#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি 💞💞
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৭৯
★ দেখতে দেখতে আরও দু সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। নূর তানির বেবির সাথে সপ্তাখানেক থেকে ওরা আবার ধানমন্ডির বাসায় চলে এসেছে। এখন আবার সবাই যার যার জীবনে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। রিপার পাঁচ মাস পুরো হওয়ার পর আদিত্য রিপাকে নিজের জেল থেকে বের করে পুলিশের হাতে দিয়ে দিয়েছে।
বেলা ১২টা
আজ শুক্রবার তাই আদিত্য আজ বাসায়ই আছে। আদিত্য বেডে বসে আপেল খাচ্ছে আর ল্যাপটপে কিছু কাজ করছে। নূর ওয়াশরুমে গেছে শাওয়ার নিতে।
হঠাৎ আদিত্যের গায়ে কিছু পানির ছিটা এসে লাগলো। আদিত্য হকচকিয়ে উঠে পানি কোথাথেকে আসলো সেই উৎস খোজার জন্য সামনে তাকালো। আর সামনে তাকাতেই বেচারা আদিত্যের হৃদপিণ্ড থেমে যাওয়ার উপক্রম। সামনে নূর ওয়াশরুমের দরজায় শুধু একটা তোয়ালে পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তোয়ালেটা বুকের ওপর দিয়ে পেচিয়ে হাটুর ওপর পর্যন্ত ঝুলে আছে। নূর দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে এক হাঁটু ভাজ করে আবেদনময়ী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, ঠোঁট কামড়ে আবেদনময়ী হয়ে হাসি দিচ্ছে। চুলগুলো আধো ভেজা হয়ে ছড়িয়ে আছে। আদিত্যের গায়ে পানি নূরই ছিটিয়ে মেরেছে।
নূরের এমন মাত্রাতিরিক্ত আবেদনময়ী রুপ দেখে আদিত্য হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো হা হয়ে গেছে। হা হয়ে থাকায় আদিত্যের মুখে থাকা আপেলের টুকরো টা মুখ থেকে নিচে পড়ে গেল। নূর আবেদনময়ী হাসি দিয়ে তর্জনী আঙুল দিয়ে ইশারা করে আদিত্যকে নিজের কাছে ডাকলো। আদিত্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে দাঁড়িয়ে নূরের দিকে আসতে লাগলো। নূরের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ নূর দুষ্টু হেসে ওয়াশরুমের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগলো।
নূরের হাসিতে আদিত্যের ঘোর কাটলো। আদিত্য ওয়াশরুমের দরজায় নক করে বললো।
….দিস ইস নট ফেয়ার প্রাণপাখী। আমাকে পাগল করে এখন দরজা বন্ধ করে দিচ্ছ? খোলনা প্লিজ? তুমি না আমার লক্ষী বউ? আমার সুইট সুইট কিউটি সোনা? প্লিজ না?
নূর শুধু ভেতর থেকে হেসেই যাচ্ছে। আদিত্য আবার বলে উঠলো।
….ঠিক আছে খুলবে নাতো? ফাইন, থাক তুমি। আমাকে পুড়িয়ে অনেক মজা পাচ্ছ তাইনা? তাহলে তুমি মজাই নেও,আমি গেলাম।
কথাটা বলে আদিত্য চুপ করে দরজার পাশে দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে রইলো।
আদিত্যের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নূর চেক করার জন্য দরজাটা হালকা খুলে মাথা বের করে উঁকি দিয়ে দেখলো আদিত্য আছে না নেই। তখনই হঠাৎ আদিত্য দ্রুত এসে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে নূরকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। নূর কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই সবকিছু হয়ে গেল। যখন বুঝতে পারলো তখন লাজুক হেসে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। আদিত্য টেডি স্মাইল দিয়ে বললো।
……অনেক মজা হচ্ছিল না? এখন কোথায় পালাবে আমার কাছ থেকে?
নূর আদিত্যের দিকে তাকিয়ে আবেগি কন্ঠে বললো।
….কোথায় পালাবো তোমার কাছ থেকে? আমার ঠিকানাই তো তুমি।
নূরের কথায় আদিত্য মুচকি হেসে নূরের ঠোঁটের দিকে এগুলো। ডুব দিল নূরের রসালো ঠোঁটে। চুষে নিতে থাকলো নূরের ঠোঁটের সব মধু। নূরও আদিত্যর চুল খামচে ধরে আদিত্যের ভালোবাসায় সাড়া দিতে লাগলো। আদিত্য চুমু খেতে খেতে নূরের তোয়ালের গিট খুলে ফেললো।
___
দুপুর ২টা
বেডের ওপর, আদিত্য নূরের পেটের ওপর থেকে শাড়ির আচল সরিয়ে খোলা পেটের ওপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। আর আঙুল দিয়ে নূরের নাভির চারিদিকে আঁকিবুঁকি করছে। নূর মুচকি হেসে আদিত্যের চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।
নূর ভাবলো এখন আদিত্যের মুড অনেক ভালো আছে। এখনই ভালো সুযোগ কথাটা বলার। এসব ভেবে নূর মিষ্টি করে বললো।
….শোন না, একটা কথা বলার ছিল?
আদিত্য নূরের পেটে একটা চুমু খেয়ে বললো।
….একটা কেন, হাজার টা বলো প্রাণপাখী।
…বলছিলাম যে আমাদেরও এখন বেবি নিয়ে নেওয়া উচিৎ তাইনা? দেখ তানি আমাদের জামাইকে তো নিয়ে আসলো।এখন আমাদের মেয়েকেও দুনিয়াতে আনতে হবে।
আদিত্য হঠাৎ ঠাসস করে উঠে বসে গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
…হঠাৎ বাচ্চার কথা কোথাথেকে আসলো? কে ঢুকালো তোমার মাথায় এসব? এসব ফালতু চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।
আদিত্যের এমন রিয়্যাকশনে নূর একটু অবাক হলো। নূর ভ্রু কুঁচকে বললো।
….ফালতু চিন্তা মানে? বাচ্চা নেওয়া তোমার কাছে ফালতু চিন্তা মনে হয়? দেখ আমাদের বিয়ের প্রায় দেড় বছর হতে চলছে। এখনি সঠিক সময় এসেছে বাচ্চা নেওয়ার। চলনা আমরা বেবি নেই?
