ভালোবাসার ফোড়ন ২ পর্ব-৫৩+৫৪+৫৫

0
844

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৫৩

হুট করেই নানা হেসে উঠেন। তার হাসির আওয়াজ চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছিল। নানা হাসতে হাসতে বলেন,

“বুঝলে গো আরিফের মা ( আরিফ হলো বড় মামার নাম ) তোমার নাত বউ তোমার মতোই হয়েছে। মনে আছে তোমার কথা। নতুন নতুন বিয়ে হবার পর এভাবে কাছে বসে পেয়ারা, আম , তেঁতুল কতো কিছু খেলে। কতো বকা খেয়েছিল এজন্য তোমার শাশুড়ি’র‌ কাছে মনে আছে।

নানু রুদ্ধ চোখে একবার নানা ‘র দিকে তাকাল। নানা চুপ হয়ে গেল। অতঃপর নানু বলে,
“তোমরা সবাই যাও এখান থেকে, বাড়ি যাও সবাই!

নানুর কথায় সবাই বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে। আহিয়ান একবার থাকতে চাইলে নানু তাকেও বলে চলে যেতে। অতঃপর উনিও চলে গেলেন।
নানু এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,
“কি গো নাত বউ সারাদিন কি গাছে থাকবে বলে ঠিক করে রেখেছ নাকি। নেমে এসো জলদি!

আমি ভয়ে ভয়ে গাছ থেকে নেমে নানুর সামনে এসে মাথা নিচু করে নিলাম। নানু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর শীতল গলায় বলেন,

“বাসায় চলো!

বলেই তিনি হাঁটা ধরলেন। আমি উনার পাশে পাশে হাঁটছি। কিছুক্ষণ হাটার পর নানু বলে উঠেন,

“আমার বিয়ে অনেক কম বয়সে হয়েছিল, বুঝলে নাত বউ! আমার যখন প্রথম সন্তান হয় তখনও আমার বয়স অনেক কম। আমি কিছুই জানতাম না তখন। রান্না বান্না এসব আমার শাশুড়ি করতেন আর আমি তাকে সাহায্য করতাম। আমার কাজ ছিল শুধু গাছে চড়া আর লাকড়ি যোগাড় করা। তখন আমাদের দিঘিতে অনেক মাছ ছিল। আমরা ঘরের বউরা কাপড় পেতে মাছ ধরতে পারতাম। আহ কতোই না দিন ছিল সেগুলো!

বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। নানুও দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত রেখে বলেন,

“তোমাকে দেখে আজ সেদিনের কথা মনে পড়ল আমার। আমার সেই শৈশব স্মৃতি!

বলেই মুচকি হাসি দিলেন। অতঃপর আবারো হাঁটা ধরলেন। আমি কিছুক্ষণ সেখানেই নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কারন এই প্রথম নানু আমার দিকে তাকিয়ে হেসে কথা বললেন।‌ আমার মাথায় হাত রাখলেন।‌ কেন জানি খুব খুশি খুশি লাগছিল। কিছু একটা পেয়ে গেছি আমি!

বাড়িতে আসার পর দেখি টেনশনে সবাই অস্থির। সবাই তো ভেবেই নিয়েছিল আমাকে নাকি নানু গাছের সাথে বেঁধে রাখবে। নানুকে আমি হাত ধরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে এলাম। নানু সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“সবাই এখানে লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কাজ কাম নেই তোদের। না থাকলে আমি বলে দেই, রোদ চলে গেছে, সন্ধ্যা নামছে। ছাদ থেকে মরিচ আর আচার গুলো নিচে নিয়ে আয়। আর জামাকাপড় গুলো আনতে ভুলিস না।

নানুর কথায় কিছু মেয়ে মাথা নেড়ে উপরের দিকে হাঁটা ধরল আর বাকি রা রান্না ঘরে গেল। নানা কিছু বলতে গেলে নানু তার দিকে তাকাতেই তিনি চুপ হয়ে গেলেন। বোঝাই যাচ্ছে নানা খুব ভয় পায় নানু কে। অতঃপর নানুর কাছে আহিয়ান এলো। উনি আসতেই নানু তার হাত চেপে ধরলেন। বলে উঠেন,

“তোরা আয় আমার ঘরে! ( নানার দিকে তাকিয়ে) তুমিও আসো!

অতঃপর নানু আহিয়ানের হাত ধরে চলে গেলেন। উনার পিছন আমি আর নানা গেলাম। নানা আমার মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করছেন,

“তোমার নানু কিছু বলেছে

“না নানা, বলে নি।

“তাহলে আর বলবেও না। কিন্তু এখন কেন ডাকছে!

“সেটা তো গেলেই বুঝতে পারব

“চলো!
.
নানু বিছানায় বসা আর নানা সোফায়। তাদের মাঝে আমি আর আহিয়ান দাঁড়িয়ে আছি।‌ নানু শাড়ির আঁচল থেকে চাবির গোছা টা বেঁধে বলেন,

“আহি!

“জ্বি নানু!

“শুনলাম তুই নাকি পালিয়ে বিয়ে করেছিস!

পালিয়ে বিয়ে করেছিস শুনেই আমার বুক টা মোচড় দিয়ে উঠলো। আহিয়ান শান্ত ভাবেই বলল,

“হ্যাঁ, উকিল আনিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে বিয়ে করেছি।

“আমি এতো রেজিস্ট্রেশন বেজিস্ট্রেশন বুঝি না বাপু। ভালো করে বল।

নানা বলে উঠে,
“কাগজে কলমে বিয়ে হয়েছে।

নানু বলে উঠে,
“হ্যাঁ গো কি বলছো! তাহলে তোদের কাজী ডাকিয়ে কালিমা পড়ে বিয়ে হয় নি।

নানুর কথায় আমি আর আহিয়ান দুজনেই মাথা নেড়ে না বলে। নানু অস্থির হয়ে বলেন,

“হায় আল্লাহ কি বলে। তাহলে এই বিয়ে নিয়েই তোরা এতোদিন আছিস। কেন রে তোদের কি টাকার অভাব ছিল যে কাজী ডাকিয়ে বিয়ে পড়াতে পারলি না।

আমি আড়চোখে আহিয়ানের দিকে তাকালাম। উনিও সেই ভাবেই আমার দিকে তাকালেন। নানা উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,

“এতো অস্থির হয়ো না।

“অস্থির হবো না বলছো। আমার নাতি আর নাতবউ কি করছে তুমি বুঝতে পারছো না।

“পারছি আর তাই বলেই বলছি অস্থির হয়ো না। কাজী ডাকিয়ে বিয়ে যখন হয় নি তখন এইবার হবে। তুমি তোমার মেয়ে কে ফোন করে বলে দাও ওরা শহরে পৌঁছানোর পর’ই যেন বিয়ের ব্যবস্থা করে।

নানু আমাদের দিকে তাকিয়ে রেগে বলেন,
“তোরা দুই হতছাড়া আর হতছাড়ি বের হো ঘর থেকে।

নানুর ধমক আমরা দু’জনেই বের হয়ে এলাম। বাইরে এসে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেললাম। হঠাৎ উনি আমার মাথার‌ চুল টেনে বলে,

“তোমার জন্য আমিও বকা খেলাম নানুর কাছে।

“কি বললেন, বলুন আপনার জন্য আমি বকা খেয়েছি

“ওহ আচ্ছা গাছে তো আমি উঠেছিলাম না!

