মন একে একে দুই পর্ব-২২+২৩

0
6

#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ২২(দ্বন্দ অনুভূতি!)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী

– ‘নেই! চলে গেছে।’

আকসাদ কিছুটা অবাক হলো! শিমলার যাওয়ার দিক তাকিয়ে ভাবছে চলে গেছে! প্রাহী না দেখা করেই চলে গেলো! স্ট্রেঞ্জ! আকসাদ ঘরে আসতেই দেখলো ওর ঘরে একটা অপরিচিত মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে! আকসাদ কিছুটা ভ্রু কুঁচকে আওয়াজ দিয়ে বললো,

– ‘এক্সকিউজ মি!’

মেয়েটা আকসাদের দিক ফিরে মিষ্টি হাসলো। আকসাদ মেয়েটাকে চিনেনা! আগে তো কখনও এ বাসায় দেখেনি! ও কিছুটা এগিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘আপনি! আপনাকে তো চিনলাম না!’

আকসাদের প্রশ্নে মেয়েটি ভদ্রতার হাসি দিয়ে বললো,
– ‘হাই! আমি শিমলার মামাতো বোন মিতু!’

আকসাদ মনে মনে আওড়ালো, মেয়েটা বোধহয় মেহমানদের মধ্যেই একজন!

– ‘বুঝলাম! কিন্তু আপনি এখানে!’

– ‘আসলে শিমলার ঘরটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না খুঁজতে খুঁজতে এ ঘরে চলে এসেছি!। ‘

আকসাদ ‘ওহ্’ শব্দ করে বললো,
– ‘আপনি এই বাসায় প্রথম এসেছেন!’

মেয়েটা দাঁত দেখিয়ে হেসে বললো,
– ‘নাতো! এইতো রুমি আপুর বিয়ের সময় এসেছিলাম লাস্ট!’

আকসাদ হালকা ভ্রু কুঁচকে বললো,
– ‘বিয়ের সময় লাস্ট এসেছেন! তার মধ্যেই নিজের কাজিনের ঘর ভুলে গেলেন!’

মেয়েটা দাঁত কেলিয়েই মাথা নাড়ালো। আকসাদ শান্তভাবে বললো,
– ‘এ ঘর থেকে বের হয়ে সোজা বরাবর হেঁটে ডান দিকের প্রথম ঘরটাই শিমলার!’

মেয়েটা মিষ্টি হেসে বললো,
– ‘থ্যাংকস!’

আকসাদ দরজা হতে সরে দাঁড়ালো। মেয়েটা এখনও যাচ্ছেনা! কি অবস্থা!

– ‘একচু*য়েলি…’

– ‘নাম মিতু রাইট! লিসেন মিতু আমি একটু টায়ার্ড! আর শিমলার ঘরটা কোনদিকে এখন তো জেনেই গেলেন! সো!’

আকসাদ দরজায় ইশারা করে কথাটা বলে উঠলো। মিতুর মুখের হাসিহাসি ভাবটা একদম মিলিয়ে গেলো! ও বেশ বুঝতে পারলো আকসাদ ওকে চলে যাওয়ার জন্যই বলছে! কোনোরকম জোডপূর্বক হাসি দিয়ে ও বের হয়ে গেলো। আকসাদ সাথে সাথে দরজা লাগিয়ে বিছানায় যেয়ে বসলো। গায়ে পড়া স্বভাবের মানুষজন ওর একদম পছন্দ না। আর সেখানে এই মেয়ে ওর রুমে বেশ অনেকক্ষণ ধরেই যে দাঁড়িয়ে ছিলো এটা ও বুঝেছে! রুমের বেশভুষা দেখে যে কেউ বলবে এটা একটা ছেলের ঘর! আশেপাশে আকসাদের কাপড়, ওয়ালেট সব গুছিয়ে রাখা! শিমলার ঘর যে এটা না তা বুঝেও একটা ছেলের ঘরে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার মানে কি! ‘ডিজগাস্টিং’ বলে আকসাদ বিছানার হেলান দিয়ে শুয়ে পা নাড়াতে থাকলো। টেবিলে রাখা কলমদানির দিক তাকিয়ে ভাবছে, ‘ এই প্রাহীর হয়েছে কি!’

