#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৭২
সেদিনের ঘটনার পর মীরার বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে বললেই চলে। বড়মা কেন এত ভয় পাচ্ছে? সে কি ছোট বাচ্চা? ছোট চাচী কি ভাবে মেলায় হারিয়ে গিয়েছিল বলে কি এখনও হারিয়ে যাবে? আর মেলায় তো হারিয়ে যায়নি। ইচ্ছে করে হারালে না করবে কে? কিন্তু এই কথাটা তো এই মহিলারা বুঝতে চাইছে না। কী এক যন্ত্রণা! তাই মীরা আজ সুমনা আন্টিকে দেখতে যাওয়ার বাহানা করে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। যদিও জানে এখন গেলে জায়িনের সাথে দেখা হবে না। কিন্তু শাশুড়ির খোঁজ খবরও তো রাখা উচিত। সুমনা মীরাকে দেখে প্রতি বারের মতোই খুশি হয়েছে। ঘরে যা খাবার আছে মীরার জন্য নিয়ে আসছে। মেয়েটা আচার খেতে ভীষণ পছন্দ করে। শখ করে খায়। সুমনা সামনে বসে মুগ্ধ হয়ে দেখে।
“তুই সবসময় কেন আসিস না মীরা? তুই এলে আমার কত ভালো লাগে জানিস তুই!”
“কীভাবে আসব আন্টি? কেউ বাড়ি থেকে বেরই হতে দেয় না। নইলে আমার তো আসতে ইচ্ছেই করে।”
“আমার কথা বলবি। তাহলেই আসতে দিবে।”
“আচ্ছা।”
মীরা সুমনার ঘরে বসে আছে। বাড়িতে কেউ নেই এখন। আন্টি একা একা সারাটা দিন কীভাবে থাকে? এই ঘরের দেয়ালে তিন চারটা ছবি ঝুলানো। মীরা সেগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
“এটা কি জায়িন ভাই আন্টি?”
“কোনটা? লাল হাফপ্যান্ট পরাটা মুবিন। পাশেরটা জায়িন।”
মীরা ছবিটা ভালো করে দেখতে লাগল। ছবিতে জায়িনের মুখ ভর্তি হাসি। সে মুবিনের কান টেনে ধরে রেখেছে। মুবিন কাঁদছে। এতেই যেন জায়িন ভীষণ মজা পাচ্ছে। মীরার বিশ্বাস হতে চাইল না। সে জিজ্ঞেস করল,
“জায়িন ভাই মুবিন ভাইয়ের কান টেনে ধরে রেখেছে?”
“হুম। ছোটবেলায় জায়িন অনেক দুষ্টু ছিল। ওর দুষ্টুমির কারণে আমি টিকতে পারতাম না। এখন তো ভদ্র হয়ে গেছে। কেউ দেখে বিশ্বাসই করবে না এই ছেলে ছোটবেলায় আমাকে কী জ্বালানিই না জ্বালিয়েছে।”
জায়িন ভাই ছোট বেলায় দুষ্টু ছিল! অসম্ভব। এই লোকের পক্ষে দুষ্টুমি করা সম্ভবই না। এই বয়সেই এমন গম্ভীর হয়ে থাকে যেন বয়স সত্তর পেরিয়েছে।
“মুবিনকে যেমন আদর করত তেমনই কাঁদাত। আমি চোখের আড়াল হলেই কানে ধরে, চুলে ধরে টান মারত। চিমটি মেরে কাঁদিয়ে নিজেই শান্ত করত।”
“আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে তুমি বানিয়ে বলছো। তোমার ছেলেকে দেখে বোঝাই যায়না।”
“আমারও বিশ্বাস হয় না। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরেও জায়িন অনেক বাঁদরামি করেছে। টিচারদের কত নালিশ যে আসত। একে মারত, ওকে মারত। মাঝে মাঝে আমি নিজেও বিরক্ত হয়ে যেতাম। কিন্তু ক্লাস ফোরে উঠে হুট করেই আমার দুষ্টু ছেলেটা ভালো হয়ে গেল। কারো সাথে ঝগড়াঝাটি মারামারি করে না। বাড়িতে আমাকেও বিরক্ত করে না। ছোট ভাইয়ের খেয়াল রাখে। আমার সব কথা শুনে। বিশেষ করে ওর বাবার কথা ছাড়া চোখের পলকও ফেলে না এমন অবস্থা। একদম সভ্য ভদ্র। ছেলেটার হঠাৎ এই পরিবর্তনের কারণ আমি আজও জানতে পারিনি।”
“হুম।”
মীরা এমনভাবে মাথা দুলিয়ে হুম বলল সুমনা হেসে ফেলল।
“বোস তুই। আরও কিছুক্ষণ থাকবি? দুপুরে খেয়ে যা।”
“না না। বড়মা বকবে। আজ চলে যাই। আরেকদিন আবার আসব।”
সুমনা বলতে ভুলে গিয়েছিল। মীরা উঠতে নিলে বলল,
“রোববারে জায়িনের পাত্রী দেখতে যাব।”
কথাটা শুনে মীরা একমুহূর্তের জন্য ধমকে গেল। জায়িন ভাইয়ের পাত্রী দেখতে যাবে! মীরার চোখ জ্বালা করতে লাগল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
“জায়িন ভাই বিয়ে করবে!”