“নানু মটেও সেই কারনে বকে নি। বকেছে বিয়ের জন্য।

“সেই রাগ তো আমার উপর ঝেড়েছে।

“আপনার উপর’ই ঝাড়া উচিত। দোষ তো আপনার’ই। আমার তো বলা উচিত ছিল আপনি আমার জোড় করে বিয়ে করেছেন।

উনি চোখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,
“কি বললে তুমি!

“শুনেন নি বলেছি আপনি আমায় জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছেন। ভুলে গেছেন সেই কথা।

“ভূতনি একটা! দাঁড়িয়ে আছো কেন যাও বলে দিয়ে আসো।

“হ্যাঁ তাই যাবো!
বলেই নানুর ঘরে দিকে যেতে নিলাম। এর আগেই আহিয়ান আমার হাত ধরে টেনে তার সামনে নিয়ে আমার দুই হাত পিছনে করে জোরে চেপে ধরে বলে,

“যাও এখন।

“এটা কি ধরনের কথা। হাত ধরে আটকে রেখে বলছেন যেতে।

“হ্যাঁ যাও, তুমি তো ভূতনি,তোমার তো পাখা আছে যাও উড়ে উড়ে যাও।

“বেশি হচ্ছে কিন্তু, এখন চেঁচিমেচি করলে কি হবে জানেন।

উনি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে টেনে আমাকে ঘরে নিয়ে এলেন। অতঃপর ছেড়ে দিয়ে বলেন,

‘নাও চেচাও!

আমি রেগে জোরে চিৎকার করে নানু কে ডাকতে যাবো এর আগেই উনি আমার মুখে ফট করে মোয়া ঢুকিয়ে দিলেন। আমি পাশে তাকিয়ে দেখি কিছু মোয়া নাড়ু এসব প্লেটে ছিল। আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি হাসতে হাসতে বলেন,

“নাও এবার যতো ইচ্ছে চেচাও!

বলেই প্লেট টা নিয়ে বিছানায় উঠে খেতে লাগলেন। আমি মোয়া হাতে নিলাম। ইশ ফট করে মুখে ঢুকিয়ে দেওয়ায় ব্যাথা পেয়েছি। বজ্জাত লোক একটা!
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি উনি এখনো ঘুমাচ্ছেন। ঘরে আবছা আবছা আলো এর মানে বাইরে আলোকিত হয়ে গেছে। বাইরে পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমি বিছানায় ছেড়ে উঠে জানালার পর্দা টা টেনে সরিয়ে দিলাম। পুরো ঘর আলোয় ভরে গেল। জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। বসন্তের শেষ সময় চলে আসছে। কোকিলের ডাক শোনা যাচ্ছে। সেও ডাকছে নাহ গান গাইছে। ভালোই লাগছে এমন একটা দৃশ্য। বাইরে চারদিক গাছপালায় ঘেরা এখানে পাখির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। আকাশের পাখিরা একের পর এক উড়ে যাচ্ছে নিড়ের সন্ধানে। আমি এখানে বসে দু নয়ন দিয়ে দেখছি এসব। বাতাস জোরে বেয়ে যাচ্ছে। আমি জানালার সাথে ঘেসে দাঁড়িয়ে সেই বাতাস অনুভব করার চেষ্টা করছি। জানি না আর কবে দেখতে পারবো এসব। আবার কবে ভাগ্য হবে আমার এসব দেখার। আমার সময়ও যে ঘনিয়ে আসছে। আজ’ই চলে যাবো এখান থেকে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার কাছ থেকে সরে বিছানায় এসে বসলাম। উনার আর আমার মাঝে বালিশের দেওয়াল। আজ পর্যন্ত কখনো ঘুমের ঘোরে উনি এদিকে আসেন নি আর না আমি গেছি। আমরা দুছনেই কমফোর্টেবল হতে শিখে গেছি।

হঠাৎ’ই ফোনটা বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখি মা ফোন করেছে। আমি ফোনটা রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে মা বলেন,

“নিহা!

“জ্বি মা।

“উঠেছ ঘুম থেকে।

“মাত্র উনি এখনো ঘুমাচ্ছেন।

“এটা তো জানা কথাই। আচ্ছা তোমারা কখন আসছো।

“রাতের দিকে রওনা দেবো।

“দেখো রাতে সাবধানে এসো।

“জ্বি মা আসবো। ইয়ানের কথা শুনতে পাচ্ছি, ও আছে আশেপাশে।

“আছে বৈ কি, এখানে ইয়ান যে জ্বালিয়ে মারছে আমাকে। পাগল হয়ে গেছে তোমাকে আর আহি কে দেখার জন্য।

আমি হেসে বলি,
“আচ্ছা একটু দিন ইয়ান কে।

অতঃপর ইয়ান কে ফোন দেওয়া হল। খানিকক্ষণ কথা বললাম ওর সাথে। আহা বেচারা আমার আর আহিয়ানের জন্য বেশ কষ্ট পাচ্ছে। তার সাথে কথা বলার সময় বুঝলাম তার গলা ভারী হয়ে আসছিল।

#চলবে….

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৫৪

রাতের বেলা, চারদিক অন্ধকার। ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি ড্রাইভ করছে আহিয়ান। উনার পাশে বসে আছি আমি। গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। তার সাথে একটা গান বাজছে। বাংলা গান উনার গাওয়া সেই গান টা। “তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবো না”!

সব মিলিয়ে ভালোই লাগছে।‌ হয়তো আজ সারারাত উনাকে ড্রাইভ করতে হবে। বেচারার অনেক কষ্ট হবে মনে হচ্ছে। আমি কিছুক্ষণ উনার দিকে তাকিয়ে আছি। ক্লান্তিহীন ভাবে তাকিয়ে আছে সামনের দিক। একবার উপরের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। তার ঠোঁটের কোনে হাসি দেখে আমার ঠোঁটে ও হাসি ফুটল। উনি বলে উঠেন,

“ভূতনি তুমি দেখছি নজর লাগিয়ে দিবে আমায়।

আমি মুখ ভেংচি দিয়ে বাইরের দিক তাকালাম। উনি বলে উঠেন,
“কি হলো নজর লাগানো শেষ!

আমি উনার দিকে ফিরে চোখের কাজল হাতে নিয়ে উনার কানের পিছনে লাগিয়ে দিয়ে বলি,

“নিন কাজল লাগিয়ে দিলাম, এখন আর নজর লাগবে না।

আমার এমন কান্ড তে উনি খিলখিলিয়ে হাসলেন। আমিও হেসে নিজের সিটে বসলাম। গান বাজছে নিম্ন স্বরে। শুনতে খারাপ লাগছে না। আমার চোখ গেল হাতের দুই বালার দিকে। সোনার বালা দুটি নানু নিজে আমাকে পরিয়ে দিয়েছেন। আমি তাকিয়ে ছিলাম উনার চোখের দিকে। না আজ উনার চোখে আমি হতাশা দেখি নি। বরং দেখেছি আমার জন্য থাকা সূক্ষ্ম ভালোবাসা। নানুর চোখে ভালোবাস দেখে আমার খুব ভালো লাগছিল। নানু আমার দুই হাতে বালা পড়াতে পড়াতে বলেন,

“যখন আমি এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলাম তখন আমার নানি শাশুড়ি আমার হাতে দুটি সোনার বলা পরিয়ে দিয়েছিলেন। আজ সেই রীতি আমিও করলাম। আমার হাতের বালা তোমাকে পড়ালাম বুঝলে গো নাতবউ।

“জ্বি নানু !

