#ভালোবাসার_ভিন্ন_রুপ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৭
মামা বাড়ির সবাই আদ্রিয়ানকে দেখে দুপুরের পর রওনা দিলো। বড় মামি রোদের সাথে কোন কথা বলে নি। রোদ সালাম দিলেও শুধু উত্তর দিয়ে কেটে পরেছে। বেচারী একটু শক্ড আছে। রোদরা কি না এত বড়লোক। কিন্তু মনে মনে উনি খোজ চালিয়ে যাচ্ছেন যত যাই হোক রোদের পরিবার কিভাবে আদ্রিয়ানের কাছে বিয়ে দিল। হাজার হোক আদ্রিয়ান সুন্দর টাকা পয়সাও ঢের তবুও যার কি না বিয়ে তো বিয়ে মেয়েও আছে তার সাথে কেন রোদকে বিয়ে দিলো যেখানে কি না রোদ নিজেকে সুন্দরী, মেডিকেল স্টুডেন্ট।
বিকল দিকে আরেক কারবার ঘটে গেল। রোদ মিষ্টিকে ঘুম পারিয়ে নিজে মাত্র আদ্রিয়ানের পাশে ঘুমাতে গিয়েছে। আদ্রিয়ান বা হাত দিয়েই ল্যাপটপে টুকটাক কিছু করছে রোদ কড়াভাবে না বলায় বলেছে একটা ইমেইল সেন্ড করে রেখে দিবে। রোদ আদ্রিয়ানের পাশে এসে ওর থেকে একটু দূরত্বে সুয়ে পরলো। রাতে ঠিক মতো ঘুম হয়নি তাই যেই না চোখ লাগবে ওমনি জারবা দরজায় ধুমধাম আওয়াজে কান খেলছে। আদ্রিয়ান রোদকে দেখে বিরক্ত হয়ে জোরে বললো,
— আমি আসলে কিন্তু মাইর খাবি।
— ভাইয়া দরজা খুলো।
রোদ ঢুলতে ঢুলতে উঠলো। আদ্রিয়ানের একটু খারাপ লাগলো কারণ রোদ সারা রাত আদ্রিয়ানের খেয়াল রেখেছে। যতবার আদ্রিয়ান উঠেছে ততবার রোদ সজাগ ছিল। রোদ দরজা খুলতেই জারবা ভিতরে ডুকে এলো। রোদ কিছু না বলে বিছানায় ধপ করে শুয়ে পরলো। আদ্রিয়ান জারবাকে ধমকে বললো,
— কি হয়েছে এখন তো বল।
— আরে ভাইয়া কি হয় নি তা বলো?
— ড্রামাবাজ বল কি হয়েছে?
— আর কি তোমার শশুর শাশুড়ী আর শালা উপস সমন্ধি এসেছে।
আদ্রিয়ান না বুঝতে পেরে বললো,
— মানে???
— মানে মানে বাদ দাও।।বাসা পুরো ভরে গিয়েছে। তারা ও ডালা নিয়ে এসেছে। সাথে খাসির বাচ্চাও আছে। ভাইয়া প্লিজ খাসিটা আমি পালি প্লিজ প্লিজ।
একদমে বলে থামলো জারবা। আদ্রিয়ান এখনও হা হয়ে আছে কি বলছে জারবা? ওর শশুর শাশুড়ী তো সকালেই এসে গেল। রোদ আবারও ঘুমিয়ে গিয়েছে।এরমধ্যেই সাবা ডুকে জারবাকে বললো,
— জারবা কেন পাঠালাম তোমাকে আর তুমি কি করছো?
— বড় ভাবী আমি তো ভাইয়াকে বললামই। জিজ্ঞেস করো।
আদ্রিয়ান ল্যাপটপটা কোল থেকে নামিয়ে সাবাকে বললো,
— কে এসেছে ভাবী?
— রোদের চাচা, চাচী আর চাচাতো ভাই এসেছে তোমাকে দেখতে।
আদ্রিয়ান এবার ভয়ানক অবাক হলো। যারা কি না এতোদিনে একবার ও এলো না তারা আজ এসেছে এরমধ্যে আদ্রিয়ান একা দাড়াতেও পারছে না। শশুর শাশুড়ী আসলো প্রথম বার ভালোভাবে যত্নও নিতে পারলো না অবশ্য তারা সুযোগই দেন নি।ব্যাস্ততা দেখিয়ে চলে গিয়েছেন।আদ্রিয়ান সুস্থ থাকলে নিজে সুযোগ তৈরী করে নিত। একবার রোদের দিকে তাকালো মেয়েটা তার ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু ডাকতে তো হবেই কি আর করার। আদ্রিয়ান সাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
— ওনারা কোথায় ভাবী?
— নিচে বসে আছে। তোমাকে দেখেই নাকি চলে যাবে। কিন্তু মা ব্যাস্ত হয়ে আছে যেতে দিবে না। রোদ কে উঠাও। তুমি তো নিচে যেতে পারবে না ওনারাই রুমে আসবে। আমি যাই মা একা করছে সব।এই জারবা চলো আমার সাথে।
একদমে সব কথা বলে সাবা বেরিয়ে গেল। জারবা বের হতে নিয়েও আদ্রিয়ানের কাছে এসে বাহুতে হালকা খোচা দিয়ে বললো,
— ভাইয়া খাসিটা জবাই করো না প্লিজ।
আদ্রিয়ান একটু বিরক্ত হলো। ও আছে নিজের টেনশনে আর এই মেয়ে আছে খাসি নিয়ে। আদ্রিয়ান কিছু বলার আগেই সাবা আবার রুমে ডুকে জারবাকে টেনে নিয়ে গেল। আদ্রিয়ান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আস্তে করে রোদকে ডাক দিলো কিন্তু রোদ উঠলো না উঠবে কি করে আদ্রিয়ান ডেকেছেই এতো ধীরে। এবার রোদের গালে একহাত দিয়ে হালকা ঝাকিয়ে ডাক দিল। ঘুম কাতুরে রোদ লাফ দিয়ে উঠে বসলো। আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
— কি হয়েছে? ওয়াসরুমে যাবেন? ব্যাথা করছে?
আদ্রিয়ান শান্ত চাহনি দিয়ে বললো,
— চোখ, মুখে পানি দিয়ে এসো।
— কেন? কি লাগবে বলুন।
— কি লাগবে না।
— তাহলে ঘুমাই একটু।
বলতেই বালিশে মাথা লাগালো। আদ্রিয়ানের মায়া হলেও জোরে বললো,
— রোদ উঠো। গেস্ট এসেছে বাসায়।
বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলো না রোদ। টেনে টুনে চোখ খুলে ওয়াসরুমে ডুকলো। মিনিট পাঁচ এক পর বের হয়ে এলো। বের হতেই দেখলো মিষ্টি আদ্রিয়ান পাশে বসে কিছু একটা বলছে। রোদ ওদের সামনে এসে আদ্রিয়ানকে বললো,
— আমি কি নিচে যাব?আর চেঞ্জ করতে হবে নাকি ঠিক আছে?
