#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫৮
মাহিমা রাতে মামার বাড়ি থেকে গেল। আবির অবশ্য চলে যাবে। মামীরা তাকে আটকে রেখেছে রাতে না খেয়ে যেতে পারবে না। বাবার সাথে মীরার কথা হয়ে গেছে। বাবা ইভান ভাইকে বললেই কাজ হয়ে যাবে। মীরা মাহিমাকে আস্বস্ত করে বলল,
“চিন্তা করিস না। আমি বাবাকে পটিয়ে নিয়েছি। বাবা ইভান ভাইয়ের সাথে কথা বলবে।”
“তুই একটা গাধা। মামা তোর মন রাখতে এই কথা বলেছে।”
“তুই বেশি জানিস না? আমার বাবাকে আমি জানি। আমার কোন কথা ফেলতে পারে না। দেখবি কান্নাকাটি, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে ঠিক রাজি করিয়ে নিব।”
কলিংবেল বাজছে। বড়মা, ছোট চাচী রান্নাঘরে ব্যস্ত। ইভা খাবার এনে ডাইনিং টেবিলে রাখছে। ইভান আবির কোন একটা বিষয় নিয়ে সিরিয়াস আলাপ করছে। তনির কোলে মাহা। রুশমি ফ্লোরে বসে খেলছে। দরজা খুলতে মীরা বা মাহিমাকেই যেতে হবে। এটা জেনেও ওরা কলিংবেলের শব্দ না শোনার ভান করে থাকল। পরপর কয়েকবার কলিংবেল বাজলে তনি ওদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল,
“লা’থি খাবি? দরজা খুলে দিয়ে আয়।”
মাহিমা মীরাকে ঠেলে বলল,
“তুই যা। সেদিন আমি খুলেছিলাম।”
“সেদিন কোনদিন? তুই যা।”
“না। তুই যা।”
তনি ধমক দিয়ে বলল,
“মীরা যাবি তুই!”
না চাইতেও মীরাকে উঠতে হলো। ভাল্লাগে না। সব কাজ তাকেই করতে হয়। পরিবারের ছোটদের এই এক জ্বালা। সবাই শুধু কাজ করায়। না করতে চাইলে চোখ রাঙায়, ধমক দেয়।
মীরা বিরস মুখে দরজা খুলে দিয়ে সামনে জায়িনকে দেখে চোখ বড়ো বড়ো করে খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল। আজ কলেজে দেখা হয়নি বলে সোজা বাড়ি চলে এসেছে! হায়, এই লোক তাকে পাগল করে ছাড়বে। আন রোমান্টিক বলতে বলতেও মাঝে মাঝে রোমান্টিক হয়ে যায়। সম্পর্কের পরে এটাই জায়িনের প্রথম তাদের বাড়িতে আসা। মীরা একটু বেশিই এক্সাইটেড হয়ে গেছিল। ও কিছু বলতে গিয়েও পেছনে মুবিনকে দেখে সামলে নিল। জায়িন মীরাকে দেখে হাসছে। মীরার মাথায় চব্বিশ ঘন্টায়ই শয়তান নাচানাচি করতে থাকে। এখনও সে জায়িনকে বেকায়দায় ফেলতে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম জায়িন ভাই। কেমন আছেন আপনি? আরে মুবিন ভাই, আসুন আসুন। ভাবী দেখো কারা এসেছে।”
মীরার চিৎকার শুনে ইভা সহ আবির ইভানও চলে এসেছে। দুই ভাইকে দেখে ইভা খুশিতে গদগদ। মীরা সবার সামনে এমন ভাব করছে যেন তাদের সম্পর্ক এখনও আগের মতোই আছে।
“জায়িন ভাই, এখনও বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন? ভেতরে আসুন।”
জায়িন মনে মনে বলল,
“ঠিক আছে। আমারও সময় আসবে।”
মাহিমা মুবিনকে সাধারণ ভাবেই বলেছিল, এতই দেখতে মন চাইলে আমার মামার বাড়ি চলে আসুন। আপনাকে কেউ তো আটকাচ্ছে না। বোনের শ্বশুরবাড়ি। যখন খুশি আসতে পারবেন। সে ভাবেনি সত্যি সত্যিই মুবিন চলে আসবে। ভেতরে যাওয়ার সময় মুবিন মীরার কানের কাছে এসে বলল,
“শালিকা, আমাকে দেখে আপনার বোনের খুশি হওয়ার কারণটা বোঝা গেল। কিন্তু আপনার এত খুশি হওয়ার কারণটা ঠিক বুঝলাম না।”
“কে বললো আমি আপনাকে দেখে খুশি হয়েছি?”
“তাহলে কাকে দেখে খুশি হয়েছেন?” মুবিন আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সন্দেহের সুরে বলল,
“আমার ভাইকে?”
মীরা মুখ মোচড় দিয়ে বলল,
“আপনার ভাইকে দেখে খুশি হবো! দিনদিন আপনার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বুঝি অবশ্য। ওরকম একটা গার্লফ্রেন্ড থাকলে মাথা তো খারাপ হবেই। অনেক প্যারা দেয়, না?”
“তা একটু দেয়। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা আমি সিআইডি লাগিয়ে খোঁজ নেব।”
“আপনি নিজেই সিআইডি হয়ে যান না।”
….