নানু হেসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। অতঃপর একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সবাই অনেক আদর করল আমায়। মামিরাও কিছু উপহার দিলেন।
তিন্নি আর তিথি কে খুব মনে পড়বে। খুব ভালো সময় কাটিয়ে ওদের সাথে!

গাড়ির হর্ন এর শব্দে আমার ঘোর কাটল। আমি একটু নড়েচড়ে উঠলাম। আশপাশ তাকাচ্ছিলাম। গাড়ি আসছে আর যাচ্ছে কোন সীমাবদ্ধতা নেই আশেপাশে। গানটা শেষ হয়ে গেছে। অন্য একটা গান শুরু হলো। কে জানে কি গান। সবে সুর শুরু হলো। এই সুর শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। তবে কেন জানি মনে হচ্ছিল গানটা তখনও আমার কানে বাজছিল।

ঘুমের মাঝে একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্ন টা ছিল এমন যে আমি আর আহিয়ান পাশাপাশি হাটছি। ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে। আমাদের মাথার উপর কোন ছাতা ছিল না। দুজনেই ভিজে একাকার হচ্ছি তবুও যেন খারাপ লাগছে। ভালোই লাগছে এভাবে হাঁটতে। এভাবেই হাঁটতে লাগলাম এর মাঝেই দু’জন দু’জনের হাতের ছোঁয়া পেলাম। আমার শরীর শিহরিত হয়ে গেল। কেঁপে উঠলাম আমি।‌‌ হুট উনি আমার হাতটা আলতো ভাবে ধরলো। ঘুম ভেঙে গেল আমার। আমি চোখ খুলে আশপাশ তাকাতেই বুঝলাম আহিয়ানের ঘাড়ে আমার মাথা। স্বপ্নের কথা মাথাতে আসতেই আমার শরীর আবারো কেঁপে উঠলো। আমি দ্রুত সরে বসলাম উনার কাছ থেকে। উনি হেসে বলেন,

“ঘুম ভেঙ্গেছে তোমার ভূতনি!

“হুম।

“ভালোই ঘুম দিলে, তা একটু চা খাওয়াতে পারবে আমায়।

“দিচ্ছি!

খানিকক্ষণ বাদেই উনি কোথায় গাড়ি থামালেন একটা বীজ্রের উপর। বোতল থেকে পানি বের করে মুখে পানি ছিটালেন। আমি ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে উনাকে দিলাম। উনি আমার সিটের সামনে দাঁড়িয়ে চা খেলেন। আর আমি গাড়ির ভিতর। গাড়ির দরজা টা খোলাই ছিল। তাতে হাত রেখে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করলেন আমার সাথে। অতঃপর আবারো গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। রাত যতোটা গভীর হতে থাকল ততোটাই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল।
.
ভোরে হয়ে গেল বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে। গাড়িতে বসে থেকে বাইরে ভোর হওয়া দেখলাম আজ। বেশ মনোমুগ্ধকর ছিল তা। আকাশে সূর্য উঁকি দিতে না দিতেই পাখিরা নীড়ের খোঁজে দল বেঁধে বের হয়ে গেছে। মেইনরোডএ কিছু কর্মী রাস্তায় ঝাড়ু দিচ্ছে। আমিও উনার সাথে আজ সারারাত জাগলাম। মাঝখানে একবার শুধু ঘুমিয়েছিলাম। তারপর উনার সাথে চা খাবার পর আর ঘুমোলোম না।

বাড়ি পৌঁছে দেখি দরজার সামনে মা আর বাবা দাঁড়ানো। তাদের সাথে দেখা করার পর দুজনেই রুমে এলাম। ইয়ান এখনো ঘুমাচ্ছে। মজার ব্যাপার ছিল ইয়ান আমাদের ঘরে ঘুমাচ্ছিল। আমি তাকে ঘুমের মাঝেই একটা চুমু খেলাম। উনিও চলে গেলেন ফ্রেস হতে। একবারে শাওয়ার নিয়ে বের হলেন। আমি ততোক্ষণে উনার জন্য বসে ছিলাম। বজ্জাত লোক একটা। শাওয়ার নিয়ে বলে জামাকাপড় দিতে। জামাকাপড় ছাড়াই এসেছিল গোসল করতে আর এখন বলছে জামাকাপড় দিতে। দরকার ছিল না জামাকাপড় দেওয়ার। অসভ্য লোক একটা।

শাওয়ার নিয়ে এসে দেখি ইয়ান কে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে গোমরামুখো টা। ইচ্ছে তো করছিল তার ঘুমের মাঝে জল ঢেলে দেই কিন্তু ইয়ান ছিল বলে বেঁচে গেল।
হঠাৎ করেই দরজা নক করার আওয়াজ পেলাম। আমি তাকিয়ে দেখি মা। অতঃপর উনার সাথে কথা বললাম। উনি চাইলেন ইয়ান কে নিয়ে যেতে আমি না করে দিলাম। ভালোই লাগছে ও এখানে। আম্মু আমাকে ঘুমানোর কথা বলে চলে গেল। আমিও এসে ইয়ানের পাশে ঘুমিয়ে পড়লাম। ইয়ানের মুখটা ছিল আমার দিকে। উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল ও। আমি ওর মাথায় কিছুক্ষণ হাত বোলানোর পর ঘুমিয়ে পড়লাম!
.
ঘুম ভাঙতে ভাঙতে অনেক বেলা হয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে দেখি দুপুর ১ টা বাজে।‌ বাহ ভালোই তো ঘুমিয়েছি আমি। ওপাশে তাকিয়ে দেখি উনি এখনো ঘুমিয়ে আছেন কিন্তু ইয়ান নেই। তবে এখানে আমার মনে হলো আমি কিছুটা ভুল দেখলাম। উনার মুখে কিসব আঁকা। আমি চোখ কচলিয়ে আবারো ভালো মতো দেখলাম। আসলেই উনার মুখে কিসব আঁকা। আমি হাত দিয়ে উনার চোখটা ধরতেই উনি নড়েচড়ে উঠলেন। সাথে সাথে আমি সরে গেলাম। অতঃপর উনার মুখটা ভালো মতো দেখলাম। কোন একটা সমুদ্রের ডাকাত দলের লিডার মনে হচ্ছিল উনাকে। চোখের ধারে লাল রঙের কালি দিয়ে গোল দেওয়া। এছাড়া উনার দাড়ির ওখানেও আঁকাআঁকি করা। উনার এই মুখের হাল দেখে না হেসে পারলাম না। জোরে জোরে হাসতে শুরু করলাম আমি।

আমার হাসিতে উনার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উনি একটা কুশন দিয়ে আমার মাথায় মেরে বালিশে মুখ গুজে বলেন,

“ভূতনি পেত্নির মতো হাসা বন্ধ করো, ঘুমোতে দাও আমায়।

“আমি না হয় ভূত বা পেত্নি কিন্তু আপনাকে তো ডাকাত দলের সর্দার লাগছে।

বালিশ থেকে মুখ সরিয়ে,
“মানে…

“আয়নায় গিয়ে দেখে আসুন!

