মজিলো_প্রেম_সখার_সনে পর্ব-৩০+৩১

0
214

#মজিলো_প্রেম_সখার_সনে

®️ রিয়া জান্নাত

| | পর্বঃ- ৩০ | |

সকাল সকাল ল্যাগেজ গুছিয়ে ল্যাগেজ নিয়ে ডিলনাসিন নিচে চলে আসে? ডিলকে এভাবে ল্যাগেজ গুছিয়ে নিচে আসতে ডিলের শশুড় শাশুড়ী একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে। ডিল শশুড় শাশুড়ী কে সালাম দিয়ে বলে,,

” বাবা মা আমি আমাদের বাসায় চলে যাচ্ছি। এতদিন আপনাদের সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। না জানি কত ভূল করে ফেলেছি? আমার করা সকল ভূলের জন্য আপনাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি? নিজেদের মেয়ে মনে করে ক্ষমা করবেন। ”

” ডিলের শশুড় বলে বউমা তুমি হঠাৎ ওই বাড়িতে যাচ্ছো? তা যাচ্ছো যাও এইখান থেকে ওইখানেই যেতে এত কাপড় চোপড় সঙ্গে করে নিতে হয় নাকি? এমন ভাবে এই বাড়ি থেকে বেড়েচ্ছো। মনে হচ্ছে আর ফিরবেনা? ”

ডিল মেকি মুচকি হেসে বলে,,,

” বাবা কারজন্য এই বাড়িতে ফিরবো বলতে পারেন? আজ সাত দিন হলো আমার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে? আপনাদের ছেলে পাকিস্তান থেকে আসছে চারদিন হলো। কিন্তু সে আমার সঙ্গে এখনো একটা কথা বলে নাই। আমাকে দেখলে পালাই পালাই ভাব চোখমুখে নিয়ে ঘোরে।কাল রাতে সে আমাকে বলছে সে কখনো আমাকে স্ত্রীর স্বীকৃতি দিতে পারবেনা? তাহলে বলুনতো আমি অবলা নারীর মতো এখানে পড়ে থাকবো কেনো? ”

ডিলের কথায় ডিলের শশুড় শাশুড়ীর বুকে আঘাত লাগে। তপ্তশ্বাস ছেড়ে ডিলের শাশুড়ি বলে,,,

” শুধু কি আমাদের ছেলে ভালোবাসেনা বলে চলে যাবে? আর আমরা তোমাকে ছেলের বউ করে নিয়ে আসলাম এইদিনটা দেখার জন্য ? আমরা তোমাকে ভালোবাসিনা। তুমি পারবে আমাদের এই দুইটা মানুষের ভালোবাসা অবজ্ঞা করে ওই বাড়িতে থাকতে? ”

” ডিলনাসিন স্বার্থপরের মতো বলে পারতে হবে মা। আমি এইখানে থাকলে আপনাদের ছেলের কষ্ট বাড়বে বৈকি কমবে না। আমি যে মানুষটাকে ভালোবাসি। তার সামনে এভাবে ঘুড়ঘুড় করে তার ভাঙ্গা হৃদয়ে আঘাত করতে পারিনা। ”

ডিলের শশুড় বলে বউমা,,,

” আর কয়েকটা দিন দেখো না? আমার মন বলছে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা ওর সঙ্গে আরও কথা বলবো? ”

” বাবা আর কত একদিন, দুদিন, এক সপ্তাহ করতে করতে আজ চারটা মাস পেরিয়ে গেছে? সে যদি আমাকে মেনেই নিতো পাকিস্তান থেকে ফেরার পর অত্যন্ত আমাকে জিজ্ঞেস করতো কেমন আছো ডিলনাসিন? আমি তার সামনে থেকে তার এই কাঠিন্যে নিতে পারছিনা। আমার জন্য দোঅ করবেন বাবা মা। আপনাদের ছেলেকে বলে এসেছি ডির্ভোস লেটার বাড়িতে পাটিয়ে দিতে? আমি তাকে মুক্ত করতে চাই এই বন্ধন থেকে। ”

