মন কারিগর পর্ব-৩০+৩১

0
143

#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-৩০]
~আফিয়া আফরিন

রাফি আজ সময়ের অনেকটা আগেই বাড়ি ফিরল। ফিরে দেখল জুহি এখনো ফেরে নাই। মাকে জিজ্ঞেস করল। মা বললেন, ‘আমায় তো বলল দুপুরের মধ্যে ফিরে আসবে। ফিরল না কেন কে জানে? ফোন করে দেখ তো।’

‘ফোন করেছি মা। ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে।’

‘হয়তো ফোনের চার্জ শেষ। চলে আসবে, এতো অস্থির হোস না।’
রাফি তবুও স্থির হতে পারল না। ছুটে গেল জুহির অফিসে। এখানে এসে যা জানল, তাতে সে বাকরুদ্ধ! জুহি নাকি আজকে অফিসেই আসে নাই।
একজন জানাল, ‘আপুর তো আসার কথা ছিল। আপুর সাথে দেখা করব বলে সকাল থেকে অপেক্ষা করছি। আর এখন তো ফোনও বন্ধ।’

‘কিন্তু জুহি তো এগারোটা নাগাদ বের হয়েছিল। বলেছিল, অফিসে যাবে। গেল কোথায়?’ রাফি পাল্টা প্রশ্ন করল।
রাফি জুহিকে খুঁজে পাওয়ার কোনো উপায়-ই খুঁজে পেল না। অস্থিরচিত্তে ফোন করল মাহিদকে। মাহিদ ফোন রিসিভ করতেই বলল, ‘ভাইয়া জুহিকে খুঁজে পাচ্ছি না।’
রাফির কথার ধরনে মাহিদের হাসি পেয়ে গেল। এমন ভাবে কথাটা বলল মনে হচ্ছে, কোনো ছোটো বাচ্চা তার সবচেয়ে শখের জিনিসটা হারিয়ে ফেলেছে।
মাহিদ বলল, ‘কেন কোথায় গেছে? ফোন কর। আর এমন পাগলের মতো বউ বউ করে মরছিস কেন?’

‘আরে ভাই ফোন বন্ধ। সকালে বেরিয়েছিল অফিসে যাবে বলে। কিন্তু অফিসে খোঁজ নিলাম, ও এখানে আসে নাই।’ অস্থির কণ্ঠে বলল রাফি।

‘এ বাবা, তাহলে নিশ্চয়ই আমার বোনটা তোর অত্যাচারে পালিয়েছে। কী করেছিস রে রাফি?’

‘ভাই তুমি মজা করছ? এটা মজা করার সময় হলো? আরে আমি সিরিয়াসলি বলছি।’

‘আচ্ছা ভাই, তুই বাড়ি যা আমি আসতেছি। তারপর দেখতেছি ব্যাপারটা। তোর বউ তো ছোটো বাচ্চা না যে হারিয়ে যাবে। শান্ত হো।’

রাফি ফোন রেখে দিল। আশেপাশে উদ্দেশ্যহীনভাবে আরেকবার খুঁজল জুহিকে।
মাহিদ রাফির সাথে কথা বলতে বলতেই রওনা হলো এবং রাফি পৌঁছানোর আগেই সে রাফিদের বাড়ি পৌঁছে গেল।
সায়রা হক মাহিদকে দেখা মাত্রই জিজ্ঞেস করল, ‘রাফি কই? আর জুহি কোথায় গেছে জানো বাবা?’

