখন বুঝলাম। ওটা কোনো নাম না বরং আমার জীবনের চরম সত্য।আর আমার জীবনের অভিশাপ। যেটা নিয়ে হয়তো আমাকে সারাজীবন বাঁচতে হবে।

#অন্য পৃষ্ঠা
সবাই বলে আমার জন্য নাকি আমার মা মারা গেছে। আমি আমার মাকে খেয়েছি। আমার দাদিকে খেয়েছি। এমনকি আমার বাবাও তাই মানে।
সবার কথা শুনতে শুনতে এখন আমার নিজেরো মনে হয়। আমি আসলেই একটা অপয়া।আমার জন্য সবাই চলে যায়। মা দাদি আমাকে রেখে চলে গেছে। আর বাবা থেকেও নেই। সেও আমাকে দেখতে পারে না।
ছোট মার অত্যাচারেও এতটা কষ্ট লাগেনা। যতটা কষ্ট বাবার অবহেলায় লাগে।

মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয়। বাবা যদি একটু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো।তাহলে হয়তো আমার সব কষ্ট দূর হয়েও যেতো।

#অন্য পৃষ্ঠা
আমার বান্ধবী তানি বলে। তুই কেন ওই বাড়িতে পরে থাকিস? আর ওদের এতো অত্যাচার সহ্য করিস?।ছেড়ে দে ওই বাড়ি। নিজে ইনডিপেনডেন্ট হয়ে নিজের মতো চল।
কিন্তু ওকে কিভাবে বোঝাই। বলাটা যতো সহজ বাস্তবতাটা ততই কঠিন।ইনডিপেনডেন্ট বললেই ইনডিপেনডেন্ট হওয়া যায় না। বিশেষ করে একটা মেয়ের জন্য। আমাদের সমাজে ছেলেরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। কিন্তু মেয়েরা তা পারে না। এমন না যে মেয়েরা পরিশ্রম করতে পারে না।তারাও ছেলেদের সমান পরিশ্রম করতে পারে।
কিন্তু একটা মেয়ে যখন ঘরের বাইরে পা রাখে। তখন চারিদিকে হায়েনার দল তাকে গ্রাস করে তার সর্বনাশ করার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে।

তাই একটা মেয়ে ইনডিপেনডেন্ট হতে গেলেও, তার কারোর না কারোর সাপোর্ট দরকার হয়।সে যেই হোক না কেন।

আমি জানি তানি আমাকে ওর বাড়িতে থাকতে কখনো মানা করবে না। কিন্তু সেটাওতো একটা আশ্রিতার মতোই হবে। আর তাছাড়া কতোদিনই বা তানির বাবা মা অন্য একটা মেয়েকে তাদের বাড়িতে রাখবেন। একসময় না একসময় তারাও বিরক্ত হয়ে যাবেন।
তাই যেমনই হোক নিজের বাড়িই থাকা ভালো।
আর সবচেয়ে বড়ো কথা। তারা আমাকে আপন না ভাবলেও। আমিতো তাদের আপন ভাবি।যতো যাইহোক দিনশেষে ওটাইতো আমার পরিবার ।

#অন্য পৃষ্ঠা
জানো মা? মাঝে মধ্যে তোমার কথা ভীষণ মনে পরে। ইচ্ছে করে তোমার কাছে চলে যাই।তুমি খুব পচা মা।আমাকে একা রেখে কেন চলে গেলে?আমার এখানে ভালো লাগে না মা।এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমার যে কেউ নেই।কেউ আমাকে ভালোবাসে না।কেউ আমাকে দেখতে পারে না। জানো মা আমার না অন্ধকারে অনেক ভয় লাগে। রাতের বেলা যখন ঝড়ের বাজ পরে,তখনও ভয়ে কুকরে যাই।তবুও কেউ আসেনা আমার কাছে ভয় কমাতে।নাখেয়ে থাকলেও কেউ খেতে বলে না।আমি থাকতে চাই না এখানে। আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও মা।

এটুকু পড়েই আদিত্য ঠাসস্ করে ডাইরি বন্ধ করে ফেললো। আর পড়তে পারে না ও।বুকের ভেতর কেমন চিনচিন ব্যাথা করছে। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে।এমন একটা নিস্পাপ মাছুম মেয়েটাকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। ভাবতেই আদিত্যর দম বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ দুটো ভীষণ জ্বালাপোড়া করছে।হয়তো অশ্রু ঝরাতে চাইছে।কিন্তু ওতো পুরুষ মানুষ। আর পুরুষদের যে কাঁদতে নেই।
আদিত্য আর বসে থাকতে পারে না। উঠে বেলকনিতে যায়।এখন ওর একটু ফ্রেশ হাওয়ার দরকার। নাহলে ওর দম বন্ধ হয়ে যাবে।
আদিত্য বেলকনির গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দু’হাতে গ্রিল ধরে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। বাইরের দমকা বাতাসে নিজেকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করছে ।

কিছুক্ষণ পর আদিত্য নিজেকে একটু শান্ত করে ওয়াসরুমে যেয়ে চোখে মুখে পানি ছিটালো।তারপর ফ্রেস হয়ে বেড়িয়ে এলো।
মাথাটা কেমন ব্যাথা করছে। তাই আদিত্য কিচেনে গিয়ে একটা ব্লাক কফি বানাল।তারপর কফি নিয়ে আবার বেডরুমে এসে বেডের ওপর বসলো। কফিটা খেতে খেতে আবারও ডাইরি পড়তে শুরু করলো।

