#ভালোবাসি_তোকে_সুহাসিনী
পর্ব,,,২৭
মৌমো তিতলী
মুখ থমথমে করে বসে আছে আমজাদ তালুকদার। একমাত্র ছেলে আফনানের সাথে মোতালেব মাস্টারের মেয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া সম্বন্ধ এক কথায় নাকচ করে দিয়েছেন মোতালেব মাস্টার। আর এই প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারেননি আমজাদ তালুকদার। ড্রয়িং রুমে অবস্থিত কাঁচের টি টেবিলটা লাথি মেরে ভেঙ্গে ফেলেন তিনি। রাগে মাথাটা ধপধপ করছে তার। আসেপাশে সার্ভেন্টরা সব ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে সবথেকে খারাপ অবস্থা শফিকের। কারণ প্রত্যাখিত হওয়ার খবরটা সেই এনেছে। এখন তার একটাই ভয় কখন না আবার তালুকদার তাকে তুলেই আছাড় দিয়ে বসে।
আমজাদ তালুকদার হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন।বলেন,,
:- মোতালেব মাস্টারের এতো বড় সাহস। আমার ছেলের জন্য রাখা প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। ছোটলোক জাত তার আবার এতো অহংকার কোথা থেকে আসে? আমার মতো প্রভাবশালী ধনী লোক যে তার একমাত্র উত্তরাধিকার ছেলের জন্য তাদের মতো মধ্যে বিত্ত ঘরের মেয়েকে ছেলের বউ করতে চেয়েছি তা তাদের সাত পুরুষের ভাগ্য। কোন সাহসে তা পায়ে ঠেলে দেয় মোতালেব মাষ্টার??
শফিক সাহস করে এগিয়ে গিয়ে মিনমিন করে জিজ্ঞাসা করে,,,
:- কিন্তু বস ওই মেয়েই কেনো? এতোই যখন ছোটলোক তাহলে আপনিই বা ওই মেয়েকে ছেলের বউ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন কেনো?
শফিকের প্রশ্ন শুনে যেন রাগের আগুনে এক খাবলা ঘি পড়লো আমজাদ তালুকদারের। শফিকের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,,
:- গাধা কোথাকার। এতো বছর আমার সাথে থেকে এই শিখলি জীবনে?? তুই জানিস না এই মোতালেব মাস্টারের মেয়ে হলো সোনার ডিম পাড়া হাঁস। ওই ছোকড়া এমপির পরাণ আটকে আছে ওই মেয়ের মাঝে।
আমজাদ তালুকদার কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভয়ঙ্কর ঠান্ডা গলায় শফিকের উদ্যেশ্য বলেন,,
:-ছোটবেলায় নানি দাদিদের কাছে রাক্ষসীদের গল্প শুনেছিস কখনো শফিক?
আচমকা আমজাদ তালুকদারের মুখে ছোটবেলার গল্প শোনার প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খায় শফিক। আমতা আমতা করে বলে,,
:- শুনেছি হয়তো। মনে নেই।
আমজাদ তালুকদার ঘাড় ঘুরিয়ে শফিকের দিকে তাকায়। তারপর ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলে,,
:- জানিস ওই গল্পে প্রত্যেকটা রাক্ষসীদের প্রাণভোমরা একটা টিয়া পাখির ভিতরে সুরক্ষিত করে রাখা থাকতো । একমাত্র সেই টিয়া পাখিটাকে মারতে পারলেই ওই রাক্ষসীদের মৃত্যু হতো। আর ওই পাখিটাকে একেবারে না মেরে যদি টর্চার করা হতো তাহলে, পাখিটার সাথে যা যা করা হতো সেই একই যন্ত্রনা অনুভব করতো ওই রাক্ষসীরা। মোতালেব মাস্টারের মেয়ে হলো সেই টিয়া পাখি। আর ওই ছোকড়া এমপির প্রাণভোমরা আটকে আছে ওই টিয়া পাখির ভিতরে।
