#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ১০ (নজর!)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী
– ‘ইচ্ছে করে প্যান্টটা পানিতে চুবিয়েছিস তাইনা!’
প্রাহী বিরক্তিসূচক দৃষ্টিতে নক্ষত্রের দিক তাকালো। ইচ্ছে করে কেউ কাপড় ভিজায় আজব! বাবার কাপড়গুলো পাউডার মিশিয়ে ভিজিয়ে রেখেছিলো প্রাহী। তখন মা বললো নক্ষত্রেরও কিছু প্যান্ট আর জামা ভিজিয়ে দিতে। পরে দুপুরে গোসলের সময় উনি ধুঁয়ে দিবে। ছেলেমানুষের জামাকাপড় ময়লা হয় বেশি! তাই প্রাহীও আর কালবিলম্ব না করে ওর কিছু প্যান্ট, শার্ট আলাদা করে ভিজিয়ে দিয়েছে।
প্রাহী কাপড়গুলো পাউডার মিশানো পানিতে ভিজাতে ভিজাতে বললো,
– ‘জামাকাপড় ময়লা হলে ধুঁতে দিতে হবে না! ইচ্ছে করে কে কার কাপড় এভাবে ভিজায়! মা বলেছে তাই ভিজিয়ে দিচ্ছি।’
নক্ষত্র ভ্র্য কুঁচকে বলে উঠলো,
– ‘তা আমার এই প্যান্টটাই কেন চুবালি!’
– ‘মানে! তুই সারাটা দিন বাইরে বাইরে থাকিস। ঘুড়িস ফিরিস। বাসায় এসে পড়নের জামাকাপড় টা কোনো রকম মেলে সকাল হতে না হতেই সেই জামাকাপড় পড়েই আবার বের হয়ে যাস! জামাকাপড় থেকে আঁশটে গন্ধ বের হয়না! আবার বলিস এই প্যান্টটা কেন ভিজালাম!’
– ‘কি ব্যাপার বাথরু*মের সামনে এভাবে চেঁচামেচি কিসের!’
মায়ের কথায় প্রাহী আর নক্ষত্র সেদিক ফিরে তাকালো।
প্রাহী কাপড় ভিজানো শেষে হাত ধুঁতে ধুঁতে বললো,
– ‘তোমার ছেলের অপরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পড়তে ভালো লাগে আর কি!’
নক্ষত্র কিছু বলার আগেই প্রাহীর মা বললো,
– ‘কি সমস্যা! আমি ভিজাতে বলেছি ওকে তোর জামাকাপড়। এতদিনের বাঁশি জামাকাপড় না ধুলে পড়বি কিভাবে!’
নক্ষত্র প্রাহীর দিক তিরিক্ষি দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর মার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘তোমার মেয়ে…।’
প্রাহীর মা জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– ‘কি করেছে! ভালোমতো তোর জামাকাপড় ভিজিয়ে দিচ্ছে ভালো লাগছে না তাইনা! খোঁচা না মারলে হয়না!’
