ভালোবাসি তাই পর্ব-৩৫+৩৬

0
543

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-৩৫

রাতের নিস্তব্ধতায় চারিদিক টা থমকে আছে। কোথাও নেই কোনো মানুষের সাড়াশব্দ। দূর থেকে দু চারটে শেয়ার কুকুরের হাঁক আর মাঝেমধ্যে ঝিঁঝিপোকার আহাজারি,, আর কিছুই কানে আসছে না এই মুহূর্তে। দিলারা ঘুমিয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে। কিন্তু ঘুম নেই আশার চোখে। বেশ অনেক্ষণ যাবৎ চেষ্টা করে যাচ্ছে ঘুমানোর জন্য, কিন্তু ঘুম যেনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। আশা এক সময় শোয়া থেকে উঠে বসে, বেশ বিরুক্ত লাগছে এবার। রাতে সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয়টা হচ্ছে চোখে ঘুম না আসা। আশা বিছানা ছেড়ে নেমে আসে, একবার মায়ের দিকে ফিরে তাকায় সে। মা খুব আরামে ঘুমাচ্ছে। আশা মুচকি হেসে ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরোয়।।

বারান্দার মাথায় গিয়ে দাঁড়ায় সে। ফুরফুরে হাওয়া বইছে, মুহুর্তে শরীর আর মন দুটোই জুরিয়ে গেলো তার। এক রাশ স্নিগ্ধতা অনুভব করলো সে। আশা রুমের সামনে পায়চারি করতে লাগলো। এক সময় সে খেয়াল করলো তার রুমের সামনে অর্থাৎ যেখানে এখন সাদ আছে সেখানটায় মৃদু আলো জ্বলছে। আলোটা ঘরে নয়, ঘরের বাইরে। টিমটিমে আলোটা একবার জ্বলছে তো আরেকবার নিভছে। ব্যাপারটায় অবাক হলো আশা। কি হচ্ছে এখানে? আশার মনে উৎসাহ জাগলো ব্যাপারটা কি দেখার জন্য। পরক্ষণে কিছুটা ভয়ও লাগলো মনে। এত রাতে ওখানে গিয়ে দেখা টা ঠিক হবে কিনা ভাবতে লাগলো সে। এইসব ভাবতে ভাবতেই আশার নজরে এলো একটা অবয়ব। টিমটিমে আলোটা এবার বন্ধ না করে মুখের সামনে বেশ কিছুটা সময় জ্বালিয়ে রেখেছিলো সাদ। যার কারণে মুখটা স্পষ্ট বোঝা গেছে। আশা অবাক হলো, এত রাতে সে বাইরে বসে আছে কেনো?
আশা এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলো সেদিকে। সাদের হাতে একটা লাইটার… সেটা দিয়েই সে এমন করছে।

আশা সাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে সাদ কারো উপস্থিতি টের পেলো। ঘার ঘুরিয়ে সে তাকালো আশার দিকে। বিস্ময় নিয়ে বললো
“কিউটি তুমি!!
“এত রাতে বাইরে বসে আছেন কেন?
“এত রাতে তুমি বাইরে কি করছো কিউটি?
আশা সামান্য হেসে বললো
“প্রশ্নটা কিন্তু আমি আগে করেছি।
সাদ লাইটার টা এবার হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে মৃদু গলায় বললো
“ঘুম আসছিলো না, তাই এখানে বসে আছি। কিন্তু তুমি এখানে কেন?
আশা মুচকি হেসে সাদের পাশে বসলো। এরপর বললো
“আমারও ঘুম আসছে। বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম। বিরক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি আপনি বসে আছেন এখানে। তাই এসেছি।
“ওহ!
সাদ আর কিছু বললো না, নিজের মতো বসে রইলো। আশা কিছুটা অবাক হলো। এ তো এভাবে বসে থাকার পাত্র নয়, সারাক্ষণ বকবক করেই থাকে। আর আশা সামনে থাকা অবস্থায় তো আরো বেশি। তাহলে হঠাৎ এখন এতো চুপচাপ কেন?