এতক্ষণে বসের প্ল্যান মগজবিদ্ধ হয় শফিকের। চওড়া হেসে বলে,,,
:- কিয়া বাত হ্যায় বস। আপনে তো দেখি সেই পাকা খেলোয়াড়। মোতালেব মাষ্টারের মাইয়ার লগে আফনান ভাইয়ের বিয়ে দিতে পারলে ওই এমপি পরাণ হারাইয়া এমনিতেই মুখ থুবড়ে পড়বে। আর মাইয়াটারে তুরুপের তাস বানাইয়া ওই ছোকড়া এমপিরে দিয়া যা ইচ্ছা করাতে পারবেন আপনে।
আমজাদ তালুকদার নিজের বুদ্ধির তারিফ শুনে অহংকারে বুক ফোলায়। কিন্তু মোতালেব মাস্টার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে মনে হতেই রাগ বাড়ে তার। গলা ছেড়ে হাঁক দেয়,,,
:- শফিক!! মোতালেব মাস্টারের মাইয়া রে তুলে আনার ব্যবস্থা কর। ভালোই ভালোই বিয়ে দিয়ে সসম্মানে আনতে চাইলাম, মোতালেব মাস্টারের হয়তো সম্মান দেয়াটা সহ্য হয়নি। এখন সম্মানটাও যাবে আমাদের প্ল্যানও সাকসেসফুল হবে।দেখি ওই ছোকড়া এমপির কত ক্ষমতা। আমার হাত থেকে তার প্রাণভোমরাকে বাঁচিয়ে দেখাক।
শফিকও পোষা কুকুরের মতো বসের আদেশ পালনে নেমে পড়ে।
__________
মির্জা ম্যানসনের সবাই রেডি হচ্ছে সুহাসিনীদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। আহাদ মির্জা, আয়েশা সিদ্দিকা ,আরশি, সাহিত্য আর সাহিত্যের বন্ধুদের মধ্যে অরুদ্ধ আর সিফাত যাবে। তিয়াশ এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয়। তাই সে যেতে পারবে না।
সবারই প্রায় গোছগাছ শেষ। এমন সময় সাহিত্য মাকে ডেকে বলে,,
:- তোমরা রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ো। আমার ছোট্ট একটা কাজ আছে, সেটা মিটিয়াই আমি চলে আসবো। আমি ওবাড়িতে যাওয়ার পর বিয়ের কথা তুলবে তোমরা। তার আগে নয়।
আহাদ মির্জা ,আয়েশা সিদ্দিকা দুজনই ছেলের কথায় সম্মতি জানান। সাহিত্যোও বেরিয়ে পড়ে নিজের কাজে।
********
সাহিত্যের পার্টি অফিসের ওয়েটিং রুমে বেশ অনেকক্ষণ ধরে বসে আছেন চকচকে টাকমাথার লোকটা। বগল দাবায় পাত্র-পাত্রীর লিস্টের খাতাটা আটকে ধরে এদিক ওদিক পায়চারি করছেন তিনি। ওনাকে দেখে যে কেউ বলতে পারবেন ভীষণই অস্থিরতায় ভুগছেন তিনি।
এমতা অবস্থায়ও ডান হাতে কাঠি দিয়ে দন্ত খুঁচিয়ে চলেছেন। মাঝেমধ্যে ডাস্টবিনের সামনে গিয়ে চপাৎ করে পানের পিক ফেলছেন।
এমন সময় সাহিত্য এসে পৌঁছায় সেখানে। সাহিত্যকে দেখতেই লোকটার মুখে অস্থিরতা বদলে স্বস্তির দেখা মেলে। লাল লাল দাঁত বের করে হেসে এগিয়ে যায় সাহিত্যর দিকে। সাহিত্য লোকটা কে দেখে সৌজন্যে হেসে বলে,,,
:- আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মন্টু চাচা। সঠিক সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন দিয়েছেন আপনি।
মন্টু ঘটক স্বগর্বে হেসে বলেন,,
