#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ৪৮(ঝুঁকি!)
#লেখনীতে:-#ফেরদৌসী_নবনী
– ‘সকাল সকাল সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছেন?’
আকসাদ পরণের ডার্ক ব্রাউন শার্টের হাতের বোতাম লাগাতে লাগাতে পিছু ফিরলো। প্রাহী ঘুমঘুম চোখে তার দিকে তাকিয়ে। বোতাম লাগানো শেষে আকসাদ পা চালালো তা ঘুমে ঢুলঢুলে হয়ে থাকা বউয়ের দিকে। নিচু প্রাহীর ফোলা গালে চু*মু বসালো। প্রাহী উঠে বসলো। আকসাদ প্রাহীর কপালের চুলগুলো গুছিয়ে কানে গুজে দিয়ে বললো,
– ‘অফিসে যাব। তুমি এখন উঠো। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট সেড়ে নাও আমরা একসাথে বের হবো।’
প্রাহী আকসাদের কথায় দেয়াল ঘড়ির দিক তাকালো। মাত্র বাজে ৭:৩০ টা। আকসাদ এতো তাড়াতাড়ি আজ বাইরে যাবে যে! জিজ্ঞাসুক চোখে আকসাদের দিক তাকিয়ে ও বললো,
– ‘আজ এতো আগে আগে বের হচ্ছেন যে! জরুরী কাজ আছে নাকি?’
আকসাদ মাথা দুলালো,
– ‘হু। আজ আমার ল্যাবের মেডিসিনগুলো বাইরে ইমপোর্ট হবে। সেখানে প্রেজেন্ট থাকাটা দরকার।’
প্রাহী মাথা নাড়লো। ঘুম জড়ানো কন্ঠে ধীরে শুধালো,
– ‘এবার আশা করি আপনাদের মেডিসিনগুলো নির্ভুলভাবে সুরক্ষিত অবস্থায় বাইরে ইম্পোর্ট হয়ে কাঙ্খিত মানুষদের কাছে পৌঁছাবে।’
আকসাদ শ্বাস ফেলে বললো,
– ‘তাই যেনো হয় প্রাহী। এবার উঠো তোমার তো আজ ভার্সিটি আছে রাইট!’
প্রাহী মাথা নেড়ে বললো,
– ‘আছে। কিন্তু আপনার আজকে যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন, আপনি না হয় আমার জন্য অপেক্ষা না করে নাস্তা করে বেরিয়ে পডুন! আমি আস্তেধীরে ভার্সিটি যাব না হয় পরে আয়সুনের সাথে।’
– ‘ আমিই তোমাদের দিয়ে ভার্সিটি দিয়ে আসব। তারপর সেখান থেকে অফিস যাব। যাও যেয়ে ফ্রেশ হও।’
বলেই আকসাদ প্রাহীর হাত ধরে ওকে বিছানা থেকে নামালো। প্রাহী অগত্যা চোখ ডলতে ডলতে ওয়াশরুমে গেলো। আকসাদ সেদিক তাকিয়ে হালকা হাসলো। আয়নায় সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে চুলটা ঠিক করে নিজের স্টাডি রুমের দিকে রওনা হলো। আকসাদের স্টাডি রুমটা দোতলার একদম শেষের ঘরটার সাথেই। নিরিবিলি ঘরটার পুরোটা জায়গা জুড়ে শুধু বইয়ের শেলফ আর একটা আলমারি। আকসাদ আলমারির লকার এ পিন দিয়ে সেটা আনলোক করে তার ভিতর থেকে মেটালের একটা ভারী বস্তু বের করে কিছুক্ষণ সেটার দিক তাকিয়ে নিজের পকেটে ঢুকালো। বের হওয়ার আগে স্টাডি রুমটা ভালোভাবে লক করলো। রুমে যাবার পথে ফুপির রুমটা পড়তেই আকসাদ একবার সেই রুমে ঢুকলো। মাঝারি আকারের সিম্পল বেডে প্রাণহীন অবস্থার ন্যায় শুয়ে আছে ওর ফুপি। আকসাদ ধীরে ধীরে ফুপির দিক এগিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত গুজে ফুপির ফ্যাকাশে মুখটার দিক তাকিয়ে রইলো।ফুপির হেলথ চেকআপ করে নিজের ঘড়ির দিক তাকালো। তারপর ও ওর ফুপিকে নিয়ম অনুযায়ী মেডিসিনগুলো দিয়ে রুম থেকে বের হবার আগে ফুপির দিক তাকিয়ে আকসাদ বিড়বিড়িয়ে বললো,
– ‘দোয়া কর সন্দেহ যাতে সত্যি না হয় ফুপি।’
রুমে প্রাহীকে না পেয়ে আকসাদ নিজের ব্যাগ আর জিনিস নিয়ে একবারে ব্রেকফাস্ট টেবিলে চলে আসলো। প্রাহী সেখানেই সবার সাথে বসে আছে। আকসাদ বসতেই ওর মা ওকে টোস্ট,জুস আর ওমলেট দিলো। প্রাহী আর আয়সুন জুস খেতে খেতে একে অন্যের সাথে গল্প করছে। আকসাদের বাবা খাবারের এক পর্যায়ে বলে উঠলেন,
– ‘শুনলাম আজ তোর মেডিসিন শিপমেন্ট এর দিন! তা সব ঠিকঠাক?’
আকসাদ গ্লাসটা হাতে নিয়ে বললো,
– ‘আপাতত সব ঠিক।’
আকসাদের মা আকসাদের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
– ‘চিন্তা করিস না। যা হবার ভালোর জন্যই হবে।’
আকসাদের বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– ‘ভালো হলেই ভালো!’
আকসাদ টেবিল ছেড়ে উঠে প্রাহীকে ডেকে উঠলো,
– ‘প্রাহী উঠো! আর মা! আসছি! বাবা আল্লাহ হাফেজ!’
আকসাদের বাবা-মা মাথা নাড়তেই আকসাদ প্রাহীকে নিয়ে বেডিয়ে গেলো। আয়সুন এর মাথা ব্যথা বিধায় ও আজকে আর ভার্সিটি যাচ্ছেনা। আকসাদ প্রাহীকে নিয়ে কিছু মিনিটের মধ্যেই ওর ভার্সিটির সামনে আসতেই আকসাদ নেমে দরজা খুলে দিতেই প্রাহী নামলো। আকসাদ প্রাহীর গালে হাত ডুবিয়ে গভীর কন্ঠে বললো,
– ‘ভালোভাবে ক্লাস করবে । আর হ্যাঁ মন সবসময় শক্ত রাখবে,কেমন?’
প্রাহী আকসাদের কথার প্রেক্ষিতে মনে হালকা নাড়া দিলেও ও হাসিমুখে আকসাদের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘ ইনশাআল্লাহ এবার আপনারা এবার সাকসেস হবেনই।
আকসাদ চোখ বুঝে ‘হ্যাঁ’ বুঝাতেই প্রাহী হেসে সামনে চললো। আকসাদ ওর দিক কিছুক্ষণ চেয়ে গাড়ির ডোরে হাত দিতেই প্রাহী হালকা ডাক দিয়ে উঠলো,
– ‘শুনুন?’
আকসাদ পিছু ফিরতেই প্রাহী মুচকি হেসে বললো,
– ‘তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবেন কিন্তু! আজ একসাথে রাতের বেলা বাসার সামনের পার্কে ঘুরতে হবো।’
আকসাদ হেসে বললো,
– ‘ওকে ম্যাডাম, আমি রেডি হয়ে থেকেন আমি এসে আপনায় নিয়ে যাব।’
প্রাহী হেসে আবারও ব্যাগ কাঁধে ভার্সিটির দিক এগোলো৷ ভীডের মাঝে প্রাহী মিশে যেতেই আকসাদ গাড়ি স্টার্ট দিলো।
,
,
,
– ‘তোরা এভাবে ফুসুরফাসুর করে বিয়ে করে নিলি? প্ল্যান করে করেছিস নাকি! যাতে দুই বান্ধবী সবসময় কাছাকাছি থাকতে পারিস! কি রে বল না?’
শিমলা বিরক্তিমাখা কন্ঠে তুলিকে বললো,
– ‘উনার মতো লোককে কে প্ল্যান করে বিয়ে করবে শুনি? বারবার যে বলছি, অনাকাঙ্ক্ষিত বশত বিয়েটা হয়ে গেছে। কথা কানে যাচ্ছেনা। তাও সেই কখন থেকে ঘ্যানঘ্যান করে চলেছিস। সর তো।’
বলেই শিমলা সামনে হাঁটা দিলো। তুলিও এবার দৌড়ে শিমলার কাঁধ ধরে বললো,
– ‘আরে চেঁতছিস কেন? নক্ষত্র ভাই তো বর হিসেবে দারুণ! তবে তোর বিয়েটায় এঞ্জয় করা হলোনা এজন্য একটু খারাপ লাগছে। এই শোন না, একে একে তোদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে৷ আমার বিয়েটা কবে হবে বলতো?’
পাশ থেকে রাতুল ফট করে বললো,
– ‘তোর বিয়ে হবেনা! আয়বুড়ি হয়ে বসে থাকবি, অসুবিধা আছে?’
তুলি কটমট করে রাতুলের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘তুই কি জ্যোতিষী নাকি যে জানিস যে আমার বিয়ে হবেনা?’
– ‘হ্যাঁ, বলতে পারিস?’
শিমলা ওদের তর্ক দেখতে দেখতে সামনে তাকিয়ে দেখলো তন্নি আসছে৷ পিছে শোয়াইব উল্টো পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটার চোখমুখ শুকনো৷ শিমলা তন্নিকে হালকা করে ডাক দিলো,
– ‘এই তন্নি।’
কারো ডাকে তন্নি পাশ ফিরে দেখলো শিমলা ওর দিকে তাকিয়ে। তন্নি হালকা হেসে ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
– ‘আরে শিমলা কেমন আছো? শুনলাম তোমার বিয়ে হয়ে গেছে!’
শিমলা হালকা হেসে বললো,
– ‘হ্যাঁ হয়েছে আর কি! আমি ভালো আছি, তোমার কি অবস্থা বলো তো?’
তন্নি মুচকি হেসে বললো,
– ‘আছি ভালোই।’
শিমলা এবার হালকা শ্বাস ফেলে তন্নিকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘তোমার আর শোয়াইবের মাঝে কিছু হয়েছে?’
তন্নি কিছুটা চমকালো৷ তাও জোড়পূর্বক হেসে বললো,
– ‘না! কি আর হবে। হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করছো!’
শিমলা শান্ত গলায় বললো,
– ‘কারণ কয়দিন ধরে দেখছি তুমি আর শোয়াইব কেমন জানি খাপছাড়া ব্যবহার করছো! বিশেষ করে শোয়াইব।’
তন্নি নিশ্চুপ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। শিমলা এগিয়ে এসে তন্নির হাত ধরে বললো,
– ‘তন্নি আমরা সবাইই কিন্তু জানি যে তুমি আর শোয়াইব একে অপরকে পছন্দ করো। একসাথে সবসময় ক্লাসে বসো, লাইব্রেরিতে গেলেও তোমাদের একে অপরের সাথে দেখা যায়। হয়তো তোমাদের সম্পর্কটা এখন পছন্দ করা অবধিই থেমে নেই! কিন্তু বিগত কিছুদিন যাবত দেখছি তোমরা এক আরেকজনের থেকে বেশ দূরে দূরে থাকছো৷ শোয়াইব কে তো তোমার আশেপাশেই দেখা যায়না! কি হয়েছে? আমাকে বলো! হুট করে কি এমন হলো যে তোমরা এভাবে আলাদা হয়ে যাচ্ছ?’
তন্নি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– ‘আমার বাসায় বিয়ের কথা চলছে। সেই কথা তোমার বন্ধুকে বলতেই ও আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। ওর সাথে কথা বলতে গেলেই ও আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যায়৷ কোথায় ও এখন আমাকে একটু মেন্টালি সাপোর্ট দিবে তা না ও আরও আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।’
রাতুল এবার পাশ থেকে তন্নিকে হালকা গলায় বললো,
– ‘আসলে তন্নি শোয়াইব না পারতেই এমনটা করছে। ওর কথা হচ্ছে তোমাদের অবস্থা আর শোয়াইব এর অবস্থা তো আর এক না। তোমার বাবা একসময় এই শহরের চেয়ারম্যানও ছিলো। আর সেখানে শোয়াইবের বাবা খুলনার কলেজের সাধারণ একজন শিক্ষক৷ তোমার বাসায় বিয়ের কথা হচ্ছে এখন শোয়াইব চাইলেও পারবে না ওর বাবা-মাকে দিয়ে তোমাদের বাসায় প্রস্তাব পাঠাতে। কারণ ওর একটা ছোটো বোন আছে। ওর তো সেখানে দায়িত্ব আছেই। আবার তুমি ছোটোবেলা থেকে একটু আভিজাত্য পরিবেশে বড় হয়েছ ভবিষ্যৎ এ শোয়াইবদের সাধারণ পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারবে কি না এটাও শোয়াইবকে বেশ ভাবাচ্ছে। আর শোয়াইব বা আমাদের এখনও অনার্সটাই শেষ হয়নি। ও কিভাবে তোমাকে এখন এপ্রোচ করবে বুঝতে পারছিলোনা। তাই ও ভেবেছে আস্তেধীরে তোমার সাথে কথাবার্তা কমিয়ে তোমার থেকে দূরে সরে যাবে। এটা নিয়েও শোয়াইব নিজেও বেশ ডিপ্রেসড!’