#অন্য পৃষ্ঠা
ছোট বেলায় দাদি আমাকে রুপকথার কাহিনী শোনাতো। যেখানে আমার মতো একটি দুঃখি মেয়ে থাকতো।তারপর একটা সুন্দর রাজকুমার এসে তাকে রানী বানিয়ে নিয়ে যেতো তার রাজ্যে।
আমিও মনযোগ দিয়ে শুনতাম।
দাদি বলতেন আমার জন্যেও নাকি কোনো এক রাজকুমার আছে। যে আমাকে নিয়ে যাবে তার রাজ্যে।
আমিও শুনে খুশী হয়ে যেতাম। দাদির কোলে মাথা দিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। একটা সুন্দর রাজকুমার সাদা ঘোড়ায় চড়ে এসে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে তার রাজ্যে। আমাকে তার রানী বানিয়ে।

কিন্তু বড়ো হতে হতে আমার এই ভ্রমও চলে গেলো। আমি বুঝে গেলাম এগুলো সব শুধু কল্পকাহিনিতেই হয়। বাস্তবে কোনো রাজকুমার থাকে না। নিজের ভালো মন্দ নিজেকেই দেখতে হয়।

তানিও বলে আমার জীবনে নাকি কেউ আসবে। যে আমার সব কষ্ট দূর করে দিবে। আমি ওর কথায় হেসে দেই।মেয়েটা সত্যিই একটু ফিল্মি।কারণ আমি জানি এসব কিছুই হবার নয়।শুধু শুধু এসব স্বপ্ন দেখে নিজেকে মিথ্যে আশা দিতে চাই না।

কিন্তু ওইযে লোকে বলে না? মন, মন যে বড়ো বেহায়া জিনিস। যতোই বুঝাও না কেন। সে তার মতোই চলে। আর তাইতো,এতকিছুর পরেও এখনো মনের কোনে কোথাও না কোথাও ক্ষীণ একটা আশা বেধে রাখে।যে হয়তো কেউ না কেউ সত্যিই আসবে একদিন। যে আমার জীবনটাকে নতুন রঙে রাঙিয়ে তুলবে। তার কাছে হয়তো রাজাদের মতো বড়ো বড়ো প্রাসাদ না থাকুক।তার মনের ঘরে যেন আমার জন্য অসীম যায়গা থাকে।তার কাছে বড়ো বড়ো গাড়ি না থাকুক। শুধু পূর্ণিমা রাতে নৌকার ওপর বসে তার কাঁধে মাথা রেখে যেন চাঁদ দেখতে পারি।

দিনশেষে আবারও মনকে ঝাড়ি দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে,এসব কিছুই হবার নয়।শুধু শুধু স্বপ্ন দেখে লাভ নেই।

#অন্য পৃষ্ঠা
(এখানে নূরের সাথে আদিত্যর দেখা হওয়া থেকে শুরু করে সবই লেখা আছে। এসব দেখে আদিত্যের মুচকি হাসলো।)

#অন্য পৃষ্ঠা
ওই পঁচা লোকটা আবার এসেছে। কেন আসে ওই জঘন্য লোকটা বারবার। ওকে দেখলেই আমার ঘেন্না লাগে।আজ আবার এসেছে। শেষমেশ কি আমার শেষ সম্বলটুকুও রক্ষা করতে পারবো না? (তারপর জনি নূরের সাথে কি কি করেছে সবই লিখেছে এখানে) ।

এসব পড়ে আদিত্যের মাথায় আগুন ধরে গেল। রাগে সারা শরীর ফেটে যাচ্ছে। কপালের রগ ফুলে উঠেছে। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। চোখ দুটো লালঅগ্নি হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত রাগের কারণে হাতে থাকা কফির কাপটা শক্ত করে চেপে ধরে। যার জন্য কাপটা ভেঙে যায়। কাপের কিছু টুকরো গুলো হাতের ভেতর ঢুকে হাত দিয়ে রক্ত বের হয়।
কিন্তু সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই আদিত্যের। ওর তো এখন রাগে সবকিছু ভেসে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।

আদিত্য বেড থেকে উঠে সারা ঘরে পায়চারী করতে থাকে। দুই হাতের আঙুল দিয়ে চুল টেনে ধরে আছে। কিছুতেই নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। বারবার নূরের সাথে হওয়া ঘটনার কথা মনে করতেই সারা রাগে কেপে উঠছে।

আদিত্য সহ্য করতে না পেরে খাটের পাশে ছোট টেবিলের উপর থেকে ফুলদানিটা হাতে নিয়ে ফ্লোরে টাসস্ আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেললো। তারপর চিৎকার করে বলতে লাগলো।
….হাউ ডেয়ার ইউ। ইউ ব্লাডি বিচ।হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ হার।ইউ ব্লাডি বাস্টার্ড। আই উইল কিল ইউ। আই উইল কিল দ্যাট ব্লাডি বিচ।

একটুপর আদিত্য ফোনটা বের করে তাসিরকে ফোন দেয়। তাসির ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই।আদিত্য বলে ওঠে।
…আই ওয়ান্ট টু কিল হিম তাসির।আই ওয়ান্ট টু কিল দ্যাট বাস্টার্ড।

হঠাৎ আদিত্যের এমন কথা শুনে তাসির হকচকিয়ে ওঠে। আদিত্য যে চরম পর্যায়ে রেগে আছে তা বুঝতে পারছে তাসির।তাসির আদিত্যকে শান্ত করার জন্য বললো।
….ওকে ওকে রিলাক্স। শান্ত হ আগে। টেক এ ডিপ ব্রেথ।তারপর বল কি হয়েছে? আর কাকে মারার কথা বলছিস?

