ভোরের শিশির পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
986

#ভোরের_শিশির
#সাহিরাহ_আনজুম_ইউশা
অন্তিম পর্ব

পরের দিন রাধিকা তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে।সে চলতে চলতে নদীর পাড়ে আসে।এটা সেই নদী যেখানে মাহিন তাকে প্রায় নিয়ে আসতো।চারপাশে কুয়াশায় ঢাকা।মৃদু বাতাস বয়ছে।সেই বাতাসে রাধিকার মাথার আঁচল পড়ে যায়।সে দিকে তার কোনো ভ্রক্ষেপ নেই।ঘাসের উপর শিশির বিন্দুগুলো চিকচিক করছে।
হঠাৎ এমন সময় শিশির ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে আরো আসার আওয়াজ আসে।রাধিকা সেদিকে তাকিয়ে বাকরুদ্ধ।সে পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো।কুয়াশার ভেতরে রাধিকা মাহিনকে দেখে অনিমেষ স্হিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

মাহিন মুক্ত বাতাস গায়ে লাগানোর জন্য নদীর পাড়ে আসা।সে কখনো ভাবেনি এখানেই রাধিকাকে পেয়ে যাবে।

রাধিকা অন্তরের চৈতন্য আভায় অপূর্বরুপে দীপ্ত হয়ে বললো আপনি!!
রাধিকার সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগলো।তার নড়াচড়ার শক্তি যেনো হারিয়ে গেছে।সে হুট করেই মাহিনকে জরিয়ে ধরে।তার দুই চক্ষু জলে ভরিয়ে উঠলো।মাহিনের চক্ষু দিয়ে বড়ো বড়ো জলের ফোঁটা ঝরে পড়তে লাগলো।মাহিন রাধিকাকে শক্ত করে তার বাহু ডোরে আবদ্ধ করে ।তার মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই রাধিকা হারিয়ে যাবে।বহুক্ষণ পর মাহিন রাধিকাকে ছাড়ে।রাধিকা ভেজা কন্ঠে কিছু বলতে চাইলে মাহিন রাধিকার ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বললো কোনো কথা না,সব পরে শুনবো।আর তোমাকে হারাতে চাই না।এখন এই মুহূর্তে তোমাকে বিয়ে করবো।
মাহিনের কথায় রাধিকার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠে।অজান্তে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।আজ তার সমস্ত দুঃখের মেঘ আনন্দের জলে ঝরিয়ে পড়ছে।

মাহিনের রুমটা অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।বিছানার উপরে গোলাপ ফুলের পাপরির সমাহার।রুমের চারপাশে বিভিন্ন ফুল রাখা হয়েছে।চাঁদের আলোতে তার সমস্ত রুমটি নববিবাহের রৌপ্যচ্ছটার করে তুলেছে।চাঁদের শুভ্রবর্ণের আভা মাহিনের সমস্ত রুমে পর্দা ভেদ করে রুমের ভিতরটিকে আলোকিত করেছে।ফুলশ্যায় বেনারসীর ঘোমটা জরিয়ে বসে আছে রাধিকা।ঘরোয়া ভাবে মাহিন আর রাধিকার বিয়ে হয়।মাহিনের বাবা মা এতে কোনো আপত্তি তুলেনি।তারা রাধিকাকে ছেলের বউ হিসাবে মেনে নেয়।রাধিকা অপেক্ষায় আছে তার কাঙ্কিত পুরুষের আগমণে।এমন সময় দরজায় খটমট আওয়াজ তার কর্ণে প্রবেশ করে।মাহিন ধীরে ধীরে এগুতে থাকে।রাধিকা লজ্জাজড়িত কন্ঠে সালাম দিলো।মাহিন সালামের জবাব দিয়ে রাধিকার পাশে বসে।

মাহিন রাধিকার কপালে উষ্ণ এক চুমু দেয়।রাধিকার কোলে মাথা রেখে বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।

রাধিকা পুনরাবৃত্তি করলো অতীতের সব ঘটনা।মাহিন নির্বাক হয়ে সবটুকু শ্রবণ করে।রাধিকার হঠাৎ তার মায়ের কথা মনে হয়।মাহিনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে আপনি বলেছেন আজ আম্মা আসবে।আম্মা তো আসলো না।

মাহিন বড় করে এক নিঃশ্বাস নেয়।রাধিকার কাছে সে কিছু গোপন করতে চাইনা।সব বলবে।মাহিন শুয়া থেকে উঠে বলে চল ব্যালকনিতে।এখান থেকে চাঁদ দেখতে পারবো।রাধিকা উঠার আগেই মাহিন রাধিকাকে কোলে তুলে নেয়।রাধিকা লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বলে একি করছেন?নিচে নামান।

মাহিন যেতে যেতে বলে বউকে কোলে নিবো না তো অন্যকে নিবো।আমার ইচ্ছা হলে সারা দিন বউকে কোলে রাখবো।বিয়ে তো করেছি বউকে আদর করার জন্য।

রাধিকা প্রতি উত্তরে কিছু না বলে মাহিনের বুকে মাথা রাখে।

শীতের রাতের চাঁদটিকে আজ দারুন লাগছে।আকাশে অসংখ্যা তারকার মেলা।আজ যেনো চাঁদনী রাতটা নতুন সাজে সজ্জিত হয়েছে।মাঝে মাঝে চাঁদ মেঘের আড়ালে চলে যায়।তখন পুরো পৃথিবীতে অন্ধকার বিস্তার করে।