‘রাফি আসতেছে আন্টি। আর জুহির কথা ঠিক বলতে পারতেছি না। তবে জুহি তো বাচ্চা মানুষ না যে হারিয়ে যাবে। হয়ত কোনো কাজে আটকে পড়েছে।’

‘হবে হয়ত।’ তিনিও বেশ ভাবনাগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন।

‘আপনার ছেলে যা পাগলামী শুরু করে দিয়েছে, বলার মতো নয়। আমাকে ফোন করে জ্বালিয়ে মেরেছে একদম। বুঝলেন আন্টি, আপনার ছেলে এখনো‌ বাচ্চাই রয়ে গেছে।’

‘তা তো বুঝিই বাবা।’
এমন সময় রাফি ঘরে ঢুকল। মাহিদের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর বড়ো বড়ো পা ফেলে ঘরে চলে গেল। মাহিদও পিছু পিছু যেতে নিয়ে থমকে গেল। তারপর সায়রা হকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ব্যাপারটা তারমানে ভীষণ সিরিয়াস তাইনা‌ আন্টি? আমি তো রাফির কথাগুলো মজা ভেবে উড়িয়ে দিচ্ছিলাম।’

‘হ্যাঁ। জুহি বলে গিয়েছিল দুপুরের পর ফিরবে অথচ এখন সন্ধ্যা হয়ে গেল। মেয়েটা ফিরল না কেন? কোনো বিপদ আপদে পড়ল না‌ তো আবার।’

‘আন্টি চিন্তা করবেন না। আমি দেখতেছি ব্যাপারটা। কোথায় আর যাবে? বন্ধু-বান্ধবও নাই তেমন একটা।’
মাহিদ ফের ডায়াল করল জুহির ফোন নাম্বারে। এইবারও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। কী আশ্চর্য, মেয়েটা গেল কোথায়?
এতক্ষণ পর্যন্ত সবাই ঠিকঠাক থাকলেও যখন রাত দশটা বেজে গেল, তখন আর কেউ ঠিক থাকতে পারল না।
রাফি পুরো ঘরের মধ্যে অস্থির ভাবে পায়চারি করছে। মাহিদ খানিকক্ষণ আগে বেরিয়েছে জাহিনের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ওর থেকে সম্ভাব্য কোন খোঁজখবর যদি পাওয়া যায়!
সায়রা হক মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। তার মনের মধ্যে নানান‌ ধরনের কু’চিন্তাভাবনা উঁকি দিচ্ছে। যদিও তিনি সেসব পাত্তা দিচ্ছেন না, তবুও বড্ড চিন্তা হচ্ছে মেয়েটার জন্য।
রাফি কী মনে করে মায়ের কাছে এগিয়ে এল। ধপাস করে পায়ের কাছে বসে পড়ল। তারপর মায়ের হাত ধরে আকুতি ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘মা তুমি কি জুহিকে আবার কিছু বলেছ যার কারণে ও বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারে? যদি বলে থাকো, তাহলে বলো মা। যে করেই হোক আমি আবার ওকে ফিরিয়ে আনব।’

সায়রা হক অবাক হলেন বটে। রাফির মাথায় এইসব চিন্তা-ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে? অবশ্য এইসব চিন্তা-ভাবনা ঘুরপাক খাবে নাই বা কেন? এর আগে তো তার আজেবাজে কথা শুনেই জুহি রাফির জীবন থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এইবার? এইবার কেন চলে গেল জুহি? আর কোথায়-ই বা গেল?

সায়রা হক রাফির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোর মা এতটাও খারাপ না যে তোর সুখ শান্তিতে নজর দিবে। ভালোই তো ছিল সকাল থেকে। এমনকি জুহি আমার কাছ থেকে বলেই গিয়েছিল।’
সকালের মুহূর্ত গুলো অনায়াসে মানসপটে ভেসে উঠল রাফির। সব তো ঠিকঠাকই ছিল। কতো সুন্দর মুহূর্তগুলো! এতো শান্তি ছেড়ে জুহি কোথায় চলে গেল?

মাহিদের এক বন্ধু পুলিশ ইন্সপেক্টর। জুহির কোনো খোঁজখবর না পেয়ে তার শরণাপন্ন হলো সবাই। এতক্ষণে খবরটা মামা মামীর কাছেও পৌঁছে গিয়েছে। তারা সেকেন্ডে সেকেন্ডে ফোন করছেন আর বারবার হতাশ হচ্ছেন। কোথাও গেল তাদের এতো আদরের মেয়েটা?