আশা প্রশ্ন করলো
“মন খারাপ?
সাদ অন্যমনস্ক হয়ে বললো
“নাহ।
“তাহলে চুপচাপ যে?
কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে এক সময় সে বললো
“ভাবছি কাল চলে যাবো।
কথাটা তীরের ফলার মতো আশার বুকে গিয়ে আঘাত করলো। যে মানুষটা এতটা উৎসাহ আর তীব্র ভালোবাসা নিয়ে দূর দেশ থেকে পাড়ি জমিয়ে এখানে এসেছে শুধুই তার জন্য, সেই কিনা একটা দিন যেতে না যেতেই চলে যাবার কথা বলছে!!
আশা বিস্ময় নিয়ে বললো
“এখানে আপনার কোনো সমস্যা হচ্ছে?
সাদ মৃদু হেসে বললো
“তোমাদের আতিথেয়তা মানেই অন্যরকম অনুভূতি। এখানে সমস্যা হওয়ার কোনো চান্সই নেই।
“তাহলে চলে যাবার কথা বলছেন যে?
“যেতে তো হবেই। এখানে কি আমি সারাজীবন থাকার জন্য এসেছি।

কথাটা অন্যরকম ঠেকলো আশার কানে। সে বিস্ময়ে বললো
“হঠাৎ এইভাবে কেন কথা বলছেন?
“আজকাল কেন যেনো সুন্দর করে কথা বলতে পারছি না। অনেকের কাছে তিক্ত, আবার অনেকের চোখের পানিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায় আমার বলা অতি ছোট্ট কথাগুলোও।
এতক্ষণে সাদের মন খারাপের আসল কাহিনি আশার নিকট স্পষ্ট হলো। তখন তাকে ভালোবাসার কথা বলতে বলার পরও আশা বলেনি, বরং অতি উত্তেজনায় চোখের কোনে পানি এসে গেছিলো তার। ব্যাপারটা সাদকে এতটা কষ্ট দিবে সেটা ধারণারও বাইরে। সাদ হঠাৎ বসা থেক উঠে দাড়ালো। আশার দিকে না তাকিয়েই বললো
“রুমে চলে যাও কিউটি, গিয়ে ঘুমিয়ে পরো। অনেকটা রাত হয়ে গেছে।
সাদ রুমে যাবার জন্য পা বাড়ালো। ঠিক সে মুহূর্তে আশা বলতে শুরু করলো…
______আমি উত্তপ্ত বালুচরে, মরিবার প্রান্তরে..
ক্ষণে ক্ষণে আপনারে চাই..
বড্ড বেশি ভালোবাসি তাই।

সাদ থমকে দাঁড়ালো আশার কথায়। সে বিস্মিত চোখে ফিরে তাকালো আশার দিকে। অবাক হয়ে বললো
“কি বললে, কি বললে কিউটি?
আশা মৃদু হেসে বললো
“ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি… বড্ড বেশি ভালোবাসি আপনারে।
সাদের মুখে হঠাৎ হাসি ফুটে এলো। সে দ্রুত গতিতে আশার সামনে এসে দাড়ালো। দুহাতে আশার দুই বাহুতে চেপে ধরে বললো
“আবার বলো কিউটি।
আশা হাসলো। মিষ্টি কন্ঠে বললো
“আমি কি আপনার বাচ্চার মা হতে পারি?
সাদের চোখেমুখে খুশির ঝলকানি ভেসে উঠলো। সে এক টানে নিজের সাথে জরিয়ে ধরলো আশাকে। বুকের সাথে চেপে ধরে প্রচন্ড খুশির সাথে বললো
“আগে আমার বউ হও, বাচ্চার চিন্তা আমার।