ডির্ভোসের কথাটি শুনতেই লিটুর বাবা মায়ের চোখে পানি এসে যায়।

” ডিলের শশুড় বলে সকাল বিকাল চা দেওয়ার অভ্যাস করেছো। সকাল বেলা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে ভাত এনে দিছো? রাতের বেলা অসুস্থ হলে নিজের মায়ের মতো সেবা করছো? এসব আমি ভূলিবো কিভাবে? ”

” ডিলনাসিন তপ্তশ্বাস ছেড়ে বলে শূন্যস্থান কখনো শূন্য থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে। কাজলী খালাকে সব বলে দিছি। ওনি টাইমমতো সব করে দিবে বাবা। ”

” ডিলনাসিনের শাশুড়ী চোখ থেকে চশমাটা সরিয়ে টি টেবিলে রাখে। এরপরে বলে বউমা তুমি চলে গেলে নিয়ম করে তিনবেলা ঔষধ আমাকে কে দিবে? গোসলের পর আমার ভেজা কাপড় কে ছাঁদে মেলতে দিবে? আমার মাথায় বিকাল হলে তেল দিয়ে দিবে কে? ”

” ডিলনাসিনের চোখের কার্নিশ বেয়ে দুফোঁটা পানি গালে ফেলে । এরপরে বলে বাবা মা আমি চলে যাচ্ছি। যাওয়ার সময় আমাকে এইভাবে দুর্বল করবেন না। আমি চলে গেলে আপনাদের ছেলের পছন্দ মতো বউ নিয়ে আসতে পারবেন? আর কাজলী খালাকে সব বলা আছে? এইগুলা নিয়ে ভাববেন না! ”

” লিটন সরকার দুতালা থেকে এসব কিছু দেখে। মনে মনে বলে এই ছোট মেয়েটার জন্য আমার মা বাবা চেখের পানি ফেলছে। গত চারমাস আগে এই মেয়েটার মধ্যে কত ছোট ছোট আবদার ছিলো।বাচ্চামি স্বভাব ছিলো। আজ এই মেয়েটির এতো পরিবর্তন কিভাবে? বাড়ির সকলের মন জয় করে নিয়েছে ? মেয়েটার চোখের দিকে তাকালে আমারো ক্যান মায়া হয় তারজন্য? তার ভালোবাসাগুলো তাহলে বাচ্চামি ছিলোনা। ”

উপরের দিকে নজর পড়ে ডিলের শশুড় ও শাশুড়ীর। তারা দেখতে পায় লিটু দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে সবটা দেখছে। মুখে কিছু বলছে না। ডিলনাসিন ল্যাগেজ নিয়ে বাইরের দিক পা বাড়ায়। লিটুর বাবা মা বলে উঠে বউমা তুমি যদি এই বাসা থেকে চলে যাও। তাহলে আমরাও এই বাসা ত্যাগ করবো। আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাও তোমাদের বাড়িতে।

” ডিল পিছন ঘোরে তাকায় না আর। কারণ পিছন ঘোরে তাকালে তার, শশুড় শাশুড়ীর অনুনয় বিনয় ফেলতে পারবেনা। দ্রুত পথ হাটা দেয়। ”

লিটুর বাবা মা সোফায় বসে পড়ে। কপালে হাত দিয়ে লিটুর দিকে আড়চোখে তাকায়। তারপরে মাথা নিচু করে লিটুর বাবা লিটুর আম্মাকে বলে দেখো লিটুর মা এই বাড়িতে যদি বউমা না থাকে আমিও থাকবো না। এইবলে লিটুর বাবা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।

” লিটু নিচে এসে বলে মা তোমরা এসব কি পাগলামি করছো? আমি কি তাঁকে যেতে বলেছি সে তো স্বইচ্ছায় বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। এখানে আমার কিছু করার নাই। ”

” লিটুর মা ছেলের কথা সহ্য করতে না পেরে বলে,, থাকতেও তো বলো নাই। মেয়েটা নীরবে আর কত অপমান সহ্য করবে। সে তো রক্তমাংসে গড়া একজন মানুষ। তার মধ্যে তো বিবেক বলে একটা কথা আছে। যা তোমার মধ্যে নাই। ”

