মন পলাশ পর্ব-০২

0
70

#মন_পলাশ ( দ্বিতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৩>
পরেরদিন রুক্মিণীর কথা মতন সৌমী ঠিক সকাল দশটার সময় এসে পৌঁছেছিল সেন কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অর্জুনের কেবিনে ডাক পড়েছিল সৌমীর। মনে মনে বেশ নার্ভাস ছিল আজ। তাও নিজের মনকে শক্ত করে বাওডেটা সমেত হাজির হয়েছিল অর্জুনের সামনে। চশমা পড়া বেশ গম্ভীর মুখের মানুষটাকে দেখে মনে মনে বেশ ঘাবড়ে গেলেও জোর করে আলতো হেসে বলেছিল
——–” গুড মর্নিং স্যার। আমি সৌমী। আপনি যে এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছেন, তার জন্য সত্যি থ্যাঙ্ক ইউ। ”
কথাগুলো সহজ মনেই বলেছিল সৌমী। কিন্তু অর্জুন কথাটায় খুব স্থিরভাবে সৌমীর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিয়েছিল,
———-” বুঝেছি। এইসব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেই আমার মা কে হাত করেছো। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবে, আমি আর আমার মা এক লোক নই। বসো । ”
কথাগুলো কেমন ধাক্কা দিয়েছিল সৌমীকে। ও কেমন স্থিরভাবে চেয়ারে বসেছিল এবার। অর্জুন এরপর সৌমীর রেজাল্টগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে বলেছিল,
———” আমার কোম্পানিতে আমি এক্সপিরিয়েন্স ছাড়া কাউকে কাজ দিই না। কিন্তু যেহেতু আমি আমার মায়ের কথা ফেলতে পারি না,তাই তোমাকে চাকরিটা দিতে বাধ্য হচ্ছি। তবে একটা কথা জেনে রাখো, আমি তোমাদের মতন সুবিধেবাদি স্বার্থসন্ধানী লোকেদের সব থেকে বেশি অপছন্দ করি। আর চাকরি দিয়ে দিচ্ছি মানে এই না যে কখনো নিতে পারবো না। আই উইল কিপ মাই আই অন ইউ.. যদি এফিসিয়েন্সি না দেখি আমি আমার কোম্পানিতে তোমাকে রাখবো না। কথাটা মাথায় রেখো। নাও প্লিজ লিভ। ”

কথাগুলো বেশ রুক্ষভাবে বলেছিল অর্জুন। সৌমীর চোখটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য ছলছল করে উঠেছিল এই মুহূর্তে। যদি বাবা বেঁচে থাকতো তাহলে আজ ও রিসার্চের জন্য চেষ্টা করতো। যা রেজাল্ট ছিল ইউনিভার্সিটিতে কোন ল্যাবে চেষ্টা করলে ঠিক ঢুকে যেতে পারতো। কিন্তু বাবার হঠাৎ চলে যাওয়ায় সব এলোমেলো হয়ে গেল। ওর স্বপ্ন, ওর ইচ্ছেগুলো কেমন হারিয়ে গেল চোখের পলকে। এখন শুধু রুক্ষ বাস্তবই পড়ে আছে সামনে। কথাগুলো ভেবেই সৌমী আর কিছু বললো না। থমথমে মুখে বেরিয়ে এলো অর্জুনের কেবিন থেকে।
সেদিনের পর সৌমী অফিসে আসতে শুরু করেছিল রোজ। অর্জুন তবে অফিসে আসার দ্বিতীয় দিনেই সৌমীকে ফাইলের পাহাড় হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল,
———-” এগুলো সব আমাদের কোম্পানির পুরনো হিসেবের কপি। এগুলো চেক করে দেখবে আর আমাকে রিপোর্ট করবে। সাত দিনের মধ্যে আমার ফাইনাল রিপোর্ট চাই। ”
কথাগুলো বলে অর্জুন একটা কথাই ভেবেছিল, এত পাহাড় প্রমাণ ফাইলের হিসেব চেক করা সাত দিনে মুখের কথা না। এই মেয়ে কখনোই কাজটা ঠিক সময়ে কমপ্লিট করতে পারবে না। যদিও সব হিসেবই সিনিয়র একাউন্টেন্ট গৌড়বাবুর করা। অর্জুনের বাবার আমলের লোক। তাই হিসাবে ভুল হওয়ার কোন প্রশ্নই নেই। কিন্তু তাও সৌমীকে এই কাজটা দিয়ে ও এটাই বোঝাতে চেয়েছে এই কোম্পানিতে টিকে থাকা অতো সহজ না। দিন রাত পরিশ্রম করতে হবে। এখানে কারোর রেফারেন্স নিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ালে চলবে না।