আদিত্য হালকা রাগী কন্ঠে বললো।
….আচ্ছা তো এসব রোমান্টিক প্ল্যান সব বাচ্চা নেওয়ার জন্য করছিলে তাইনা? দেখ এসব বাচ্চা নেওয়ার কথা ভুলে যাও। তোমার যদি বেবি চাই, তাহলে আমরা বেবি এডপ্ট করবো। দুনিয়াতে অনেক এতিম বাচ্চা আছে,যাদের কোনো মা বাবা কিছুই নেই। সেখান থেকে আমরা একটা বাচ্চা এডপ্ট করে নিব। তাহলে খুশিতো? বাচ্চা হলেই তো হলো।
….এসব কি ধরনের কথা বলছ? আমরা বাচ্চা এডপ্ট কেন করবো? আমি নিজের বাচ্চা চাই। যা তোমার আমার ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে আমার গর্বে আসবে। আমি অন্য বাচ্চা না, তোমার অংশ চাই।
….দেখ এটা কখনোই হবে না। আমি তোমার লাইফ নিয়ে কোনো রিস্ক নিতে পারবো না। তোমাকে একবার হারিয়েছি আরেকবার হারানোর ক্ষমতা আমার মাঝে নেই। তুমি কিছুদিন আগেই এতবড় এক্সিডেন্ট থেকে বেচে উঠেছ। আবার বাচ্চা কনসিভ করে তোমার লাইফ রিস্কে ফেলতে পারবো না। বাচ্চা কনসিভ করার পর যদি কোনো কমপ্লিকেশন আসে তখন? ডেলিভারিতে যে পেইন হয়, আমি তোমার ওই পেইন কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না। যদি ডেলিভারি হওয়ার সময় তোমার কিছু হয়ে যায় তখন? তখন আমি কি করবো? তোমার কিছু হয়ে গেলে আমিও বাচব না। আর যদি আমরাই না থাকি তাহলে বাচ্চা দিয়ে কি হবে? তাই এসব বেবি নেওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।
….কি বলছ তুমি এসব? পরে কি হবে না হবে সেই চিন্তা করে আমি কখনো মা হবো না? আমাকে কি তোমার এতো সেলফিশ মনে হয়? দুনিয়াতে কি আমি একাই মা হবো নাকি? প্রতিদিন লাখ লাখ মহিলা বাচ্চা জন্ম দিচ্ছে। তারা কি সবাই মরে যাচ্ছে? আর লেবার পেইন সহ্য করার ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালা সব মেয়েদের দিয়ে দিয়েছেন। তাই বলে কি সবাই সেই ভয়ে বাচ্চা নেওয়া বন্ধ করে দিবে? এটা কেমন কথা?
….দেখ সবাই কি করলো না করলো সেটা আমার দেখার বিষয় না। আমি শুধু জানি যে আমি তোমাকে নিয়ে কোনো রিস্ক নিতে পারবো না বাচ।
….আর আমাদের পরিবার? তাদের কি কোনো চাওয়া নেই আমদের ওপর? বাবার কি ইচ্ছে হয়না তার একমাত্র ছেলের ঘরের নাতি নাতনির মুখ দেখতে? যে তার ছেলের অংশ হবে। তানি বেচারি কতো আশায় আছে আমার মেয়ের সাথে ওর ছেলের বিয়ে দিবে। তুমি তাদের কথা একবারও ভাববে না? তাদের প্রতি কি আমাদের কোনো দায়িত্ব নেই?
…দেখ এতকিছু আমি জানি না। তোমার আর পরিবারের জন্য তো বাচ্চা এডপ্ট করতেই চাচ্ছি। এরবেশি আমি আর কিছু করতে পারবো না। বাচ কথা শেষ। এই নিয়ে আর কোনো আরগিউ হবে না।
কথাটা বলে আদিত্য উঠে চলে গেল ওখান থেকে।
নূরের অনেক কান্না পাচ্ছে আদিত্যের কথায়। লোকটা এমন কেন? সবকিছুতেই এতো বেশি বোঝার কি দরকার? এখন কি করবো আমি? কিভাবে বোঝাব এই পাগল কে?
এইভাবে দুদিন কেটে গেল। নূর আদিত্যকে অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনকিছুতেই কাজ হচ্ছে না। নূর পরিবারের অন্যদের দিয়েও বুঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু আদিত্য ওর ডিসিশনে অটল। সবাই ট্রাই করে হার মেনে নিয়েছে। তবে নূর এখনো হার মানে নি। ও এখনো চেষ্টা করেই যাচ্ছে।
যেমন এখনো, আদিত্য ডিনার শেষে একটু আরাম করছে। আর নূর সেই কখন থেকে একই কথায় বলে যাচ্ছে। বেবি নেওয়ার কথা। আদিত্য এবার বিরক্ত হয়ে বললো।
….কি বারবার এক কথায় বলে যাচ্ছ? আমি বলেছি না মানে না। তাও বারবার কেন একই কথাই বলে যাচ্ছ? তুমি যতযাই বলো, আমার ডিসিশন চেঞ্জ হবে না। এই কথাটা তোমার মাইন্ডে ফিট করে নেও।
নূর এবার রাগী কন্ঠে বললো।
…. না ফিট করবো না। আমার বাচ্চা চাই মানে চাই। তোমাকে আমার কথা শুনতেই হবে।
….আর আমার ডিসিশনও ফাইনাল।
নূর আরও রেগে বললো।
….বাচ্চা দিবে নাতো? এটাই তোমার ফাইনাল ডিসিশন?
