#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-১৮]
~আফিয়া আফরিন
জুহি সকাল সকাল টিউশনি শেষে অফিসে চলে এল। তামিমের সাথে দেখা করে বলল, তার কয়েকদিনের ছুটি দরকার। তামিম উত্তরে বলল, ‘জাহিন ভাই গত পরশু চলে গেল বোনের বিয়েতে, এখন তুমিও চলে গেলে চলবে কী করে?’
জুহি শান্ত কণ্ঠে ধীরস্থির ভাবে জবাব দিল, ‘আমাকে যেতে হবে তামিম ভাই।’
‘জাহিন ভাই আসুক, তারপর না হয়…!’
জুহি পুরো কথা শেষ করতে দিল না তামিমকে। মাঝপথে থামিয়ে বলল, ‘ছুটি টা না পেলে আমায় হয়ত এই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েই যেতে হবে তামিম ভাই। তবুও যেতেই হবে।’
তামিম অবাক হয়ে বলল, ‘কিছু হয়েছে জুহি? এনিথিং রং?’
‘না ভাই। ভালো থাকবেন। সবদিক একটু দেখেশুনে রাখবেন। আসছি আমি।’
জুহি চলে গেল। যাওয়ার আগে একবার শুধু মাহিদের সাথে দেখা করে গেল। জানাল, সে বাড়ি যাচ্ছে কিছুদিনের জন্য।
যাওয়ার আগে মাহিদকে একটা চিরকুটও দিল। দিয়ে বলল, এটা যেন সে রাফিকে দিয়ে দেয়। আর রাফি যদি জানতে চায়, জুহি কোথায় আছে এটা যেন কোনোভাবেই না বলে মাহিদ।
মাহিদ সন্দেহভাজন কন্ঠে জুহিকে জিজ্ঞেস করল, ‘হঠাৎ এ কথা কেন বলছিস? আর তুই’ই বা এতদিন পর হঠাৎ করে বাড়ি কেন যাচ্ছিস? রাফির কথা উঠছে কেন? রাফির সাথে তোর কী সম্পর্ক?’
‘কোনো সম্পর্ক নেই আবার অজানা একটা সম্পর্কে বাঁধা পড়ে গেছি। কিন্তু সব সম্পর্কের আগেই তো একটা পরিচয় দরকার হয়, আমার তো সেটাই নেই। যাইহোক, এত কথা জিজ্ঞেস করো না আমায়। দয়া করে আমার কথাগুলো রেখ। আর জিজ্ঞেস করলে না এতদিন পর হঠাৎ করে বাড়ি যাচ্ছি কেন? কেন আমার কি বাড়ি যাওয়া মানা? না গেলেও সমস্যা আবার গেলেও দেখি তোমাদের সমস্যা।’
মাহিদ উত্তরে কিছুই বলতে পারল না। শুধু অবাক হয়ে জুহির যাওয়ার পথে চেয়ে রইল। জুহি কী বলল না বলল, সবটাই মাথার উপর দিয়ে গেছে। ভাবনা চিন্তা ছেড়ে জুহি যে চিরকুটটা দিয়েছিল সেটা প্যান্টের পকেটে রেখে দিল, রাফির সাথে দেখা হলে দিয়ে দেওয়া যাবে।
.
রাফির সাথে জুহির দেখা করা ছিল বেলা বারোটায়। সেই বেলা পার হয়ে দুপুর গড়িয়ে গেল, দুপুর থেকে বিকেল গড়িয়ে গেল তবুও জুহির দেখা মিলল না। রাফি নিশ্চিত হয়ে গেল, গতকাল রাতে জুহি নিশ্চয়ই মায়ের কথাগুলো শুনেছে। রাফি তৎক্ষণাৎ ছুটল জুহির অ্যাপার্টমেন্টে। কিন্তু না, এখানেও জুহিকে পাওয়া গেল না; দরজাও বাহির থেকে তালা দেওয়া। বারবার ফোন করে গেল রাফি, কিন্তু জুহির কোন রেসপন্স পাওয়া গেল না। এমন সময় মাহিদের কথা মনে পড়ল তার। আর এক মুহূর্তও দেরি না করে ছুটল মাহিদের গন্তব্যস্থলে। পেয়েও গেল মাহিদকে।
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসায় রাফির ঘর্মাক্ত শরীর মাহিদের নজর এড়াল না। মনের মধ্যে আবার একটা প্রশ্ন ডঙ্কা বেজে উঠল, জুহির সাথে কী সম্পর্ক রাফির?