সারারাত অপেক্ষায় কেটে গেল। জুহি ফিরল না। রাতটা কাটল নির্ঘুম। এক একটা সেকেন্ড মনে হয় একেক ঘন্টায় রূপান্তরিত হল। বাজে সময়গুলো এতো চিরস্থায়ী কেন হয়? এমন একটা কাহিনী ঘটবে জানলে তো রাফি সব ছেড়েছুড়ে জুহিকে পাহারা দেওয়ার কাজেই লেগে পড়ত। বুকের মধ্যিখানে খুব শক্ত করে আগলে রাখত।
অপেক্ষার প্রহর ফের শুরু হলো। রাফি অপলক ঘড়ির কাটায় চেয়ে রয়েছে, কখন সমাপ্তি হবে এই নিষ্ঠুর সময়ের! অসাঢ় হয়ে পড়েছে বোধহয় সারা শরীর, বোধ বুদ্ধি ক্রমশূন্য হয়ে আসছে। ভালোবাসা নামক এই অমসৃণ পথে এতটাই বাঁধা? এত বাঁধা রাফি একলা সামাল দিবে কীভাবে? ক্ষীণ আশা, বিন্দু পরিমাণ সাহস আর এক মুঠো ভালোবাসা বোধহয় তাকে এই বাঁধার সামলানোর পথ বাতলে দিবে।
কিন্তু বুকভাঙ্গা কষ্ট, এই কষ্ট কীভাবে সামাল দেবে রাফি? বুকের পাঁজর গুলো ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। এতো ব্যাথা, এতোটাই যন্ত্রণা!
রাফি ফিসফিস করে তাচ্ছিল্যের স্বরে নিজেকেই উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তুমি হেমলোক বিষের চেয়েও বিষাক্ত জেনে সেই বিষ করেছি পান। এখন তুমি নামক এই বিষ তো আমার বুকপাঁজরে জ্বালা ধরাবেই। তবুও আমাকে বেঁচে থাকতে হবে, শুধু তোমার জন্য!’
.
একটা অন্ধকার ঘুপচি জাতীয় ঘরের দরজার ফাঁক গলিয়ে ঘরে আলো প্রবেশ করছে। সেই আলো চোখে পড়তেই সহসা জুহি চোখ মেলে তাকাল। চোখ মেলতেই জাগতিক সকল প্রকার অনুভূতি যেন জেঁকে বসল মাথার ভেতর। অসহ্য মাথা যন্ত্রণায় আবার নেত্রপল্লব মুদ্রিত হল। আবছা আলো অন্ধকারে বোঝার চেষ্টা করল সে কোথায় আছে। কিন্তু মস্তিষ্ক শূন্য। মাথাব্যথা ব্যতীত আর কিছুই সে অনুভব করতে পারছে না। কী অদ্ভুত মাথাযন্ত্রণা।
আরেকবার চোখ মেলে তাকাল জুহি। হঠাৎই মনে পড়ে গেল সবকিছু।
সে বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজ গন্তব্যে পৌঁছানোর কিছুটা আগেই একটা মধ্যবয়সী লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে তার কাছে। এসে বলে, সে গ্রাম থেকে শহরে এসেছে মেয়ে নিয়ে। তার মেয়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে, সামনের গলিতে অচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কিন্তু আশেপাশে সাহায্য করার মত কাউকে পাচ্ছে না।
তাই বাধ্য হয়ে জুহি ছুটে গেল কোনো কিছু না ভেবে। কিন্তু কোথায় কেউ? কেউ নেই। কারো সাহায্যও লাগবে না, আর কেউ অচেতন হয়ে পড়েও নেই। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকে মাথায় লোহা জাতীয় ভারী কিছুর আঘাতে জ্ঞান হারায় জুহি।
তার আর কিছুই মনে নেই। পরবর্তীতে নিজেকে আবিষ্কার করে এই ঘুপচি জাতীয় ঘরের মধ্যে।
কিন্তু জুহি বুঝতে পারছে না তাকে কেন ধরে আনা হয়েছে। কে এই গোপন শত্রু?
তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে জুহি মাথার পেছনে ঘাড়ের দিকটায় হাত বুলাল। রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে গেছে, স্পষ্ট বুঝতে পারল। জুহি দু’পায়ে সারা শরীরের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। নিঃশ্বাসও ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বড়ো বড়ো কয়েকটা শ্বাস নিল। মনে পড়ে গেল পরিবারের কথা, মা-বাবার সমতুল্য শশুর শাশুড়ির কথা আর একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ রাফির কথা। কি করছে তারা এখন? নিশ্চয়ই জুহিকে খুঁজছে। রাফি কী করছে? আজ সকাল সকাল তার বান্দরবান যাওয়ার কথা ছিল তো। গেছে নাকি জুহির জন্য আটকে গেছে?
জুহি আশেপাশে তাকাল। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কেউ কী নেই এইখানে? কে তাকে আটকে রেখেছে? এখন সে এখান থেকে মুক্তি পাবে কী করে?
জুহির ভাবনা চিন্তার শক্তি যখন ক্রমশ অসাঢ় হয়ে পড়ছিল, ঠিক তখন বাহিরে কিছু মানুষের কথার আওয়াজ শোনা‌ যাচ্ছিল। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলে জুহি। তেমন কিছু শুনতে পেল না, তবে একটা বুদ্ধি এঁটে ফেলল মস্তিষ্কে। জাগতিক সমস্ত যন্ত্রণা একপাশে সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা চক্কর দিল। জুহি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিল।
পুরো ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে যা যা দেখতে পেল তা হচ্ছে, বাম দিকের এক কোনায় শ্যাওলা ধরা কয়েকটা ইট বিছিয়ে রাখা হয়েছে। পাশেই কাঠের লাঠি জাতীয় কয়েকটা জিনিস। জুহি একমুহূর্ত দেরি করল না। একটা লাঠি তুলে নিয়ে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কেউ এলে এইটাই কাজে লাগাবে সে। কিন্তু ভাগ্য প্রসন্ন ছিল না। নিকটে থাকা পায়ের আওয়াজ গুলো অদূরে মিলিয়ে গেল। জুহি হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা চেপে বসে পড়ল। মুক্তির একটা উপায় তাকে খুঁজে বের করতেই হবে, যে করেই হোক।