নক্ষত্র বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,
– ‘জামাকাপড়ের সাথে সাথে সবগুলো আন্ডার*ওয়্যারও ভিজিয়েছে…।’
প্রাহী কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো। প্রাহীর মা মেয়ের দিক তাকিয়ে নক্ষত্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– ‘জামাকাপড়ের সাথে হয়তো চলে এসেছে। তোর আলমারিতে নতুন একটা আছে ডান দিকে কাপড়ের ভাঁজে ওখান থেকে ওটা পড় আপাতত।
মার কথায় নক্ষত্র প্রাহীর দিক তাকিয়ে একটা রাগী দৃষ্টি দিয়ে ‘বেয়াদ্দপ’ বলেই গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো। প্রাহী সেদিক তাকিয়ে হাতগুলো ধুঁয়ে নিজ রুমের দিকে চললো।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল এখন। মেঘের ভীড়ে হালকা কিরণ গাছের ডালপালার লতাপাতার ফাকে উঁকি দিচ্ছে। কড়া রোদের হালকা উত্তাপ এখনও বিরাজমান। প্রকৃতির হালকা বাতাসের দরূণ সেই তাপ গায়ে লাগছে না। এক উষ্ণ বাতাস শরীরের সাথে দোল দিয়ে যাচ্ছে। বাতাসটা ভালোই লাগছে! সরু পথের এক সাইড দিয়ে চঞ্চল পায়ে হেঁটে চলছে প্রাহী। উদ্দেশ্য শিমলাদের বাড়ি। ভার্সিটি থেকে ফিরার পর শিমলা ফোন করে বলেছিল বিকেলে ওদের বাড়িতে যেতে। আড্ডা দিবে বলে! প্রাহীও আর না করেনি। মেয়েটার মন ভালো নেই। এই উছিলায় যদি একটু খারাপ লাগাটা দূর হয় তাহলে তো সেটা ভালোই! তুলিকেও বলেছে ও আসতে। ও বলেছিল আসতে পারলে আসবে।
শিমলাদের বাড়ির গেইট দিয়ে ঢুকেই দেখলো বাড়িতে অনুষ্ঠানের প্যান্ডেল, সাজগোজ সব তুলে ফেলা হয়েছে। দুদিন আগেও বাড়িটা যেখানে আলোকসজ্জা, হৈ হুল্লোড় দ্বারা বেশ রমরমা ছিল। আজ সেখানে বাড়িটা বেশ শান্ত! হালকা শ্বাস ফেলে প্রাহী শিমলাদের ঘরের ভিতর ঢুকলো। বসার ঘরে শিমলার মা, চাচী আকসাদের মা, বসে আছে। প্রাহী সেদিক এগিয়ে গেলো। সালাম জানাতেই সবাই ওর দিক তাকালো।
শিমলার মা প্রাহীর দিক তাকিয়ে হালকা হেসে বললো,
– ‘কি রে কেমন আছিস! বোস এখানে!’
প্রাহী শিমলার মার পাশে বসতে বসতে বললো,
– ‘এইতো ভালো৷ তোমার কি অবস্থা!’
শিমলার মা হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– ‘এইতো আছি। একলা এসেছিস! মাকে সাথে নিয়ে আসিস নি!’
– ‘মা আজ খালামণিদের বাসায় যাবে বললো। নইলে আসতো আমার সাথে এখানে!’
শিমলার মা হালকা মাথা নেড়ে বললেন,
– ‘ঠিকাছে। কি খাবি বল! হাতের সেমাইয়ের পায়েস রেঁধেছি খাবি!’
প্রাহী মাথা দুলিয়ে বললো,
– ‘এখন কিছু খাব না চাচীমা। পেট ভরা।’
– ‘একটু খেলে কিছু হয়না। বস আমি আনছি!’
বলেই শিমলার মা রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন
প্রাহী হালকা হেসে পাশ ফিরতেই দেখলো আকসাদের মা মুচকি হেসে ওর দিক তাকিয়ে রয়েছে। দেখলো আকসাদের মা মটরশুঁটি বাছছে। প্রাহী সেদিক তাকিয়ে আলতো হেসে বললো,
– ‘আমিও হেল্প করছি। তাহলে তাড়াতাড়ি হবে!’
বলেই মটরশুটিগুলো বাছতে লাগলো। আকসাদের মা মটরশুঁটি বাছতে বাছতে প্রাহীর দিক তাকিয়ে রইলেন।
– ‘প্রাহী তোমার পড়াশোনা কতদূর!’
প্রাহী মটরশুঁটি বাছতে বাছতেই বললো,
– ‘সেকেন্ড ইয়ারে আছি আপাতত আন্টি। দোয়া করবেন।’
আকসাদের মা হেসে বললেন,
– ‘অবশ্যই! তা পড়াশোনার পাশাপাশি কি কি করতে পছন্দ!’
প্রাহী আলতো হেসে বললো,
– ‘তেমন কিছুনা। মাঝেমধ্যে গার্ডেনে কাজ করি ভালোলাগে। আর টুকটাক রান্না করতেও ভালোলাগে।’
আকসাদের মা চমকিত সুরে বললেন,
– ‘তাই নাকি! কি কি রান্না করতে পারো শুনি!’