–নিচে যেতে হবে না।
এরমধ্যে কেউ দরজায় নক করতেই রোদ বললো,
— খোলা তো।
পরপর দরজা ঠেলে নিজের চাচা,চাচি আর চাচাতো ভাই ইশানকে দেখা মাত্র চমকে তাকালো রোদ। হুট করে এদের আশা করে নি রোদ। চাচা রোদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— কেমন আছিস মা?
— আলহামদুলিল্লাহ। তোমরা কেমন আছো?
এরপর চাচি জড়িয়ে ধরে কতক্ষণ আদর করলো। ইশান ও আদর করলো। আদ্রিয়ান সবাইকে সালাম দিলো। সবাই ওর খোজ খবর নিলো। চাচি রোদকে একটু সাইডে নিয়ে চাপা ধমক দিয়ে বললো,
— এগুলো কি পরেছিস তুই?
— কি পরেছি মানে? দেখনা? জিন্স আর কুর্তি।
— বাসায় পড়তি ঠিক ছিলো। শশুর বাড়ী এগুলো পড়ে না মা।
— আজব কি পড়বো?
— কেন থ্রি পিছ পড়বি মাঝে মধ্যে শাড়ী পরবি।
রোদ চিন্তা করেছে চাচী এটা দেখেই এমন করছে। রোদ তো টিশার্ট আর প্যাট পরে রাতে থাকে। চাচী দেখলে নিশ্চিত আরেকদফা ঝারতো।যদিও ওগুলো পরে আরিয়ান আর শশুরের সামনে যায় না। আদ্রিয়ান সব শুনলেও কিছু বললো না। ওর মতে রোদ ওর কাছে আছে এই ঢের আর কিছু চাই না। আর রোদ নিজের পর্দা নিয়ে নিজেই যথেষ্ট সচেতন যদিও সবসময় হয়ে উঠে না।
রোদ চাচিকে আর তেমন কিছু বললো না। চাচি,চাচা,চাচাতো ভাই, বোনরা সবসময়ই রোদকে অনেক করে। প্রয়োজনে শাসন ও করে। চাচা আর ইশান অনেকক্ষণ আদ্রিয়ানের সাথে কথা বলে বিদায় নিলো। নিচে নামতেই আটকা পরলো। আদ্রিয়ানের বাবা আর আরিয়ান জরুরি ভিত্তিতে বাসায় এসেছে। যত পদ সম্ভব বিকালের নাস্তা দিয়েছে। তারা শুধু চা আর হালকা নাস্তা করেই বিদায় নিল। বরাবর যাওয়ার জন্য তাগাদা দিতে ভুলেন নি।
____________
বিদায় দিয়েই রোদ রুমে এলো। এখন শুয়ে আর লাভ নেই একটু আগেই মাগরিবের আজান দিয়েছে।তাই আদ্রিয়ান আর মিষ্টির জন্য খাবার নিয়ে রুমে ডুকলো। মিষ্টি কিছু একটু বলছে। রোদ রুমে ডুকে মিষ্টিকে ডাক দিলো। ট্রেটা সাইড টেবিলে রেখে মিষ্টির কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,
— আস মা খাবে।
মিষ্টিকে কাছে নিয়ে কাউচে বসিয়ে খায়িয়ে দিল। এর মধ্যে জানতে পারলো মিষ্টি নাকি খাসিটা পালতে চাইছে। রোদ না বুঝতে পেরে বললো,
— খাসি কোথায় পেলে মা?
— নিচে আছে তো। বাসার পেছনে রাখা। যারা এলো তারাই এনেছে।
রোদ তবুও তেমন বুঝতে পারল না দেখে আদ্রিয়ান বললো,
— চাচা,চাচীরা এনেছেন শুনলাম। ঐ জারবার কাজ এগুলো।মিষ্টিকে দিয়ে করাচ্ছে এমন। প্রতিবার কুরবানির ঈদে ও এমন করে। গরু নাকি পালবে আবার সামনে যেতেও ভয় পাবে।
— ওহ।
মিষ্টি খেতে খেতে বললো,
— মাম্মা আমি ভয় পাই না পুটকু কে।
রোদ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,
— পুটকু কে?
— আমার, ভাইয়ার আর ফুপির খাসিটা। ওর নাম এটা। ফুপি রেখেছে।
রোদ একটু জোরেই হেসে উঠল। আদ্রিয়ান ও হেসে উঠেছে। দুই জনকে হাসতে দেখে মিষ্টি ও হেসে উঠলো।
মিষ্টিকে খায়িয়ে দিলেই ও দৌড়ে গেল জারবার রুমে। মিষ্টি যেতেই রোদ আদ্রিয়ানের সামনে খাবার আনলো। দুপুরের পর কিছু খাওয়া হয়নি। রোদ নিজেই খায়িয়ে দিল। আদ্রিয়ান ওকে খেতে বললে রোদ জানালো পরে খাবে কিন্তু আদ্রিয়ানের জোরাজুরিতে না পেরে নিজের জন্য অল্প নাস্তা আর দুজনের জন্য কফি নিয়ে এলো।
ডালার এতো সব কিছু আত্মীয়, প্রতিবেশীদের বিলাতে বিলাতে রাত হয়ে গেল। এরমধ্যে রোদ আদ্রিয়ানের জন্য এক প্লেট ফল নিয়ে এলো। আদ্রিয়ান অনিচ্ছ প্রকাশ করলেও লাভ হয়নি। রোদ জোর করে খায়িয়ে বললো,
— আপনার শশুর বাড়ীর ডালা আপনাকে খায়িয়ে সুস্থ করতে হবে তো।
___________
বড় মামি এবার বড় ধরনের ধাক্কা খেল কারন রাত ৯ টায় আদ্রিয়ানদের বাড়ীর ড্রাইভার এতো কিছু নিয়ে এসেছে। তিনি চিন্তা করছেন নানী বাড়ী এতো কিছু পাঠিয়েছে আল্লাহ জানে কতই না ডালা পাঠালো আবার। নানু মনির কথায় ছোট মামি আর বড় মামি মিলে সব গুছিয়ে রাখলো।
জাইফার আচরন কারোই স্বাভাবিক লাগছে না। রাত, দিন কখনোই ঠিক মতো খেতে চায় না। রাদের ছবি দেখতে থাকে। জাইফ কত বুঝালো লাভ হলো না। কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। না পেরে রাদকে কল করলো জাইফ। রিসিভ করেই সালাম দিয়ে একে একে সব বললো জাইফ। ভেবেছিলো রাদ হয়তো রাগ করবে বা কিছু। জাইফকে ভুল প্রমানিত করে রাদ ঠান্ডা মাথায় জাইফকে বুঝিয়ে বললো, ও জাইফাকে পছন্দ করে না আর না কখনো এসব সম্ভব। এরপর আর কিইবা বলার আছে জাইফের। যেখানে কিনা রাদ সম্পূর্ন না করে দিয়েছে। ফোন লাউডে থাকায় জাইফা সব শুনলো। হঠাৎ করে রুমের জিনিস ছুড়তে লাগলো। জাইফ চেয়েও থামাতে পারলো না। ওর মা, বাবা ছুটে এসে মেয়েকে দেখে সামনে আসতেই জাইফা ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে ওর মায়ের দিকে ইশারা করে বললো,
— বা..বাবা এই মহিলার জন্য হচ্ছে এ..এমন। রাদ আমায় দেখতে পারেন না। কেন পারে না বাবা কেন?