ওষুধ এর দোকান থেকে বাড়ি যাচ্ছে প্রাহী। সকালে হালকা বৃষ্টি হয়েছিলো বোধহয়! নয়তো রাস্তাঘাট কেমন যেন হালকা হালকা ভিজে ভিজে অবস্থায় রয়েছে। ধীর পায়ে মাথা নিচু করে প্রাহী হেঁটে যাচ্ছে। মাথায় লম্বা করে ঘোমটা টানা ওড়না দিয়ে। হাঁটার মাঝেই সামনে বেশ জোড়েসড়ে কেউ ব্রেক কষায় ও হালকা পিছিয়ে গেলো। গাড়িটা এমনভাবে থেমেছে যে যেতে হলে একদম ঘুড়ে যেতে হবে! তার আগেই আকসাদ গাড়ি থেকে নেমে ওর সামনে দাঁড়ালো। প্রাহী আকসাদ এর দিক তেমনভাবে তাকালো না। হালকা পাশ কাঁটাতে গেলেই আকসাদ ব্যস্ত কন্ঠে ওকে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘কি হয়েছে প্রাহী! তিনদিন ধরে আপনার কোনো খোঁজ খবর নেই! ভার্সিটিও যাচ্ছেন না। বাড়ির বাইরেও আপনাকে পাচ্ছিনা! কি হয়েছে কোনো সমস্যা!’

– ‘কিছু হয়নি!’

প্রাহীর উত্তরে আকসাদের ভ্রু কুঁচকে এলো। মেয়েটার কন্ঠ এমন থমথমে শুনাচ্ছে কেন! প্রাহীর দিক ভালোভাবে তাকাতেই আকসাদের বুকটা কেমন যেন করে উঠলো। চেহারাও কেমন যেন মলিন হয়ে আছে! আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘প্রাহী কোনো সমস্যা আমাকে বলুন! আপনি কি ঠিক আছেন!’

প্রাহী আগের ন্যায়ই উত্তর দিলো,
– ‘ঠিক আছি!’

আকসাদ প্রাহীর হাতের দিক তাকাতেই দেখলো হাতে ওষুধের প্যাকেট! সাথে সাথে প্রাহীর দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘এই ওষুধগুলো কার! আপনার!’

প্রাহী মাথা নেড়ে বললো,
– ‘না বাবার।’

– ‘কি হয়েছে আংকেলের!’

– ‘তেমন কিছুনা জ্বর ঠান্ডা!’

আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে রইলো। প্রাহী পাশ কাটিয়ে যাবে তার আগেই আকসাদ ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
– ‘এভাবে যাচ্ছেন যে! কি হয়েছে আপনার?’

প্রাহী শান্ত কন্ঠেই উত্তর দিলো,
– ‘কিছু হয়নি।’

আকসাদ প্রাহীর দিক চেয়ে শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করলো,
– ‘আসলেই কিছু হয়নি!’

প্রাহী আকসাদের দিক চেয়ে ঠান্ডাভাবেই উত্তর দিলো,
– ‘বললাম তো কিছু হয়নি! সরুন! আমি বাসায় যাব!’

আকসাদের এবার রাগ হচ্ছে। মেয়েটা যথেষ্ট হেয়ালি করছে! প্রাহী যেতে নিলেই আকসাদ ওর সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। প্রাহী সেদিক চেয়ে বললো,
– ‘আকসাদ! পথ ছাড়ুন!’

নিজের নাম এভাবে থমথমে ভাষায় শুনে আকসাদের এবার
খটকা লাগলো। প্রাহী আবার যেতেই আকসাদ ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো৷

– ‘সমস্যা কি হয়েছে না বলে যেতে পারবেন না।’

– ‘কোনো সমস্যা নেই! সরুন।’

– ‘বললাম তো! আপনি না বলা পর্যন্ত এখান থেকে যেতে পারবেন না!’