:- এ আর এমন কি কাম বাবা!! তোমার লাইগ্গা আমি হের থেকেও বড় কাম করবার রাজি আছি। ওই তালুকদার হারামজাদা আমার জোয়ান সমর্থ শিক্ষিত পোলাডারে পঙ্গু বানাই দিছে। মোর পোলা শুধু তার একখান কুকর্মে বাধা দিছিলো। প্রতিবাদ করছিলো দেইখা ওই তালুকদারের পালতু কুত্তারা আমার পোলার দু হাতের কব্জি কাইটা দিলো। আমার পোলাটা বাঁচার আশ ছাইড়া দিলো। দুই হাত নাই, তারে কামে নিবো কেডা? শিক্ষিত পোলাডা আমার ঘরে বন্দি থাইকা দিন দিন ধুইকা ধুইকা মরতে আছিলো। সেই সময় তুমি ফেরেস্তার লাহান আমার পোলাডার জীবনে আবার অনুপ্রেরণা দিছো। আমার পোলাডারে কলের হাত লাগাইয়া দিছো। তারে কত বড় আপিসে চাকরি দিছো। সে আবার বাঁচার আশ পাইছে। তারে নতুন জীবন দিছো তুমি। তোমার কাছে আমরা হগ্গলে সারাজীবন বহুৎ ঋণী থাকুম।
মন্টু ঘটক সাহিত্যের হাত চেপে ধরে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেন। অপ্রস্তুত হয় সাহিত্য। মন্টু ঘটককে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,,
:- এমন বলবেন না চাচা। এসব করা তো আমার কর্তব্য। আপনি আমার বাবার বয়সী, সম্মানীয় মানুষ। আমি যা করেছি সেটা মানবতার খাতিরে আর এলাকার এমপি হিসেবে করা আমার কর্তব্য ছিলো।
মন্টু ঘটক মুগ্ধ হয়ে তাকান সাহিত্যের দিকে। দুহাত তুলে বলেন ,,
:-আল্লাহ তোমারে অনেক ভালা করুক বাবা। তুমি অনেক বড় হও। হাতের উল্টো পিঠে আলগোছে চোখ মুছে প্রস্থান করে মন্টু ঘটক। সেদিকেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজেও গন্তব্যে বেরিয়ে পড়ে সাহিত্য।
*************
ঘন্টা খানেক আগে মোতালেব হোসেনের বাড়িতে এসে পৌঁছেছে মির্জা পরিবার। তাহিরা বেগম ব্যাস্ত তাদের আপ্যায়নে। সুহাসিনী মাকে টুকটাক কাজে হেল্প করছে।
ড্রয়িং রুমে বসে বাকি সবার সাথে কথা বলছেন মোতালেব হোসেন। তবে মনে মনে বেশ চিন্তিত তিনি। এমন হুট করে মির্জা পরিবারের সকলে ঠিক কোন উদ্দেশ্যে তার বাড়িতে এসে জড়ো হয়েছেন ঠিক বুঝতে পারছেন না তিনি। তবে কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছেন হয়তো। মোতালেব হোসেনের অভিজ্ঞতা বলছে হয়তো সাহিত্যের জন্য সুহাসীনির হাত চাইতে পারেন আহাদ মির্জা। আর এমন কিছু যদি হয়, তিনি সাথে সাথে না করে দিবেন বলে ঠিক করেন। ওমন মৃত্যুপুরীতে তিনি তার একমাত্র আদরের মেয়েকে কিছুতেই বিয়ে দিবেন না। যেখানে চলতে ফিরতে মৃত্যু তাড়া করে বেড়ায়।
___________
সাহিত্য এসে পৌঁছায় আরো আধঘন্টা পরে। আহাদ মির্জা রয়ে সয়ে কথা পাড়েন। এক কথা দু কথার মাঝে সাহিত্যের জন্য সুহাসীনিকে চেয়েই বসেন আহাদ মির্জা। তাহিরা বেগম এসব কিছু ঘুনাক্ষরেও চিন্তা ভাবনাই আনেননি। অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে তিনি বেশ অবাক হয়েছেন। কিন্তু মোতালেব হোসেনের মুখ দেখে কোনরকম অবাকের লেশমাত্র পাওয়া গেলো না। তিনি এমটাই আশা করেছিলেন। নয়তো বিগত ২০ বছরেও বন্ধু আহাদ মির্জা কখনোই তার পুরো পরিবারসহ তাদের বাড়িতে আসেননি। মোতালেব হোসেন নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর আগে আরেকবার আড় চোখে পাশে বসা মেয়েকে পরখ করলেন। সুহা অনুভূতি শূন্য হয়ে বসে আছে। একটা মেয়ের সামনে তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব রাখলে স্বাভাবিক ভাবে মেয়েটা যেমন লজ্জা পায় তেমনি লজ্জায় নত মুখ দেখলেন মেয়ের। সাহিত্যের দিকে চোখ তুলে তাকানো বা অতিরিক্ত কোন অনুভূতির লেশমাত্র আভাস পেলেন না তিনি। অপরদিকে সাহিত্যের নজর তার কন্যার দিকেই নিবদ্ধ।