রাফি মাহিদকে জুহির কথা জিজ্ঞেস করতেই মাহিদ বলল, ‘ওর কথা আমি জানি না কই গেছে। কিন্তু সকালে এসেছিল, একটা চিরকুট দিয়ে বলে গেছে তোকে যেন দিয়ে দেই। তারপর কোথায় গেল বা কি হল, আমাকে কিছুই বলে যায়নি।’
‘দাও দাও চিরকুট টা দাও।’ হন্তদন্ত হয়ে বলল রাফি।
‘তার আগে কী আমাকে একটু বলবি, জুহির সাথে তোর কী সম্পর্ক? তুই এরকম হন্তদন্ত হয়ে জুহির খোঁজ কেন করছিস? আর জুহি কেন তোকে কোন চিরকুট লিখবে? বল আমায়।’
রাফির বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। সে কোনরূপ ভনিতা বিহীন সোজা সাপটা উত্তর দিল, ‘আমি উনাকে ভালোবাসি। কিন্তু মাঝখানে একটু ঝামেলা হয়েছে।’
রাফির ভালোবাসার কথা শুনে মাহিদের ভুরু আপনা আপনি উঁচু হয়ে গেল। ওষ্ঠ্যদ্বয় কিঞ্চিৎ উন্মুক্ত হলো।
একরাশ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি বললি? ভালোবাসিস, তাও আবার জুহিকে? আর জুহি, ও তোকে ভালোবাসে?’
‘জানিনা কিছু আমি। সবশেষ হয়ে বোধহয় ভাইয়া। সম্পর্কটা যখন একটু একটু করে গোছাতে শুরু হলো, তখনই একটা দমকা হাওয়া এসে সব শেষ করে দিল।’
মাহিদের বোধহয় অবাক হওয়ার ক্ষমতাও শেষ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকল। সে কি বলবে কিছু বুঝল না। রাফির কথা বিশ্বাস হচ্ছে না, আবার অবিশ্বাস করারও কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘জুহি যাওয়ার আগে আমায় কী কী যেন বলে গেল। আচ্ছা আগে এই চিরকুটটা নে। দেখ কী লেখা?’
রাফি হাত বাড়িয়ে চিরকুটটা নিল। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে,
—“যেখানে আমাদের রাস্তাটা আলাদা, সেখানে জীবনের গল্প এক হওয়ার তো কিঞ্চিৎ পরিমাণ সম্ভাবনাও নেই। উত্তর চেয়েছিলেন না? এইতো উত্তর। ভালো থাকবেন, আর আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করবেন না; এটা আপনার কাছে আমার একান্ত আদেশ এবং অনুরোধ রইল!”
ব্যাস এইটুকু লেখা। রাফি বেড়িয়ে এল। মাহিদ পিছু ডাকলেও সে কানে তুলল না। শুধু বিড়ডিড় করে বলল, ‘আপনি চাইলে উত্তরটা সুন্দর হতে পারত। আপনি চাইলে আজকের দিনটা আমায় শান্তি দিতে পারত। আপনি চাইলে আজকের এই দিনটাকে আমি জীবনের সেরা প্রাপ্তিতে স্বীকৃতি দিতে পারতাম। কিন্তু আপনি চাইলেন না। কেন চাইলেন না? আপনি একটাবার চাইলে সব কিছু সম্ভবত হতো।’
বিশাল এক অপ্রাপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরল রাফি। জুহি এমনিতেই চাপা স্বভাবের মানুষ। তাকে রাফি নিজেকে কী করে বোঝাবে? একবারও রাফির দিকটা ভাবার প্রয়োজন মনে করল না। নিজে কি না কি বুঝে, সব ছেড়ে চলে গেল এইভাবে? কী দরকার ছিল তাহলে দুইদিনের সামান্য পরিচয়ের? এসেছিল’ই যখন রাফি কেন ভালোবাসতে গেল? এই অনলে যে তাকে সারা জীবন জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হতে হবে। জীবন টা কী ভীষণ অসহায়!