…এখন কি স্টাম্পে শই করে দেব নাকি? বললাম তো এটাই ফাইনাল।
নূর এবার দাঁত কটমট করে বললো।
….ঠিক আছে, তাহলে এখন থেকে আমার কাছে আসাও বন্ধ তোমার। তুমি যতদিন বাবু দিতে না চাইবে ততদিন আমাদের মাঝে ওসব হবে না। এই আমি বলে দিলাম। আর এটা আমারও ফাইনাল ডিসিশন।
নূরের কথা শুনে আদিত্য মনে মনে ভয় পেলেও, উপরে উপরে এটিটিউট দেখিয়ে বললো।
….হ্যাঁ তো? না আসলাম কাছে। আমি কি এতটাই ডেস্পারেট নাকি যে,বউয়ের সাথে ফিজিক্যাল না হয়ে থাকতে পারবো না? নিজের ওপর যথেষ্ট কন্ট্রোল আছে আমার। তোমার মাথা থেকে এই বাচ্চার ভুত নামানোর জন্য যদি আমাকে এটা করতে হয়, তাহলে আমি এটাতেও রাজি।
নূর রাগে কিড়মিড় করে উল্টো দিকে হয়ে শুয়ে পড়লো। আর মনে মনে বললো, দেখা যাক মিঃ কতক্ষণ আপনি আপনার কথায় কায়েম থাকতে পারেন।
একটু পরে আদিত্য নূরকে ঘুরিয়ে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে নিল। নূর ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগলে, আদিত্য ধমক দিয়ে বললো।
….কি হলো এভাবে সাপের মতো মোচড়ামুচড়ি করছো কেন? তোমার সাথে ফিজিক্যাল হতে পারবো না, তার মানে এইনা যে তোমাকে ছুতেই পারবো না। যতযাই হোক না কেন, তুমি আমার বুকেই ঘুমাবে। তাই নড়াচড়া না করে চুপচাপ বুকের মাঝে থাকো। আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে।
আদিত্যের কথায় নূরও আর কিছু না বলে মুচকি হেসে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেল। ওর নিজেরও যে আদিত্যের বুকে ছাড়া ঘুম হয় না।
______
পরদিন সন্ধ্যা ৭-৩০
আদিত্য মাত্রই অফিস থেকে এসেছে। বাসার দরজায় এসে বেল বাজালো। একটু পরে নূর এসে দরজা খুলে দিল। আদিত্য স্বাভাবিক ভাবেই সামনে তাকালো। সামনে তাকাতেই আদিত্যর হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ও নিজের বাসায় না অন্য কোথাও চলে এসেছে বুঝতে পারছি না।
নূর আজ পাতলা একটা নেটের শাড়ি পড়েছে। যা শুধু নামেরি শাড়ি। শাড়ীর ফাঁকে নূরের ফর্সা শরীর দৃশ্যমান হয়ে আছে। শাড়ির সাথে একটা স্লিভলেস আর ব্যাকলেস ব্লাউজ পড়েছে। নূরকে আজ পুরো বলিউডের হিরোইনের মতো লাগছে। নূরকে এভাবে দেখে বেচারা আদিত্যের অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেছে।
আদিত্যকে এভাবে দেখে নূর বাঁকা হেসে বললো।
….কি হলো, দরজায়ই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? ভেতরে আসবে না?
নূরের কথায় আদিত্যের ঘোর কাটলো। আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে ভেতরে ঢুকলো। নূর আগে আগে যাচ্ছে আর আদিত্য পিছে পিছে। ব্যাকলেস ব্লাউজ পরায় পেছন থেকে নূরের খোলা ফর্সা মোলায়েম পিঠ বেড়িয়ে আছে। এসব দেখে আদিত্যের গলা শুকিয়ে আসছে। হঠাৎ আদিত্যের অনেক গরম ধরতে লাগলো। আদিত্য রুমে গিয়ে কোট টাই খুলতে লাগলো। নূর আদিত্যের কাছে এসে মুচকি হেসে আদিত্যের কোট টাই খুলতে সাহায্য করলো। নূর আজ স্ট্রং পারফিউম লাগিয়েছে। যা আদিত্যের নাকে এসে লাগতেই আদিত্যের অবস্থা আরও করুন হয়ে যাচ্ছে। আদিত্য চোখ বন্ধ করে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।
আদিত্যের শার্ট খোলা শেষে নূর মুচকি হেসে বললো।
….তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি টেবিলে ডিনার সার্ভ করছি।
কথাটা বলে নূর চলে যেতে নিলেই আদিত্য বলে উঠলো
….কি ব্যাপার, আজকে কি তুমি লেস দিবস পালন করছ নাকি?
নূর ভ্রু কুঁচকে বললো।
…..মানে?
….মানে আজ সবকিছু এভাবে লেস লেস পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ যে, তাই বললাম আর কি।
নূর একটু হেসে দিয়ে বললো।
…..কিযে বলোনা তুমি, এমন আবার কোনো দিবস হয় নাকি? আজ না আমার কেন জানি অনেক গরম লাগছিল। তাই একটু খোলামেলা কাপড়চোপড় পড়েছি। কেন, তোমার কি খারাপ লাগছে আমাকে এভাবে দেখে? তাহলে বলো আমি এখুনি চেঞ্জ করে আসছি।
একটু মন খারাপ করার ভান করে কথাটা বললো নূর।
আদিত্য থতমত খেয়ে বললো।
….না না আমি কখন বললাম যে, তোমাকে খারাপ লাগছে? তোমাকে তো অনেক হট,আই মিন অনেক সুন্দর লাগছে।
কথাটা বলে আদিত্য দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেল। ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দরজার সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করতে লাগলো। ও ভালো করেই বুঝতে পারছে যে নূর এসব ইচ্ছে করেই করেছে, ওকে দূর্বল করার জন্য। কিন্তু আমাকে দূর্বল হয়ে পড়লে চলবে না। স্ট্রং থাকতে হবে। এতো সহজে হার মানলে চলবে না। বি আ ম্যান আদি,বি আ ম্যান।
এভাবে নানান কথা বলে নিজের মনকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করছে আদিত্য। যদিও ও জানেনা কতোটুকু সফল হতে পারবে ও।
এদিকে নূর আদিত্যের এমন অবস্থা দেখে মুখে হাত টিপে হাসতে লাগলো। এইটুকুতেই এই অবস্থা মিঃ আদিত্য? আগে আগে দেখ হোতা হে কেয়া? আজতো তোমাকে হাড় মানিয়েই ছাড়বো আমি।
একটু পরে আদিত্য ফ্রেশ হয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে আসলো। আদিত্য মাথা নিচের দিকে রেখে সোজা চেয়ারে এসে বসলো। নূরের দিকে তাকাচ্ছেই না। এটা দেখে নূর বাঁকা হেসে আদিত্যের সামনে প্লেট রাখলো। আদিত্য রোজ এক প্লেটেই নূরকে খাইয়ে দেয় আর নিজেও খায়। তাই নূর রোজকার মতো এক প্লেটেই খাবার বাড়তে লাগলো। খাবার বাড়তে এসে ইচ্ছে করেই নিচের দিকে বেশি করে ঝুকলো,আর ঝুকতেই নূরের বুকের ওপর থেকে শাড়ির আচলটা পড়ে গেল। এটা দেখতেই আদিত্যের চোখ ওখানেই আটকে গেল। বেচারার কন্ট্রোলও যেন জবাব দিয়ে দিচ্ছে। নূর ন্যাকামি করে শাড়ীর আঁচল ঠিক করে বললো।
…ওহহ সরি সরি, এই আঁচল টাও না একদম পিচ্ছিল। শুধু শুরুত শুরুত পরে যায়।
আদিত্য সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে মাথাটা একটু ঝাকালো। মাথা কেমন যেন হ্যাং হয়ে যাচ্ছে। এভাবে হলে চলবে না। শক্ত হতে হবে তোকে হ্যাঁ। আদিত্য চোখ খুলে নূরের দিকে না তাকিয়েই বললো।
…আ আজকে তুমি খাবার হাত দিয়েই খাও কেমন?