আদিত্য একটু শান্ত হয়ে। তাসিরকে সবটা খুলে বলে। সবটা শুনে তাসির হতভম্ব হয়ে যায়।এতটুকু মেয়ের জীবনে এতো কষ্ট। ভাবতেই তাসিরের খুব খরাপ লাগে। শেষের কথা শুনে ওরও খুব রাগ লাগে। তারপর আদিত্যকে বলে।
…আচ্ছা ঠিক আছে বুঝতে পেরেছি । যা করার কাল করিস।আমরা আছি তোর সাথে। এখন একটু শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পর।কাল আমারা এটা নিয়ে কথা বলবো। ওঁকে বায়।

তাসিরের সাথে কথা বলার পর আদিত্য কাওকে ফোন করে বলে।
….শোন, একজনকে খুঁজে বের করতে হবে। খুঁজে বের করে আমাদের গোডাউনে নিয়ে আসবে।আর হ্যা খবরদার ওকে কেউ হাত লাগাবে না।যা করার আমি করবো। মনে থাকে যেন।

—————————————-

নূর বই খুলে একটু পড়তে বসেছে। ওষুধ খাওয়ায় জ্বরটা এখন আর নেই। গত দুদিন হলো কোনো পড়াশোনা হয় না। তাই আজ একটু পড়তে বসেছে। কিছুক্ষন পড়ালেখা করার পর,নূর রোজকার মতো ডাইরি লেখার জন্য ব্যাগে হাতে দেয় ডাইরি বের করার জন্য।
ব্যাগের ভেতর ডাইরি না পেয়ে নূরের কপাল কুঁচকে আসে। ব্যাগের ভেতর থেকে সব বের করে ভালো করে খুজতে থাকে।নূর চিন্তার পরে যায়। মনে মনে ভাবে ব্যাগেই তো রেখেছিলাম কোথায় গেল? সারা ঘড়ে পাগলের মতো ডাইরিটা খুজতে থাকে নূর। কোথাও না পেয়ে নূর নিচে বসে কান্না শুরু করে দেয়। দাদির দেওয়া শেষ স্মৃতিটাও ধরে রাখতে পাড়লাম না। লোকে ঠিকই বলে তুই আসলেই একটা অপয়া। কোনো কিছুই ধরে রাখতে পারিস না।সবকিছু হারিয়ে ফেলিস।নূর কান্না করতে করতে নিজেকেই বকতে থাকে।
————————————

গত এক ঘন্টা যাবত নিজের জিমিং রুমে বক্সিং ব্যাগের সাথে বক্সিং করে যাচ্ছে আদিত্য।এই মূহুর্তে নিজেকে শান্ত করার এটাই একমাত্র পদ্ধতি ওর কাছে। যতো রাগ এই বক্সিং ব্যাগের ওপর ঝাড়ছে। মনে হচ্ছে বক্সিং ব্যাগকে নয় ওই জনিকে মারছে।

কিছুক্ষণ পর একটু ক্লান্ত হয়ে বক্সিং করা থেমে যায়। বক্সিং ব্যাগকে দুই হাতে ধরে তার সাথে মাথা ঠেকিয়ে হাঁপাতে থাকে।

নিজেকে একটু শান্ত করে মাথা তুলে দাঁড়ায়। তারপর হাতের গ্লোবস গুলো খুলে রেখে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।
নিজের রুমে এসে সোজা ওয়াসরুমে ঠুকে যায়।শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে টিশার্ট টা খুলে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে পরে। দুহাত দেয়ালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। শাওয়ারের পানি সব মাথা আর পিঠ দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে।
আদিত্য চোখ বন্ধ করে শুধু নূরের কথা ভাবছে। ওই নিস্পাপ মায়াবী মুখটার পেছনে কতো কষ্ট লুকিয়ে আছে। কতো কিছু সহ্য করতে হয়েছে ওকে।এই জন্যই মেয়েটা এতো মনমরা হয়ে থাকে

আদিত্য মনে মনে প্রমিজ করছে। যে করেই হোক নূরকে আর কোনো কষ্ট ভোগ করতে দিবে না।তার জন্য যা করতে হয় সে করবে। ওই নিস্পাপ মেয়েটাকে আর কোনো কষ্ট পেতে দিবে না।

———————————

ক্যাম্পাসে মন মরা হয়ে বসে আছে নূর। ডাইরিটার জন্য ওর অনেক খারাপ লাগছে। দাদি ওকে সখ করে কিনে দিয়েছিল।আর বলেছিল, নিজের মনের সবকথা এই ডাইরিতে লিখবি।
আমিও দাদির কথা মতো বড়ো হওয়ার পর থেকে আমার মনের সবকথা ওই ডাইরিতেই লিখতাম। ধীরে ধীরে ডাইরিটা আমার অনেক প্রিয় বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। আর শেষ পর্যন্ত কিনা ওটাও আমাকে ছেড়ে চলে গেল।

নূরের ভাবনার মাঝেই তানি এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো।
…জানুউউউ,,, তোকে খুব মিস করেছি এই দুই দিন। কেমন আছিস তুই?