প্রাহীর এবার আর ধৈর্য কুলালো না। চিল্লিয়ে উঠে আকসাদকে বললো,
– ‘আপনার কথামতো সবকিছু করতে আমি বাধ্য নই আকসাদ! বাধ্য নই! তাহলে কেন বারবার এভাবে জিজ্ঞেস করছেন! কেন আপনি…।’

প্রাহী চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। কথা বলতে যেয়ে বারবার থেমে আসছে! আকসাদ এতক্ষণ প্রাহীকে দেখছিলো। আলতো করে ওর কাছে যেয়ে প্রাহীর মাথায় হাত দিয়ে ধীরে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘একটা প্রশ্নই তো জিজ্ঞেস করছি! এভাবে রেগে যাচ্ছেন কেন!’

উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে প্রাহীর চোখজোড়া হতে জল গড়িয়ে পড়লো। আকসাদের দিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘আমিও শুরু থেকে আপনাকে একটা প্রশ্ন ভাষায় কিংবা ইশারায় জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিলাম। আপনি কোনো উত্তর দিয়েছেন কি! তাহলে আমি কেন আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে যাব!’

আকসাদ জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– ‘কোন প্রশ্ন!’

প্রাহী নির্লিপ্ত কন্ঠেই বললো,
– ‘আপনি আমায় কিভাবে চিনেন!’

আকসাদ প্রাহীর দিক একধাপ এগিয়ে বললো,
– ‘এখন এসব কথা কেন উঠছে প্রাহী!’

প্রাহী শক্ত কন্ঠে বললো,
– ‘কথাগুলো উঠার দরকার! মিথ্যে কথা তো আর নয় তাইনা! আপনি আমার কথার না উত্তর দিয়েছেন আর না কিছুর খোলসা করেছেন! এদিক দেখা হয়েছে কিন্তু আমাদের অনেক বারই!’

হালকা দম ফেলে প্রাহী আবারও বললো,
– ‘আমিও একটা সময় চুপ হয়ে ছিলাম! তাও দিনশেষে একটা অপ্রস্তুততা কাজ করতো! যতোই হোক আপনি আমার কাছে ছিলেন অপরিচিত! তাও দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে, কথাবার্তা হয়েছে! আমি একটা মেয়ে মানুষ! একটা ছেলের কথাবার্তা, বা সে কি চায় এতটুকু বোঝার ক্ষমতা আমার একটু হলেও আছে! তাও একটা কিন্তু থেকে যেত আপনার প্রতি! এরপর আমাকে সহজ করার জন্য আপনি যতটুকু পারা যায় সেভাবেই আমার সাথে মিশলেন, আমিও চুপ হয়ে গিয়েছিলাম! যে একদিন হয়তো আপনি সব বলবেন! কিন্তু…।’

প্রাহী ভিজে কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘আকসাদ আপনিই কিন্তু আমাকে এপ্রোচ করেছেন! শুরু থেকেই! দন্দের মাঝে থাকলেও আমারও একটা সময় আপনার প্রতি…।’

বলেই প্রাহীর চোখ হতে জল গড়িয়ে পড়লো। আকসাদ প্রাহীর ছোট্ট কান্নায় ফোলে যাওয় মুখটা নিজের হাতের ভাজে নিয়ে বললো,
– ‘প্রাহী আমি সবই মানছি! আমার ক্লিয়ার করাটা দরকার ছিলো! কিন্তু…’

প্রাহী নিজের গাল থেকে আকসাদের হাতটা আলতো করে সরিয়ে বলল,
– ‘আকসাদ! আমি হয়তো এভাবে আর পারবোনা! আমি…।’

আকসাদ প্রাহীর মুখটা আবারও নিজের ভাজে নিয়ে বললো,
– ‘পারবেন না মানে! এই প্রাহী! কে কি বলেছে আপনাকে! আমাকে বলুন! না বললে আমি কিভাবে বুঝবো বলুন!’

প্রাহী আকসাদের হাতের উপর নিজের হাত রেখে আকসাদের দিক তাকালো। আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে নরম কন্ঠে ব্যাকুল হয়ে বললো,
– ‘প্লিজ প্রাহী!’

প্রাহী নিচের ঠোঁট কামড়ে আকসাদের হাতের থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে কাঁপা কন্ঠে বললো,
– আকসাদ আমি! আমি আর…।’

বলেই প্রাহী পুরোপুরিভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে এক ছূটে নিজের বাড়ির সামনে যেয়ে লোহার গেইট টা পেরিয়ে গেলো। পিছনে রেখে গেলো অসহায়ের ন্যায় চেয়ে থাকা এক মানবকে!