নূর মন খারাপের ভান করে বললো।
…কেন তুমি না রোজ খাইয়ে দাও? তো আজ কি হলো?
…কিছুই হয়নি এমনই বলছিলাম আর কি। তুমি আজ হাত দিয়েই খাও।
….ঠিক আছে আমি তাহলে খাবোি না।
কথাটা বলে নূর মিথ্যে অভিমান করে চলে যেতে নিলেই আদিত্য ওর হাত ধরে বললো।
….আরে খাবেনা কেন? আচ্ছা ঠিক আছে আসো খাইয়ে দিচ্ছি।
নূর হেসে দিয়ে ফট করে আদিত্যের কোলে বসে আদিত্যের গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কন্ঠে বললো।
…ঠিক আছে তাহলে দাও খাইয়ে।
আদিত্য জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো।
…চেয়ারে বসোনা, ওখানেই খাইয়ে দিচ্ছি।
নূর আদুরে গলায় বললো।
….না আজ আমার তোমার কোলে বসে খেতে ইচ্ছে করছে। নাও তাড়াতাড়ি খাইয়ে দাও, আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে।
আদিত্য আর উপায় না পেয়ে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে নূরকে খাইয়ে দিল আর নিজেও খেয়ে নিল।
রাত ১০টা
আদিত্য বেডে বসে মোবাইল টিপসে, নূরের দিকে একদমই তাকাচ্ছে না। নূরকে এইরুপে দেখেও ওকে আদর করতে না পারার যা কষ্ট, তা শুধু বেচারা আদিত্যই বুঝতে পারছে। কি দরকার ছিল নূরের শর্তে রাজি হয়ে যাওয়ার? এখন ধুঁকে ধুঁকে পুড়তে হচ্ছে আমার। ধ্যাৎ ভাল্লাগে না। নিজের বউয়ের কাছেও পরপুরুষের মতো নজর ঝুকিয়ে রাখতে হচ্ছে।
আদিত্যের ভাবনার মাঝেই হঠাৎ নূর দৌড়ে এসে ছটফট করতে করতে বললো।
….আদিত্য, আদিত্য দেখনা আমার পিঠে কি যেন কামড় দিয়েছে। উফফ অনেক চুলকাচ্ছে দেখনা প্লিজ?
কথাটা বলে নূর আদিত্যের সামনে পিঠ করে বসলো।পিঠের ওপর থেকে চুল সরিয়ে আদিত্যকে দেখতে বললো।
নূরের খোলা পিঠ দেখে আদিত্যের সব সংকল্প যেন ধুলোয় মিশে গেল। এতক্ষণ ধরে এতো কষ্টে আটকে রাখা ইমোশন গুলো ছুটে বেড়িয়ে এলো। আদিত্য নূরের পিঠে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বললো।
…কোথাও কামড় দিয়েছে, এখানে?
….না
…তাহলে এখানে?
…না
আদিত্য আর পারলো না থাকতে। নূরের মোলায়েম পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে ও ঘোরের মাঝে চলে গেল। আদিত্য মুখ নামিয়ে নূরের পিঠে চুমু খেতে লাগলো। নূর শিহরণে চোখ বন্ধ করে মুচকি হাসলো। আদিত্য পিঠে চুমু খেয়ে নূরকে নিজের দিকে ঘুরালো। তারপর নূরের ঠোঁটের দিকে ঝুঁকতে লাগলো। ঠোঁটের কাছাকাছি আসতেই নূর হঠাৎ আদিত্যের ঠোঁটের ওপর তর্জনী আঙুল ঠেকিয়ে বললো।
….শর্ত নিশ্চয় মনে আছে? কাছে আসতে চাইলে বাবু দিতে হবে।
নূরের কথায় আদিত্যের ঘোর কাটলো। আদিত্য ঝট করে নূরকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো।
আদিত্যের এমন আচরণে নূরের সত্যি এবার অনেক খারাপ লাগলো। ওর চোখে পানি চলে এলো। নূর কাঁদো কাঁদো গলায় বললো।
….কেন এমন করছ? কেন এতো জিদ করছ? কেন বুঝতে পারছ না, একটা মেয়ের জীবন তখনই পরিপূর্ণ হয় যখন সে মা হয়। আর শুধু মেয়ে কেন, একটা পুরুষের জন্যেও বাবা হওয়ার চেয়ে বেশি খুশির দুনিয়াতে আর কিছুই নেই। তুমি হয়তো এখন আবেগের বশে মানা করছ। কিন্তু যখন পরবর্তীতে সবাইকে বাবা হতে দেখবে। বাবা হওয়ার সুখ পেতে দেখবে, তখন তোমার আজকের দিনের জন্য আপসোস হবে। আর তখন তোমাকে আপসোস করতে দেখে আমি তিলতিল মরবো। তুমি কি এটা চাও? হায়াত মওত সব আল্লাহ তায়ালার হাতে। আমাদের এতে কিছু করার নেই। যার যতদিন হায়াত সে ততদিনই বাঁচবে।তার কম বা বেশি কেউই বাঁচবে না।দেখনা এতো বড়ো একটা এক্সিডেন্টের পরেও আল্লাহ আবার আমাকে বাচিয়ে দিয়েছে। কারণ আমার হায়াত ছিল বলে। তাহলে পরে কি হবে না হবে সেটা ভেবে আমরা জীবনের এতবড় খুশি থেকে বঞ্চিত থাকবো? আমি এতবড় স্বার্থপর না যে নিজের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আমি বাচ্চা নিব না। মনে রেখ আমি এভাবে কখনো খুশি থাকবো না। কখনই না।
কথাগুলো বলে নূর দৌড়ে বেলকনিতে চলে এলো। বেলকনির গ্রীল ধরে কাঁদতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পরে আদিত্য পেছন থেকে নূরের কোমড় জড়িয়ে ধরলো। তারপর নূরের কাঁধে চুমু খেয়ে বললো।
….এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাদলেই কি বাবু হয়ে যাবে? তার জন্য প্রসেসিং শুরু করতে হবে না?