প্রাহী হেসে বললো,
– ‘বেশি কিছু পারিনা আন্টি। নুডুলস্, চা,কফি, খিচুড়ি, গরুর মাংস ভুনা আর পিঠা বানাতে পারি।’
– ‘তাই! পিঠাও বানাতে পারো! কি কি পিঠা বানাতে পারো!’
– ‘দুধপুলি আর ভাপাপিঠা।’
আকসাদের মা আলতো হেসে বললো,
– ‘তাহলে তো একদিন তোমার হাতের পিঠা খেতে হবে প্রাহী!’
প্রাহী লাজুক হেসে বললো,
– ‘জ্বী আন্টি অবশ্যই!’
আকসাদের মা হাসলেন। এভাবেই কিছুক্ষণ প্রাহীর সাথে টুকটাক কথা বলতে লাগলেন। হুট করে উপর থেকে শিমলা ডেকে উঠলে আকসাদের মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– ‘যাও শিমলা তোমায় ডাকছে! অনেক সাহায্য করেছো তুমি আমাকে! ধন্যবাদ প্রাহী!’
প্রাহী হেসে বললো,
– ‘ধন্যবাদের কিছু নেই আন্টি। মটরশুঁটি বাছা শেষ। আমি বরং এগুলো চাচীর কাছে দিয়ে তারপর যাই!’
বলেই আর কয়েকটা মটর বেছে শিমলার মার কাছে দিয়ে দুটো পায়েসের বাটি নিয়ে উপরে চললো প্রাহী। পিছন হতে আকসাদের মা আলতো হাসলো।
পায়েসের বাটি নিয়ে উপরে উঠতেই দেখলো আকসাদ ফোন দেখতে দেখতে হাঁটছে। হুট করে সামনে কেউ পড়ে যাওয়াতে তাকিয়ে দেখলো প্রাহী চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আকসাদ একটু অবাক হয়ে বললো,
– ‘আরে মিস প্রাহী! আপনি! কেমন আছেন!’
প্রাহী মাথা নেড়ে বললো,
– ‘জ্বী ভালো।’
কিছুটা থেমে আবার জিজ্ঞেস করলো,
– ‘আপনি!’
আকসাদ দেয়ালে হেলান দিয়ে বললো,
– ‘হু ভালো! পায়েস নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন! একটা আমার আর আরেকটা আপনার!’
প্রাহী কিছুটা চমকে প্লেটগুলোতে ইশারা করে বললো,
– ‘না…মানে একটা আমার আরেকটা শিমলার!’
আকসাদ ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
– ‘আচ্ছা! আমার তো খিদে পেয়ে গেলো আপনার হাতে পায়েস দেখে!’
প্রাহী কিছুক্ষণ আকসাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই আকসাদ ওকে বললো,
– ‘রিল্যাক্স প্রাহী! কি এতো ভাবছেন! আপনার খাবারে নজর দিচ্ছিনা আমি!’
প্রাহী কিছুটা জোড়পূর্বক হেসে বললো,
– ‘না আমি তেমন কিছুই মিন করিনি। আপনি এখান থেকে একটা নিতে পারেন! নজর দেবার কিছু নেই।’
আকসাদ ভ্রু উঁচু করে বললো,
– ‘সো কাইন্ড ওফ ইউ প্রাহী! আর ঠিক বলেছেন নজর দেবার মতো কিছু নেই কারণ!’
বলে হালকা ওর দিক ঝুঁকে বললো,
– ‘নজর যে অন্য কোথাও পড়ে গেছে অলরেডি!’
প্রাহী কিছুটা নড়ে উঠলো। হাতের ট্রেতা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে নির্ঘাত বাটিগুলো ভাঙবে। যেটা ও চাচ্ছেনা। হালকা আওয়াজে বললো,
– ‘একটু সরুন!’
আকসাদ নড়লো না। একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ওর দিক তাকিয়ে রইলো। প্রাহী মিনমিন কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘পায়েসের বাটিটা পড়ে যাবে!’