দরজায় কোনো রকম খিল দিয়ে প্রাহী সোফার এক কোণে বসে মুখে হাত দিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগলো! তিনদিন আগেও এই সময়টাতে ও বেশ খুশি ছিলো! আর আজে! সেদিনের কথা মনে পড়তেই প্রাহী চোখ জোড়ে বন্ধ জল ফেলতে লাগলো।

মায়ের কাছ থেকে শাপলা রান্না করার নির্দেশন নিয়ে প্রাহী বেশ মনোযোগ দিয়ে শাপলা রেঁধে দুপুরের দিক শিমলাদের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলো। শিমলাদের বাড়িতে যেয়েই দেখলো মোটামুটি মানুষ! হয়তো মেহমান এসেছে! ভিতরে শিমলার কাছে যেয়েই দেখলো ওর দুই মামী আর মামাতো ভাইবোন এসেছে। প্রাহী ভাবলো বেশিক্ষণ থাকবে না! আশেপাশে আকসাদ কে দেখলো না! হয়তো বাইরে! তরকারির বাটিটা টেবিলে রেখেই ও রান্নাঘরে শিমলার মার কাছে গেলো। ততক্ষণে ডাইনিং রুমে শিমলার মামীরা আর আকসাদ এর মা এসে বসেছে। এর মধ্যে শিমলার এক মামী আকসাদের মাকে বলে উঠলো,

– ‘তা ভাবী! ছেলের এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ভাবলেন! বিদেশী মেয়েই আনবেন নাকি বাঙালী মেয়েই ঘরে তুলবেন!’

আকসাদের মা হাসি বজার রেখেই বললো,
– ‘সেটা ছেলের ব্যপার! ওর যেটা পছন্দ তা আমাদেরও পছন্দ!’

বলে আকসাদের মা রুমে গেছে ওষুধ নেবার জন্য! প্রাহী রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। ততক্ষণে শিমলাও সেখানে এসেছে। শিমলার মামী শিমলার মাকে বলে উঠলো,

– ‘এই বিটু তোর দেবরের ছেলে আকসাদের কি কোনো পছন্দ আছে!’

শিমলার মা টেবিলে খাবার বাড়তে বাড়তে বললো,
– ‘কি জানি! এই যুগের ছেলেমেয়ে থাকতেই পারে!’

– ‘তা ঠিক! যেমন ছেলে তেমন মেয়েই হয়তো ধরেছে!’

তখনই শিমলার বড় মামী ঠেস মেরে বললো,
– ‘তেমন মেয়েই তো ধরবে! কোনো অজপাড়াগাঁয়ের মেয়ে আবার ধরবে নাকি! আর ধরলেও সেই মেয়ে ঘরে তো নিশ্চয়ই তুলবে না!’

প্রাহী তখন ড্রয়িং রুমের দিক যাচ্ছিলো বাসায় চলে যাবে বলে! কিন্তু শিমলার মামীর এরূপ কথায় ও আড়চোখে সেদিক তাকাতেই দেখলো উনি ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন! প্রাহী মনটা খুট করে উঠলো। উনি কি ওকেই ইংগিত করে কিছু বলেছে! প্রাহীর ভাবনার মাঝেই শিমলার মা ওকে ডেকে উঠলো,

– ‘কি ব্যাপার দরজার কাছে যাচ্ছিস যে! খেয়ে যাবি! আয়!’

প্রাহী মুচকি হেসে বললো,
– ‘কাকীমা আমি খেয়েই এসেছি! তোমরা খাও!’

– ‘তুমিই শিমলার বান্ধবী না! একই ভার্সিটিতেই পড়ো শুনলাম!’

শিমলার মামীর কথায় শিমলার মা বলে উঠলো,
– ‘হ্যাঁ! ছোটোবেলার বান্ধবী ওরা! এক সাথেই পড়ে।’

শিমলার মামী ভাত খেতে খেতে বললেন,
– ‘এখন কার ছেলেমেয়েদের বিবেক বলে কিছু নেই! এই ধর যে যেখানকার তার সেখানেই থাকা উচিত! কিন্তু না! আজকালকার ছেলেমেয়েরা দেখবি থাকে যদি নিম্ন তলে ধরবে আবার সেই খাপের খাপ। স্বর্ণের মই খুঁজে এরা! যাতে ধরে বেয়ে উপরে উঠতে পারে আর কি!’