জুহিকে খোঁজার কোনো চেষ্টা বাদ রাখে নাই তার পরিবার। চেনাজানা, আশেপাশে সমস্ত জায়গায় খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। এমনকি যশোরেও জুহির খোঁজ নেওয়া হয়েছে। জুহিকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে রাশেদ চৌধুরী বিচলিত হয়ে পড়লেন। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো, এটা যেনো জুতো মেরে গরু দানেরই সমান!
মাহিদ আর তার ইন্সপেক্টর বন্ধু রাকিব সমস্ত জায়গায় খোঁজখবর নিচ্ছে। জুহির ফোন নাম্বারও ট্রাক করা হয়েছে, কিন্তু লাস্ট যেখানে জুহির খোঁজ পাওয়া গেছে সেই জায়গাটা তন্নতন্ন‌ করে ফেলেছে রাফি। তার ইচ্ছে করছে হাঁকডাক ছেড়ে কাঁদতে। জীবনে এতোটা অসহায় পরিস্থিতিতে সে কখনো পড়েছে বলে তার মনে হয়। এরচেয়ে নিজে মরে গেলেই বোধহয় ভালো হতো।
রাফি বাড়ি ফিরে এসে সোজা ঘরে ঢুকে হাতের কাছে যা পেল তাই ভাঙচুর করল। ভয়ে তার ধারে কাছে আসার সাহস পেল না কেউ।
ইন্সপেক্টর রাকিব বিস্তারিত সব শুনে বলেছিল এটা কিডন্যাপ কেস। কিন্তু তদন্ত করেও কোন শত্রুর নাম সামনে এলো না।
একদম দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে জুহি সবাইকে। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। জুহি কী নিজের ইচ্ছে হারিয়ে গেল নাকি তাকে হারিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে?
সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো, কিন্তু যুক্তিযোগ্য উত্তর কারো কাছ থেকেই পাওয়া গেল।
অফিসে এসে জাহিনকে বারবার একটা প্রশ্নই করা হলো। সেটা হচ্ছে, জুহির কোন শত্রু আছে কিনা বা জুহির সাথে কারো কোন ছোটখাটো ঝামেলা আছে কিনা?
কিন্তু জাহিন ‘হ্যাঁ’ বোধক উত্তর দিতে পারল না। জুহির সাথে সে কাজ করছে অনেক দিন পর্যন্ত। কারো সাথে ছোটখাটো ঝামেলা হোক বা কথা কাটাকাটি হোক, সমস্তটাই জুহি জাহিনকে বলেছে। কিন্তু পুলিশকে বলার মত কোন কথাই জাহিন খুঁজে পেল না। জুহিকে কিডন্যাপ করার মত এমন শত্রু কে থাকতে পারে?
.
.
.
চলবে…..