আকসাদ বাঁকা হেসে বললো,
– ‘কেন! হাত কাঁপছে আপনার এজন্য!’
প্রাহী কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো।
আকসাদ ঠোঁটের কোণে হাসি রেখেই বললো,
– ‘ওকে ওকে ইউ ক্যান গো নাউ!’
বলে সরে দাঁড়ালো। প্রাহী সেই ফাঁকে আলতো পায়ে চলে গেলো। আকসাদ সেদিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিচে চললো।
– ‘ক্লাসে কবে থেকে জয়েন করবি!’
ছাদের এক কোণে বসে আছে প্রাহী আর শিমলা। পায়েসের বাটিটা রেখে শিমলা বললো,
– ‘কাল থেকেই দেখি। আর মিস দেওয়া যাবেনা।’
প্রাহী মাথা নেড়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ পরীক্ষা চলে এসেছে সামনে।’
– ‘হু। বিয়ের ছবিগুলো আমার ফোনে আছে আর কিছু ক্যামেরায়। একবারে সব তোকে দিব নে!’
প্রাহী ছাদের একপাশে যেয়ে বললো,
– ‘অসুবিধে নেই। যখন ইচ্ছা তখন দিস।’
তারপর হলুদ সন্ধ্যামালতীর চারা হতে একটা ফুল কানে গুজে আরেকটা ফুল হাতে নিয়ে শিমলাকে ইশারা করে বললো,
– ‘তুই সন্ধ্যামালতীর গাছ কবে লাগিয়েছিস!’
শিমলা হেঁটে হেঁটে বললো,
– ‘একমাস হবে লাগিয়েছি। গাছটা বিকালের দিকে ফুটলে দারুণ লাগে!’
প্রাহী হালকা হেসে বললো,
– ‘হ্যাঁ!
বলে নিচে তাকাতেই দেখলো আকসাদ ফোনে কথা বলতে বলতে উপরে মুখ তুলতেই ওর দিক তাকিয়ে আছে। প্রাহী আলতো করে সেখান থেকে সরে গেলো। ছাদে রাখা চেয়ারে বসে শিমলার সাথে কথা বলতে লাগলো।
সন্ধ্যার আগেই বিধায় চটজলদি মাথায় কাপড় দিয়ে বেড়িয়ে পড়লো প্রাহী। ঘর থেকে বেড়িয়ে হাঁটতেই কেউ ডেকে উঠলো,
– ‘মিস প্রাহী!’
প্রাহী মাথা ঘুরিতে এদিক ওদিক তাকালো। কই! কোথাও তো কেউ নেই! আবার পাশ ফিরতেই কেউ বললো,
– ‘এই যে এদিকে!’
মাথা উঁচু করে তাকাতেই দেখলো আকসাদ হাতে বাঁটি নিয়ে ওর দিক তাকিয়ে আছে।
– ‘চলে যাচ্ছেন!’
প্রাহী মাথা নাড়ালো।
– ‘একলা যেতে পারবেন! দাঁড়ান আমি পৌপৌঁছে দিচ্ছি!’
বলে নিচে নামতেই প্রাহী বললো,
– ‘না না আমি পারব।’
– ‘শিউর!’
– ‘জ্বী!’
আকসাদ হাতের বাটির দিক ইশারা করে বললো,
– ‘পাস্তা খাবেন মিস প্রাহী!’
প্রাহী কিছুটা বেকুব হয়ে উপরে আকসাদের দিক তাকিয়ে রইলো। এই লোক ওকে এভাবে ডেকে বলছে পাস্তা খাবে কি না! কি অদ্ভুত!
– ‘না! ধন্যবাদ। আসি তাহলে!’
বলেই বেড়িয়ে গেলো।
পেছন হতে আকসাদ রেলিং এ হাত দিয়ে প্রাহীর ঘোমটাবৃত পিছন সাইডের দিক তাকিয়ে রইলো। যতক্ষণ না প্রাহী চোখের অদৃশ্য হয় ততক্ষণ চেয়ে রইলো! কি মনে করে নিচে যেয়ে বাড়ির বাইরে গেলো ও। হালকা নিচু হয়ে কিছু একটা হাতে নিয়ে এক গাল হেসে বলে উঠলো,
– ‘এক ফুল আরেকফুল রেখেই চলে গেছে!’
