ভালোবাসি তাই পর্ব-১৬+১৭

0
564

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-১৬

আশা উদ্ধিগ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে সাদের দিকে। সাদ কি বলে সেটা জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে। কিভাবে সে এড্রেস পেলো এটার জানার বাসনা কঠোরভাবে জেঁকে বসেছে মনের মধ্যে। সাদ বললো
“সেদিন অনেক সময় অপেক্ষা করার পরেও যখন ফিরলে না তখন সত্যিই আমি খুব চিন্তায় পরে গেছিলাম।। পরে মায়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম তোমরা বাড়ি চলে এসেছো। জানো, কথাটা শোনার পর খুব খারাপ লেগেছিলো। দুটো দিন যে কিভাবে পার করেছি আমি নিজেও জানিনা। সারাক্ষণ শুধু তোমাকে মিস করতাম।
আশা অবাক হয়ে বললো
“কেন?
“জানিনা। এর কারণটা আমার অজানা। তোমার প্রতি আমার এতটা আকুলতা কিসের জন্য সেটা জানার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি আমি, কিন্তু পারিনি।

শেষে বাধ্য হয়ে নিয়াশার কাছে গেলাম, তোমার এড্রেসের জন্য। সেতো রেগেমেগে আমার দিকে ওর মাথার কাটা ছুড়ে মারলো। কাটাটা গিয়ে লাগলো আমার মাথার ঠিক মাঝখানে। অনেক ব্যাথা লেগেছিলো, তাও কিছু বলিনি। নিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সেও নাকি জানেনা তোমার বাড়ির ঠিকানা।
কিভাবে তোমার ঠিকানা পাবো সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছিলাম।
“তারপর? প্রশ্ন করলো আশা।
সাদ আশার দিকে এক পলক তাকালো, এরপর স্মিথ হেসে বললো
“আর কি, তোমার রুমের তালা ভাঙ্গলাম।

আশা কপাল কুচকালো। সামান্য রেগে বললো
“তালা ভেঙ্গেছেন মানে? আপনি আবারও এই কাজ করেছেন?
“কি করবো বলো, তোমার ঠিকানা টা তো পেতে হবে।
আশা খানিক তেজে বলল
“তাই বলে এটা করবেন? এর আগেও এমন করেছিলেন, আমার জরিমানা লাগিয়ে আরেকটা কিনতে হয়েছিলো। কদিন হয়েছি কিনেছি, নতুন তালাটার আবারও অকাজ করে এলেন।।
সাদ ওকে শান্তনা দিয়ে বললো
“রাগ করোনা কিউটি, আমি আরেকটা তালা কিনে লাগিয়ে দিয়ে এসেছি।
আশা ভ্রু বাকিয়ে বললো
“সত্যি?
“হুম।

আশা এবার একটু শান্ত হলো। কয়েক সেকেন্ড কি যেনো ভেবে বললো
“আমার রুমে ঢুকলেন বুঝলাম, কিন্তু রুমে কি এমন পেয়েছেন যেটাতে আমার এড্রেস ছিলো।
“তোমার জন্ম নিবন্ধন।
আশা চমকে উঠলো সাদের কথায়। খানিক চেচিয়ে সে বলে উঠলো
“সেটাতো ফাইলে ছিলো।
“সেখান থেকেই বের করেছি।
” ফাইলটা কিন্তু ড্রয়ারে ছিলো।।
সাদ হেসে বললো
“ড্রয়ার খুলেই তো বের করেছি।
আশা সামান্য কাঁদোকাঁদো ফেস করে বললো
“ড্রয়ারে তো তালা লাগানো ছিলো ভাই।
সাদ নিরীহ মুখ করে বললো
“ভেঙ্গে ফেলছি।
“ওটাও ভেঙ্গেছেন?
“ওটা ভেঙ্গেই তো বের করেছি।

