মন বলেছে পর্ব-০৫

0
90

#মন_বলেছে
#তাহিরাহ্_ইরাজ

[৫]

” শা* বাট*! আমার চরম দুরবস্থার কথা শুনে তোর হাসি পাচ্ছে? তুই তো কলঙ্ক। আস্ত এক বন্ধু নামক কলঙ্ক। ”

ফোনালাপে ব্যস্ত দু’জনে। ওপাশ হতে তখনো ভেসে আসছে অট্টহাসি। শয়ন রাগে ফুঁসছে রীতিমতো। রেগেই তো উপরোক্ত কথাটা বললো। সে শুনে বন্ধু নাজমুল আরো হাসতে লাগলো। শয়ন এবার রাগ ঝেড়ে বললো,

” মুলা রে! তুই যদি এখুনি অফ না যাস, মে-রে ভূত বানিয়ে দেবো কিন্তু। ”

ভূত প্রসঙ্গ উঠতেই নাজমুলের হাসি আস্তে ধীরে মুছে গেল। শুকনো ঢোক গিলে লঘু কন্ঠে বললো,

” আর ভূত! দ্বিতীয়বার নাম নিস না ভাই। এক ভূতেই যা হলো! ”

শয়ন এ মুহূর্তে অবস্থান করছে তার বেলকনিতে। ফ্লোরে বিছানো আকর্ষণীয় ফ্লোরম্যাট। আরামদায়ক নকশিকাঁথা বিছিয়ে রাখা সেটার ওপর। দুই তিনটে কুশন, একটি কোলবালিশ-ও রয়েছে। অবসরে এখানেই গা হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে শয়ন। শুয়ে বসে সময় কাটায়। উচ্চ আওয়াজে গান শুনে পাশের বাড়ির শান্তি বিনষ্ট করার ক্ষুদ্র প্রয়াস চালায়। গেমস খেলে। লাইভ খেলা দেখে। চ্যাটিং করে। আরো কত কি! আকামের অন্ত নেই। এখন এই মুহূর্তে সে তার প্রিয় ঠিকানায় শুয়ে। পা দুটো উঁচু করে বেলকনির গ্ৰিলে ঠেকিয়ে রাখা। বন্ধুর কথায় সম্মতি পোষণ করে বললো,

” আসলেই। বা*লের ওই ভূতেই তো খেলো আমায়। কি এক নাকলি ভূত। সেটা দেখেই ফণা তোলা সাপটার যাচ্ছেতাই অবস্থা। আর সহানুভূতিশীল মনে রোগী দেখতে গিয়ে আমার সাড়ে সর্বনাশ। ”

হো হো করে হেসে উঠলো নাজমুল। বিপরীতে খ্যাক খ্যাক করে উঠলো শয়ন,

” আব্বে ওই। একদম দাঁত কেলাবি না। মূল কাণ্ডারি তো তুইই। ”

নাজমুল প্রতিবাদস্বরূপ কিছু বলবার পূর্বেই শয়ন নাটুকে কণ্ঠে বলতে লাগলো,

” ভুলে যাস না… সে রাতে ওই ভূত কিন্তু তুই নিজে ছিলি। মূলা জানু গো.. ইফানা ইকবালের পুরো গুষ্টি তোমারই খোঁজে। একবার হাতের নাগালে পেলে.. হিউম্যান কিমা বানিয়ে খেয়ে নেবে। ”

কি ভ’য়ঙ্কর হুমকি বার্তা রে! বাবা গো। লোমকূপ সব দাঁড়িয়ে গেল একচোটে। নাজমুল ভয়ার্ত ফ্যাসফেসে গলায় কোনোরকম বললো,

” হারা*! বুদ্ধি দিলি তুই। কু সঙ্গ দিলি তুই। ভূতুড়ে সাউন্ড ট্র্যাক বাজালি তুই। আমি শুধু পায়েল পায়ে ছমছম হাঁটলাম। আর ওই.. ওই কাঁটা মু`ণ্ডুটা বেলকনিতে ঠেসে ধরলাম। এতেই সব দোষ আমার? আসল কালপ্রিট তো তুই। তুই। ”

গলায় যেন ব্যাঙ ঢুকেছে। ফ্যাসফ্যাসে কি যে বললো শেষে বোঝা মুশকিল। শয়ন বিনা শঙ্কায় বললো,

