মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব-৪৯+৫০+৫১

0
583

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৪৯

মীরা রুশমির চিপসের প্যাকেট থেকে একটা একটা করে চিপস খেতে খেতে প্রায় সবটাই খেয়ে নিয়েছে। তার মনোযোগ ফোনে ছিল। কখন চিপস শেষ হয়ে গেছে খেয়ালই করল না। এদিকে চিপস শেষ হয়ে যাওয়ায় রুশমি কান্না শুরু করে দিয়েছে। বেচারি মীরা ফেঁসে গেল। সে কোনভাবেই রুশমির কান্না থামাতে পারছে না।

“সোনা ময়না লক্ষী বোন আমার। কাঁদিস না। আমি তোকে অনেকগুলো চিপস এনে দেব। প্রমিজ। কাঁদে না টিয়া পাখির ছাও।”

“তুমি পঁচা। আমাল তিপস খেয়ে ফেলেছ। মিশি না।”

“মিশতে হবে না। তবুও তুই কাঁদিস না। কার্টুন দেখবি? এই নে, আমার ফোন তোকে দিয়ে দিলাম। তবুও কাঁদে না শালিকের ছাও।”

যেমন তেমন করে রুমশিকে শান্ত করতে পেরে মীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আজকালকার পোলাপান গুলাও! ভদ্রতা বুঝে না। বড়ো বোন একটু চিপসই তো খেয়ে নিয়েছে। তার জন্য এভাবে কাঁদতে হবে? মীরা রুশমিকে কোলে বসিয়ে ফেসবুকে ভিডিও দেখছে। বন্ধুরা তাকে গ্রুপে ডাকছে।

“রুশমি পেঁচার ছাও। গিয়ে দেখ তো মাহা বাবু কী করে। মাহা বাবুকে একটা আদর নিয়ে এসো। দৌড়ে যাও।”

রুশমি চলে গেলে মীরা গ্রুপে ঢুকলো। সবাই কিসের যেন একটা লিংক দিচ্ছে। মীরা লিংকে ঢুকে পুরা থ! মুবিন ভাইদের গানের দলটার একটা ভিডিও প্রচুর ভাইরাল হচ্ছে। সেখানে মুবিন ভাইকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সবাই কত প্রশংসা করছে। মীরাকে দেখেই কয়েকজন ম্যানশন করে বলতে লাগল,

“তোর স্যার তো রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে গেছে রে মীরা। এখন কি আর তুই আমাদের পাত্তা দিবি? হায়, মুবিন ভাই যে এত সুন্দর গান গাইতে পারে আমরা জানতামই না। মানুষ কত কত শেয়ার করছে!”

মীরা খুশিতে চিল্লিয়ে দু’মিনিটে সবাইকে একসাথে করে ফেলল। এই মেয়েকে নিয়ে আর পারা যায় না। এর গলায় সৃষ্টিকর্তা মাইক ফিট করে দিয়েছে। চিল্লাচিল্লি থামেই না।

“তোমরা কই গো। সবাই তাড়াতাড়ি আসো। এসে দেখে যাও।”

আবিরের সাথে তনির ঝগড়া চলছে তাই তার মেজাজ ভালো না। তনি এসেই ধমক লাগালো।

“কী হয়েছে? ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন?”

“কী হয়নি সেটা বলো! আমার স্যার এখন সেলিব্রিটি। তোমরা তার অটোগ্রাফের জন্য আমাকে ধরবে। কিন্তু কোন লাভ হবে না।”

” আবোলতাবোল বলার জন্য ডেকেছিস? লা’থি খাবি বলে রাখলাম।”

সবাই চলে এলে মীরা মুবিন ভাইয়ের ভিডিওটা সবাইকে দেখাল। মা, চাচীরা কেউ বিশ্বাসই করতে পারল না মুবিন এত সুন্দর গান গায়। ছোট চাচী বলল,

“ছেলেটার গুণের শেষ নেই। পড়াশোনাতে যেমন ভালো। অন্যান্য দিক দিয়েও ফেলে দেওয়া যায় না। কী ভালো গলা!”

বড়মাও বলল,

“সত্যিই। আমরা তো মুবিনের এই গুণের কথা জানতামই না।”

ভিডিওটা দেখে, সবার এতো প্রশংসা শুনে গর্বে ইভার বুকটা ভরে যাচ্ছে। মুবিনটা এতদূর এগিয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি। তনি এতক্ষণে ভিডিওটা চার পাঁচ বার দেখে ফেলেছে।

“তোর মনে আছে মীরা, ভাবীর বিয়ের আগে একদিন আমরা সবাই ছাঁদে আড্ডা দিয়েছিলাম। মুবিন সেদিন গান করেছিল। প্রথমে তো রাজিই হচ্ছিল না। সবাই চেপে ধরায় শোনালো। এই ছেলে যে ছোপা রুস্তম বের হবে ভাবতেই পারিনি।”

মীরা গর্বে মাটি থেকে দু-হাত উপরে উড়ে ভাব নিয়ে বলল,

“তোমরা না জানো। আমি সব জানতাম। মুবিন ভাই তো আমাকে সবই জানাতো। পাঁচ জন সদস্যের এদের একটা গানের দল আছে। ওদের প্রথম গানও এই মাসেই বেরুবে।”

“তুই আগে থেকেই জানতি!”

“অবশ্যই। তোমরা আমাকে কী ভেবেছ বলো তো? ফিউচারে আমি মুবিন ভাইয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট হবো। তখন তো ওর সাথে দেখা করার জন্য আমার থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে।”

হঠাৎ মীরার মনে পড়ল, কইতরি কি এই খবরটা শুনেছে? এই ভিডিও দেখে থাকলে এতক্ষণে হয়তো খুশিতে পাগল হয়ে কয়েকবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। মাহিমাকে জানানোর জন্য মীরা ফোন হাতে দৌড়ে রুমে চলে গেল। ইভা মা’র কাছে কল করলো।

….

জায়িন সোস্যাল মিডিয়ায় তেমন এক্টিভ থাকে না বিধায় মুবিনের ভিডিওটা তার দেখা হয়নি। এমনকি এই ব্যাপারে সে কিছুই জানে না। পুরোটা দুপুর ঘুমিয়ে কাটলো। মুবিন বাড়ি নেই। বিকেলে জায়িন ঘুমিয়েছিল। তার ঘুম ভাঙলো বাবার গলা শুনে। বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই জায়িন ঘুম ঘুম চোখ মেলে কান পেতে শুনতে চাইল বাবা কার সাথে এত রেগে কথা বলছে। মা’র সাথে নিশ্চয় বলবে না। কারণ এতগুলো বছরেও জায়িন কোনদিন বাবা মা’র ঝগড়া হতে দেখেনি। মা যত বড়ো অন্যায়, অপরাধই করে ফেলুক বাবা কোনদিন কঠিন কন্ঠে মা’র সাথে কথা বলেনি। জায়িন হালকা হালকা শুনতে পেলো।

“এত এত টাকা খরচ করে তোকে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি করিয়েছিলাম। তুই পড়াশোনা না করে এসব করে বেড়াচ্ছিস!”