_____

ঘুম ভাংলে চোখ মেলে তাকিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো বেলা দশটার কাছাকাছি। ধরফরিয়ে উঠে বসলো আশা। এতটা বেলা অব্দি সে ঘুমিয়েছে, আর কেউ তাকে ডাকলোই না!! আশা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে তারাহুরো করে নেমে গেলো বিছানা থেকে। গতরাতে অনেক রাত অব্দি সজাগ ছিলো, যার ফলে এখন এই অবস্থা, তাই বলে কেউ ডাকবে না? আশা সামান্য রাগি রাগি মুখ করে বাইরে বেরোলো। ঘর থেকে বেরিয়েই সে অবাক। এটা কি তার নিজের বাড়ি? বাড়িটাকে বেশ সুন্দর করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। সাইডের আগাছাগুলো কেটে সাফ করে দেওয়া হয়েছে। এপাশ ওপাশে যত ঝোপঝাড় ছিলো তা বাদ দেওয়া হয়েছে, উঠোনে থাকা যত অপ্রয়োজনীয় জিনিস ছিলো সব এক সাইডে থাকে থাকে রাখা হয়েছে, ইনফ্যাক্ট এখনো বাড়ি পরিষ্কারের কাজ চলছে। আর কাজগুলো করছে আদিব.. আর তার হেল্পার হিসেবে তাকে সেইসব কাজে সাহায্য করছে সাদ। আশা অবাক হলো, হঠাৎ এরা বাড়ি পরিষ্কার করার কাজে কেন লেগেছে?

আশাকে দেখতে পেয়ে আদিব হেসে বললো
“ঘুম ভাংলো?
“হুম। ছোট্র করে জবাব দিলো আশা। সাদ আশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আদিব বললো
“এতক্ষণ তো আরাম করেছিস, অনেক ঘুমিয়েছিস.. এবার আমার সাথে এসে কাজে হাত লাগা তো।
সাদ মুখ কালো করে বললো
“আমি করছি তো ভাইয়া। আর কি করা লাগবে আমায় বলেন।
আদিব দুষ্টুমির হাসি হেসে বললো
“আমার বোনটা কাজ করলে তোমার খুব কষ্ট লাগবে?
সাদ মুখ বাকালো। ওর এমন কান্ডে হাসলো আদিব৷ আশাও হেসে ফেললো। সে তার মাকে খুজতে খুজতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। সেখানে গিয়ে আরেক দফা অবাক হলো সে। এতো এলাহি আয়োজন চলছে। প্রচুর রান্নাবান্না চলছে। কেউ আসবে না কি?
আশা বিস্ময় নিয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করলো
“আজ এতো রান্নাবান্না কেন হচ্ছে মা?
দিলারা উত্তর দেওয়ার আগেই মৃদুলা হেসে তাকালো আশার দিকে। হাসিমুখে বললো
“খাওয়ার জন্যই হচ্ছে।
খাওয়ার জন্য হচ্ছে সেটা সেও জানে, কিন্তু তাই বলে বিনা কারণে এতো আয়োজন?

আশা ফিরে আসে সেখান থেকে। হয়তো সাদের জন্যই হচ্ছে এতকিছু। বেচারা স্পেশাল গেস্ট কিনা।
আশা ব্রাশটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পরলো বাইরে। ব্রাশ করতে করতে চলে গেলো সেই পুকুর পাড়টায়। এখানে প্রতিদিন সকালে একবার না আসলে দিনটা যেনো ভালো যায় না আশার। যদিও এখন এই মুহূর্তটাকে সকাল বললেও ভুল হবে। রোদ্রের অতি প্রখর তাপে সকালের মিষ্টি ভাবটা চলে গেছে অনেক আগেই। আশা সিড়িতে বসে একমনে দাঁত ব্রাশ করে যাচ্ছে। মাঝেমাঝে গতরাতের কথাগুলো মনে পরে যাচ্ছে। মনে হতেই একা একাই বেশ লজ্জা পাচ্ছে সে। একমনে হাসছে আর ব্রাশ করছে। এমন সময় পেছন থেকে ডাক এলো..
“কিউটি।
আশা ঘার ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে সাদ। এ হাসি মুখটা দেখে আশার মন পুলকিত হলো, সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। আহ, এ হাসিমাখা মুখটা.. এটা দেখেই সে সারাটা জীবন পার করে দিতে পারবে।