তারপর নূরকে ছেড়ে সামনাসামনি হয়ে বসলো তানি।নূরের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো।
…কিরে কি হয়েছে তোর? মুখটা এমন পেচার মতো বানিয়ে রেখেছিস কেন?

নূর তানির দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো সুরে বললো।
….জানিস? আমার ডাইরিটা না হারিয়ে গিয়েছে। কাল ব্যাগে করে ভার্সিটিতে নিয়ে এসেছিলাম।বাসায় যেয়ে দেখি নেই। কতো খুঁজলাম কোথাও পেলাম না।

তানি বললো।
…নেই মানে কোথায় যাবে? ব্যাগ থেকে কি আর একা একাই হাওয়া হয়ে যাবে?

নূর মুখ ছোট করে বললো।
…জানিনা।

…আরে চিন্তা করিস না। আমার মনে হয় কোথাও পড়ে গেছে। পেয়ে যাবি নিশ্চয়। আচ্ছা তুই মনে করতো কাল কোথায় কোথায় গিয়েছিলি?হয়তো সেইসব জায়গায় কোথাও পড়েছে। আমরা খুজলেই পেয়ে যাব।

তানির কথায় নূরের হুঁশ আসে। ওর কথামতো নূর মনে করতে থাকে কাল কোথায় কোথায় গিয়েছিল।নূর একটা একটা সব মনে করে আর সেখানে সেখানে ওরা দুজন খুজতে শুরু করে।

প্রথমে ক্লাসে , তারপর কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে খোঁজে। কিন্তু কোথাও পায় না।তানি নূরকে জিজ্ঞেস করে।
…আর কোথাও যাস নি?

তখন নূরের মনে পরে। কালতো ওকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল ওখানে পরে নিতো? তানি বলে।
…কিরে কি ভাবছিস? গিয়েছিলি আর কোথাও?

নূর মাথা ঝাকিয়ে বললো
.. হ্যা।

তানি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
…কোথায়?

…হসপিটালে।

তানি চমকে যেয়ে বলে উঠলো।
….কিহহ?কেন? কি হয়েছে তোর? অসুস্থ হয়েছিলি তুই?

…আরে আরে থাম বলছি। তারপর নূর তানিকে কালকের সব ঘটনা বলে। (জনির ঘটনাটা বলে না)।

…হুম বুঝতে পেরেছি।আমার মনে হয় ডাইরি আদিত্য ভাইয়ার গাড়ির ভেতরেই কোথাও পড়েছে।কারণ হসপিটালের ভেতরে শুধু তোকে নিয়ে গেছে। ব্যাগতো গাড়ির ভেতরেই ছিল। তাই হয়তো ডাইরি গাড়ির ভেতরেই কোথাও পড়েছে বুঝতে পেরেছিস? তুই চিন্তা করিস না। ক্লাস শেষে আদিত্য ভাইয়ার কাছে জিজ্ঞেস করিস।যদি উনি পেয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয় তোকে দিয়ে দিবে।

নূর খুশী হয়ে গেল। যাক তাওতো একটা আশা আছে। হয়তো ডাইরিটা পাওয়া যেতে পারে ।

চলবে……

#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি 💞💞
#লেখিকা- Mehruma Nurr
#পর্ব-১৫

★নূর বসে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। মনে মনে একটা আশা নিয়ে বসে আছে। হয়তো আদিত্যের কাছে ওর ডাইরিটা পেতে পারে।

আদিত্য আসে ওখানে। পিছন থেকে দেখতে পায় নূর ব্রেঞ্চের ওপর বসে আছে। নূরকে দেখে ওর ডাইরির কথাগুলো মনে পরে যায়। আদিত্য পেছন থেকে মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে নূরের দিকে। এতো নিস্পাপ মায়াবী মেয়েটাকে কেউ কিভাবে কষ্ট দিতে পারে। ভাবতেই আদিত্যর বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা শুরু করে। ইচ্ছে করছে এখুনি যেয়ে নূরকে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিতে।
আদিত্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে ঠিক করে নেয়।নূরের সামনে ওকে স্বাভাবিক বিহেব করতে হবে। তানা হলে নূর সন্দেহ করবে। মেয়েটা যেহেতু নিজের ব্যাপারে কখনো কিছু বলে না। তার মানে সে কারোর সিমপ্যাথি চায় না। তাই আমাকেও ওর সামনে স্বাভাবিক থাকতে হবে। যাতে ও বুঝতে না পারে যে আমি সবটা জেনে গেছি। এসব ভেবেই আদিত্য নিজেকে ঠিক করে নূরের সামনে যায়।

আদিত্য নূরের পাশে গিয়ে বসে। আদিত্য বসতেই নূরও আদিত্যের দিকে তাকায়। আদিত্য দেখে নূরের মুখটা কেমন ছোট হয়ে আছে। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো।
…কি হয়েছে? মন খারাপ কেন? আবার শরীর খারাপ করেছে? সকালে ওষুধ খাওনি?

নূর বললো
…না না কিছু হয় নি।আমি ঠিক আছি।আর আমার শরীরও ঠিক আছে।

…তাহলে মুখটা এমন ছোট করে রেখেছো কেন?

নূর আমতা আমতা করে বললো।
…আ আআসলে একটা কথা বলার ছিল আপনাকে।

আদিত্য আগ্রহ নিয়ে বললো।
…হ্যা বলো কি বলবে?

…আসলে আপনার গাড়িতে কি কাল কিছু পেয়েছেন?