জাইফার বাবা মা স্তব্ধ হয়ে গেল। ওর বাবা প্রথমে না বুঝলেও পরে জানতে পারলো রাদ কে। মেয়ের এহেন অবস্থা দেখে ভাবলো রাদের সাথে কথা বলবে।
এক তরফা ভালোবাসায় দহন সবসময় একটু বেশি কারন এতে ভালোবাসতে হয় একা,পুরতে হয় একা, কাদতে হয় একা এমনকি মাঝে মধ্যে ভালোবাসা শেষ ও হয়ে যায় একার একজনের হৃদয়ে।
_______________
রাতে আদ্রিয়ানকে মেডিসিন খায়িয়ে নিজেও একা মেডিসিন খেয়ে পড়তে বসলো রোদ। রাত ১২ টার দিকে পড়া শেষ করে উঠতেই আদ্রিয়ান বললো,
— দুধ নিয়ে এসো।
— যাচ্ছি।
রোদ দুধ আনতেই আদ্রিয়ান রোদের অগচরে মেডিসিন মিশিয়ে দিলেই রোদ কোনমতে খেয়ে উঠলো। রোদ খেয়াল করলো আদ্রিয়ানের পায়ে হয়তো হালকা পেইন হচ্ছে। রোদ বললো,
— পেইন হচ্ছে?
— অল্প।
রোদ কিছু না বলে লাইট অফ করে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে আদ্রিয়ানের পায়ের সামনে বসে আল্ত হাতে টিপে দিতে লাগলো। আদ্রিয়ান না করলেও শুনলো না। আদ্রিয়ান কেন জানি মনে হচ্ছে রোদ অবুঝ না প্রিয় মানুষদের আগলে রাখতে জানে।আচ্ছা আদ্রিয়ান বুঝি তার প্রিয়? রোদ কিছুটা মা চাচিদের মতো যারা সারা পরিবারের খেয়াল রাখবে কিন্তু নিজের যত্ন নিতে পারেন না। তাতে কি আদ্রিয়ান আছে তো তার রোদকে আগলে রাখতে,যত্ন নিতে, ভালোবাসা দিতে।
#চলবে…..
#ভালোবাসার_ভিন্ন_রুপ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৮
কেটে গেল ২সপ্তাহ খানিক। শীত শেষে বসন্ত বরণের তোরজোড় চলছে। কিন্তু আমার শান্তি নেই। একেতো আজ মেডিক্যাল এ রোদের এক্সাম তার মধ্যে কোচিং করাতে যেতে হবে। আদ্রিয়ান এখন সুস্থ তবুও পায়ের ক্ষতটা ততটা শুকায় নি। ড্রাইভার সাথে নিতে হয়। কফি হাতে ব্যাস্ত পায়ে রুমে ছুটলো রোদ। মিষ্টিটাও আজ এখনও দুধ খায় নি। আদ্রিয়ানের হাতে কফি দিয়ে রোদ চলে যেতে নিলেই আদ্রিয়ান হাত ধরে আটকে দিল। পিছনে ঘুরে তাকাতেই আদ্রিয়ান বললো,
— সকাল থেকে দৌড়া দৌড়ি করছো। একটু রেস্ট নাও বসে।
রোদ হাত ছাড়িয়ে অল্প রাগ দেখিয়ে বলল,
— রেস্ট নিলে পাঁজি টা আজ আর দুধ খাবে না। কাল খেলতে যেয়ে হাটু ছিলে এসেছে। আজ আবার আলিফের সাথে দৌড়ে যাচ্ছে সাড়াবাড়ি।
কথাগুলো বলে আদ্রিয়ানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেল রোদ। আদ্রিয়ান অবাক হয়ে দেখে সদ্য উনিশে পা রাখা তার বউয়ের দিকে। কে বলবে এই মেয়ে একটু ওদিক হলেই কেদে বুক ভাসায়, গাল ফুলিয়ে রাখে। এরকম মানুষের মন হয় একদম সাদা। কিন্তু পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে শক্ত করে হাল ধরতে জানে। আদ্রিয়ান অসুস্থের সময় সারাদিন রাত এক করে সেবা করেছে। নিজ হাতে খায়িয়ে তারপর নিজের লেখাপড়া করে আবার মিষ্টিকে সামলিয়েছে। কেমন সংসারী হয়ে উঠেছে তার রোদ। ভাবতে ভাবতে রোদ রুমে ডুকে রেডি হয়ে নিল। বই খুলে কয়েকবার চোখ বুলালো মার্ক করা টপিক গুলোতে। আদ্রিয়ান ওকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ড্রাইভার ড্রাইভ করছে। আদ্রিয়ান আর রোদ পিছনে বসা। রোদ বইতে মুখ গুজে আছে যদিও প্রিপারেসন আলহামদুলিল্লাহ ভালো তবুও টেস্ট মানেই ভয় রোদের কাছে। বই রেখে বাইরে তাকালো রোদ। ছোট ছোট স্টল করে ফুলের দোকান। আজ একেতো বসন্ত তার মধ্যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে। রোদের এগুলোতে ইনট্রেস্ট নেই কিন্তু দেখতে ভালো লাগে বসন্ত বিলাস। চোখ নামিয়ে আবার বইতে মুখ গুজে দিল রোদ।
__________________
পরিক্ষা শেষে রোদ ইয়াজের সাথে কোচিং এ রওনা দিলো। আদ্রিয়ান ফোন করে বলেছে আজ নিতে আসবে। রোদ আর কিছু বলে নি। ক্লাস শেষে বেরিয়ে এলো। আবার মেডিক্যালের সামনে এসে দাড়ালো।রোদ দাঁড়াতেই কোথা থেকে রাতুল এসে সামনে দাড়ালো। ভদ্রতার খাতিরে সালাম জানালো।রাতুল যেন সুযোগ পেল। একপ্রকার আলাপ শুরু করে দিলো। রোদ বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলো না। এদিকে আদ্রিয়ান এসে ওদের এতো কাছাকাছি আর ছেলেটাকে হেসে হেসে কথা বলাতে কিছুটা রাগ হলো। কিছু কথা শুনতে ও পেল। রাতুল রোদকে জিজ্ঞেস করছিলো যে, রোদ আজ কার সাথে বসন্ত বিলাস করবে?ভ্যালেন্টাইন্স এর জন্য কোথাও যাবে কি না? রোদ সহজ ভাষায় উত্তর দিলো,
— যে ভালোবাসা একদিনের জন্য বেহায়াপনার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় সে রকম ভালোবাসা আমি কাউকে বাসি না। আর রইল বসন্ত বিলাস যদি মন সায় দেয় তাহলে তো নিজের ব্যালকনিতে বা ছাঁদেও তা করা যায়। সঠিক ব্যাক্তিটি পাশে থাকলেই হলো।
— খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারো তো তুমি।
আদ্রিয়ান এতক্ষণ রোদের কথা শুনলো। এগিয়ে গিয়ে হাত ধরায় রোদ একটু ভয় পেল। পরক্ষণেই আদ্রিয়ানকে দেখে কিছু বলার আগেই আদ্রিয়ান ওকে ধরে হাটা ধরলো। রাতুল একটু অপমানিত বোধ করলো। রোদেরও কেমন লাগলো। এভাবে আনার কি আছে?
