মন পলাশ পর্ব-০১

0
92

#মন_পলাশ ( প্রথম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১>
সৌমী মায়ের সাথে ক্লান্ত শরীরে দাঁড়িয়েছিল কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায়। বাবার ডেথ সার্টিফিকেট তুলে ফিরছে। শরীর মন কোনোটাই ভালো নেই। এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না মাথার ওপর যেই বট গাছটা ছিল, সেটা আজ নেই। বাবা নেই। একটা এক্সিডেন্ট এ সব শেষ। এই ভিড় রাস্তায় কথাটা আবার মনে পড়তেই চোখ দুটো ভিজে এলো কেমন সৌমীর। মায়ের হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো ও। তবে নন্দিনীর মাথাটা ঘুরছে এই সময়। হঠাৎ আসা এই আঘাত, এরপর সংসারের চিন্তা, স্বামী চলে যাওয়ার যন্ত্রণা সব মিলিয়ে আর টাল রাখতে পারলো না যেন। পা দুটো এলোমেলো হয়ে বসে পড়লো রাস্তায়। সৌমী এই দৃশ্য দেখে ঘাবড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো মাকে। সাথে জলও নেই। তাই কি করবে বুঝতে না পেরে আসে পাশের লোকজনদের দিকে এলোমেলো ভাবে সাহায্যের জন্য বলে উঠলো। কিছু লোকও জড়ো হয়ে এলো এই সময়।