মীরার বাবার সাথে জায়িন বসে গল্প করছে। এই দৃশ্য মীরা কিছুটা দূরে বসে গালে হাত দিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। তার সবথেকে প্রিয় দুইটা মানুষ একসাথে। ইশ, কী সুন্দর লাগছে। মীরা মনে মনে বলল,
“শ্বশুর জামাইয়ের মধ্যে কত গল্প হচ্ছে! কিন্তু আমাকে বাইরে রেখেছে। দু’জনই ভীষণ ভীষণ ভীষণ পঁচা।”
মাহিমা মুবিনের চোখে চোখে ইশারায় কথা হচ্ছে। মীরা সেদিকে দেখেও বড়ো নিঃশ্বাস ফেলল। তার বেডাডা সত্যিই আন রোমান্টিক। শ্বশুরের থেকে মনোযোগ সরিয়ে এবার একটু বউয়ের দিকেও দিলে কী হয়?
“বউ! আমি কি উনার বউ নাকি? ইশ, নিজেকে উনার বউ ভাবতেই কেমন লজ্জা লাগে। মীরা তুই এত লজ্জাবতী কবে থেকে হলি রে?”
কিছুক্ষণ ভাবী, চাচীদের মাঝে ঘুরঘুর করে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে মীরা বাবার কাছে এসে বসলো। বায়েজিদ সাহেব মেয়েই দেখে উৎফুল্ল হয়ে বললেন,
“জায়িনের সাথে কথা বলছিলাম। কয়েকদিন পরেই ডাক্তার হয়ে যাবে। আর আমার মেয়েটা, পড়াশোনায় ভীষণ ভালো। তারপরও সবসময় ফাঁকি দেওয়ার বাহানা খুঁজে।”
জায়িন ভাইয়ের সামনে বাবার তাকে ফাঁকিবাজ বলতে হলো! অন্য সময়, অন্য কারো সামনে বললে হতো না। দূর, বাবাও না। এখানে আসার পরে মীরা যে ব্যবহারটা করেছে। সুযোগ পেয়ে জায়িন এখন সেটার মিষ্টি প্রতিশোধ নিয়ে নিলো। সে বলল,
“পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়া মোটেও ভালো কাজ না। বিশেষ করে ভালো স্টুডেন্টরা কখনও পড়াশোনায় ফাঁকি দেয় না। মুবিনের কাছে পড়ত তো। বাসায় ভালো করে পড়ো কেমন?”
মীরা মুখ মোচড় দিয়ে মনে মনে বলল,
“পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ হতে পারি চৌধুরী সাহেব। কিন্তু আপনার সাথে প্রেম করায় মোটেও ফাঁকিবাজ নই। আমার মতো গার্লফ্রেন্ড আপনি হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজে পাবেন? খুঁজে দেখান তো দেখি।”
মামা জায়িনকে ছাড়লে আবির এসে ধুপ করে বন্ধুর পাশে বসে পড়ল। মীরা তখনও এখানেই বসা ছিল। আবির গলাটা হালকা নিচু করে জানতে চাইল,
“প্রজাপতির খবর কী বন্ধু? এখনও পছন্দ পর্বই চলছে? বেচারা দেবরটার কী দোষ বল? আমি কেন ভাবী ডাকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি?”
আবির যতই নিচু গলায় বলুক না কেন, মীরা ঠিকই শুনতে পেয়েছে। প্রজাপতি! ওটা আবার কে? প্রজাপতি সম্পর্কে তো জায়িন ভাই কোনদিনও তাকে কিছু বলেনি। মীরা স্থির হয়ে বসে থাকলেও কান পেতে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করছে। জায়িন মীরাকে এরকম করতে দেখেই বলল,
“তোর কপালে মনে হয় ভাবী ডাকা লিখা নেই।”
আবির ব্যথিত গলায় বলল,
“কেন বন্ধু? রিজেক্ট করে দিয়েছে?”
“তা করেনি। কিন্তু তুই ওকে ভাবী ডাকতে পারবি না।”
“কেন? এখনও প্রপোজ করিস নি! কিরে শালা তুই? এত কিসের ভয়?”
মীরা এপর্যায়ে আর স্থির বসে থাকতে পারল না। সে ছাড়াও জায়িন ভাইয়ের জীবনে আরও কোন মেয়ে আছে? কাকে প্রপোজ করার কথা বলছে আবির ভাই? আবির ভাই যার কথা বলছে সে যদি মীরা হয় তাহলে জায়িন ভাই বলছে না কেন ওদের মধ্যে সম্পর্ক হয়ে গেছে। মীরার মনে একটা কথা ঢুকে গেছে। সে ছাড়া কি জায়িন ভাইয়ের জীবনে আরও কোন মেয়ে ছিল? যার কথা আবির ভাই জানত।
মীরার ডাক পড়লে সে উঠে গেল। কিন্তু যাওয়ার আগে জায়িনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“আমি ছাড়াও যদি আপনার জীবনে কোন মেয়ে এসে থাকে তাহলে আপনার খবর আছে জায়িন ভাই। আমার জীবনে আপনিই প্রথম। আপনার জীবনে আমি প্রথম হতে না পারলে আপনাকে আমি ছাড়ব না। মানছি আপনি আমার থেকে অনেক বড় হবেন। কিন্তু আপনি আমার বড় হওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে অন্য মেয়েদের সাথে কেন সম্পর্কে জড়াবেন? কেন কাউকে ভালোবাসবেন? একটু অপেক্ষা করলে আপনার কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত? আপনার যদি এক্স বের হয় জায়িন ভাই আমি কিন্তু আপনাকে মেরে ফেলব। কারো রিজেক্ট করা বা কারো ব্যবহার করা জিনিস আমার লাগবে না।”
খাবার টেবিলে জায়িন, মুবিনের যত্ন-আত্তির শেষ নেই। বোন তো আছেই সাথে বোনের শাশুড়ী, চাচী শাশুড়ী, দুলাভাইও ঠেলেঠুলে তাদের দু’ভাইকেই সব খাইয়ে ফেলতে চাচ্ছে। নিজের ভবিষ্যত শ্বশুরও কম যাচ্ছে না।
“জায়িন মনে হয় লজ্জা পাচ্ছে। কিছুই খাচ্ছে না। ওকে আরেকটু মাংস দাও তো।”
বেচারা যে এত বার না না করে যাচ্ছে, তার না কেউ কানেই নিচ্ছে না। মীরা এমনিতেই জায়িনের উপর রেগে আছে। সবার কত করে বলার পরও খাচ্ছে না দেখে আরও রাগ হচ্ছে। জায়িন মনে মনে ভাবছে,
“এখনই এত খাতিরযত্ন। মেয়ের জামাই হলে কপালে না জানি কী অপেক্ষা করছে! আল্লাহ বাঁচিয়ো।”
পেটে এতটুকু জায়গাও নেই। তবুও সবাই জোর করেই যাচ্ছে। তার উপর আরেকটা ঘটনা ঘটল। টেবিলের নিচে দিয়ে পা দিয়ে কেউ তার পায়ে ধাক্কা মারল। কাজটা যে মীরার তা বুঝতে সময় লাগল না অবশ্য। জায়িন মীরার দিকে তাকালেও মীরা অন্য দিকে তাকিয়ে এখনও সেই কাজটা করে যাচ্ছে। জায়িন বুঝতে পারল না, এমেয়ের হঠাৎ হয়েছে কী?