উনি উঠে একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে আয়নায় সামনে গেল। উনার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি মারাত্মক রেগে যাচ্ছেন উনি। উনি আয়ানার দিকে তাকিয়েই বলে উঠেন,

“ভূতনি এসব তোমার কাজ নাহ!

“কি, পাগল হয়েছেন নাকি। আমি এসব কেন করবো!

“কেন করবে, দাঁড়াও দেখাচ্ছি!
বলেই আমার দিকে তাকালেন। অতঃপর নিরব হয়ে গেলেন। আমি উনার এই নিস্তব্ধতার মানে বুঝতে পারলাম না। আচমকা উনি হেঁটে আমার কাছে আসতে লাগলেন। উনার চাহনি বেশ অদ্ভুত লাগছিল। উনি কাছে এসেই হাত বাড়িয়ে আমার ঠোঁটের দিকে ধরতে গেলেন। আমি উনার হাতে বাড়ি মেরে বলি,

“কি করছেন?

হঠাৎ করেই উনি জোরে জোরে হেসে উঠলেন। উনার হাসি মানেই আমার মুখের অবস্থা ও বেশি ভালো না। দেরি না করে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।‌ নিজেকে নিজে দেখেই চমকে উঠলাম। এটা আদৌও আমি নাকি। এ কি হাল আমার মুখের। ঠোঁটে থেকে নিচ অবদি লাল কালি দিয়ে রঙ করা। মনে হচ্ছে কারো রক্ত খেয়েছি। এছাড়া আমার ভ্রু গুলোতেও আঁকাআঁকি করা। গালেও কিসব আঁকা। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। বলে উঠি,

“এসব কি হাল আমার মুখের!

পেছনে উনার হাসি যেন থামছেই না। উনি হাসতে হাসতে বলেন,

“এখন একদম ভূতনি ভূতনি লাগছে তোমায়!

বলেই হাসতে হাসতে উনি বিছানায় শুয়ে পড়েন। তবুও হাসি থামে না। আমি উনার সামনে এসে কোমরে হাত দিয়ে বলি,

“এভাবে হাসবেন না আপনার মুখের অবস্থাও কিন্তু বেশি একটা ভালো না।

উনি উঠে বসে বলেন,
“তোমার থেকে বেটার।

মুখ ভেংচি কেটে বলি,
“রাখুন তো আপনার সাথে কথা বলাই বেকার। আজ ইয়ান কে পাই তখন বোঝাব।

বলেই যেতে নিলাম। তখন’ই শাড়িতে টান খেলাম। বুঝে গেলাম উনি ধরেছেন। পিছনে ফিরে জিজ্ঞেস করি,

“কি হয়েছে এখন আবার।

“এভাবে বাইরে যেও না প্লিজ।

“এমন ভাবে বলছেন যে অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার।

“আরে কষ্ট তো হবেই..

“কেন হবে, সবাই আপনার বউ কে নিয়ে হাসবে বলে।

” সেটা কোন ব্যাপার না কিন্তু কথা হলো তুমি এভাবে গেলে তারা ভয় পেয়ে হার্ট অ্যাটাক করবে তখন ক্ষতি তো আমার’ই হবে না বল।

বলেই দাঁত বের করে হেসে দিলেন। আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলি,

“আপনাকে আমি…

উনি দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন। আবারো লাগলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ !
.
নানু বিয়ের কথা মুখ দিয়ে বের করতে দেরি কিন্তু মা’র বিয়ের কাজ শুরু করতে একটুও দেরি করেন নি। সন্ধ্যা বেলা নিচে এসে দেখি তিনি অলরেডি বিয়ের তারিখ থেকে শুরু করে কার্ড অবদি বানিয়ে ফেলেছেন। তার এমন কর্মকান্ডে আমি আর উনি দুজনেই অবাক। অতঃপর বিয়ের কার্ড মেহমানদের দেওয়াও শুরু হয়ে গেল। এমনকি কেনা কাটাও শুরু হয়ে গেল। বিয়ের শাড়ি মা’র কিনলেন তার পছন্দ মতো। ধরতে গেলে সবকিছু তিনি নিজের হাতেই করেছেন। আমার মা বাবা চাচা আর উনার নানুদের ও আসতে বলা হলো। সপ্তাহ খানিক এর মধ্যে তারা চলেও এলো। এমনকি মিতু আর মুন্নি আপু , দাদা দাদি তাদেরও নিমন্ত্রণ করা হলো।

মা নিজেই এসব দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি আহিয়ানের প্রত্যেক বন্ধুদের নিজে দাওয়াত করলেন। আর এদের মধ্যে নিতিও ছিল। তারা বিয়ের দুদিন আগে বাড়িতে চলে আসল। পুরো বাড়িতে একটা জমজমাট ব্যাপার শুরু হলো। মেহমান এ ভর্তি চারদিক। কোথাও গিয়ে এক দন্ড বসে থাকার জো নেই। এর মাঝে শুধু একটু শান্তি ছিল নিজের ঘর। কিন্তু তাও ছেড়ে দিতে হলো। ইতি আর আকাশ ভাইয়ার এক করা আমরা দু’জন বিয়ের আগে এক ঘরে থাকতে পারবো না। তারা শুধু সুর তুলল এরপর যা হবার এমনে এমনেই হয়ে গেল।

শুধু গায়ে হলুদ আর বিয়ের অনুষ্ঠান‌ হবে বলে ঠিক করে করা হলো। বিয়ের সব অনুষ্ঠান ছাদেই হবে। তাই সেখানে সাজানো শুরু হয়ে গেল। রাতে আমি ইতি আর আপু একসাথে ঘুমাতাম। আর আমাদের সাথে ইয়ান ও ছিল। ভালোই লাগতো বেশ রাত অবদি সবাই গল্প করতাম। অতঃপর গায়ে হলুদের দিন..

#চলবে….