তবে অর্জুন এটা বোঝেনি যে সৌমী কাজকে দেখে কখনো ভয় পায় না, আর কাজ আসলে পিছিয়েও যায় না। সৌমী সেদিন ফাইলগুলো হাতে পেয়ে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেনি। একের পর এক পুরনো ডেটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে হারিয়ে গেছিল হিসাবের মধ্যে। সেই জন্য সেই মঙ্গলবার অফিস খালি হয়ে যাওয়ার পরেও সৌমী নিজের ডেস্ক এ বসে এক মনে হিসাব করে যাচ্ছিল। ঘড়িতে রাত তখন আটটা। অর্জুন নিজের কেবিনে বসে আনমনে কাজ করতে করতে হঠাৎ খেয়াল করেছিল কাঁচের জানলার ওপাশে খালি অফিসের কোণের টেবিলটায় আলো জ্বলছে, আর এক মনে একটা মেয়ে কাজ করে যাচ্ছে। অর্জুন দৃশ্যটা দেখে কাজ থামিয়ে দিয়েছিল নিজের। সৌমী এখনো বাড়ি যায়নি! এত রাত হয়ে গেছে! তাহলে কি ও একটু বেশিই কাজের প্রেশার চাপিয়ে দিয়েছে মেয়েটার ওপর! কথাটা ভেবে অর্জুন এই মুহূর্তে নিজে এসেছিল সৌমীর ডেস্কের সামনে। তারপর নিজের সেই গাম্ভীর্য বজায় রেখেই বলে উঠেছিল ভারি গলায়,
———” কি ব্যাপার? তুমি এখনও বাড়ি যাওনি? ”
এই কথায় সৌমীর যেন স্তম্ভিত ফিরেছিল। ও কিছুটা হকচকিয়ে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,
———” স্যার আপনি! না, আসলে অনেক ফাইল তো, তাই একটু দেরি হচ্ছে। ”
এই কথায় অর্জুন কিছুটা জোর দেখিয়ে বলেছিল,
———” এত রাত অব্দি কাজ করার কোন দরকার নেই অফিসে। লিভ নাও.. বাকি যা কাজ, কাল এসে করবে। ”
কথাটায় সৌমী দু সেকেন্ড চুপ থেকে কি একটা ভেবে বলে উঠেছিল,
———” স্যার, আমি যদি কিছু ফাইল বাড়িতে নিয়ে গিয়ে চেক করি, প্রব্লেম আছে? ”
এই প্রশ্নে অর্জুন এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটা কি তাহলে সত্যিই বেশ পরিশ্রমী, কাজ পাগল! কথাটা যেন মনে এসে উঁকি দিয়েছিল হঠাৎ। অর্জুন এরপর আস্তে গলায় বলেছিল,
——-” ইয়েস ইউ ক্যান.. ”
কথাটা শুনে সৌমী আর কোন কথা বাড়ায়নি। চুপচাপ কিছু ফাইল গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল অফিস থেকে।

তবে সেদিন অফিসের বাইরে রাস্তায় কিছু লোফার টাইপের ছেলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সামনের চায়ের ঠেকে এরা বাইক নিয়ে আড্ডা দিতে আসে। সৌমীকে একা এই রাত্রিবেলা অটোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছেলেগুলো বেশ বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল। সৌমীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে নানা রকম আকার ইঙ্গিত উল্টো পাল্টা কথা বলা শুরু করেছিল মজা করে। একটা ছেলে তো সৌমীকে আপদমস্তক মেপে বলে উঠেছিল বেশ জোরে,
———” খাসা মাল আছে কিন্তু। তা ম্যাডাম অটোর জন্য দাঁড়িয়ে আছেন না কি! আমরা আছি তো। আমরা লিফ্ট দিই? এই রাত্রিবেলা বেশ ভালো সার্ভিস দেব। ”