.
জুহি ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বই পড়ছিল, উহু পড়ছিল না। পড়ার ভাণ করে ভাবছিল নিজের জীবনের কথা, নিজের ভাগ্য নিজের পরিচয় সবকিছুকে ধিক্কার জানাচ্ছিল বারবার। এভাবে বেঁচে না থাকলেও তো চলে! এতোদিন আটপৌরে জীবন ছিল তার, এই জীবনে ব্যক্তিগতভাবে মা ব্যতীত কোন দুঃখ তাকে স্পর্শ করতে পারে নাই। কিন্তু আজ, আজ তো রাফি নামক এক ব্যক্তিগত দুঃখ জীবনে লেপ্টে রয়ে গেল। কী করে নিস্তার পাওয়া যাবে এই দুঃখ থেকে? দুঃখের সঙ্গে আড়ি নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে, শূন্য হাতে ফিরে আসতে হল। দোষ কি সব জুহির একার? মা-বাবা ছাড়া কি পরিচয় হয় না? একটাবার যদি উত্তরটা পাওয়া যেতো! হ্যাঁ পাওয়া যেতেই পারে। এই উত্তর একমাত্র জুহির বাবা ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না। তারও সুন্দর একটা পরিবার হতে পারত, মা-বাবা নিয়ে সুন্দর সাজানো গোছানো একটা জীবন হতে পারত; কিন্তু কেন হলো না? এই জবাবদিহি তো করতেই হবে চৌধুরী সাহেবকে।
ভোরে ঠাণ্ডা হাওয়া, সকালে মিষ্টি রোদ, বিকেলের নীল আকাশের ক্যানভাসে থোকা থোকা সাদা মেঘের ভেলায় চড়া জুহির স্বপ্নটা যেন নিমিষেই দূর অজানায় হারিয়ে গেল।
হেমন্তের প্রৌঢ়ত্বের পরে এইবার যেন খুব তাড়াতাড়িই জড়তা গ্রস্ত শীত ঋতুর আবির্ভাব ঘটল প্রকৃতিতে। ভোরবেলায় ঘনকুয়াশার ধবল চাদরে প্রকৃতি ঢাকা পড়েছে। জুহি একটা চাদর গায়ে দিয়ে ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হিমেল হাওয়ায় ‘হাড় কাঁপানি শীত’ জেঁকে বসেছে শরীরের শিরায় শিরায়।
অদূরেই সরিষা ফুলের হলুদ ক্ষেত আর মৌমাছির গুঞ্জনের দৃশ্য মনকে খুব পুলকিত করে। আহা! কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে! শীতে শিশিরভেজা বনে জঙ্গলে একদল মৌমাছি মধু পেয়ে পাপিয়ারা পিয়া পিয়া বলে ডাকে গুনগুন করে, মহুয়া গাছের ফাঁকে ফাঁকে। কতোই মধুর সুরে কতো পাখিরা গায়; কতো না রঙিন ফুলের ডালে ডালে, বাঁশবনে ডাকে আপন খেয়ালে ঝুঁটিবাঁধা হরিয়ালী।
এতো মনোহরণী প্রকৃতির জুহি খুশি হতে পারছে না। বিষাদে ছেয়ে রয়েছে মন।
সে বিষাদ চিত্তে আপন মনে বলল, ‘মানুষ হারানোর যখন ভয় ছিল না, তখন ছিলাম স্বাধীন। অতঃপর এক মানুষ এল জীবনে, জীবনটাকে ভালোবাসা নামক শিকলে আবদ্ধ করে আমার গোটা দুনিয়াটা করে দিয়েছে পরাধীন।’
জুহি গুনগুন করতেই মামী পাশে এসে দাঁড়াল। দৃষ্টি সম্মুখে স্থাপন করে জুহিকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি রে মা মন খারাপ তোর?’
নিজের মনের খবর কাউকে কোনোভাবেই জানতে দিবে না জুহি। তাই সে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘না তো মামি। আচ্ছা মামা কই গেছে? কখন আসবে?’