চলবে,,,
#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ১১ (অপেক্ষা!)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী
– ‘আমাকে একটু দিয়ে আসতে পারবি!’
নক্ষত্র বাইক ধুতে ধুতে বললো,
– ‘আজকে বাইক টা ধুচ্ছি। কোথাও যাবি!’
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ টেইলারে তোকে নিয়ে যাওয়ার পর মায়ের শাড়িটা তোর হাতে দিয়ে ওখান দিয়ে আমি ভার্সিটি চলে যেতাম। আজ না হয় থাক। কালকে যাব না হয়।’
নক্ষত্র বাইক ধুতে ধুতে সামনে তাকাতেই প্রাহীর দিক কোণাচোখে তাকিয়ে বললো,
– ‘আমার আর যাওয়া লাগবে না৷ চামচিকে আসছে ওটাকে নিয়ে যা।’
প্রাহী নক্ষত্রের কথায় পাশ ফিরে দেখলো শিমলা ওদের দিকেই আসছে। প্রাহী হালকা হেসে বললো,
– ‘কি রে তুই! ভার্সিটি যাবি না!’
– ‘যাব তো। আজকে তোর সাথে যাব ভাবছিলাম। তাই আগে এদিকে আসলাম। যা যেয়ে রেডি হো! আমি দাঁড়াচ্ছি তোর জন্য!’
– ‘আচ্ছা আমি রেডিই আছি। শুধু ব্যাগটা নিব৷ দাঁড়া আমি আসছি।’
বলেই তড়িঘড়ি করে প্রাহী বাড়ির ভিতর ঢুকলো।
শিমলা পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো নক্ষত্র ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে বাইক ধোঁয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আবার।
– ‘শোক কমেছে!’
শিমলা ভ্র কুঁচকে নক্ষত্রের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘কিসের!’
– ‘এই যে বোন যাওয়ার দিন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদলি। সেই শোক!’
শিমলা হালকা শ্বাস ফেলে বললো,
– ‘এই শোক কি কোনোদিনো কমে! বোন যখন বিয়ে দিবেন তখন বুঝবেন। আর আমি মোটেও ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদিনি। তাই বাজে কথা রাখুন!’
নক্ষত্র বাইকের চাকায় পানি দিতে দিতে বললো,
– ‘বুঝলাম। বেশি খারাপ লাগলে যেয়ে দেখা করে আসবি। অসুবিধা কি!’
– ‘হু!’
বলে শিমলা নক্ষত্রের বাইক ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
– ‘সরে দাঁড়া পানি দিব এখন। জামা ভিজবে তোর।’
নক্ষত্রের কথায় শিমলা সামান্য দূরে যেয়ে দাঁড়ালো। বাইক ধোঁয়া শেষে হাতে কিছু পানি নিয়ে নক্ষত্র শিমলার দিক ছিটিয়ে বললো,
– ‘ডান!’
শিমলা চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
– ‘অ্যাই এটা কেন করলেন!’
নক্ষত্র তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বললো,
– ‘কি করলাম আবার!’
শিমলা হালকা চেঁচিয়ে বললো,
– ‘কি করলাম মানে! পানি ছিটা…’
– ‘কি হয়েছে!’
প্রাহী নক্ষত্র আর শিমলার দিক তাকিয়ে বলে উঠলো।
শিমলা নক্ষত্রের দিক রাগ সহিত তাকিয়ে বললো,
– ‘কিছুনা। তোর ভাই একটা খবিশ!’
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘তা তো জানা কথা!’
নক্ষত্র চেঁচিয়ে বললো,
– ‘কি বললি!’
শিমলা প্রাহীকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠলো,
– ‘চুপ করুন। নিজ কাজে মন দিন।’
নক্ষত্র সেদিক তাকিয়ে বাইকটাকে রোদের মাঝে দিয়ে ধুমধাম পা ফেলে ঘরের ভিতর চললো।
– ‘ছ্যাচড়ামির একটা লিমিট আছে!’