” এই মূহুর্তে লিটুর খুব রাগ হলো। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে মায়ের কথাটি হজম করার চেষ্টা করলো। সোফায় গা এলিয়ে বসলো মায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু তার মা লিটুকে পাত্তা না দিয়ে উপরে চলে যায়। ”

” লিটন সরকার মনে মনে বললো আমার অনুপস্থিতে এই বাচ্চা মেয়েটা আমার বাবা মায়ের সঙ্গে করলো কি? যারজন্য আমার বাবা মা আমার সঙ্গেই এরকম অশোভনীয় ব্যবহার করছে। লিটনের মাথাটা প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে। এই মূহুর্তে এক কাপ কফি দরকার। কিন্তু কাকে বলবে বানাতে সেই লোকটা বাড়ির মধ্যে নাই। তাই কাজলী খালাকে বললো এক কাপ কফি আনতে। ”

লিটুর মা ব্যাগ গুছিয়ে নিচে আসলো। লিটু তার তার আম্মাকে বললো কোথাও বের হচ্ছো মা?

” লিটুর মা ছেলেকে বললো যেই বাড়িতে বউমা থাকবে না। সেই বাড়িতে আমরা থেকে কি করবো? তোমার বাবা একটু আগে বাড়ি থেকে বের হইছে। আমিও চললাম শ্রীহীন সংসারে স্ত্রীলোকের দরকার কি? ”

মা তোমরা স্বার্থপরের মতো আচরণ করছো ক্যান? তোমরা কি আমার বাবা মা নাকি ডিলের বাবা মা? আমিতো তোমাদের আদরের বউমাকে যেতে বলেনি। সে স্বইচ্ছায় বাড়ি ত্যাগ করেছে? তাহলে বাবা মা হয়ে আমার প্রতি কাঠিন্যে হইতেছো ক্যান? আমি কি পাকিস্তান থেকে ফিরছিলাম এসব দেখার জন্য।

” লিটু তুমি অনেক বড় ছেলে। ডিলের মতো অভিমানের বয়স তোমার নয়। তুমি যেমন আমাদের ছেলে তেমনি ডিল আমাদের কাছে মেয়ে। মেয়েটার কাজ অনেক নিখুঁত। জানো তোমার জন্য মেয়েটা কত কষ্ট করে রান্না শিখেছে এই বাড়িতে। সবকিছু শিখার পর সংসারে পাক্কা গিন্নী হয়ে উঠেছিলো। এরপরে থেকে আমি কখনো কিচেনে যাইনাই। আর সেই তুমি আমার সংসারকে শ্রীহীন করছো? এই শ্রীহীন সংসারে আমরা থাকবো কি করে? ”

” লিটুর মুখে আর কোনো কথা আসেনা। কাজলী খালা কফি দেয় লিটনকে। লিটুর মা কাজলীকে বলে তোমার ছোট স্যার কে দেখে রাখিয়ো কাজলী। কখন কি চায় দিয়ো। সে একাই উপভোগ করুক এই বিলাসবহুল সুখ। তারতো চাওয়া পাওয়া সব পূর্ণ হলো। আমাদের এই সংসারে থাকলে কি আর না থাকলে কি? তার কোনো যায় আসবে না। ”

” লিটু কফির মগে এক চুমুক দিয়ে বলে কোথায় যাচ্ছো মা? ”

” যেদিকে দু চোখ যায়? ”

★★★

ভার্সিটি যাবানা ফিহা আর কতদিন বাড়িতে থাকবে বিয়ের নাম করে।

” আজকে ভার্সিটিতে যাবো সখা। তিহার সঙ্গে সকালে কথা বলছি । আমারো সেইম প্রশ্ন আপনার নতুন চাকরির ব্যবস্থার কি খবর? ”

” অন্য কোথায় চাকরি নিবো কি করে প্রেয়সী? প্রিন্সিপাল স্যার যে আমাকে প্রেয়সীর কাছছড়া করতেই দিলোনা? ”

” মানে! ”