তাহিরা বেগম ভেতরের খবর কিছুই জানেন না। তিনি বেশ খুশিই হয়েছেন এই প্রস্তাবে। সাহিত্যের মতো ছেলে তাদের একমাত্র মেয়ের জন্য আর কোথাও পেতেন নাকি? সাহিত্য পাত্র হিসেবে একেবারে খাঁটি হিরে।
তাহিরা বেগম হাসিমুখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিতেই থমকে যান। স্বামীর মুখে স্পষ্ট অমতের চিহ্ন দেখতে পান তিনি। কিন্তু তাহিরা বেগম স্বামীর এই অমতের কারণ হাজার খুঁজেও পেলেন না মনে মনে। অগত্যা আগে থেকেই কথা না বাড়িয়ে মোতালেব হোসেনের মুখ খোলার অপেক্ষা করলেন।
মোতালেব হোসেন ভাবলেশহীন ভাবে শান্ত গলায় বললেন,,,
:- আমি আমার মেয়ে সুহাসীনিকে তোমার হাতে তুলে দিতে রাজি নই সাহিত্য।
মোতালেব হোসেনের এক বাক্যে উপস্থিত সকলের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মনে হলো।
সবথেকে বেশি অবাক হয়েছেন আহাদ মির্জা নিজে। মোতালেব হোসেন তার বাল্যকালের বন্ধু। কত চড়াই উৎরাই পেরিয়ে জীবন দাঁড় করাতে দেখেছেন একে অপরকে। সুখে-দুখে একে অপরের পাশে থেকেছেন। তাই তো এখনো পর্যন্ত বন্ধুত্ব টিকে আছে অনড় পাহাড়ের মতো। সম্পদ বা ছেলের অযোগ্যতার কারনে যে মোতালেব হোসেন মেয়েকে সাহিত্যের হাতে দিতে রাজি হননি এটা কখনোই সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই এর পেছনে অন্য কোন কারণ আছে। আহাদ মির্জা না ঘাবড়ে হালকা হেসে বলেন,,
:- তুই চিন্তাভাবনা না করেই হুট করে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছিস তালিব। আমার ছেলে যে কোন অংশে অযোগ্য এটা নিশ্চয়ই তুই বলবি না। এর পেছনে অবশ্যই অন্য কোন কারণ থাকবে। কোন সমস্যা হলে সেটা তুই নির্দ্বিধায় বল আমাদের। তবুও অমত করিস না।
মোতালেব হোসেন চোখ তুলে তাকান বন্ধুর দিকে। বলেন,,
:-সাহিত্য বাবা কোন দিক থেকেই অযোগ্য নয় সেটা আমরা স্বীকার করতে বাধ্য। হ্যাঁ তোর ভাবনা সঠিক এখানে আমার রাজি না হওয়ার পেছনে কারণটা ভিন্ন।
হুট করেই সাহিত্য উঠে গিয়ে মোতালেব হোসেনের পায়ের কাছে বসে পড়ে। দুহাতে মোতালেব হোসেনের পা আকড়ে ধরে বলে,,,
:- আঙ্কেল প্লিজ আপনি অমত করবেন না। সুহাসিনী কে আমি ভালোবাসি। ওকে ছাড়া এক মুহুর্তও নিজেকে ভাবতে পারি না আমি। কোন সমস্যা থাকলে আপনি আমাদেরকে বলুন, আমরা সবাই মিলে সেটা সমাধান করবো। তবুও সুহাসিনী কে আমায় দিন আঙ্কেল।
ছেলের অসহায়ত্ব দেখে চোখ ছলছল করে ওঠে আয়েশা সিদ্দিকার। তিনি তো জানেন তার ছেলে কতটা ভালোবাসে সুহাসিনীকে। রাতের পর রাত জেগছ মেয়েটার জন্য তড়পাতে দেখেছেন তিনি নিজের ছেলেকে। সুহাসিনীর জন্য করা এক একটা পাগলামির চাক্ষুষ সাক্ষী তিনি।
আরশি,অরুদ্ধ ,সিফাতও বাকরুদ্ধ। তারা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাহিত্যের দিকে। সুহা কে ছাড়া যে তাদের
বন্ধু শেষ হয়ে যাবে।