‘ধান কাটা হচ্ছে তো, ঐদিকে গেছে। আসতে আসতে রাত হবে। কেন? কিছু বলবি?’
‘মামার সাথে একটু দরকার ছিল। আচ্ছা মামা আসুক। মিমি আবার কবে আসবে মামি?’ নিজেকে ব্যস্ত রাখতে অকারণ প্রশ্ন করল জুহি।
‘ওতো দিন দুয়েকখানেক আগেই এসে ঘুরে গেল। তুই দেখা করবি ওর সাথে? আসতে বলব আরেকবার? তোর কথা শুনলেই চলে আসবে।’
‘থাক এখনই বলো না, আমি তো আছি কয়েকদিন। সময় করে একদিন দেখা করব। আর নতুন শ্বশুরবাড়ি গেল এত ঘন ঘন বাপের বাড়ির আসলে তারা কি বলবে? তার চেয়ে যদি পারি আমি একদিন গিয়ে দেখা করে আসব।’
তাহেরার চোখ চকচক করে উঠল। তিনি জুহিকে শুধালেন, ‘তুই সত্যি যাবি জুহি? এক বছর পার হয়ে গেছে মিমির কত আফসোস তার বোন একবারও তার শ্বশুরবাড়ির সম্মুখে পা রাখল না। আচ্ছা একটা কথা বল দেখি আমায়। তুই হঠাৎ করে এখানে কেন? এরকম তো কখনো না জানিয়ে অথবা কোন অনুষ্ঠান ছাড়া আছিস না।’
‘মাঝেসাঝে কি নিয়মের ব্যাঘাত ঘটতে পারে না মামী? চলে এলাম হঠাৎ করেই, দেখলাম আমাকে পেয়ে তোমাদের উচ্ছ্বাস। আমায় এত ভালোবাসো কেন তোমরা? আরেকটু কম কম ভালোবাসলেই তো আমার কোন আফসোস থাকতো না।’ দীর্ঘশ্বাসের সহিত বলল জুহি।
‘বেশি ভালোবাসায় আফসোস আছে বুঝি?’ পাল্টা প্রশ্ন করলেন তিনি।
‘হু আছেই তো। এতো ভালোবাসো অথচ আমি তোমাদের জন্য কিছু করতে পারি না। নিজের কাছে নিজেকে কিছু কিছু সময় এত ছোট লাগে যা বলার বাহিরে।’ মাথা নিচু করে বলে জুহি।
‘সন্তানকে ভালোবাসার পেছনে মা-বাবা কি কখনো কোন প্রতিদান চায়? জুহি, তোর মা যেদিন তোর দায়িত্ব আমার কাছে দিয়ে যায় সেদিনই তোকে মেয়ে মেনে নিয়েছিলাম। আমি আমার মেয়েকে ভালোবেসেছি, কতটুকু ভালোবাসব নাকি মেপে মেপে আধা পরিমাণ ভালোবাসব, সেটাও আমার ব্যাপার।’
জুহি মামীর গলা জড়িয়ে ধরে হাসল। এই পৃথিবীর বুকে কতো সুন্দর একটা পরিচয় তার। তবুও, মানুষ বলে পরিচয় নেই। কেনো বলে? বেঁচে থাকতে হলে এই পরিচয়টুকুই তো যথেষ্ট। আর কত বড় পরিচয় হলে মানুষ মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করবে?
.
.
.
চলবে……
#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-১৯]
~আফিয়া আফরিন
রাফির দিনটা কাটল প্রচুর অস্থিরতায়। আশ্চর্য, সবকিছু তখন ঠিকঠাক ভাবে গুছিয়ে উঠতে নেয় তখন কেন আবার একটা ঝড় এসে সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে চলে যায়? এর কোনো উত্তর স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারো জানা নেই। কেউ পারবে না রাফির এই প্রশ্নের উত্তর দিতে।
কেমন যেন খুব অপরাধবোধ হচ্ছে, একটা মানুষকে ভালোবাসতে পারল অথচ ধরে রাখতে পারল না। এ কেমন ভালোবাসা? এমন ভালোবাসার জন্য রাফি তো ভালোবাসে নাই। জীবনের কিছু কিছু ব্যাপারে এত নিয়ন্ত্রণহীনতা থাকে! থাকুক সেটা রাফির সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে, অভ্যাস। মানুষ অভ্যাসের দাস। একটা মানুষের সাথে দিনের পর দিন চলাফেরা, কথাবার্তায় অভ্যস্থ হয়ে গেলে হুট করে সেই মানুষটার সান্নিধ্যহীন হয়ে গেলেই তো বহুত সমস্যা। জুহি তাকে বুঝল না। পৃথিবীর একটা মানুষও বুঝল না তাকে।
.