তন্নি রাতুলের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো! এতকিছু শোয়াইব ভেবে ফেলেছে! তন্নি হতভম্ব হয়ে বললো,
– ‘তোমার ফ্রেন্ড এতকিছু নিজে নিজে ভেবে ফেলেছে। সবযদি ও নিজে নিজেই ভেবে ফেলে তাহলে তো আমাকে আর দরকারই নেই ওর! তাইনা? কারণ আমি জানি সম্পর্করত দু’টো মানুষ মিলে সবসময় যা ভাবার বা সিদ্ধান্ত নেয়৷ আর সেখানে তোমার বন্ধু এতকিছু চিন্তা করে ফেলেছে আমাকে নিয়ে?’
শিমলা এবার রাগী গলায় বললো,
– ‘ঠিকই তো! ওকে আগ বাড়িয়ে এতো পন্ডিতি করতে কে বলেছে! আশ্চর্য তো?’
তন্নি এবার তাচ্ছিল্যের হেসে শিমলার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘ শোয়াইব যতোই সাধারণ পরিবারের ছেলে হোক না কেন সব কথার বড় কথা ও একটা শিক্ষিত পরিবারের ছেলে আমার এর থেকে বেশি কিছু চাইনা! কি বলো তো শিমলা তোমার বন্ধু এখনও ম্যাচিউরই হয়নি। আমি ওর সাথে ওর পরিবারের সাথে মানিয়ে চলতে পারব কি পারব না সেটা আমায় ও একটা বার জিজ্ঞেস করতে পারতো না! ওর কিছু দায়িত্ববোধ আছে মানলাম, সেটা নিয়ে আমার সাথে ও আলোচনা করতে পারতো! আমি কি বলেছি ওকে যে এখনই আমায় বিয়ে করতে হবে! যেখানে আমার নিজেরও মাস্টার্স কম্পলিট না করা অবধি বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই! আর আমি শুধু বলেছি আমার বিয়ের কথা চলছে, আমার বিয়ে তো আর হয়ে যায়নি! তার আগেই ও আকাশ কুসুম ভেবে আমার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার প্ল্যান করছে!’
শিমলা এবার তন্নির কাঁধে হাত রেখে বললো,
– ‘চিন্তা করোনা! ওকে আমরা সবাই মিলে ধরবো! দেখবে ব্যাপারটা সমাধান হয়ে যাবে খুব শীঘ্রই! ওর একা চিন্তা ভাবনা ঘুঁচিয়ে দেবো।
তুলি মাথা নেড়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ সেটাই। কাল ওকে নিয়ে বসে কথা বলবো ওর সাথে।’
তন্নি হতাশামাখা একশ্বাস ফেলে বললো,
– ‘ওর মনে এত অহেতুক ভাবনা চিন্তা কিভাবে আসে আল্লাহই ভালো জানে।’
,
,
,
রাত বাজে প্রায় দশটা৷ আকসাদ এখনও বাসায় ফেরেনি। প্রাহী রেডি হয়ে আয়নার সামনে বসে বারবার ঘড়ি দেখছে। কখনও তো এতো দেরী হয়না! প্রাহীর মনটা কেমন যেন করছে। তাও ও নিজেকে সামলে একবার আয়লিনা হোসেনের ঘরে গেলো। যেয়ে দেখলো উনি আর আকসাদের বাবা কথা বলছেন। প্রাহী দরজায় নক করতেই আয়লিনা হোসেন প্রাহীর দিক তাকিয়ে হেসে বললেন,
– ‘আরে প্রাহী দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে এসো।’
প্রাহী মুচকি হেসে ভিতরে ঢুকলো,
– ‘মা আপনারা রাতে খাবেন না!’
আয়লিনা হোসেন দেয়াল ঘড়ির দিক তাকিয়ে বললেন,
– ‘হ্যাঁ খাব তো। আকসাদকে নিয়ে তুমি নিচে এসো। আমরা যাচ্ছি।’
প্রাহী এবার ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
– ‘মা উনি তো এখনও আসেননি!’
আয়লিনা হোসেন অবাক কন্ঠে বললেন,
– ‘কি! আকসাদ এখনও ফেরেনি! ও তো আটটার মধ্যেই বাড়ি চলে আসে সবসময়?’
প্রাহী এবার জড়ানো গলায় বললো,
– ‘আমিও বলেছিলাম আজ তাড়াতাড়ি আসতে। কিন্ত উনি এখনও আসছে না দেখে ভাবলাম হয়তো কাজ বেশি এজন্য…।’
আকসাদের না মাথা নেড়ে বললেন,
– ‘না না আকসাদের এতো দেরী কখনও হয়নি!’
ওদের কথা বলার মাঝেই প্রাহীর ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ‘ভিঞ্চি’ নাম দেখাতেই ও দ্রুত কলটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় ভিঞ্চি শুধালো,
– ‘প্রাহী ভাবী! আকসাদ কি বাসায়!’
প্রাহীর মনটা এবার কু গাইছে। কোনোরকম বললো,
– ‘ভাইয়া উনি এখনও ফেরেনি।’
ওপাশ থেকে ভিঞ্চিও প্রাহীর কথা শুনে থমকে গেলো। আজ পুরো গার্ড দিয়ে আকসাদের শিপমেন্ট গুলোকে এয়ারপোর্টে থেকে একদম দেশের বাইরে অবধি পৌঁছে দেয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণের সিকিউরিটির ব্যবস্থা ভিঞ্চি আর ফ্রানকো করলেও আকসাদ মানা করে দিয়েছে। বলেছে এবার ওর প্ল্যানমতোই আগাতে। এদিকে ফাইনাল প্রোডাক্ট সাবমিট এবং বাইরে সেই শিপমেন্ট পাঠানোর পারমিশন ও ওরা পেয়ে গিয়েছিলো। আকসাদ আর ওর পুরো টিম একসাথেই ছিলো। কথা ছিলো পারমিশন পেয়ে যাবার পর ওরা আর অন্তত ভিঞ্চিকে নিয়ে এগোবে। কিন্তু শিপমেন্টগুলো নিয়ে ওর পুরো টিম আসলেও আকসাদ ওদের সাথে আসেনি! আকসাদের কথামতো ভিঞ্চি শিপমেন্টগুলো উইদ আউট সিকিউরিটি ছাড়াই পাঠিয়েছে এয়ারপোর্ট বরাবর।
এদিকে পুরো একটা দিন আকসাদের কোনো খবর নেই! মাঝে ভিঞ্চিরা জানতে পেরেছে ৬ টা শিপমেন্টের কারগুলোর মধ্যে ৪ টা কারই নাকি মিসিং! বাকি দুটো কার এয়ারপোর্ট অবধি পৌঁছেছে। আর এদিকে ৪ টা শিপমেন্ট এর কার আর আকসাদের কোনো হদিসই ওরা পাচ্ছেনা। এদিকে ভিঞ্চি তারপরও প্রাহীকে একবার ফোন দিয়েছে জানার জন্য আকসাদ কি বাসায় গিয়েছে কি না কোনোভাবে! কিন্তু ওপাশ থেকে প্রাহীর না বোধক উত্তর শুনতেই ভিঞ্চির এবার গলা শুকিয়ে এলো। কোনো মতে কি আকসাদ! ভাবতেই ভিঞ্চি নিজের চুল টেনে ধরলো। আকসাদ যদি এভাবে লাইফ রিস্ক নিয়ে থাকে তাহলে খুব খারাপ হবে। খুব খারাপ।
– ‘আকসাদ কি আপনাদের সাথে নেই ভাইয়া!’
ভিঞ্চি শুকনো গলায় বললো,
– ‘না, তবে…।’
আকসাদের মা এবার ফোন লাউডস্পিকারে থাকায় জিজ্ঞেস করে উঠলো,
– ‘ভিঞ্চি ওদিকের খবর কি?’
ভিঞ্চি এবার আর না লুকিয়ে বললো,
– ‘শিপমেন্ট কিছু কিছু মিসিং এদিকে আকসাদ কেও ফোনে পাচ্ছিনা।’
আকসাদের মা এবার নিজের স্বামীর দিক তাকালেন। উনারা দুজনেই এখন আতঙ্কিত হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। আকসাদের মা এবার চিন্তামিশ্রিত গলায় বললেন,
– ‘ছেলেটার কোনো বিপদে পড়লো না তো!
প্রাহীর মুখটা রক্তশুন্য হয়ে গেছে। মন থেকে বারবার একটা কথাই ও নিজেকে নিজে বলে যাচ্ছে, ‘আকসাদ ঠিক আছে তো!’
চলবে,,,
#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ৪৯(নিখোঁজ)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী
রাত বাজে প্রায় দুটো। হিমশীতল বাতাসের মধ্যে প্রাহী এক কাপড়েই বারান্দায় বসে। গায়ে কোনো রকম একটা সুতির ওড়না জড়ানো। বদ্ধ ঘরের দেয়াল ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে প্রাহীর চোখ বেয়ে নোনাজল বিনা বাঁধায় গড়িয়ে পড়ছে। চারঘন্টা যাবত ভিঞ্চি, সাথে অফিসারদের ফোর্স আকসাদের অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় আকসাদকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু না আকসাদের কোনো হদিস কোথাও নেই! কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত প্রাহী সামনের স্বচ্ছ বিলের বিশাল পার্কের দিক তাকিয়ে ক্রন্দনরত গলায় বলে উঠলো,
– ‘আকসাদ, আজ…আজ কথা ছিল আপনি খুব জলদি বাড়ি ফিরবেন! কথা ছিল আমি আর আপনি দূরের ওই বেঞ্চিতে বসে একে উপরের হাত ধরে স্বচ্ছ বিলের ওই জলের মাঝে রাতের আকাশের তারার প্রতিবিম্ব গুনবো! এইযে দেখুন আকসাদ আমি রেডি হয়ে বসে আছি! আপনি এখনও আসছেন না! আপনি…এখনও।’
বলেই প্রাহী রেলিং ধরে নিচে বসে পড়লো। ওর এখন আর শরীরে মন কিছুতেই জোড়ে কুলাচ্ছেনা। কাঁদার শক্তিও এখন ওর আর নেই। বুকের ভিতরটা ক্রমাগত চেঁপে চেঁপে আসছে। আকসাদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা কথাটা মাথায় আসতেই মনে হচ্ছে ওর হৃদয়টা যেন কেউ মুচড়ে ধরেছে! এই মুহুর্তে একান্তে ওর স্বামীকে একনজর ওর দেখার খুব দরকার! আকসাদের ওই পেশল বুকটায় মাথায় রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার খুব দরকার৷ নইলে ও পারবেনা এভাবে আর থাকতে!
রাস্তার মোড়ে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ আসতেই ক্লান্ত প্রাহী দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। পুলিশের জিপগাড়ি দেখতেই প্রাহী একদৌড়ে বারান্দা ত্যাগ করে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো। ড্রয়িং রুমের দরজা বরাবর ভিঞ্চিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই প্রাহী দৌড়ে ওর দিক এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিয়ে বারবার দরজা বরাবর তাকাচ্ছে। ভিঞ্চির দিকে তাকিয়ে উতলা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘আকসাদ কোথায়! উনাকে দেখছি না যে! গাড়িতে আছে বুঝি!’
ভিঞ্চি অসহায়ের ন্যায় প্রাহীর দিক তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে দেখে ওর খুব খারাপ লাগছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে মেয়েটা নিজের অবস্থা কেঁদেকেটে প্রায় বেগতিক করে ফেলেছে। আকসাদের মা এবার প্রাহীকে একহাতে জড়িয়ে জড়ানো কন্ঠে শুধালো,
– ‘ভিঞ্চি প্রাহী কিছু জিজ্ঞেস করেছে তোকে! উত্তর দে! আকসাদ কোথায়? আসেনি তোর সাথে?’