“ও তো না করছে। কিন্তু ওর বাবা মেয়ে পছন্দ করে রেখেছে। এখন দেখা যাক কী হয়।”
আঙ্কেল জায়িন ভাইয়ের জন্য মেয়েও পছন্দ করে ফেলেছে। এই কথাটা জায়িন তাকে জানায়নি! লুকিয়ে লুকিয়ে পাত্রীও দেখে আসবে। মীরাকে সে ভালোবাসে তারপরেও বাবার পছন্দ করা পাত্রী দেখতে যাবে? মীরা মনে মনে বলল,
“জায়িন ভাই আপনি আমাকে এভাবে ঠকাতে পারলেন! আপনার বিয়ের কথা হচ্ছে তবুও আপনি আমাকে জানালেন না। আপনি কি সত্যিই আঙ্কেলের পছন্দ করা মেয়েটাকে বিয়ে করবেন! তাহলে আমার সাথে কেন ভালোবাসার নাটক করেছেন।”
বাড়ি ফিরে রুমে এসেই মীরা দরজা বন্ধ করে নিল। কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলল। জায়িন তাকে ঠকিয়েছে। তাকে ভালোবাসার কথা বলে এখন অন্য মেয়েকে বিয়ে করছে। দুপুরে খাবার সময় হলে তনি মীরাকে ডাকতে এলো। মীরা দরজা খুললো না। মাথা ব্যথার কথা বলে তনিকে পাঠিয়ে দিল। পুরোটা দুপুর মীরা বন্ধ ঘরে কাঁদল। কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বিকালে বড়মা ডাকতে এলো। মীরা তখনও দরজা খুলতে না চাইলে বকা দিয়ে জোর করে দরজা খুলালো। মীরাকে দেখে বড়মা হতভম্ব হয়ে গেল। কী হয়েছে মেয়েটার!
“এই মীরা কী হয়েছে তোর? তোর চোখে কী হয়েছে? এমন লাল কেন? আর চোখমুখ এরকম ফুলেছে কীভাবে?”
বড়মাকে দেখেই মীরার কান্না পেয়ে গেল। বড়মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করল।
“বল না রে মা। কী হয়েছে তোর?”
“মাথা ব্যথা করছিল বড়মা। সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই কান্না করেছি।”
“মাথা ব্যথা করছিল তুই আমাকে ডাকিসনি কেন? একা একা ঘরে পড়ে কাঁদলে মাথা ব্যথা ভালো হয়ে যাবে? ওঠ। আয় আমার সাথে ঔষধ দেই।”
মীরা বড়মাকে জড়িয়ে ধরে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলল। মীরার এরকম কাজে তিনি হতবাক। তিনি মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“কাঁদছিস কেন? এই পাগল মেয়ে। চল এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে যাব। এত ঘনঘন মাথা ব্যথা হওয়া ভালো লক্ষণ না।”
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বড়মা। আমি কী করব?”
মীরা কাউকে বলতে পারছে না। আবার সইতেও পারছে না। সে কীভাবে বড়মাকে বলবে যাকে সে ভালোবাসে সেই মানুষটা অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। মানুষটা তার সাথে কেন এমন করল?
সন্ধ্যা পর্যন্ত মীরার জ্বর এসে গেল। মূলত অতিরিক্ত কান্না করা থেকেই এই জ্বর। সবাই মীরাকে নিয়ে অস্থির হয়ে পড়ল। সুস্থসবল মেয়েটার হঠাৎ কেন মাথা ব্যথা করে জ্বর আসবে?