শিমলার মা ভ্রু কুঁচকে বললো,
– ‘তুই এসব বলছিস যে! কোথা থেকে কোথায় কথা নিচ্ছিস! আর আমাদের ছেলে মেয়েরা এমন না! পড়াশোনা করছে। ভিতরে বিদ্যা নিয়ে এমন করবে না নিশ্চয়ই!’

শিমলার কাকী কটাক্ষ করে এবার প্রাহীর দিক তাকিয়েই বললো,
– ‘কি জানি! হয়তো ভালোই! বেশিরভাগ এখন উপরে যা ভিতরে ততই টিনটিনে ঘৃণ্য চিন্তাভাবনা! রাজপুত্তুর ছেলে পেলেই…।’

শিমলা চুপ! ও কিছু বলছে না। শিমলার মা তৎক্ষণাৎ ওর মামীকে থামিয়ে বললেন,
– ‘বেশি বলে ফেলছিস না! খাওয়ার সময় এত কথা তুলতে নেই!’

প্রাহী কোনোরকম গলায় কান্নার দলা গিলে বললো,
– ‘কাকীমা আসি!’

|

সেদিনের পর থেকেই প্রাহী আকসাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেনি। কেন করবে! শিমলার মামী কি মিন করে এই কথাগুলো বলেছে সেটা প্রাহী বেশ বুঝেছে! প্রাহীর মনে এই চিন্তাভাবনা কখনই ছিলো না! নির্ঝনঝাট পরিবারে বড় হয়েছে। যেভাবে বাবা মা গড়েছে সেভাবেই বেড়ে উঠেছে ও! কাউকে কখনও তিরস্কার করে কিছু বলেনি বা নিজেরাও শুনেনি। এমনকি নক্ষত্রও এত চঞ্চল হলেও ওর মধ্যেও এইসব কটুক্তিমূলক ব্যবহার নেই। তাই সেদিন শিমলার মামীর ওমন কথা শুনে প্রাহীর মনটা বেশ ভালোভাবেই আহত হয়েছে! সারাটা রাস্তা চোখের জল নিয়েই বাড়ি ফিরেছে! আকসাদ যেদিন বলেছে ‘আমি আপনাকে চিনি!’ সেদিন থেকেই একটা কৌতুহল কাজ করতো এই লোকটার উপর ওর। যে লোককে ও কখনও দেখেনি সে ওকে কিভাবে চিনে! তারপর থেকেই আকসাদের একটু একটু করে ওকে খোঁচানো, গভীর নজরের চাহনী সব কিছু মিলিয়ে ওর এই মানুষটাকে জানবার ইচ্ছা আরও বেড়ে গিয়েছিলো! আর এসবের মাঝে প্রাহীরও আকসাদের উপর একটা টান কাজ করতো! কিছু না হতেই কত কথা ওকে শুনতে হলো!

ভাবতে ভাবতে প্রাহীর চোখ দিয়ে আরও জল গড়িয়ে পড়লো! তিনদিন ঘর থেকে বের হয়নি ও। বের হতেই ইচ্ছে করছিলো না! প্রায় সময় যখন রুমের জানালা দিয়ে দেখতো আকসাদ ওদের বাড়ির সামনেই হাঁটছে ওদের বাড়ির দিক তাকাচ্ছে! প্রাহী সাথে সাথে জানালা লাগিয়ে দিত! আর কোনো টান বা অনুভূতিতে ও আর এগোতে চায়না! যেখানে ওর বিবেক নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় সেখানে এগিয়ে লাভ আছে! এর মধ্যে ওর বাবার জ্বর আবার বাড়ির সামনে হতে আকসাদের রোজ ওই শুকনো মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া যব মিলিয়ে প্রাহী চোখভেজা নিয়েই এইকদিন পার করেছে! কি এক দ্বন্দ অনুভূতি! কলিং বেলের আওয়াজে প্রাহী চোখমুখ মুছে নিজেকে ঠিক করে দরজা খুলতেই দেখলো,,,