মোতালেব হোসেন আস্তে করে পা থেকে সাহিত্যের হাত দুটো ছাড়িয়ে নেন। বলেন,,
:- তোমার এই ভালোবাসায় আমার অমতের কারণ সাহিত্য।
মোতালেব হোসেনের কথাই আবারো বাকরুদ্ধ সকলে। সাহিত্যের ভালবাসা কি করে এই প্রস্তাবের অমতের কারণ হতে পারে, ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না কেউই।
সাহিত্য নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,,,
:- ঠিক বুঝলাম না আঙ্কেল আপনি কি বলতে চাইলেন।
মোতালেব হোসেন এবার সিরিয়াস কণ্ঠে বললেন,,,
:- তোমার এই ভালোবাসা আমার মেয়েটার প্রাণ কেড়ে নেবে সাহিত্য। তাকে সুস্থভাবে এই ভালোবাসা নিয়ে কেউ বাঁচতে দেবে না। তোমার এই ভালোবাসার আভাস হয়তো বহুদুর পর্যন্ত ছড়িয়েছে। তুমি জানো কাল আমার মেয়ের জন্য কে সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিলো?
সাহিত্য শক্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,,
:- জানি আঙ্কেল। আমজাদ তালুকদার তার একমাত্র মেন্টাল ছেলের জন্য প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু আপনি তো সেই প্রস্তাব স্বসম্মানে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাহলে সমস্যা কোথায়?
মোতালেব হোসেন হালকা হেসে বলেন,,
:- সাহিত্য আমি জানি তুমি খুবই বিচক্ষণ একটা ছেলে। কিন্তু এটা বুঝতে পারছো না? যে আমজাদ তালুকদার কেন আমার মেয়ের জন্য তার ছেলের সম্বন্ধ পাঠালেন?? আমার মত গরিব মধ্যবিত্ত বাবার মেয়েকে সে কোন সুখে নিজের ছেলের বউ করে নিতে চাইবে?? তার মতো ধনী লোক তো সহজেই যেকোনো মেয়ে পেয়ে যেতো। সেখানে আমার মেয়ে সুহাসিনীই কেন??
আহাদ মির্জা ছোট ছেলের দিকে এগিয়ে এসে বলেন,,,
:- এসব কি সাহিত্য ?? আমজাদ তালুকদার তার ছেলের জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিলো, এটা তুমি কি করে জানলে? আর কেনই বা তিনি এরকম একটা প্রস্তাব রেখেছেন??
মোতালেব হোসেন এগিয়ে এসে বলেন,,,
:- কারণটা আমি বলছি আহাদ। কারণটা হলো আমজাদ তালুকদার জেনে গেছে যে, এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জা এই গরিব মাস্টারের মেয়ে সুহাসিনী কে ভালোবাসে। আর আমজাদ তালুকদার যে সাহিত্যর সব থেকে বড় শত্রু, সেটা তো আমাদের এলাকায় ছোট বড় সকলেই জানে।
তাই সাহিত্যর সাথে শত্রুতার জের ধরে আমার সহজ সরল নিষ্পাপ মেয়েটাকে মোহরা বানাতে চেয়েছে আমজাদ তালুকদার।
তোমাদের বাড়িতেও আমার মেয়ে নিরাপদ নয়। তোমাদের নিজের লোকেরাই আমার মেয়ের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে। একবার নয়, কয়েকবার। আমার নিঃকলঙ্ক মেয়েটার জীবনে কলঙ্ক লেপে দিয়েছে। কোন দোষ না করেই সমাজের চোখে দোষী হয়েছে আমার ছোট্ট মেয়েটা। সমাজের লোকের কটু কথা শুনেছে। তিনি সাহিত্যের দিকে তাকিয়ে বলেন,,
:-তোমার শত্রুরা তোমাকে দমন করতে আমার মেয়েটার উপর দিয়ে ছুরি চালাবে। সেখানে আমি বাবা হয়ে জেনেশুনে আমার মেয়েকে এরকম একটা মৃত্যু পুরীতে কি করে ঠেলে দিতে পারি বলো আমাকে??