ভিঞ্চি মাথার ক্যাপ খুলে কোনোমতে বলে উঠলো,
– ‘আকসাদকে আমরা এখনও খুঁজে পাচ্ছিনা আন্টি।’
ভিঞ্চির কথা কানে আসতেই প্রাহী কান্নায় ভেঙে পড়লো। নিজের শরীরের ভাড় ছেড়ে নিচে পড়ে যেতে নিলেই আকসাদের মা সহ আয়সুন ওকে দ্রুত নিয়ে সোফায় বসালো। আকসাদের মা ভিঞ্চির দিক তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলে উঠলো,
– ‘খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা মানে কি! আকসাদ ম্যাচিউর একটা ছেলে। বাচ্চা না যে লুকিয়ে বসে থাকবে! এত জায়গায় গিয়েছিস কোথাও ওকে পাসনি?’
ভিঞ্চি মাথা নেড়ে বললো,
– ‘আন্টি অর্ধের শহর ওকে খোঁজা হয়ে গেছে! তোমার ছেলে নিজ দায়িত্বে ওর লাইফ রিস্কে রেখে লুকিয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা এখন কি করবো কিছু বুঝতে পারছিনা।’
আয়লিনা হোসেন এতক্ষণ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেও এবার উনি আর পারছেন না। চোখের পানি ছেড়ে উনি সোফায় প্রাহীর পাশে বসে পড়লেন। মুখে হাত চেপে চাঁপা গলায় বললেন,
– ‘আকসাদ! ও এটা কি করলো! এভ…এভাবে নিজের লাইফ বাজি রেখে ও এভাবে গেলো! তাও একা?’
ভিঞ্চি নিজেও হতাশ। আকসাদের মনে যে এই পরিকল্পনা চলছিলো তা ও একটুও টের পায়নি! পেলে হয়তো কখনই ও ওকে এভাবে যেতে দিতো না! আকসাদের বাবা এবার গলায় জোড় এনে কোনো রকম ভিঞ্চিকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘ওর ফোন কি এখনও আনরিচেবল?’
ভিঞ্চি মাথা নেড়ে বললো,
– ‘হ্যা, অনেক ট্রাই করে যাচ্ছি কোনোভাবেই ওর ফোনে ফোন ঢুকছে না।’
আকসাদের বাবা চেয়ারে বসে মাথা চেপে ধরলেন। টেনশনে উনার মাথা আর বুক খুব ব্যথা করছে। একমাত্র ছেলের এই রকম অবস্থা দেখে উনার মাথা কাজ করছেনা। ভিঞ্চি ভাবলো এভাবে বসে থাকা চলবে না। ও এসেছে আকসাদকে যে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি এই খবরটা আন্টি, আংকেল উনাদের দিতে! ভিঞ্চি এবার পা বাড়িয়ে সামনে এগোতে যাবে তার আগেই হাতে টান খেয়ে পিছন ফিরলো। প্রাহী ভিঞ্চির একহাত দু’হাতের মুঠোয় আকড়ে ধরে আকুল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে! ভিঞ্চি প্রাহীর দিক পুরোপুরি ফিরতেই প্রাহী ছোটো হাতের ভাঁজে ভিঞ্চির শক্তহাত খানা ধরে হেঁচকি তুলে বললো,
– ‘ভাইয়া…দ…দয়া করে আকসাদকে খুঁজুন! উনাকে কেউ লুকিয় উনাকে খুঁজে আনুন না! উনি কি আসলেই লুকিয়ে আছে! উনি কি বুঝতে পারছেনা! উনাকে ছাড়া আমরা কেউই ভালো নেই! উনি…উনি কেন এভাবে…।’
প্রাহীর কান্নারত লাল মুখখানা দেখে ভিঞ্চির বেশ মায়া লাগলো। নিজের হাতদ্বারা প্রাহীর মাথায় হাত বুলিয়ে দৃঢ় গলায় বললো,
– ‘আকসাদ আজ হোক বা কাল খুব শীঘ্রই তোমার কাছে ওর পরিবারের কাছে ফিরে আসবে! বিশ্বাস করো! ও ফিরে আসবেই? নিজের আপনগৃহে না ফিরে ও কোথায় যাবে বলো?’
প্রাহী মাথা তুলে দূর্বল গলায় বললো,
– ‘কিন্তু উনি যে আসছেন না!’
ভিঞ্চি হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো,
– ‘আরেকটু অপেক্ষা করো চলে আসবে?’
প্রাহী সাথে সাথে বললো,
– ‘সত্যি?’
ভিঞ্চি মাথা নেড়ে বললো,
– ‘হুম, কিন্তু তার আগে তোমায় একটা কথা রাখতে হবে!’
প্রাহী শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে বললো,
– ‘কি কথা!’
ভিঞ্চি প্রাহীর মাথায় হাত রেখে বললো,
– ‘একটু ধৈর্য রাখতে হবে! এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। নিজেকে শক্ত করো। মানুষের জীবনে খারাপ সময় আসবেই। কিন্তু সে সময়টায় নিজেদের শক্ত রেখে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়! এজন্য বলছি একটু ধৈর্য রাখো! শান্ত হও! ফিরে এসে আকসাদ তোমাকে এভাবে দেখলে ওর নিজেরও অনেক খারাপ লাগবে! সেক্ষত্রে নিজেকে যদি একটু সামলে ওর জন্য অপেক্ষা করো দেখবে ও নিজেও খুশি হবে। ভাববে ওর পরিবার ওর জন্য ভেঙে না পড়ে ওর জন্য দৃঢ় মনে অপেক্ষা করে গেছে! যেটা ভেবে ওর অনেক খুশি লাগবে! একটু শান্ত করো নিজেকে আমার এই কথাটুকু রাখতে পারবেনা?’
মাথা দুলিয়ে প্রাহী চোখের পানি মুছে দূর্বলকন্ঠে বললো,
– ‘বেশ!এইযে আমি শান্ত হচ্ছি! উনাকে খুঁজে নিয়ে আসবেন বলুন?’
ভিঞ্চি ভরা গলায় বললো,
– ‘হু আনবো প্রাহী। আনবো।’
আকসাদের মা প্রাহীর পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
– ‘ফিরলে ওকে নিয়ে ফিরিস!’
ভিঞ্চি অভয়মুলক ইশারা করে প্রাহীর দিক একপলক তাকিয়ে বেড়িয়ে গেলো। আকসাদের মা প্রাহীর কাঁধে হাত রাখতেই প্রাহী উনাকে পাশ হতে জড়িয়ে ভিঞ্চির যাওয়ার দিক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে নির্মল কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘আমায় এভাবে একলা ফেলে আপনি নিঁখোজ হয়ে যাবেন না আকসাদ!
,
,
পিটপিট আঁখিজোড়া মেলে সবকিছু ঝাপসা অনুভব হতেই বারবার চোখ বন্ধ করে এবার পুরোপুরিভাবে চোখ মেলতেই ধীরে ধীরে সামনের দৃশ্য কিছুটা দেখতে সক্ষম হলো এবার আকসাদ। তাও আবছা আবছা লাগছে সবকিছু! গা নাড়া দিতেই ও খেয়াল হলো ওর হাত ও নাড়াতে পারছেনা! এমনকি পাজোড়াও যেন জমে আছে মনে হচ্ছে। নিজের দিক তাকাতেই ও খেয়াল হলো ওর হাত আর পা চেয়ারের সাথে বেশ শক্ত করে বেঁধে রাখা। ভ্রু কুঁচকে আকসাদ ভাবলো ও এখানে কিভাবে হলো! ও তো! এবার আস্তেধীরে ওর সব মনে পড়তে লাগলো। আকসাদ আগেভাগেই জানতো যতো সিকিউরিটি দিয়েই শিপমেন্ট পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক না কেন! একটা না একটা হামলা যে কারো অগোচরে হবেই সেটা ও টের পেয়েছিলো। এজন্যই শিপমেন্টের বাকি কিছু গাড়ি ওদের টিমের সাহায্যে পাঠিয়ে দিলেও নিজে বাকি গাড়িগুলো নিয়ে ও রওনা হয়েছিলো। শিপমেন্টের একটা গাড়ির ভিতরেই ও আগে থেকে ছিলো। যার দরুন কেউ বুঝতে পারেনি আকসাদ এর অবস্থান এর কথা৷ ওদের গাড়িগুলো কিছুক্ষণ ভালোভাবে চললেও অন্যপথে যখনই গাড়িগুলো মোড় নিয়েছিলো তখনই ও বুঝে গিয়েছিলো গাড়িগুলো এবার অন্য রাস্তায় যাচ্ছে! গাড়ির নিচে ট্র্যাক্টর সেট করার দরূন ও মোবাইলে লোকেশন দেখে সবটা বুঝে গিয়েছিলো। গাড়িগুলো এখন কাঙ্ক্ষিত রাস্তা ছেড়ে প্রায় একদম শহরের বাইরের পথ ধরে চলছে। কিছুদূর পর লোকেশিন আর কাজ না করায় ভেবেছে এদিকে নেটওয়ার্ক হয়তো নেই! যার কারণে ওরা কোথায় যাচ্ছে তা ও বুঝতে পারেনি! কিছুক্ষণ পর গাড়িগুলো একজায়গায় থেমে যাওয়ায় আকসাদ চুপ করে বসে ছিলো। যাতে কেউ দরজা খুলতেই যেনো ও সরাসরি হামলে পড়তে পারে অপর পাশের ব্যাক্তির উপর! কিন্তু অনেকক্ষণ যাবত কেউ দরজা না খুলায় বা সাড়াশব্দ না পাওয়ায় আকসাদ এবার ধীরে ধীরে গাড়ির দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো। আকসাদ প্রায় বিস্মিত হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। কারণ আপাতত ও এখন একটা টানেলের মধ্যে আছে! যার কারণে ও অবাক হলেও আপাতত কিছুদূর পা চালিয়ে টানেলের ভিতর হাঁটার পর দূর থেকে আলোর রশ্নি আসতেই আকসাদ সেদিকে এগিয়ে গেলো। টানেলের ভিতর সরঞ্জামসহিত এত রুম আর দু’একটা লোকের আনাগোনা দেখে সেদিক এগোতেই মাথার পিছন সাইড বরাবর অসহ্য ব্যাথা অনুভব হতেই আকসাদ মাথায় হাত দিয়ে দেখলো কেমন যেন ভেজা ভেজা অনুভব হচ্ছে! হাত সামনে আনতেই ও নিচে বসে পড়লো। সবকিছু কেমন যেন ওর কাছে ঝাপসা লাগছে! কিছুই দেখতে পারছেনা ও! এরপর আর কিছুই মনে নেই ওর!
হয়তো ওর মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছিলো! নাহলে ওর মাথা এখনও চিনচিন ব্যথা করছে! কপাল বেয়ে গরম একফোঁটা তরল গড়াতেই ওর বোধ হলো, ওর গাল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। চেয়ারে বাঁধা অবস্থাতেই একটু নড়তেই সামনের ছায়ামূর্তির দিক তাকিয়ে ও থামলো। ক্রমান্বয়ে ছায়ামুর্তির ওই মুখটা ওর দর্শনে আসতেই আকসাদ বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,
– ‘ফুপা।’
ঝাপসা আলোয় এবার বেশ স্পষ্টভাবেই শ্বেত চামড়ার মানুষটাকে এবার দেখা যাচ্ছে। মাঝারি বয়সের সেই শ্বেতাভ ব্যাক্তি প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মুখে শয়তানি হাসি ফুটিয়ে আকসাদের দিক তাকিয়ে আছে। একটু একটু করে আকসাদের দিক এগিয়ে ওর কপাল বেয়ে পড়া রক্তটা নিজের তর্জনী আঙুলের ডোগায় নিয়ে তার দিক তাকিয়ে বলে উঠলো,
– ‘চিনেছো তাহলে! ভা…তি…জা?’