রাতুল বিরক্তি নিয়ে তুলির দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে ব্যাগটা ডেস্কে রাখলো।
তুলি ত্যাড়াভাবে বললো,
– ‘তোর সমস্যা কি! ভালো না লাগলে শুনিস না!’
বলে শিমলার দিকে ফিরে আবারও জিজ্ঞেস করলো,
-‘ বল না! তোর আকসাদ ভাই কয় ভাই বোন! কি করে! কোথায় থাকে! পড়াশোনা করছে এখনও!’
শিমলা হালকা হেসে বললো,
– ‘আস্তে আস্তে! একসাথে এতগুলো প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায়!’
রাতুল বিরক্তি নিয়ে বললো,
– ‘ওর এতো জেনে লাভ আছে!’
তুলি কিছু বলতে যাবে তার আগেই শিমলা বললো,
– ‘আচ্ছা ওকে থাম!’
শিমলার দিক ফিরে বললো,
– ‘আকসাদ ভাই কানাডা থাকে। ওখানে বড় কাকার বিজনেস আছে। আর আকসাদ ভাইয়ের পড়াশোনা আমি শুনেছি শেষের দিকে। জিজ্ঞেস করা হয়নি আমার সেভাবে আকসাদ ভাইকে! আর আকসাদ ভাইরা এক ভাই এক বোন। উনার বোনটাও উনার মতোই সুন্দর!’
তুলি হেসে বললো,
– ‘হবেনা! উনার মা তো মাশাল্লাহ যেই সুন্দরী। সেখানে উনারা তো সুন্দর হবেই!’
শিমলা হালকা হেসে মাথা নাড়ালো। প্রাহী একপাশে বসে ওদের কথা শুনছে। যেখানেই যাবে না কেন হয় আকসাদের কথা শুনবে নয়তো আকসাদের উপস্থিতি সেখানে থাকবে! ফোস করে একটা শ্বাস ছেড়ে ব্যাগ থেকে খাতা বের করে বেঞ্চে রাখলো।
তুলি শিমলাকে পাশ থেকে আঁকড়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
– ‘আচ্ছা শোন আকসাদ ভাই…’
রাতুল হালকা চেঁচিয়ে বললো,
– ‘তুলি! ওফ যা এখন!’
ওদের কথার মাঝে তন্নি হালকা হেসে পিছন ফিরে বললো,
– ‘হয়েছে আপাতত আলোচনা বন্ধ রাখো। স্যার ক্লাসে এসে পড়েছে!’
ক্লাস শেষে সবাই ক্যান্টিনে বসে সিঙ্গারা খাচ্ছে। তুলি প্রাহীর সাথে কথা বলতে বলতে তন্নির দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘কি ব্যাপার তন্নি! আজকে পড়াশোনা থেকে ছুটি নিয়েছো!
তন্নি সিঙ্গারা খাওয়া শেষে হাতটা ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
– ‘না। এখন যাব! খিদে পেয়েছিলো তাই একটু খেয়ে নিলাম!’
তুলি মাথা নাডিয়ে বললো,
– ‘আচ্ছা! এজন্যই তো বলি তুমি আজ ক্লাস শেষেই লাইব্রেরী গেলে না কেন!’
তন্নি মুচকি হেসে বললো,
– ‘এইযে এখন যাচ্ছি! থাকো তোমরা!’
বলেই উঠে গেলো। শোয়াইব আড়চোখে একবার তন্নির যাওয়ার দিক তাকিয়ে মোবাইলে মনোযোগ দিলো।
প্রাহী একলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেলপুরি খাচ্ছে। এতক্ষণ শিমলা ওরা ছিলো। কিন্তু ওরা কোনো রকম খেয়েই তুলির বাসায় গেছে। তুলি আর শিমলা আজ বাজারের দিকটা যাবে বই কেনার জন্য। প্রাহী অবশ্য যেতে চেয়েছিলো কিন্তু টেইলার্সে যেতে হবে ওর। এই ভেবে পরে আর যায়নি। প্রাহী বড হা করে ভেলপুরি মুখ দিতে যাবে তার আগেই কেউ পিছন হতে বলে উঠলো,
– ‘আস্তে হা করে খান মিস প্রাহী!’