সাহিত্য আবারও অস্থির হয়ে বলে,,
:- আঙ্কেল আমি বুঝতে পারছি আপনার চিন্তা। কিন্তু আপনি যেমন বাবা হিসেবে সুহাসিনীকে ভালোবাসেন, আগলে রেখেছেন। তেমন আমিও ভালোবেসে আগলে রাখবো সুহাসিনিকে। আমি তো সুহাসিনীকে ভালোবাসি। কত বছর ধরে একটু একটু করে স্বপ্ন বুনেছি আমি সুহাসিনী কে নিয়ে। আমার এই ২৮ বছর বয়সের জীবনে অন্য কোন নারীকে জায়গা দিইনি, শুধুমাত্র সুহাসিনীর জন্য। আঙ্কেল আপনি প্লিজ এতটা কঠিন হবেন না। আমি শেষ হয়ে যাবো সুহাসিনীকে ছাড়া। মরে যাবো আমি। সুহাসিনী আমার জীবন আঙ্কেল।
সাহিত্যর কাকুতি-মিনতি যেন ছুঁতে পারলো না একমাত্র মেয়ের প্রাণ সংশয়ের ভয়ে ভয়ার্ত পিতা কে।
এর মাঝে সবথেকে নির্লিপ্ত ,অনুভূতিহীন, শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুহাসিনী। আসলে উপস্থিত ঘটনায় সে এতটাই শকড, যে তার কি বলা উচিত, কি করা উচিত কোনটাই মাথায় আসছে না তার। বাবার পেছনের সোফার পাশে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুহাসিনী।
সাহিত্য ছুটে গিয়ে সুহাসিনীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দুহাতে সুহাসিনীর বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলে,,,
:- তুই চুপ করে আছিস কেন ফুল? বল না আঙ্কেল কে। তুই বললে আঙ্কেল নিশ্চয়ই রাজি হবে!! তুই তো জানিস ফুল, তোকে ছাড়া আমি শ্বাস নিতে পারবো না। বাঁচতে পারব না তোকে ছাড়া তুই একবার বল না আঙ্কেলকে।
এর মধ্য আয়েশা সিদ্দিকা আশ্চর্যজনক একটা কাজ করে বসলেন। তিনি গিয়ে মোতালেব হোসেনের পায়ের কাছে আঁচল পেতে বসে পড়লেন। দু চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন,,,
:- আমার ছেলেটার প্রাণ ভিক্ষা দিন ভাইজান। আপনি এতটা কঠোর হবেন না। আমি জানি এখন যদি আমি ভরসা দিয়ে বলি, আপনার মেয়েটাকে আমি নিজ দায়িত্বে দেখে রাখবো। তাহলে সেটা হয়তো দ্বিতীয় বার আপনারা ভরসা করবেন না।
প্রথম বারে আমি আমার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারিনি ঠিকই। কিন্তু এবার সবদিক থেকে খেয়াল রেখে আমি আপনার মেয়েটাকে আগলে রাখবো ভাইজান। শুধু আমার ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে আপনার মেয়েটাকে ভিক্ষে দিন। আমার ছেলেটা মরে যাবে ভাইজান সুহাসিনীকে ছাড়া। আমি মা আমি জানি, আমার ছেলেটা আপনার মেয়েকে কতটা ভালোবাসে। ওকে ছাড়া আমার ছেলেটা নিঃশেষ হয়ে যাবে।দয়া করুন ভাইজান।
সাহিত্য সুহাসিনী কে ছেড়ে দিয়ে মায়ের কাছে দৌড়ে যায়। মাকে আকড়ে ধরে দাঁড় করায়। মায়ের চোখ মুছিয়ে দেয় সযত্নে। আরশির চোখ দুটিতেও অশ্রু ধারা বয়ে যাচ্ছে। সেও তো শুনেছে সাহিত্যর পাগলামির কথা। সাহিত্য যে কতটা ভালোবাসে সুহাসিনী কে সেও তো জানে অনেকাংশে। কিন্তু সুহাসিনীর বাবা যে এভাবে অমত জানাবেন, সেটা একবারও ভাবতে পারিনি কেউ।
আরশি গিয়ে সুহার সামনে দাঁড়ায়। সুহার দুহাত হাতের মুঠোয় তুলে নিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে,,,
:- তুমি প্লিজ চুপ করে থেকো না সুহা। তুমি তো সবটাই জানো বলো! সাহিত্য ভাইয়া তোমাকে কতটা ভালোবাসে। তোমাকে কতটা চাই। এই মুহূর্তে তুমি চুপ করে থেকো না। কিছুতো একটা বলো? তুমি কি চাওনা যে সাহিত্য ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়েটা হোক??