সাদ হাসিমুখেই এগিয়ে এলো আশার দিকে। ওর পাশ ঘেঁষে বসে বললো
“ঘুম কেমন হলো রাতে?
“ভালো, আপনার?
“জীবনের সবচেয়ে বেস্ট ঘুমটা বোধহয় গত রাতেই হয়েছে।।
আশা হাসলো সাদের কথায়। সাদ একভাবে তাকিয়ে রইলো এ হাসি মুখটার দিকে। আশা যখন বুঝতে পারলো সাদ একভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে তখন সে লজ্জায় রাঙ্গা হলো। নিচের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো
“কখন উঠলেন?
“খুব ভোরে।
আশা অবাক হয়ে বললো
“রাতে তো অনেক দেরি করে ঘুমালেন, তাহলে এত সকাল সকাল কিভাবে উঠলেন?
“অতি উত্তেজনায় উঠে গেছি।
“কিসের উত্তেজনা? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো আশা।
সাদ মুচকি হেসে বললো
“সিক্রেট।
আশা আর কিছু বললো না। সাদ এবার নরম গলায় বললো
“এলো চুলে তোমায় খুব সুন্দর লাগছে কিউটি।
সাদের কথা শোনে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো আশা। ঘুম থেকে উঠার পর চুল আঁচড়ানো হয় নি, এলোমেলোই আছে। আশার যতটুকু ধারণা, এলো চুলে তাকে পাগলী ছাগলিই লাগে, আর সাদ বলছে সুন্দর লাগছে। এটা বড় ধরনের কোনো পাম নয়তো?

আশা ভ্রু বাকিয়ে বললো
“মতলব কি?
“কিসের মতলব?
“পাম দিচ্ছেন কেন? এলো চুলে আমাকে মোটেও ভালো দেখায় না সেটা আমি জানি।
সাদ হেসে বললো
“তুমিতো অলরেডি আমার প্রেমে পরেই গেছে, তাই শুধু শুধু তোমাকে কেন পাম দিবো বলো তো। পাম দেবার হলে তাদেরকেই দেবো, যারা এখনো আমার প্রেমে পরেনি।।
আশা চোখ বড় বড় করে তাকালো সাদের দিকে। সে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাবে ঠিক তখনই ওর কপালে হুট করে চুমু বসিয়ে দিলো সাদ। আশা নিজ যায়গায় জমে গেলো এবার। এটা কি হলো? চোখের পলকে সাদ আরেকটা চুমু দিয়ে উঠে পরলো সেখান থেকে। কোনো কিছু হয়নি, এমন একটা ভাব ধরে সে চলে যাচ্ছে সেখান থেকে।

আশা কিছুক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে রইলো। এক পর্যায়ে সামান্য রাগ দেখিয়ে সাদ কে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলো
“ওহ আচ্ছা, পাম দেওয়ার কারণ তাহলে এইটা!
সাদ হাসতে হাসতে বললো
“তুমি যেটাই মনে করো কিউটি। আমি মাইন্ড করবো না।
সাদ চোখের আড়ালে চলে যাবার পর আশা নিজ কপালে মৃদুভাবে স্পর্শ করলো। একটু আগেই তার ভালোবাসার মানুষটা এখানে ভালোবাসার মিষ্টি স্পর্শ দিয়ে গেছে। আশা সে যায়গাটায় কয়েকবার হাত বুলালো। অজান্তেই মুখে মৃদু হাসি চলে এলো তার। একা একা বলে উঠলো
“পাগল একটা।