মুবিন ভাইয়ের কানে কানে বলল,
“আর পারছি না ভাইয়া। এবার মনে হয় পেট ফেটে যাবে।”
“অভ্যাস করে রাখ। এটা তো কিছুই না। এবাড়ির জামাই হওয়ার স্বপ্ন দেখছিস। ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি আরও অনেক আসবে।”
মুবিন ভবিষ্যতের দৃশ্য কল্পনা করে শুকনো ঢোঁক গিলল। আবির জায়িনের সাথেই বেরুবে। মীরা জায়িনের আশেপাশে ঘুরলেও জায়িন মীরার সাথে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিল না। এখন হঠাৎ সুযোগ পেয়ে গেলে কাছাকাছি এসে নিচু গলায় বলল,
“কী হয়েছে বলো তো? দূরে দূরে থাকছো। আবার কথাও বলছো না।”
“কেন কথা বলবো?”
“মানে?”
“মানে আপনার মাথা। আপনি কিন্তু কাজটা ঠিক করেননি।”
“কী আশ্চর্য! কোন কাজটা ঠিক করিনি?”
“জানি না।”
“আরে না বললে বুঝব কীভাবে?”
“বুঝতে হবে না। আপনি তো কিছুই বুঝেন না। এটাও বোঝা লাগবে না।”
সবাই চলে আসাতে মীরা দূরত্বে চলে গেল। জায়িন হতভম্ব হয়ে রইল। এই মেয়ের কি মাথা ঠিক আছে? হঠাৎ কী হলো। আরে বাবা, রাগ করার কারণটা কী? জিজ্ঞেস করলেও বলছে, জানতে হবে না। না জানলে সমাধান করবে কীভাবে? এই মেয়ের মান-অভিমান বুঝতে বুঝতে আর ভাঙাতে ভাঙাতেই তো তার একজীবন পার হয়ে যাবে। কিছু বলার বা করার আগেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।
“এর নাম মীরা না। অভিমানী হওয়া উচিত ছিল। এখন আবার কী করলাম কে জানে? কেন রেগে আছে?”
চলবে
#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫৯
জায়িনের তিনদিন লাগলো মীরার রাগের কারণ জানতে। এই তিনদিন মীরা একটা কথারও ঠিকঠাক মতো জবাব দেয়নি। জায়িনও চেষ্টা করতে করতে হাল ছেড়ে দিয়েছিল। এই মেয়ের মন বোঝা তার সাধ্যের বাইরে। কিন্তু তিনদিন পর মীরা নিজে থেকেই বলল,
“আমার প্রশ্নের সত্যি করে উত্তর দিবেন। মিথ্যা বললেও কিন্তু আমি বুঝতে পারব।”
“প্রশ্নটা করো আগে।”
“আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?”
“এটা কোন প্রশ্নের মাঝে পড়ে মীরা?”
“কথা না ঘুরিয়ে উত্তর দিন। আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?”
“এটা তো তোমার থেকে ভালো আর কেউ জানে না।”
“আহ, আবারও কথা ঘোরাচ্ছেন। নিজের মুখে বলতে সমস্যা কী?”
জায়িন হতাশ হয়ে বলল,
“আছে।”
“নাম কি?”
“কার?”
“গার্লফ্রেন্ডের? আপনার নাম জিজ্ঞেস করব নাকি?”
“এটা কেমন ছেলেমানুষী মীরা?”
“এমনই ছেলেমানুষী। আপনি উত্তর দিবেন কি-না বলেন।”
“মীরা। আমার গার্লফ্রেন্ডের নাম মীরা।”
উত্তরটা শুনে মীরা কতক্ষণ চুপ থাকল। জায়িন বুঝতে পারল না সে আবারও কোন ভুল কিছু বলেছে কি-না।
“আগে আর কোন গার্লফ্রেন্ড ছিল?”
“কার? আমার?”
“না, আমার। আমি তো মেয়ে হয়ে গার্লফ্রেন্ড বানাবো।”
মীরা রেগে যাচ্ছে দেখে জায়িন তাড়াতাড়ি করে বলে উঠল,
“গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড, জাস্ট ফ্রেন্ড কিচ্ছু ছিল না।”
“সত্যি?”
“একশো না, হাজার বার সত্যি।”
“আমার আগে আপনার জীবনে কেউ আসেনি?”
“আসেনি মীরা। কীভাবে বললে তুমি বিশ্বাস করবে বলো তো। আমি সেভাবেই বলবো।”
“তাহলে আবির ভাই কোন প্রজাপতির কথা বলছিল? সেই মেয়েটা কে যাকে আবির ভাই প্রপোজ করতে বলছিল?”