আদিত্য এতক্ষণে বুঝতে পারলো। নূর তার ডাইরির কথা বলছে।আদিত্য একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো।
…কেন গাড়িতে কি কিছু থাকার কথা ছিল নাকি?

নূর মুখটা ছোট করে বললো।
…আসলে আমার একটা ডাইরি আছে। কাল আমার ব্যাগেই ছিল। কিন্তু বাসায় যেয়ে আর পাচ্ছি না।ক্যাম্পাসেও অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাইনি।তাই ভাবলাম হয়তো আপনার গাড়িতে পড়েছে কিনা?

নূরের এমন চেহারা দেখে আদিত্যের অনেক হাসি পাচ্ছে। আর একটু মজা নেওয়ার জন্য আদিত্য গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
…তোহ তোমার কি আমাকে চোর মনে হয়? যে আমি তোমার ডাইরি চুরি করে রেখে দিব?হাহ্?

আদিত্যের এমন রিয়্যাকশন দেখে নূর একটু ভয় পেয়ে গেল।
ও ভীতু স্বরে বললো।
…না না কি বলছেন আপনি? আপনাকে চোর কেন ভাববো?আপনিতো অনেক ভালো মানুষ। অনেক সাধু মানুষ, অনেক সিধা মানুষ, অনেক সুধু মানুষ, অনেক সিধি মানুষ, অনেক দিধি মানুষ। ভয়ের চোটে নূর কি বলছে ও নিজেও জানেনা।

নূরের এসব কথা শুনে আদিত্য হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। নিজের এমন প্রশংসা ও বাপের জনমেও শোনেনি। আদিত্য নিজের মাথাটা একটু অন্য দিকে ঘুরিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে।তারপর আবার নূরের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে।
…সে যায় হোক। তোমার কথাতে তো তাই আসে। আর তাই আমি অনেক হার্ট হয়েছি।কথাটা বলে আদিত্য মিথ্যে রাগ দেখিয়ে সামনে তাকিয়ে থাকে। নূরের দিকে আরচোখে তাকিয়ে মনে মনে হাসতে থাকে।

নূর পরে গেছে মহা মুশকিলে।কি বলতে যেয়ে কি হয়ে গেলো। উনিতো সত্যি সত্যিই রাগ করে ফেলছে। এখন কি করবো? নূর ওড়নার কোণা আঙুল দিয়ে পেঁচাতে পেঁচাতে অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো।
…দেখুন আপনি রাগ করবেন না প্লিজ। আমি সত্যি বলছি। আমি ওসব ভেবে বলিনি। আমিতো শুধু বলতে চেয়েছিলাম যে।হয়তো কাল ভুলবশত আমার ব্যাগ থেকে ডাইরিটা আপনার গাড়িতে পড়েছে। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করছিলাম আপনি পেয়েছেন কিনা। আর কিছুই না।

আদিত্যর পেট ফেটে হাসি পাচ্ছে নূরের এমন অবস্থা দেখে। কোনরকমে গম্ভীরতা বজায় রেখে আদিত্য বললো।
…ঠিক আছে তুমি যখন এতো করে বলছো আমি মেনে নিলাম তোমার কথা। আর হ্যা তোমার ডাইরি আমি গাড়িতে পেয়েছি। ভেবেছিলাম কার না কার হবে? তাই ফেলে দিতে চেয়েছিলাম।

আদিত্যের কথা শুনে নূরের এখন কান্না করে দেওয়ার মতো অবস্থা।

আদিত্য বুঝতে পেরে বললো।
…চিন্তা করোনা ফেলিনি। গাড়ির ভেতরেই রেখে দিয়েছি।

নূর খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললো।
…সত্যিই? আপনিনা সত্যিই অনেক ভালো। একদম এত্তো এত্তো এত্তগুলা ভালো। নিজের দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে পরিমাপ দেখিয়ে কথাগুলো বললো নূর।

আদিত্য মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে নূরের দিকে।নূরের খুশি দেখে ওর মনটাও ভালো হয়ে যায়। সামান্য একটা ডাইরির জন্য কতো খুশি মেয়েটা।

নূর খুশী মনে বললো।
….তাহলে চলুন ডাইরিটা নিয়ে নেই আমি।

আদিত্য গলা খাঁকারি দিয়ে বললো
…হুম দিব। আগে তোমার কাজটা করে ফেলো।তারপর।

নূর লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। তারপর মাথা ঝাকিয়ে হ্যা বুঝালো। আদিত্য চোখ বন্ধ করতেই নূর এসে চুমু দিয়ে দিলো। তারপর রোজকার মতো ওখান থেকে চলে গেল। কিন্তু আজ আর একেবারে বাসায় গেল না। মাঠের একপাশে এসে দাঁড়িয়ে রইল।আদিত্যের কাছ থেকে যে ওর ডাইরিটা নিতে হবে তাই জন্য।
আদিত্য বেড়িয়ে এসে ওর গাড়ির দিকে এগুলো। নূর দেখতে পেয়ে সেও আদিত্যের পিছে পিছে গেল। আদিত্য গাড়ির কাছে এসে লক খুলতেই নূর ওর পিছনে এসে দাড়ালো। আদিত্য পিছনে ফিরে নূরের তাকাতেই নূর মাথা নিচু করে আমতা আমতা করে বললো।
….আ আমার ডাইরিটা?