রাধিকা পুনরায় প্রশ্ন করে আম্মা আসলো না কেনো?
মাহিন আকাশের দিকে ইশারা করে বলে এই যে তোমার মা।
রাধিকা কিছুই বুজতে পারিনি।বোকার মত মাহিনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে আমি কিছুই বুজতে পারেনি।

এমনি সময় হঠাৎ কালো মেঘ তাদের ভাগ্যকাশে ছেয়ে গেলো।আকস্মাৎ রাস্তার দিক থেকে একটি বুলেট রাধিকার বুকে বিঁধে।রাধিকা পড়ে যেতে চাইলেই মাহিন রাধিকাকে ধরে ফেলে।পুনরায় আরেকটা বুলেটের শব্দ শুনা যায়।মাহিন রাস্তায় দৃষ্টি দিয়ে দেখে আবিব।আবিব মাহিনকে মারতে এসেছিলো।গুলিটা সে মাহিনকে করেছিলো,কিন্তু ভুলে রাধিকার গায়ে লাগে।নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের হস্তে গুলি করাই আবিব সাথে সাথে সুইসাইড করে।

মাহিনের সাদা শেরওয়ানীটা রাধিকার রক্তে ভেজে যায়।রক্তরাঙা হয়ে উঠে রাধিকার মেহেদীমাখা হাত।রক্তস্নাত হয়ে উঠে তাদের বাসর।মধুর বাসর রক্ত ভেজা বাসরে পরিণত হয়।রাধিকা মাহিনকে কামছে ধরে বলে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।আমি বাঁচতে চাই,তোমার সাথে সংসার করতে চাই।

মাহিনের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।কান্না কন্ঠে বলে একদম চিন্তা করবে না।তুমি বাঁচবে।আমাদের বাচ্চা হবে।তোমাকে আম্মু আর আমাকে আব্বু বলে ডাকবে।

তা মনে হয় আর হবে না মাহিন।আমি বাঁচবো না।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

মাহিন আলতো করে রাধিকার গলায় চুমু দিয়ে বলে বাজে কথা বলবে না।দেখিও আমাদের সব স্বপ্ন পুরণ‌ হবে।আল্লাহ তোমাকে আমার কাছে যখন পাঠিয়েছে তখন তিনি আবার নিয়ে নিবেন না।

তখনিই এ্যাম্বুলেন্স আসার শব্দ আসে।মাহিন রাধিকাকে কোলে করে নিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে তুলে।

মাহিন তার মাকে বলে আম্মু আমি রাধিকাকে ছাড়া বাঁচব না।

তিনি অশ্রু মুছে বলেন চিন্তা করিস না রাধিকার কিছুই হবে না।

পরের দিন সকাল আটটায় রাধিকার সেন্স ফিরে।মাহিন এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে রাধিকার কেবিনে আসে।
রাধিকা মাহিনকে দেখে মৃদু হেসে উঠে।মাহিন কৃত্রিম রাগ নিয়ে বলে হাসা হচ্ছে তাই না।সারা রাত আমাকে চিন্তায় রেখে এখন মজা নিচ্ছ।

রাধিকা মাহিনের বুকে মাথা রেখে বলে আপনাকে চিন্তিতমাখা মুখটা দেখলে যে আমার ভালো লাগে।

মাহিন রাধিকার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে বাসায় যাই তারপর তোমাকে শাস্তি দিবো।

কেনো,,

আমাকে বারে বারে কষ্ট দেওয়ার জন্য।

আপনিও তো আমাকে কষ্ট দিয়েছেন।

কখন দিলাম?

তাহলে আমি কখন দিলাম?

বাসায় যাই তারপর বলবো কখন দিয়েছ।

ট্রেন তার আপন গতিতে চলছে।যাত্রীরা ঘুমে তলিয়ে আছে।কেউ কেউ তন্দ্রার ভাব নিয়ে ঝিমুচ্ছে।রাধিকা মাহিনের কাঁধে মাথা রেখে বহু আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে।জানার বাতাসে রাধিকার চুল এসে মাহিনের মুখে এসে বিরক্ত করার চেষ্টা করছে।কিন্তু মাহিন বিরক্ত না হয়ে সেটা উপভোগ করছে।তাদের বিবাহের আজ দুই মাস।মাহিনের স্বপ্ন ছিলো সমুদ্র বিলাস করার।আজ সেটাই পুরণের জন্য কক্সবাজারের দিকে যাত্রা করছে।ট্রেন ব্রিজের উপর আসতেই মাহিনের মনে পড়ে রাধিকা তো কখনো বড় কোনো ব্রিজ দেখেনি।আজ রাধিকাকে সে ব্রিজ দেখাতে চাই।কালবিলম্ব না করে রাধিকাকে ডেকে বলে রাধিকা ব্রিজ দেখবে।

রাধিকা তন্দ্রার ভাব নিয়ে বলে দেখবো।

তাহলে চুখ খোল।

রাধিকা তন্দ্রা দূর করে জানার দিকে দৃষ্টি দেয়।যতক্ষন ধরে ট্রেন ব্রিজের উপর ছিলো ততক্ষণ ধরে চেয়ে থাকে।হাস্যজ্জ্বল হয়ে বলে আপনি না থাকলে কখন এই সব দেখতে পারতাম না।

এখন থেকে তোমার সব ইচ্ছা পুরণ করব।

রাধিকা মাহিনের বুকে মাথা রেখে অদূরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে ভালোবাসি আপনাকে।
মাহিন রাধিকার হাত ধরে বলে আমিও ভালোবাসি।

সমাপ্ত,,,,,,,