আশার খুব রাগ হলো এবার। ইচ্ছে করলো সাদের মাথাটা ফাটিয়ে দিক। সে চোখ বড় করে ঝাঝালো ভাবে তাকালো সাদের দিকে। সাদ আবারও নিরীহ গলায় বললো
“মানুষ দরকারে আরো কত কঠিন কাজ করে, আমিতো শুধু তালাটাই ভেঙ্গেছি। এভাবে রেগে যাচ্ছো কেন?
“তালা ভাঙ্গার জন্য কি শুধু আপনি আমার তালাই পান? আচ্ছা বলুন তো, আপনি কি তালা ভাঙ্গার উপর পিএইচডি করেছেন?
“পিএইচডি ছাড়াই ভালোভাবে ভাঙ্গতে পারি, এর জন্য পিএইচডির কোনো প্রয়োজন নেই।
আশার ইচ্ছে হলো না আর কোনো কথা বলার। সে রেগে বারকয়েক বার সাদের দিকে তাকিয়ে এক পর্যায়ে উঠে চলে গেলো হনহন করে। সাদ কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে রইলো সেদিকে।।

সবকিছু মোটামুটি প্রায় সম্পন্ন হলে রাতে শোবার বন্দোবস্ত করা হলো। যে যেভাবে পেরেছে শুয়ে পরেছে।।
কথা ছিলো আশার রুমে ওর কয়েকটা মেয়ে কাজিনসহ সে শোবে। সেই মোতাবেক তারা এসে শুয়ে পরলো নিজেদের মতো। বিপাকে পরলো সাদ। সে কোথায় শোবে ভেবে পাচ্ছেনা। আশাও যে সেই রাগ করে গেলো আর এলোনা। এদিকে চোখে অনেক ঘুমও এসেছে। কি করবে না করবে ভেবে এদিক ওদিক হাঁটতে লাগলো। এক সময় শরীর বেশ ক্লান্ত হয়ে গেলে সে কোনো কিছু না ভেবে সোজা আশার রুমে গিয়ে হাজির হলো। মেয়েগুলো নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে, তবে আশা নেই এখানে। সাদ দেখলো পাশের টেবিলের উপর পানিভর্তি একটা জগ রাখা। সে জগ থেকে হাতে পানি নিয়ে একটা দুষ্টু হাসি হাসলো। এরপর পানিগুলো ছিটিয়ে দিলো মেয়েগুলোর উপর।

হটাৎ গায়ে পানি পড়ায় হুড়মুড়িয়ে উঠলো তারা। আচমকা ঘুম ভাংগায় কিছু বুঝতে পারলোনা। সাদ তৎক্ষনাৎ ব্যস্ত গলায় বললো
“প্রচুর বৃষ্টি শুরু হয়েছে ৷ অনেক কিছুই বাইরে রয়ে গেছে। ভিজে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেগুলো। তারাতাড়ি তোমাদের যেতে বলেছে৷ সবার মধ্যে একটা মেয়ে ঘুমঘুম চোখে বললো
“হটাৎ বৃষ্টি?
“হুম।
“কিন্তু আমাদের গায়ে পানি এলো কোথা থেকে?
“হয়তো ঘরের ছাদে ফুটো হয়ে গেছে।
ঘুম লেগে থাকায় সেগুলো নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করলো না মেয়েগুলো। যেহেতু আগামীকাল বিয়ে, আর বাইরে প্রয়োজনীয় জিনিস ভিজে নষ্ট হচ্ছে তাই তারা দুচার না ভেবে ছুটে চলে গেলো বাইরে।
সাদ বিশ্বজয়ের হাসি হেসে এক লাফে উঠে পরলো বিছানায়। এরপর এক পলক বাইরে তাকিয়ে শুয়ে পরলো পাতলা একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে।

কিছুটা সময় পর মেয়েগুলো বেশ রেগেমেগে ফিরে এলো, এবার ওদের সাথে ছিলো আশা। মুলত ওরাই আশাকে ধরে নিয়ে এসেছে। নালিশ করছে, কোত্থেকে কোন ছেলে এসে ওদের সাথে ফাইজলামো শুরু করে দিয়েছে। আশা রুমে এসে দেখলো সাদ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। হয়তো তন্দ্রার মাঝে আছে।। আশা বিস্ময় নিয়ে বললো
“ইনি তোদের সাথে এমন করেছে?
মেয়েগুলো একসাথে বলে উঠলো
“হ্যাঁ।
আশা মুচকি হাসলো। সাদ পারেও বটে। শোবার জন্য কি মজাটাই না করলো। আশাকে এভাবে মুচকি হাসতে দেখে মেয়েগুলো অবাক হয়ে বললো
“তুমি হাসছো কেন?
আশা ধীরগলায় বললো
“কান্না করিস না, উনি যদি তোদেরকে এভাবে নাও বিদায় করতো তাহলে আমিই এসে তোদের তুলতাম।
“কেন?
“উনি যতদিন আছেন, ততদিন আমার রুমটা উনার নামেই বুকিং করা হয়ে গেছে।