চলবে……

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-৩৬

বেলা যখন বারোটা ছুইছুই.. তখন আশা বারান্দার এক কোনে একটা চেয়ারে বসে ফোন স্ক্রল করছিলো। মাঝে মাঝে আপন মনে হাসছিলো সে। মৃদুলা রান্নার কাজ শেষ করে ঘর গুছানোয় মন দিয়েছে। যদিও ঘর গুছানো প্রায় শেষের পথে। আশার মাথায় কুলোচ্ছে না, আজ সবাই এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আর রান্নাবান্নায় মন দিয়েছে কেন। যদিও ওরা পরিষ্কার হয়ে থাকতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তবে আজ একটু বেশিই হচ্ছে। আদিব আর সাদ বাইরে বেরিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। কোথায় গিয়েছে বলে যায় নি। এ দুজনের হাবভাবে স্পষ্ট দুজনের মধ্যে বেশ ভাব জমে গেছে। তবে এ দুজনের এত মিল, এত সখ্যতা দেখে আশার ভালোই লাগছে।

কিছু মুহূর্ত পেরিয়ে গেলে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে আদিব আর সাদ। আশা সেদিকে তাকায়। ওদের চোখমুখে খুশি, বিশেষ করে সাদের মুখে। মুখটা দেখে বুঝাই যাচ্ছে সে প্রচন্ড খুশি। আশা সেদিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এরই মাঝে বাড়িতে এসে প্রবেশ করলো পর পর তিনজন। এদের মধে দুইজন কে আশা খুব ভালো করেই চিনে। আশা বসা থেক এক লাফে দাঁড়িয়ে গেলো। প্রচন্ড অবাক সে। আশা উচ্ছ্বসিত হয়ে দৌড়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো
“আন্টি আপনি?
লুৎফুন্নাহার আশাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললো
“কেমন আছো আশা?
আশা হেসে বললো
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আন্টি।
আশা পাশের লোকটার দিকে তাকালো। উনি হচ্ছে আন্টির সেই গ্রামে থাকা বড় ভাইটা, যিনি শহরে আসার পথে অসুস্থ হয়ে গেছিলেন। আন্টির ভাই আর সাদের মামা হবার কারণে সে ভদ্রতার সহিত উনাকে সালাম দিয়ে বললেন
“ভালো আছেন মামা?
লোকটি চওড়া হাসি হেসে বললো
“ভালো আছি মামনি, তুমি কেমন আছো?
“জি মামা, ভালো আছি।

বাকি একজন ছিলো, উনাকে চিনতে পারলো না আশা। সাদ সেটা বুজতে পেরে আশাকে চুপিসারে বললো
“উনি আমার চাচা।
আশা ভদ্রতার সহিত উনার সাথেও কুশল বিনিময় করলেন।
আদিব উনাদের নিয়ে ভেতরে চলে গেলেও আশা আর সাদ বাইরে রয়ে গেলো। আশা অবাক হয়ে সাদকে প্রশ্ন করলো
“আচ্ছা, আন্টি হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে আপনার মামা আর চাচাকে নিয়ে এখানে কেন এলো?
“উনারা আসাতে কি তুমি অখুশি?
“অখুশি হতে যাবো কেন, হঠাৎ এলো তাই বলছি।
সাদ হেসে বললো
“তোমার বাড়িতে এতসব আয়োজন দেখেও বলছো না জানিয়ে হঠাৎ এসেছে?
আশা চমকে তাকালো সাদের দিকে। বিস্ময়ে বললো
“তারমানে জানিয়েই এসেছে!!
“অবশ্যই।
“আর সেটা আমি ছাড়া বাকি সবাই জানে! শুধু আমিই বাদ?
সাদ হেসে বললো
“মা আজ আসবে সেটা গতকালই ডিসাইড হয়েছে। আদিব ভাইয়া আর আমার শাশুড়ীও জানতো। আজ সকালে তারা রওনা করেছে।
“আপনার শাশুড়ি?
“তোমার মা।
আশার মনে হলো গতরাতের ঘটনাটা। ভাইয়া তাহলে এই ব্যপারেই মায়ের সাথে কথা বলছিলো।
আশা ভ্রু বাকিয়ে সাদকে বললো
“আমাকে কেন জানানো হয়নি?
“সারপ্রাইজ!
“কিসের সারপ্রাইজ?
“একটু পরেই জানতে পারবে কিউটি।
আশা সাদের কথার মানে ধরতে পারলো না। সাদ হেসে বললো
“যাও, ঘরে যাও।
আশা সেটাই করলো। সে তৎক্ষনাৎ ঘরে চলে গেলো৷