নূর এক ঝটকায় আদিত্যের দিকে তাকিয়ে অশ্রু চোখে হাসি মুখে বললো।
….সত্যিই? তারমানে তুমি রাজি?
আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
….হ্যাঁ তোমার জিদের কাছে শেষমেশ আমাকে হার মানতেই হলো। তুমি তো জানোই আমি সবকিছু সহ্য করতে পারি, কিন্তু তোমার চোখের পানি না। তবে তোমাকে একটা প্রমিজ করতে হবে।
….কি প্রমিজ বলো?
….তুমি যদি কনসিভ করো,আর আল্লাহ না করুক প্রেগ্ন্যাসির সময় বা ডেলিভারিতে যদি তোমার কিছু হয়ে যায়। তবে তুমি অন্যদের মতো আমাকে এটা বলবে না বা এধরণের কোনো প্রমিজ চাইবে না যে,তোমার পরে আমি যেন আমাদের বাবুকে দেখে রাখি। কারণ এটা আমি কখনোই করতে পারবো না। তোমাকে ছাড়া আমি এক সেকেন্ডও এই পৃথিবীতে নিঃশ্বাস নিতে পারবো না। তোমার সাথে আমিও চলে যাবো। তাই আমাকে প্রমিজ করো তুমি এমন কিছু চাইবে না আমার কাছে।
নূর মুচকি হেসে বললো।
….ওকে প্রমিজ। আল্লাহ ভরসা। যা হবে ভালোই হবে। আমি ওসব চিন্তা করিনা।
আদিত্য নূরকে কোলে তুলে নিয়ে বললো।
….তাহলে চলো যাওয়া যাক। আমারতো অনেক মেহনত করতে হবে এখন।
নূর লজ্জায় আদিত্যের বুকে মুখ গুঁজল।
চলবে……
#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি 💞💞
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব- ৮০
★ ৩ বছর পর
বেলকনিতে নূর মনমরা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আজকাল ও বেশির ভাগ সময় এটাই করে। এই তিন বছরেও নূর সেই সুখের মুখ দেখেনি যার জন্য ও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এই তিন বছরেও নূর কনসিভ করেনি। অনেক ট্রাই করেছে, এমনকি ডাক্তারও দেখিয়েছে। তবুও কোনো সুফল পায়নি। ডাক্তার বলেছে, নূরেরই কিছু সমস্যা আছে , তাই কনসিভ হতে সমস্যা হচ্ছে। এটা শোনার পর থেকে নূর আরও ভেঙে পরেছে। সব আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে।
এরইমধ্যে নূরের পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছে। তানির ছেলেটাও বড়ো হয়ে গেছে। সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়ায় এখন। তোতলা তোতলা মুখে কথা বলে। সানা আর তাসিরেরও বিয়ে হয়ে গেছে এক বছর হলো। সানাও তিনমাসের প্রেগন্যান্ট। সবাই মা হচ্ছে শুধু নূরই হতে পারছে না। এসব ভেবে নূরের অনেক খারাপ লাগে। নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হয় ওর। নিজেকে কেমন আদিত্যর কাছে অযোগ্য লাগে এখন ওর। যতই আদিত্য মুখে কিছু না বলুক, কিন্তু সব ছেলেই বাবা হওয়ার সুখ পেতে চায়।আর আমার জন্য আদিত্য বাবা হওয়ার সুখ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতে নূরের চোখে পানি চলে এলো। এই পানিও যেন আজকাল বেশি বেশি আশা শুরু করেছে।
একটু পরে আদিত্য অফিস থেকে এলো। রুমে ঢুকে দেখলো, নূর রুমে নেই। আদিত্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেলকনিতে গেল। ও জানে নূর ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্য বেলকনিতে এসে দেখলো, নূর আকাশের দিকে তাকিয়ে নীরবে কান্না করছে। নূরকে এভাবে দেখে আদিত্যের বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো। যদিও আদিত্যর বাচ্চা হওয়া না হওয়া নিয়ে কোনো আপসোস নেই। তবে নূরের এই অবস্থা ও কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। ওর প্রাণপাখীটা যেন আজকাল হাসতেই ভুলে গেছে। আগের সেই হাসি খুশী প্রাণচঞ্চল নূরকে আর দেখা যায় না। আদিত্য অনেক ট্রাই করে নূরকে হাসিখুশি করার। আজকাল ও নূরকে নিয়ে সাভারের বাড়িতেই থাকে। যাতে সবার মাঝে থাকলে নূর যেন হাসিখুশি থাকে। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয়না। নূরের এমন অবস্থা আদিত্য আর দেখতে পারছে না। তাইতো নূরের খুশীর জন্য এখন ও নিজেও চায় যে নূর কনসিভ করুক। যাতে ওর প্রাণপাখীটা আবার হাসি খুশী হয়ে উঠে।
এসব ভেবে আদিত্য জোরপূর্বক মুখে হাসি এনে নূরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো।
…..কি করছে আমার প্রাণপাখীটা?