পরের দিন সকাল সকাল সকলেই উঠে গেলো। বাড়ির মহিলারা রান্নার কাজে ব্যস্ত। ছেলেমেয়েরা আনন্দ করছে। এদিকে আদিবকে নেওয়া হয়েছে গোসলের জন্য। সাদকে নাস্তা দেওয়া হলে সে ভদ্রতার সাথে নাস্তা শেষ করে এগিয়ে গেলো আদিবের গোসলের যায়গায়। ছেলে মেয়ে, মহিলারা কাদা ছুড়াছুড়ি করছে, একে অন্যকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে, রং নিয়ে খেলছে। কেউ কেউ তো এইসব থেকে বাঁচার জন্য ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজায় খিল দিচ্ছে, তাতেও শেষ রক্ষে হচ্ছেনা। কোনো না কোনো ভাবে তাকেও ভিজানো হচ্ছে।

কিছুটা দুরে দাঁড়িয়ে সবটা উপভোগ করছে সাদ। বেশ ভালোই লাগছে তার। খুব সাধারণের মাঝেও তারা অসাধারণ আনন্দ উদযাপন করছে। হটাৎ ই ঘটে গেলো এক দুর্ঘটনা। কোথা থেকে রংমাখা পানি এসে ভিজিয়ে দিলো সাদকে। সাদ উৎসের দিকে তাকিয়ে দেখলো একজন মাঝবয়সী মহিলা কিছুটা দুরে ওর দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে আছে আর অদ্ভুত ভাবে হাসছে। হাতে একটা মগ। মহিলাটি আশার চাচাতো দিকের ভাবী হয়। সাদের বুঝতে বাকি রইলো না এ কাজটা উনারই। তবে সে কিছুটা নার্ভাস ফীল করতে লাগলো।। সে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে রইলো।

এমন সময় এগিয়ে এলো আশা। বেশ রেগে গেলো সে। এটা কি ধরনের অসভ্যতা , তারা আনন্দ করছে করুক, তাই বলে উনার সাথে এমন কেন করলো। সে রেগে গিয়ে বেশ ভারী গলায় কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিলো সেই ভাবীকে। সাদ শান্ত গলায় আশাকে বললো
“থাক না কিউটি, একটা দিনেরই তো ব্যাপার। এটা করে উনাদের যদি একটু আনন্দ হয় তাতে সমস্যা কোথায়।
আশা সে কথার উত্তর না দিয়ে বললো
“আসুন আমার সাথে। ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করবেন।
সাদ আশাকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলো।

বেলা এগারোটা নাগাদ বরযাত্রীরা রওনা হলো। লোকজনের সংখ্যা বেশি থাকায় চারটে মাইক্রোবাস আর বরের জন্য টয়োটা প্রাডো নেওয়া হয়। এছাড়া বাইকে করেও অনেকে যাবে।
বরের গাড়িটা অনেক রকমের ফুল দিয়ে সাজিয়ে সুসজ্জিত করা হয়।
বাকি গাড়িগুলোতে অধিকাংশ বরযাত্রীরা উঠেছে। শুধুমাত্র যেটা দিয়ে বর যাবে সেটাতে বরের পাশাপাশি ওর কিছু বন্ধুবান্ধব, আশা, সাদ আর আশার দুটো মেয়ে কাজিন বসেছে। আশার ঠিক পাশেই বসেছে সাদ। পুরোটা রাস্তাই বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা আর আনন্দ ফুর্তি করেই জার্নিটা সেড়েছে ওরা।