কথাটায় সৌমী মনে মনে কেমন অস্থির হয়ে উঠছিল। সত্যি অনেক রাত হয়েছে। একটা অটোও নেই। আর ছেলেগুলো মোটেও সুবিধের নয়। কথাটা ভেবেই ও এবার হাঁটা শুরু করেছিল। তবে ওই তিন চারজন ছেলে এবার সৌমীর পিছন পিছন বাইক নিয়ে আসতে শুরু করেছিল। সৌমী দৃশ্যটা দেখে আরো জোড়ে পা চালিয়েছিল। সত্যি এই মুহূর্তে কেমন বুক কাঁপছে ওর। ছেলেগুলো যদি উল্টো পাল্টা কিছু করে দেয়! কি করবে এই শুনশান রাস্তায়! অফিস পাড়া বলে এখন এমনিও লোকজনের ভিড় নেই। এখানে তো চেঁচিয়েও লাভ হবে না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই খেয়াল করলো একটা কালো রঙের গাড়ি এসে ওর সামনে থামলো। তারপর গাড়ির কাঁচ নামিয়ে অফিসের সেই গম্ভীর মুখের মানুষটা বলে উঠলো,
———-” এখানে এইভাবে একা হেঁটে কোথায় যাচ্ছ? গাড়িতে ওঠো। ”
কথাটা বলেই অর্জুন গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিল সৌমীকে নিজে থেকে, আর সৌমী যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল এই মুহূর্তে। আর কোন কথা না বাড়িয়ে জোরে পা চালিয়ে গাড়ির ভিতর উঠেছিল ও। এখনো যেন হাত পা কাঁপছে। তবে অর্জুনও আর অপেক্ষা করেনি। গাড়ি স্টার্ট করেছিল এই নিঃসঙ্গ রাস্তায়।
<৪>
সেদিন সৌমী কিছুটা কৃতজ্ঞ হয়েই অর্জুনকে বলে উঠেছিল,
——-” থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ স্যার। আপনি যদি আমাকে আজ লিফ্ট না দিতেন, তাহলে ওই ছেলেগুলো যে আজ কি করতো! ”
সৌমীর কথাটাকে শেষ হতে না দিয়েই অর্জুন বলে উঠেছিল,
——–” থ্যাঙ্ক ইউ বলার কিছু নেই। আর একটা এডভাইজ দিচ্ছি, সব সময় ব্যাগে একটা পিপার স্প্রে রাখবে। কখন কিভাবে কাজে লেগে যায়! যাইহোক, এইসব বলছি মানে এটা ভেবো না তুমি আমার মায়ের বন্ধুর মেয়ে বলে তোমাকে নিয়ে আমি বেশি কনসার্ন। তোমার জায়গায় অফিসের অন্য কোন এম্প্লই হলেও আমি এটা করতাম। ”
কথাগুলো বলে অর্জুন গম্ভীর মুখে গাড়ি ড্রাইভ করতে থাকলো। সৌমীও এরপর আর কথা বাড়ালো না। শুধু কাছেই একটা বাস স্টপ আসতে বলে উঠলো,
———” স্যার এখানে থামিয়ে দিন গাড়ি। আমি এখান থেকে বাস পেয়ে যাবো। ”
অর্জুন কথাটা শুনে গাড়ি থামাতেই সৌমী নেমে গেল মাঝ রাস্তায়। আসলে এইসব বড়লোক রাশভারী লোকেদের থেকে যত দূরে থাকা সম্ভব ততই ভালো। নইলে কোন কথার কি মানে ধরবে!

তবে এর দুদিন বাদে সৌমীর অফিসে আসতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। সাড়ে দশটার জায়গায় এগারোটা বেজে গিয়েছিল। আসলে মায়ের শরীরটা আজ সকাল থেকে বেশ খারাপ। লো প্রেশার। তাই ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছিল সকাল সকাল । বাবা চলে যাওয়ার পর মনে মনে এতটা ভেঙে পড়েছে মানুষটা যে শরীরের ওপর তার প্রভাব পড়ছে। না ঠিকভাবে খায়, না ঠিকভাবে ঘুমায়! এইসব এলোমেলো চিন্তার মাঝেই সৌমী অফিসে এসে পৌঁছেছিল, কিন্তু আজ অফিসে এসেই ওকে অর্জুনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, কারণ আজ একটা মিটিং ছিল ইনভেস্টরদের সাথে। অর্জুন এই মুহূর্তে সৌমীকে দেখে সবার সামনেই বেশ তীক্ষ্ণ স্বরে বলেছিল,
———” এখন কটা বাজে? এটা কি সময় অফিসে আসার? ওয়ার্কিং আওয়ার্স কটা থেকে শুরু হয় জানা আছে তো? ”
কথাটায় সৌমী বেশ হকচকিয়ে বলে উঠেছিল,
———” না স্যার, মানে আজ মায়ের শরীরটা! ”
ওর কথাটাকে শেষ হতে না দিয়েই অর্জুন বলেছিল ভীষণ বিরক্ত হয়ে,
———” মায়ের শরীর খারাপ? আই হেট দিজ কাইন্ড অফ এক্সকিউসেস.. আমার অফিসে যারা সময়ের দাম দিতে জানে না, তাদের কোন জায়গা নেই। এটা তোমার লাস্ট ওয়ার্নিং.. নেক্সট ডে আমি কিন্তু আর তোমাকে এই অফিসে এলাও করবো না। ইউ মে লিভ নাও..”