চলবে,,,

#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ২৩(সব কি শেষ!)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী

প্রাহী চোখভেজা নিয়েই এইকদিন পার করেছে! কি এক দ্বন্দ অনুভূতি! কলিং বেলের আওয়াজে প্রাহী চোখমুখ মুছে নিজেকে ঠিক করে দরজা খুলতেই দেখলো ওর মা আর বাবা দাঁড়িয়ে। বাবার চেহারা টা কেমন যেন শুকনো হয়ে আছে! জ্বরে ভুগছে আজ তিনদিন! দূর্বল হয়ে গেছে বেশ!

– ‘ডাক্তার কি বললো!”

প্রাহীর মা আর বাবা ঘরে ঢুকে সোফায় বসলো। প্রাহীর প্রশ্নে ওর মা বললো,

– ‘টেস্ট দিয়েছে ডেঙ্গুর। করিয়ে আনলাম। রিপোর্ট দিলে আবার যেতে বলেছে।’

প্রাহী চিন্তিত মুখে একবার বাবার দিক তাকিয়ে উনার পাশে যেয়ে বসলো।

– ‘বাবা খারাপ লাগছে! কিছু খাবে!’

প্রাহীর বাবা মেয়ের দিক তাকিয়ে দূর্বল হাসি হেসে বললেন,
– ‘না আম্মা ঠিক আছি! এখন কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।’

– ‘এখন আর কিছু খাবেনা। একবারে দুপুরের ভাত খেয়ে নিবে।আপাতত একগ্লাস স্যালাইন বানিয়ে তোর বাবাকে দে। শরীর দূর্বল তার। আর শোন ভাত টা একটু বসিয়ে দে। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে রান্না বসাচ্ছি।’

প্রাহী মার কথায় মাথা নাড়িয়ে স্যালাইন বানাতে চললো। বাবার সাথে সাথে মাকে সহ একগ্লাস বানিয়ে দিলো। রান্নাঘরে যেয়ে ভালোমতো চাল ধুঁয়ে ভাতটা বসিয়ে দিলো। মাকে জানিয়ে ও ঘরে এলো। বেশ ক্লান্ত লাগছে ওর। ওর নিজেরও একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার!

আজ প্রায় পাঁচদিন পর প্রাহী ভার্সিটি এসেছে। আসার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু পরীক্ষা আর দু’দিন পর থেকেই সেখানে আসাটা জরূরী ছিলো। চুপচাপ ক্লাস শেষে প্রাহী একটু রিসিপশনিস্ট এর কাছে গেলো। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কিছু কাজ সেরে সিড়ি দিয়ে লাইব্রেরীর সামনে দিয়ে যেতেই দেখলো তন্নি আর শোয়াইব একসাথে বসে আছে। দুজনের সামনে বইপত্র। শোয়াইব কিছু একটা বলছে আর তন্নি খাতায় লিখছে আর মুচকি হাসছে। ওদের দু’জনকে দেখে প্রাহী হালকা হাসলো। পরক্ষণেই হাসি মিলিয়ে ও সামনে তাকিয়ে রইলো! কয়দিন আগেও তো আকসাদ আর ও ঠিক এভাবেই হেসে সময় পার করেছিল! আর আজ! ভাবতেই একটা চাপা শোকের শ্বাস ছাড়লো ও। ওদের থেকে চোখ সরিয়ে প্রাহী সিড়ি বেয়ে নামতে লাগলো। ওর চোখের কোণ কেমন যেন ভিজে ভিজে উঠছে। সিড়ির এক প্রান্তে এসে ও দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নিলো। হাত দিয়ে মুখটা একবার চেঁপে স্বাভাবিক করে বাড়ির দিক রওনা দিতে নিলো। ভার্সিটির গেইটের কাছে আসতেই পিছন হয়ে তুলি ওকে ডাক দিলো। প্রাহী হালকা ঘাড় ঘুড়িয়ে তুলিকে দেখে থামলো।

– কতবার ডাক দিয়েছি! শুনলি না যে!’

প্রাহী অনুতাপের সুরে বললো,
– ‘সরি রে। বাসায় যেতে হবে বিধায় তাড়াতাড়ি ওভাবে ছুটছিলাম! কিছু বলবি!’