আদিত্য বাঁকা হেসে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে যেয়ে বসলো। তারপর পাশের সিটের দরজাটা খুলে বললো।
…গাড়িতে বসো।

নূর চমকে তাকালো আদিত্যের দিকে। তারপর বললো।
…গাড়িতে বসার কি দরকার? আপনি এখানেই দিয়ে দিন না?

আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
…ডাইরি চাই কি চাই না?

নূর দ্রুত মাথা ঝাকিয়ে বললো।
…হ্যা হ্যা চাইতো।

….তাহলে গাড়িতে এসে বসো।

নূর আর কোনো উপায় না পেয়ে গাড়িতে যেয়ে বসলো।নূর গাড়িতে বসার সাথে সাথেই আদিত্য গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। নূর ঘাবড়ে যেয়ে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে বললো।
…আরে আরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আমিতো শুধু ডাইরি নিতে এসেছিলাম। ডাইরিটা নিয়ে আমি বাসায় চলে যাবো। প্লিজ গাড়ি থামান।

আদিত্য নূরের দিকে না তাকিয়েই সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো।
…. ডাইরি নিতে চাইলে আগে আমি যেটা বলবো সেটা মানতে হবে। নাহলে পাবে না।এখন তুমি বলো তুমি কি করবে?

আদিত্যের কথা শুনে নূর একটু ঘাবড়ে গেল। ভাবছে ডাইরির জন্য এখন আবার কি করতে বলে কে জানে?আবার কি নতুন কোনো শাস্তি দেবে নাকি? কিন্তু ডাইরিটা তো আমার চাই। এখন কি করবো?এমন কেন উনি? ধ্যাৎ উনাকে যতটা ভালো ভেবেছিলাম ততটা ভালো না উনি।তিনটা এত্তো থেকে একটা এত্তো বাদ হুহ্😤

নূরের ভাবনার মাঝেই আদিত্য বলে উঠলো।
…কি ভাবছো ডাইরি কি চাই না তোমার? না চাইলে সমস্যা নেই। আমি বাসায় যেয়ে ওটা ডাস্টবিনে ফেলে দিব কেমন?

নূর তড়িৎ গতিতে বলে উঠলো।
…না না আমি চাইতো।প্লিজ দিয়ে দিন আমাকে।

….তাহলে আগে বলো আমার শর্তে রাজি কি না?

নূর আর কোনো উপায় না পেয়ে মাথা ঝাকিয়ে হ্যা বুঝালো। তারপর গাল ফুলিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে বসে রইলো। আদিত্যের ওপর একটু অভিমান হলো নূরের।
আদিত্যর নূরের এমন মুখ ফুলানো দেখে মিটিমিটি হাসছে।

হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করায় নূর ভ্রু কুঁচকে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে।
…কি হয়েছে?এখানে গাড়ি থামালেন কেন?

আদিত্য বললো।
… আগে নামো তারপর বলছি।

নূর নেমে দাড়ালো। সামনে তাকিয়ে দেখলো অনেক বড়ো একটা রেস্টুরেন্টে। আদিত্যকে জিজ্ঞেস করলো।
…এটাতো রেস্টুরেন্ট। এখানে কি করবো আমরা।

আদিত্য বললো।
…ক্রিকেট খেলবো।

নূর থতমত খেয়ে বললো।
….মানে?কি বলছেন আপনি? রেস্টুরেন্টে কেউ ক্রিকেট খেলে নাকি?

….জানোই যখন তখন ফালতু প্রশ্ন করছো কেন?বেশি কথা না বলে আমার সাথে চলো।বলেই আদিত্য নূরের হাত ধরে রেস্টুরেন্টের ভেতরে নিয়ে গেল।

ভেতরে যেয়ে একটা টেবিল বুক করে বসে পড়লো।আদিত্য আর নূর দুজন সামনা সামনি হয়ে বসলো।নূর নম্র সুরে বললো।
……দেখুন আমার বাসায় যেতে দেরি হলে সমস্যা হবে। আমাকে কি করতে হবে সেটা বলুন। যাতে আমি আমার ডাইরিটা নিয়ে বাসায় যেতে পারি।

…আপাতত আমার ক্ষুধা লেগেছে।আর তুমিতো জানোই আমার একা একা খেতে ভালো লাগে না।তাই তুমিও আমার সাথে খাবে। মনে করো এটাও একটা শর্ত। বুঝতে পেরেছে? আর হ্যা চিন্তা করোনা বাসায় টাইম মতোই পৌঁছে দিব আমি।

নূর একটু অবাক হলো। এটা আবার কেমন শর্ত। তারপর মাথা ঝাকিয়ে বললো।
…হুম।
নূর চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে।এর আগে কখনো এতো বড়ো রেস্টুরেন্টে আসেনি নূর। ওরা যে টেবিলে বসেছে।সেটা কাচের দেয়ালের পাশে। তাই নিচের সবকিছু দেখা যাচ্ছে। নূরের ভালোই লাগছে জায়গাটা।
একটু পরেই একটা ওয়েটার খাবারের অর্ডার নিতে আসলো। আদিত্য নূরকে জিজ্ঞেস করলো।
…কি খাবে তুমি?