আকসাদ বিনিময়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তাহলে ওর মিছেক সন্দেহই সত্যি হলো! ওদিন প্রাহীর সাথে বাইরে বের হওয়ার আগে প্রাহী রেডি হতে হতে ওকে বলছিলো, ‘আকসাদ কেন জানি মনে হয় আপনার কাছের কেউই ঘুরে ফিরে আপনাদের ক্ষতি বারংবার করে যাচ্ছে।’
সেদিন ও ফুপির ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ওর মনে হয়েছিলো যেদিন ওর ফুপির এক্সিডেন্ট হয় সেদিন ফুপার লাশ দেখা গেলেও চেহারা চেনার কোনো উপায় ছিলোনা! কি মনে করে সেদিন আকসাদ প্রাহীকে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় যেই হাসপাতালে ওর ফুপার লাশকে পোস্টমর্টেম এর জন্য নেয়া হয় সেখানকার ডাক্তার কেভিডের কাছে গিয়ে উনাকে জানাতেই উনি আকসাদকে মর্গে নিয়ে যায়। মর্গে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিলো একটাই ফুপার লাশ যদি থেকে থাকে তাহলে সেই লাশটাকে ভালোভাবে একবার দেখা। কারণ ওর ফুপা মারা যাওয়ার আগে ওর বাবার সাথে উনার কিছু একটা নিয়ে বেশ ঝামেলা চলছিলো! আর আকসাদের কাছের মানুষজন বলতে ওর বাবা-মা, ওর বোন, প্রাহী আর ভিঞ্চি এরাই। আর বাকি সবাই থাকে বাংলাদেশে! তাহলে আর কে ওদেরক্ষতি করার চেষ্টা করবে! মনের সান্তনার জন্য সেদিন ও হসপিটালে গিয়েছিলো। ভাগ্যক্রমে ফ্রিজিং করা অনেক লাশের মাঝে ওর ফুপার লাশটাও ছিলো। কিন্তু ওর ফুপা লম্বায় আকসাদের মতোই অনেক উঁচু কিন্তু মর্গে ওর ফুপার নামে চিহ্নিত করা সেই লাশের উচ্চতা ছিলো পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চি। মরে গেলে মানুষের হাইট তো আর কমে যায়না। তাইনা! এছাড়া ওর ফুপার কোনো ডেথ ডকুমেন্টস ও সেখানে ছিলোনা। আকসাদ সেদিন সন্দেহ মন নিয়ে বাড়ি ফিরে। কিছুতেই এই বিষয়টা ওর মাথা থেকে যাচ্ছিলো না। তারপর একদিন ও আর ভিঞ্চি মিলে ওর স্টুডেন্ট জেডের ল্যাপটপ এর ব্ল্যাকমেইলার দের মেইলগুলো বার বার চেক করছিলো। ঘুরেফিরে একটা জায়গাতেই ওর চোখ আটকে যাচ্ছিলো। জেডের কথামতে যেই লোকগুলো কোডের মাধ্যমে ওর সাথে যোগাযোগ করতো তার বেশিরভাগ কোডগুলোই ছিলো ch420, ch-110, ch-121 এরকম। প্রায় সব জায়গায় এভাবে ch লেখায় আকসাদের সন্দেহ আরও বাড়ছিলো। কিন্তু তাও শক্তপোক্ত কোনো প্রমাণ না থাকায় আকসাদ সেটা নিয়ে তেমন ঘাঁটায়নি। অথচ আজ ওর সেই ধারণাই পুরোপুরিভাবে সত্যি হয়ে গেলো!
– ‘তারমানে ফুপা এতোদিন আপনি…।’
সামনের ব্যাক্তি ওর দিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
– ‘হিশ্… কথায় কথায় ফুপা ডেকো না তো! ইটস্ ভেরি লেইম?’
আকসাদ শান্ত গলায় বলে উঠলো,
– ‘চ্যাডউইক হেরোন।’
সামনের মানুষ এবার জোড়ে হেসে বললো,
– ‘নাও ইটস্ পার্ফেক্ট! যাই হোক তোমার সন্দেহের তালিকায় আমি ছিলাম নাকি?’
আকসাদ স্বাভাবিকভাবেই বললো,
– ‘সন্দেহের তালিকায় থাকতেন না যদি না নিজের নামের প্রথম শব্দ দিয়ে এভাবে কোড বানিয়ে নিজেদের লোকেদের সাথে কন্ট্রাক্ট করতেন।’
চ্যাডউইক ভ্রু উঁচিয়ে মাথা নেড়ে বললো,
– ‘বাহ্! ব্রিলিয়ান্ট!’
আকসাদ এবার ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– ‘কারণ কি?’
চ্যাডইউক চোখ সরু করে বললো,
– “কিসের কারণ?’
– ‘এতোদিন আমার এবং আমাদের পরিবারের মানুষদের এভাবে অনিষ্ট বা ক্ষতি করার কারণ!’
আকসাদের কথায় চ্যাডউইক বাঁকা হেসে বললো,
– ‘কারণতো অনেক! কোনটা শুনবে?’
আকসাদের স্বাভাবিক গলার জবাব,
– ‘সব।’
চ্যাডউইক এক হাত প্যান্টের পকেটে রেখেই অন্য হাত দিয়ে আরেকটা চেয়ার নিয়ে আকসাদের সামনে বসলো,
– ‘কিছুক্ষণ পর তুমি মরবে। কাজেই মরার আগে মানুষদের কৌতুহল মেটানো উচিত। নইলে সেই মানুষ মরেও শান্তি পাবেনা! আর আমি চাইনা আমার ভাতিজা অশান্তিতে মরুক! কি বলো?’
আকসাদ শীতল দৃষ্টিতে চ্যাডউইকের দিক তাকিয়ে৷ চ্যাডউইক চওড়া হেসে চেয়ারে গা এলালো,
– আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে থেকেই ড্রাগ র্যাকেটিং এর বিজনেস। তবে সেটা সাধারণ মানুষদের সাথে নয়। আন্ডারওয়ার্ল্ড এর মাফিয়া,গ্যাংস্টার,ড্রাগ ডিলারস, প্যাডলার এদের সাথে। কিন্তু ভদ্র সমাজে থাকার তাগিদে আমি বিজনেস করতাম। তারমধ্যে কানাডার একটা ইউনিভার্সিটিতে মেডিসিনের উপর একটা কোর্স করার জন্য সেখানে ভর্তি হতে হয়েছিলো আমাকে। কারণ আমি চাচ্ছিলাম এবার মেডিসিন, ক্যামিকেল এসব নিয়ে বিজনেস করতে। সেই ইউনিভার্সিটিতেই তোমার ফুপির সাথে আমার দেখা হয়। আমরা একজন আরেকজনকে পছন্দ করি। তবে তোমার ফুপি আমাকে নিয়ে বেশ সিরিয়াস ছিলো। ওর জোড়াজুড়িতে এক প্রকার বাধ্য হয়েই ওকে বিয়ে করি। এর মধ্যে আমার ড্রাগ র্যাকেটিং ভালোই চলছিলো। কিন্তু বাইরের দেশে হুট করে ড্রাগ ইম্পোর্ট করা আমার জন্য দিন দিন টাফ হয়ে যাচ্ছিলো। কারণ হাইয়ার ফ্যামিলির ইয়াং এডোলেসেন্স দের মাঝেও ড্রাগ সাপ্লাই করতাম আমি। ততদিনে আমার নামডাক আন্ডারওয়ার্ল্ডে বেশ পরিচিত পাচ্ছিলো। কারণ যতো মাফিয়া, গ্যাংস্টার আছে তারা যেই ড্রাগের বিজনেস করতো তার হেড ছিলাম আমি। আমার ড্রাগ সাপ্লাই ছাড়া তাদের পক্ষে এভাবে কালো দুনিয়ায় বসে ড্রাগের বিজনেস করা বেশ একটা সহজ ব্যপার ছিলোনা। এর মধ্যে টিনেজারদের মধ্যে ড্রাগের নেশা আশেপাশে ছড়াতেই রেস্ট্রিকশন দিনদিন বাড়ছিলো। এতে করে আমার ড্রাগ সাপ্লাইও ওফ হয়ে যাচ্ছিলো। এর মধ্যে তোমার বাবার সাথে যখন আমার দেখা হয় তখন আমি জানতে পারি উনি একজন সাকসেসফুল বিজন্যাস মেন। উনারও যেহেতু মেডিসিনের ব্যবসা তাই আমি মনে মনে ভাবি এর সাথে বিজনেস করলে আমারই লাভ। যেহেতু বিভিন্ন দেশেই আফজালের মেডিসিন এক্সপার্ট ইমপোর্ট হচ্ছেই সেখানে ওর সাথে আমার শেয়ারে বিজনেস হলে আমার ড্রাগ সাপ্লাইটাও আবার আগেরমতো চলবে। আফজালকে বলতেই আফজাল রাজি হয়ে যায়। আগের মতো কাঁচা ড্রাগ এক্সপোর্ট করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠছিলো৷ তাই আমি মেডিসিনে ড্রাগ মিশিয়ে বাইরে পাঠাতাম৷ আর সেখান থেকে ড্রাগগুলোকে আলাদা করে যে যেভাবে পারতো কাজে লাগাতো। এর মধ্যে আফজাল এর কানে আসে মেডিসিনে নাকি ঝামেলা হচ্ছে। আফজাল আমাকে বলতেই আমি কোনোরকম ওকে বুঝ দেই যে দু একটা ক্যামিকেল হয়তো ভুলবশত বেশি পড়েছে এইজন্য এমন হচ্ছে। কিন্তু পরপর এমন হতেই আফজাল এবার একটু সন্দেহবাতিকভাবে খোঁজ লাগাতেই জানতে পারে ঔষধে ক্যামিকাল নয় ক্ষতিকর ড্রাগ যেমন পিসিপি, ম্যাথ, রুফিস এসবের প্রভাবের জন্যই এভাবে কমপ্লেইন আসছে। ও সাথে সাথেই কি মনে করে আমার সাথে বিজনেস না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে আমার ততদিনে আমেরিকান মাফিয়াদের সাথে দশ মিলিয়ন ডলারের ডিল হয়েছে ড্রাগের। যেই ডিলটা ছিলো আমার জন্য বেশ ইম্পোরটেন্ট। কিন্তু আফজাল কিছুতেই আমার সাথে বিজনেস করতে চাইছিলোই না। যার দরুন দশ মিলিয়ন ডলারের ডিল আমার ক্যানসেল হয়ে যায়। তারপর থেকে ড্রাগ র্যাকেটিং ঠিকঠাকমতো হচ্ছিলো না আবার আমার ঋণ বাড়ছিলো। সাথে আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে প্রেশার তো ছিলোই। কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারছিলাম না। বিশেষ করে এই আফজালের জন্য৷ বিজনেস ওফ এর পর থেকে আমার উপর প্রায়ই নজর রাখতো ও। তাই এর মাঝে আমি সিদ্ধান্ত নেই আফজালকে রাস্তা থেকে সরাতে পারলে ওর বিজনেসটা যদি কোনোরকম নিজের আন্ডারে পারি তাহলে আমারই লাভ। কারণ আমার ওর বিজনেসের উপর কোনো লোভ ছিলোনা ওর বিজনেস আমার হাতে আসলে আমি তা হাতিয়ারস্বরূপ আমার ড্রাগ সাপ্লাইয়ের জন্য ব্যবহার করতে পারতাম। এদিকে একদিন ফোনে আফজালকে মারার এবং ড্রাগের বিষয়ে কথাবার্তা বলতে গেলে তোমার ফুপি আফসানা সেটা শুনে ফেলে। আফজালকে জানাতে গেলেই আমি ওকে আটকাই। কিন্তু ও আফজালকে এই বিষয়ে জানিয়েই ছাড়বে! বড় ভাইয়ের প্রতি এত নেওটাগিড়ি আমার একদমই সহ্য হচ্ছিলো না। ভাবলাম দু’টো ভাইবোন কে একবারেই এই দুনিয়া থেকে বিদায় দেব। তাই প্ল্যানমতো একদিন আফসানা কে নিয়ে নিজের নতুন বাড়ি দেখানোর নাম করে সেখানে নিয়ে যাই। আসার পথে পরিকল্পনামতো এক্সিডেন্ট ঘটিয়ে আমার জায়গায় মোটামুটি আমার মতোই দেখতে অন্য একজনের লাশ আমার লোক সেখানে রেখে দেয়। এরপর আমি রাশিয়ায় যেয়ে কয়েকদিনের জন্য গা ঢাকা দেই। আর সেখান থেকেই প্ল্যান করি আফজালের এতো বড় সাকসেসফুল বিজনেস আমি কখনোই সাসটেন করতে দিব না। এন্ড দেন আমি ওর আন্ডারের প্রত্যেকটা ল্যাবের দু’একজন মানুষকে টার্গেট করে তাদের দিয়েই মেডিসিনে ড্রাগ মিশাই যাতে বাইরের দেশ থেকে ইন্টারন্যাশনালি আফজালের বিরুদ্ধে স্টেপ নেয়া হয় । আর ওর এই বিজনেস যাতে বিলীন হয়ে যায়। আর অফকোর্স তোমাকেও নিজ হাতে যাতে মারতে পারি! ততদিনে আমার প্রথম টার্গেট ছিলে তুমিই! কারণ তোমার সাথে আমার আলাদা হিসেব নিকেশ বাকি আছে!’
আকসাদ এতক্ষণ যাবত উনার প্রত্যেকটা কথা শুনে হতচকিত দৃষ্টিতে চ্যাডউইকের দিক তাকিয়ে ছিলো। অবিশ্বাস্য কন্ঠের ন্যায় বললো,
– ‘সামান্য কয়েকটা টাকার লস, আর ড্রাগ এর এই বিজনেসের জন্য আপনি এভাবে নিজের স্ত্রীকে মারতেও দুবার ভাবেননি! বাবার বিজনেসের কথা তো না হয় বাদই দিলাম! আপনার জন্য কতগুলো মানুষের হাই পাওয়ারের ড্রাগ নিয়ে কতো সমস্যা হয়েছে আপনি জানেন?’