_________________
জাইফার বাবা মেয়েকে আসস্ত করেছেন রাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। এতদিন আদ্রিয়ান অসুস্থ ছিলো বলে তারা আগায় নি। যদিও ব্যাপারটা অড দেখায় মেয়ের বাসা থেকে প্রস্তাব পাঠাতে তবুও মেয়ের কথা চিন্তা করে কিছু বললো না।
জাইফা আজ মহা খুশি। রাদ আর ওর বিয়ে হবে ভাবতেই কালি পড়া চোখ গুলো লজ্জারা ভর করলো। বাবা বলেছে কথা বলেই কাবিন করে রাখবে। মাও খুশি।সবাই খুশি। জাইফা আয়মায় নিজের চেহারা দেখলো। চোখের নিচে কালি পড়েছে, চাপা ভেঙে গিয়েছে। নিজেকে আবারও সুন্দর করতে উঠে পড়ে লাগলো।
জাইফার বাবা আদ্রিয়ানের মাকে ফোন দিয়ে জানালো। তারা শুনে খুশি হলো। যদিও রোদ আর আদ্রিয়ান কিছু জানে না। একবুক আশা নিয়ে ফোন করেন রাদের বাবাকে। পরিচয় দিয়ে কথা বলেন। একপর্যায়ে রাদ আর জাইফার বিয়ের কথা তুললে রাদের বাবা জানায় ছেলেকে এ বিষয়ে বলবেন।
ফোন কাটতেই জাইফা লজ্জা পেয়ে রুমে ডুকলো। একটা শাড়ি বের করে নিজেকে দেখলো। ছটপট করে পড়ে ফেললো। নিজেকে কেমন বউ বউ লাগছে। ১০ মিনিটের মধ্যেই জাইফাকে ডাক দিলো বাবা। জাইফা বের হয়ে তার রুমে ডুকে পরলো। বাবা ওকে নিজের সামনে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— আমার মা তো অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। শাড়ীতে অনেক সুন্দর লাগছে। তোমার জন্য রাজপুত্র আনবো আমি মা।
জাইফা লজ্জা পেল। নিচু স্বরে বললো,
— রাদ হলেই হবে বাবা। রাজপুত্র চাই না।
— রাদ রাজি হয় নি মা।
গলগলিয়ে চোখ ভেঙে পানি পরলো জাইফার। দৌড়ে নিজের রুমে ডুকে পরলো। বাবা,মা ডাকলেও শুনলো না। অঝোরে কাদলো। রাদ কেন তাকে ভালোবাসতে পারছে না? কেন জাইফার হৃদয়ের হাহাকার টের পাচ্ছে না? কেন জাইফার কাছে টেনে নিচ্ছে না?
বয়সটা যদিও আবেগের না কিন্তু ভালোবেসে হিতাহিত বুদ্ধি লোপ পেল জাইফার। ড্রয়ার থেকে নেইল কাটার বক্স বের করে ধারালো ছোট ছুড়ির মতো জিনিসটা বের করে বা হাতের রগ বরাবর টান দিলো। গলগলিয়ে র*ক্ত দিয়ে ফ্লোর ভেসে গেল। দেহটা ধপাস করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করার আগে অস্ফুট স্বরে বললো,
— ভালোবাসি রাদ।
________________
গাড়িতে তেমন হলো না আদ্রিয়ান আর রোদের। আদ্রিয়ান শুধু জিজ্ঞেস করল,
— ছেলেটার কে রোদ?
— কে রাতুল ভাইয়ার কথা বলছেন?
— বাহ নামও জানা হয়ে গিয়েছে?
— মানে?
— কতদিন ধরে চিনো আর কিভাবে চিনো যে ফ্রীলি কথা বলছিলে?