জুহি এসেছে শুনে মিমি কি আর থাকে? সেও সেদিনই রওনা হলো। অবশ্য বাসায় আগে থেকে বলে নাই। জুহিকে চমকে দেওয়ার জন্য শশুর বাড়ীর সকলকে ম্যানেজ করে চলে এল। মিমিকে দেখে জুহি আসলেই খুশি হলো। দু’বোনে মিলে অনেকক্ষণ গল্প হলো, আড্ডা হলো। মিমি যেহেতু ছিল তাই মামার কাছে জুহি আর নিজের কথা তুলতে পারে নাই। সময় সুযোগ বুঝে কাল কথা বললেই হবে।
সকালে দেখা গেল মাহিদ এসে হাজির। বাড়ির সবাই তো অবাক! এভাবে হুটহাট কেউ কখনো বাড়ি আসে না। মাহিদ এলে আগে থেকে জানিয়ে রাখে। আর জুহি তো স্বইচ্ছায় কখনো আসেই না। তাকে অনেক অনুরোধ করার পর সে হয়ত দুইদিন থেকে যাবে। কিন্তু এইবার, সব কেমন জানি এলোমেলো হচ্ছে। জুহির কথাবার্তার মধ্যেও রহস্য রহস্য ভাব, মনে হচ্ছে কিছু একটা গোপন করছে। আবার মাহিদকে এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে, সেও বলছে বেড়াতে এসেছে।
তাহেরা সোজা সরল মানুষ। এতো ঘোরপ্যাচ তার মাথায় খেলে না। সে সরল মনে রান্না ঘরে গিয়ে রান্নার আয়োজন করতে লাগলেন। তার ছেলে মেয়ে দুটো বাড়ি ফিরে এসেছে, এতোদিন পর তিনি ওদের মুখ দর্শন করতে পারছে এটাই তার কাছে অনেক।
সকালে নাস্তা শেষ করে মাহিদ এসে জুহিকে আলাদা ভাবে ডেকে নিয়ে গেল। জুহি জানে মাহিদের উৎকণ্ঠা, তার এখানে আসার কারণ। মাহিদ যখন তাকে ডেকে নিয়ে গেল তখনই সে নিজেকে ভেতরে ভেতরে গুছিয়ে নিয়েছিল।
মাহিদ খুব শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘ঘটনা কি খুলে বল আমায়।’
জুহি অন্য দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, ‘বলার মত তেমন কোন বিশেষ ঘটনা না ভাইয়া। তুমি কি শুধুমাত্র এই ঘটনা শোনার জন্যই ঢাকা থেকে চলে এসেছ?’
‘জানা উত্তর কে প্রশ্ন সাজাস কেন? তোকে আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দে। রাফির সাথে তোর কী? আর এসব কবে থেকে? আমরা একবারও টের পেলাম না? রাফি যখন আমাকে বলল, তখন তো পায়ের তলার মাটি সরে গেল। মানে তুই? জুহি তুই? আসলেই? সিরিয়াস? আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।’
জুহি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মাহিদের দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইয়া তুমি কি রাফিকে বলে দিছ, আমি এখানে আছি?’
‘না বলি নাই। তুই বলতে মানা করলি। রাফি তোকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই মামাবাড়ি আসছিস কিনা? বলেছি, না।’
‘আচ্ছা। ওকে বলো না আমার কথা।’
মাহিদ কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর ফের ডাকল, ‘জুহি!’