চ্যাডউইক এবার উঠে আকসাদের কলার চেপে বললো,
– ‘টেন মিলিয়ন ডলার সামান্য হলেও আমার ছেলের জীবনটা সামান্য ছিলোনা!’
আকসাদ কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
– ‘মানে!’
চ্যাডউইক আকসাদের কলার আরও জোড়ে চেপে বললো,
– ‘মনে নেই! তোর বোনকে একটু ছুঁয়েছিলো বলে তুই আমার ছেলেটাকে এমন মারাই মেরেছিস আমার ছেলেটার ব্লিডিং হতে হতে প্রাণ হারায়! আর আজ এখনই আমি তোর প্রাণটা নিজ হাতে নিবো। যেভাবে তুই আমার ছেলেটাকে মেরেছিলি।’
আকসাদকে ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে ওর কপাল বরাবর চ্যাডউইক গান রাখতেই পিছন থেকে কেউ বললো,
– ‘এত সহজে মেরে ফেলবে! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আনকমন ওয়েতে ওকে মারবে!’
আচমকা পরিচিত কন্ঠস্বর পেতেই চ্যাডউইক পিছন ফিরলো। এদিক আকসাদও সেদিক বরাবর তাকিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানূষটাকে দেখেই ও বিস্মিতকরণ দৃষ্টিয়ে তাকিয়ে রইলো। ও কখনও ভাবেনি যে
চলবে,,,
#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ৪৯(দ্বিতীয় অংশ – নিস্তব্ধ!)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী
এত সহজে মেরে ফেলবে! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আনকমন ওয়েতে ওকে মারবে!’
আচমকা পরিচিত কন্ঠস্বর পেতেই চ্যাডউইক পিছন ফিরলো। আকসাদও কিছুটা দূরবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে অবাকের চরম সীমানায় যেন পৌঁছালো! এতক্ষণ যাবত ওর সাথে যা ঘটেছে তা ও মেনে নিয়েছে। কারণ এরূপ একটা ঘটনা যে ওর সাথে ঘটতে পারে তা ও আগে থেকেই আন্দাজ করলেও এখানে যে চ্যাডউইকের পিছনে দাঁড়ানো লোকটাও জড়িত এটা আকসাদ কখনোই ভাবেনি! চোখ বড় বড় করে ও সামনে তাকিয়ে আছে। অবিশ্বাস্য কাঁপানো কন্ঠে নিস্তেজ গলায় বলে উঠলো,
– ‘ফ্রানকো…তুমি?’
,
,
,
ভিঞ্চি আপাতত আকসাদ যেই পথ দিয়ে ওর টিমদের নিয়ে মেডিসিন নিয়ে গিয়েছিলো সেখান দিয়ে ওর জিপ নিয়ে এগোচ্ছে। রাস্তার একদম শেষ প্রান্তে এসে একটা সাইনবোর্ড দেখে ও জিপ গাড়িটা থামালো। সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা ‘ওয়ান ওয়ে’। তার মানে এই রাস্তা সোজা বরাবরই গেছে! কিন্তু এই রাস্তা দিয়ে ভিঞ্চির লোকেরা অনেকক্ষণ ধরেই টহল দিয়েছিলো আকসাদের কোনো খোঁজ ওরা পায়নি! ভিঞ্চি জিপ গাড়িটা থেকে নেমে কিছুক্ষণ সেই রাস্তা বরাবর তাকিয়ে থাকলো। আকসাদ এখান থেকেই হয়তো হারিয়েছে! না হলে ওর কোনো খোঁজ আগে গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে না কেন! ভিঞ্চি আশেপাশে তাকাতেই দেখলো একটা ঝোপঝাড়ে ঘিরে রাখা একটা জঙ্গল এর মতো জায়গা। ভিঞ্চি প্যান্টের পকেটে হাত রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সেদিকে পা বাড়ালো। আশপাশ তাকিয়ে হাঁটতে লাগলো। আকসাদ আর ভিঞ্চি ছোটোবেলায় যখন লুকোচুরি খেলতো তখন থেকেই একজন আরেকজন এর জন্য কোনো ক্লু রেখে যেতো একে অপরকে ধরার জন্য। ওদের এই স্বভাবটা বড় হওয়ার পরেও রয়ে গিয়েছিলো। একসাথে কোনো ক্যাম্পিং বা মিশনে গেলে ওরা একে অপরের জন্য কোনো সূত্র ফেলে যেত। যাতে পরে সেই সূত্র ধরেই একে অপরকে খুঁজে পায়। ভিঞ্চি মনে মনে ভাবছে, আকসাদ ওর জন্য এবার কোনো সুরুক রেখে গেছে কি না কে জানে! নইলে এভাবে ওর খোঁজ জানা বেশ কঠিন হয়ে যাবে ওর পক্ষে। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ভিঞ্চি জঙ্গলের একটু ভিতরে যেতেই একটা পথের দিক তাকালো। এই পথটা জঙ্গলের আশেপাশের মতো এতো কাটা বা ঝোপঝাড় দিয়ে ভরা নয়! ভিঞ্চি পা ফেলে সেদিক এগিয়ে যেতেই দেখলো রাস্তাটা কেমন যেন ভেজা ভেজা। ভিঞ্চি নিচু হয়ে সেখানটায় হাত দিয়ে নাক বরাবর আনতেই একটা তীক্ষ্ণ ঝাঁঝালো গন্ধে ও ভ্রু কুঁচকালো। এটাতো ফিনাইলের গন্ধ! ভিঞ্চি আরও কিছু পথ এগিয়ে দেখলো সেখানকার পাতা,মাটিও ভেজা৷ সেখানে হাত দিয়েও ও দেখলো একই গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে! ভিঞ্চি দাঁড়িয়ে সেদিক বরাবর হাঁটতে হাঁটতে দেখলো এই জঙ্গলের ভিতরেই আরেকটা পথ তবে সেটা মেইন রোডের মতো এতো প্লেইন নয়। সেই দিক এগিয়েও ভিঞ্চি দেখলো পানির ন্যায় একটা সরু তরলের দাগ সেই রাস্তা কেঁটে কেঁটে সামনে এগিয়ে গেছে! যেনো কিছুক্ষণ আগেই এই তরল পদার্থটি কিছু একটার থেকে অগোছালোভাবে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়েছে। ভিঞ্চি পাশের দেয়াকে একহাত দিয়ে কিচ্ছুক্ষণ ভাবলো। তাহলে কি আকসাদ! আর সময় নষ্ট না করে ভিঞ্চি দ্রুত পিছিয়ে যেয়ে ওর জিপ গাড়িতে উঠে তার ভিতরকার রাস্তা বেয়ে এগিয়ে চললো। ও আপাতত মনে মনে একটাই প্রার্থনা করছে, ওর ধারণাগুলো যাতে এবার ঠিক হয়! খুব বেশী দেরী হওয়ার আগেই যাতে ও দ্রুত পৌঁছাতে পারে!
,
,
,
আকসাদের অবাক চিত্তকে পরোয়া না করে ফ্রানকো ওর সামনে এগিয়ে এলো। আকসাদ এখনও বিশ্বাস করতে পারছেনা ফ্রানকোও এর সাথে জড়িত! একজন অফিসার হয়ে কিভাবে ও এই কাজ করলো! ফ্রানকো আকসাদের বিস্মিত চাহনী দেখে জোড়ে হেসে ওর সামনে মাথা ঝুঁকে বললো,
– ‘সারপ্রাইজড! আরে*ন্ট ইউ?’
আকসাদ চোখের পলক ফেলে বললো,
– ‘ফ্রানকো! তুমি একজন অফিসার!!! একজন অফিসার হয়ে তুমি কিভাবে এই স্মাগলার টাকে সাপোর্ট করলে! হাও ডু ইউ ডিড দ্যাট?’
ফ্রানকোর এতক্ষণের স্বাভাবিক চেহারা কঠোর হতে থাকলো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
– ‘করার ইচ্ছা ছিলোনা। বাট আমি বাধ্য হয়েই করেছি বলতে পারিস!’
আকসাদ চমকালো। সময় ব্যয় না করে ফ্রানকোকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘বাধ্য! কিন্তু কেন?’
ফ্রানকো এবার পুরো দমে চিল্লিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– ‘বিকোজ আই ওয়াজ পিস’ড বাই ইউ! যাস্ট বিরক্ত আর ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছিলাম আমি দিনকে দিন তোর জন্য!’
আকসাদ অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে ফ্রানকোর দিক তাকিয়ে আছে। ওর কথা কিংবা আচরণ কিছুই ওর মাথাতে ঠেকছে না। তারপরও ও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। ঠিক কোন কারণে ফ্রানকো এভাবে সবাইকে ধোঁকা দিলো সেটা ও জানতে চায়!
ফ্রানকো আকসাদের নিরলস চাহনীর দিক তাকিয়ে রুক্ষ কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘আমি কে! আমি একজন অফিসার! আজ থেকে তিন বছর আগে আমি অফিসার হিসেবে জয়েন করি! সেখানে জয়েন হয়ে জানতে পারলাম তুই ভিঞ্চির ফ্রেন্ড, মাস্টার্স করছিস সাথে ডিপার্টমেন্টের আন্ডারে একজন সিক্রেন্ট এজেন্ট হিসেবেও তুই কাজ করিস। আমার এসব নিয়ে প্রথম দিকে কোনো মাথাব্যথা ছিলোনা। কিন্তু বছর গড়ালেও আমার কোনো প্রমোশন হচ্ছেনা এদিকে তুই একজন সিক্রেট এজেন্ট হয়ে তোর প্রমোশন খালি বাড়তো! এদিকে আমি কিন্তু অফিসিয়ালি একজন অফিসার আর তুই একজন আনঅফিসিয়াল এজন্ট! তাতেই তোর প্রমোট ডিপার্টমেন্ট করাচ্ছে আর আমি সেই সাধারণ অফিসারই রয়ে গেলাম! এরপর আরেকবছর এগোলো প্রমোশন এর কোনো নামগন্ধ নেই সাথে ফিস টাও বাড়ালো না। ভাবলাম এবার একটু অন্য ওয়েতেই ডলার কামাতে হবে। ডিপার্টমেন্টের প্রতিটা কেসে যত টাকা বরাদ্দ ছিলো তার চেয়ে একটু বেশি টাকা আমি ভিক্টিমদের থেকে কেস সলভের জন্য নেয়া স্টার্ট করলাম। ভালোই কামাচ্ছিলাম এর মধ্যেও তোর রোজগার স্বভাবের মতো নাক গলাতে হলো! ভিক্টিমদের থেকে কেসের জন্য এক পয়সাও বেশি নেয়া যাবেনা। আর নিলেও ভিক্টিমরা যাতে সাথে সাথে হেড কোয়ার্টারর কাছে তা নিয়ে প্রসিকিউট করে। এই রুলস তুই ক্রিয়েট করে দিলি! যাও কটা টাকা ইনকাম করতাম নিয়মের বাইরে যেয়ে তাও তোর জন্য ভেস্তে গেলো। দু’বছর পর আমি ভেবেছি এবার অন্তত আমার প্রমোশনটা হবে। হয়তো উনারা এবার আমাকে চিফ ইলেকট্রোরাল বা কমিশনড অফিসার হওয়ার সুযোগ টা দিবে। তাহলে প্রমোট হওয়ার সাথে সাথে আমার ফিস সাথে সুযোগ সুবিধাও বাড়বে। কিন্তু এবার আমার প্রমোট হওয়ার বদলে ঘুরে ফিরে তোরই প্রমোট হলো, একজন মার্শালের সমান অধিকার তোকে দেয়া হলো। যেখানে এবার অন্তুত আমার প্রমোট টা হবার কথা ছিলো! একজন আনঅফিসিয়াল অফিসার হয়ে ডিপার্টমেন্ট থেকে সমস্ত রাইটস তুই পাচ্ছিলিস! এইসব আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না। যাস্ট সহ্য হচ্ছিলো না। ভাবলাম তুই রাস্তা থেকে সরলেই আমার সমস্ত প্রবলেম সলভ হয়ে যাবে! তাই উইকের সাথে আমি হাত মিলিয়েছি। আর আমার ট্রিকস কাজেও লেগেছে! এইযে দেখ তোকে আটকে রেখেছি, তোর ফ্যামিলির উপর ব্লেইম এসেছে সেই ব্যস্ততায় ডিপার্টমেন্টের সাথে তোর সেভাবে যোগাযোগ নেই বিধায় পুরোপুরি এই কেসের দায়িত্ব আমার উপর দিয়েছে! তুই ডিপার্টমেন্টের সাথে কয়েকটা দিন শুধু কানেক্টেড নেই আর সেখানে আমাকেই প্রায়োরিটি দিয়ে প্রত্যেকটা কেসের অর্ডার দেয়ার হচ্ছে! ইজেন্টিট ম্যাজিক! কাজেই ভেবে দেখলাম তুই না থাকলে অবভিয়াসলি আমারই লাভ! এবার অন্তত আমি নিজের মনমতো চলতে ফিরতে পারব! প্রফিটও হবে আমার! কি বলিস?’