#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-৩১]
~আফিয়া আফরিন

বেশ ভাল রকমের একটা পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই নারী ব্যবসা আরো আগে থেকেই চলমান। কিন্তু ইদানিং এর প্রকোপ আরো বেশি বেড়েছে। গ্রামের মেয়েদের প্রলোভন দেখিয়ে শহরে নিয়ে আসা, সহজ সরল মেয়েদের ভবিষ্যতে বড় কিছু হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে একজোট করা হচ্ছে। তারপর দেশের বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে বিদেশে। এই সময় তো ডাকাতির আরেক ধারা দেখা যাচ্ছে। উন্নত চিকিৎসার নাম করে মানুষের শরীরের বিভিন্ন দামী অংশগুলো রেখে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও রাস্তায় আশেপাশে এবং স্টেশনে বেড়ে ওঠা পরিচয়হীন ছোট বাচ্চাদের নিয়ে এসে পঙ্গু বানিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি চলছে। কে করবে এসবের প্রতিবাদ? এই চক্রের মূলে যারা আছে তাদের হাত অনেক লম্বা। তবুও সাহস করে এগোয় কয়েকজন। তারমধ্যে জুহিও একজন! “আমি নারী এই সংস্থাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল নারীদের নিয়ে কিছু করা। আর এটাই তো সমস্যা হয়ে দাঁড়াল সেই দুষ্কৃতিকারীদের।
বিগত এক মাস ধরে প্রায় ৩০ জন মেয়েকে বন্দী করা হয়েছে। এর মধ্যে গার্মেন্টস কর্মীদের সংখ্যাই অধিক। তবে জুহি তো ভোলাভালা মেয়ে নয়, কোনো কিছু দিয়ে তাকে ভুলিয়ে রাখা সম্ভব নয়। আজ পর্যন্ত তাকে যতটুকু চিনেছে, সে হচ্ছে প্রচন্ড একরোখা এবং জেদি— নিজের সিদ্ধান্তে অটুট থাকা টাইপের মেয়ে। তাকে বন্দি করার কোন উদ্দেশ্যই ছিল না। কিন্তু কী আর করার। মেয়ের ডানা বড় হয়ে যাচ্ছিল। তাই কাটতে তো হতোই।
‘পিপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে……পিপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে!’ আপন মনেই ফিসফিস করছিলেন লোকটা। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ ভেসে এল। উচ্চস্বরে বললেন, ‘কে?’