বাবার কথার প্রতিত্তোরে মুবিনও জোরে জোরে বলছে,

“তোমার ইচ্ছে ছিল আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। আমি একবারও বলিনি ইঞ্জিনিয়ারিং করব। তুমি নিজের ইচ্ছে আমার উপর চাপিয়েছিলে।

“আমার বাড়িতে থাকতে হলে আমার কথা মতোই চলতে হবে। নইলে নিজের রাস্তা দেখে নিতে পারো। লায়েক হয়ে গেছ এখন। নিজেরটাও করে খেতে পারবে।”

“থাকব না তোমার বাড়িতে। তাছাড়াও এটা বাড়ি কম জেলখানাই বেশি। এখানের জেলার তুমি। আর আমরা তোমার কয়েদি। তুমি চাও তোমার কথাই যেন শেষ কথা হয়। হোক সেটা ভুল।”

“তুই আমাকে ঠিক ভুল শেখাচ্ছিস!”

“সন্তান ভুল করলে বাবা মা-ই তো সঠিকটা শেখায়। বাবা মা’র ক্ষেত্রেও যদি সন্তান এই কাজটা করতে পারত!”

জায়িন উঠে বসল। তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে নেমে গেল। বাবা মুবিনের উপর চোটপাট করছে এটা আর পাঁচটা দিনের মতোই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু আজ মুবিনও বাবার সাথে রাগ দেখাচ্ছে। তার মানে অবস্থা গুরুতর। কিছু তো হয়েছে।
জায়িন বেরিয়ে আসতে আসতেই মায়ের গলাও শোনা গেল।

“কী করছো তোমরা? বাবা ছেলে মিলে অবুঝের মতো ঝগড়া করে যাচ্ছ।”

“ঝগড়া আমি করছি! তোমার ছেলের আচরণ চোখে পড়ছে না তোমার? বাবার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় মিনিমাম শিক্ষাটুকু জানা নেই। ওকে বলে দাও সুমনা, নিজের মন মর্জি করতে হলে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় যেন।”

“দূর! থাকলাম না তোমার বাড়িতে। তোমার বাড়ি এমনও কোন রাজপ্রাসাদ না।”

“হ্যাঁ যাও যাও। মাথার উপর ছাঁদ না থাকলেই বুঝতে পারবে তুমি যতটা ভাবছো জীবন ততটা সহজ নয়।”

“দরকার পড়লে আমি গাছ তলায় থাকব। তবুও তোমার বাড়িতে থেকে চব্বিশ ঘণ্টায় চব্বিশ বার তোমার খোঁটা শুনতে পারব না।”

মুবিন একথা বলে ঘরে চলে গেল। জায়িনকে দেখে সুমনা যেন ভরসা খুঁজে পেল। বড়ো ছেলেই বাবা ছেলের মধ্যকার এই দ্বন্দ্ব মেটাতে পারবে। জায়িন কিছুই বুঝতে পারছে না। কয় ঘন্টা ঘুমিয়েছে সে? ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তো সব ঠিকই ছিল। এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে কী এমন হয়ে গেল!

“মা কী হচ্ছে এসব?”

“দেখ না বাবা। তোর বাবা আর ভাই মিলে কী শুরু করেছে। আমার কোন কথাই শুনছে না। তুই একটু বোঝা বাবা।”

“হ্যাঁ, কিন্তু কী হয়েছে সেটা তো বলবে?”

মুবিন ব্যাগ গুছিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সুমনা ছেলের হাতে ব্যাগ দেখেই হাহুতাশ করতে লাগলেন। জায়িন ঘটনা পুরোটা না জানলেও বড়ো ভাই হিসেবে মুবিনকে শাসন করে বলল,

“কী হচ্ছে কী মুবিন? অনেক বড়ো হয়ে গেছিস না? ব্যাগ ঘরে রেখে আয়।”

মুবিন আজ কারো কথাই শুনবে না। যে বাড়িতে তার নিজের ইচ্ছের কোন দাম নেই সেই বাড়িতে থাকার চেয়ে ফুটপাতে রাত কাটানো ভালো। জামান হোসেন মুবিনের রাগের আগুনে ঘি ঢাকার কাজ করে বলে উঠলেন,

“আহা যেতে দাও। যাক, বাইরের জগতটা দেখে আসুক। দুদিনেই স্বপ্নের পেছনে ছোটার নেশা কেটে যাবে। তখন সুরসুর করে নিজে থেকেই বাড়ি ফিরে আসবে।”

জায়িন কাউকেই থামাতে পারছে না। বাবা থামার নামই নিচ্ছে না। আজ মুবিনও ছেলে মানুষী করা থেকে পিছু হাঁটবে না। তার স্বপ্ন নিয়ে বাবার এরকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য শুনে মুবিন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল, এই বাড়িতে আর না। মুবিন চলে যেতে নিলে জামান হোসেন আবার বললেন,

“অহো তুমি যে ব্যাগটা নিয়ে যাচ্ছ সেটাও আমার টাকায় কেনা। ব্যাগের ভেতর যে জামাকাপড় গুলো নিয়েছ সেগুলোও আমি কিনে দিয়েছি।”

মুবিন বাবার মুখের উপর কিছু বলার আগেই তার ফোন বেজে উঠল। জামান হোসেন তাচ্ছিল্য করে হেসে বললেন,

“তোমার নিকর্মা বন্ধুরা যে ফোনে কল করছে সে ফোটাও আমারই টাকায় কেনা।”

বাবার এসব কথা মুবিনের আত্মসম্মানে আঘাত করছে। সে হাতের ব্যাগ, ফোন সব টেবিলের উপর রেখে দিল। জায়িন হতাশ হয়ে বাবার ছেলেমানুষী দেখছে। বাবা ইচ্ছে করে মুবিনকে ক্ষেপিয়ে দিচ্ছে বেশ বুঝতে পারছে। মুবিন দুপা হেঁটে বাবার সামনে এসে দাঁড়াল। এবার ওর কন্ঠে রাগ নেই। বরং চ্যালেঞ্জ দেওয়া গলায় বলল,

“তুমি ভাইয়াকে কন্ট্রোল করতে পারো। কিন্তু আমাকে পারবে না। আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমি নিজে নিব। ভবিষ্যতে গিয়ে ওই সিদ্ধান্ত ভুল হলেও আমি পস্তাব না। কারণ সিদ্ধান্তটা আমার ছিল। কিন্তু তোমার চাওয়া মতো জীবনে যদি আমি প্রতিষ্ঠিত হয়েও যাই তবুও আমার আফসোস থাকবে। কারণ আমি নিজের ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা, শখকে গুরুত্ব দিইনি। বরং তোমাকে খুশি করতে গিয়ে নিজের খুশিকে গলা টিপে হত্যা করে সেই অবস্থানে পৌঁছব। আমি না তোমার বড়ো ছেলের মতো অত মহান নই আব্বু। আমি ভীষণ স্বার্থপর। কারণ আমি তোমাকে খুশি করতে গিয়ে এমন কোন কাজই করতে পারব না যেটাতে আমার মন সায় দিবে না।”

বাবাকে কথাগুলো বলে জায়িনের সামনে দিয়ে যাবার সময় একটু থেমে মুবিন ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে গেল।

“আর ভাইয়া, ছোট ভাই হয়েও আজ তোমাকে আমি একটা পরামর্শ দিতে চাই। যতদিন তুমি আব্বুর হাতের কাঠ পুতলি হয়ে থাকবে ততদিনই আব্বু তোমাকে নিয়ে গর্ব করবে। একবার আব্বুর বিরুদ্ধে গিয়েই দেখো না। তখন তুমিও আমার মতোই অপদার্থ হয়ে যাবে। আজ তুমি উনার সব কথা শুনছো বলেই তুমি উনার যোগ্য সন্তান। গুড বয়। আমার মতো একটিবার নিজের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দাও। নিজের মন কী চায় সেটা শোনো। নিজের খুশির জন্য কোন কাজ করো। তখন আব্বু তোমাকেও বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলবে। ভেবো না তোমাকে হিংসে করে কথাগুলো বলছি। আমি এই একটা কাজই পারি না। নয়তো আর সব পারি।”

চলবে

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫০

মীরা মাহিমার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলল,

“না, আমার ফোনও ধরছে না।”

“আমারটাও না। করছে কী বল তো?”