তুলি প্রাহীর হাতে হাত রেখে বললো,
– ‘ব্যাপার না! আচ্ছা তুই কি অসুস্থ!’

প্রাহী ভ্রু কুঁচকে বললো,
– ‘না তো কেন!’

– ‘চোখমুখ এমন শুকনো যে তোর! কয়দিন ধরে ভার্সিটি আসছিস না! কিছু হয়েছে!’

– ‘তেমন কিছুনা! বাবার শরীরটা ভালোনা এজন্য আর কি!’

– ‘আংকেল এখন কেমন আছে!’

– ‘মোটামুটি ভালো! দোয়া করিস!’

– ‘তা তো অবশ্যই! আচ্ছা শোন শিমলার কোনো খবর জানিস!’

প্রাহী কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
– ‘না! ওর আবার কি হয়েছে!’

– ‘ও তোর মতোই ভার্সিটি আসেনা এই কয়দিন। ওকে তো ফোনেও পাইনা।’

প্রাহী ভ্রু কুঁচকে তুলির দিক তাকিয়ে রয়েছে। ভাবছে শিমলাকে আজকে ও দেখেনি ক্লাসের সময়। অন্যান্য সময় ক্লাস না করলেও ক্যান্টিনে থাকে এই মেয়ে কিন্তু সেখানেও ওকে দেখেনি! মেয়েটা কি আসলেই অসুস্থ! ওদিনের পর থেকে শিমলার সাথে ওর আর কথা হয়নি! টুকটাক তুলির সাথে কথা বলে প্রাহী বাসায় চলে এলো। আসতে আসতে সেই দুপুর হয়েছে। রান্নাঘরে মাকে না পেয়ে ঘরে যেয়ে দেখলো বাবা মা দুজনেই ঘুম! হালকা শ্বাস ফেলে প্রাহী ব্যাগটা সোফাতেই রেখে হালকা ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে যেয়ে ভাত বসালো। ভাবলো আজকের রান্নাটা করেই ও ঘরে যাবে। মা আজ সকাল সকাল বাবাকে নিয়ে একটু আবার হাসপাতাল গিয়েছিলো।
একটু আগেই হয়তো বাসায় এসেছে! সকাল থেকে ছোটাছুটিতে দু’জনেই ক্লান্ত! উনারা বরংচ একটু ঘুমাক। এই ফাঁকে প্রাহী যা পারে রেঁধে নিবে। বাঁধাকপি কুচিকুচি করে কেঁটে তা দিয়ে ভাজি করে নিলো প্রাহী। ফ্রিজে কাজলী মাছ ছিলো তা দিয়ে টমেটোর ঝোল করলো পাতলা করে। বাবার এই তরকারিটা বেশ পছন্দ! শরীরটা যেহেতু ভালোনা এই সময়ে এই ধরনের খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। শেষমেশ ডাল পাতলা করে রাঁধতেই দেখলো ওর মা রান্নাঘরে এসেছে।

– ‘তুই কি সব রেঁধে ফেলেছিস! আমার এমন ঘুম পাচ্ছিলো বাইরে থেকে এসে!’

– ‘অসুবিধে নেই! সব রান্না শেষ। ডালে শুধু বাগার টা দেয়া বাকি!’

– ‘ডালে আমি বাগার টা দিয়ে দিচ্ছি তুই যা! ঘেমে গেছিস তো পুরো! যা গোসল করে আয়! তাড়াতাড়ি আসবি! একসাথে খেয়ে নিব সবাই!’