আচমকা কারোর কথায় প্রাহীর হাত হতে বেলপুরি টা পড়ে গেলো। আলতো করে পিছন ফিরে দেখলো আকসাদ দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে বাকা হাসি! এই লোক এখানে! আকসাদ ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
– ‘কি খাচ্ছেন!’
প্রাহী চোখ পিটপিট করে বলে উঠলো,
– ‘ভে…ভেলপুরি!’
আকসাদ চোখ ছোটো ছোটো করে বললো,
– ‘ভেলপুরি! এটা আবার কি!’
প্রাহী জিভ দিয়ে হালকা ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আকসাদ প্রাহীর প্লেট থেকে একটা ভেলপুরি নিতে নিতে বললো,
– ‘ওকেই! আমি টেস্ট করে দেখি।’
বলেজ আকসাদ একটা ভেলপুরি মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ চিবুতেই বড় বড় চোখে প্রাহীর দিক তাকিয়ে রইলো। কোনোরকম পুরোটা ভেলপুরি গিলে আকসাদ বলে উঠলো,
– ‘পানি হবে!’
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে দ্রুত ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করতেই আকসাদ দ্রুত সেটা নিয়ে বোতলের মুখ খুলে মুখ লাগিয়ে ঢক ঢক করে পানি খেতে লাগলো। পুরোটা পানি শেষ করে প্রাহীর দিক তাকিয়ে বলে উঠলো,
– ‘আপনারা এগুলো কিভাবে খান! এত্ত ঝাল!’
বলেই আকসাদ হু হা করতে লাগলো। প্রাহীর বেশ মায়া লাগলো যেন। ও একটা দোকানে যেয়ে আরও এক বোতল ঠান্ডা পানি কিনে আকসাদের কাছে এসে বললো,
– ‘নিন!’
আকসাদ মাথা নেড়ে ঠান্ডা পানির বোতলটা নিয়ে পানি পান করতে লাগলো। সবশেষে প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘থ্যাংকস্!’
প্রাহী মাথা নেড়ে বললো,
– ‘হু! এখন ঠিক লাগছে!’
আকসাদ কোনোরকম করে বললো,
– ‘হ্যাঁ কিছুটা! আপনি এতো ঝাল খান!’
প্রাহী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ আর তাছাড়া ফুচকা,ভেলপুরি এগুলো ঝাল ঝাল খেতেই মজা। আপনি প্রথম খেয়েছেন হয়তো এজন্যই!’
আকসাদ মাথা নেড়ে বললো,
– ‘হতে পারে। যাই হোক চলুন!’
প্রাহী অবাক হয়ে বললো,
– ‘জ্বী!’
– ‘আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি! বাড়ির দিকেই যাবেন তো! ক্লাস শেষ না!’
প্রাহী মাথা নেড়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ কিন্তু আমি যেতে পারব। আপনার আমাকে পৌঁছে দিতে হবেনা!’
আকসাদ গাড়ির দিক যেতে যেতে বললো,
– ‘আমিও আপনার বাড়ির সামনে দিয়েই যাব। আসুন নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছি!’
প্রাহী ধীর পায়ে হেঁটে আকসাদের গাড়ির দিক এগিয়ে বললো,
– ‘শুনুন! আমি যেতে…।’
আকসাদ ড্রাইভিং সিটে বসে বললো,
– ‘উঠে আসুন প্রাহী!’
প্রাহী কিছু না বলে গাড়িতে উঠলো। আকসাদ গাড়ি চালাতে চালাতে এক পলক প্রাহীর দিক তাকালো। গোলগাল মুখ,কপালে কিছু চুল পড়ে আছে। ঠোঁটের দিক নজর যেতেই আকসাদ থমকে গেলো। ঠোঁটের আশপাশ লাল লাল হয়ে আছে! ঝাল জাতীয় জিনিস খাওয়ার জন্যই এমনটা হয়েছে! আকসাদ প্রাহীর দিক হতে নজর সরিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং এ শক্ত করে চেঁপে ধরে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিয়ে গাড়ি চালানো তে মন দিলো।
অনেকক্ষণ ধরে আকসাদ কিছু বলছে না দেখে প্রাহী একটু নড়েচড়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
– ‘আপনি এখন ঠিক আছেন!’