রোদ কি বলবে ভেবে পেল না। কোচিং এর কথা আপাতত বলা সম্ভব না পরে বলবে বুঝিয়ে। আর মিথ্যা ও বলতে চাইলো না। তাই অর্ধেক সত্যি বললো,
— উনি ইয়াজের পরিচিত। যেচে পড়ে কথা বলতে আসলে তো আর চুপ করে থাকা যায় না।
একটু রেগে বললো রোদ। সাধারণ কথা বলাতে এতো প্রশ্ন কেন? কিন্তু বোকা রোদ কি বুঝলো যে ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো সাথে কথা বলতে দেখলে কেমন লাগে তাও যে কিনা অন্য নজরে দেখে।
বাসায় ফিরেছে ১ ঘন্টা হবে। গোসল সেরে দুজনেই নানাজ পড়ে নিয়েছে। এখন বাজে ৪টা। রোদ আদ্রিয়ানকে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজেও খেতে বসলো। আদ্রিয়ানের মা এসে একবার দেখে গিয়েছে আর বলেছে আদ্রিয়ানের সাথে কথা আছে। খেতে খেতে আদ্রিয়ান একটুকরা মুরগির মাংসের পিস রোদের প্লেটে দিল। রোদ ও কিছু না বলে খেয়ে নিলো। আজ রোজকার থেকে একটু বেশি খেয়েছে রোদ আদ্রিয়ান এ নিয়ে ভীষন খুশি।
খাওয়া শেষে সব গুছিয়ে রুমে ডুকলো রোদ। মিষ্টি ঘুমাচ্ছে। রোদ ভেজা চুলগুলো মেলে দিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে পরলো। আদ্রিয়ানের মা ওকে জানালো জাইফার জন্য রাদের কথা। কিন্তু তারা কেউ জানে না রাদ না করে দিয়েছে। আদ্রিয়ান এসব ভাবে নি তাই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে ব্যার্থ হলো। রুমে ডুকে রোদের দিকে নজর দিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। এখনো বুকে ব্যাথা অনুভব হয় নিজের হারিয়ে যাওয়া প্রেরসীর কথা মনে পরলে। আদ্রিয়ান ওদের পাশে বসে মিষ্টির কপালে চুমু খেয়ে রোদকেও চুমু খেল। রোদ চোখ মেলে তাকাতেই আদ্রিয়ান বললো,
— ভালোবাসি।
— আমিও…
— কি বলো?
— কিছুনা।
বলে রোদ জড়িয়ে ধরলো আদ্রিয়ানকে। আদ্রিয়ানের বুকের বা পাশে কান লাগিয়ে শুনতে লাগলো ধুকপুক শব্দ।
___________
মাগরিবের আজানের আওয়াজে ঘুম ভাঙলে রোদ উঠে বসলো। আদ্রিয়ান মিষ্টিকে কোলে নিয়ে কি জানি করছে। আবার হাসছে। রোদ ওযু করে বেরুতেই আদ্রিয়ান ওযু করে মসজিদে চলে গেল। নামাজ শেষে মিষ্টিকে কোলে তুলে নিচে নামলো রোদ। কিচেনে ডুকতেই দেখলো সাবা কিছু করছে। দুই জা মিলে সন্ধ্যার নাসতা বানিয়ে ফেললো। আদ্রিয়ান ও ফিরে এলো। আরিয়ানও আজ এসময়ে বাসায় এলো। সবাই সোফার রুমে বসে আড্ডা দিতে দিতে খেতে লাগলো। রোদ মিষ্টিকে খায়িয়ে দিয়ে বললো,
— বল মা আলহামদুলিল্লাহ।
— আল হাম দু লি ল্লাহ্।
আদ্রিয়ান অনেক ভালোলাগে যখন রোদ এসব বিষয় মিষ্টিকে শিখায়। ছোট মিষ্টি কাল তার বাবাইকে কোরআনের সবচেয়ে ছোট সূরা “সূরা কাউসার” শুনিয়েছে। আদ্রিয়ানের চোখে তখন বিস্ময় ছিলো আর কৃতজ্ঞতা ছিলো রোদের প্রতি।
নিজে মাত্র রোলের পিসে কামড় দিলো এমন সময় জারবা বললো,
— বড় ভাইয়া ভালোই আজ ভাবীকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। ছোট ভাইয়াও তো কিছুমিছু করবে। আমি আজ কি করবো? খাসিটা থাকলে নাহয় ওকে নিয়ে বসন্ত বিলাস করতাম।
রোদ ফিক করে হেসে উঠল। বাকি সবাইও হেসে উঠল। মিষ্টি আর আলিফ তেমন কিছু না বুঝলেও ওরাও হেসে উঠল। জারবা গাল ফুলিয়ে বসে রইল কারণ খাসিটাকে জবা*ই করা হয়েছিলো।এরপর আত্মীয়দের মধ্যে বিলিয়ে দিতে দিতে নিজেদের জন্য অল্প বাকি ছিলো।
_____________
আরিয়ান সাবা আর আলিফকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। বাবা বাসায় নেই। মা পাশের বাসায় গিয়েছে। মিষ্টি জারবার রুমে বসে টিভি দেখছে। ল্যাপটপ সাইডে রেখে উঠে দাড়ালো আদ্রিয়ান। আরমোরা ভেঙে ব্যালকনিতে গেল না রোদ নেই। নিচে ও সুনসান নীরবতা। জারবার রুমে ও নেই। কিছু একটা ভেবে ছাঁদে উঠলো আদ্রিয়ান। রেলিং পাশ ঘেঁষে দাড়ানো রোদ। বিষন্ন মনে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ান শব্দ না করে ওর পেছনে তাকালো। আলত করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। চমকালেও নিজেকে সামলে নিল রোদ। আদ্রিয়ান রোদকে ঘোমটা ফেলে দিয়ে কাঁধ উন্মুক্ত করলো। নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো রোদের উন্মুক্ত কাঁধে। শিউরে উঠলো রোদ। সরে যেতে চাইলেই হাতের বাঁধন দৃঢ় হলো। আদ্রিয়ানের উষ্ণ নিঃশ্বাস রোদের ঘাড়ে আছরে পরলো। রোদ ছটপট শুরু করলেই আদ্রিয়ান ওর কানের লতিতে আলত কামড় দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
— ছাঁদে নাহয় বসন্ত বিলাস করবে তবে সঠিক ব্যাক্তিকে ছাড়া কেন রোদুপাখি। হুম?
আদ্রিয়ানের ফিসফিসানিতে রোদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যার্থ হয়ে গেল। জোর করে ছুটে ঘুরে জড়িয়ে ধরলো আদ্রিয়ানকে।আদ্রিয়ান ও জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেল। আদুরে গলায় বললো,
— কোথায় যাবে আমার সোনাপাখি?
………
— বলো। নিচে চলো রেডি হও।
………
— কি হলো? যাবে না?
— উহু।
— কেন?
— আমি আপনার বুকেই থাকবো। আজ কেন ঘুরতে হবে? আজ আমরা এখানেই থাকি?