‘আমি স্যার।’ ওই পাশ থেকে উত্তর এল ক্ষীণ আওয়াজে।

‘ওহ ফরিদ নাকি? আসো আসো ভেতরে আসো। মনে মনে তোমাকেই চাচ্ছিলাম। ওইদিকে সব ঠিকঠাক? মেয়েটাকে জায়গা মতো রাখা হয়েছে?’

‘জি স্যার আপনার কথা মতো সব হয়েছে। তবে এখনো জ্ঞান ফেরে নাই।’

আচমকা তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘ও মেয়ের কৈ মাছের প্রাণ। চিন্তা করো না, এত সহজে মরবে না।’

‘স্যার আমরা কি কাল রওনা হবো? কথায় কথায় শুনলাম কাল নাকি রওনা হওয়ার কথা।’

‘হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ তুমি।’

‘কিন্তু স্যার এই মেয়েটার কিডনাপিং এর খবর প্রায় সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। এই অবস্থায় আমরা যদি কাল বের হই, ব্যাপারটা আমাদের জন্য রিক্স হয়ে যাচ্ছে। হাতে একটু সময় নিয়ে কিছুদিন অপেক্ষা করে গেলে হয় না?’

তিনি হাত উঠিয়ে ফরিদ নামের লোকটাকে থামিয়ে দিলেন। কড়া গলায় বললেন, ‘আমাকে উপদেশ দেওয়া আমার মোটেও পছন্দ নয়।’
ফরিদ তাই চুপ করে গেল। কিন্তু তারা কেউ স্যারের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে না। প্রতিটা মেয়েকে আনার পেছনে একটা উদ্দেশ্য থাকে, সেই প্রতিটা উদ্দেশ্য স্যার তাদের বলে। কিন্তু এই মেয়েটা সম্পর্কে এখনো কোনো পরিকল্পনা কারোরই জানা হয় নাই। বাকি ২৯ জন মেয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেছে, বাকি আছে শুধু জুহি! কে জানে কী হবে?
.
তদন্ত করতে করতে একটা চাঞ্চল্যকর খবর বেরিয়ে এসেছে। হঠাৎ করেই জাহিনের মনে পড়েছে, বিগত কিছুদিন আগে তাদের সংস্থা থেকে দুটো মেয়ে হঠাৎ করে গায়েব হয়ে গেছে। সেটা তখন মাথায় আসে নাই কিন্তু যখন মনে পড়ল তৎক্ষণাৎ পুলিশকে জানানো হল। ইন্সপেক্টর সেই মোতাবেক তাদের বাড়িতে খোঁজখবর নিলেন। দুটো পরিবার থেকেই থানায় মিসিং কমপ্লেইন করা হয়েছিল, কিন্তু মিসিং রহস্য আজও সমাধান হয় নাই। থানা থেকে নাকি তাদের পরিবারকে বলা হয়েছিল, ‘এরা নিজের ইচ্ছায় হারিয়েছে এদের আর হাজার খুঁজলেও কখনো পাওয়া যাবে না। দেখা গেল, নিজের বয়ফ্রেন্ডের সাথে কোনো চিপাচাপির মধ্যে গিয়ে বসে আছে।’
পুলিশের কথার প্রতি উত্তর কিছু বলার সাহস পাইনি সোজা সরল পরিবার। মেনে নিয়েছে সত্যিটা।
তদন্ত করতে গিয়ে অনেকের নাম সামনে এল। কিন্তু এর মধ্যে আসল অপরাধী কে, তার নাগাল পাওয়া গেল না খুব সহজেই। এইদিকে সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে, কিন্তু সুরাহা হচ্ছে না কোনোকিছুর। ইন্সপেক্টর শহরের প্রতিটা স্টেশনে পাহারা বসিয়েছেন। এছাড়াও বর্ডারে ব্যবস্থা করেছেন আলাদা নিরাপত্তা। তারা ধারণা করেই নিয়েছে, জুহি কোনো নারী পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়েছে।