আশাদের আলাদা করে কোনো ড্রয়িং রুম নেই। ওদের বড় ঘরটাতেই সোফা পাতা আছে। আর সেখানেই উনাদের বসতে দেওয়া হয়েছে। উনারা এসে সর্বপ্রথম হাত মুখ ধুয়ে তারপর এসে বসেছেন। পাশেই দিলারা বসে আছেন। দিলারার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আদিব। মৃদুলা সবাইকে ঠান্ডা পানি দিয়ে লেবুর শরবত দিলো। লুৎফুন্নাহার শরবত টা ধীরে ধীরে খেয়ে শেষ করলেন। গ্লাসটা মৃদুলার হাতে দেওয়ার সময় উনি হাসিমুখে বললনে
“তুমিই বোধহয় আশার ভাবী?
মৃদুলা ভদ্রতার সহিত বললো
“জ্বি।
“আশার মুখে তোমার কথা অনেক শুনেছি। তোমার খুব প্রশংসা করতো সে। উনার কথা শুনে মৃদুলা আশার দিকে ফিরে তাকালো। মেয়েটা এক পাশে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মৃদুলার মনে হলো, এই মেয়েটার সাথে সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে বাজে আচরণ করেছে, তাও সে তার নামে প্রসংশাই করে গেছে। মৃদুলা একটা ভারী নিশ্বাস ছাড়ালো। এরপর হাসিমুখে বললো
“আসলে আশা খুব মিষ্টি মেয়ে, মন মানসিকতাও অনেক ভালো। তাই সবাইকে সে নিজের মতই ভালো মনে করে। কারো ব্যাপারে খারাপ কথা সহজে ওর মুখে আসে না। মানুষকে অনেক ভালোবাসে কিনা৷।

আদিব এক পলক তাকালো মৃদুলার। মেয়েটার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসে গেছে একদিনেই।
মৃদুলার কথা শুনে লুৎফুন্নাহার হেসে বললো
“সত্যিই, আশার কোনো তুলনা হয় না। এ যুগে এমন মেয়ে পাওয়া দুষ্কর।
এরপর লুৎফুন্নাহার দিলারার দিকে তাকিয়ে বললেন
“সত্যিই আপনার ভাগ্য ভালো। কপাল করে এমন দুটো ছেলে মেয়ে পেয়েছেন।
দিলারা বললো…
“আপনার ছেলেও কিন্তু কম না, অনেক ভদ্র ছেলে মাশাল্লাহ।
লুৎফুন্নাহার হেসে বললো
“সবই আপনাদের দোয়া।
আশা সাদের দিকে তাকালো। সাদ এতক্ষন উনাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেও এবার আশার দিকে তাকালো। চোখাচোখি হয়ে গেলো দুজনের। সাদের মুখের হাসি প্রসস্থ হলো, আশা মুখ বাকিয়ে ফিসফিস করে বললো
“ভদ্র না ছাই, আস্ত বদের হাড্ডি।
আশার এমন কান্ডে সাদের হাসির বেগ বেড়ে গেলো, তবে সেটা সাথে সাথে চাপা দিতে হলো। ঘরভর্তি লোকজন, তাদের সামনে জোরগলায় হাসলে যদি মাইন্ড করে।

দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেড়ে উঠোনে হাঁটতে বের হয় লুৎফুন্নাহার। উনার সাথে আছেন দিলারা আর মৃদুলা। আশাও পাশেই আছে। আর সাদের মামা চাচাকে নিয়ে আদিব বেরিয়েছে… রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছে বোধহয়। কিছুক্ষণ হাঁটার পর লুৎফুন্নাহার মৃদুলার দিকে তাকিয়ে বললেন…
“আদিব কোথায় গেছে মা?
“ঠিক বলতে পারছিনা আন্টি। বোধহয় রাস্তায় হাঁটছে।
“কাউকে দিয়ে খবর দিয়ে আনাতে পারবে? আমাদের আবার রওনা করা লাগবে.. কথাবার্তাটা সেড়ে নিই।
রওনা দেবার কথা শুনে আশার বুকে ধক করে উঠলো। উনাদের সাথে কি সাদও চলে যাবে? হয়তো উনারা সাদকে নিতেই এসেছে এখানে। মুহুর্তে মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। তবে এতকিছুর মাঝেও মাথায় ঘোরপাক খেলো আন্টির বলা কথাবার্তা সেড়ে নেওয়ার কথা। কিসের কথাবার্তা সেড়ে নিবে সেটা জানতে চাওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করতেই সবাই কেমন করে যেনো আশার দিকে তাকালো। ওদের তাকানোর ধরন দেখে আশা অবাক হলো। এক সময় মৃদুলা হেসে বললো
“যখন কথাবার্তা হবে তখন জানতেই পারবে সব। তুমি দেখোতো তোমার ভাইয়া এদিকে পাশেপাশে আছে কিনা?
আশা সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে। বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে একটু আশপাশ টায় চোখ বুলালো আশা। কিছুটা দুরেই আদিব দাঁড়িয়ে আছে বাকিদের নিয়ে। উনাদের সাথে সাদ নেই। তাহলে সাদ কোথায়? মনের মধ্যে এই প্রশ্নটা উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো। কিন্তু এখন ওর কথা ভাবার সময় না, ভাইয়াকে ডাকতে হবে। কিন্তু কিভাবে ডাকবে?

সাদের মামা আর চাচা আছে সাথে, তাই জোরে চিল্লিয়ে ডাকা যাবে না। উনারা আশাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু ভাবতে পারেন। আশা আশেপাশে চোখ বুলাতে লাগলো, কোনো বাচ্চা ছেলেমেয়ের দেখা পায় কিনা। তাহলে তাদেরকে দিয়েই ভাইয়াকে খবর পাঠাবে। আশা এদিক ওদিক তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলো না।। একসময় নিরাশ হয়ে সেই সামনের দিকে পা বাড়ালো, কিচ্ছু করার নেই৷ ওকে গিয়েই ডেকে আনতে হবে। সাথে সাদের চাচা মামা আছে, তাই সে যেতে চাইছিলো না। কিন্তু এখন না গিয়েও কোনো উপায় নেই। আশা কয়েক পা এগুতেই পেছন থেকে সাদ তাকে ডেকে বললো
“কোথায় যাচ্ছো কিউটি?
আশা পেছন ফিরে তাকিয়ে সাদকে দেখতে পেয়ে বললো
“কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
“মিস করছিলে আমায়? মুচকি হেসে বললো সাদ।।আশা হেসে বললো
“মিস করলে কি কোনো সমস্যা?
“নো, কিন্তু আমি চাইনা আমার কিউটি আমাকে মিস করুক।।
“কেন?
“কাউকে মিস করাটা খুব যন্ত্রণার।। কানাডায় যাওয়ার পর তোমায় খুব মিস করতাম, হাড়ে হাড়ে এটার যন্ত্রণা আমি টের পেয়েছি।
আশা হেসে বললো
“তাহলে বলছেন আমি আপনাকে মিস করবো না?
“মিস করার সুযোগ পাবেনা তো।
“কেন? ভ্রু বাকিয়ে প্রশ্ন করলো আশা।