বিয়েটা শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এর মাঝে বউকে নিয়ে ফিরে আসার বন্দোবস্ত করা হয়ে গেছে। বিদায় বেলা অঝোরে কান্না করছিলো সদ্য বিবাহিত বউটি। সাদ দূর থেকে দেখছিলো সেটা। পাশেই আশা ছিলো। সাদ দৃষ্টি সামনে রেখেই আশাকে জিজ্ঞাসা করল
“কিউটি
আশা শান্ত গলায় বললো
“কিহ?
“বউ সাজার পর মেয়েদের অনেক কিউট লাগে তাইনা?
“হুম। খুশিমনে উত্তর দিলো আশা।
সাদ এবার আশার দিকে তাকালো। ভারী গলায় বললো
“তোমার ইচ্ছে করেনা?
“কি?
“বউ সাজতে?
আশা এবার অবাক হয়ে তাকালো সাদের দিকে। বিস্ময় নিয়ে বললো
“আমার কেন শুধু শুধু বউ সাজতে ইচ্ছে করবে?
“তোমার বিয়ে হলেও সাজতে ইচ্ছে করবেনা?
আশা সামান্য হেসে বলল
“যখন বিয়ে হবে, তখন দেখা যাবে।।
“কবে হবে তোমার বিয়ে?.
সাদের এমন বোকা বোকা প্রশ্নে হাসি পেলো আশার। হাসিটাকে কন্ট্রোল করে বললো
“যেদিন কেউ বর সেজে আসবে সেদিনই আমার বিয়ে হবে।।

সাদ ভ্রু বাকিয়ে বললো
“যে কেউ বর সেজে চলে এলেই বিয়ে করে ফেলবে?
“আপনার মাথায় এসব কথা কেন আসছে বলুন তো? বিয়েটা কি আমার হাতে? আমাকে কে বিয়ে করবে না করবে সেটা আমি কি করে জানবো? আর যে কেউ এলেই বা কেন বিয়ে করবো? আমার মা আছে, ভাইয়া আছে। উনারা আমার জন্য যাকে ঠিক করবে, আমি তাকেই বিয়ে করবো। তবে সেটা অনেক পরের কথা। এখন ওদের বিয়েটা দেখুন তো। আশা অন্যদিকে চোখ ফেরালো। তবে সাদের দৃষ্টি এখনো আশার দিকে। কেন যেনো বেশ অস্বস্তি হচ্ছে তার।

বাড়ি ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় আশা। বউ নিয়ে আসায় গ্রামের মানুষজন ভীর করেছে নতুন বউ দেখার জন্য। অন্যদিকে আদিবের রুমটা সাজানোর বন্দোবস্ত চলছে। উঠোনে একটা চেয়ারে বসে আছে আদিব। তার ঠিক পাশের চেয়ারটায় সাদ বসা। আশেপাশে আরো কিছু মানুষ আছে। আদিব সাদের দিকে তাকিয়ে বললো
“এখানে তোমার কোনো কষ্ট হচ্ছেনা তো?.
সাদ বিনয়ের হাসি হেসে বললো
“আমি এতো আনন্দ মনে হয় কখনো পাইনি। অনেক ভালো লাগছে আমার।। জীবনের অর্ধেক স্বার্থকতা এখানেই পেয়ে গেলাম বোধহয়।।
আদিব তৃপ্তির হাসি হেসে বললো
“আবার আসবে তো আমাদের বাড়ি? নাকি ফিরে যাবার পরই ভুলে যাবে?
“ভুলে যাওয়া কি এতটাই সহজ?

আদিব আর কোনো উত্তর দিলোনা। এর মাঝে একজন বয়স্ক লোক বলে উঠলো
“নিজের বিয়েটা তো হয়েই গেলো, এবার বোনের বিয়ের চিন্তাটাও করিস। বয়সটা আর তো কম হয় নাই।
আদিব মৃদু হেসে বললো
“আমার বোন এখনো একটা বাচ্চা। যখন সময় হবে তখন বিয়ে হবেই। আমরা কেউ আটকে রাখতে পারবোনা। তাই বলে বয়সের দোহাই দিয়ে এখনই যার তার হাতে তো তুলে দিতে পারিনা।
লোকটি চওড়া হাসি হেসে বললো যার তার হাতে কেন দিবি। তোরা চাইলে আমি একটা পাত্রের সন্ধ্যান দিতে পারি। খুবই ভালো পাত্র।
সাদের মুখটা হটাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। কিউটির বিয়ে হয়ে যাবে, কথাটা মাথায় আনলেও কেমন যেনো গা ঝাড়া দেয়।
আদিব ভ্রু বাকিয়ে বললো
“তাই? ভালো পাত্র!! তা কেমন ভালো পাত্র শুনি?
“ছেলে বিদেশ থাকে, অনেক টাকা কামাই করে। গ্রামে অনেক বড় দালান করছে, শহরেও অনেক যায়গা আছে। কিন্তু বিয়া কইরা বউরে দেশে রাখবো না, সাথে কইরা নিয়া যাইবো বিদেশে। এমন ভাগ্য কয় মাইয়ার হয়। তোর বোইন মাশাল্লাহ সুন্দর। অপছন্দ করবোনা। তুই কইলে আমি ওগোরে কমু আমাগো আশারে আইসা দেখার লাইগা।