আদিত্য আশায় নূর তাড়াতাড়ি করে চোখের পানি মুছে নিল। তারপর জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে নরম গলায় বললো।
…..তুমি এসে গেছ? ফ্রেশ হয়ে নেও। আমি খাবার বাড়ছি।
কথাটা বলে নূর মাথা নিচু করে চলে গেল।
আদিত্যের অনেক খারাপ লাগছে। ওর প্রাণপাখীটা কেমন যেন দিন দিন ওর কাছ থেকে দূর হয়ে যাচ্ছে। ও চেয়েও কিছু করতে পারছে না। মাঝে মাঝে ওর অনেক ভয় লাগে নূরকে নিয়ে। যদি ওর নূর এভাবে একসময় অনেক দূর হয়ে যায়। তাহলে কি করবে ও? নূরকে ছাড়া যে ও একদম নিঃশ্ব।
একটু পরে সবাই ডাইনিং টেবিলে এলো ডিনারের জন্য। হঠাৎ তানির ছেলে নিবিড় দৌড়ে এসে নূরের কোলে চড়ে বসে বললো।
….বও (বড়ো) মা বও মা, আমাকে তাইয়ে দাও।
নূর মুচকি হেসে বললো।
….জ্বি জ্বি অবশ্যই, আমার বাবাটাকে তো আমিই খাইয়ে দেব।
নিবিড়কে দেখলেই শুধু নূরের মুখে একটু হাসি দেখা যায়। আর নূরের এইটুকু হাসিই যেন আদিত্যের কাছে অনেক কিছু।
নিবিড় খেতে খেতে বলে উঠলো।
….বও মা, বও বাবা কি তোমাল তুল (চুল) তায়(খায়)?
নূর ভ্রু কুঁচকে বললো।
….কি বলছ বাবা এসব? চুল কি খাওয়া যায় নাকি?
….হ্যাঁ যায়তো, বাবা না ততন (তখন) আম্মুল তুল তাচ্ছিল। আমি দেতেছি। আমি যতন(যখন) বললাম। বাবা তুমি তি তরছ( কি করছ)? বাবা বললো,আমি তোমাল আম্মুল চুল তাচ্ছি। তুমি চতলেত খাও বাইলে যেয়ে।
নিবিড়ের কথায় আবিরের কাশি উঠে গেল। কি ছেলেরে বাবা, সবার সামনে ইজ্জতের ফালুদা করে দিচ্ছে। মানুষের ঘরে ছেলে হয়, আর আমার ঘরে বাপ পয়দা হয়েছে। একেই বলে কার্মা আবির, এতদিন তুই সবার বাজিয়েছিস। এখন তোর ছেলে তোরই বাজাচ্ছে। আবিরের এমন অবস্থা দেখে সবাই মুখ টিপে হাসছে।
খাওয়া শেষে নিবিড় বলে উঠলো।
…. আত্তা বও মা, আম্মু বলেতে তোমাল তামিতে(টামিতে) নাকি আমাল বউ আতবে? তবে আতবে বওনা?
নিবিড়ের কথায় নূরের হাসি মুখটা আবার মলিন হয়ে গেল। এটা দেখে আদিত্য সহ বাকি সবারও মন খারাপ হয়ে গেল। তানি নিবিড়কে ধমক দিয়ে বললো।
…নিবিড় , আজকাল বেশি কথা বলা শিখে গেছ তুমি। তোমাকে না বলেছি ছোট বাচ্চাদের এসব কথা বলতে নেই? চলো রাত হয়েছে এখন ঘুমাবে চলো।
নূর জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো।
…..তানি ওকে কেন বকছিস? ও বাচ্চা মানুষ। ও কি বোঝে?
নূর নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে বললো।
…তুমি যাও বাবা। রাত হয়ে গেছে। এখন যেয়ে ঘুমু দাও কেমন?
নিবিড় মাথা ঝাকিয়ে নূরের গালে একটা চুমু খেয়ে তানির সাথে চলে গেল। নূর সবার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বললো।
…আমার খাওয়া হয়ে গেছে। আমি রুমে যাচ্ছি।
কথাটা বলে নূর দ্রুত ওখান থেকে চলে গেল।
নূরকে যেতে দেখে আদিত্যর মুখেও আর খাবার উঠলো না। ও ভালো করেই যানে নূর এখন রুমে যেয়ে কাঁদবে। আর এটা জানা সত্বেও আদিত্যের গলা দিয়ে কিভাবে খাবার নামবে? আদিত্য প্লেট রেখে উঠে গেল। বাকি সবাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আদিত্য আর নূরকে এভাবে দেখে ওদেরও অনেক খারাপ লাগে।
রাত ১০টা
আদিত্য বেডের ওপর বসে ল্যাপটপে কিছু একটা করছিল। নূর পাশেই বসে আছে। নূর অনেকক্ষণ ধরে মনে মনে অনেক সাহস যোগাচ্ছে আদিত্যকে কিছু বলার জন্য। নূর নিজের মনকে শক্ত করার চেষ্টা করছে। নূর তোকে এটা করতেই হবে। তাছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এসব ভেবে নূর আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
…..শ শোন এ একটা কথা বলার ছিল।
আদিত্য ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই বললো।
….হ্যাঁ বলো কি বলবে?
নূর চোখ বন্ধ করে দুই হাতে বিছানার চাদর খামচে ধরে বুকের ওপর পাথর চাপা দিয়ে ঢোক গিলে বললো।
…..ব বলছিলাম যে তু তুমি আরেকটা বিয়ে করে নেও।
কথাটা যেন তীরের মতো আদিত্যর কানে যেয়ে বিঁধল। ওর মনে হচ্ছে ও নিশ্চয় কানে ভুল শুনেছে। আদিত্য এক ঝটকায় নূরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
….সরি? কেন ইউ সে ইট এগেইন? মনে হচ্ছে আমি কিছু ভুল শুনেছি।
নূর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
….তু তুমি ভুল শোন নি। আমি ওটাই বলেছি। তু তুমি আরেকটা বি,,,
আর বলতে পারলোনা নূর। আদিত্য রাগে হাতের ল্যাপটপ টা নিচে ছুড়ে ফেলে দিয়ে অত্যন্ত রাগী কন্ঠে বলে উঠলো।
….স্টপ ইটটট,,,ডোন্ট ইউ ডেয়ার নূর। আরেক বার যদি এই কথা বলেছ তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।
আদিত্য উঠে দাঁড়িয়ে চুল টেনে ধরে কতক্ষণ রুমের পায়চারী করতে লাগলো। রাগে ওর মাথার রগ ফেটে যাচ্ছে। নূর কিভাবে বলতে পারলো এই কথা? কিভাবে? আদিত্য রাগে কাচের টি টেবিলে একটা লাথি মেরে দিল। তারপর নূরের কাছে এসে নূরের দুই কাঁধ ধরে ঝাকিয়ে রাগী কন্ঠে বললো।
…..তুমি জানো তুমি কি বলছো? এমন একটা কথা বলতেও কিভাবে পারলে তুমি ? তোমার কি একবারও বুক কাঁপলো না এই কথাটা বলতে? বলো?