” ফিরোজ মুচকি হেসে বললো আমার রিজাইন লেটার সাবমিট করে নাই প্রিন্সিপাল। এতদিন থেকে ভার্সিটিতে যাই নাই। তিনি সেই অনুপস্থিগুলো বৈবাহিক ছুটি হিসাবে দেখিয়েছে? বলোতো এখন আমি কি করি? ”

” সত্যি বলছো সখা! খুশিতে যেয়ে ফিরোজকে জড়িয়ে ধরে। আমি কতটা খুশি তোমাকে বুঝাতে পারবো না সখা? আমার সম্পর্কের উৎপত্তি গুলো তো সেই প্রফেশনের মাধ্যমে। সম্পর্কের পরিণতি পেয়ে আমরা সেই স্মৃতিগুলো মুছতে পারিনা। আপনাকে এই কয়েকদিনে এই কথাটা অনেকবার ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেও পারিনি সখা? ”

ফিরোজ দুই বাহু দ্বারা প্রেয়সীকে বক্ষ থেকে হালকা করে নেয়। এরপরে চিবুক ধরে বলে,,

” ভার্সিটির সবাই যে বলাবলি করবে স্যার হয়ে ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে? এই অপবাদটি সহ্য করে নিতে পারবে তো? আমি তোমার ভালোর জন্যই রিজাইন দিয়েছিলাম। কিন্তু ভার্সিটির প্রিন্সিপালতো আমাকে ছাড়লোই না। ”

” আমরাতো আর আমাদের সম্পর্কের পরিণত টা বাজেভাবে উপস্থাপন করি নাই। আমরা যা করেছি সম্পর্কের বৈধ নাম দিয়েছি। এরপরেও পাছে লোকের কিছু কথা শুনবো কেনো? পৃথিবীতে তো আর আমি তুমি স্যার ছাত্রী বিয়ে করি নাই। এরআগে হাজার হাজার সম্পর্কের অধ্যায় এভাবেই শুরু করছে। তারা যদি পারে আমরা পারবো না কেনো? ”

” ফিহাকে বক্ষে টেনে নেয় ফিরোজ। এরপরে বলে ফিহা আমাদের বিয়েতে তোমার কোনো স্যার ম্যাডাম কে ইনভাইট করি নাই। ওরা যদি আমার সঙ্গে রসিকতা করে ওদের আমি কি বলবো? আমার ভার্সিটিতে যেতে লজ্জা করছে। ওদের মুখের দিকে তাকাবো কি করে? ”

ফিহা ফিরোজের বক্ষের কোটর থেকে বেড়িয়ে বলে,,,

” বিয়েটাতো আমিও করেছি। ওরা ওইগুলা অভিমান থেকে দু চারদিন বলবে। একদিন তাদের ইনভাইট করে বাড়িতে খাইয়ে দিবো?

এমন সময় লিভিং রুম থেকে শাফখাতের চিৎকারের আওয়াজ আসলো। শাফখাতের চিৎকারের শব্দে ফিহা ও ফিরোজ নিচে চলে আসে।

চলবে,,,

#মজিলো_প্রেম_সখার_সনে

®️ রিয়া জান্নাত

| | পর্বঃ- ৩১ | |

ডিলনাসিন তুই সকাল সকাল ল্যাগেজ গুছিয়ে এই বাড়িতে একা আসছিস কেন? লিটন কোথায়? ও আসে নাই?

” কেনো ভাইয়া আমার বিয়ে হয়ে গেছে বলে কি আমি পর হয়ে গেছি? সেই আসার পর থেকে তোমরা সকলেই এক প্রশ্ন করতেছো? একই প্রশ্নের উত্তর কতজনকে দিবো? একটু আগে শাফখাত ভাইয়াকে আর বাড়ির সকলকে আমার বাড়ি আসার পিছনের কারণ বলছি? এখন আলাদা করে তোমাকেও বলতে হবে? ”

” ডিলনাসিনের এমন উত্তরে ফিরোজ বুঝতে পারে কোনো গন্ডগোল আছে? তাই এইমূহূর্তে ডিলনাসিনের সঙ্গে তর্কে না যেয়ে পারিজাতকে ইশারা করে উপরে নিয়ে যা ওকে? ”