সাদের বুকের মধ্যে হটাৎ হাতুড়ি পিটা শুরু হলো। বুক ধরফর করা শুরু করলো অনবরত। হার্টবিট বেড়ে গেছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। সে নিরীহ চোখে তাকিয়ে রইলো আদিবের দিকে। সে কি বলে সেটা শোনার জন্য।
আদিব হাসলো। বললো
“আমার বোনের এতো ভাগ্যের দরকার নেই। কোনো বিদেশী জামাই আমাদের চাইনা। সে যতই বড়লোক হোক না কেন।। আমার বোনকে এমন কারো কাছে বিয়ে দিবো যেনো সে সবসময় আমার বোনের পাশে থাকতে পারে, আর আমরাও যখন তখন আমাদের আশামনিকে দেখতে পারি।

চলবে…….

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-১৭

সদ্য বিবাহিতা নতুন বউ টি আশার রুমে বিছানার একপাশে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। চারিদিকে অনেক লোকের আনাগোনা। কিছুক্ষণ পর পর আশা এসে তার ভাবীর কি লাগবে না লাগবে জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছে। বিনিময়ে তার ভাবী মাথা নেড়ে জানান দিচ্ছে, উনার কিছু চাইনা।

এর মধ্যে আশার কাজিনেরা হুরমুর করে ঘরে এসে ঢুকেছে। তারা সবাই ব্যস্ততার সাথে আশাকে টেনে বাইরে নিয়ে যেতে লাগলো। আশা কিঞ্চিৎ ভ্রু বাকিয়ে বললো
“আমাকে এভাবে টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস তোরা?
“ভাই ভাবীর বাসর সাজাবি না? চল..
বাসরের কথা শুনে সদ্য বিবাহিতা বউ এর মুখ লজ্জায় লাল বর্ণ ধারণ করলো। আশা সেটা খেয়াল করে হাসলো। এখন কিছু বললে উনি হয়তো আরো লজ্জা পেয়ে যাবেন তাই সে আর এখানে কোনো কথা বাড়ালো না।
সকলের সাথে বাইরে গিয়ে উপস্থিত হলো আশা। সে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিলো বাসর সাজানো তার পক্ষে সম্ভব না।

বাকিরা এটা মানলো না। তারা টেনে হিচড়ে আশাকে সাথে করে আদিবের রুমের সামনে নিয়ে গেলো। আশা খেয়াল করলো সেখানে সাদও আগে থেকে দাঁড়িয়ে আছে। সাদ অপলক চোখে তাকিয়ে আছে আশার দিকে। আশা কিছুটা ইতস্তত বোধ করলো। সে আবারও বলে উঠলো
“আমাকে ছাড়া তো। ওদিকে আমার কাজ আছে।
সবাই সমস্বরে বলে উঠলো
“কোন কাজটাজ নেই। আমাদের সাথে বাসর সাজাবে ব্যস। সাদ ভাইয়াও আমাদেরকে সাজাতে সাহায্য করবে।
আশা বিস্ময় নিয়ে তাকালো সাদের দিকে। বললো
“আপনি সাজাবেন?
সাদ মুখ ফুটে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে জানান দিলো সেও সাজাবে।

আশা বাকিদের দিকে তাকালো। মৃদু গলায় বললো
“তোরা উনাকে নিয়ে সাজা প্লিজ। আমাকে ছেড়ে দে। আমি এটা পারবোনা।
এবার মুখ খুললো সাদ। শান্ত গলায় বললো
“কেন পারবেনা কিউটি?
“এমনি।।
“এমনি কোনো উত্তর হতে পারেনা। কারণ থাকলে বলো, নাহলে আমাদের সাথে চলো।
আশা এবার ইতস্তত গলায় বললো
“এটা আমার আপন বড় ভাইয়ের বাসর। যে সবসময় আমার বাবার মতো মাথার উপর থেকেছে, আগলে রেখেছে। বাবার যায়গায় বড় ভাই হয়েও সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছে। আমি কিভাবে তার বাসর সাজাতে পারি? ব্যাপারটা আমার জন্য বেশ লজ্জাজনক। সে যদি আমার কোনো কাজিন হতো, আমি নির্দ্বিধায় এটা করতাম। কিন্তু আপন বড় ভাইয়ের বাসর সাজানোটা ছোট বোন হিসেবে আমার কাছে বিব্রতকর।