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৫৫ ( #বাসর_বিলাস )

আজ আমার গায়ে হলুদ প্রথমবারের মতো কিছু বিয়েটা দ্বিতীয়! কি অদ্ভুত না বিষয় টা। আমার কাছে কিন্তু বেশ অদ্ভুত লাগছে আমার মজাও লাগছে। গায়ে হলুদের দিন সকাল বেলা ঘুম থেকে যখন উঠে তখন আমার পাশে কাউকে দেখতে পাই নি। এমনকি ইয়ান কেও না। এ ছেলেটা এতো সকাল সকাল উঠে না কিন্তু আজ কি হলো কে জানে। এতো ভোরে উঠে গেল পিচ্চিটা। আমার ধারনা পিকু কে কোলে নিয়ে সে পুরো ঘুর ঘুরে বেড়াচ্ছে! ঘর ভর্তি এতো মানুষ দেখে ইয়ান’ই সবচেয়ে বেশি খুশি।

আমি বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেস হয়ে এলাম। অতঃপর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বাইরে একটু উঁকি দিতেই আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। বাগানে নতুন নতুন ফুল ফুটেছে। আমার চোখ কারল জবা ফুল। হ্যাঁ এটা জবা ফুল’ই‌ । অবশেষে এই ফুলটা ফুটেই গেল। এছাড়া বাড়ির গেট ফুল দিয়ে সাজানো। ভালোই লাগছে এসব দেখতে।

আমি হাঁটতে হাঁটতে ঘরের বাইরে চলে এলাম ‌। মনে মনে একটা কথা ভাবছি। আর তা হলো এক কাপ গরম চা নিয়ে সোজা চলে যাবো বাগানে। সেখানে ফুল বিলাস করবো আর তার সাথে চা ও‌। এক কাজ হয়ে যাবে।

ঘর থেকে বের হতেই শোরগোল আমার কানে এলো। নিচে তাকিয়ে দেখি সব মেয়েরা গোল হয়ে বসে আছে। আর কি সব বকছে। আমার কানে কিছুই আসছে না এতো চেঁচামেচি কে কি বলছে কিছুই ঠিক করে বোঝা যাচ্ছে না। বাইরে থেকে এসময় আকাশ ভাইয়া আর নাহান তারাও এলো। তারাও যোগ দিল। মেয়ের দল গুলো ওদেরো ছাড়লো না। নিতি ওরা এক কোনে বসে সব কিছু দেখছে। তবে এখানে মজার বিষয় ছিল সিফাত আসে নি। আচ্ছা তাকে কি ইনভাইট করা হয় নি নাকি সে নিজেই আসে নি। কিন্তু উনাকে আর ইয়ান কে চোখে পড়ল না আমার।

সবার থেকে এড়িয়ে রান্না ঘরে চলে এলাম। সার্ভেন্ট রা মেহমানদের জন্য রান্না করতে করতে ব্যস্ত। আমি তাদের মাঝে ফাঁকে ফাঁকে এক কাপ চা বানিয়ে ফেললাম। অতঃপর বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে চলে এলাম। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাগানের কাছে চলে এলাম। বাগান দেখছি আর চা খাচ্ছি। হঠাৎ মনে হলো কিছু একটা আমার পায়ে বাজল। আমি পিছনে ফিরে দেখি ইয়ান দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে ফুটবল যা একটু আগে নিচ থেকে কুড়িয়ে নিল। ইয়ান ফুটবল খেলছে কিন্তু কার সাথে। আমি পিছনে তাকিয়ে দেখি উনি আসছে।‌ তার মানে তারা দুজন এখানে খেলছিল। এজন্য’ই ভিতরে তাদের দেখলাম না।

“আরে ভূতনি, একা একা চা খাচ্ছো!
বলেই আমার চায়ের কাপ টা নিয়ে গেল।

“আরে এটা তো আমার।

“কিন্তু এখন আমার, এটা আমি খাবো।

“কিন্তু এটা তো আমার।

“তো, মনে আছে একবার আমার থেকে এভাবে চা নিয়ে খেয়েছিলে তুমি।

“তার বদলে আমার চা আপনি খেয়েছিলেন তা ভুলে গেছেন।

“না ভুলি নি তবে আমার থেকে কিছু চেয়ো না আমার কাছে কিছু নেই।

বলেই আমার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফেলল। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি।

“কেন নেই, ভিতরে যান খেতে পারবেন।

“কোনমতে না। এখন গেলেই সবাই আমাকে ঝাপ্টে ধরবে। বাবা অনেক কষ্টে বেঁচে এসেছি।

হঠাৎ ইয়ান বলে উঠে,
“আহি ফুটবল খেলবা না।

“ওই তো তোমার ভূতনি আম্মু আছে তার সাথে গিয়ে খেলো এখন।

ইয়ান আমার দিকে তাকাল। আমি বলে উঠি,
“আমি তো খেলতে পারি না।

“আচ্ছা আমি শিখিয়ে দেবো আসো।

বলেই আমার হাত টেনে নিয়ে গেল। অতঃপর আমি আর ইয়ান খেলছি। আমি একবার তার দিকে বল দিচ্ছি আরেকবার সে বল দিচ্ছে আমাকে। সকাল টা এভাবেই কাটল আমার। আর উনি দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর আমাদের দেখছেন।
.
বিকেল থেকে সবাই আমাকে আয়নার সামনে বসিয়ে রেখেছে যেখানে অনুষ্ঠান শুরু সন্ধ্যার পর। আমি বুঝে উঠতে পারছি না তারা এতোক্ষণ কেন আমাকে বসিয়ে রেখেছে। এতো সাজগোজের কি দরকার। এটা কি আমার প্রথমবার বিয়ে নাকি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আমাকে একটা হলুদ রঙের ভারী লেহেঙ্গা পড়িয়ে পুতুলের মতো বসিয়ে রাখা হয়েছে। শুধু কি তাই তার সাথে মুখে এক গাদা কি সব দিয়েছে। নিজেকে নিজেই চিনতে পারছি না। যদিও দেখতে অতোটা খারাপ লাগছিল না কারন মেকাপ টা আমার মুখের সাথে মানানসই ছিল। তবুও কেন জানি নিজেকে খুব অস্বাভাবিক লাগছিল। সাজগোজের উপর বরাবরই আমার আমার আগ্রহ কম।

চুল গুলো পিছনে ছেড়ে দিয়ে তার উপর একটা ফুল দিয়ে দিল। হলুদ রঙের একটা ফুল তবে এটা আসল না। তাদের এই কার্যক্রম শেষ হতে হতে রাত হয়ে গেল। এতোক্ষণের কার্যক্রম শেষে আমাকে উপরে নিয়ে গেল অর্থাৎ ছাদের উপর। ছাদের ডেকোরেশন দেখে আমি হতবাক হলাম। পুরো ছাদ’ই লাইটিং করা দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। আমাকে সবাই ধরে স্টেজের সামনে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি চোখ তুলে তাকাতেই দেখি সামনে আহিয়ান বসে আছে। তাকে দেখতে বেশ সুদর্শন লাগছে। কেন জানি আজ বেশ সুন্দর’ই লাগছে। উনার কোলে উনার মতোই পাঞ্জাবি পড়ে ইয়ান বসে আছে। আজ ওকে দেখতে পুরোই আহিয়ান আহিয়ান লাগছিল। আমার পাশে ইতি ছিল সে বলে উঠে,

“ভাইয়া আর কতোক্ষণ ওখানে বসে থাকবেন। আসুন বউ কে ধরে নিয়ে যান!

উনি হেসে বলে উঠেন,
“আসছি!

অতঃপর সেখান থেকে উঠে আসেন। হলুদ রঙের পাঞ্জাবিতে আজ বেশ লাগছে তাকে। পাঞ্জাবিতে কিছু সূক্ষ্ম হাতের কারুকাজ এর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। উনি এসে হাত বাড়ালেন। আমি হাত ধরতে যাবো ওমনি তিথি আমার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,

“হাত না ধরে নিয়ে যাও তো দেখি!