রুক্মিণী আজ এই রাস্তা দিয়েই বাড়ি ফিরছিল গাড়িতে। জানলার কাঁচের দিকে তাকিয়েছিল আনমনে। চলন্ত রাস্তায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময়েই খেয়াল করলো রাস্তায় কিছু লোকের জটলা একজন মহিলাকে ঘিরে। মনে হয় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন উনি! কথাটা ভেবেই রুক্মিণী গাড়িটা থামাতে বললো ড্রাইভারকে। আসলে কেউ বিপদে পড়েছে দেখে আজও নিজেকে সামলাতে পারে না । সেই ছোটবেলার স্বভাব, অন্যের বিপদে এগিয়ে যাওয়া। সেদিন এই ভাবনার ভিড়েই এগিয়ে গিয়েছিল ও। কিন্তু কাছে যেতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল হঠাৎ। রাস্তায় যে অসুস্থ হয়ে বসে আছে, সে আর কেউ না, রুক্মিণীর ছোটবেলার বন্ধু নন্দিনী। কিন্তু ও এখানে এই অবস্থায় কি করছে! আর সাথে ওই ফর্সা করে মিষ্টি মুখের মেয়েটা কি নন্দিনীর মেয়ে! কথাটা ভেবেই এগিয়ে গেল রুক্মিণী নন্দিনীর দিকে। তারপর নিজের গাড়ি থেকে জল আনিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে কিছুটা সুস্থ করলো নন্দিনীকে। তবে এখানেই শেষ না। রীতি মতন জোর করে ওদের নিজের গাড়িতে তুলেছিল রুক্মিণী বাড়ি ছেড়ে দেবে বলে। নন্দিনী যদিও বেশ ইতঃস্তত করছিল এইভাবে গাড়িতে উঠতে। আসলে ছোটবেলায় স্কুলে যখন একসাথে পড়তো, তখন আলাদা ব্যাপার। কিন্তু এত বছর বাদে রুক্মিণীকে দেখেই বুঝছে ওদের দুজনের অবস্থার এখন বিস্তর পার্থক্য। যদিও রুক্মিণী এত বছর বাদে বন্ধুকে পেয়ে কিছুতেই ছাড়তে চাইছিল না। আর এই অবস্থায় যে নন্দিনীকে দেখবে সেটা ভাবতেও পারেনি! সিঁদুরহীন, শাখা পলাহীন চেহারাটা দেখেই রুক্মিণী বুঝেছিল নন্দিনীর খুব বড় একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে। সাথে সাথে ভেসে উঠেছিল বিমলদার মুখটা। ওদের দুজনের বিয়েতে তো গেছিল রুক্মিণী সেই সময়ে। অর্জুনের তখন দু বছর বয়স। ছেলে আর বরকে সঙ্গে করেই গেছিল বিয়েতে। কিন্তু আজ ওর মতন নন্দিনীরও একই অবস্থা! রংহিন একটা জীবন মেয়েটার স্বামী ছাড়া। ভেবেই খুব কষ্ট হচ্ছিল। সেদিন এরপর একদম নন্দিনীদের বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিল রুক্মিণী। সেই সময় নন্দিনী নিজে থেকেই বলেছিল এক কাপ চা খেয়ে যেতে। সেদিন কথায় কথায় নন্দিনী নিজের মনেই বলে উঠেছিল ,
_———–” একটা এক্সিডেন্ট আমাদের জীবনের সবটা বদলে দিল। ও যে আমাদের একা ফেলে এইভাবে চলে যাবে ভাবতে পারিনি। এরপর সংসার কিভাবে চলবে জানি না! জমানো টাকায় আর কদিনই বা চলবে! তাও মেয়েটা যদি একটা কাজ পেত। ”
কথাগুলো শুনে রুক্মিণী সৌমীর দিকে তাকিয়েছিল। একদম নন্দিনীর মুখ বসানো হয়েছে মেয়েটা। নিষ্পাপ মিষ্টি দেখতে। দেখেই কেমন মায়া হলো যেন। রুক্মিণী এরপর নিজে থেকেই বলে উঠলো ,
———-” সৌমীর কোয়ালিফিকেশন কি? গ্র্যাজুয়েট হয়ে গেছে তো? ”
এই কথায় সৌমীই বলে উঠেছিল,
_———-” কাকিমা, আমি কমার্সের স্টুডেন্ট।এম.কম পাশ। ”
এই কথায় রুক্মিণী সাথে সাথেই বলে উঠেছিল,
———” বাঃ। তাহলে তো আমার ছেলের অফিসেই ওর কাজ হয়ে যাবে। আমাদের কনস্ট্রাকশনের বিজনেস আছে। অর্জুনের বাবাই শুরু করেছিল। তারপর ওর বাবা চলে যাওয়ার পর অর্জুনই ব্যাবসা সব দেখাশোনা করে। আমি ওকে বলে সৌমীর চাকরির একটা ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলবো। তুই একদম চিন্তা করিস না। ”
কথাগুলো আলতো হেসে বলেছিল রুক্মিণী। এইসব শুনে নন্দিনী ওর হাত দুটো ধরে বলে উঠেছিল,
———–” সত্যি! খুব বড় উপকার হলো রে। নইলে আমি যে মেয়েটাকে নিয়ে কি করতাম এই বিপদের দিনে! ”
কথাগুলো বলতে বলতে চোখে জল চলে এসেছিল নন্দিনীর। রুক্মিণী এই মুহূর্তে নন্দিনীর হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিল,
———” এইভাবে বলিস না। তুই আর তোর মেয়ে কি আমার পর! একদম চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
কথাগুলো বলে সেদিন আর বেশিক্ষণ বসেনি রুক্মিণী। বেরিয়ে এসেছিল ওদের বাড়ি থেকে। তবে নন্দিনী আর সৌমী যেন নিজেদের জীবনে নতুন আশার আলো দেখেছিল এই মুহূর্তে। মনে হয়েছিল একটা চাকরি পেলে অন্তত সংসার চালানোর চিন্তাটা দূর হবে মাথা থেকে।