মীরা মাহিমার পাশে বসে পিঠের উপর দিয়ে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,

“বোন রে, এখন থেকেই এসবের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যা। আরও কতকিছু যে তোকে সহ্য করতে হবে। কল তুলবে না। আগের মতো সময় দিতে পারবে না। এমনকি এখন আর লুকিয়ে চুকিয়ে ঘুরতেও যেতে পারবি না। তোকে তো কেউ চিনবে না। কিন্তু তোর সেলিব্রিটি বয়ফ্রেন্ডকে সবাই চিনবে। বিশেষ করে মেয়েরা তো মুবিন ভাইয়ের পেছনে দৌড়বে। মুবিন ভাইয়ের ভালোবাসা যদি একশো ভাগ খাঁটি হয় তাহলে সে তোকে ছাড়বে না। নইলে তোমার কপাল পুড়ল বলে।”

মাহিমা নাক ফুলিয়ে মীরার দিকে তাকাল। ওর হাতপা চলার আগেই মীরা লাফিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে গেল। সেখানে থেকেও বলে চলল,

“খুব তো বলছিলি, বয়ফ্রেন্ডকে তুই জামাই ভাবিস না। মুবিন ভাই তোকে ছেড়ে দিলে তুই এক্সকে ভুলে নেক্সট খুঁজবি। এখন তো তোর কথা কাজের কোন মিল পাচ্ছি না। বেচারা এক দুপুর তোর কল তুলেনি বলেই তুই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিস!”

“কই কাঁদছি আমি? চোখে বেশি দেখিস তুই।”

“অবশ্যই কাঁদছিস। সব কান্নাই যে প্রকাশিত হবে এমন তো আইন নেই। মনে মনে কাঁদছিস। আমার চোখ ভালো বলেই তোর মনের কান্নাও দেখতে পারছি।”

“আল্লাহর দোহাই লাগে তুই আমার সামনে থেকে যা মীরা। নইলে এক্ষুনি কোন একটা অঘটন ঘটে গেলে আমি দায়ী থাকব না।”

“এত চেততেছিস ক্যান? আমি কি তোর শত্রু? বোন আমরা। তোর দুঃখের দিনে আমি কীভাবে তোকে একা ফেলে চলে যাই বল। আয় তোকে সান্ত্বনা দিই। না, না কাঁদে না বাবু। ”

….

পাঁচ মিনিটের থেকেও কম সময়। এই সময়টুকুর মাঝেই কতকিছু হয়ে গেল জায়িন কিছুই বুঝতে পারল না। মুবিনের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কারণ এখনও তার অজানা। বাবাই বা হঠাৎ মুনিনের উপর এত চেতলো কেন? মুবিন চলে গেলে সুমনা স্বামীর উপর রাগে, কষ্টে কাঁদতে লাগলো। মুবিনের বলা কথাগুলো এখনও জামান হোসেনের কানে বাজছে। সারাজীবন ছেলেদের ভালো চেয়ে এসে শেষ বয়সে এই প্রতিদান পেলেন তিনি! জায়িন মা’র কান্না থামাতে পারছে না। আবার বাবাকেও কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না। মুবিনটা কেন এভাবে বাবাকে কষ্ট দিয়ে কথা বললো? বাবা কি ওর খারাপ চায়? জামান হোসেন ঘরে চলে গেলে জায়িন মা’কে ধরে সোফায় বসিয়ে দিল।

“মা প্লিজ, কাঁদছো কেন তুমি? মুবিন তো ওরকমই পাগল। এখন রাগ করে চলে গেছে একটু পরে ফিরে আসবে।”

সুমনা কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিল,

“আসবে না। দেখলি না তোর বাবা কীভাবে ছেলেটাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল।”

“আসবে। মুবিন না এলে আমি ওকে জোর করে নিয়ে আসব। বাবা তো ওর ভালোটাই চায় মা। কিন্তু পাগলটা তো সেই কথা বুঝে না।”

“মাঝে মাঝে বেশি ভালো চাওয়াটাও খারাপ হয়ে যায়। সন্তান বড় হলে তাদের স্বাধীনতা দিতে হয়। সারাজীবন কি আমরা তোদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারব? বাবা, মা হয়েছি বলে কী হয়েছে? আমাদের সিদ্ধান্ত কেন তোদের উপর চাপিয়ে দিব? তোদের নিজেও কিছু শখ আহ্লাদ থাকতে পারে বাবা মা হয়ে এই কথা কেন বুঝতে চাইব না?”

মা’কে কোনরকমে শান্ত করে জায়িন রুমে এসে দেখল তার ফোনে আবিরের নয়টা মিসড কল। আবির এতবার কেন কল করছে? জায়িন ফোন হাতে নিয়ে কল ব্যাক করল। আবির শুরুতেই গড়গড়িয়ে বলতে লাগল,

“ওরে শালা ফোন তুলিস না কেন? আমাদের ছোট হিরো তো ছোপা রুস্তম নিকলা। কী কাণ্ডটাই না বাঁধিয়েছে। আমি ইমপ্রেসড।”

আবির কীসব বলে যাচ্ছে তার কোন কথাই জায়িনের বোধগম্য হচ্ছে না। সে আবিরকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“এক সেকেন্ড থাম। শ্বাস নে। কী বলছিস এসব? বুঝিয়ে বল।”

“এহ লে, তুমি এখনও কিছুই জানো না?”

জায়িন কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

“কী জানব?”

আবির গাধাটাকে গালি দিতে গিয়েও দিল না। শুধু শুধু মুখ নষ্ট করার দরকার কী? গাধা কি কোনদিন মানুষ হয়? জায়িনটাও হবে না।

“কল রাখ গাধা। অনলাইনে আয়। দেখাচ্ছি কী হয়েছে।”

জায়িন ভিডিওটা দেখে এবার বুঝলো বাবা কেন এতটা চটেছে। মুবিনের জন্য গানবাজনা বাবার পক্ষ থেকে একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। মুবিন এই কাজটাই করছে দেখেই বাবা রাগ সামলাতে পারেনি। জায়িন ভিডিওটা পরপর কয়েকবার দেখল। তার ভাইয়ের এই গুণের উপর সে মুগ্ধ হলো। জায়িনের পক্ষ থেকে মুবিনের জন্য কোনো কিছুতেই কখনও বাধা ছিল না। ও যা করতে চায় করতে দিয়েছে। ছোট ভাইকে সে এবারও নীরবে সাপোর্ট করে যাবে।

….