আকসাদ ফ্রানকোকে কি উত্তর দিবে তা ও বুঝতে পারছেনা। সামান্য পদের প্রমোশন আর টাকার জন্য কেউ এভাবে নিজেরই ডিপার্টমেন্টের বাইরে যেয়ে আইনের সাথে বেইমানী করবে তা ওর ধারণার বাইরে ছিলো! তাও স্তব্ধ গলায় বললো,
– ‘ভিঞ্চি, আর ডিপার্টমেন্ট তোমাকে ট্রাস্ট করতো ফ্রানকো! বিশেষ করে ভিঞ্চি! ভিঞ্চির জন্যই তুমি আজ এ জায়গায় আছো! আর সেখানে তুমি এভাবে…।’
ফ্রানকো সাথে সাথেই উত্তর দিলো,
– ‘রাখ তোর ট্রাস্ট। ওর জন্য আরও আমি পিছিয়ে ছিলাম! কোথায় ভেবেছি ওর সাহায্যে আমি আরও ভালো করতে পারব। এদিকে দেখি ও তোর মতোই আরেক চিজ। সিভিলাইজড পারসনদের মতো দেশের ভালো করতে হবে, সৎ থাকতে হবে, দায়িত্বে রেগুলার হতে হবে এইসব জ্ঞান দেয়া ছাড়া আর কোনো কথাই ওর মুখে ছিলো না! ওই ভিঞ্চিও আমাকে বহুত জ্বালিয়েছে। কিন্তু, ব্যাপার না তোর সাথে আগে হিসাব মিটিয়ে নেই! তারপর ওকে দেখব। একে একে সবার পালা শেষ করবো! কি বলো চ্যাডউইক?’
চ্যাডউইক দাঁত বেরে করে হেসে মাথা নাড়ালো। গানটা এবার আকসাদের মাথা বরাবর আবার তাক করতেই ফ্রানকো বলে উঠলো,
– ‘ওকে এভাবে না মেরে অন্য উপায়ে মারা যায়না! বাইরে সবাই ওকে খুঁজছে! ওর লাশ নিয়ে পরে দৌড়াদৌড়ি করতে ঝামেলা হবে। লাশ কোথাও পুঁতে রাখলেও বিপদ। পরে এটা নিয়েও কেস কাবারি হবে।’
চ্যাডউইক কিছুক্ষণ আকসাদের দিক তাকিয়ে ভাবলো। তারপর রুমের আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে দেখলো একটা বড় ছয় ফিটের চারকোনা শেপের গ্লাসের জাড়ে সালফারিক ছাড়াও বিষাক্ত কিছু এসিডের মিশ্রণ টগবগ করছে। একটা খড়গোশ এখানে পড়লেও ১ মিনিটের মাথায় তা গলে যাবে৷ কোনো অস্তিত্বই তার খুঁজে পাওয়া যাবেনা! তাহলে এখানে যদি আকসাদকেও! ভেবেই ক্রুর হেসে ফ্রানকোকে উদ্দেশ্য করে চ্যাডউইক বললো,
– ‘ওকে ওই জাড়ের দ্রবণে ডুবিয়ে দেই! কোনো ঝামেলাই তাহলে হবেনা!’
ফ্রানকো হেসে মাথা নাড়ালো। চ্যাডউইক হেসে আকসাদের দিক ফিরে বললো,
– ‘সো স্যাড ভাতিজা! তুই একাই মরবি! ভেবেছিলাম তোর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী প্রাহীকেও তোমার সাথে এই বিষাক্ত এসিডে ডোবাবো! কিন্তু কোনো ব্যাপার না! একটা কজা করা যায়! তুই মারা যাবার কিছুক্ষণ পরই তোর বাবা-মা, বোন আর প্রাহীকে এখানে ডোবানো হবে। তখন না হয় এই প্রাণহীন দ্রবণের মাঝে একে অপরের নিষ্প্রাণ আত্নাকে খুঁজে নিস!’
আকসাদ এর চোখমুখ এবার মুহুর্তেই লাল হয়ে উঠলো। এতক্ষণ অনেক কষ্টে নিজেকে ঠিক রাখলেও নিজের পরিবার আর প্রেয়সীর ব্যপারে এমন কথা শুনে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা ও চালালো না। প্রচন্ড ক্রোধে ও হাত পা জোড়ে নেড়ে হিসহিস করতে লাগলো। ফ্রানকো তা দেখে জোড়ে হেসে বললো,
– ‘পাগলা ঘোড়া এতক্ষণে ক্ষেপেছে বুঝি! আসো ক্ষেপানোটা দমিয়ে দেই!’
বলে আকসাদের বেঁধে রাখা দড়িতে হাত রাখতে যাবে তার আগেই অচিরেই ধারালো একখানা গুলি তীরের ন্যায় ফ্রানকোর হাতে যেয়ে বিঁধলো। দ্রুত আকসাদের থেকে নিজেকে সরিয়ে রক্তাক্ত হাতখানা চেপে ধরলো অন্য হাত দ্বারা। সামনে তাকাতেই দেখলো ভিঞ্চি হাতে Beretta 92FS গান নিয়ে ওদের দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে। চ্যাডউইক সামনে এগোতে নিলেই ভিঞ্চি সাথে সাথেই চ্যাডউইকের পা বরাবর একটা শ্যুট করলো যার ফলে উইক সাথে সাথে পা ধরে নিচে বসে পড়লো। ভিঞ্চি ফ্রানকোর দিক গান তাক করতেই ও হাতউপরে তুলে পিছু হাঁটতে হাঁটতে চ্যাডউইকের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো। ভিঞ্চি শিকারী নজরে ওদের দিক তাকিয়ে আকসাদের দিক এগিয়ে ওর হাতের দড়িগুলো খুলে দিয়ে বললো,
– ‘তুই এতো স্টুপিড! একা একা রিস্ক নিতে গিয়েছিস কেন হ্যাঁ!’।
আকসাদ বর্তমানে আর কথা না বাড়িয়ে পায়ের দড়িগুলো খুলতে লাগলো। ভিঞ্চি ওদের দিক ফিরলো। ফ্রানকো ওদের দিক ফিরে আসতেই ভিঞ্চি ওর নাক বরাবর এক ঘুষি মেরে বললো,
– ‘আমার লাইফে আমি কখনও ভাবিনি যার সাথে একই ছাদের নিচে বড় হয়েছি। তার থেকে এভাবে প্রতারিত হতে হবে ভাবিনি! তোর সাথে হিসাব নিকেষ টা বাকি আছে। সেটা আমি তা দেখব তাও পার্সোনালি!’
বলেই ফ্রানকোর মুখ বরাবর আরেকটা ঘুষি মারলো ভিঞ্চি। ফ্রানকো এবার নিচে পড়লো। শ্বেতাঙ্গ মুখে আপাতত রক্ত ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। এদিকে আকসাদ নিজের পায়ের দড়িগুলো খুলে এক মুহুর্ত অপচয় না করে নিজের পকেট হতে colt 1911 সিরিজের গানটা বের করে চ্যাডউইকের দিক তেড়ে গিয়ে ওর কলার চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বললো,
– ‘তোর খুব শখ না আমার পরিবারের মানুষজনকে এই এসিডের দ্রবণে চুবানোর! তোর এই শখ আমি পূরণ করব তাও তোরই দ্বারা! তার আগে তোকে একটা সিক্রেট বলি। তোর ছেলে চার্লি তোর জন্যই মরেছে। কেন জানিস!!! তুই তো তোর ড্রাগ এর বিজনেস শুধু মেডিসিনের মাধ্যমেই অব্যাহত রাখিসনি? ইয়াং, হায়ার টিনাজেরদের মাঝেও তুই এই ড্রাগ সাপ্লাই করতি। আর তোর ছেলে তার বাবার সাপ্লাইয়ের ড্রাগই তার বন্ধুদের সাথে নিয়ে নিজের ডেথ নিজে ডেকে এনেছে।’
চ্যাডউইক আকসাদের কথায় পুরো থমকে গেলো। ওর ছেলে ওরই অগোচরে সাপ্লাই করা ড্রাগ নিয়ে মারা গেছে! না না এটা অসম্ভব! ড্রাগ নিলে কেউ মারা৷ যায় না এতো সহজে! আকসাদের দিক তাকিয়ে জোড়ালো গলায় বললো,
– ‘মিথ্যে বলছিস তুই। আমাকে বিভ্রান্ত করার একদম চেষ্টা করবিনা। ড্রাগ নিলে কেউ এত সহজে মরে নাকি!’
আকসাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো,
– ‘তুই আসলে বাবা হিসেবে ব্যর্থ। কেন জানিস! কারণ তুই তোর ছেলেকে শুধু ওই উচ্চ লেভেলের কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পাঠানো পর্যন্তই খালাস। এরপর আর কোনো খবরই নেই! তোর ছেলের শরীরে যে ইমিউন সিস্টেম কম আর জেনেটিক প্রবলেম ছিলো এটা তুই জানতি না! যেদিন রেইন আয়সুনের সাথে অসভ্যতা করে সেদিন আমি ওকে শুধুমাত্র একটা পাঞ্চ মেরেছিলাম মাত্র! হুট করেই ওর চোখমুখ লাল হয়ে যখন মুখ আর নাক দিয়ে ব্লিডিং হওয়া যখন শুরু হয় তখন সাথে সাথে ওকে আমরা হসপিটালে নিয়ে যাই। ডাক্তার রা যখন ওকে মৃত ঘোষণা করে তখন ফুপি দিশেহারা হয়ে এর কারণ জানতে চাইলে ডাক্তার এক কথায় বলে দেয়, ‘ওর শরীরে কিছু এলার্জিক এক্টিভিটি, আর হাই ব্লাড প্রেশারের কারণে এত হাই লেভেলের ড্রাগ ওর শরীরে কুলায়নি। যার দরুণ সারা শরীরে র্যাশ উঠে ভরে গিয়েছিলো, আর অতিরিক্ত এক্সটার্নাল ব্লিডিং এমনকি ইন্টার্নাল ইফেক্ট এর জন্য ও মারা যায়!। তাহলে এবার যাস্ট ভাব তুই কেমন বাবা! যে নিজের ছেলেও তার পিতার অপকর্মের ভিক্টিম হয়ে যায় অজান্তেই?’
চ্যাডউইক এবার পাগলের মতো আচরণ শুরু করেছে। উনার বিশ্বাসই হচ্ছেনা! মাথার চুলগুলো খামচে ধরে বিলাপ করে যাচ্ছে,
– ‘না না আমার জন্য আমার ছেলে মরেনি! আমার…না এটা হতে পারেনা। আমার ছেলে পুরো সুস্থ ছিলো! রেইন ওয়াজ হেলদি এ বয়। ওর কোনো এলার্জি,ফ্যালার্জি ছিলোনা। তুইই আমার ছেলেকে মেরেছিস! বুঝেছিস! এসব বলে…লাভ নেই। আমি…আমি তোকে ছাড়ব না।’
আকসাদের দিক বন্দুক তাক করতেই আকসাদ চ্যাডউইকের বন্দুক সংলগ্ন হাতটা ধরে ফেলে। ওদের মধ্যে একপ্রকার ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। আকসাদ চ্যাডউইকের মুখ বরাবর গান দ্বারা আঘাত করতেই চ্যাডউইক পা পিছলে সেই এসিডের দ্রবণের মধ্যে পড়ে যায়। অর্ধেক শরীর দ্রবণের মধ্যে আর বাকি অর্ধের শরীর বাইরে। দ্রবণে ডোবানো অর্ধেক শরীর পুড়ে গলে যাচ্ছে। চ্যাডউইক যন্ত্রণাকাতর মিশ্রিত গলায় বলে উঠলো,
– ‘আম…আমি ম…মরলেও লে…লেজ রেখে যাচ্ছি। তো…তোদের এতো সহজে নিস্তার নেই!’
আকসাদ দৃঢ় কন্ঠে চ্যাডউইকের করুণ দশার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘তুই যতো লেজই ফেলে যাস না কেন। তাদের পরিণতি তোর মতোই হবে নয়তো তোর চেয়েও করুণ হবে।’
চ্যাডউইকের শরীর মুহুর্তের মাঝেই সেই এসিডিয় তরলে পুড়ে মিশে গেছে। যার থেকে ইতিমধ্যে গন্ধ বের হওয়া বের শুরু হয়েছে। ভিঞ্চি দ্রুত আকসাদের দিক এগিয়ে বললো,
– ‘লাশটাতো একদম গলে গেলো!’