এই কথাটা নিয়ে মীরা তিনদিন রাগ করে ছিল! জায়িনের নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করল। তিনদিন সে কী চিন্তাটার মধ্যেই না ছিল। তার কোন কাজে বা আচরণে মীরা কষ্ট পেয়েছে ভেবে ভেবেই জান বেরিয়ে যাচ্ছিল।
“তুমি এই কথাটা নিয়ে রাগ করে ছিলে মীরা?”
“রাগ করবো না? আপনার মনে হচ্ছে এটা রাগ করার বিষয় না? আমি থাকতেও আপনি অন্য কোন মেয়েকে নিয়ে কেন কথা বলবেন? আমার জীবনে আপনিই প্রথম। আপনার জীবনে আমি দ্বিতীয়, তৃতীয় নাম্বারে আছি এটা জেনে আমার কষ্ট লাগবে না?”
“তুমি জানতে চাও আবিরের সাথে আমার কাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল?”
“হু।”
“আবির জানে আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি। কিন্তু মেয়েটা কে এটা জানে না। দেখা হলেই আবির সেই মেয়েটার কথা জানতে চায়। আমি তাকে খোলাখুলি কিছু বলি না। কিন্তু আমার মুখে মেয়েটার সম্পর্কে একটুআধটু কথা শুনেই ও মেয়েটার নাম দিয়েছে প্রজাপতি। এখন কি আমি আবিরকে বলে দিব সেই চঞ্চল প্রজাপতিটা আর কেউ না তারই আদরের বোন। তুমি চাওনি বলে এতদিন বলিনি। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে আমার বলে দেওয়াই উচিত ছিল। বলে দিলে অন্তত আসল মানুষটা আমার উপর রাগ করে এতদিন থাকতে পারতো না।”
নিজের ভুল বুঝতে পেরে মীরার কিছু বলার মুখ থাকলো না। সে বালিশে মুখ গুঁজে নিজেকে গাল দিচ্ছে। এই ভুলের কী সাফাই দিবে সে? এখন তো জায়িন ভাই তার উপর রাগ করবে। মীরা এক সেকেন্ডও দেরি না করে বলল,
“সরি। সরি সরি সরি লক্ষ কোটি বার সরি। আপনি আমার উপর রাগ করবেন না প্লিজ। আমি আর কোনদিনও আপনার উপর সন্দেহ করবো না। আপনাকে অবিশ্বাসও করব না।”
জায়িন রাগ করেনি। এ মেয়ের উপর রাগ করা যায় না। তবুও কন্ঠ গম্ভীর করে বলল,
“উঁহু, তুমি আমাকে ভালোই বাসো না মীরা। ভালোবাসলে সন্দেহ করতে না।”
“কে বলেছে আমি আপনাকে ভালোবাসি না? আমি আপনাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। মাহিমা মুবিন ভাইকে যতটা ভালোবাসে, আমি আপনাকে তার থেকেও বেশি ভালোবাসি।”
জায়িন এপাশে নিঃশব্দে হাসছে। পাগলিটা এখানেও মাহিমার সাথে তুলনা করছে।
“কিন্তু যেখানে বিশ্বাস নেই। সেখানে কি ভালোবাসা থাকে?”
“কে বলেছে আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না? আমি তো আপনাকে বিশ্বাস করি। আমার মাথা খারাপ। তাই তো আপনাকে অবিশ্বাস করেছি। কিন্তু এখন থেকে আপনাকে আমি অন্ধের মতো বিশ্বাস করব। আপনি যদি দিনকে রাত বলেন তাহলে আমি সেটাই বিশ্বাস করব। আপনি সাদাকে কালো বললেও সেটাই মেনে নিব। তবুও আপনি রাগ করবেন না।”
মীরার ছেলেমানুষী কথা শুনে জায়িন না হেসে থাকতে পারল না। ওকে হাসতে শুনে মীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল।
“আপনি হেসেছেন! যাক বাবা বাঁচা গেল। তার মানে এখন আর রাগ করে নেই। আমি তো ভেবেছিলাম আপনার রাগ ভাঙাতে কী না কী করতে হবে।”
“আমি তো তোমার মতো পাগল না। এসব ছোটখাটো সামান্য বিষয় নিয়ে আমি রাগ করি না।”
“ঠিকই বলেছেন আমি সত্যিই পাগল। বড়মাও এটাই বলে। এত রাগ যে কোত্থেকে আসে! কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি। আমি আর কোনদিন আপনার সাথে রাগ করব না।”
“উহু, করবে। রাগ করা তোমার অধিকার। আর সেই রাগ ভাঙানো আমার দায়িত্ব। কিন্তু আজকের পর একটা কাজ তুমি করবে না। রাগ করে কথা না বলে থাকা যাবে না। যতো ইচ্ছে রাগ করো। আমি তোমার রাগ ভাঙিয়ে নেব। কিন্তু তুমি রাগ করে কথা না বলে থাকলে আমার কিছুই ঠিক থাকে না।”
মীরা মনে মনে আকাশে উড়তে উড়তে ভাবছে, হায়, এই লোক সত্যি সত্যিই একদিন আমাকে পাগল করে দিবে। জায়িন ভাই এত ভালো কেন? বাবার পর এই মানুষটাই তার সব ছেলেমানুষি মেনে নেয়।
…