মুবিন মীরা মাহিমার কারোর কলই তুলছে না। এতে অবশ্য মীরার কোন চিন্তা হচ্ছে না। কিন্তু মাহিমা এতেই চিন্তা করে করে হার্টের রোগী হয়ে গেছে। আরে বাবা এত বড় একটা ঘটনা ঘটেছে। ছেলেটাকে সবকিছু সামলে নিতে দে। তা না, নিব্বি গার্লফ্রেন্ডের মতো বয়ফ্রেন্ডের জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। কই, সে-ও তো জায়িন ভাইকে ভালোবাসে। এইযে জায়িন ভাই দুই মাস/চার মাস পরপর বাড়ি আসে মীরা তো তখন এরকম করে না। এতগুলো দিন তো সে মানুষটাকে না দেখে, কথা না বলেই থাকে। মানুষটা দূরে থাকলে মীরা তাকে আরও বেশি করে অনুভব করতে পারে। কাছে এলেই তো কেমন যেন কনফিউজড হয়ে যায়।

“মীরা তুই একবার দেখ না। ওবাড়িতে যা না। তুই তো মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়তে যাস।”

“তা সপ্তাহের বাকি ছয় দিন তো যাই-ই। কিন্তু শুক্রবারে তো যাওয়ার কথা না। আজ পড়তে যাওয়ার নাম নিলেও তোর মামীরা আমাকে প্রশ্নের তীরে খুলে খাবে।”

“আমি এখন কী করব তুই বল। কাল রাতের পর থেকে একটা বারও কথা হয়নি। এইযে কল করছি কিন্তু সে তো কলই তুলছে না।”

“আচ্ছা আমি দেখছি কী করা যায়। তুই শান্ত হ তো। কী নিব্বি গিরি করছিস! তোর কি সেই বয়স আছে? কলেজে পড়িস একটু তো ম্যাচিউরিটি দেখা।”

কে কাকে ম্যাচিউরিটি দেখানোর কথা বলছে! অন্য দিন মাহিমা তর্ক করলেও আজ তার সেই মুড নেই। মাহিমার কল রেখেই মীরা মুবিনকে কল করে যাচ্ছে।

“আহা প্রেম! এমন কঠিন প্রেম আমার কেন হলো না? আমি তো উনাকে না দেখে, কথা না বলেও দিব্যি উনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেই দিন কাটিয়ে দিতে পারি। কইতরি একদিনেই বিরহে মরে যাচ্ছে।”

রিং হচ্ছে। কিন্তু মুবিন কল তুলছে না। তুলবে কিকরে? ফোনটা মুবিনের কাছে থাকলে তো! সে তো রাগ করে বাড়ি থেকে বের হবার সময় ফোন রেখে গেছে। কিন্তু মীরা তো এই কথাটা জানে না। তাই সে ধৈর্যের সাথে কল করেই যাচ্ছে।

“মুবিন ভাই, করছিলেনটা কী আপনি? কল ধরছিলেন না কেন? কম হলেও একশোটা কল দিয়েছি। আপনি তো অনেক খারাপ। নতুন নতুন সেলিব্রিটি হয়েই দাম দেখাতে শুরু করে দিয়েছেন! পুরোপুরি সেলিব্রিটি হয়ে গেলে তো আপনার দেখাই পাব না। আপনার সাথে কথা বলার জন্য লাইন ধরতে হবে। আপনি যত বড় সেলিব্রিটিই হোন না কেন, আমাদের সম্পর্কটা কিন্তু ভুলে যাবেন না। তাহলে আপনার কপালে খারাবি আছে ”

মীরার শেষের কথাটা শুনে জায়িনের কপালে ভাঁজ পড়ল। মীরা মুবিনের মাঝে সেরকম কোন সম্পর্ক আছে নাকি? মুবিন ও মীরার মাঝে স্যার স্টুডেন্ট ছাড়া অন্য কোন সম্পর্ক হতে পারে জায়িন এটা কোনদিন কল্পনাতেও আনেনি। জায়িন শক্ত পুরুষালী গলায় বলল,

“মুবিন ভাই না। জায়িন ভাইয়ের সাথে কথা বলছো তুমি।”

মীরা ভড়কে গিয়ে কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকাল। সত্যি সত্যিই তো জায়িন ভাইয়ের গলা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু নাম্বার তো মুবিন ভাইয়ের নামেই সেভ করা। ইশ, ভাগ্য ভালো আজ দুলাভাই ডাকেনি। মুখ ফসকেও একবার এই শব্দটা বেরিয়ে গেলেই সেরেছিল।

“মুবিন ভাইয়ের ফোনে আপনি কেন? আপনি জানেন না এভাবে অন্যের ফোন তুলতে নেই।”

মুবিনের ফোন তুলেছে বলে মীরা রাগ করছে! আশ্চর্য, জায়িনের তার নিজের ভাইয়ের উপরই হিংসে হচ্ছে। সে মনে মনে বলল,

” মুবিনের বাচ্চা, ভাবীকে পড়াতে পড়াতে ভাইয়ের সম্পত্তির উপরই হাত দিয়েছিস! ভুলেও এই কাজ করে থাকলে আমি তোর হাতই ভেঙে দিব। তখন তুই গিটার বাজাস!”

মনে মনে মুবিনের কাজের শাস্তি ঠিক করে ফেললেও গলা স্বাভাবিক রেখেই ফোনে বলল,

“না জানলেও এখন তো তুমি জানিয়ে দিলে।”

মীরা মনে মনে বলল, কথা জানে! মানুষের সামনে ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না এমন ভাব ধরে থাকে। এই লোকটাকেই কি-না আমি মন দিয়ে বসে আছি! ব্যাটা মিনমিনা তো আমার মনের কথা বুঝতেই পারে না। ওপাশ থেকে কোন কথা আসছে না দেখে জায়িন বলল,

“কী বলার আমাকে বলো।”

“আপনাকে কেন বলব? আপনি কি মুবিন ভাই? আমার কথা মুবিন ভাইয়ের সাথে।”

জায়িনের সত্যি সত্যিই তার ভাইয়ের উপর অসম্ভব রাগ হচ্ছে। তুই ব্যাটা স্টুডেন্ট পড়িয়ে পরীক্ষায় পাস করাবি। স্টুডেন্টের সাথে তোর এত খাতির থাকবে কেন? এই স্টুডেন্ট তোর ভবিষ্যত ভাবী কেন জানলি না হ্যাঁ?

“মুবিন ভাইয়ের সাথে এত কিসের কথা তোমার? যার সাথে কথা থাকার কথা, তার সাথেই তো বলো না।”

“কার সাথে কথা বলি না আমি? আমি সবার সাথেই কথা বলি। আর আপনি কবে থেকে এত কথা বলতে শুরু করেছেন? এটা কিন্তু আপনার নতুন রুপ।”

মীরা যদি ঘূনাক্ষরেও টের পেত জায়িন নিজের ভাইকে নিয়েই জেলাস হচ্ছে তাহলে জায়িনকে আরও জেলাস ফিল করাতে কী কী করত তা আল্লাহই ভালো জানেন।
জায়িন নিঃশব্দে হেসে গলাটা সামান্য খাটো করে বলল,

“এখনও তো আরও অনেক রুপ দেখার বাকি। সব রুপ তুমিই তো দেখবে। আমি তো জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো। এই কথাটা যেভাবেই হোক তোমাকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেব।”

“চিউচিউ করে কী বলছেন? মুবিন ভাই কোথায়?”

“নেই।”

“নেই মানে? কোথায় গেছে?”

“তোমার সেলিব্রিটি মুবিন ভাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।”

চলবে_

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫১

রাতে মীরা ডাইনিংয়ে জগ থেকে পানি ঢেলে গ্লাসটা মাত্র মুখের কাছে এনেছে। এখনও গলা জেভায়নি। তার আগেই তনির বিকট ডাকে হাত থেকে কাচের গ্লাসটা নিচে পড়ে ভেঙে অনেকগুলো টুকরোয় পুরো ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়লো। মীরা কোমরে হাত চেপে রাগী চোখে তনির দিকে তাকাল। তনি মীরার রাগ পাত্তা না দিয়ে বলতে লাগল,

“তোরা দুইটা কবে মানুষ হবি বল তো? টম এন্ড জেরির মতো লেগেই থাকতে হয়! একটুও শান্তি দিবি না?”