পেছন থেকে আকাশ ভাইয়া বলে উঠে,
“হাত না ধরে নিতে গেলে তো নিহা কে নিজেই হেটে আসতে হবে!

তিন্নি বলে উঠে,
“না তা হবে না। ভাবী নিজ থেকে এক পা ও নড়বে না।

নাহান ভাইয়া বলে উঠে,
“তাহলে কি করে নিয়ে যাবে?

ইতি বলে উঠে,
“সেটা তো ভাইয়া ভাববে!

আহিয়ান মুচকি হেসে ওদের বলল পিছিয়ে যেতে। অতঃপর হুট করেই আমাকে কোলে তুলে নিল। সবাই হইচই শুরু করে দিল।‌ আচমকা এমন কিছু হওয়ায় আমি ভয়ে উনার গলা জরিয়ে ধরে আছি। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,

“ভূতনি তোমার ওজন বাড়ল কিভাবে,‌ কাল থেকে কম খাবা।

“আমার লেহেঙ্গার ওজন আমার থেকে ডাবল, আপনি এটা জানেন!

মুখ ভেংচি দিয়ে উনি আমাকে নিয়ে স্টেজের দিকে গেলেন। আনাফ ভাইয়া আর কয়েকজন ক্যামারা নিয়ে ছবি তোলা শুরু করে দিল। আমাকে বসিয়ে দেবার পর আশপাশ এতো মানুষ দেখে চক্ষু লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। উনি আমার পাশে বসে বড় শ্বাস নিয়ে বলেন,

“তোমাকে কোলে নিতে গিয়ে আমি শেষ!

“আপনি এটা মোটেও ঠিক করেন নি, আশেপাশে মা বাবা ছিল।

“নানা নানিও ছিল কিন্তু।

“মজা করছেন

“একদম না!
বলেই এক পাটি দাঁত বের করে হাসলেন। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। শুরু হলো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান! একে একে সবাই এলো হলুদ লাগাতে। প্রথমে নানা এলেন অতঃপর নানু। অতঃপর মা বাবা আর আম্মু আব্বু আর চাচা। তাদের পর মামা মামী থেকে শুরু করে আপু আর দুলাভাই! এখানে উনার ফ্রেন্ড রা আবার বাদ যাবে কেন। না হলেও দু ঘন্টা ধরে বসে থাকতে থাকতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেলাম। আমার সাথে সাথে উনিও। এতোক্ষণ ধরে যাকে খুঁজছিলাম তাকে অবশেষে দেখতে পেলাম। হ্যাঁ এটা নিতি। দূরে এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে সে। সেও এলো আমাদের হলুদ লাগাতে। আমি ভেবেছিলাম নিতি হয়তো কিছু একটা করবে কিন্তু সে কিছুই করলো না। এমনকি আমার সাথে কথাও বলল না। যখন আমাদের হলুদ লাগাতে এলো, আমাকে হলুদ লাগিয়ে আহিয়ানের কাছে গেল। তাকে হলুদ লাগিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। আহিয়ান তার থেকে মুখ সরিয়ে আমার হাত টা হুট করে ধরল। এটাই কি ছিল নিতির জন্য তার জবাব। কেন জানি তখন খুব খুশি লাগছিল আমার। কিন্তু এটা এমন কিছু ছিল না তবুও খুশি লাগছিল। অতঃপর গুরুজনরা আমাদের ছেড়ে দিয়ে নিচে চলে গেল। গান বাজনা শুরু হলো। ইতি আর আকাশ ভাইয়া’ই নাচ দিয়ে শুরু হলো। একে একে সবাই নাচল। আমাদের ও টেনে নিয়ে গেল। মধ্যরাত অবদি চলল এই আয়োজন!
.
সবাই বলে বিয়ের আগের রাত নাকি বউদের ঘুম আসে না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটল। আমার অনেক ঘুম পেতে লাগল। কোনমতে সব কিছু চেঞ্জ করেই আমি একটা ঘুম দিলাম। বলাবাহুল্য আমি বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠলাম। উঠি নি আমাকে রীতিমতো উঠানো হলো। উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১২ টা বাজে। এসব দেখে নিজেই অবাক হলাম। অতঃপর ফ্রেস হয়ে আবারো এসে বসলাম তৈরি হতে!

বিয়ের জন্য আমাকে তৈরি করানো হলো। একটা লাল রঙের লেহেঙ্গা পড়ানো হয়েছে। চুল গুলো খোঁপা করে গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো। সাজানোর পর পরই মা এলেন আমার ঘরে। খানিকক্ষণ বসে গল্প করলেন। বেশ ভালো লাগল তার সাথে গল্প করে। অনেকদিন পর প্রাণ খুলে তার সাথে গল্প করলাম। মা আজও কাঁদলেন। কেন কাঁদলেন বুঝতে পারলাম না। চাচাও আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন।
আব্বুর সাথে দেখা করলাম। তার চোখেও অশ্রু দেখলাম। চোখে তা জল জল করছে। আব্বু আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। অতঃপর নানা আর নানুর সাথে করে নিচে এলাম। বিয়ের জন্য নিচের বসার ঘর’ই সাজানো হয়েছে। চমৎকার ভাবে ডেকোরেট করা হয়েছে। আহিয়ান সেখানে ছিল না। আমি গিয়েই আগে সেখানে বসলাম। মা আর আপু আমাকে দেখলেন। মা আমার থিতুনি হাত দিয়ে চুমু খেয়ে ঘোমটা টেনে দিলেন। অতঃপর সবাই দৌড়ে বাইরে গেল। বর‌ নাকি চলে এসেছে!

ইতি, তিথি আর তিন্নি নাকি বেশ ভালো ভাবেই জব্দ করেছে আহিয়ান কে। তাকে এসে বসানো হলো আমার পাশে। আমি তাকে দেখতে পেলাম না। অতঃপর কাজী এলো বিয়ে পড়ানোর জন্য।

বিয়ে পড়ানো শেষ হলো। তিন বার কবুল বলার আমি আবারো উনার স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পেলাম আর এটা ধর্মীয় ভাবে। নানা আর নানু দুজনেই খুব খুশি হলেন। হঠাৎ করেই ইয়ান এসে আমার হাত ধরে বলে,

“ভূতনি আম্মু আমি এখন তোমাকে কি বলে ডাকবো!

তার এই কথার পর হাসির শব্দে চারদিক ছড়িয়ে গেল। আয়নায় মুখ দেখার নিয়ম হলো। উনি একটা আয়না আমার সামনে ধরে সেটাতে তাকালেন। আমি সেখানে তাকিয়ে একটা মুখ ভেংচি দিলাম। উনি ভূতনি বলে হেসে উঠেন। অতঃপর খাওয়া দাওয়ার পর্ব শুরু হলো।
.
রাত অবদি ছাদে বসে আড্ডা দিল। অতঃপর রাত হতেই আমাকে বাসর ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো!
বাসর ঘরে আসতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। এটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছিল। এতোদিন পর নিজের ঘরের সেই চিরচেনা ঘ্রাণ নিতে পারলাম। আমার ক্লান্তি যেন নিমিষেই কেটে গেল। আয়নার‌ সামনে দাঁড়িয়ে একে একে সব গয়না গাটি খুলতে লাগলাম। বাইরে আমি ততোক্ষণে অনেক শোরগোল শুনতে পেলাম। এটা ইতির কাজ। আবারো সে জব্দ করবে আহিয়ান কে!