মীরা ঠিকঠাক মতো প্রেমটাও করতে পারল না। তার আগেই ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা তার দুয়ারে এসে কড়া নাড়ল। প্রেম ফ্রেম ভুলে মীরা বইয়ের সাথে সম্পর্ক করল। জায়িন নিজেও মীরার পরীক্ষার সময়টায় বেশি কথা বলতে চাচ্ছে না। এই মেয়ের সাথে কোন ঠিকঠিকানা নেই। পরীক্ষা খারাপ হলে কেঁদেকেটে ঘরবাড়ি বাসিয়ে ফেলবে। জায়িন এই কয়দিন বেশি কল করছে না। মেসেজ দিচ্ছে না। এতেও মীরার সমস্যা। জায়িন তাকে ভুলে যাচ্ছে এই ব্যাপারটা নিয়ে মন খারাপ করে পড়তে পারছে না।
জায়িন মাঝে মাঝে ভেবে পায় না মীরার বয়স কত? বয়সের তুলনায় মীরা অনেকে বেশি ছেলেমানুষ। হয়তো সবার বেশি আদরের ফলে এমন হয়েছে। মীরার কথা মনে করে জায়িন একা একাই হাসে।
প্রেম ভালোবাসা বয়ফ্রেন্ড রিলেশন নিয়ে একটা মেয়ের মনে কতটা ফ্যান্টাসি থাকতে পারে তা মীরাকে না দেখলে জানতেই পারতো না জায়িন। এইতো সেদিন। গভীর রাত পর্যন্ত ফোনে কথা বলার পর জায়িন যখন বলল,
“এবার ঘুমোতে যাও মীরা। নয়তো কাল তোমার কলেজ মিস যাবে।”
“আমার নামটা যে এত সুন্দর তা আপনার মুখে না শুনলে জানতে পারতাম না। আপনি ‘মীরা’ বলে ডাকলে আমার কেমন যেন লাগে। নিজের নামের প্রতিই অদ্ভুত এক মায়া কাজ করে। কত মানুষই তো আমার নাম ধরে ডাকে। তখন তো আমার এমন লাগে না।”
জায়িন সবটাই চুপ করে শুনলো। কী বলা উচিত তার? ভেবে পেল না। মেয়েটার এই ছেলেমানুষী গুলো তার কাছে বড্ড আদুরে লাগে। মীরা জায়িনের উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু জায়িন বেচারিকে হতাশ করে দিয়ে বলল,
“হুম, এবার ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে উঠতে হবে।”
“ধ্যাত!”
মীরা স্পষ্ট হতাশা জাহির করল। এই লোক এমন কেন? মনে কোন আবেগ অনুভূতি নেই?
“আপনি এরকম আনরোমান্টিক কেন? প্রেমিকার মন কীভাবে রাখতে হয় জানা নেই? দুই তিনটা মিষ্টি কথা বললে আপনার কি ডায়াবেটিস হয়ে যাবে? আশ্চর্য!”
জায়িন নিঃশব্দে হাসল। মীরা রাগে ফোঁসফোঁস করছে। তার বান্ধবীদের বয়ফ্রেন্ডদের কথা শুনলে মীরার হাঁ করে শুনতে হয়। ওদের এসব ন্যাকামি? নাকি জায়িন ভাইয়ের মনে আবেগ অনুভূতি কম? সানজির বয়ফ্রেন্ড ওকে কোথাও যেতে দেয় না। গতবার ওর মামাতো বোনের বিয়েতে যাওয়া নিয়ে সে কী ঝগড়া! মাহিমার সাথে মুবিন ভাই সারারাতই কথা বলে। এদিকে তার বয়ফ্রেন্ড? ঘড়ি ধরে যেন কথা বলে। এগারোটা বাজার আগেই ঘুমানোর তাড়া দিতে থাকে। ফোনে দু’চারটা ভালোবাসার কথা বলবে তো দূর তার পড়াশোনার খোঁজ খবর নিয়েই রেখে দেয়। সামনাসামনি দেখা হলেও পড়াশোনা নিয়েই তাগাদা দিতে থাকে। এখন পর্যন্ত একদিন কোথাও ঘুরতে নিয়ে যায়নি। দুঃখে কষ্টে মীরার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। এটা তো বয়ফ্রেন্ড কম মুরুব্বি ফিল বেশি আসে।
মীরা কিছু বলছে না দেখে জায়িন বলল,
“আচ্ছা তুমিই বলে দাও আমাকে কী করতে হবে?”
“আমি কেন বলব? বড়ো কে? আপনি। অভিজ্ঞতা বেশি থাকার কথা কার? আপনার। আপনি জানেন না কিছু? আমাকে কেন বলতে হবে?”
জায়িন হেসে ফেলল। বলল,
“বড়ো হলেই কি অভিজ্ঞতা বেশি থাকে? মুবিন আমার ছোট হয়েও কিন্তু ওর অভিজ্ঞতা বেশি।”
“মুবিন ভাইয়ের থেকেই আপনার শেখা উচিত। মুবিন ভাই হলো আদর্শ প্রেমিক। আপনি চাইলেও মুবিন ভাইয়ের মতো হতে পারবেন না। আপনি তো হওয়ার চেষ্টাও করবেন না।”
“আচ্ছা করব। বলো তোমার মুবিন ভাই কী কী করে। চেষ্টা করে দেখি আদর্শ প্রেমিক হতে পারি কি-না।”
“মুবিন ভাই মাহিমার সাথে অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলে। আপনিও আমার সাথে অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলবেন।”
“তোমার ঘুম পেলে?”
“আমি ঘুমিয়ে গেলেও আপনি কল কাটবেন না। আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনবেন। সানজির বয়ফ্রেন্ড কিন্তু এমন করে।”
জায়িন হেসে ফেলতে গিয়েও হাসল না। এখন হাসলে তার কপালেই খারাবি আছে। টিনএজার ছেলেপুলে গুলা বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলোর মাথা খারাপ করে রেখেছে। তার ভাইটাও তো কম যায় না। সারারাত কী কথা বলে এত?