বাকিরা খানিক তেজ নিয়ে বললো
“এটা কোনো লজিক হলো? বড় ভাইয়ের বাসর সাজানোটায় সমস্যা কোথায়?
“হয়তো এটা কোনো লজিকের মধ্যে পরেনা। কিন্তু আমার কাছে এটাই লজিক মনে হচ্ছে।
আশা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতের আঙ্গুলগুলো বার বার মুষ্টিবদ্ধ করছে। সাদ নজর ফেরাতে পারছেনা সেদিক থেকে।। এই মুহূর্তে ওকে আরো বেশি ভালো লাগছে সাদের কাছে। সাদ আশার দৃষ্টির অগোচরে হাসলো। সে মারাত্মক হাসি। যদি সেই মুহূর্তটা আশার নজরে আসতো নির্ঘাত সাদের প্রেমে পরতে বাধ্য হতো।।
বাকিরা এখনো নারাজ আশার এই ডিসিশন মানতে। তারা আশাকে চেপে ধরে আছে। সাদ এবার সকলের উদ্দেশ্যে বললো
“আমরাই নাহয় সাজাই। কিউটি অস্বস্তিতে পরুক, এমন কিছু তো আমরা চাইতে পারিনা বলো, ওকে ওর মতোই থাকতে দিই। চলো, আমরা কাজে লেগে পরি।
বাকিরা সামান্য হতাশ হলেও সাদের কথায় রাজি হয়। আশা অবাক দৃষ্টিতে তাকায় সাদের দিকে। সকলে রুমের ঢুকে গেলে সাদ আশার মুখোমুখি দাঁড়ায়। আশার চোখ নিচের দিকে ফেরানো। সাদ মুচকি হাসে , আবেশী গলায় বলে
“কেন জানি তোমাকে ফোর্স করতে পারিনা। তুমি এতটাই কিউট যে ফোর্স শব্দটা তোমার সাথে যায় না।।

আশার নির্বাক দৃষ্টি সাদের চোখ বরাবর গিয়ে ঠেকে। সে চোখে প্রচুর মায়া, অজানা এক টান। ইচ্ছে করে হারিয়ে যাক সে চোখের গভীর থেকে গভীরে। সাদ কিছুক্ষণের জন্য সে মোহে আটকে পরে। দুহাত দিয়ে আলতো করে আশার দুগাল চেপে ধরে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে আশার একদম কাছাকাছি। আশা যেনো একটা পাথরে পরিণত হয়ে গেছে। একদম নড়াচড়া করতে পারছেনা। সাদের নজর আশার চোখ বরাবর। কিঞ্চিৎ দুরত্বে থাকা অবস্থায় সাদ বলে উঠে,
“এতটা কিউট তুমি, একদম স্ট্রবেরির মতো। দেখলে দূরে থাকা যায়না, খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।
আশা কাঁপাকাপা গলায় বলে
“কিহ!
“কি?
হটাৎ হুশ ফিরে আশার। সাদ এখনো তার দুগাল চেপে ধরে আছে। আশা যতদ্রুত সম্ভব নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় সাদের হাত থেকে। পিছিয়ে যায় বেশ কয়েক কদম। সাদও নিজ ধ্যানে ফিরে আসে। আশার সারা শরীর কাঁপছে।

সাদ ভ্রু বাকায়। স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে
“এভাবে কাঁপছো কেন কিউটি?
আশা অবাক হয়। কেন কাঁপছি সেটা কি উনার অজানা? নাকি ভুলে গেছেন এর মধ্যে? এটা কি করে সম্ভব!!
সাদ আবারও বলে
“কোনো সমস্যা হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ লাগছে?
আশা মৃদু গলায় উত্তর দেয়
“আমি ঠিক আছি।
একদন্ড সে আর এখানে থাকেনা। এক দৌড়ে চলে যায় নিজ ঘরে। নতুন ভাবীর পাশে গিয়ে ধপ করে উপুর হয়ে শুয়ে পরে। হার্টবিট বেশ উঠানামা করছে। কপাল বেয়ে ঘাম পরছে। এটা কি হলো কিছুক্ষণ আগে? স্বপ্ন নয়তো? কিছু ভাবতে পারছেনা আশা। বেশ লজ্জা লাগছে তার, সেই সাথে কিছুটা রাগও লাগছে। বিয়ে বাড়ির এত মানুষজনের ভীরে এটা কিভাবে করতে পারলো সে, পাছে কেউ দেখে নিলে কত বড় বদনাম হতে পারতো ভাবা যায়।