পারিজাত ডিলের হাত থেকে ল্যাগেজটা নিয়ে ডিলের বামহাত ধরে উপরে উঠে।

বাড়ির সবাই চুপ। কেউ কোনো কথা বলছে না। যে যেখানে বসে, দাড়িয়ে ছিলো সেইভাবেই মূর্তির মতো কাকতাড়ুয়া স্টাইল হয়ে আছে। মাথা নিচু করে। সবাইকে এইভাবে চুপ থাকতে দেখে ফিরোজ শাফখাতের কাছে যায়। ফিহা তিহার পাশে এসে দাঁড়ায়।

” ফিরোজ শাফখাতকে বলে কি হয়েছে তোরা সবাই শক্ত হয়ে আছিস যে? একটু আগে আমার রুমে তোর গলার চিৎকার পেলাম? ”

” শাফখাত ফিরোজের দিকে মাথা তুলে বলে ভাইয়া ডিলনাসিন ওই বাড়ি থেকে চলে আসছে? লিটু ডিলনাসিনকে ডির্ভোস দিবে। এই সম্পর্কের নাম পাচ্ছেনা। বলতো ডিলের মতো নিষ্পাপ মেয়ের দোষ কোথায়? এই বয়সে সেফারেশন মানা যায়? ”

” ওই বাড়িতে কল করছিস? ”

” কার কাছে কল করবো? লিটু আমার বন্ধু হলেও এখন তাকে পেলে আমি মেরে ফেলবো? ও আমার বোনের সঙ্গে এটা করতে পারেনা? ডিল ওকে ভালোবেসে এই বিয়েতে আগাইছে । এই সম্পর্কের নাম দিতেই হবে ওকে। ”

শাফখাতের এমন কথায় বাড়ির সকলে স্তব্ধ হয়ে যায়। সবার কর্ণে শাফখাতের শেষের কথাটা মোটর সাইকেলের হর্ণের মতো বাজতে লাগলো। একেকজন আরেকজন কে দেখতেছিলো। সবার চোখ ছানাবড়া। ফাহিম খান আর চুপ করে থাকতে না পেরে প্রশ্ন করে বসে শাফখাতকে,,,

” ভালোবেসে বিয়ে মানে কি শাফখাত? এই বিয়েটা তো অঘটন ছিলো? ভালোবাসার প্রসঙ্গ আসলো কই থেকে? ”

ফাহিম খানের প্রশ্নে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খায় ফিহা। শাফখাত আর ফিরোজ একে অপরের চোখের দিকে তাকায়। চোখ দিয়ে দুইভাই যেনো প্রশ্ন করে উত্তর নিলো! শাফখাত এবার বাড়ির সকলের উদ্দেশ্য বললো ,,,

” হ্যা এই বিয়েটা অঘটন ছিলো না বড়আব্বু? এই বিয়েটা ছিলো প্লানমাফিক? অবশ্য বিয়ের আগে এসব কিছুই জানতাম না আমি। পরে ফিহা ভাবীর কাছে জেনেছিলাম! ”

” সিয়াম খান, ফুয়াদ খান ধৈর্যহারা হয়ে বলে কি জেনেছো তুমি? হেয়ালি না করে দ্রুত বলো। ”

” শাফখাত তপ্তশ্বাস ছেড়ে বলে আমাকে গুছিয়ে বলার সময় টাতো দিবে। সবাই এরকম করলে আমি নেক্সট আলোচনায় আসবো কি করে? ”

” মায়া খানের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অবিরত। মেয়ের জীবন নষ্টের জন্য মনে মনে দায়ী করছে ছেলের বউ ফিহাকে। কিন্তু সবার সামনে এই কথাটা বলতে পারছেনা। কিন্তু ফিহার দিকে কঠোর ভাবে দেখে। শাফখাতকে বলে যা জানো দ্রুত বলো। ”

” ফিহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে শাফখাত ভাইয়া এই অপকর্মে যেহেতু আমার হাত আছে আমাকেই সবাইকে সত্যিটা জানাতে হবে। ”

” না ফিহা, তোর কথায় অনেকে অনেক রিয়াক্ট করতে পারে আমি বলছি সবটা। ”