“হুম। কিন্তু তুমি এখন না ঘুমালে আমি কীভাবে তোমার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনবো বলো তো?”
মীরা রাগ করে বলল,
“আমি ঘুমাবোও না। কাল পরীক্ষাও দিব না। আপনার সাথে কথাও বলবো না। আমি কিচ্ছু করব না। আপনি এত ঘুমঘুম করেন, তাই আপনি নিজেই ঘুমান গিয়ে।”
চলবে
#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৬০
পরীক্ষা চলাকালীন মুবিন প্রতিদিনই এসেছে। মুবিনকে দেখে মীরার আফসোস হয়েছে, জায়িন ভাই কেন আসতে পারে না। সে-ই অবশ্য সম্পর্কের কথা এখন কাউকে জানাতে চায় না। জায়িন এলে মাহিমা সন্দেহ করবে। মাহিমা জেনে যাওয়া মানে মুবিন ভাইও জেনে যাওয়া। আজ প্রচণ্ড গরম পড়েছে। মুবিন মীরা মাহিমার জন্য আইসক্রিম কিনে এনেছে। মীরা আইসক্রিম খেতে খেতে বলল,
“মুবিন ভাই আমার পরীক্ষা খারাপ হলে কিন্তু সব দোষ আপনার।”
মুবিন আকাশ থেকে পড়ে বলল,
“আমার! কীভাবে?”
“আপনি ঢঙ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। আমাকে আর পড়ালেনও না। তাই সব দোষ আপনার।”
“যাহ! আমি পড়ালেই কি তুমি ভালো রেজাল্ট করতে? বাড়িতে না পড়ে এখন আমার দোষ দেওয়া হচ্ছে,না!”
মাহিমাও আইসক্রিম মুখে দিয়ে বলল,
“আমার রেজাল্ট খারাপ হলেও আপনার দোষ।”
“তোমাকেও কি আমি পড়াতাম?”
“না। কিন্তু আপনার সাথে প্রেম করেই তো পড়াশোনা থেকে আমার মনোযোগ উঠেছে।”
দুই বোন কী সুন্দর সব দোষ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে।
“একজনের সাথে প্রেম করে দোষ করেছি। একজনকে পড়িয়ে দোষ করেছি। এখন দেখা যাচ্ছে দোষে ভরা জীবন আমার।”
মুবিনের কথা শুনে মীরা মাহিমা একসাথে হাসতে লাগল। মুবিন বেচারা রাগ করে গাল ফুলিয়ে রাখল।
…
বাড়িতে আজ কেউ আসবে? মানুষটা কি অনেক বড়ো কেউ? নইলে তার আসা নিয়ে আজ এত স্পেশাল স্পেশাল রান্না হচ্ছে কেন? দুপুরে না খেয়ে পুরোটা দুপুর ঘুমিয়েছে মীরা। এখন খিদে পাচ্ছে। রান্নাঘর এসে কতক্ষণ ঘুরঘুর করে বুঝতে পারল আজ কোন মেহমান আসবে। কিন্তু কে আসবে এটা জানা নেই। তাই ছোট চাচীকে জিজ্ঞেস করল,
“আজ কে আসবে গো?”
“মেহমান। তুই কখন ঘুম থেকে উঠেছিস? তোর তো খাওয়াদাওয়ার প্রয়োজন নেই। ঘুমিয়েই জীবন পার কর।”
মীরা কী জিজ্ঞেস করছে তার ঠিকঠাক উত্তর না দিয়ে উল্টো বকে যাচ্ছে।
“জানি তো মেহমান আসবে। কিন্তু সেই মেহমানটা কে?”
ছোট চাচীর হাত ভর্তি কাজ। এখনও কত রান্না বাকি আছে। আগামীকাল উনাদের আসার কথা ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই জানাল, আজ রাতেই আসবেন। এই অল্প সময়ে কীভাবে কী করবেন বুঝতে পারছেন না। মীরা ছোট চাচীর পেছনে ঘুরছে। তিনি হঠাৎ করে পেছন ফিরলে মীরার সাথে ধাক্কা খেল।
“আহ মীরা! কেন যন্ত্রণা করছিস বল তো। দুপুরে খাসনি। ডাইনিংয়ে গিয়ে বোস। তোর পছন্দের চিংড়ি মাছ রান্না হয়েছে। মেহমান চলে আসার আগে ঝটপট খেয়ে নে।”
“কিন্তু মেহমান কারা?”
এপর্যায়ে ছোট চাচী চোখ পাকিয়ে বললেন,
“তুই যাবি এখান থেকে?”
বাধ্য হয়ে মীরা চলে এলো। ডাইনিংয়ে এসে ইভাকে পেলো। কেউ না বললেও ভাবী বলবে। মীরা ছুটে ইভার কাছে চলে এলো।
“মেহমান কারা গো? কে আসবে?”
ইভা মীরার দিকে তাকাল, ঘুম থেকে উঠে এসেছে। চোখে মুখে পানিও দেয়নি। মুখ ফোলা। চুল এলোমেলো।
“এই অবস্থা কেন তোমার? আয়নার চেহারা দেখেছ? পাগল লাগছে।”
“উফ ভাবী, তুমি আগে বলো মেহমান কে। এটা জানতে না পারলে এমনিতেই পাগল হয়ে যাব।”
“তনিকে দেখতে আসছে। বাবার বন্ধুর ছেলে। ছেলে আর্মি। ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ায় আজই দেখতে আসছে।”
এই কথাটা শুনে মীরার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লে তনির কী অবস্থা হবে। আচ্ছা তনি আপু কি জানে? আবির ভাই কি জানে? হায় হায়, তনি আপু এখন কী করবে? মীরার কি তনি আপুকে হেল্প করা উচিত নয়? মীরা তনির কাছে ছুট লাগানোর আগেই ছোট ফুপুর আগমন ঘটল। মাহিমা মীরাকে দেখেই চোখে ইশারা করে জানতে চাইল, এসব কী হচ্ছে বাড়িতে? মীরা দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে জানাল, সে-ও মাত্রই জানলো। ইভা ছোট ফুপুকে দেখে বলল,
“এত দেরি করলেন কেন ফুপু? মা কিন্তু আপনার উপর ভীষণ রেগে আছে।”
“আরে রাগ করবে কেন? আমাকে জানালোই তো কিছুক্ষণ আগে। আমি কি উড়ে চলে আসতাম?”