“আমি কী করেছি আপু? তোমার জন্য গ্লাস ভেঙে এখন আমি বকা খাব। তার উপর তুমিও বকছো?”

” তোরা আবার কী নিয়ে লেগেছিস হ্যাঁ? কোন সম্পত্তির ভাগ নিয়ে এভাবে লাগিস দুইটা।”

“পাগলের মতো কী সব উল্টাপাল্টা বলছো বলো তো?”

“আমি পাগল! মাহিমার সাথে আবার কী নিয়ে লেগেছিস?”

“আমি লেগেছি! কখন, কোন সময়? আমি লাগিনি তো।”

“তোদের ঝগড়া হয়নি?”

“আরে বাবা ঝগড়া কেন হবে? কী আজব! কইতরি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”

তনি ব্যাঙ্গ করে বলল,

“তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডই বলেছে তুমি ওর সাথে ঝগড়া করে কথা বলছো না। তাই সে কেঁদেকেটে বাড়িঘর ভাসিয়ে ফেলছে। ফুপু মাত্রই আমাকে বলেছে, তোকে বুঝিয়ে যেন মাহিমার সাথে ভাব করিয়ে দিই।”

মীরা আকাশ থেকে পড়ল। তাদের কখন ঝগড়া হলো? বাস্তবে তো হয়নি। স্বপ্নে হয়েছে নাকি? তনি বকরবকর করেই যাচ্ছে। মীরা গ্লাস ভেঙে ফেলেছে দেখে বড়মা এসেও বকাবকি করছে। মীরার হয়েছে সব জ্বালা। যেদিকে যাবে সেদিকেই বকা খাওয়া কপাল। মীরা ঘরে গিয়েই মাহি মীরজাফরনীটাকে কল করল। রেগেমেগে আগুন হয়ে বলল,

“কোন জন্মের শত্রুতা মেটাতে ফুপুর কাছে আমার নামে বানিয়ে বলে ওরকম একটা কেস খাওয়ালি? তোর সাথে কবে আমি ঝগড়া করেছি রে জঘন্য মেয়ে।”

মাহিমা নাক টানতে টানতে উত্তর দিল,

“তখন মুবিন ভাইয়ের কথা মনে পড়ে ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। কিছুতেই কান্না আটকাতে পারছিলাম না। শুধু শুধু তো কেউ কাঁদে না। মা এসে হাজারটা প্রশ্ন করছিল কেন কাঁদছি। আমি কি মা’কে সত্যিটা বলতে পারতাম? তাই এই মিথ্যাটা বলেছি।”

“বাহ ভাই বাহ! তোমরা সবাই আমার কাঁধে রেখেই বন্দুক চালাও। বাড়িতে কিছু হলেই মীরার দোষ। এখন তুইও পুষ্টিকর সব কেস খাওয়াচ্ছিস। আমি কী করব? পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব?”

“রাগ করিস না প্লিজ। তুই ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই। কার কথা বলবো বল।”

“নাটক। এসব ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের নাটক আমার সাথে চলবে না। তোর রিলেশনের ঘটকালি আমি করেছি তো! আমিই তোর ব্রেকআপ করাব। কীভাবে তোরা ব্রেকআপ না করে থাকিস সেটা দেখব শুধু।”

“মীরা তুই দেখছিস আমি কাঁদছি। তবুও তুই এসব কথা বলছিস! কোথায় আমাকে একটু সান্ত্বনা দিবি।”

“সান্ত্বনা না৷ তোকে চটকানা দেওয়া উচিত। বজ্জাত মেয়ে।”

“মুবিন ভাই কোথায় আছে, কী করছে আমি তো কিছুই জানি না। টেনশন হবে না বল?”

“এই, মুবিন ভাই কি কচি খোকা? বেডা মানুষ সে। রাতে একা রাস্তায় শুয়ে থাকলেও কোন সমস্যা হবে না। তুই এমন করছিস যেন তোর বয়ফ্রেন্ড হাইস্কুলের নিব্বা।”

“তুই নিজে তো কাউকে ভালোবাসিস নি। তাই বুঝবি না, আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে।”

“কে বলেছে আমি কাউকে ভালোবাসিনি? আমার সে না তোর মুবিন ভাইয়ের মতো গাধা না। আর আমার ভালোবাসাও তোর মতো ন্যাকা না। ফোন রাখ খবিশ। আর জীবনে আমার সাথে কথা বলবি না।”

….

“তুমিও বসে পড়ো। দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

“তুমি খাচ্ছ খাও। আমার খিদে পেলে খাব। আমার চিন্তা তো তোমাকে করতে হবে না। তুমি পেট ভরে খাও।”

জামান হোসেনের কথার উত্তরে সুমনা ত্যাড়া জবাব দিলে জামান হোসেন আর কথা বাড়ালেন না। প্লেটের ভাত শেষ করে উঠে পড়লেন। জায়িন নিশ্চুপ থেকে একবার শুধু বাবাকে উঠে যেতে দেখল। মাকেও সে কিছু বলল না। এখন এরকমই হবে। অন্তত যতদিন না মুবিন বাড়ি ফিরে আসছে ততদিন মা কারোর সাথেই ভালো করে কথা বলবে না। আজকের খাবারে লবণ কম হয়েছে। জায়িন সেই কথাটাও মা’কে বলার সাহস পেল না। চুপচাপ খেয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। মুবিনের ফোন জায়িনের ঘরেই ছিল৷ মুবিন তার এক ফ্রেন্ডের ফোন থেকে কল করেছে। জায়িন জিজ্ঞেস করল,

“কোথায় আছিস তুই এখন?”

“বন্ধুর ফ্ল্যাটে উঠেছি। ওর রুমমেট কয়েদিদের জন্য বাড়িতে গেছে। ও ফিরে আসতে আসতে আমি একটা ব্যবস্থা করে নিব। ওদিকের আবহাওয়া এখন কেমন?”

“আবহাওয়া কেমন হতে পারে এটা তোর অজানা না। মায়ের আদরের ছেলে। তোর জন্য মা আমাদের জীবন নুন ছাড়া তরকারি করে রেখেছে।”

মুবিন হাসলো। যাক ভাইয়ার কথা শুনে মনে হচ্ছে না ভাইয়াও তার উপর রেগে আছে। আসার সময় রাগের মাথায় একটু বেশিই বলে ফেলেছে। তবে কথাগুলো তো মিথ্যা না।

“ইয়ে ভাইয়া আমার ফোন কি তোমার কাছেই ছিল?”

“আমার ঘরেই ছিল।”

“আব্বু নিয়ে যায়নি!”

“নিজের বাপকে তুই কী ভাবিস বল তো।”

“হিটলার। যাকগে সেসব কথা। কাল তুমি বাজারের দিকে এলে আমার ফোনটা একটু নিয়ে এসো।”

“তুই নিজে এসে নিয়ে যা।”

“আমি আর কোনদিন ওই বাড়িতে যাব না। ”

“তাহলে আমিও পারব না।”

“ভাইয়া তুমি আমার সাথে এমন করছো! তুমি না আমার ভাই। ”

“আমিও তো সেটাই জানতাম। তাছাড়া তুই বাবার বাড়িতে থাকবি না। তাহলে বাবার ফোন চালাবি কেন?”