আকসাদ নির্বিকার চিত্তে চ্যাডউইকের ভাসমান কিছু হাড্ডির দলার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘ওর মতো মানুষের লাশ থেকে আর কি কী হবে! আগেভাগে পঁচে গেছে এটাই শ্রেয়।’
ভিঞ্চি মাথা নেড়ে বললো,
– ‘ফোর্স অলরেডি চলে এসেছে আমা…।’
কথাটা শেষ করার আগেই আচমকা এক গুলির শব্দে চারপাশ আন্দোলিত হয়ে। মুহুর্তে সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল!
চলবে,,,
#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ৪৯(তৃতীয় অংশ- উষ্ণ স্পর্শ)
#লেখনীতে-#ফেরদোসী_নবনী
(পর্বটা রোমান্টিক ভালো না লাগলে স্কিপ করতে পারেন)
– ‘আমার ছেলে…বাঁচবে তো?’
আকসাদের মা ক্রন্দনরত কন্ঠে ভিঞ্চিকে জিজ্ঞেস করলো। ভিঞ্চি পাশ ফিরে কাঁচের দেয়ালের ওপারে আকসাদের দিক চোখ বুলালো। যার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। হাতে,বুকে, পায়ে বিভিন্নি তার ঝুলানো। আকসাদের এক পা হতে ক্রমান্বয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে। ভিঞ্চি তা দেখে চোখ ফিরিয়ে সজোরে বন্ধ করে ভাবতে লাগলো, ভিঞ্চি আর আকসাদ যখন কথা বলছিলো তখন ফ্রানকো পাশে পড়ে থাকা চ্যাডউইকের গান দিয়ে ওদের দিকে একটা গুলি ছুড়ে দিতেই তা আকসাদের পা দিয়ে ভেদ করে বেড়িয়ে যায়। মুহুর্তেই আকসাদ পা ধরে মাটিতে বসে পড়ে। ভিঞ্চি সাথে সাথে ফ্রানকোর হাতে দু’টো গুড়ি ছুড়তেই ভিঞ্চিদের ফোর্স চলে আসে। তারপর ওখান থেকে আকসাদকে সাথে সাথে ভিঞ্চি হাসপাতালে নিয়ে এসে। আকসাদের পরিবারকে কল করে জানাতেই উনারা সাথে সাথেই চলে আসে। আকসাদের বাবা-মা ছেলের এই অবস্থা দেখে একদম ভেঙে পড়েছে।
ভিঞ্চি আকসাদের মাকে কিছু বলতেই আকসাদের কেবিন থেকে ডাক্তার বেড়িয়ে আসতেই উনার দিকে সবাই এগিয়ে যায়। আকসাদের বাবা ব্যস্ত কন্ঠে ডাক্তারকে সুধায়,
– ‘আমার ছেলের কি অবস্থা কি ডক্টর! এভরিথিং ইজ ফাইন!’
ডক্টর মাথা নেডে বলে,
– ‘উনার পায়ের হাঁটুর জয়েন্টে গুলি লেগে বেড়িয়েছে৷ ইমার্জেন্সি অপারেশন করাটা জরূরী।’
আকসাদের মা পিছন থেকে বলে উঠলেন,
– ‘আপনি অপারেশন শুরু করে দিন। আর দেরী করবেন না।’
আকসাদের মায়ের কথায় ডাক্তার মাথা নাড়িয়ে আকসাদকে অপারেশন থিয়েটারের দিকে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে উনি চলে গেলেন৷ আকসাদকে থিয়েটারের দিক নিয়ে যাওয়ার সময় প্রাহী আকসাদের হাত শক্ত করে চেঁপে ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া বেডের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওকে বললো,
– ‘আকসাদ! আপনার কিচ্ছু হবেনা! আপনি…আপনি ঠিক…।’
প্রাহীর হাতের ভাঁজে আকসাদের হাত ছুঁটে গেলো। ওকে থিয়েটারে নিয়ে সেখানকার দরজা লক করে দিলে প্রাহী দরজার বাইরে নিজের হাতের দিক তাকালো যেখানে কিছু মুহুর্তের জন্য নিস্তব্ধ আকসাদের হাতজোড়া ওর হাত জুড়ে ছিলো! আকসাদের মা এগিয়ে প্রাহীকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
– ‘আকসাদ ঠিক হয়ে যাবে! ইনশাল্লাহ।’
ভিঞ্চি পাশ থেকে বলে উঠলো,
– ‘ঠিক প্রাহী! আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো দেখবে ও নিজে থেকেই তোমার সাথে কথা বলছে!’
পানিভেজা চোখে প্রাহী ভিঞ্চি আর আকসাদের মায়ের দিক তাকিয়ে মাথা নেড়ে অপারেশন রুমের বাইরের দেয়ালে মাথা ঠেকে দাঁড়িয়ে রইলো। ওর চোখ দিয়ে আর পানি বের হচ্ছেনা। প্রায় আটাশ ঘন্টা নিজ স্বামীর জন্য চিন্তা, উদগ্রীব, অস্থিরতার কাঁদতে কাঁদতে ও এখন ক্লান্ত! খুব ক্লান্ত! দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে প্রাহী নিরব দৃষ্টিতে অপারেশন থিয়েটারের রুমের দিক তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
– ‘উঠে পড়ুন আকসাদ। আপনাকে কাছে পেয়েও এভাবে জড়হীন অবস্থায় দেখতে আমার ভালো লাগছেনা। একদম ভালো লাগছেনা।’
,
,
,
দীর্ঘ দেড় ঘন্টা অপারেশন এর পর ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে এলো। আকসাদের পুরো পরিবার সহ প্রাহী, ভিঞ্চি সহ সেদিক এগিয়ে গেলো৷ ভিঞ্চি ডাক্তারের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘কি অবস্থা ডক্টর! অল গুড!’
ডাক্তার মুখের মাস্ক খুলতে খুলতে বললো,
– ‘ইয়াহ্। অপারেশন সাকসেসফুল। আপাতত কোনো কিছু নিয়ে ভয় নেই।’
সবাই এক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতেই প্রাহী ব্যকুল কন্ঠে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘উন…উনার সাথে একটু দেখা করা যাবে?’
ডাক্তার প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘না। পেশেন্ট আপাতত ঘুমোচ্ছে। একঘন্টা পর উনাকে কেবিনে দেয়া হবে। তখন সবাই দেখে করে নিবেন।’
প্রাহী রুমের বাইরে হতে ছোট্ট কাঁচের গ্লাস দিয়ে একটু উঁকি দিলো। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, পায়ে মোটা ব্যান্ডেজ পরিহিত অবস্থায় আকসাদ কেমন নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে! প্রিয় মানুষটাকে এভাবে দেখে প্রাহীর চোখ বেয়ে এক ফোঁটা উষ্ণ জল গড়িয়ে পড়লো।
,
,
,
– ‘এখন কেমন লাগছে! খারাপ লাগছে?’
আকসাদ মায়ের দিক তাকিয়ে ধীরকন্ঠে বললো,
– ‘ আমি ঠিক আছি এখন। চিন্তা করোনা।’
আয়লিনা হোসেন ছেলের দিক তাকিয়ে গোমড়া কন্ঠে বললেন,
– ‘চিন্তায় চিন্তায় সবাই শেষ হয়ে গিয়েছি। আর তুই এখন বলছিস চিন্তা করবো না! এরকমভাবে বিপদে নিজেকে ঠেলে দেওয়ার কি খুব দরকার ছিলো? একটা বারও নিজের পরিবারের কথা মনে পড়েনি! আমাদের কথা ছাড়াও প্রাহীর কথাও কি মনে পড়েনি!’
আকসাদের বাবা আফজাল হোসেন ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
– ‘সবচেয়ে বড় কথা মেয়েটা তোর বউ! কয়দিন আগেই তোদের বিয়ে হয়েছে। ওর প্রতি যে তোর একটা দায়িত্ব বলে কিছু একটা আছে এটা কি তুই ভুলে গিয়েছিলিস নাকি! ওর বাবা-মার কাছে আমরা কি জবাব দিতাম বল তো?’
আকসাদ নিজের বাবা-মায়ের দিক তাকিয়ে কিছু বলার আগেই ভিঞ্চি বলে উঠলো,
– ‘আচ্ছা হয়েছে। এসব নিয়ে কথা পড়ে হবে। আপাতত ওর সাথে বেশি কথা বলাও যাবেনা। ডাক্তার বারণ করেছে।’
আকসাদের মা মাথা নেড়ে আকসাদের দিক ফিরে বললো,
– ‘মেয়েটা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। রাত থেকে দু’লোকমা ভাত ছাড়া আর কিছুই খায়নি তোর জন্য। তোর সাথে কথা বলার পর ওকে বাসায় নিয়ে যাব। খাইয়ে দাইয়ে রাতে আসবে না হয়।’
আকসাদের মা উঠে চলে যেতেই ভিঞ্চি আকসাদের দিক এগিয়ে বলে উঠলো,
– ‘শা*লা বেশ নাকুনিচিবুনি খাইয়ে ছেড়েছিস! জঙ্গলের ওই দিকটা ভেজা ভেজা ছিলো কেমিক্যাল এর জন্য রাইট!’
আকসাদ হাসলো,
– ‘হু যেই গাড়িতে ছিলাম তার নিচে ছিদ্র করা ছিলো। সেখান দিয়ে লিকুইড গড়িয়ে পড়েছে৷ এভাবে নিশানা রেখে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিলোনা।’
ভিঞ্চি মাথা দুলিয়ে বললো,
– ‘আই নিউ ইট!’
আকসাদ ভিঞ্চির দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘ফ্রানকো…।’
ভিঞ্চি গম্ভীর গলায় বললো,
– ‘ওকে কাস্টডিতে রাখা হয়েছে। আপাতত ওর কথা বাদ দে। তুই রেস্ট নে। বাকি কথা পরে হবে।’
আকসাদ মাথা নাড়লো। ভিঞ্চি দরজার দিক এগোতেই আকসাদ বলে উঠলো,
– ‘আমার বউটাকে একটু পাঠিয়ে দিস!’
ভিঞ্চি আকসাদের দিক তাকিয়ে ফিচেল হেসে বেড়িয়ে গেলো। বাইরে এক কোণায় প্রাহী দাঁড়ানো। ওর কাছে এগিয়ে যেয়ে বললো,
– ‘তোমার ডাক এসেছে! যাও!’
প্রাহী মাথা নেড়ে সেদিকে এগোনের আগে ভিঞ্চির দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘ভাইয়া!’
ভিঞ্চি পিছন ফিরে তাকাতেই প্রাহী মিহি কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনার জন্যই আমরা সবাই আকসাদকে ফিরে পেলাম৷ আপনি তখন উনাকে খুঁজতে না গেলে উনার সাথে হয়তো এর থেকেও বেশি কিছু হতে পারতো!’
ভিঞ্চি প্রাহীর কথায় মুচকি হেসে বললো,
– ‘ভাইয়া বলে আবার ধন্যবাদ দিচ্ছো! নট ফেয়ার!!!’
প্রাহী আলতো হাসলো। ভিঞ্চি দরজার দিক ইশারা করে বললো,
– ‘ভিতরে অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। যেয়ে দেখা করে এসো! এতক্ষণ তো বসে ছিলে কথা বলার জন্য! তাছাড়া তুমি তো আবার বাসায় যাবে তাইনা!
প্রাহী মাথা দুলালো। ভিঞ্চি হেসে চোখের ইশারায় ওকে যেতে বলে আকসাদের মায়ের দিক এগোলো। প্রাহী সেদিক এক পলক তাকিয়ে ধীর পায়ে আকসাদের কেবিনের দরজা খুলে সেখানে প্রবেশ করলো। আকসাদ বেডে হেলান দিয়ে বসা। মুখে অক্সিজেন মাস্ক আপাতত আর নেই। প্রাহী ভিতরে যেতেই ওকে হাত দিয়ে ইশারায় নিজের কাছে ডাকলো। প্রাহী ধীরচোখে কিছুক্ষণ আকসাদের দিক তাকিয়ে সেদিকে পা বাড়ালো। বেডের কাছের টুলটায় বসতেই আকসাদ প্রাহীর একটা হাত নিজের হাতের ভাজে নিলো। প্রাহী আকসাদের পায়ের ব্যান্ডেজ, হাতের দাগ, পায়ের কাটাছেড়ার উপর চোখ বুলাচ্ছে। প্রাহীর চোখ দিয়ে অজান্তেই পানি গড়িয়ে পড়ছে। আকসাদ প্রাহীর চোখের পানি মুছে দিতেই প্রাহী ভাঙাচোরা গলায় শুধালো,
– ‘এ…এ কি অবস্থা হয়েছে আপনার আকসাদ! আপনি কিভাবে এতগুলো বিপদের মাঝে নিজেকে ঝুকে দিলেন! এক…একটা বারের জন্য আমার কথা না হলেও নিজের পরিবারের কথাটা ভাবতেন? আপ…আপনি কি করে এমন…।’
আকসাদ প্রাহীকে সাথে সাথে টেনে নিজের বুকের মাঝে ওর মাথাটা রেখে বললো,
– ‘হিশ! প্রাহী! আর কেঁদো না প্লিজ! মা-বাবার পর তোমার এই ফোলা চেহারা আমায় বড্ড পোড়াচ্ছে প্রাহী! আমায় আর পুড়িয়ো না! এবার একটা থামো সোনা প্লিজ!’