” আমি কি করেছি ভাই? ওই তো স্রেফ হরর সাউন্ড ট্র্যাক বাজিয়েছি। বুদ্ধি দিয়েছি আর সাথে থেকেছি। এছাড়া বাকি সব তো তুইই করেছিস। পায়েল পায়ে রিনিঝিনি। আহা হা! কানে বাজে রে এখনো। কি সুন্দর করে হাঁটলি! আর? আর তো সে-ই কাঁটা মু’ণ্ডু। পারফেক্ট শট ছিল একদম। এক দর্শনেই ইফু সোনা বোল্ড আউট। লা জাবাব! ”

গদগদ হয়ে বলে গেল শয়ন। নাজমুল বিশ্রী একটা গালি দিয়ে বলল,

” শা*! বন্ধু নামের কলঙ্ক আমি না তুই? তুই তুই। খবরদার আর আমাকে কল করবি না। ব্লক করে দিচ্ছি এখুনি। ব্লক খোলার জন্য হোয়াটসঅ্যাপে নক করবি না। মেসেঞ্জারে নক দিবি না। আমার গরীবের বাড়ির সামনেও আসবি না। খবরদার। ”

আগেপিছে শয়নকে কিছু বলতে না দিয়েই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো নাজমুল। ফলস্বরূপ একাকী হাসতে লাগলো শয়ন। শব্দহীন, প্রাণবন্ত সে হাসি। এই বন্ধু প্রজাতির জীবগুলো হয়েই থাকে এমন। মন ভালো করার টনিক। সুসময়, দুঃসময়ের সাথী। এই একটাই তো বেস্ট ফ্রেন্ড ওর। যাকে বলে একদম পরাণের টুকরো। সে-ই ন্যাংটা কালের কয়েক বছর পর থেকে, আরম্ভ এদের দোস্তি। যা অটুট রয়েছে আজো। আলহামদুলিল্লাহ্! মূলাটা এমনই। রাগ করেছে নিজে। রাগ করে যোগাযোগের কতগুলো পথ বাতলে দিলোও নিজে। আবার সেধে সেধে যোগাযোগ করবেও সে নিজেই। ভীষণ আবেগী ছেলেটা। সরল মনের। ভেতরটা স্বচ্ছ, সুন্দর। শয়ন শুয়ে শুয়ে ভাবছিল এগুলো। ঠিক তখনই শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছালো ওই বাড়ির বুড়ির কণ্ঠস্বর। মমতা বেগম হাউকাউ করছেন জোহরা খাতুনের সঙ্গে। বাড়ির আঙ্গিনায় দুই বুড়ির যু`দ্ধ লেগেছে যেন। মমতা বেগমের কণ্ঠ শুনেই শয়নের মেজাজটা বিগড়ে গেল। স্মরণে এলো পরশু রাতের সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি….
_______

নরম হৃদয়ে রোগী দেখতে গিয়ে ভালোমতো ফেঁ`সে গিয়েছে বেচারা। শয়ন চোখ মুখ কুঁচকে গালমন্দ করতে লাগলো মনে মনে। খাটের নিচে ছটফটানি হচ্ছে। ডান হাতটি কোনোমতে একটু প্রসারিত করলো। অমনি ওরে আল্লাহ্ রে! বেদনাদায়ক আর্তনাদ জোরপূর্বক মুখে হাত চাপা দিয়ে গিলে নিলো শয়ন। বুড়িটা**। ওর হাতের ওপর পারা দিয়েছে। আল্লাহ্ গো! হাতটা মনে হয় ভেঙেই গেল। বুড়ির গায়ে এত বল এলো কোথা থেকে? খায় কি এ? বৃদ্ধদের হরলিক্স? র’ক্তিম মুখে খাটের নিচে পড়ে রইলো শয়ন। মমতা বেগম কতক্ষণ বসে রইলেন। এরপর শুলেন নাতনির ঠিক পাশেই। শয়ন তো বেখবর সে সম্পর্কে। ঘুমও পাচ্ছে বেশ। অন্যদিন দুটোর আগে ঘুম ধরে না। আজ এখুনি ঘুম পাচ্ছে?

‘ আআআ ‘

হাই তুলছে ছেলেটা। নিভু নিভু করছে চোখ। মমতা বেগম নাতনির পাশে শুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ওদিকে শয়ন অপেক্ষা করেই চলেছে কখন মমতা বেগম চলে যাবেন। সে ফাঁকে একটুখানি সুযোগ মিলবে। ফটাফট এই ঘর থেকে কেটে পড়বে ও। কিন্তু আফশোস! সে তো আর জানে না খাটের ওপরের সিনারি ঠিক কি। মমতা বেগম নাতনিকে স্নেহশীল আদর করতে করতে একসময় ওর পাশেই ঘুমিয়ে পড়লেন। এদিকে খাটের তলে অপেক্ষারত শয়ন জোরপূর্বক চোখ খিঁচে জাগনা রয়েছে। আর পারছে না। ঘুমের চোটে মাথার ভেতর ভনভন কনকন করছে। মস্তিষ্ক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে। আর পারা যাচ্ছে না।