” ফিরোজ ফিহার কাছে যেয়ে ফিহার ডানহাত চেপে ধরে। চোখে চোখে বলে শান্ত হও। ”

” মায়া খানের আর সহ্য হচ্ছে না। ছেলে বউকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে ইচ্ছে করছে। সবার সামনে বলতে ইচ্ছে করছে। ডিলনাসিনের এই পরিণতির জন্য তুমি দায়ী বউমা। ফিরোজকে ভালোবাসা সত্বেও লিটুর সঙ্গে বিয়েতে মত দেওয়ার কি দরকার ছিলো তোমার? ”

” পরিস্থিতি স্বাভাবিকের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ফাতেমা খান জেবা খানের দিকে তাকায়। জেবা সবটা বুঝতে পেরে শাফখাতকে বলে কি জানো দ্রুত বলো? ”

শাফখাত লম্বা নিঃশ্বাস নেয়। এরপরে বলা শুরু করে,,,

” ডিলনাসিন লিটন কে ভালোবাসে সেই ক্লাস টেন থেকে। ডিলনাসিন সাহস করে লিটনকে প্রস্তাব করে। লিটন সেই প্রস্তাব নাকচ করে আমাকে সবটা জানায়। আমি লিটনকে বলি ডিলনাসিন বাচ্চা মেয়ে। কিশোরী হওয়া দরুন এরকম করছে সবকিছু ভূলে যা লিটু। লিটু ব্যাপারটা মজা হিসাবে নিয়েছিলো। প্রথমবার এইরকম ভূল করাতে বাড়িতে আমি কিছু জানাইনি। আমি ভেবেছিলাম ডিলনাসিনকে বোঝালে সবটা বুঝে যাবে। সামান্য বিষয় নিয়ে বাড়িতে গন্ডগোল করার মানে হয়না। আমি ডিলনাসিনকে সেবার বুঝিয়ে এসএসসি অব্দি আটকে রেখেছিলাম। লিটু আমার বন্ধু হওয়া দরুন প্রায় আমার বাড়িতে যাতায়াত করতো? কিন্তু ডিলনাসিন সেইম ভূল এসএসসি পরীক্ষার পর করে। লিটুর হাত ধরে গোলাপ ফুল দেয়। লিটু সেই গোলাপ তৎক্ষনাৎ ফেলে দিয়ে আমার রুমে এসে সবটা বলে। আমি লিটুকে এই বাড়িতে সচরাচর আসতে মানা করে দিই। আমি ডিলনাসিনকে দ্বিতীয়বার বড় আঙ্কেলের নাম করে ভয় দেখিয়ে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় থাকি। ফিরোজ ভাইয়াকেও কিছু বলি নাই এইভেবে, যে কিশোরী বয়সে এইরকম ভূল সবাই করে একটু আধটু। এইভেবে তখন সেই কথা বাড়ির কাউকে বলি নাই। ভেবেছিলাম বাড়িতে এই কথা উঠলে ডিলের পড়াশোনা, ক্যারিয়ারে ইফেক্ট পড়বে। এরজন্য আমি নিজেই দায়িত্ব নিয়েছিলাম কলেজে ডিলনাসিন ও পারিজাতকে যাতায়াতের মাধ্যমে কলেজ পৌঁছে দেওয়ার। যাতে এসব বাচ্চামি করার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমি এগুলা করেও ডিলকে এই সম্পর্কে থেকে ছাড়াতে পারিনাই। ভেবেছিলাম ডিল সব ভূলে মুভ অন করছে। কিন্তু আমি ভূল ছিলাম। ফিহার সঙ্গে লিটুর বিয়ের প্রস্তাব আসাতে এই অঘটন টা হলো। ফিহা ডিলকে সাহায্য করার জন্য বিয়েতে মত দিয়েছিলো। বিয়ের দিন ফিহা পালাবে আর ডিলনাসিন ফিহার জায়গায় বসবে। বাড়ি থেকে মান সম্মানের ভয়ে তোমরাও সেদিন তাই করলে। আমারি ভূল ছিলো সবকিছুর পরেও ডিলকে প্রশয় দেওয়া। ”