মা ভাবী কথা বলতে বলতে মাহিমা মীরাকে নিয়ে তনিকে দেখার জন্য চলে এলো। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল,
“এসব কী হচ্ছে বল তো। তনি আপুর তো আমার ভাইয়ের বউ হওয়ার কথা ছিল। মামা কেন তনি আপুকে অন্য ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছে? আমার ভাইকে কি মামার চোখে পড়েনি?”
“আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। আবির ভাই কি জানে?”
“জানি না। ভাইয়া তো বাসায় নেই। কোন বন্ধু না কার যেন বাড়ি গেছে। তনি আপু কি ভাইয়াকে জানিয়েছে?”
“জানি না। আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে।”
“আমারও।”
…
বাচ্চা গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে জায়িনের দিনগুলো মিষ্টি যন্ত্রণায় বেশ কেটে যাচ্ছে। তার মেডিকেলের রেজাল্ট বের হয়েছে। প্রত্যাশার থেকেও অনেক বেশি ভালো রেজাল্ট করেছে সে। এতে সবচেয়ে খুশি হয়েছে তার বাবা। দ্বিতীয় জন যে বাবার সমানই খুশি হয়েছে সে মীরা। পাগলিটা সেদিন বাড়ির সবাইকে এই বলে মিষ্টি খাইয়েছে যে, সে স্বপ্নে দেখেছে সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালে তার সাথে ভীষণ ভালো কিছু হবে।
জায়িন নিজের শহরেই ভালো একটা হসপিটালে ইন্টার্নি করছে। বাবা অবশ্য চেয়েছিল জায়িন ঢাকা ফিরে যাক। কিন্তু জায়িন তাতে রাজি হলো না কারণ ঢাকা ফিরে গেলে সে চাইলেও আর যখন তখন মীরাকে দেখতে পারবে না। ঢাকা থেকে এসে মীরার হুটহাট আবদার পূরণ করা সম্ভব হবে না। জায়িনের এখানে থাকার সিদ্ধান্তে বাবা খুশি না হলেও তেমন কিছু বলেনি।
জায়িনের আজকের দিনটা ভীষণ ব্যস্ততায় কেটেছে। ইন্টার্ন ডক্টরদের খাটুনি অনেক। বাড়ি ফিরে সে সবেমাত্র ঘামে ভেজা শার্টটা খোলার জন্য উপরের দুইটা বোতাম খুলেছে। তখনই ফোন বেজে উঠল। এসময় কে আর হবে? এত ক্লান্তির মাঝেও জায়িনের মুখে হাসি ফোটে উঠল।
“শুনুন, সাঙ্ঘাতিক একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। আজ মনে হয় আমাদের বাড়িতে কিছু একটা ঘটবে। তনি আপুকে বড় আব্বুর বন্ধুর ছেলে দেখতে এসেছে। পছন্দ হলে বিয়েও ঠিক হয়ে যেতে পারে। ছেলে আর্মিতে আছে। বড় আব্বুর আগেভাগেই দেখা শেষ। এখন শুধু ছেলে তনি আপুকে পছন্দ করলেই শোভ কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। এদিকে আবার তনি আপু বেঁকে বসেছে। কারণ সে আবির ভাইকে ভালোবাসে। আবির ভাই বাড়ি ছিল না। হয়তো খবরটা শুনেছে। কিন্তু এখনও ফিরেনি। ফিরলে কী হবে জানি না। বাড়ির সিচুয়েশন এখন টেনশনময়। আপনি বুঝতে পারছেন তো?”
“বুঝলাম। কিন্তু তোমার এত টেনশনের কোন কারণ আছে কি?”
“কী বলছেন আপনি! কারণ নেই? আমার ভাই বোনের পুরোটা জীবনের ব্যাপার। টেনশন না হয়ে যাবে কোথায়?”
“ঠিক আছে। টেনশন করো। তবে অল্প করে।”
“আমি এখন রাখছি। আবির ভাই ফিরে কী করে কে জানে। তনি আপুকে যে ছেলেটা দেখতে এসেছে সে-ও কিন্তু হেব্বি হ্যান্ডসাম। আবির ভাইটা যে কীভাবে কী করবে?”
মীরার সাথে কথা বলতে বলতে জায়িন শার্ট চেঞ্জ করে ফেলেছে। মাঝে মাঝে সামান্য একটা বিষয় নিয়ে মীরার আগ্রহের শেষ থাকে না। যেমন এই ছোট্ট বিষয়টা নিয়ে টেনশনের শেষ নেই।
“তোমার কি খুব বেশি টেনশন হচ্ছে?”
“হুম।”
“আমি আসব?”
“কেন?”