‘ আআআআ ‘

লম্বা এক হাই তুললো ছেলেটা। তুলতে তুলতেই ঢলে পড়লো ঘুমের কোলে। আর দমন করা সম্ভব হলো না। হাত-পা গুটিয়ে যথাসম্ভব ছড়িয়ে রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো শয়ন মিয়া। ভুসভুস করে ঘুমাচ্ছে সে। খাটের ওপর দু’জন, তলে সে। ঘুমে বিভোর পুরো বাড়ি, কলোনী, এলাকা। আজকের ঘুমটা মোটামুটি ভালোই হলো। ক্লান্ত শরীরে সে ঘুমালো আর মশারা তার র;ক্ত চুষে খেল হ্যাপি হ্যাপি। মশাদের সঙ্গেই ঘুমালো গোটা রাত। ভোরবেলা ইয়া করে ইয়ে পেল শয়নের। ঘুমের ঘোরে শোয়া থেকে উঠে বসতে গিয়েই ঠাস! আম্মুউউউ! খাটের সঙ্গে মাথায় এমন আঘাত লাগলো না! মুহুর্তের মধ্যেই আঘাতপ্রাপ্ত স্থান লাল বর্ণ ধারণ করলো। ব্যথায় চোখ ছলছল করে উঠলো। ঘুম পালালো আসমানে। আকস্মিক এভাবে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় মাথার তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে। ঠিকমতো ঠাহর হচ্ছে না কিছু। শুয়ে পড়েই এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো শয়ন। কোথায় সে? এখানে কি করছে? নিজের বেডরুম বাদ দিয়ে এখানে কি করছে? কখন এলো? সে কি ম`রে ভূত হয়ে গেছে? চারপাশ এত অন্ধকার কেন? আস্তে ধীরে উপলব্ধি হলো সবটা। মিললো সকল অদ্ভুত প্রশ্নের উত্তর। মনে মনে মমতা বেগমকে গালমন্দ করতে করতে শয়ন তার কল্লা বের করলো খাটের নিচ হতে। ঘরের এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে নিলো। আশপাশে কেউ নেই। পিনপতন নীরবতা এবং অন্ধকার পরিবেশ। পরিস্থিতি অনুকূলে দেখে বিশাল বড় স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল শয়ন। খাটের নিচ হতে অবশেষে বেরিয়ে গেল আপাদমস্তক সে নিজেই। বেরিয়ে আরেকবার বড় করে শ্বাস ছাড়লো। গা, হাত-পা ব্যথায় ম্যাজ ম্যাজ করছে গো।‌ সাহেবী ছেলেটা কিনা পুরো রাত খাটের নিচে কাটিয়ে দিলো! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! কেউ জানলে মানসম্মানের কাইফা হালুকা। শয়ন রোষপূর্ণ চোখে তাকালো খাটে। ঘুমন্ত দুই প্রাণকে দেখে ফুঁসে ফুঁসে উঠছে সে। সহসা ঘুমের ঘোরে নড়ে উঠলো ইফানা।

‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’

তিড়িং বিড়িং করে একবিন্দু বিলম্ব না করে সে ঘর হতে ছুটে পালালো শয়ন। অন্ধকার করিডোর ধরে যথেষ্ট সাবধানে দৌড়াতে লাগলো। পোঁছে গেল ছাদে। ছাদের দরজা ভেতর হতে বন্ধ। সেটা সতর্ক হাতে খুলে সে প্রবেশ করলো ছাদে। এরপর আস্তে করে ছাদের দরজা ভিড়িয়ে দিলো। দেখে মনে হচ্ছে সব স্বাভাবিক। দরজা বন্ধ। অতঃপর হাঁটি হাঁটি পায়ে শয়ন পৌঁছালো নিজেদের ছাদে। কলিজা লাগালাগি করে বাড়ি অবস্থিত না? ছাদ পারাপার হতে মোটেও কষ্ট হলো না। নিজেদের ছাদে গিয়ে স্বস্তি ফিরে এলো। এবার বিপদমুক্ত সে। নিজেদের ছাদের দরজা সে খুলেই রেখে এসেছিল। এবার শুধু যাওয়ার পালা। ঘুমাচ্ছন্ন ছেলেটা ঢুলতে ঢুলতে নিজের বাড়িতে ঢুকে পড়লো। এবার সোজা যাবে ঘরে। এরপর এক লম্বা ঘুম। এক ঘুমে দুপুর বারোটা।‌ এর আগে কেউ বিরক্ত করলে তার তো… ডট ডট ডট।
________