আদ্রিয়ান বারবার হাজার বার এই মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়। কে বলেছে ওকে এতো সুন্দর করে আদর লাগিয়ে কথা বলতে?সময়টা দুজন উপভোগ করলো। একজন আরেকজনের হৃদয়ের খবর নিলো। কিন্তু সবটা শব্দহীন।
____________
এশারের আজান হতেই নিচে নেমে এলে দুজন। নামাজ পরে মিষ্টিকে খায়িয়ে ঘুম পারিয়ে দিয়েছে রোদ। হঠাৎ করে আদ্রিয়ানের মা জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। ভরকে গেল আদ্রিয়ান আর রোদ। আদ্রিয়ান দরজা খুলতেই আদ্রিয়ানের মা কেঁদে উঠলেন। আদ্রিয়ানের হাত ধরে বললো,
— জলদি হসপিটালে চল। জাইফা আত্মহত্মা করেছে।
রোদের মাথা ঘুরে উঠলো। আদ্রিয়ান এখন ও বুঝতে পারে নি। দাড়িয়েই জিজ্ঞেস করল,
— কে? আবার বল।
উনি কেদে দিল। জারবা দৌড়ে রুমে ডুকে বললো,
— ভাইয়া। জাইফ ভাইফা কল দিয়েছিলো তোমার ফোন নাকি অফ। জাইফা আপু হাতের রগ কেটে ফেলেছে।
আদ্রিয়ান তড়িৎ গতিতে গাড়ির চাবি হাতে নিলো। রোদ ততক্ষণে উঠে বললো,
— আমিও যাব। প্লিজ না করবেন না।
— বোরকা পড়। কুইক।
জারবাকে মিষ্টির পাশে রেখে মা আর রোদকে নিয়ে ছুটলো আদ্রিয়ান। রোদ আদ্রিয়ানের মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— মামনি প্লিজ শান্ত হও। আপুর কিছু হবে না। তুমি দোয়া কর।এভাবে তো তোমার প্রশার ফল করবে।
–ওকে নিজের মেয়ের মতো পেলেছি আমি। জারবা আর ওর মধ্যে ভেদ করি নি। কি এমন হলো যে ও এমন করলো। সকালেও কত খুশি ছিলো।
রোদ সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা পেল না। হসপিটালে পৌঁছে চার তলায় গেল ওরা। পরিচিত অনেক মুখ দেখতে পেল। সাবাও আলিফকে নিয়ে দাড়িয়ে। আদ্রিয়ান ওকে বাসায় যেতে বললো কারণ জারবা আর মিষ্টি একা এছাড়াও আলিফ ছোট। ড্রাইভার ওদের নিয়ে বাসায় গেল।
বড় মামি জ্ঞান হারিয়েছেন এপর্যন্ত তিন বার। মামা ও প্রেশার হাই হয়ে গিয়েছে। ডক্টর চেক করছেন তাকে। জাইফ একদম চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছে ফ্লোরে।সমবয়সীদের ভালেবাসা একটু বেশি থাকে। আরিয়ান ওটি তে আছে। সবাই চিন্তিত হয়ে আছে।
আদ্রিয়ান জাইফের কাঁধে হাত দিয়ে ওর পাশে বসতেই জাইফ হাউমাউ করে কেঁদে দিল। এতক্ষণ বুঝি ভরসার কাউকে খুঁজছিলো। বাচ্চাদের মতো কেঁদে যাচ্ছে। ওর কান্নার আওয়াজ পুরো করিডোরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ছেলেরা বুঝি এমন করে কাঁদে? হ্যাঁ কাদে তো যখন প্রিয়জন হারানোর শঙ্কা থাকে তখন কাদে।অনেক সময় নিয়ে থামলো জাইফ। রোদ পানির বোতল এগিয়ে দিলো। ঢকঢক করে এক বোতল পানি খেল জাইফ। আদ্রিয়ান ওর কাঁধে হাত দিয়ে বললো,
— কীভাবে হলো এসব?
— জানিনা।
একটুপর বললো,
— বাসায় এসে দেখি ও দরজা লক করে রেখেছে। বাবা মা ডাকলেও খুলে নি। আমিও ডাকি কিন্তু শব্দ করে না ও। পরে জানালা বাবা আজ বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো রাদ ভাইয়ার বাবার কাছে। জাইফা অনেক খুশি ছিলো কিন্তু..
থাকলো জাইফ। আটকে রাখা শ্বাস ছাড়লো। জরানো কন্ঠে বললো,
— রাদ ভাইয়া না করে দিয়েছেন।
একথা শুনেই জাইফা হাতের…
আর বলতে পারলো না জাইফ। ডুকরে উঠলো। রোদ কপাল কুচকে বললো,
— কোন রাদ।
— আপনার ভাই।
চমকালো রোদ। ভীষণ ভাবে চমকালো। আদ্রিয়ান ও চমকেছ কিন্তু কম। রোদ ধীর কন্ঠে বললো,
— ভাইয়া আর আপুর কি রিলেশন ছিলো?
— জাইফা ভালোবাসে উনাকে।
— ভাইয়া কি আপুকে চিট করেছে?
কথাটা বলতে কন্ঠ কেঁপে উঠল রোদের। আদ্রিয়ান ধমকে বললো,
— রোদ!!
জাইফ বললো,
— উনি পছন্দ করে না জাইফাকে। জাইফা বললেও প্রথমে ভালোভাবে বুঝায় কিন্তু জাইফা তবুও বারবার বলাতে উনি রেগে থাপ্পড় ও দিয়েছেন তবুও জাইফা ওনার জন্য রোজ পাগলামি করে। ও মনে করে আম্মু আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করায় ভাইয়া হয়তো এমন করছে।
রোদ আর কিছু শুনলো না। চুপ করে সিটে বসে পরল। এত কিছু ঘটলো অথচ ও কিছুই জানে না।
___________
দীর্ঘ ১ ঘন্টা পর ওটি থেকে বের হলো আরিয়ান। সাথে আরেকজন ডক্টর। সবাই ওদের সামনে দাঁড়াতেই ছোট মামা বললো,
— আরিয়ান জাইফা ঠিক আছে তো?
আরিয়ান মুখ কালো করে বললো,
— রাগ কেটে গিয়েছে। আপাতত ঠিক আছে কিন্তু প্রচুর র*ক্ত ক্ষরণ হ’য়েছে। জরুরি ভিত্তিতে o+ ব্লাড লাগবে। নাহয় বেঁচে থাকা সম্ভব না।
আদ্রিয়ান ব্লাড ব্যংক সহ নানা জায়গায় খোজ করলো। সবাই সব ভাবে খুজও পেল না। তখন রোদ সবার সামনে বললো,
— আমি দিব ব্লাড। আমার o+।
আদ্রিয়ান জানে রোদের ব্লাড গ্রুপ কিন্তু রোদ নিজেই পুরোপুরি সুস্থ না সেখানে কি না ব্লাড ডোনেট করবে? চোখ গরম করে তাকালো আদ্রিয়ান। রোদ সবার সামনে বলায় আদ্রিয়ান সরাসরি বলতে না বলতে পারলো না। আবার আপন জনের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে চুপ হয়ে গেল। নার্স এসে কিছু টেস্ট করাতে নিয়ে গেল। ভয়ে রোদের গলা শুকিয়ে এলো। আদ্রিয়ান ওর সামনেও এলো না। দ্বিধায় চোটে রাগ হচ্ছে ওর। শেষে যখন ব্লাড নিবে তখন না পেরে রোদের সামনে এলো আদ্রিয়ান। ভয়ে মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আদ্রিয়ান আসতেই রোদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আদ্রিয়ান ও নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো। রোদ কান্না মাখা কন্ঠে বললো,
— শুনুন শক্ত করে ধরে রাখবেন। কাঁদলেও ছাড়বেন না যতক্ষণ পর্যন্ত ব্লাড নেয়া না হয়। আমি ছটফট করলেও না। ঠিকাছে?