জুহি উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে তাকাল। মাহিদ জিজ্ঞেস করল, ‘ডু ইউ লাভ রাফি?’
‘জীবনে না চাইতেও অনেক কিছু হয়ে যায়। আবার কোনো জিনিস আমরা কান্নাকাটি করে হম্ভিতম্ভি করেও পাই না। সেখানে ভালোবাসা অনেক দূরের বিষয়। একদম ধরাছোঁয়ার বাইরে। জীবনের একমাত্র চাওয়াটুকু চেয়েও যেখানে পেলাম না, সেখানে কাউকে ভালোবাসার মত এত বড় স্পর্ধা দেখাব কী করে?’
জুহি উল্টো দিকে পা বাড়াল। মাহিদ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। একটা বাউন্ডুলে ছেলে, আর একদিকে একটা চাপা স্বভাবের মেয়ে। দুজনেই তার বড্ড প্রিয়, একদম কাছের মানুষ। একজন অসহায়ের মত অনুরোধ করছে, আরেকজন সেই অনুরোধ বড্ড কঠিনত্বে রূপ দিচ্ছে।
ফোনটা আবার বেজে উঠল মাহিদের। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল রাফি ফোন করেছে। নিশ্চয়ই জুহির কথা জানতে চাইবে। মাহিদ ফোন ধরল না। সাইলেন্ট করে রেখে দিল। সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করল—এইবার যেন জুহি তার জীবনে শান্তির দেখা পায়। একটা মানুষ জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। আর না! এতো কষ্টে তো মানুষ রোবটে পরিণত হয়। জুহি যে এখনো নিজের জায়গায় ঠিকঠাক আছে এটাই অনেক।
রাফি বারবার ফোন করছিল, মাহিদ একপ্রকার অতিষ্ঠ হয়েই ফোন রিসিভ করল। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাফি বলল, ‘ভাই জুহির কোন খবর পাইছ?’
মাহিদ গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘না।’
‘কোনো খোঁজ পাও নাই? কোথায় গেল উনি? তোমার এমন পরিচিত কোন জায়গা আছে যেখানে উনি যেতে পারে?’
‘আমার পরিচিত জায়গায় কেন ওর যেতে হবে? ওর নিজেরই বহুত পরিচিত জায়গা, গেছে হয়ত কোথাও! এত খুঁজিস না রাফি। ওর চলে আসার হলে ঠিক চলে আসবে।’
রাফি নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলে, ‘আসবে তো?’
‘আসবে না কেন? জুহি মানুষই তো। মানুষ কখনো হারাতে পারে না। তুই যদি ওকে সত্যিই ভালোবাসিস, ও যদি সত্যিই তোকে আপন ভেবে থাকে তবে সেই টানে টানে অবশ্যই ফিরবে। মানুষ ঘর ছাড়া বেশিদিন থাকতে পারে না। মানুষকে ফিরতেই হয়।’
জুহি ফিরবে, এই একবুক আশা রাফিকে আবার উদ্যমী করল। হতাশা মুক্ত হলো সে। কিন্তু বেশিক্ষণ পারল না নিজেকে ঠিক রাখতে। কবে ফিরবে জুহি? ভালো না বাসুক, একটাবার অন্তত চোখের দেখা দেক!
বিকালের দিকে হঠাৎ হইহই করতে করতে আদনান আর প্রান্ত এল। রাফির মন মেজাজ এমনিতেই ভালো ছিল না, তার উপর দু’জনের আউলাঝাউলা কথা আরও মাথা ব্যথা ধরিয়ে দিল।
দুজনের আলাপের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে ছিল মিতা। আদনান বলতে বলতে বলেই ফেলল, ‘ভাই আমি তো চার তলা পর্যন্ত উঠছি চোরের মত। আমি নিশ্চিত কেউ দেখলে চোর ভেবে গণপিটুনি দিত।’
রাফি শক্ত গলায় বলল, ‘কেন?’