আশা চলে আসার পরপরই লজ্জাজনক হাসি হেসে মাথা চুলকাতে থাকে সাদ। ঘোরের বশে সে কি না করে বসলো। যদিও আশা যেনো কোনো বিব্রতবোধ না করে সেই জন্য তার কিছু মনে নেই এমন একটা অভিনয় সে করেছে, তাতে কি। ঘটনাটা তো ঘটেছে। সাদ আবার মৃদু হাসলো। হটাৎ এক অজানা টান অনুভব করলো সে আশার প্রতি। এ টানের নাম কি? একেই কি বলে ভালোবাসা?
সাদের ভাবনা কাটলো কারো ডাকে। আদিবের রুম থেকে ডাক এসেছে। সমস্ত চিন্তাভাবনাকে এক সাইডে রেখে সে রুম সাজানোর জন্য চলে গেলো ভিতরে।

পরের দিন বউ ভাতের আয়োজন ছিলো। বিশাল আয়োজন করা হয়েছিলো সেদিনটাতেও। গ্রামের সকলের জন্য প্লাস আদিবের শশুড় বাড়ির লোকজনের জন্য আয়োজন টা করা হয়েছে। সে জন্য খুব ব্যস্ততার মাঝে রইলো আশা। তবে সাদও বসে নেই। বাড়ির ছেলের মতো সেও খেটে যাচ্ছে সমানে।। একটা সময় কাজ করতে করতে বেশ পানি পিপাসা পেলো তার। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পানি খাবার জন্য আশার রুমে গিয়েও লাভ হলোনা। সেখানে কোনো পানি ছিলোনা। সে রান্নাঘরের দিকে গেলো। অনেক মহিলাটা সেখানে কাজ করছে। দিলারাও ছিলো সেখানে। সাদকে রান্নাঘর মুখো হতে দেখে তিনি বেরিয়ে এলেন।। মমতাভরে বললেন
“তোমার কিছু লাগবে বাবা?
“পানি পিপাসা পেয়েছে আন্টি।
দিলারা খেয়াল করলেন সাদের পুরো শরীর ঘামে ভিজে চুপচুপ করছে। ফর্সামুখটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। বড় লোকের ছেলে, কখনো পরিশ্রম করেনি, আর সেই ছেলে কিনা গ্রামের বাড়ি বেড়াতে এসে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছে।

দিলারার মনের কোনো এক যায়গায় বেশ শক্তপোক্ত আসন করে নিতে সক্ষম হলো সাদ। তিনি নিজের আঁচলে সাদের মুখের ঘাম মুছে দিলেন। দরদ ভরা গলায় বললেন
“তুমি আশার রুমে গিয়ে বসো বাবা, আমি পানি পাঠাচ্ছি রুমে।
সাদ প্রাণখোলা হাসি হেসে বললো
“কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো আমার মা আমাকে আদর করছে, আমি ঘেমে গেলে আমার মাও এভাবে আমার মুখ তার পরণের কাপড় দিয়ে মুছে দেয়।
দিলারা হাসলেন।।
সাদ আশার রুমে চলে এলে দিলারা আশাকে ডেকে একগ্লাস লেবুর শরবত করার জন্য বললেন। আশা কোনো কথা না বাড়িয়ে মায়ের হুকুম পালন করতে লাগলো।
দিলারা চলে গেলেন আদিবকে খুঁজতে।।

বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেলো। অথচ কেউই পানি নিয়ে আসছেনা। সাদ ভাবলো এতো এতো ব্যস্ততার ভীড়ে আন্টি হয়তো ওর পানি খাবার কথাটা ভুলেই গেছে। সে এবার উঠে পরলো, বাইরে বেরোবার জন্য পা বাড়াবে ঠিক সেই মুহূর্তে রুমে এসে ঢুকল আশা। ওর হাতে বিশালাকার একটা ট্রে। এতে তিনটে গ্লাস রাখা। একটা বাটিতে মিষ্টি, আর দুটো বাটিতে দুই ধরনের আচার।
সাদ এতসব দেখে অবাক হলো। বিস্ময় নিয়ে বলল
“এগুলো কার জন্য এনেছো কিউটি?
আশা টেবিলের উপর ট্রে রাখতে রাখতে বললো
“মা পাঠিয়েছে আপনার জন্য।
সাদ অবাক হলো।