উত্তর দিলো না আদ্রিয়ান। নার্স এসে সুচ ঢুকতেই আদ্রিয়ানের টিশার্ট খামচে আম্মু বলে কেঁদে উঠলো রোদ। আদ্রিয়ানের কলিজাটা মোচর দিয়ে উঠল। জোরে চেপে ধরে রাখলো। রোদের কান্নার বেগ কমেছে। ব্লাড নেয়া শেষ। আদ্রিয়ান রোদের মাথা বুক সরাতেই পরে যেতে নিল রোদ। আদ্রিয়ান খপ করে ধরে ফেললো। পাশে রাখা ডাবের পানি খাওয়াতে চেয়েও পারলো না। নেতিয়ে গিয়েছে তার রোদ। ফ্যাকাসে মুখ দেখে ভয় পেয়ে গেল আদ্রিয়ান। নার্সকে জিজ্ঞেস করতেই উনি বললেন,
— আপনার ওয়াইফ তো এনিমিয়ায় আক্রান্ত তাই বেশি দূর্বল হয়ে গিয়েছেন। ঠিক ঠাক খাওয়া দাওয়া করলেই চার পাঁচ দিনের মধ্যে দূর্বলতা কেটে যাবে।
আদ্রিয়ান চামচ দিয়ে দিয়ে রোদের ঠোঁটের ফাকে ডাবের পানি দিয়ে পুরো গ্লাস খাওয়ালো। চোখ খুলে নি রোদ। মাথা ঘুরছে তার। আদ্রিয়ান নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে ধরে ফল খাওয়াতে লাগলো। দূর্বল রোদ যেন চিবুনোর শক্তিও পাচ্ছে না।
#চলবে….
#ভালোবাসার_ভিন্ন_রুপ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৮(বর্ধিতাংশ)
পাশের কেবিন শুয়ে আছে রোদ। মাত্র আদ্রিয়ান বের হয়ে গেল। জাইফার খোজ নেয়া দরকার। আরিয়ান বের হয়ে জানালো জাইফা এখন ঠিক আছে কিন্তু ৪৮ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। জাইফার বাবা মা একটু শান্ত হলো। আদ্রিয়ান চাচ্ছে রোদকে নিয়ে বাসায় রেখে আসবে। ভালোবাসায় সে আজ তার মন কিছুটা হলেও স্বার্থপর হয়ে উঠেছিল। কি দরকার ছিল রোদের ব্লাড দেয়ার হয়তো আরেকটু খোজ করলে পেতো ব্লাড এখন যে রোদ অসুস্থ হয়ে পরে আছে। যেখানে সারাদিন পর ওর ক্লান্ত চেহারা দেখেই আদ্রিয়ানের খারাপ লাগা শুরু করে সেখানে এত দূর্বল রোদের দিকে কিভাবে তাকাবে সে। এসব ভাবতে ভাবতে আরিয়ানের কেবিনে ডুকলো কথা বলতে।
ঘন্টা খানিক হবে রোদ শুয়ে আছে। আর ভালোলাগছে না। নার্সের সাহায্য উঠে বসলো। মাথাটা ভার হয়ে আছে। পানি চাইলেই নার্স ডাবের পানি এগিয়ে দিল। একচুমুক খেয়ে রোদ বললো,
— নরমাল পানি দিন।
— আপনার হাসব্যান্ড মানা করেছেন ম্যাম। শুধু ডাবের পানিই দিতে বলেছেন।
রোদের হাসি পায়। লোকটা একটু অতিরিক্ত ভালোবাসে তাকে। উঠে দাড়ালো রোদ। পড়ে যেতে নিলেই বেডে বসে পরলো। হঠাৎ ডাক পরায় নার্স ওকে হেলান দিয়ে বসিয়ে চলে গেল।
জাইফার খবর জানতে উঠে দাড়ালো রোদ। বেরিয়ে এলো রুম থেকে। সামনের করিডরে যেতেই দেখা মিললো সবার। রোদ আস্তে করে হেটে হেটে ওর শাশুড়ীর সামনে দাড়িয়ে বললো,
— আপু কেমন আছে মামনি?
— তুই উঠে এলি কেন রোদ? আদ্রিয়ান দেখলে রাগ করবে।
— ঠিক আছি এখন।
মামি রোদকে দেখা মাত্র তেঁতেঁ উঠলেন। তেড়ে এসে রোদর বাহু ধরে ওনার সামনে এনে পরপর কঁষে দুটো থাপ্পড় লাগালেন ওর গালে। দ্বিতীয় থাপ্পড়ে ছিটকে পরলো রোদ। তৎক্ষনাত ঘটনায় সবাই স্তব্ধ। আদ্রিয়ানের মা সহ সবাই যেন বুঝে উঠতে পারলো না। হঠাৎ করে কেউ গর্জে উঠলো। হাটু গেরে বসে রোদকে বুকে টেনে ধরে উঠালো। আরিয়ান চিল্লিয়ে বললো,
— কি করছেন মামি? রোদের গায়ে কেন হাত তুলেছেন?
মামি যেন দ্বিগুণ তেজ দেখিয়ে বললেম,
— এই এই মেয়ের জন্য আমার মেয়ের আজ এই অবস্থা। আমি ওর সাথে একটু খারাপ ব্যবহার করায় ওর ভাই আমার মেয়ের সাথে এমন করেছে। ওই হয় তো না করেছে। নাহলে আমার মেয়ের মধ্যে তো কোন কমতি নেই। ওর জন্য হয়েছে সব।
বলে তেড়ে যেতে নিলেই আদ্রিয়ান রোদকে বুকে চেপেই উঠে দড়ালো। শুরুতে শুধু একবার গর্জে আর কিছু বলে নি সে। রোদের চেহারার দিকেও তাকায় নি। রোদের মুখ আদ্রিয়ানের বুকে চেপে রাখা। মামি সামনে এগুতেই আদ্রিয়ান হুংকার ছেড়ে বললো,
–আপনি আমার মামার বউ আর মামাতো ভাই বোনের মা বলে আজ ছেড়ে দিলাম। দ্বিতীয় বার যেন এই ভুল না হয়।
— এই দু দিনের রাস্তার মেয়ের জন্য আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস আদ্রিয়ান?