.
এইদিকে জুহির বাড়ির মানুষগুলো হয়েছে জীর্ণশীর্ণ দশা। মামা মামী সমানে কান্নাকাটি করে যাচ্ছেন, মাহিদ তাদের সামলানোর চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। তার নিজেরও মন মানছে না। অজানা বিপদের ভয়ে বুক কাঁপছে খুব। এই মুহূর্তে জুহিকে নিয়ে সে যতটা না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত রাফিকে নিয়ে। ছেলেটার উপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা আন্দাজ করা মুশকিল। দুটো শান্তনা বাক্য শোনানোর ও জো নেই। সে দুয়ারে খিল দিয়ে বসেছে। একটাই কথা, জুহি না ফেরা পর্যন্ত আমি এই ঘর ছেড়ে বের হবো না।
সায়রা হক আপাতত শান্ত রয়েছেন, তবে মনে মনে প্রার্থনা নিশ্চয়ই করছেন। খানিকটা চাপা অভিমান করেছেন ছেলের কথায়। রাফি ওমন কঠিন কথা কী করে বলতে পারল ভেবে পেলেন না তিনি। ভুল না হয় একবার করেছেন। সেই ভুলের মাশুল ও পেয়েছেন। সে ভুলের শাস্তি অশান্তি, ভালো না থাকা— সেই ভুল দ্বিতীয় বার করার মত এত বড় বোকা তো তিনি নন। তবে ছেলের প্রতি এই অভিমান বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেন না। ছেলের করুণ পরিণতি দেখে ফের ছুটে যান। রাফি কিছু বলে না। নির্বিকার থাকে, অতিরিক্ত শান্ততা তার মধ্যে। জীবনে একটু ভালো থাকার প্রয়াস তার নিজের মানুষগুলোকে নিয়ে। অথচ জীবন সেই সুযোগটাই দিচ্ছে না? শুনেছিল, চাওয়া নাকি অতিরিক্ত হলে সে চাওয়া কখনো পূরণ হয় না। তবে জীবনে ভালো থাকার চাওয়া টা কি রাফির অতিরিক্ত হয়ে গেল?
শুধু কেন তার সাথে হচ্ছে এসব? কত কষ্টের পর মানুষটাকে নিজের করতে পেরেছে। কত কষ্টের পর দুজনের ভালোবাসা স্বীকৃতি পেয়েছে। কত কষ্টের পর একে অপরকে বরণ করেছে। এই কষ্টের কোন মূল্য নেই? এতটাই মূল্যহীন সব? মানুষের চেয়ে তো আজকাল ভালোবাসাকে বেশি মূল্যহীন মনে হয়!
.
এত দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও জুহির জ্ঞান না ফিরায় ফরিদ উদ্বীগ্ন হয়ে উঠল। সে আবার ছুটে গেল তার কাছে। গিয়ে বলল, ‘স্যার আপনি তো বলছিলেন মেয়েটার ঠিকঠাক মত খেয়াল রাখতে। কিন্তু ওর তো এখনো জ্ঞান ফিরে নাই। কী করব?’

তিনি কুটিল হেসে জবাব দিলেন, ‘ঠিকঠাকমতো খেয়াল রাখতে বলেছি মানে তুমি কি বুঝেছ বলো তো ফরিদ? তুমি কি ভেবেছ, ঠিকঠাক মত খেয়াল রাখা মানে তিন বেলা ফাইভ স্টার থেকে খাবার নিয়ে এসে ওকে খাওয়ানো? উঁহু। খেয়াল রাখতে বলেছি মানে, মেয়েটা যেন কোনোভাবেই পালাতে না পারে।’