” ফিহা সবার উদ্দেশ্য বলে ডিলনাসিনের চোখে লিটুর জন্য খাঁটি ভালোবাসা ছিলো। আমার সাধ্য ছিলোনা ওদের আলাদা করার। তাই এই অপশন টা আমাকে ব্যবহার করতে হয়েছে। কারণ ডিল তখন আবেগী ছিলো। আমি এরকম কিছু না করলে লিটুকে বিয়ে করার সুযোগ হারাতো ডিলনাসিন। আবেগী ডিল আবেগের বয়সে কিছু করে ফেলতো এরজন্য ওকে এভাবে সাহায্য করেছিলাম। ”

” ফিরোজ ফিহার হাত চেপে ধরে বলে,, তুমি কিছুই ভূল করো নাই। আমি বলছি ডিলনাসিন লিটুর থাকবে। ওদের আলাদা করতে পারবেনা কেউ। লিটু নিজেই ডিলকে পাওয়ার জন্য পাগলামো করবে। কয়েকটা দিন যেতে দাও। তার আগে ওই বাড়িতে ফোন করো ডিলের শশুড় শাশুড়ীকে। ”

” ডিলের শাশুড়ী কাপড় চোপড়ের ব্যাগ নিয়ে ভিতরে ঢোকে। পিছন পিছন ডিলের শশুড় ও ঢোকে? ”

” মায়া খান নিজের আবেগকে কন্ট্রোল রাখতে না পেরে বিয়াইনকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলে,, বিয়াইন আমার মেয়ের সংসার টা ভেঙ্গে দিয়েন না। আমি মা হয়ে এই ব্যাথা সহ্য করতে পারছিনা। আমার মেয়ে কিভাবে সহ্য করবে। ”

” ডিলের শাশুড়ী মায়া খানের পানি শাড়ির আচল দ্বারা মুছে দিয়ে বলে,,, কারো সাধ্য নাই আমাদের এইরকম লক্ষী বউমাকে আমাদের সংসার থেকে ত্যাগ করিবার। বউমা চলে আসছে বলে আমরাও সেই বাড়ি থেকে চলে আসছি। ছেলেকে বলে আসছি বউমা যেখানে থাকবে আমরাও সেখানে। আমাদের কয়েকটা দিনের জন্য সহ্য করে নেন বিয়াইন। ”

” বিয়াইনের মুখে এই কথাশুনে খুশিতে গদগদ হয়ে যায় বাড়ির সকলে। মুহূর্তের মধ্যে সবার মলিন মুখ হাস্যউজ্জ্বল হয়ে উঠে। ”

” ফাহিম খান বিয়াইকে জড়িয়ে ধরে বলে,, একদম ঠিক করেছেন বিয়াই এখানে এসে। জামাই এবার বুঝুক একা থাকার কষ্ট কত? ”

” আরে বিয়াই ছেলে আর ছেলের মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে এই স্টেপ নিছি। তাছাড়া এইরকম লক্ষী গুনবতী বউমাকে কেউ গৃহছাড়া করে। মাত্র চারমাসে আমাদের যতটা আপন করে নিছে অন্যকেউ এলে জীবনেও পারতো না। মাত্র চারমাসে সব রান্না বান্না শিখে নিছে। জানেন না বউমা কত সুস্বাদু খাবার রান্না করে। এই বউমাকে ঘরছাড়া করে আপনাদের বিয়াইনের লবনছাড়া খাবার খাই কি করে? ”

” ডিলের শাশুড়ী বলে শুরু হয়ে গেলো বউমার গুনকীর্তন আর বউয়ের দুর্নাম। তাও আমারি সামনে! বিয়াইন যতদিন আপনার বাড়িতে থাকবো আপনার বিয়াইকে লবনছাড়া খাবার পাতে দিবেন। দেখবো খায় কি করে ওই লকলকে জিহ্বা? ”

” এই পরিস্থিতিতে ডিলের শশুড় শাশুড়ীর খুনশুটিতে হেসে উঠে সবাই। ”