‘কেন মানে কি? ওই যে মিতা ফিতার জন্য যে লুকিয়ে লুকিয়ে এলাম। মাইয়া কী ডেঞ্জারাস! এই মাইয়া আবার তোর পেছনে চরকির মতো ঘুরছে।’
‘তোদের ফাজলামি আমার ভালো লাগছে না। তোরা এখন যা। আমি একটু একা থাকতে চাই। আমার এসব কিছুই ভালো লাগছে না।’
‘প্রেমে পড়লে মানুষের বন্ধু-বান্ধব কোনটাই ভালো লাগে না। তুমি কি মনে করছ মামা তোমার কাহিনী কিছু জানিনা?’
রাফি অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, ‘কেমনে জানিস? আমি তো কাউকে কিছু বলি নাই।’
আদনান শার্টের কলার উঠিয়ে ভাব নেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘আমাদেরকে কিছু বলতে হয় না আমাদের কাছে সব সংবাদ নিজে নিজে পৌঁছে যায়। বাই দ্যা ওয়ে, আমাদের সাথে ভাবির পরিচয় করিয়ে না দিলে সে চলে তো যাবেই। সম্পর্কে আমরা দেওর, আমাদের একটা অধিকার আছে না?’
‘তোরা এত সব কিছু কিভাবে জানিস? কে বলেছে?’
‘এটা তো বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, তুই আমাদেরকে কেন বলিস নাই? আমরা কি তোকে সাহায্য করতাম না?’
রাফি বিষন্ন গলায় বলল, ‘আমি তোদের কি বলব? সে তো আমায় ভালোবাসে নাই। আমি ভালোবেসেছিলাম। একতরফা!’
‘ঘটনার বিস্তারিত আমি আন্টির কাছে শুনেছি। আসলে আন্টিও বুঝতে পারে নাই, জল এত দূর অব্দি গড়াবে।’
‘আমি ওকে কোথায় খুঁজে পাব বলতে পারিস?’ উত্তরের আশায় চেয়ে রইল রাফি।
আদনান হেসে বলল, ‘পাবি। এই পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্তেই আছে। পৃথিবী থেকে তো আর দূরে চলে যায় নাই। শুধু তোর থেকে একটু দূরে চলে গেছে।’
‘আমি কেন পৃথিবী হলাম না? আমি পৃথিবী হলেই তো সে আমার মধ্যে অবস্থান করত। শত অভিযোগ আর অভিমানেও, আমার পানে আশ্রয় নিত।’
‘যদি ভালোবাসা সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তোকে পৃথিবী হতে হবে না। তুই রাফি হয়েই থাক, ও ফিরে আসবে।’
‘আর যদি না আসে…..?’ রাফির কন্ঠে উৎকণ্ঠা।
‘তবে তুই ফিরিয়ে নিয়ে আসবি। দ্বিধার দেয়ালটাকে ভেঙ্গে ভালোবাসার সম্রাজ্য গড়ে তুলবি।’
রাফি আর কিছু বলে না। ভালোবাসা শব্দটা এই মূহুর্তে তার কাছে প্রচুর কঠিন মনে হচ্ছে। বাংলা যখন পড়েছিল তখন ভালোবাসা নামক এই শব্দটার সন্ধি বিচ্ছেদ এতটা কঠিন ছিল না! তবে আজকে কাউকে ভালোবাসার পর ভালোবাসা শব্দটাকে এত নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে কেন?
.
মাহিদ সেদিন দিনে দিনেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। তার কাজ শেষ, আগাম কোনো পরিকল্পনা করে আসে নাই, তাই তার যাওয়াটা বাধ্যতামূলক।
মাহিদ যাওয়ার পর জুহি মামার সাথে একটা আলোচনায় বসল। কথাটা তুলবে তুলবে করে, সময়ের অভাবে তুলতে পারছিল না। অবশেষে মামার সাথে কথা হলো, অজানা একটা বিষয় আবছা আবছা জানা হলো। একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। তার জীবনের এই চরম বাস্তবতার সামনে দাঁড়াতে সে প্রস্তুত। মনে মনে প্রহর গুনল। ঝড়ো হাওয়ার মত পেছনের কথাগুলো মনে পড়লেই তার মনে হয়, এই পৃথিবীতে সে একটা বাড়তি মানুষ। তার জন্মটাই ভুল, চরম ভুল।
.
.
.
চলবে……
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১২৩৭