শাওয়ার নেবার পর নিজেকে অনেকটা ফ্রি বলে মনে হলো। ভিজে চুল গুলো ছেড়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালাম। এসময় দেখলাম উনি রুমে এলেন। বাহ অনেকক্ষণ পর তারা সবাই উনাকে ছেড়েছে। উনাকে ভিতরে পাঠিয়ে দেবার পর’ই বাইরে থেকে দরজা বন্ধ। আর কিসব জানি বললো যা আমার কানে এলো না। উনি কিছুক্ষণ বকবক করার পর আমার দিকে তাকালেন।
অতঃপর মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলেন,
“তুমি ফ্রেস হয়ে গেছ, আচ্ছা আমি ফ্রেস হয়ে আসছি!

বলেই আলমারি থেকে জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেলেন। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে লাগালাম। মনে করতে লাগলাম আমার পুরোনো সেই সব স্মৃতি। কিভাবে কাটাতাম আমি আমার গ্রামের বাড়ির দিনগুলো। কিভাবে আমার আর খালেদের বিয়ে ঠিক করা হলো। আমি পালিয়ে গেলাম সেখান থেকে। অতঃপর দেখা হলো ট্রেনে উনার সাথে! এমন সময়’ই দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। উনি এসেছেন ঘরে। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেলকনিতে এলেন।আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলেন,

“এক কাপ চা খুব দরকার ছিল ভূতনি।

“দরজা বাইরে থেকে আটকানো ভুলে গেছেন!

উনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,
“জানি, আচ্ছা রাত কতো হয়েছে!

আমি পিছন ঘুরে ঘড়ি দেখে বলি,
“১২ টা বাজবে!

“তাহলে তো রাত বেশি হয় নি, বাইরে দোকান খোলা পাবো

“মানে!

“আচ্ছা ভূতনি আজ তো আমাদের বাসর তাই না।

“হ্যাঁ তো!

“তাহলে এই দিন টা মনে রাখার জন্য কিছু একটা করা দরকার না।

আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলি,
“মানে!

উনি আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেন। অতঃপর এক এক পা করে এগিয়ে আমার কাছে আসতে থাকেন। আমি ততোই পিছুতে থাকি। একসময় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে উনি তবুও আমার কাছে আসছেন। আমার অস্থিরতা হঠাৎ করেই বেড়ে গেল। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করি,

“আ..আপনি কি করতে যাচ্ছেন!

উনি আমার একপাশে দেওয়ালে একহাত রেখে বলেন,
“সেটাই তো বলবো!

বলেই উনি আমার আরো কাছে আসতে লাগলেন। ভয়ে আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। উনার গরম শ্বাস গুলো আমার ঘাড়ে পড়ছে। আমি ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছি‌। উনি ফিসফিসিয়ে বললেন,

“চলো পালিয়ে যাই!

আমি ফট করে চোখ খুলে বলি,
“মানে!

উনি আমার থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে বলেন,
“বাসর রাতে দুজনেই বাড়ি থেকে পালিয়ে বাইরে চলে যাই কি বলো। সবাই তো বাসর রাতে ঘর থেকে বাইরে চলে যায়। কেউ করে চন্দ্র বিলাস তো কেউ করে সমুদ্র বিলাস। তুমি আর আমি না হয় করবো বাসর বিলাস!

আমি উনার হাতে একটা চিমটি কেটে বলি,
“এটা বলার জন্য আমার এতো কাছে আসার কি দরকার ছিল।

উনি হেসে বলেন,
“আরে এতো ইম্পর্ট্যান্টে একটা কথা, জোরে জোরে বলবো নাকি।

“অসভ্য লোক একটা।

“ভূতনি কোথাকার, চলো এখন।

“তা আপনি বাইরে যাবেন কি করে, দরজা যে বাইরে থেকে বন্ধ ভুলে গেছেন।

উনি বাঁকা হেসে বলেন,
“এই যে এভাবে!
বলেই নিচের দিকে ইশারা করেন। আমি বলে উঠি,
“এখান থেকে নামবো কিভাবে!

“এখনি দেখতে পারবে!

অতঃপর আমার হাতে তোয়ালে দিয়ে ঘরে গেলেন। বাইরে এসে গ্রিল বেয়ে নিচে নেমে গেলেন। অতঃপর নিচ থেকে নিচু গলায় আমাকে বলেন,

“নেমে আসো ভূতনি!

আমি উপর থেকে ফিসফিসিয়ে বলি,
“আমার কি পাখা গছিয়েছে যে উড়ে উড়ে আসবো।

“না তুমি ভূতনি হলেও এতো শক্তি এখনো পাও নি!
বলেই উনি হেসে দিলেন। আমি উপর থেকে উনার উপর তোয়ালে ছুঁড়ে মারলাম। উনি সেটা ধরে বলেন,

“দাঁড়াও!

বলেই কোথায় চলে গেলেন। আমিও সেই কখন থেকেই দাঁড়িয়ে আছি। খানিকক্ষণ পর উনি এলেন হাতে একটা মই নিয়ে। অতঃপর সেটা বেলকনিতে রেখে বলেন,

“নেমে এসো।

“পারবো তো!

“তুমি যেই মেয়ে গাছে চড়তে পারো আর মই তে চড়তে পারবে না।

“আজাইরা কথা বলবেন না, গাছ তো আর পড়ে যাবে না। কিন্তু মই..

“ওহ হ্যাঁ তাই তো। গাছ তো তোমার ভার নিতে পারবে মই নিবে কিভাবে। যদিও কাল আমিও নিয়েছিলাম।

“আপনাকে আমি!

“আচ্ছা আচ্ছা রেগো না। আমি ধরে আছি তুমি নেমো এসো। তবে হ্যাঁ সাবধানে!

অতঃপর শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে বিসমিল্লাহি বলে নামতে লাগলাম। বেশ ভয় ও করল তবুও ভালোই নামছিলাম। উনি নিচ থেকে ধরে রেখেছিলেন। নামার পর আমার হাত ধরে বলে,

“চলো!

এসময়’ই কারো আওয়াজ পেলাম। আমি উনার হাত ধরে দুজনেই একসাথে দৌড়ে বাইরে চলে এলাম। বাইরে এসে হাঁপাতে লাগলাম। দুজনের এই লুকোচুরি দেখে দুজনেই হেসে দিলাম। উনি বলে উঠেন,

“এক মিনিট!

অতঃপর আবারো বাড়ির ভেতরে গিয়ে এলেন। উনার হাত পিছনে ছিল। আমি কি বলে উঠি। উনি পেছন থেকে একটা জবা ফুল বের করে আমার কানে গুঁজে দিয়ে বলেন,

“বাসররাতে নাকি সব বর রা তার বউ দের উপহার কিন্তু আমি কিছুই কিনে নি। তার বদলে এই ফুল দিলাম তোমায়!