আকসাদ ছোট্ট করে ‘হুম’ বলে উঠলো।
প্রাহী আস্তে করে বলে উঠলো,
– ‘শিমলা তো ছিলোনা ক্লাস হওয়ার পর। তাহলে আপনি ওখানে গেলেন যে!’
আকসাদ আলতো করে ঘাড় ঘুড়িয়ে প্রাহীর দিক তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘আপনার জন্য!’
প্রাহী আকসাদের দিক তাকাতেই ওর বুকটা যেন কেঁপে উঠলো। চোখগুলো কেমন যেন লাল হয়ে আছে আকসাদের! কিছুক্ষণ আগেও তো এমনটা ছিলো তাহলে এখন এমনটা দেখাচ্ছে কেন!
– ‘আপনি ঠিক আছেন!’
আকসাদ কন্ঠে গম্ভীরতার রেশ টেনেই বললো,
– ‘ঠিক আছি!’
প্রাহী কিছুক্ষণ আকসাদের দিক তাকিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিক তাকালো। দুপুরের সময় এখন। মানুষজন রাস্তায় বেশি নেই। বিকেলের পর রাস্তায় আবার লোক জড়ো হবে! রোদের তাপ এখন কিছুটা কম। তাও গরম লাগছে বেশ। দুপুরের বাতাসটা কেমন যেন! গায়ে লাগলেই মনে হয় আগুনের হালকা তাপ গায়ে লাগছে।
প্রাহী এক পলক আকসাদের দিক তাকালো। আকসাদের চোয়াল শক্ত। চোখমুখ এখন ঠান্ডা! অথচ কিছুক্ষণ আগেও এই লোকের চোখমুখ কেমন কঠিন হয়ে ছিলো!
– ‘এখানেই নামিয়ে দিন!’
আকসাদ হুট করে গাড়ি থামিয়ে প্রাহীর দিক তাকালো।
– ‘এখানে কেন!’
প্রাহী কাচুমাচু কন্ঠে বললো,
– ‘সামনেই আমার বাসা। আমি হেঁটে যেতে পারবো।’
আকসাদ ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ওর দিক তাকিয়ে ব্যপার টা বুঝতে পেরে মাথা নেড়ে গাড়ি থেকে নামলো। ততক্ষণে প্রাহীও গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো৷
– ‘সাবধানে যাবেন!’
প্রাহী মাথা নেড়ে বললো,
– ‘আপনিও! আর ধন্যবাদ!’
আকসাদ আলতো হেসে বললো,
– ‘নো নিড প্রাহী! অনেক গরম বাহিরে তাড়াতাড়ি বাসায় যেয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিবেন কেমন!’
প্রাহী মুচকি হেসে সামনে হেঁটে চললো।
প্রাহী কিছুদূর যেতেই আকসাদ গাড়ির দরজার সাথে হেলান দিয়ে দূর থেকে প্রাহীর ছোট্ট অবয়ব টার দিক তাকিয়ে বলে উঠলো,
– ‘ইট’স টু পেইন টু কন্ট্রোল! কবে যে অপেক্ষার অবসান হবে!
বলেই চোখ বন্ধ করে জোড়ে একটা শ্বাস নিয়ে গাড়ির সাথে কিছুক্ষণ হেলান দিয়ে দাঁডিয়ে গাড়িতে উঠে সামনে যেতে থাকলো। প্রাহীদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতেই দেখলো মেয়েটা সবে মাত্র গেইট দিয়ে ঢুকছে! সেদিকে তাকাতেই আকসাদ আনমনে হেসে উঠলো! হুট করে আকসাদের ফোনে কল আসলে ও ফোনটা হাতে নিয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে ফোনের দিক তাকিয়ে থাকলো। এ এখন ফোন দিচ্ছে কেন!
চলবে,,,