ছোট ফুপুরা সবাই মীরাকে দেখতে এলো। আবির এখানে এসে অবশ্য মীরার জ্বরের আসল কারণ বুঝতে পারল। ইভার মুখে সে জায়িনের মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথাটা শুনেছে। তার আর বুঝতে বাকি রইল না। আবির এটা ভেবে অবাক হলো, তার বোনটা জায়িনকে এতটাই ভালোবাসে যে, জায়িনের বিয়ের কথা শুনেই বিছানা ধরে ফেলল। মীরার এই অবস্থা দেখে স্বাভাবিক ভাবেই জায়িনের উপর রাগ হচ্ছে। মীরাকে কষ্ট দিলে জায়িনকে সে ছাড়বে না। যত ভালো বন্ধুই হোক জায়িনের বাপের নাম ভুলিয়ে দিবে।
….
মুবিন ফ্রিজ থেকে পানির বোতল নিয়ে রুমে যাবার সময় জায়িনের ঘরে আলো দেখে থামল। ভাই এখনও জেগে আছে? বেচারার ঘুমই বা আসবে কিকরে? ভালোবাসে একজনকে বাবা বিয়ে করাতে চাচ্ছে আরেকজনকে। মুবিন ভাইকে খোঁচা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারল না। নিঃশ্বাস পায়ে জায়িনের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একবার না দু’বার না, জায়িন অসংখ্য বার মীরাকে কল করেছে। কিন্তু মীরা কল তুলছে না। সকালেও তো কথা হয়েছে। হঠাৎ কী হলো মীরার? জায়িন আর ভাবতে পারছে না। ওদিকে বাবাকেও মীরার কথা কিছুই বলতে পারছে না। অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করা তো দূর দেখতেও যাবে না। কিন্তু এই কথাটা বাবাকে কীভাবে বলবে? টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে।
“কল তুলছো না কেন মীরা? সবাই মিলে আমাকে টেনশন দেওয়ার পরিকল্পনা করেছ!”
মুবিন মিটমিট করে হাসছে। গলা ঝেড়ে শব্দ করে বলল,
“এখনও ঘুমাওনি? জেগে আছো কেন?”
জায়িন মুবিনের দিকে তাকাল। কপাল থেকে চিন্তার ভাঁজ মুছে সহজ ভাবে বলল,
“ঘুম আসছে না। তুই কী করছিস?”
“রুমে পানি ছিল না। এখান দিয়ে যাবার সময় দেখলাম তোমার রুমে আলো জ্বলছে।”
“ঘুম আসছিল না তাই জেগে আছি।”
“ওহ। কাউকে কল করছিলে নাকি?”
জায়িন হাতে ধরা ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“না। এমনিতেই।”
“পরশু তাহলে মেয়ে দেখতে যাচ্ছ?”
মেয়ে দেখতে যাবার কথা শুনেই জায়িনের মুখ ছোট হয়ে গেল। মুবিন ভাইয়ের প্রতিটা আচরণ খুব ভালো ভাবেই লক্ষ করছে।
“আমি যেতে পারব না। কলেজের একটা প্রোগ্রামে ছেলেপুলেরা ডেকেছে। একসময় ওই কলেজ থেকেই পড়ে এসেছি। স্যারদের নিরাশ করতে পারলাম না। তুমি এক কাজ কোরো। আমাকে মেয়ে, স্যরি ভাবীর ছবি পাঠিয়ে দিও।”
“ভাবী ডাকছিস কেন? বিয়েটা কি হয়ে গেছে?”
“না হবার কোন সম্ভাবনা আছে নাকি? তোমার বাবার পছন্দ করা মেয়ে। তোমারও পছন্দ হয়েই যাবে।”
“হবে না। বিয়ে আমি আমার পছন্দের মেয়েকেই করব।”
কথাটা জায়িন রাগ থেকেই মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। মুবিন তো এই কথাটাই শুনতে চেয়েছিল।
“আমিও এটাই ভেবেছিলাম যে, মীরাই আমার ভাবী হবে। কিন্তু তোমার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে না এটা আর সম্ভব হবে। এখনও কাউকে বলতেই পারলে না।”
মীরার নাম শুনে জায়িন চোখ বড়ো বড়ো করে মুবিনের দিকে তাকাল।
“তুইও জানিস?”
মুবিন কিছু না বলে হাসল। জায়িন বড় করে দম ফেলে বলল,
“সবাই জেনে বসে আছিস। শুধু আমিই জানি না তোরাও যে জানিস।”
“আমাদের জানা না জানা দিয়ে কিছু হবে না। তোমার বাবাকে জানানোটাই আসল কাজ। কবে জানাবে? নাকি সবসময়ের মতো এখনও বাধ্য ছেলে হয়ে বিয়ে করে ফেলবে।
তোমাকে নিয়ে অবশ্য আমার তেমন কোন আশা ভরসা নেই। শুধু মীরার জন্য কষ্ট হচ্ছে। বেচারি ভালোবাসার জন্য আর মানুষ পেল না।”
চলবে