আশা একটা গ্লাস সাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো
“সারাদিন খাটাখাটুনি করেছেন, কুলি করে নিন।
সাদ বাধ্য ছেলের মতো সেটা করলো। এরপর আরেকটা গ্লাস ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো
“ঠান্ডা পানি দিয়ে লেবুর শরবত করেছি। খেয়ে দেখুন, ভালো লাগবে।
“তুমি করেছো?
“মা বলেছে করতে।
সাদ হাসলো। গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো পুরোটা শরবত।
এরপর বাকি গ্লাসটার দিকে চোখ গেলো সাদের। প্রশ্ন করলো
“ওটায় কি আছে?
“ডাবের পানি। ভাইয়াকে দিয়ে গাছ থেকে পাড়িয়েছে মা, আপনার জন্য।
“এইটুকু সময়ের মধ্যে আন্টি এতকিছু করে ফেলল কখন?.
“আমার মা সবকিছুতে এক্সপার্ট।
আশার মুখে হাসি লেগে আছে। সাদ এদিকে তাকিয়ে নিজেও মুচকি হাসলো। এটাও বাদ রাখলোনা। খেয়ে নিলো খুশিমনে।।

এবার ট্রেতে মিষ্টি আর আচারগুলো সাদকে দেখিয়ে বললো
“এবার এগুলো খান।। গরমে আচার খেলে ভালো লাগবে। মিষ্টিগুলোও খেয়ে নিন। আমি জগটা ভরে নিয়ে আসছি।
সাদ হেসে বললো
“শরবত আর ডাবের পানি খেয়েই পেট ভরে গেছে, কিন্তু তাও আমি খাবো। তবে মিষ্টি নয়, আচারগুলো। মিষ্টিগুলো নিয়ে যাও কিউটি।
আশা কথা না বাড়িয়ে মিষ্টির বাটিটা নিয়ে চলে গেলো।
ও চলে যাবার পর চারপাশটায় চোখ বুলালো সাদ। হাসতে হাসতে একা একাই বললো
“শশুড় বাড়ি হিসেবে এমন বাড়ি পেলে মন্দ হয়না।

এমন সময় ফোনের ম্যাসেজ টোনটা বেজে উঠলো। চামচে আচার তুলে সেটা মুখে দিতে দিতে ওপেন করলো সে। হটাৎ মুখটা ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করলো। নিমিষেই খারাপ হয়ে গেলো মনটা। আশা ফিরে এসে দেখলো সাদ খাওয়া বাদ দিয়ে কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছে।। সে বললো
“চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে আগে খেয়ে নিন। চিন্তা করার জন্য অনেক সময় পরে আছে।।
সাদ এক নজর তাকালো আশার দিকে। আশা ওর কাছাকাছি চলে এলে সাদ উঠে দাড়ালো। ওর ঠোঁটগুলি কাঁপছে। আশা অবাক হলো। সে দুইপা এগিয়ে এসে বললো
“কি হলো আপনার?
“ঢাকায় যাবে কবে কিউটি?
” সপ্তাহখানেক দেরি হবে। কেন?
“আমাকে চলে যেতে হবে। তুমি যাবে আমার সাথে?
সাদের চলে যাবার কথা শুনে বুকে কিঞ্চিৎ ব্যাথা অনুভব করলো আশা। তবুও উনাকে যেতে তো হবেই। তাই মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললো
“আপনার প্রয়োজন হলে আপনি যেতেই পারেন, কিন্তু আমার ভাইয়ের বিয়ে, আমি কিভাবে চলে যাবো!
“বিয়ে তো শেষ।
“আমেজটা তো রয়ে গেছে। আর তাছাড়া এখন আমাকে যেতে দিবেও না আমার ফ্যামিলি।

সাদ একটু এদিক ওদিক তাকালো। এক পর্যায়ে কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই সে আচমকা বলে উঠলো
“আমাকে বিয়ে করবে কিউটি? সারাক্ষণ তোমাকে নিজের কাছে রাখবো, প্লিজ করবে বিয়ে বলো?….

চলবে…..