হাসির শব্দ শুনে ডিলনাসিন, পারিজাত নিচে চলে আসে। নিচে এসে শশুড় শাশুড়ী কে দেখে সালাম দিয়ে বলে,,,

” তোমরা এখানে আসছো ক্যান বাবা _ মা? ”

” ডিলের শশুড় বলে আমাদের ঘরের লক্ষী যেখানে থাকবে আমরাও সেখানেই থাকবো। ”

ডিলনাসিন তপ্তশ্বাস ছেড়ে বলে,,

” বাবা _ মা আমাকে ক্ষমা করো। আসলে তখন তোমাদের দিকে ফিরে তাকালে আমি এই বাড়ি আসতে পারতাম না। এরজন্য কঠোরতা এনেছিলাম বুকে। তোমরা চলে যাও বাবা – মা। আমি তাকে মুক্তি দিতে চাই এই সম্পর্ক থেকে। এক তরফা ভালোবাসিছি আমি। তাহলে দুটো পরিবার ক্যান সাফার করবে আমার জন্য। তাকে বলে দিয়েন ডির্ভোস লেটার পাটিয়ে দিতে আমি সাক্ষর করে দিবো। ”

” ডিলের শাশুড়ী ডিলকে জড়িয়ে ধরে বলে বউমা কখনো ডির্ভোসের কথা বলবে না। আমরা কি মরে গেছি? আমরা তোমাদের এক করার জন্য এই বাড়িতে আসছি। ছেলে নিসন্দেহে বুঝতে পারবে তোমার জায়গা আমাদের বুকে কতখানি। ছেলেতো আর বাবা মায়ের ভালোবাসা ফেলতে পারবে না। আমরা বলে এসেছি বউমা যেই বাড়িতে নাই, আমরাও সেই বাড়িতে নাই। তোমাকে নিতে আসি নাই আমরা। তোমার সঙ্গে থাকতে এসেছি। ”

” সে কি মা? তোমরা এখানে থাকলে ও খাবে কি? ওর শরীরের খোঁজ কে নিবে? ওনি তো একাকীত্ব বোধ করবে। ”

” বউমা সবকিছু ঠিক করার জন্য একাকীত্ব আনার দরকার লিটুর জীবনে। লিটু যতদিন না তোমাকে ওই বাড়িতে নিচ্ছে আমরা এখানেই থাকবো। ”

” এটা কি আদৌও সম্ভব? ওনি আমাকে ভালোবাসবে? ”

” ডিলের শশুড় বলে সম্পর্ক জোড়া লাগানোর এতকিছু সব ঠিক হয়ে যাবে বউমা। কিছুটা সময়ের দরকার এখন। ”

শোকের বাড়িতে মূহুর্তের মধ্যে আনন্দ বিরাজিত হলো। কুটুম বাড়িতে আসায় ফাতেমা খান,মায়াখান, জেবা খান কিচেনে রান্না করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

সিয়াম খান ফ্যাক্টরিতে গেলো। ফুয়াদ নিজ অফিসে। ফিরোজ তিহা ফিহাকে সঙ্গে করে নিয়ে ভার্সিটি রওনা হলো। এমপি শাফখাত খান একটি অনুষ্ঠানের প্রধান অথিতি হিসাবে ভাষণ মঞ্জে থাকার কথা। সেইখানে রওয়ানা হলো। পারিজাত ডিলকে নিয়ে আগের মতো খুনসুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো মোবাইল নিয়ে।

ডিলের শশুড় আর ফাহিম খান লিভিং রুমে ক্রিকেট খেলা দেখা শুরু করলো। পাকিস্তান আর অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ দুই বিয়াই দুই দলের ফ্যান হয়ে কথা কাটাকাটি করতে লাগলো।

ফাহমিদুল খান, জাদেজা খান গ্রামের বাড়িতে গেছে তিনদিন হলো। তাই আজকের পর্বে ওদের উপস্থিতি পান নাই পাঠকমহল।

লিটু ওই বাড়িতে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে আর দুনিয়ার কথাগুলো তার মস্তিষ্কে স্মৃতি হিসাবে ভাসতে লাগলো।

চলবে,,,,