সাদ হেসে বললো
“অলটাইম তোমার কাছেই থাকবো।
আশা হেসে বললো
“আচ্ছা, সে দেখা যাবে। কোথায় ছিলেন এতোক্ষণ?
“ওদিকটাতে ছিলাম। আঙ্গুলের ইশারায় পেছন দিকে দেখিয়ে বললো সাদ।
“ওহ!
“তুমি ওদিকে কেন যাচ্ছো কিউটি?
“ভাইয়াকে ডাকতে। আন্টির নাকি কি কথা আছে তাই ডেকে আনতে বলেছে।
সাদ হাসলো। আশা বললো
“হাসছেন কেন?
“মা কেন এসেছে জানো?
“কেন? প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো আশা। সাদ মৃদু গলায় বললো
“তোমাকে পার্মানেন্ট ভাবে আমার জীবনে এনে দেওয়ার জন্য।
“মানে?
সাদ আশার মাথায় গাট্রা মেরে বললো
“তুমি কি বোকা, এইটুকু বুঝো না? আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন উনারা।

আকস্মিক আশা উত্তেজিত গলায় বলে উঠলো
“সত্যি?
সাদ মৃদু হেসে বললো
“হুম।
পরক্ষণে আশা মাথা নিচু করে ফেললো লজ্জায়। উত্তেজনায় সে ভুলে গেছিলো সামনে সাদ আছে। সাদ সেটা বুঝতে পেরে বললো
“তুমি বাড়ির ভেতর যাও। আমি উনাদের ডেকে আনছি।
আশা মাথা নাড়িয়ে চলে এলো সেখান থেকে।

বড় ঘরে এক সাথে বসে আছেন সবাই। দিলারা, মৃদুলা, আদিব, লুৎফুন্নাহার, সাদের মামা আর চাচা। সাদও উপস্থিত সেখানে। তবে আশা এবার এখানে উপস্থিত নেই, মায়ের ঘরে বসে আছে সে। আর প্রহর গুনছে কখন তাদের আলাপ আলোচনা শেষ হবে। কখন জানতে পারবে সেই ক্ষণটার কথা…. যে ক্ষণে দুটি মানুষ এক হয়ে যাবে। রুমের মধ্যে বার বার পায়চারি করছে সে, বার বার জানতে ইচ্ছে করছে ওখানে কি হচ্ছে? উফফ, একটা মানুষও এখানে আসছেনা কেন। না আসছে মৃদলা আর না সাদ। কেউ একজন আসুন, তাকে জানিয়ে দিয়ে যাক সেই ক্ষণটার কথা।

দীর্ঘ দেড় কিংবা দুই ঘন্টার আলোচনা শেষ করে অবশেষে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো সাদ। আলোচনার শেষ পর্যায়ে মৃদুলা আবারও সকলের জন্য একটু চা নাস্তার আয়োজন করায় ব্যস্ত হলো, তাই বাকিরা সেখানেই বসে রইলো। তবে সাদের মন এখানে টিকছিলো না, আলোচনা শেষ না করে বেরও হতে পারছিলো না সে। এখন শেষ হওয়া মাত্রই সে বেরিয়ে পরেছে। আশা যখন অতি অপেক্ষায় মগ্ন ঠিক তখনই ওর পেছনে এসে দাড়িয়েছে সাদ। মৃদু গলায় ডেকে সে বললো
“কিউটি?
আশা হুড়মুড় করে তাকায় সাদের দিকে। আগপাছ কিছু না ভেবে প্রশ্ন করে
“সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে?
সাদের মুখে কোনো উত্তর নেই, সে মলিন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে এরুপ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয় আশা। সেই সাথে মনের মধ্যে এক অজানা ভয়ে জেঁকে বসে। মনে মনে ভাবে, “বাজে কোনো কিছু হয়ে যায় নি তো?”

চলবে……