সাহিত্য আবারও গিয়ে সুহার সামনে দাঁড়ায়। এই মুহূর্তে কথা বলতে গিয়ে হাঁপাতে থাকে সাহিত্য। যেন শ্বাস নিতেও কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছে তার। অনেক কষ্টে শ্বাস টেনে ধরা গলায় বলে,,,
:- প্লিজ ফুল!! আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না। সেদিন আমি তোকে বলেছিলাম, তুই যেই শাস্তি দিবি আমি মাথা পেতে নেবো। তুই কি সেই শাস্তি আমাকে দিবি বলে ঠিক করেছিস?? যদি তাই করে থাকিস তাহলে দেখ, আমি খুবই কষ্ট পাচ্ছি।
সুহার সামনে দুহাত মেলে দিয়ে বলে,,
:-তোকে হারানোর ভয়ে আমার হাত দুটো কেমন কাঁপছে দেখ ফুল?? এর থেকেও বেশি কাঁপছে আমার বুকের ভেতরের হৃদপিণ্ডটা। এই পদ্মফুল তুই কি জানিস না? তোকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারি না। তুই এখনো চুপ থাকবি??
অরুদ্ধ আর সিফাত এসে সাহিত্যর কাঁধে হাত রাখে। অরুদ্ধ সুহাসিনীকে বলে,,,
:-এতকিছুর পরেও তুমি চুপ থাকবে সুহাসিনী?? কি করে তুমি এখনো এভাবে দাঁড়িয়ে আছো?? তোমার বাবাকে গিয়ে কিছু বলছো না কেনো ?
মোতালেব হোসেন এগিয়ে এসে মেয়ের পাশে দাড়িয়ে সাহিত্যদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন ,,,
:-তোমরা এভাবে আমার মেয়েকে প্রেসার দিতে পারো না। আমি জানি আমি যেটা সিদ্ধান্ত নেবো, আমার মেয়ে সেটাই মেনে নেবে।
তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে আদেশের স্বরে বলেন,,
:- তুমি নিজের ঘরে যাও সুহাসিনী! এই মুহূর্তে এখান থেকে যাবে তুমি।
সুহা ফ্যালফ্যাল করে একবার বাবার দিকে তাকিয়ে আরেকবার সাহিত্যর দিকে তাকায়। তারপর চুপচাপ অনুভূতি শূন্যের মতো নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়।
সুহা যেতেই দু পা পিছিয়ে যায় সাহিত্য। শরীর ছেড়ে দিয়ে পড়তে নিলেই দু পাশ থেকে বন্ধুকে ঝাপটে ধরে অরুদ্ধ আর সিফাত।
আয়েশা সিদ্দিকা মুখে আঁচল চেপে ডুকরে কেঁদে ওঠেন।আরশি শাশুড়ি কে শক্ত করে ধরে রাখে।
সাহিত্য নিজেকে সামলে নিয়ে চুপচাপ সুহাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। সাহিত্য বেরিয়ে যেতেই এক এক করে সকলেই প্রস্থান করে। বেরোনোর আগে আয়েশা সিদ্দিকা আরো একবার করুণ চোখে তাকায় মোতালেব হোসেন আর তাহিরা বেগমের দিকে। তাহিরা বেগমের চোখে মুখে ফুটে আছে বেদনা আর অসহায়ত্ব। অপরদিকে চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছেন মোতালেব হোসেন।
_____________
মির্জা ম্যানসনে ফিরেই সাহিত্য সোজা নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। বেডের পাশে ছোট্ট টি টেবিল থেকে সুহার ছবিটা হাতে নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরে। কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় সেথায়। তাকিয়ে থাকে ছবিতে তার আদরের ফুলের চোখের দিকে।