— এই মুখ সামলে। আপনি রাস্তার মেয়ে। আর একটা কথা বললে জীবিত পুতে দিব।
চিৎকার করে বললো আদ্রিয়ান। । মামি সহ উপস্থিত সকলে ভয়ে সেটে গেল। আরিয়ান এগিয়ে এসে বললো,
— আদ্রিয়ান বাসায় যা রোদকে নিয়ে। আমি মেডিসিন নিয়ে আসছি একটু পর।
আদ্রিয়ান ওভাবেই কোলে তুলে নিল রোদকে। গটগট পায়ে বেরিয়ে এলো হসপিটাল থেকে। গাড়িতে বসতেই রোদের মুখটা উঁচু করে দেখলো। দাঁতের সাথে লেগে ঠোঁট কেটে গিয়েছে। হাত দিয়ে তা মুছে দিলো আদ্রিয়ান। রোদ মাথা নিচু করে বসে আছে। চোখ দিয়ে তখন পানি পরলেও এখন শুধু চুপ করে বসে আছে। আদ্রিয়ানের মুখে কোন কথা নেই। কি বলবে ও নিজের আত্মীয়দের নিকৃষ্ট মনমানসিকতার কথা? যার মেয়ের জীবন বাঁচালো সে কি না ওর উপর হাত তুললো আবার অপবাদ দিল। আদ্রিয়ান রোদকে আবারও বুকে টেনে ধরে চুপ করে রইলো। একটু পর আরিয়ান এলো। ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। সারা রাস্তা কেউ কিছু বললো না।
____________
জারবা, মিষ্টি, আলিফ, সাবা চারজনেই জারবার রুমে ছিলো। মিষ্টি আর আলিফ ঘুম। আরিয়ানদের গাড়ি আসতেই সাবা আর জারবা রুম থেকে বের হলো। রোদ তখন আদ্রিয়ানের কোলে। আদ্রিয়ান কাউকে কিছু না বলে উপরে রুমে চলে গেল। সাবা কপাল কুচকে বললো,
— আদ্রিয়ানের কি হয়েছে আর রোদ এমন হয়ে আছে কেন?
আরিয়ান নিজের ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। সাবা বুঝতে পেরে পানি নিয়ে এলো। আরিয়ান পানি খেয়ে নিঃশ্বাস নিলো। জারবা ওর গা ঘেঁষে বসে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
— আপু কেমন আছে বড় ভাইয়া?
আরিয়ান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু ৪৮ ঘন্টার আগে বলা যাচ্ছে না।
সাবা বললো,
— রোদের কি হয়েছে?
আরিয়ান সব খুলে বললো। সব শুনে সাবা আর জারবা আতকে উঠলো।এত কিছুর পরও আদ্রিয়ান এত শান্ত হয়ে আছে ভাবা যায়? না জানি পরে কি করে। আরিয়ান সাবাকে বললো সবার জন্য খাবার বাড়তে।সাবা আর জারবা কিচেনে ঢুকলো আরিয়ানও ফ্রেশ হতে চলে গেল।
রুমে ডুকে রোদকে বিছানার শুয়িয়ে দিয়েছে আদ্রিয়ান। ওর ঘুমানোর ড্রেস বের করে ওকে আস্তে করে উঠালো। ওয়াসরুমে ডুকিয়ে নিজেই হাত,মুখ ধুয়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো। দরজা লাগিয়ে রোদ চেঞ্জ করে বেরিয়ে এলো। আদ্রিয়ান ওর চেহারা আলতো করে মুছিয়ে দিল। ডান গালটা লাল হয়ে আছে। মেয়েটাকে জোরে ধরলেই ঐ জায়গা লাল হয়ে যায় আর এখানে কি না পরপর দুবার আঘাত পেল বিনা দোষে। অপরাধ বোধে আর কথা তো দূর টু শব্দ করলো না আদ্রিয়ান। নিজে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। এতক্ষণে সাবা খাবার নিয়ে রুমে ডুকলো। কিছু না বলে আদ্রিয়ানকে বললো,
— ওকে খায়িয়ে খেয়ে নে তারাতাড়ি।
আদ্রিয়ান কিছু বললো না। চুপচাপ রোদের মুখের সামনে খাবার ধরলো। রোদ দু লোকমা খেয়ে আর খেল না। ওর কান্না আসছে। আদ্রিয়ান ও কি ওকে ভুল ভাবছে? না তা কি করে হয়। আদ্রিয়ান তো আরো মামিকে হুমকি দিয়ে এসেছে তাহলে কেন কথা বলছে না। আদ্রিয়ান নিজেও একটু খেয়ে আর খেল না। রোদের সামনে দুধ ধরতেই রোদ কোনমতে খেয়ে নিলো। একটুপর জারবা এসে সব নিয়ে গেল।
_________
রাত তখন প্রায় ৩ টা আদ্রিয়ান শুয়ে আছে। রোদ তার পাশে। আজ যেন আদ্রিয়ান ওকে বুকে টানার সাহস পাচ্ছে না। কিভাবে মামি তার প্রাণপাখিকে আঘাত করলো?সাহস কোথায় পেল? আদ্রিয়ান পারলে এখন ঐ মহিলার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতো।একটুপর রোদ এগিয়ে এলো। আস্তে করে আদ্রিয়ানের বুকে ঢুকে পরলো। জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। আদ্রিয়ান হকচকিয়ে গেল। নিজেও জড়িয়ে ধরে বললো,
— কি হয়েছে সোনা? খারাপ লাগছে বেশি?
— কষ্ট হচ্ছে অনেক।
আদ্রিয়ান কিছু বলতে পারলো না। রোদ আবার বললো,
— আমি কি করেছি? আপনি কেন কথা বলছেন না? আপনি ও কি মনে করেন…
আর কিছু বলার আগেই আদ্রিয়ান ওর ঠোঁট চেপে ধরলো। ওর কপালে চুমু খেয়ে বললো,
— মাফ করো আমায় রোদ। আমার কাছে শুধু কষ্ট পাচ্ছ তুমি। যে তোমাকে আঘাত করেছে তার শাস্তি সে পাবে।
রোদ আরেকটু ঢুকলো বুকে। কেঁদে নিজেকে হালকা করলো। আদ্রিয়ানের চোখটাও জ্বলে উঠলো।
#চলবে….