নূর এতক্ষণ নিচের মানুষ দেখায় ব্যাস্ত ছিল। আদিত্যর কথায় নূর সামনের দিকে তাকালো। তারপর বললো।
…আপনার যেটা ভালো লাগে সেটাই অর্ডার করুন।

আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
…এটা আবার কেমন কথা। আমার পছন্দ আর তোমার পছন্দ তো আর এক না।তুমি যেটা খেতে পছন্দ করো সেটা অর্ডার করো।

নূর মাথা নাড়িয়ে নিজের জন্য খাবারের অর্ডার দিল।একটু পরেই সব খাবার চলে এলো। আদিত্য নূরের প্লেটে খাবার সার্ভ করে দিল।নূর সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে খাওয়া শুরু করলো। আসলে নূর না বললেও ক্ষুধা ওরও লেগেছে খুব। রোজকার মতো আজও সকালে না খেয়েই এসেছে ও। এতোবেলা হয়ে গেছে ক্ষুধাতো লাগারি কথা। তাই আর কিছু না ভেবে খাওয়া শুরু করলো নূর।
আদিত্য খাচ্ছে কম নূরকে বেশি দেখছে। শুধুমাত্র নূরকে খাওয়ানোর জন্যই এতক্ষণ যাবৎ এসব করেছে আদিত্য। এখন নূরকে খেতে দেখে ওর শান্তি লাগছে।
খাওয়া দাওয়া শেষে ওরা বেড়িয়ে আসে। গাড়িতে বসে নূর বলে।
…এখন বলুন আমার ডাইরিটা পেতে আর কি করতে হবে?

আদিত্য গাড়ি চালাতে চালাতে বললো।
….হুম শোন তাহলে,আমার প্রথম শর্ত হলো। আমি এখন থেকে রোজ তোমাকে বাসা থেকে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসবো আর দিয়ে আসবো। আর দ্বিতীয় শর্ত হলো।তোমাকে রোজ আমার সাথে খাবার খেতে হবে। বলো রাজি?

নূর অবাক আর বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল আদিত্যের দিকে। ও ভেবে পাচ্ছে এটা শর্ত নাকি কেয়ার।এসব করে ওনার কি লাভ? আর কেনই বা করছে এসব? নূর জিজ্ঞেস করলো।
…এসব করে আপনার কি লাভ?

আদিত্য গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
…নো কোশ্চেন এলাউড। অনলি ইয়েস অর নো।

নূর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
…ঠিক আছে আমি রাজি।

আদিত্য একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।যাক শেষমেষ ওর প্ল্যান কাজে দিয়েছে।
আদিত্য নূরের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামলো।
নূর বললো।
…এখন তাহলে আমার ডাইরিটা দিন।

আদিত্য ডাইরি বের করে নূরের হাতে দিল।নূর ডাইরিটা পেয়ে একটা স্বস্তির হাসি দিল।তারপর মুচকি হেসে আদিত্যকে বললো।
…বায়। আজ তাহলে আসি।

আদিত্য বললো।
…হুম ঠিক আছে। কাল সকালে আমি এখানেই ওয়েট করবো। সময়মতো চলে এসো।

নূর মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝালো। তারপর গাড়ি থেকে নেমে চলে গেল। নূর যেতেই আদিত্য গাড়ি স্টার্ট দিল।
একটু পরেই আদিত্যের ফোনটা বেজে উঠলো। আদিত্য ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই, ওপর পাশের ব্যাক্তির কথা শুনে আদিত্য বাঁকা হেসে বললো।
….আ্যাম কামিং।
তারপর ফোনটা কেটে আবির আর তাসিরকে একটা টেক্সট করে দিল।

আবির আদিত্যের টেক্সট দেখে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে তাসিরকে বললো।
….ইয়ার, অনেক দিন হলো হকি খেলিনা। চল আজকে একটু হকি খেলে আসি।
তাসিরও হেসে বললো।
…হ্যা চল। হকির সাথে আরও অনেক কিছুই খেলা হবে।

——————————

অন্ধকার একটা গোডাউনের ভেতরে চেয়ারের সাথে হাত পা বেধে রাখা হয়েছে জনিকে।অনেকক্ষণ ধরেই চিল্লাচ্ছে জনি।
….কে এখানে? কে ধরে এনেছে আমাকে?কি চাই তোদের?ভালোই ভালোই বলছি ছেড়ে দে আমাকে?নাহলে কিন্তু তোদের জন্য ভালো হবে না বলে দিলাম।

একটু পরে হঠাৎ গোডাউনের লাইট জ্বলে উঠলো। জনি দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো কারা যেন আসছে। ধীরে ধীরে তারা সামনে এসে দাড়ালো। জনি রাগী কন্ঠে বললো।
…কে তোরা আমাকে এখানে কেন এনেছিস?

আদিত্য প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললো।
….তোর নাকি অনেক যৌবন জ্বালা? সেটাই মেটাতে এসেছি।

আবির তৎক্ষনাৎ চমকে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
…কি বলছিস ভাই? তুই কেন ওর যৌবন জ্বালা মেটাবি?এই তুই কি সত্যি সত্যিই গে হয়ে গেলি নাকি? ছিঃ ছিঃ ভাই তোর কাছ থেকে এটা আশা করিনি। আরে গে হলেও, তোরও তো একটা লেভেল আছে। শেষমেশ কিনা এই থার্ডক্লাস জনির সাথে?