আচমকা ছবির ফ্রেমটা ফ্লোরে আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলে। তারপর পাগলের মতো এতো দিনের জমানো সুহাসিনীর যতো গুলো ছবি ছিলো সব খুঁজে খুঁজে বের করে ফ্রেম গুলো আছড়ে ভাঙ্গতে থাকে। মুখে বিড়বিড় করতে থাকে,,,
_বেইমান,, বেইমান,,সব মিথ্যা,, সব ধোঁকা। ফুল আমাকে ভালোবাসে না। ভালোবাসে না। ও কেনো কিছু বললো না? ও কেনো আমার কাছে এলো না? কেনো চলে গেলো? বেইমান……
সবগুলো ছবি ভেঙেচুরে তছনছ করতে থাকে সাহিত্যে।
সাহিত্যর রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সিফাত, অরুদ্ধ বারবার করে সাহিত্যকে দরজা খুলতে বলে। কিন্তু সেসব ডাক সাহিত্যর কানে পৌঁছায় না। সাহিত্য যেন এখন এই পৃথিবীতেই নেই। পার্থিব কোন কিছুই তার ধ্যান-জ্ঞানে নেই।
ছেলের ঘর থেকে ভাঙচুরের শব্দ শুনে হাউমাউ করে কাঁদছেন আয়েশা সিদ্দিকা। আরশি ও পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছে না। এদিকে মেহরাব বাড়িতে নেই। শ্বশুর- শাশুড়ি কেউই স্বাভাবিক চিন্তার মাঝে নেই। সাহিত্যের অবস্থা সব থেকে খারাপ। না জানি সে ঘরের দরজা দিয়ে কি করছে। আদৌ নিজেকে সামলাতে পারছে কিনা। আরশি যেন আকুল পাথারে পড়েছে। কিভাবে সবটা সামলাবে বুঝে উঠতে পারে না আরশি।
সাহিত্যের রুমের ফ্লোরে চারিদিকে ভাঙ্গা কাঁচের ছড়াছড়ি। এতগুলো ফ্রেম ভেঙে তছনছ করেছে সাহিত্য। তারপর সেই ভাঙা কাঁচের ওপরেই শুয়ে পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে সে। বুকে, গলায়, হাতে জায়গায় জায়গায় কাঁচ ঢুকে ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সেদিকে কোন হুঁশ নেই সাহিত্যর। সুহার নাম ধরে চিৎকার করে ওঠে সাহিত্য,,
__আমার ফুল!! আমার আমার পদ্মফুলকে এনে দাও। আমার সুহাসিনী কে এনে দাও না তোমরা!! আমার ফুলকে ছাড়া আমি মরে যাবো ।আমার সুহাসিনী কে এনে দাও। ও ফুল! তুই আয় না একবার। আমার বুকটা জ্বলে যাচ্ছে!! হৃদপিণ্ড পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে!! একবার আয় না! এ বুকে মাথা রাখ না একবার!! আমার ফুল।
ডুকরে কেঁদে ওঠে সাহিত্য।
দরজার বাইরে থেকে সাহিত্যর হাহাকার শুনে অরুদ্ধ আর সিফাতের চোখেও অশ্রুর ঢল নামে। এতগুলো বছরে কখনো সাহিত্যকে এত ভেঙে পড়তে দেখেনি তারা। আজ শুধুমাত্র সুহাসিনীর অভাবে বন্ধুর এমন পাগল প্রায় অবস্থা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তারা। শুধু মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করছে, যেনো পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যায়। সবকিছু যেন আগের মত হয়ে যায়।
চলবে,,,,