<২>
সেদিন রাতে এরপর খাবার টেবিলে বসেই রুক্মিণী অর্জুনকে বলেছিল বেশ আলতো স্বরে,
——–” আমার একটা কথা রাখতে হবে তোকে। বল শুনবি? রাগ করবি না?”
এই কথায় স্বভাবে গম্ভীর অর্জুন বেশ ক্লান্ত স্বরেই বলেছিল,
———” নিশ্চয়ই কাউকে কোন হেল্প করতে হবে। মা তুমি এরকম কেন বলো তো! মানে কেউ তোমাকে একবার নিজের প্রব্লেম দুঃখের কথা বললেই হলো! সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করতে শুরু করে দেবে। তুমি বোঝো না, এইভাবে লোকজন তোমার সুযোগ নেয়। ”
কথাটায় রুক্মিণী শান্ত স্বরে বলেছিল,
———” কেউ সুযোগ নিচ্ছে না আমার। আর যার কথা বলছি, তার মা আমার ছোটবেলার বন্ধু নন্দিনী। তুইও যখন ছোট ছিলিস ওদের বাড়ি যেতিস খুব। তারপর তোর বাবার ব্যবসার জন্য অন্য শহরে চলে আসায় আর যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু আজ সকালেই ওর সাথে আমার দেখা হয়েছে রাস্তায়। ওরা খুব বিপদে পড়েছে রে। নন্দিনীর বর মানে বিমলদা একটা এক্সিডেন্ট এ মারা গেছে কদিন আগে। মেয়েকে নিয়ে এখন খুব অসহায় অবস্থা। সেরকম কোন ইনকামও নেই ওদের। তবে ওর মেয়ে এম.কম করেছে। সেটা শুনে আমি ওদের কথা দিয়ে এসেছি যে তোর অফিসে মেয়েটার একটা চাকরির ব্যবস্থা আমি ঠিক করে দেব। মেয়েটার নাম সৌমী। খুব ভালো মেয়ে। তুই একটা চাকরি দিয়ে দে ওকে। ”
কথাটায় অর্জুন ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো,
———” মা আমাদের অফিসে এইভাবে চাকরি হয় না তুমি জানো। আমি একটা কনস্ট্রাশন কোম্পানি চালাই। কোন চ্যারিটেবল এনজিও না। আর তুমি কি করে জানলে মেয়েটা ভালো? ওর মা কে নয় ছোটবেলা থেকে চেনো, কিন্তু তার মেয়েকে তো আজই দেখলে! ”
এই কথায় রুক্মিণী বেশ জোর দেখিয়ে বললো,
———-” যার মা নন্দিনীর মতন একজন মানুষ, তার মেয়ে কখনো খারাপ হতে পারে না! আর তুই তোর মায়ের একটা কথা রাখতে পারবি না? কি চাই আমি তোর থেকে বল! আর আমি কত বড় মুখ করে নন্দিনীকে কথা দিয়ে এসেছি ওর মেয়ের চাকরি ঠিক হবে। তোর কাছে কি আমার কথার কোন দাম নেই? ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো রুক্মিণী। অর্জুন এইসব শুনে কি বলবে বুঝতে পারলো না! মায়ের প্রত্যেকবারের এই এক ডায়লগ। ইমোশনাল কথাবার্তা বলে ঠিক মানিয়ে নেবে অর্জুনকে। আর সত্যিই তো ও এই মানুষটার মুখের ওপর না বলতে পারে না। কথাগুলো ভেবে খুব অল্প কথায়ই বলে উঠলো,
———-” ঠিক আছে ঠিক আছে। আর এইসব ইমোশনাল কথাবার্তা বলতে হবে না। কাল অফিসে পাঠিয়ে দিও মেয়েটাকে দশটার মধ্যে বাওডেটা সমেত। আর আমার কিছু বলার নেই। ”
কথাগুলো বেশ বিরক্ত হয়ে বলে খাওয়ায় মন দিল অর্জুন। কিন্তু এতক্ষণে রুক্মিণীর মনে শান্তি। ছেলেটা একটু খিটখিটে ঠিকই। কিন্তু মায়ের কথায় কোনদিন না বলে না।

চলবে।