আদিত্য অগ্নিচোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
…জাস্ট সাট আপ ইডিয়ট। নাহলে ওর আগে তোকেই শায়েস্তা করবো।

আবির বেচারা ভয় পেয়ে জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে বললো।
…না না ভাই তার কোনো দরকার নেই। আমিতো শুধু মজা করছিলাম। হে হে

তাসির আবিরকে বললো।
….তুই আসলেই একটা ইডিয়ট। দেখছিস একটা এ্যাকশন সিন চলছে। তারমধ্যে তুই কমেডি ঢুকিয়ে দিয়ে সব ঘেটে দিলি।

এদের কথার মাঝেই জনি আবার বলে উঠলো।
…আমাকে ছেড়ে দে তোরা।ভালো হবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি।

আদিত্য এবার চোয়াল শক্ত করে এক হাত দিয়ে জনির মুখ চেপে ধরে রাগে কটমট করতে করতে বললো।
…কি করবি তুই? দেখা দেখি কি করতে পারিস তুই।দূর্বল মেয়েদের ওপর নিজের পুরুষত্ব দেখানো ছাড়া আর কি ক্ষমতা আছে তোর? আজ দেখে ছাড়বো তোর কতো শক্তি আছে। আবির ওর বাধন খোল। দেখি ওর কতো পাওয়ার?

আবির জনির কাছে এসে সয়তানি ভাব নিয়ে বললো।
…আব তেরা কেয়া হোগা কালিয়া।?মুহ হা হা হা

আদিত্য আর তাসির ভ্রু কুচকে তাকালো আবিরের দিকে। ওদের তাকানো দেখে আবির হাসি থামিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো।
…ওয়াট?এখন কি আমি একটু ডায়লগও বলতে পারবো না? এরকম একটা সিন কি রোজ রোজ হয় নাকি?

তাসির বিরক্ত হয়ে বললো।
…হয়েছে তোর ডায়লগ বলা?নাকি আরো আছে?

আবির ক্যাবলা হাসি দিয়ে বললো।
…দোস্ত আর মাত্র একটা বলবো। প্লিজ প্লিজ।

…ঠিক আছে বক তোর ডায়লগ।

আবির আবারও জনির দিকে তাকিয়ে ভাব নিয়ে বললো।
…চিতে কি চাল, বাজ কি নাজার অর আবির কি মারপে কাভি সন্দেহ নেহি কারতে।

আদিত্য এদের কান্ড দেখে চরম বিরক্ত। ইচ্ছে করছে আগে এদেরকেই পেটাতে। রাগী স্বরে বললো।
…এখন তোর ফালতু কথা বন্ধ হলে ওর বাধনটা খোল।

আবির জনির বাঁধন খুলে দিল।আদিত্য জনিকে বললো।
…তো দেখা তোর পাওয়ার।

জনির তো ভয়ে কাঁপুনি উঠে গেছে। এতক্ষণ এতো কথা বললেও এখন সব ফুস হয়ে গেছে। কারণ ও আদিত্যকে চিনতে পেরেছে। আর আদিত্যের পাওয়ার সম্পর্কে ওর ভালোই ধারণা আছে। এখানে ওকে মেরে গুম করে ফেললেও কেউ জানবে না।জনি ভয়ে ভয়ে বললো।
…ভাই আমার অপরাধটা কি?আমিতো আপনার কোনো ক্ষতি করি নাই। আমারে ছেড়ে দেন প্লিজ।

আদিত্যর এবার নূরের লেখা কথাগুলো মনে পরে যায়। রাগে কপালের রগ ফুলে ওঠে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জনির নাক বরাবর একটা ঘুষি মারে।ঘুষি খেয়ে জনি ছিটকে নিচু পরে যায়। সাথে সাথে ওর নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। আদিত্য আবারও জনির কলার ধরে টেনে তুলে এলোপাথারি মারতে মারতে বলতে থাকে।
…কি করেছিস তুই জানিস না তাইনা? মেয়েদের দেখলেই তোর ভোগের বস্তু মনে হয় তাইনা?আজ তোর এমন অবস্থা করবো যে কোনো মেয়ের ছবি দেখলেও ভয়ে পালাবি।
আদিত্যর মনে পরে ওর জন্য নূরের হাতের কি অবস্থা হয়েছিল।ওটা মনে পরতেই আদিত্যের রাগ আরো বেড়ে যায়। আদিত্য জনির হাতটা নিচে ফেলে নিজের পায়ের বুট দিয়ে পিসতে থাকে। জনি জোরে আর্তনাদ করতে থাকে। একসময় নিস্তেজ হয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় জনি।আদিত্য তাও থামেনা মারতেই থাকে। ওর মাথায় যেন রক্ত উঠে গেছে।
তাসির আর আবির দুজনেই আদিত্যের অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায়। ওকে এতো রাগতে আগে কখনোই দেখেনি ওরা।আদিত্যকে এখন না থামালে জনি নির্ঘাত মরে যাবে। তাই আবির আর তাসির দৌড়ে যেয়ে
আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে ঠেকানোর চেষ্টা করলো। তাসির বললো।
…বাচ কর ইয়ার। ও মরে যাবেতো।
আদিত্য বললো।
…মরুক ওর মতো কিটকে মরে যাওয়াই উচিত।

আবির বললো।
…ভাই এমনিতেও ওর যে অবস্থা হয়েছে। আর কখনো উঠতে পারবে কিনা সন্দেহ। এখন ছেড়ে দেও ওকে।

দুজন মিলে কোনরকমে আদিত্যকে ঠেকালো। আদিত্য একটু শান্ত হয়ে ওর লোকগুলোকে ডাক দিল।ওরা আসতেই আদিত্য বললো।
…ওকে হসপিটালে ফেলে এসো।

লোকগুলো মাথা ঝাকিয়ে বললো।
… জ্বি স্যার।

তারপর ওরা তিনজন বেড়িয়ে গেলো।

চলবে…..