নূর ভেতরে ভেতরে প্রচুর ভয় পেলেও। সেটা দমিয়ে রেখে শক্ত হয়ে বললো।
….আমি যা বলেছি ভেবে চিন্তেই বলেছি। আমি বুঝতে পেরেছি যে আমি কখনো তোমাকে বাবা হওয়ার খুশী, আর বাবাকে কখনো দাদা হওয়ার খুশী দিতে পারবো না। হ্যাঁ তুমি হয়তো বলবে যে বাচ্চা এডপ্ট করি। কিন্তু সমস্যা তো আমার, তোমার তো কোনো সমস্যা নেই। তাহলে আমার জন্য তোমরা কেন স্যাক্রিফাইস করবে? তোমাদের পুরো হক আছে নিজেদের খুশী পাওয়ার। তাই আমি চাই তুমি আরেকটা বিয়ে করো।এটাই সবার জন্য ভালো হবে।
আদিত্য নূরকে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতে তালি বাজিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো
….ওয়াও নূর দেবী, তুমি কতো মহান। তোমার কোনো তুলনা হয় না। তুমি সবার চিন্তা করলে, সবার কথা ভাবলে। আর ভেবে চিন্তে ফয়সালাও শুনিয়ে দিলে। অথচ আমি নামক এই নগন্য ব্যাক্তির কথা একবারও ভাবলে না? একবারও আমার চিন্তা করলো না? তুমি এতো সেলফিশ কিভাবে হতে পারলে নূর? কিভাবে? তুমি কিভাবে ভাবলে যে আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে আমার জীবনে জায়গা দেব? বলো কিভাবে ভাবলে? আজ আমার চেয়ে তোমার কাছে বাচ্চাই বড়ো হয়ে গেল? আরে আমি কি তোমার কাছে কখনো বাচ্চা চেয়েছিলাম? আমিতো বরং তোমাকে আরও মানা করেছিলাম বাচ্চা নিতে। তাহলে তুমি আমাকে কিভাবে বলতে পারলে এই কথা? আমি তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি নূর। ইউ হার্ট মি নূর।
আদিত্যের কথায় নূরের ভেতরে ভেঙেচুরে যাচ্ছে। নূর কিভাবে বসে আছে তা শুধু ওই জানে। নূর কোনরকমে নিজেকে শক্ত করে বললো।
….এতে এতো ওভার রিয়্যাক্ট করার কি আছে? মানুষ কি দুই বিয়ে করে না? আর তাছাড়া, আমি তো আর তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি না। আমিও তো থাকছি তোমার কাছে।
আদিত্য নূরের কাছে এসে দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে আবেগি কন্ঠে বললো।
….কি হয়ে গেছে তোমার প্রানপাখী? যেই তুমি আমাকে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলাই সহ্য করতে পারতে না। সেই তুমি কিনা আজ অন্য মেয়েকে আমার জীবনে তোমার জায়গা দিতে চাচ্ছ? কেন করছ এমন?
নূর নিচের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
….সবসময় মানুষ একরকম থাকে না।পরিস্থিতির সাথে মানুষ কেও বদলাতে হয়।
আদিত্য চোয়াল শক্ত করে বললো।
….আচ্ছা তাই?তাহলে একটা কথা বলোতো,আজ যদি সমস্যা তোমার না আমার হতো, তাহলে কি তুমিও বাচ্চার জন্য অন্য ছেলের সাথে বিয়ে করে বাচ্চা নিতে?
কথাটা শোনার সাথে সাথে নূর হাত দিয়ে নিজের দুই কান চেপে ধরে বললো।
….ছিহহ,,
আদিত্য নূরের দুই হাত ওর কান থেকে নামিয়ে দিয়ে বললো।
….কেন, এখন ছিহ কেন? নিজের ওপর আসলে এখন ছিহ হয়ে গেল? এখন জবাব দাও আমার কথার?
নূর শক্ত গলায় বললো।
….এখানে আমার কথা না,তোমার কথা হচ্ছে। আর আমার কথা মানতেই হবে।
আদিত্য এবার রাগ আর সহ্য করতে পারলোনা। রাগে হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে নূরের চুলের মুঠি ধরে বলে উঠলো।
….ওকে ফাইন বাচ্চা চাইনা তোর? ঠিক আছে আমি দেব তোকে বাচ্চা। আর বিয়ের কি দরকার? এখুনি বলার সাথে সাথে আমার কাছে হাজারটা মেয়ে হাজির হয়ে যাবে, আমার কাছে শোবার জন্য। আমি তাদেরই একজনকে এনে তোর সামনেই সে** করবো। আর তুই চেয়ে চেয়ে দেখবি। কি পারবি তো?