“ফোন চালাব না। কিন্তু ফোনের ভেতর সিমটা তো আমার।”

“ছেলেমানুষী বাদ দিয়ে কাল বাড়ি ফিরে আয়। মা কান্নাকাটি করছে।”

“আমি আর ওবাড়ি ফিরব না। তুমি আম্মুকে বলে দিও।”

মুবিনটা তো ভালোই বেঁকে বসেছে। মুবিন এরকম করলে মা প্রতিদিনই তাদের লবণ ছাড়া তরকারি খাওয়াবে। মুবিন কথায় কথায় আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল,

“আমার ফোনে কেউ কল করছে ভাইয়া?”

জায়িন এবার ভাইয়ের আসল উদ্দেশ্য ধরতে পারল। এই কথাটা জানার জন্য এত বনিতা! তারপরও জায়িন বলল,

“তোর ছাত্রীর আটত্রিশটা মিসড কল।”

“মীরা তো ওরকমই, পাগলি!”

জায়িন দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলল,

“ভাবীকে পাগল ডাকছিস? মীরা তোর ভাবী বুঝেছিস গাধা। ভাবীর সাথে যদি তোর কিছু-মিছু বের হয় রে মুবিন! আমি তোকে এমন মার মারব। বাংলাদেশের কোন ডাক্তারও তোর হাড়গোড় জোড়া লাগাতে পারবে না।”

“আর কেউ কল দেয়নি?”

“ভীতু নামের কেউ একজনও অনেকবার কল করেছে।”

মুবিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক এই যাত্রায় বাঁচা গেল। মাহিমার নাম্বার সে ভীতু দিয়ে সেভ করেছিল। কারণ মাহিমা অলওয়েজ ওদের সম্পর্কের ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় পায়।
প্রথম দিনে ‘বউ’ দিয়ে সেভ করা ছিল। ওইটা এখনও থাকলে আজ বড়ো ভাইয়ের সামনে মুখ দেখানোর জো থাকত না।
ফোন বাড়িতে রেখে আসায় মুবিন মাহিমার সাথে কথা বলতে পারেনি। কিন্তু সে মাহিমাকে দেখার জন্য মাহিমাদের বাসার নিচে গিয়েছিল। গিয়েও অবশ্য লাভ হয়নি। দীর্ঘ দুই ঘন্টা অপেক্ষা করেও মাহিমার দেখা পায়নি।
মুবিন কল কেটে দিলে জায়িন চিন্তিত মুখে ঘরজুড়ে পায়চারি করতে লাগল। সে কি মীরাকে মনের কথা জানাতে দেরি করে ফেলেছে? এতদিনে কি মুবিনের মনেও মীরার জন্য কোনকিছু তৈরি হয়েছে? কিন্তু মীরা তো তাকে পছন্দ করে। সে প্রমাণও পেয়েছে?

“নাকি আমার মনের ভুল। মীরা আমাকে না বরং মুবিনকেই পছন্দ করে! না না না। অসম্ভব।”

জায়িন চিল্লিয়ে উঠল। এরকমটা হলে বেচারার পৃথিবী ছাড়তে হবে। কারণ মীরাকে সে কোনদিনও ছোট ভাইয়ের প্রেমিকা রুপে দেখতে পারবে না।

“মুবিনের বাচ্চারে! তোরেই আমি দুনিয়া থেকে পাঠিয়ে দিব। ভাবীর সাথে কী চালাচ্ছিস হ্যাঁ? আমার তো এখন মনে হচ্ছে, মীরার মনের কথা জানার অপেক্ষায় নিজের মনে কথা না জানিয়ে আমি ভুল করে ফেলেছি। মুবিনটা সব কাজেই এত ফাস্ট কেন? আমার আগে মীরাকে প্রপোজ করে ফেলবে না তো? ওরে ভাই, কেন নিজের ভাইয়ের সুখে হাত দিচ্ছিস!”

মাহিমার বাবার চাচাতো ভাই স্ট্রোক করেছে। ওরা রাতেই গাজীপুর গিয়েছে। মীরার আজ একাই কলেজ যেতে হয়েছে। ওদিকে মুবিন মাহিমাকে দেখার জন্য কলেজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেকেই নানান প্রশ্ন করছে। মানুষের এত আগ্রহ দেখে মুবিন বিরক্ত হয়ে বলল,

“ভালোই মুসিবত হয়েছে দেখা যাচ্ছে! একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েই এত প্যারা। সেলিব্রিটিরা কেমনে জীবনযাপন করে! বিরক্ত হয়না এরা?”

মীরা মুবিনকে দেখে উচ্ছ্বাসিত হয়ে ছুটে এসেছে। মুবিনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,

“আরে সেলিব্রিটি মানুষ নাকি? আপনি তো এখন স্টার! দিনেদুপুরে স্টার মানুষ মাটিতে নেমে এলেন কেন?”

“তুমিও মজা নিচ্ছ?”

“মজা নিব! কী যে বলেন, এখন কি আর আমাদের সেই সম্পর্ক আছে?”

“আরে বাবা, তুমি কিছুই জানো না মীরা। সেজন্য রাগ করছো।”

“আমি সব জানি। কাল রাতে কোথায় থেকেছেন? আপনার কইতরি চিন্তায় চিন্তায় মরে যাচ্ছিল। যাচ্ছিল কি? অর্ধেক গেছে।”

“তুমি জানো, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি?”

“হ্যাঁ।”

“কিকরে?”

“ম্যাজিক।”

“আচ্ছা, মাহিমা কলেজে আসেনি?”

“ওরা গাজীপুর গেছে।”

“কেন?”

“ওর চাচার স্ট্রোক হয়েছে। অবস্থা খারাপ। দেখতে গেছে।”

“ওর তো কোন চাচা ছিল না।”

“সব জেনে বসে আসেন! আপন চাচা না। ফুপার চাচাতো ভাই।”

“কবে ফিরবে?”

“আজই। আজ না ফিরলে কাল।”

মুবিনের মন খারাপ হয়ে গেল। আরও একটা দিন মাহিমাকে না দেখে থাকতে হবে? মাহিমাকে দেখলে হাজার প্যারার মাঝেও অদ্ভুত একটা শান্তি পাওয়া যায়।

“মীরা, আমার ফোনটাও আমার কাছে নেই। কাল অনেকক্ষণ মাহিমাদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু ও ব্যালকনিতে আসেনি। আজ ফোনেও যোগাযোগ করতে পারছি না। তুমি আমার একটা হেল্প করবে?”

“শুধু হেল্প করার বেলায় মীরা! গিফট, চকলেট পাওয়ার বেলায় অন্য কেউ? তবুও হেল্প করব। আমার মনটা অন্নেক বড়ো। বলুন।”

“মাহিমা ফেরার সাথে সাথে আমার সাথে ওর দেখা করাতে পারবে?”

“এ আর এমন কি কাজ! কিন্তু আপনি উঠেছেন কোথায়?”