‘কিন্তু স্যার…..’
ফরিদকে থামিয়ে দিলেন তিনি। বললেন, ‘বললাম না কৈ মাছের প্রান। সহজে মরবে বলে মনে হয় না। আর যদি কারণবশত সাথে মরেও যায়, তবে ওই দিকের গোরস্থানে গিয়ে মাটি চাপা দিয়ে দিও। আর বেঁচে থাকলে তো দেখা হবেই। হাহ হাহ। মেয়ে খুব সেয়ানা। এত সেয়ানা মানুষকে খাঁচায় আটকে রাখতে হয়। এদের বেশি বাইরে বের হতে দিলে, এরা গোটা দুনিয়াকে সেয়ানা বানিয়ে দিবে। কি বলো ফরিদ, ঠিক বলেছি না আমি?’ তিনি সম্মতির আশায় ফরিদের দিকে চেয়ে রইলেন।

ফরিদ আমতা আমতা করে বলল, ‘জি জি স্যার।’
তারপর তিনি আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। তার ঘর কাঁপানো হাসির শব্দে ফরিদ নিজেও ভয় পেয়ে গেল। এই লোকটার সাথে এত বছর ধরে কাজ করার পরও, দিনদিন যেন শুধু ইনার নতুন নতুন রূপ বের হয়। বড্ড ভয়ংকর সেসব রূপ!
ফরিদ নিজের কাজে ছুটল। আপাতত তার একমাত্র কাজ হল জুহিকে পাহারা দেওয়া। সত্যিকার অর্থে সে আসলেই ভীষণ চিন্তিত, এত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও মেয়েটার জ্ঞান কেন ফিরছে না? একবার কি চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দেখবে? ইচ্ছে করলেও সে ইচ্ছেটাকে চাপা দিল। মেয়েটার মুখখানা বড্ড বেশিই মায়াবী। এমন মায়াবী একটা মেয়েকে এভাবে আটকে রাখার কারণ কি সে জানে না। জানতেও চায় না। শুধু একনিষ্ঠ মনে দায়বদ্ধতা থেকে তার নিজের কাজ করে।
ভারত যাওয়ার সময় পেছানো হলো। কারণ বর্ডারে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্যে কোনভাবে বর্ডার ক্রস করতে গেলে নিশ্চয়ই দলের সবাই মারা পড়বে। আপাতত কোন রকম রিক্স নিতে চাইছেন না তিনি। বাঙালি তো তালের পাগল, এটা তার বেশ ভালো করেই জানা আছে। একদিন দুইদিন কেটে যাক, তারপর এই তালও কেটে যাবে। তখন বরং আবার নতুন করে পরিকল্পনা সাজানো যাবে।
.
ভালোবাসা শব্দটার মধ্যে যে এক ধরনের আক্রোশও লুকিয়ে আছে, তা রাফিই এইবার দেখিয়ে দিল। ইন্সপেক্টর রাকিবকে উদ্দেশ্যে করে বলল, ‘কি করছেন আপনারা? আপনি আর আপনার টিম পুরোপুরি ব্যর্থ। দুটো দিন তো গত হল, একটা খবর আপনারা দিতে পেরেছেন? পুলিশের চাকরি কেন করছেন? আপনাদের তো সব দিক দিয়েই সুবিধা, মাস গেলে ঠিকই পকেটে টাকা আসছে। খাওয়া, পড়া, থাকার কোন সমস্যা নেই। তারপর যত ভোগান্তি সব আমাদের মতো সাধারণ জনগণের। আপনারা আছেন কিসের জন্য? কার জন্য? ইউনিফর্মটার ইজ্জত নষ্ট করছেন প্রতিনিয়ত!’
আসলেই বলার মত কিছু নেই। তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। কিন্তু হঠাৎ এসে যাওয়া কিছু খবর বারবার এলোমেলো করে দিচ্ছে।
ইন্সপেক্টর রাফিকে কথা দিয়ে এলেন, তারা খুব শীঘ্রই জুহিকে খুঁজে বের করবেন।
রাফি জানে না, এই খুব শীঘ্রই দিনটি কবে আসবে? সে অপেক্ষা করছে। অপেক্ষায় কেটে গেল আরও একটা দিন!
.
.
.
চলবে…..