কথাটা বলে আদিত্য নূরকে ঝটকা মেরে ছেড়ে দিয়ে রাগে হনহন করে বেড়িয়ে গেল।
আদিত্য বেড়িয়ে যেতেই নূর বিছানায় উপর হয়ে পড়ে দাঁত দিয়ে চাদর কামড়ে ধরে হৃদয়বিদারক কান্না করতে লাগলো। এতক্ষণ আদিত্যকে এসব কথা কিভাবে বলেছে তা শুধু ওই জানে। ভেতরে ভেতরে হাজার বার মরেছে ও। ওর আদিত্যকে অন্য কারো হতে বলার আগে ওর মরন কেন হলোনা? কিন্তু ও কি করবে এছাড়া যে আর কোনো উপায় নেই। নূর একটু আগের কথা মনে করলো।
যখন ও পানি নিয়ে রুমে আসছিল। তখন আদিত্যের বাবার রুমের সামনে দিয়ে আসতেই হঠাৎ নূর শুনতে পেল।আদিত্যের বাবা আবিরের বাবকে বলছে।
….তোকেতো আল্লাহ নাতীর সুখ দিল। নাজানি আল্লাহ আমার কপালে এই সুখ কবে দিবে? আদির জন্যেও চিন্তা হয়। বাচ্চা কাচ্চা না হলে ওর ভবিষ্যৎই বা কি হবে? হয়তো বাচ্চা পালক নিতে পারবে।কিন্তু নিজের সন্তানের সুখ কি আর অন্য সন্তান দিয়ে পাওয়া যায়? এখন তো বাচ আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া। আল্লাহ যেন ওদের দিকে মুখ তুলে তাকায়। নিজের শরীরের অবস্থাও বেশি ভালো না। মরার আগে একবার আদির ছেলে মেয়ের মুখ দেখে যেতে পারলে শান্তি পেতাম।
আবিরের বাবা বলে উঠলো।
…চিন্তা করোনা ভাইয়া। আল্লাহ তায়ালা ঠিকই একদিন আমাদের দোয়া কবুল করবে।
….হ্যাঁ তাই যেন হয়। মেয়েটার জন্যও খুব খারাপ লাগে। এতিম মা মরা মেয়েটা,,,
নূর আর শুনতে পারে না। ওখান থেকে চলে আসে। নিজেকে স্বার্থপর মনে হচ্ছিল তখন ওর। নিজের অক্ষমতার জন্য অন্যদের কেন শাস্তি দিবে ও। তাইতো মরমে মরে এই কথা বলেছে আদিত্যকে ও। আর এই ডিসিশন নিয়েছে। এখন আর ওকে দূর্বল হলে চলবে না।
বিশ মিনিট ধরে আদিত্য ফুল স্পিডে গাড়ী চালাচ্ছে। রাগ কমানোর জন্য এটাই একমাত্র উপায় ওর। একটা নির্জন জায়গায় এসে গাড়ি থামালো আদিত্য। মাথার চুল টেনে ধরে চোখ বন্ধ করে স্টেরিং এর ওপর মাথা ঠেকিয়ে কতক্ষণ বসে রইলো। বারবার শুধু নূরের কথাটায় ওর মাথায় ঘুরছে। কিভাবে পারলো নূর ওকে ওমন কথা বলতে? কি হয়েছে আমার প্রাণপাখীটার? নূর কি সত্যি সত্যিই আমার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে? না না এটা আমি হতে দেবনা কখনোই না। আমার প্রাণপাখীকে আমি দূরে যেতে দেবনা। কিছুতেই না।
আদিত্যের হঠাৎ মনে পড়লো ও আজও রাগের মাথায় নূরের সাথে খারাপ ব্যবহার করে এসেছে। শিট শিট শিট, আমি আবারও আমার প্রাণপাখীকে কষ্ট দিলাম। আমি কেন নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে পারিনা? কেন? ওরও তো নিশ্চয় কতো কষ্ট হয়েছে ওসব বলতে। আর আমি কিনা ওর ওপর রাগ দেখিয়ে আসলাম? ভালো করে বুঝিয়েও তো বলতে পারতাম। আমার প্রাণপাখীটা নিশ্চয় এখন কতো কান্না করছে। আমাকে এখুনি ওর কাছে যেতে হবে। এসব ভেবে আদিত্য গাড়ী ঘুরিয়ে বাসার দিকে রওনা দিল।
ত্রিশ মিনিট পর আদিত্য বাসায় পৌঁছাল। গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত ভেতরে ঢুকে দৌড়ে ওর রুমের দিকে গেল। রুমে ঢুকে দেকলো নূর কোথাও নেই। আদিত্য ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওয়াশরুমের দরজা খোলা।তারমানে নূর ওখানেও নেই। আদিত্য তাড়াতাড়ি ব্যালকনিতে যেয়ে দেখলো, নূর ওখানেও নেই। আদিত্য এবার ঘাবড়ে গেল। কোথায় চলে গেল নূর? রাগ করে কোথাও চলে গেল নাতো? আদিত্য দৌড়ে ছাদে এসে দেখলো ছাদেও নেই নূর। আদিত্য এবার আরও ভয় পেয়ে গেল। আদিত্য ফোন বের করে নূরের নাম্বারে ফোন দিল। কিন্তু ওর ফোন বন্ধ আসছে। আদিত্যর নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। ও নিচে এসে সবাইকে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। আদিত্যের ডাকে সবাই বেরিয়ে এলো। আদিত্য সবার দিকে তাকিয়ে বললো।
….নূর কোথায়? নূরকে দেখেছ তোমরা?
আদিত্যের বাবা বলে উঠলো।
….নূর কোথায় মানে? ওরতো রুমেই থাকার কথা।
…রুমে নেই ও। কোথাও চলে গেছে।আসলে আমাদের মাঝে একটু রাগারাগি হয়েছিল। আমি কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়েছিলাম। এসে দেখি নূর রুমে নেই। তোমারা কি কেউ দেখেছ ওকে?
সবাই বললো না ওরা কেউ দেখেনি। আদিত্য আরও হতাশ হয়ে গেল। তাহলে কি ওর প্রাণপাখী সত্যি সত্যিই দূর হয়ে গেল। নিজেকে খুন করতে ইচ্ছে করছে ওর। বারবার আমার ভুলের জন্য আমি আমার প্রাণপাখীকে হারিয়ে ফেলি। কি করবো এখন আমি? কোথায় খুঁজব ওকে?
হঠাৎ আদিত্যের ফোন বেজে উঠল। আদিত্য দেখলো নূরের বাবা ফোন করেছে। আদিত্য তাড়হুড়ো করে ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে নূরের বাবা বললো।
….বাবা আদিত্য তোমার কি নূরের সাথে কিছু হয়েছে?
আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
….কেন বলুনতো?
…না আসলে নূর এতরাতে একা বাড়ি আসলো।
….তারমানে নূর আপনাদের ওখানে গেছে?
….হ্যাঁ
আদিত্য একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এতক্ষণে ওর দেহে প্রাণ এলো।
নূরের বাবা আবার বললো।
…..আমি জিজ্ঞেস করলাম তা কিছু বললো না। বললো এমনি ইচ্ছে হয়েছে তাই এসেছি। তোমার ভালো না লাগলে এখুনি চলে যাচ্ছি। ওর কথায় বুঝতে পারলাম, নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে। তাই আর ওকে কিছু বললাম না। ওতো আমাকে তোমার কাছে ফোন করতেও নিষেধ করেছিলো। কিন্তু আমি ভাবলাম তুমি হয়তো চিন্তা করছ তাই তোমাকে জানালাম।
….আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ বাবা। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি এখুনি আসছি। আমি এসে সব ঠিক করে দেব।
….ঠিক আছে বাবা।
আদিত্য ফোন রেখে দ্রুত বাইরে এসে গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি চালাতে চালাতে মনে মনে বললো, আমি তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে যেতে দেবনা প্রাণপাখী। আমি আসছি, আমি এসে তোমার সব রাগ ভাঙিয়ে দেব।
চলবে…..