“আপাতত এক ফ্রেন্ডের কাছে আছি। কাল পরশু শিফট করব। তুমি আমার ফ্রেন্ডের নাম্বারটা রাখো।”

“দিন।”

চলবে

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫১

রাতে মীরা ডাইনিংয়ে জগ থেকে পানি ঢেলে গ্লাসটা মাত্র মুখের কাছে এনেছে। এখনও গলা জেভায়নি। তার আগেই তনির বিকট ডাকে হাত থেকে কাচের গ্লাসটা নিচে পড়ে ভেঙে অনেকগুলো টুকরোয় পুরো ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়লো। মীরা কোমরে হাত চেপে রাগী চোখে তনির দিকে তাকাল। তনি মীরার রাগ পাত্তা না দিয়ে বলতে লাগল,

“তোরা দুইটা কবে মানুষ হবি বল তো? টম এন্ড জেরির মতো লেগেই থাকতে হয়! একটুও শান্তি দিবি না?”

“আমি কী করেছি আপু? তোমার জন্য গ্লাস ভেঙে এখন আমি বকা খাব। তার উপর তুমিও বকছো?”

” তোরা আবার কী নিয়ে লেগেছিস হ্যাঁ? কোন সম্পত্তির ভাগ নিয়ে এভাবে লাগিস দুইটা।”

“পাগলের মতো কী সব উল্টাপাল্টা বলছো বলো তো?”

“আমি পাগল! মাহিমার সাথে আবার কী নিয়ে লেগেছিস?”

“আমি লেগেছি! কখন, কোন সময়? আমি লাগিনি তো।”

“তোদের ঝগড়া হয়নি?”

“আরে বাবা ঝগড়া কেন হবে? কী আজব! কইতরি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”

তনি ব্যাঙ্গ করে বলল,

“তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডই বলেছে তুমি ওর সাথে ঝগড়া করে কথা বলছো না। তাই সে কেঁদেকেটে বাড়িঘর ভাসিয়ে ফেলছে। ফুপু মাত্রই আমাকে বলেছে, তোকে বুঝিয়ে যেন মাহিমার সাথে ভাব করিয়ে দিই।”

মীরা আকাশ থেকে পড়ল। তাদের কখন ঝগড়া হলো? বাস্তবে তো হয়নি। স্বপ্নে হয়েছে নাকি? তনি বকরবকর করেই যাচ্ছে। মীরা গ্লাস ভেঙে ফেলেছে দেখে বড়মা এসেও বকাবকি করছে। মীরার হয়েছে সব জ্বালা। যেদিকে যাবে সেদিকেই বকা খাওয়া কপাল। মীরা ঘরে গিয়েই মাহি মীরজাফরনীটাকে কল করল। রেগেমেগে আগুন হয়ে বলল,

“কোন জন্মের শত্রুতা মেটাতে ফুপুর কাছে আমার নামে বানিয়ে বলে ওরকম একটা কেস খাওয়ালি? তোর সাথে কবে আমি ঝগড়া করেছি রে জঘন্য মেয়ে।”

মাহিমা নাক টানতে টানতে উত্তর দিল,

“তখন মুবিন ভাইয়ের কথা মনে পড়ে ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। কিছুতেই কান্না আটকাতে পারছিলাম না। শুধু শুধু তো কেউ কাঁদে না। মা এসে হাজারটা প্রশ্ন করছিল কেন কাঁদছি। আমি কি মা’কে সত্যিটা বলতে পারতাম? তাই এই মিথ্যাটা বলেছি।”

“বাহ ভাই বাহ! তোমরা সবাই আমার কাঁধে রেখেই বন্দুক চালাও। বাড়িতে কিছু হলেই মীরার দোষ। এখন তুইও পুষ্টিকর সব কেস খাওয়াচ্ছিস। আমি কী করব? পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব?”

“রাগ করিস না প্লিজ। তুই ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই। কার কথা বলবো বল।”

“নাটক। এসব ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের নাটক আমার সাথে চলবে না। তোর রিলেশনের ঘটকালি আমি করেছি তো! আমিই তোর ব্রেকআপ করাব। কীভাবে তোরা ব্রেকআপ না করে থাকিস সেটা দেখব শুধু।”

“মীরা তুই দেখছিস আমি কাঁদছি। তবুও তুই এসব কথা বলছিস! কোথায় আমাকে একটু সান্ত্বনা দিবি।”

“সান্ত্বনা না৷ তোকে চটকানা দেওয়া উচিত। বজ্জাত মেয়ে।”

“মুবিন ভাই কোথায় আছে, কী করছে আমি তো কিছুই জানি না। টেনশন হবে না বল?”

“এই, মুবিন ভাই কি কচি খোকা? বেডা মানুষ সে। রাতে একা রাস্তায় শুয়ে থাকলেও কোন সমস্যা হবে না। তুই এমন করছিস যেন তোর বয়ফ্রেন্ড হাইস্কুলের নিব্বা।”

“তুই নিজে তো কাউকে ভালোবাসিস নি। তাই বুঝবি না, আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে।”

“কে বলেছে আমি কাউকে ভালোবাসিনি? আমার সে না তোর মুবিন ভাইয়ের মতো গাধা না। আর আমার ভালোবাসাও তোর মতো ন্যাকা না। ফোন রাখ খবিশ। আর জীবনে আমার সাথে কথা বলবি না।”

….

“তুমিও বসে পড়ো। দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

“তুমি খাচ্ছ খাও। আমার খিদে পেলে খাব। আমার চিন্তা তো তোমাকে করতে হবে না। তুমি পেট ভরে খাও।”

জামান হোসেনের কথার উত্তরে সুমনা ত্যাড়া জবাব দিলে জামান হোসেন আর কথা বাড়ালেন না। প্লেটের ভাত শেষ করে উঠে পড়লেন। জায়িন নিশ্চুপ থেকে একবার শুধু বাবাকে উঠে যেতে দেখল। মাকেও সে কিছু বলল না। এখন এরকমই হবে। অন্তত যতদিন না মুবিন বাড়ি ফিরে আসছে ততদিন মা কারোর সাথেই ভালো করে কথা বলবে না। আজকের খাবারে লবণ কম হয়েছে। জায়িন সেই কথাটাও মা’কে বলার সাহস পেল না। চুপচাপ খেয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। মুবিনের ফোন জায়িনের ঘরেই ছিল৷ মুবিন তার এক ফ্রেন্ডের ফোন থেকে কল করেছে। জায়িন জিজ্ঞেস করল,

“কোথায় আছিস তুই এখন?”

“বন্ধুর ফ্ল্যাটে উঠেছি। ওর রুমমেট কয়েদিদের জন্য বাড়িতে গেছে। ও ফিরে আসতে আসতে আমি একটা ব্যবস্থা করে নিব। ওদিকের আবহাওয়া এখন কেমন?”

“আবহাওয়া কেমন হতে পারে এটা তোর অজানা না। মায়ের আদরের ছেলে। তোর জন্য মা আমাদের জীবন নুন ছাড়া তরকারি করে রেখেছে।”

মুবিন হাসলো। যাক ভাইয়ার কথা শুনে মনে হচ্ছে না ভাইয়াও তার উপর রেগে আছে। আসার সময় রাগের মাথায় একটু বেশিই বলে ফেলেছে। তবে কথাগুলো তো মিথ্যা না।

“ইয়ে ভাইয়া আমার ফোন কি তোমার কাছেই ছিল?”

“আমার ঘরেই ছিল।”

“আব্বু নিয়ে যায়নি!”