প্রাহী মাথা নেড়ে ওড়না দিয়ে কপাল মুছতে মুছতে ড্রয়িং রুম হয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ঘরে চললো।

রাতে প্রাহী টেবিলে বসে পড়ছে। পড়ছে বললে ভুল হবে শুধু বইয়ে তাকিয়ে আছে। ঘুম আসছিলো না বিধায় ও পড়তে বসেছে। চোখ বুঝলেই কেবল আকসাদের ওই হাসিহাসি মুখটা ওর সামনে ভেসে উঠছে! এপাশ ওপাশ করেও যেহেতু ঘুম আসছে না তখন উঠে পড়তে বসেছে প্রাহী৷ তাতেও লাভ হচ্ছেনা! খাতা বের করে একাউন্টটিং এর ক’টা ম্যাথ করার চেষ্টা করলো প্রাহী। দু’লাইন লিখতেই ও চাপা স্বরে কেঁদে উঠলো! ও আর পারছেনা এসব সহ্য করে নিতে! এ কেমন অনুভূতির জালে ও জড়িয়ে পড়লো! এরকম কখনও ওর সাথে হয়নি! কখনও না! এমন চলতে থাকলে ও তো পাগল হয়ে যাবে! চোখের জল মুছে টেবিল ছেড়ে উঠে কাবার্ড টা খুলতেই আকসাদের শার্টটা ওর নজরে এলো। আলতো হাতে শার্টটা হাতে নিতেই প্রাহী শার্টটা নিজের সাথে চেপে ধরে এবার হু হু করে কেঁদে উঠলো।

– ‘আকসাদ আমি পারছিনা আপনাকে ভুলতে! এ কেমন অনুভূতিতে ফেঁসে যাচ্ছি যা কিনা একদম যন্ত্রণার ন্যায়! এর থেকে পরিত্রাণ কিভাবে পাব আকসাদ! বলুন তো!’

বলেই প্রাহী কেঁদে উঠছে। শার্টটা হাতে নিয়ে প্রাহী বারান্দায় যেয়ে বসলো। আকাশের দিক তাকালে নাকি যন্ত্রণা বা কষ্ট ভুলে থাকা যায়! কিন্তু কই রাতের অন্ধকারের আকাশের দিক তাকিয়ে তো ওর চোখের জলগুলো যেন আরও ভারী হচ্ছে!

প্রাহী এখন শিমলাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সকাল সকাল বেড়িয়েছে। হাতে একটা ব্যাগ। আকসাদের শার্ট সেটাতে। আকসাদের শার্টটা ফেরত দিবে এ বাহানা নিয়ে ও এসেছে। শুধু একটাবার মানুষটাকে দেখবে বলে। অনেক চেষ্টা করেছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখার কিন্তু পারেনি! মন মানসিকতার উপর তো আর কারো জোর নেই তাইনা! অশান্ত মন নিয়ে কতক্ষণ টিকা যায়! শার্টটা দিয়েই একবার দেখে চলে যাবে। এতে করে যদি ওর মনটা একটু হলেও শান্ত হয়! আস্তে ধীরে গেইট দিয়ে ঢুকে প্রাহী শিমলাদের ঘরের দরজার সামনে এলো। কেউ কি নেই নাকি! ঘর এত নীরব যে! ধীর পায়ে প্রাহী শিমলার রুমের একটু আগে থামলো।

– ‘তুই এখানে!’

প্রাহী চমকে পিছন ফিরে দেখলো শিমলা দাঁড়িয়ে আছে। হালকা শ্বাস ফেলে ও শিমলার দিক তাকালো। শিমলার চোখমুখ কেমন যেন শীর্ণ হয়ে আছে! কি হয়েছে ওর! শিমলার সাথে অনেকদিন পর আজ ওর দেখা। মাঝে ফোনে কথাও হয়নি। প্রাহীও এইকয়দিন ফোন থেকে দূরেই ছিল। প্রাহীর কেন জানি না শিমলাকে দেখে কেমন যেন লাগছে! গলাটা ভিজিয়ে নরম কন্ঠে প্রাহী বললো,

– ‘আ…আমি আসলে।’

– ‘যার জন্য এসেছিস৷ সে নেই।’

শিমলার কথায় প্রাহী বুকটা ধ্বক করে উঠলো। নেই মানে!

– ‘মা…মানে!’

শিমলা প্রাণহীন কন্ঠে বললো,
– ‘আকসাদ ভাই আর উনার পুরো পরিবার একসপ্তাহ আগেই কানাডায় চলে গেছে!’

প্রাহী থমকে গেলো। জলে ভেজা কম্পিত চোখে তাকিয়ে রইলো।
তবে কি এখানেই সবকিছুর সমাপ্তি ঘটলো! এভাবেই বুঝি সবটা শেষ হওয়ার ছিলো!

চলবে,,,