“চেষ্টা করে দেখব তোমার টেনশন করাতে পারি কি-না।”
“আপনি এলে আমার টেনশন কমবে না বরং বাড়বে। আসলে আমি আবির ভাই তনি আপুকে নিয়ে টেনশন করছি না। আমাদের বাড়িতে ছেলেমেয়েদের ছোট থেকেই অনেক বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হয়। কেন জানেন? কারণ বিয়ের সময়ে এই স্বাধীনতার সবটুকুই কেড়ে নেওয়া হয়। তখন বড়রা যা বলবে সেটাই করতে হবে। এতদিন এটা নিয়ে আমার আপত্তি ছিল না। আমিও ভাবতাম নিজে কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার থেকে বাবা চাচারাই নিক। অন্তত তখন দোষটা নিজের উপর থাকবে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমাদের সাথে এটা খুব অন্যায় করা হচ্ছে। জন্মের পর থেকে এত স্বাধীনতার কোন প্রয়োজনই নেই। বিয়ের সময় আমাদের ইচ্ছেটাকে প্রধান্য দিলেই হতো। আচ্ছা আমার বিয়েও যদি বাবা চাচারাই ঠিক করে ফেলে তখন? আমি কিন্তু বলে রাখছি। আমি আপনাকেই বিয়ে করব। আমি বাবা চাচাদের বিরুদ্ধে যাব না। আবার আপনাকেও ছাড়ব না। এখন আপনি ভাবতে থাকেন ভবিষ্যতে বাড়িতে আমাদের মেনে না নিলে আপনি কীভাবে সবাইকে রাজি করাবেন।”
মীরার এত এত ছেলেমানুষীর মাঝে আজকের মীরাকে জায়িনের অবুঝ মনে হলো না। মীরা তাকে নিয়ে ভবিষ্যত ভেবে চিন্তিত হচ্ছে। জায়িন মীরার এই ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারল না। কারণ সে নিজেও মনে মনে অনেকবারই তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেছে। মীরা নিজের কথাগুলো বলে কল কেটে দিয়েছে।
“যা কিছুই হয়ে যাক মীরা, তোমাকে আমি হারাতে পারব না। এখনও আমার তোমাকেই চাই। আশি বছর বয়সেও তোমাকেই পাশে চাই। তোমাকে ছাড়া জীবন কল্পনা করা আমার কাছে বেঁচে থেকেও মৃত্যুর সমানই হবে।”
….
তনি কিছুতেই পাত্রপক্ষের সামনে যাবে না। সে এক্ষুনি গিয়ে বাবাকে সব বলে দিবে। বলে দিবে, আমি আবিরকে ভালোবাসি বাবা। বিয়ে করলে ওকেই করব। ওকে ছাড়া অন্য কারো সাথে বিয়ে দিতে চাইলে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব। তনি সাহস করে বাবার কাছে যেতে নিলেও পরক্ষণে থেমে যাচ্ছে। এসব কথা বলে বাবাকে কীভাবে কষ্ট দিবে সে? বাবা কষ্ট পাবে এমন কোন কাজই তো জীবনে করেনি। তাহলে আজ কীভাবে করবে? তনি আবিরকে জানিয়েছে।
“দেখো তোমাকে ছাড়া আমি কাউকে বিয়ে করব না। আজ যারা আসছে তাদের সামনেও যাব না। বাবাকেও আমি কষ্ট দিতে পারব না। আমাদের বিয়ের জন্য কীভাবে তুমি সবাইকে রাজি করাবে সেটা তুমি জানো।”
আবিরের মনে কী চলছে সেটা তনিকে বুঝতে না দিয়ে উল্টো তনিকে খেপিয়ে দিয়ে বলল,
“এমন ভাব করছিস যেন ওদের সামনে গেলেই গাধা ছেলেটা তোকে পছন্দ করে নিবে। নিজের প্রতি এত কনফিডেন্স পাস কোত্থেকে বল তো? আগে ওদের সামনে গিয়ে বোস না। দেখবি তোর কিছু করতে হবে না। ছেলে নিজেই তোকে রিজেক্ট করে দিবে। সবাই তো আর আমার মতো গর্দভ না। যে ভুল আমি করেছি…
তনি আর কিছু শুনেনি। রাগ করে কল কেটে দিয়েছে। এরকম একটা ছেলেকে ভালোবাসে সে! ভেবেই নিজের গালে চড় দিতে মন চাচ্ছে। গার্লফ্রেন্ডকে দেখতে আসছে শুনেও যে ছেলে মজা করতে পারে সে গার্লফ্রেন্ডের বিয়েতে লুঙ্গি ডান্স দেওয়ার সাথে সাথে কব্জি ডুবিয়ে রোস্টও খেতে পারবে।
তনিকে ইভা তৈরি করিয়ে দিচ্ছে। মীরা মাহিমা মুখ কালো করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা নিজেরা কষ্টে মরে যাচ্ছে। কিন্তু তনি আপু কী সুন্দর করে বসে বসে সাজছে! মীরা ফিসফিস করে বলল,
” তনি আপু কি কষ্টে পাগল হয়ে গেছে?”
“জানি না। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।”
“তনি আপু তো ইচ্ছে করে ভাবীকে সাজিয়ে দিতে বলছে। যে মেয়ের প্রেমিক থাকে সে কি এত সেজেগুজে ছেলে পক্ষের সামনে যেতে পার?”
“আমার ভাইটারও তো কোন খোঁজ নেই। যার গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে সে কীভাবে বাড়িতে না ফিরে থাকতে পারে! সত্যিকারে ভালোবাসলে এতক্ষণে এদের দু’জনেরই তো অবস্থা খারাপ হয়ে যাবার কথা ছিল। অন্তত আমি তনি আপুর জায়গায় হলে এতক্ষণে কেঁদেকেটে ছোটখাটো একটা নদী বানিয়ে ফেলতাম।”
“আমি জা..’ বলতে বলতে মীরা থেমে গেল। সে জায়িন ভাইকে বাড়ি ডেকে বাবার পায়ে পড়ে যেত একথা আপাতত কইতরির সামনে বলা যাবে না।
চলবে