উনার কথায় আমি মুচকি হেসে উনার দিকে তাকালাম। অতঃপর দুজনেই বাইকে চড়লাম ‌ উনার ইচ্ছে হলো বাইকে চড়ে আজ সারারাত দুজনে ঘুরবো। আমি উনার পিছনে বসে উনার দুই কাঁধে হাত রাখলাম। উনি বাইক চালাতে শুরু করলেন।

প্রথমে আমরা এসে থামলাম একটা চায়ের টং এ। সেখানে দাঁড়িয়ে দুজনেই চা খেলাম। তাও এক কাপ না! ৫ কাপ! কখন খেলাম টেরও পায় নি। দুজন শুধু গল্প করতে করতেই চা খেলাম। অতঃপর সেখান থেকে আবারো বাইকে চড়লাম! পুরো রাস্তা এখন নিরব নিস্তব্ধ! আশপাশ কেউ নেই আমরা ছাড়া। এই মুহূর্তে টা অনেক সুন্দর ছিল। ফ্লাইওভার ব্রিজে আসার পর উনি থেমে গেলেন। খুব জোরে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল সেখানে। উনি এসে ব্রিজের উপর বসলেন। আমি ব্রিজের রেলিং’র সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। উনি বলে উঠেন,

“ভূতনি কেমন লাগছে।

“ভালো!

“হাত তা তো লাগবেই। কিন্তু জানো আমার না ভয় হচ্ছে না।

“কিসের ভয় বলুন তো?

“ভূতের! কারন ভূতনি আমার সাথে!

বলেই উনি হেসে উঠেন। আমি রেগে উনাকে চিমটি মেরে দুটো ঘুসি মারি। এতো জোরে মারিনি। উনি বলে উঠেন,

“এতো মেরো না, এখান থেকে পড়ে গেলে সোজা উপরে চলে যাবো।

“আপনাকে তাই করা উচিত।

বলেই ধাক্কা দিতে গেলাম। উনি আমার হাত জোরা শক্ত করে ধরলেন। বাতাস আবারো জোরে বয়ে গেল। আমার অবাধ্য চুল গুলো এলোমেলো হয়ে মুখের উপর ছড়িয়ে গেল। উনি হাত দিয়ে তা সরিয়ে দিয়ে ফুলটা ভালো ভাবে গুঁজে দিয়ে বলেন,

“চলে আরেকটু সামনে যাই।

আমি মাথা নাড়লাম। উনি নেমে এলেন। আবারো বাইরে চড়লাম। কোন এক অজানা রাস্তায় এলাম। মজার ব্যাপার ছিল সেখান দিয়ে একটা আইসক্রিম ওয়ালা যাচ্ছিল। উনি আমাকে বলেন,

“ভূতনি চলো আইসক্রিম খাওয়া যাক!

অতঃপর সেখান থেকে আইসক্রিম কিনলাম। আইসক্রিম যে পাবো সেটা ভাবে নি। আর লোকটাও আমাদের দেখে খুব অবাক হলো। বাইকটা ল্যাম্পপোস্ট’র কাছে দাড় করলাম। আমি আর উনি দুজনেই কোণ আইসক্রিম নিলাম। আমি নিজ মনেই আইসক্রিম খাচ্ছিলাম হঠাৎ দেখি উনি আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। আমি উনার দিকে তাকাতেই উনি হাত বাড়িয়ে আমার ঠোঁটের কোনে আইসক্রিম মুছে দিয়ে বলে,

“ধীরে খাও, বাসায় যেতে দেরি আছে!

আমি মাথা নাড়িয়ে আবারো আইসক্রিম খেতে লাগলাম। অতঃপর আবারো বাইক ভ্রমণ চলল। অতঃপর আমরা গেলাম একটা নদীর ধারে। দুজনেই নিশ্চুপ ভাবে সেখানে কিছুক্ষণ বসে ছিলাম। দেখছিলাম আকাশ কে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করছিলাম বাতাস কে। অতঃপর ভোর হতে তখন’ই শুরু হলো আমরা বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। আমি উনার পিছন থেকে উকি দিয়ে বাইকের আয়ানার দিকে তাকালাম। উনার মুখটা দেখা যাচ্ছিল। আপন মনে বাইক চালাচ্ছেন উনি তার সাথে উনার মুখও ও নড়ছে। হয়তো কিছু বলছেন যা আমি শুনতে পারছিলাম না। মনে পড়ল উনার আমার দেখা হবার সেই প্রথম ঘটনা। পরপর নিতির হাত থেকে বাঁচানো। সমাজের সবার হাত থেকে বাঁচানো। আমি তাকিয়ে আছি উনার দিকে। কে জানত, প্রথমে ট্রেনে দেখে যেই ছেলেকে সন্দেহ করছিলাম তার সাথে আমার বাকি টা জীবন পার করবার শপথ নিবো। উনি এখনো কথা বলছেন। আমি আবারো আয়নায় তাকালাম। চোখ পড়ল সেই জবা ফুলটার দিকে। কানে এখনো গুঁজে আছে সেই ফুল। মনে পড়ল উনার বলা সেই কথা। বাসর রাতে পাওয়া বরের থেকে এই উপহার। খুব ইচ্ছে করছিল আমি জোরে বলে উঠি,

“আমার সবচেয়ে বড় উপহার যে আপনি আহিয়ান। নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করি আপনাকে পেয়ে”

কিন্তু তা আর বলা হলো না। ভোরের আগমনে রাতের আঁধার যেমন ঢাকা পড়ল তেমনি ভাবে আমার এসব কথা মনেই রয়ে গেল। চুপ হয়ে থাকলেন। কেন বলতে পারছিলাম জানি না। তবে এক অনুভূতি হচ্ছিল। কি সেই অনুভূতি? কি নাম দেবো সেই অনুভুতির! কি হতে পারে তার নাম! ভালোবাসা! সত্যি কি তাই! এমন ভাবেই কি মানুষ ভালোবাসে অন্য জনকে। এমন ভাবেই কি মানুষ প্রেমে পড়ে। তবে কি আমিও সেই দলের খাতায় নাম লেখালাম!
.
বাড়িতে আসার পর আর ঘুম হলো না আমার তবে উনি দিব্যি ঘুমালেন। আমি আমার একটা ডায়রি বের করলাম। লিখে রাখলাম তাতে আজ রাতের এই ঘটনা। দেখতে লাগলাম ঘুমন্ত সেই আহিয়ান কে! সেই গোমরামুখো কে! সেই অসভ্য লোকটা কে! যার সম্পর্কে ভাবতেই এখন ভালো লাগছে আমার! উপর হয়ে শুয়ে আছে বিছানার এক কোনে। খুব নিষ্পাপ লাগছে তাকে দেখতে। ঘুমোলেই কি সবাইকে এভাবে নিষ্পাপ দেখায়। জানতে ইচ্ছে করল খুব!
.
পরদিন খুব ধুমধাম করে বৌ ভাতের অনুষ্ঠান হলো। বাড়ির সবাই মিলে নানা রকম খেলাও খেলল। অতঃপর একে একে সব মেহমান বিদায় নিতে থাকল বাড়ি থেকে।

#চলবে….