কথাগুলো শুনে সৌমী চুপচাপ বেরিয়ে এসেছিল বাইরে নিজের ডেস্ক এ। অন্যের অধীনে চাকরি করতে গেলে এরকম ব্যবহার তো সহ্য করতেই হবে! কথাটা ভেবে একটা দীর্ঘ্যশ্বাস চলে এসেছিল আপনাআপনি।
তবে সেইদিনের পর সৌমী নিজে গেছিল অর্জুনের কাছে ঠিক সাত দিনের মাথায় সমস্ত পুরনো ফাইলের রিপোর্ট সমেত। অর্জুন তো এটা দেখে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল! মেয়েটা সত্যি মাত্র সাত দিনের মধ্যে এত পুরনো ফাইলের ডেটা ঘেঁটে হিসেব করে রিপোর্ট বানিয়ে আনতে পারলো! কথাটা ভাবতেই সৌমী বলে উঠেছিল,
———” স্যার এইসব পুরনো ফাইলের মধ্যে কিছু হিসেব ভুল আছে। আমি প্রজেক্টগুলো আর ইয়ার গুলো রিপোর্টে মেনশন করে দিয়েছি। প্রজেক্টে যা খরচ হয়েছে, তার থেকে বেশি করে হিসেবে দেখানো হয়েছে। আপনি মনে হয় পুরোটা চেক না করেই সাইন করে দিয়েছেন। এতে আমাদের কোম্পানির লাভের পার্সেন্টেজ সিক্স পার্সেন্ট আরো বেশি হতে পারতো লাস্ট তিন বছরে। ”

কথাগুলো শুনে অর্জুন বেশ হকচকিয়ে গেছিল। তারপর পুরো রিপোর্টটা পড়ে আর পুরনো বছরের হিসাবগুলো মিলিয়ে সত্যিই থমকে গেছিল। এই হিসাবগুলো সব সিনিয়র একাউন্টেন্ট গৌড়বাবুর করা। এই মানুষটার ওপর ভীষণ বিশ্বাস করে অর্জুন, কারণ ওর বাবার সময় থেকে এই কোম্পানিতে আছে মানুষটা। আর এত বছর ধরে অর্জুনের সাথে আলাদাই সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। যখন বাবা হঠাৎ মারা গেল, তখন গৌড়বাবু হাতে ধরে অর্জুনকে অনেক কাজ শিখিয়েছিল ব্যবসার। সেই জন্য কখনো কখনো না পড়ে প্রজেক্ট এর ফাইনাল বাজেট সাইন করে দিত অর্জুন। কিন্তু গৌড়বাবু সেটার সুযোগ নেবে! এটা ভাবতে পারছে না ঠিক।
সেদিন এরপরই অর্জুন গৌড়বাবুকে কেবিনে ডেকেছিল। ভীষণ রেগেই অর্জুন মুখোমুখি হয়েছিল গৌড়বাবুর। কিছুতেই অর্জুন আর লোকটাকে কোম্পানিতে রাখতে চায়নি। অন্য কেউ হলে তো পুলিশে জানাতো এরকম হিসাবের গরমিলের জন্য। কিন্তু গৌড়বাবু বলেই এত দূর যায়নি অর্জুন।
কিন্তু সেদিন ও সৌমীকে সব শেষে একটা কথাই বলেছিল বেশ আস্তে গলায়,
——–” ইউ ডিড আ গুড জব..”
কথাটা শুনে সৌমীর মুখে আলতো হাসি। এই প্রথম একটা ভালো কথা শুনলো বসের মুখ থেকে।
চলবে।