প্রাহী চোখভেজা নিয়েই আকসাদের পড়নে হাসপাতালের নীল শার্টটা খামচে ধরে বললো,
– ‘আর আমার যে আপনি এতক্ষণ ধরে পুড়িয়েছেন! আপনার নিঁখোজ বার্তা, বিপদের আশংকা, খারাপ খবরের ছড়াছড়িগুলো যে আমায় দগ্ধ আগুনের ন্যায় পুড়িয়েছে সেটা!’
আকসাদ শান্ত গলায় প্রাহীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– ‘পুড়িয়েছি যেহেতু আমি তার মলম হিসেবে যতটুকু দরকার ততটুকু ভালোবাসা সহিত এই আমিটাকেই না হয় উজার করে দিব!’
প্রাহী ফোঁপাচ্ছে৷ আকসাদ ফের আকুল গলায় বললো,
– ‘আ’ম সরি প্রাহী! দিন দিন এভাবে বাবার উপর আসা ব্লেইম, ল্যাবের ভিতরকার ষড়যন্ত্র, স্টুডেন্টগুলোর মৃত্যু আর মেনে নাওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না! তাই সমস্যার গোড়া উপড়ে ফেলতে এই রিস্কটা নিয়েছি!’
প্রাহী মাথা তুলে বললো,
– ‘তাই বলে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে! তাইতো?’
আকসাদ কান ধরে বললো,
– ‘এইযে কান ধরেছি! আর হবেনা! ওকে! এবার থামো। চোখফুলে লাল করে ফেলেছো একদম?’
প্রাহী চোখমুছে গুমড়ে গলায় বললো,
– ‘আর এমন করলে খবর আছে!’
আকসাদ আলতো হেসে প্রাহীর মাথা সামনে এনে কপালে ঠোঁটের গাঢ় স্পর্শ দিয়ে বললো,
– ‘এইবার আমাকে চুমু দাও! কতদিন হয়ে গেছে বউয়ের আদর পাইনা বলো তো!’
প্রাহী ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
– ‘কতদিন মানে! একদিনই সেনা হয়েছে বাইরে ছিলেন!’
আকসাদ প্রাহীকে কাছে এনে বললো,
– ‘ওই একদিনই আমার কাছে বিশ দিনের সমান!’
বলেই আকসাদ ওর ঠোঁটদুটো চোক্ষা করে প্রাহীর দিক এগিয়ে দিলো। প্রাহী লাজুক হেসে আকসাদকে সরিয়ে দিতে দিতে বললো,
– ‘না এখন না। আপনি অসুস্থ। ওসব পড়ে হবে।’
আকসাদ প্রাহীকে আরও কাছে নিয়ে এসে বললো,
– ‘না এখনই।’
বলেই প্রিয়তমার লালচে অধরে আকসাদ তার পুরু অধর ডুবিয়ে দিলো। অনায়াসেই আকসাদের শার্টটা কুঁচকে ধরে প্রাহীও হাজারো দুঃখের পর কাঙ্ক্ষিত সুখের অতল মুহুর্তে ডুব দিলো।
,
,
,
– ‘একটু নিয়ে চলুন না!’
শিমলার কথায় নক্ষত্র এবার বিরক্তি ভঙ্গিতে বিছানায় বসে বললো,
– ‘রাত বাজে এগারোটা! এখন তোর ফুচকা খেতে মন চাচ্ছে! সর তো। ঘুমাতে দে।’
শিমলা চেঁচিয়ে বললো,
– ‘কি ঘুমাবেন! এখন তো ওই ফোনই দেখবেন! তার চেয়ে বরং আমাকে একটু ফুচকা খাইয়ে আনুন না!’
নক্ষত্র সন্দেহের নজর দিয়ে বললো,
– ‘কাহিনী কি বলতো! এখনও তো তোর পেটে আমি বাচ্চা দেইনি! তাহলে হুট করে এমন টক খেতে চাচ্ছিস কেন?’
শিমলা নক্ষত্রের এমন কথায় রেগে ওর বাহু বরাবর কিল বসিয়ে বললো,
– ‘ফালতু কথা ছাড়া মুখ দিয়ে ভালো কথা বের হয়না তাইনা! নিয়ে যাবেন না বললেই হয়! তা না করে যত বাজে কথা আপনার।’
শিমলা বিছানা থেকে নামতে গেলেই নক্ষত্র ওর হাত ধরে বললো,
– ‘রেডি হো! ফুচকার বদলে যাই চাবো দিতে হবে।’
শিমলা ফুচকার লোভে মাথা নেড়ে রেডি হতে চললো। নক্ষত্র সেদিক তাকিয়ে গায়ে কাপড় জড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে বাইকের চাবিটা হাতে নিলো।
গোপাগোপ মুখে ফুচকা দিয়ে খেয়ে চলেছে শিমলা। তার পাশে বসে নক্ষত্র ওর খাওয়ার দিক তাকিয়ে আছে। পারার এই মুহিন মামার ফুচকা বেশ ফেমাস ওদের এখানে। রাত বিরাতেও এই দোকান খোলা থাকে বিধায় অনেকেই আসে।
– ‘আস্তে খা। পরে বিষম খাবি।’
শিমলা একটা ফুচকা মুখে পুড়ে নক্ষত্রের দিক আরেকটা ফুচকা এগিয়ে দিয়ে বললো,
– ‘আপনিও একটা খান না! অনেক মজার?’
নক্ষত্র মাথা নেড়ে বললো,
– ‘না তুই খা। এসব আমি খাইনা।’
শিমলা ভ্রু কুঁচকে বললো,
– ‘আরে একটা নিন তো।’
বলেই জোড়পূর্বক নক্ষত্রের মুখে একটা ফুচকা দিয়ে দিলো। অগত্যা নক্ষত্র কিছুক্ষণ চাবিয়েই ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। অতিরিক্ত ঝালে ওর কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। ফুচকাটা কোনোরকম গিলেই ও মুখ খুলে ‘হু হা’ করতে লাগলো। শিমলা ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
– ‘বেশি ঝাল পেয়েছে!’
নক্ষত্র মাথা নাড়াতেই শিমলা দ্রুত ফুচকাওয়ালাকে বললো,
– ‘মামা পানি দিন তো!’
ফুচকাওয়ালা মামা পানি দিতেই নক্ষত্র কয়েকঢোক পানি গিলে শিমলার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘এত ঝাল খাস তুই! উফ। খাওয়া হয়েছে তোর উঠ এইবার।’
শিমলা অসহায় ভঙ্গিতে নক্ষত্রের দিক তাকিয়ে রইলো। ইশ্! ঝালে ছেলেটার ফর্সা মুখখানা কেমন লাল হয়ে গেছে!
বিল মিটিয়ে নক্ষত্র শিমলাকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়েছে। রাতের পরিবেশ টা ওর বেশ ভালো লাগছে। নক্ষত্রের কাঁধে এক হাত রেখে শিমলা রাতের এই দৃশ্য বেশ এঞ্জয় করছে। হুট করে একটা নিরিবিলি জায়গায় নক্ষত্র কিছুটা জোড়েই বাইক থামালো। শিমলা জিজ্ঞেস করলো,
– ‘কি হয়েছে!’
নক্ষত্র শিমলার ঝাল ফুচকা খেয়ে ফুলে উঠা ঠোঁটের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘আমার ঝাল কমছে না। সো এই ঝাল যেহেতু তুইই লাগিয়েছিস। তুই ই এটা কমাবি।’
বলেই নক্ষত্র শিমলার ঘাড়ে একহাত রেখে ওর মুখ টা কাছে এনে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। নক্ষত্ররর এহেন কান্ডে শিমলা বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো। রাস্তার মাঝে এই লোক এই কাজ করব্র এটা ও জীবনেও ভাবেনি! খোলামেলা বাতাস, আর রাস্তার নীরবতার মাঝে নক্ষত্রের এই জোড়ালো স্পর্শে শিমলা নিংড়ে গেলো।
খানিক বাদে নক্ষত্র ওর ঠোঁট ছেড়ে আলতো কন্ঠে বললো,
– ‘উম…ঝাল কিছুটা কমেছে!’
শিমলা লজ্জায় আর চোখ তুলে তাকালোনা। নক্ষত্র ওকে এভাবে দেখে বাঁকা হেসে বাইকে উঠে তা স্টার্ট দিলো। শীতল বাতাসে শিমলার বেশ ঠান্ডা লাগছে৷ তাই ও নক্ষত্রকে একটু চেঁপে ধরে বসতেই নক্ষত্রের গায়ের থেকে একটা মাতাল করা গন্ধ পেলো। নাক একটু এগিয়ে নক্ষত্রের ঘাড়ের কাছে এনে শুকতেই দেখলো এই ঘ্রাণ নক্ষত্রের শরীর থেকেই আসছে! শিমলা নক্ষত্রের কাঁধে মাথা রেখে অজান্তেই চোখ বুঝে বলে উঠলো,
– ‘আপনার গায়ের এই সুভাসটা আমার বেশ মনে ধরেছে নক্ষত্র!’
হেলমেটের ভিতরে নক্ষত্রের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। যেই হাসিতে ছিলো প্রেয়সীর একটুকরো আদুরে কথায় ভালোলাগার আভাস!
বাড়ি পৌঁছে রুমে ঢুকতেই শিমলা লাইট জ্বালাতে যাবে তখনই নক্ষত্র ওকে বলে উঠলো,
– ‘লাইট জ্বালাস না!’
শিমলা শুধু ফ্যানটা ছাড়তেই নক্ষত্র ওকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর উপর উঠে বললো,
– ‘আমার আজ বেশ ঝাল লেগেছে রে শিমলা! তাই তোকে আজ আমার লাগবে! রিমেমবার! বলেছিলাম ফুচকার বিনিময়ে যা চাইবো তা দিতে হবে!’
শিমলা লাজুক চোখে নক্ষত্রের দিক তাকাতেই নক্ষত্র খপ করে ওর নরম ঠোঁটজোড়া নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলো। শিমলা চোখ বুঝে সেই স্পর্শ অনুভব করতে থাকলো। ধীরে ধীরে সেই স্পর্শ আর গভীর হলো! শিমলাও আজ নিজেকে স্বামী নামক মানুষটার কাছে সপে দিলো! একদিন না একদিন নক্ষত্রের কাছে ওর ধরা দেওয়া লাগতোই! সেক্ষেত্রে আজই না হয় ও বরং ধরা দিলো! নক্ষত্র ওর গলার ভাঁজে মুখ গুজে দিতেই শিমলা নক্ষত্রের পিঠ খামচে ধরলো। রাত বাড়ছে, বাড়ছে নীরবতা। বাইরে থেকে আসা ঠান্ডা বাতাসে শিমলা যতবার কেঁপে উঠছে ততবার নক্ষত্র নিজের উষ্ণ স্পর্শ ওর গায়ে মাখতে ব্যস্ত! রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো তাদের ওই আদুরে উষ্ণ ছোঁয়া।
সকাল হতেই শিমলা চোখ খুলে দেখলো নক্ষত্র বিছানায় নেই! গায়ে চাদরটা জড়িয়ে অলস ভঙ্গিতে উঠে বসতেই দেখলো ওর থ্রী-পিস সব নিচে পড়ে আছে! লজ্জায় শিমলা এদিক ওদিক তাকালো। ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ ওর কানে আসতেই হুড়মুড়িয়ে ও চাদর নিজ গায়ে পেঁচিয়ে ধরে এক দৌড়ে নক্ষত্রকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ও দরজা আটকে দিলো। নক্ষত্র দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে শিমলাকে চিল্লিয়ে বললো,
– ‘কি সমস্যা তোর! মাথা গেছে নাকি!’
পরনের তাওয়াল ধরে নক্ষত্র মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
– ‘বেশি আদরে মাথা গেছে নাকি এর!’
,
,
,
বিকেলে শিমলা ছাদে ধোঁয়া উঠা চা নিয়ে নক্ষত্রের দিক এগিয়ে গেলো৷ চা এগিয়ে দিতেই নক্ষত্র তা হাতে নিয়ে শিমলা নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বসালো। আচমকা শিমলা নক্ষত্রের দিক ঘুরে…
চলবে,,,
[সবাই কমেন্ট করবেন কেমন!]