“নিজের বাপকে তুই কী ভাবিস বল তো।”

“হিটলার। যাকগে সেসব কথা। কাল তুমি বাজারের দিকে এলে আমার ফোনটা একটু নিয়ে এসো।”

“তুই নিজে এসে নিয়ে যা।”

“আমি আর কোনদিন ওই বাড়িতে যাব না। ”

“তাহলে আমিও পারব না।”

“ভাইয়া তুমি আমার সাথে এমন করছো! তুমি না আমার ভাই। ”

“আমিও তো সেটাই জানতাম। তাছাড়া তুই বাবার বাড়িতে থাকবি না। তাহলে বাবার ফোন চালাবি কেন?”

“ফোন চালাব না। কিন্তু ফোনের ভেতর সিমটা তো আমার।”

“ছেলেমানুষী বাদ দিয়ে কাল বাড়ি ফিরে আয়। মা কান্নাকাটি করছে।”

“আমি আর ওবাড়ি ফিরব না। তুমি আম্মুকে বলে দিও।”

মুবিনটা তো ভালোই বেঁকে বসেছে। মুবিন এরকম করলে মা প্রতিদিনই তাদের লবণ ছাড়া তরকারি খাওয়াবে। মুবিন কথায় কথায় আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল,

“আমার ফোনে কেউ কল করছে ভাইয়া?”

জায়িন এবার ভাইয়ের আসল উদ্দেশ্য ধরতে পারল। এই কথাটা জানার জন্য এত বনিতা! তারপরও জায়িন বলল,

“তোর ছাত্রীর আটত্রিশটা মিসড কল।”

“মীরা তো ওরকমই, পাগলি!”

জায়িন দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলল,

“ভাবীকে পাগল ডাকছিস? মীরা তোর ভাবী বুঝেছিস গাধা। ভাবীর সাথে যদি তোর কিছু-মিছু বের হয় রে মুবিন! আমি তোকে এমন মার মারব। বাংলাদেশের কোন ডাক্তারও তোর হাড়গোড় জোড়া লাগাতে পারবে না।”

“আর কেউ কল দেয়নি?”

“ভীতু নামের কেউ একজনও অনেকবার কল করেছে।”

মুবিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক এই যাত্রায় বাঁচা গেল। মাহিমার নাম্বার সে ভীতু দিয়ে সেভ করেছিল। কারণ মাহিমা অলওয়েজ ওদের সম্পর্কের ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় পায়।
প্রথম দিনে ‘বউ’ দিয়ে সেভ করা ছিল। ওইটা এখনও থাকলে আজ বড়ো ভাইয়ের সামনে মুখ দেখানোর জো থাকত না।
ফোন বাড়িতে রেখে আসায় মুবিন মাহিমার সাথে কথা বলতে পারেনি। কিন্তু সে মাহিমাকে দেখার জন্য মাহিমাদের বাসার নিচে গিয়েছিল। গিয়েও অবশ্য লাভ হয়নি। দীর্ঘ দুই ঘন্টা অপেক্ষা করেও মাহিমার দেখা পায়নি।
মুবিন কল কেটে দিলে জায়িন চিন্তিত মুখে ঘরজুড়ে পায়চারি করতে লাগল। সে কি মীরাকে মনের কথা জানাতে দেরি করে ফেলেছে? এতদিনে কি মুবিনের মনেও মীরার জন্য কোনকিছু তৈরি হয়েছে? কিন্তু মীরা তো তাকে পছন্দ করে। সে প্রমাণও পেয়েছে?

“নাকি আমার মনের ভুল। মীরা আমাকে না বরং মুবিনকেই পছন্দ করে! না না না। অসম্ভব।”

জায়িন চিল্লিয়ে উঠল। এরকমটা হলে বেচারার পৃথিবী ছাড়তে হবে। কারণ মীরাকে সে কোনদিনও ছোট ভাইয়ের প্রেমিকা রুপে দেখতে পারবে না।

“মুবিনের বাচ্চারে! তোরেই আমি দুনিয়া থেকে পাঠিয়ে দিব। ভাবীর সাথে কী চালাচ্ছিস হ্যাঁ? আমার তো এখন মনে হচ্ছে, মীরার মনের কথা জানার অপেক্ষায় নিজের মনে কথা না জানিয়ে আমি ভুল করে ফেলেছি। মুবিনটা সব কাজেই এত ফাস্ট কেন? আমার আগে মীরাকে প্রপোজ করে ফেলবে না তো? ওরে ভাই, কেন নিজের ভাইয়ের সুখে হাত দিচ্ছিস!”

মাহিমার বাবার চাচাতো ভাই স্ট্রোক করেছে। ওরা রাতেই গাজীপুর গিয়েছে। মীরার আজ একাই কলেজ যেতে হয়েছে। ওদিকে মুবিন মাহিমাকে দেখার জন্য কলেজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেকেই নানান প্রশ্ন করছে। মানুষের এত আগ্রহ দেখে মুবিন বিরক্ত হয়ে বলল,

“ভালোই মুসিবত হয়েছে দেখা যাচ্ছে! একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েই এত প্যারা। সেলিব্রিটিরা কেমনে জীবনযাপন করে! বিরক্ত হয়না এরা?”

মীরা মুবিনকে দেখে উচ্ছ্বাসিত হয়ে ছুটে এসেছে। মুবিনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,

“আরে সেলিব্রিটি মানুষ নাকি? আপনি তো এখন স্টার! দিনেদুপুরে স্টার মানুষ মাটিতে নেমে এলেন কেন?”

“তুমিও মজা নিচ্ছ?”

“মজা নিব! কী যে বলেন, এখন কি আর আমাদের সেই সম্পর্ক আছে?”

“আরে বাবা, তুমি কিছুই জানো না মীরা। সেজন্য রাগ করছো।”

“আমি সব জানি। কাল রাতে কোথায় থেকেছেন? আপনার কইতরি চিন্তায় চিন্তায় মরে যাচ্ছিল। যাচ্ছিল কি? অর্ধেক গেছে।”

“তুমি জানো, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি?”

“হ্যাঁ।”

“কিকরে?”

“ম্যাজিক।”

“আচ্ছা, মাহিমা কলেজে আসেনি?”

“ওরা গাজীপুর গেছে।”

“কেন?”

“ওর চাচার স্ট্রোক হয়েছে। অবস্থা খারাপ। দেখতে গেছে।”

“ওর তো কোন চাচা ছিল না।”

“সব জেনে বসে আসেন! আপন চাচা না। ফুপার চাচাতো ভাই।”

“কবে ফিরবে?”

“আজই। আজ না ফিরলে কাল।”

মুবিনের মন খারাপ হয়ে গেল। আরও একটা দিন মাহিমাকে না দেখে থাকতে হবে? মাহিমাকে দেখলে হাজার প্যারার মাঝেও অদ্ভুত একটা শান্তি পাওয়া যায়।

“মীরা, আমার ফোনটাও আমার কাছে নেই। কাল অনেকক্ষণ মাহিমাদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু ও ব্যালকনিতে আসেনি। আজ ফোনেও যোগাযোগ করতে পারছি না। তুমি আমার একটা হেল্প করবে?”

“শুধু হেল্প করার বেলায় মীরা! গিফট, চকলেট পাওয়ার বেলায় অন্য কেউ? তবুও হেল্প করব। আমার মনটা অন্নেক বড়ো। বলুন।”

“মাহিমা ফেরার সাথে সাথে আমার সাথে ওর দেখা করাতে পারবে?”

“এ আর এমন কি কাজ! কিন্তু আপনি উঠেছেন কোথায়?”

“আপাতত এক ফ্রেন্ডের কাছে আছি। কাল পরশু শিফট করব। তুমি আমার ফ্রেন্ডের নাম্বারটা রাখো।”

“দিন।”

চলবে