সেদিনের বী”ভৎস স্মৃতি মনে করে শয়নের কলিজাটা কালা ভুনা হয়ে গেল যেন। ক্ষ্যা’পা বিলাইয়ের মতো উঠে দাঁড়ালো সে। উদ্দেশ্য বাড়ির আঙ্গিনায় যাওয়া এবং চার ছক্কার তালে বুড়িটাকে কুপোকাত করা। বুড়িটা কম জ্বালাতন করেনি ওকে। এর শোধ তো তুলতেই হবে। হুম। ডাটভাট নিয়ে শয়ন বাবু চললেন তার মিশনে। ওদিকে হাউকাউ তখনো চলমান।

কোনো এক ডুবন্ত অপরাহ্ন। ভুবনভুলানো রঙে রঙে সেজে উঠেছে আসমান। রাস্তার ধারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু’জনে। মিঠে রৌদ্রে চিকচিকে দেহাবয়ব। চোখে চোখ স্থির তাদের। দুই জোড়া চোখই জ্বলজ্বলে। অকুতোভয় অন্তর।

” দিবি কিনা বল? ” গমগমে কণ্ঠে শুধালো সে।

” না দেবো না। ” নির্ভীক জবাব ছোটোটার।

” মা র খাবি কিন্তু। ”

” ভয় পাই নাকি আমি? ” বলার সময় কণ্ঠটা কেমন কেঁপে উঠলো।

” মে রে ভূত বানিয়ে দেবো। ”

” বিচার দেবো। ”

” তো দে না। কে নিষেধ করছে? ”

” পিপিকে সব বলে দেবো। ”

” তোহ্..? দে। ”

” ঠিক আছে। এখুনি বলে দেবো সব। ”

কথাটি বলে পুঁচকে রনি যেই না ঘুরে দাঁড়াতে নিলো অমনি ওকে জাপটে ধরে কোলবন্দী করে ফেললো শয়ন।

” ছাড়ো। ছাড়ো আমাকে। ”

কোলের মধ্যে ছটফটে বিল্লির মতো লম্ফঝম্প দিচ্ছে রনি। শয়ন দাঁতে দাঁত পিষে বললো,

” শা* বিচ্ছু! দুই আঙ্গুলের পুঁটি হয়ে আমাকে ভাব দেখানো হচ্ছে? চিঠিটা দিবি কিনা বল? ”

রনি ভয়ার্ত গলায় বললো,

” না দেবো না। ”

” কেন দিবি না? ”

” কারণ তুমি খারাপ। ”

মুখের ওপর তিক্ত সত্যে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল শয়ন। ভ্রু কুঁচকে শুধালো,

” কেন? কি করেছি আমি? ”

” তুমি খারাপ খারাপ খারাপ। ছাড়ো আমাকে। ”

শয়ন ছাড়লো না বরং আরো জোরে জাপটে ধরলো। রনি আজ ভয়ডরহীন ভাবে, সর্বোচ্চ শক্তি খরচ করে নিজেকে ছাড়াতে চাইছে।‌ হঠাৎ এত শক্তি পেল কোথায়, ভেবে কূলকিনারা করতে পারছে না শয়ন। দু’জনের ধস্তাধস্তির মধ্যে হঠাৎ ডেকে উঠলো রনি,

” আব্বু! দেখো না শয়ন আঙ্কেল আমাকে মা’রছে। ”

ইনজামকে অকস্মাৎ ডেকে ওঠায় ঘাবড়ে গেল শয়ন। ইতিউতি না ভেবেই তৎক্ষণাৎ রনিকে ছেড়ে দিলো। রনি ঠাস করে পড়লো জমিনে। শয়ন ডাহা মিথ্যা কথা সাজিয়ে যেই না ইনজামের নিকটে পেশ করবে, অমনি.. । এ কি রে? ওই ব্যাটা ইনজাম কোথায়? কোথাও কেউ নেই যে। শেষমেষ গুঁড়ি কৃমি রনিটা ঢপ মা’রলো ওকে? শয়ন হিংস্র সিংহের মতো গর্জে উঠলো। রনির দিকে তাকাতেই দেখে, রনি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে এতক্ষণে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে দৌড় লাগিয়েছে। ফুঁশ। হতাশা ভরা বুকে দাঁড়িয়ে রইল শয়ন। টিশার্টের বুক-পকেটে অবহেলিত হয়ে পড়ে চিঠি। চিঠিটা দেয়াও হলো না। অশান্ত হৃদয়ে ক্ষণিকের শান্তিও এলো না। দুই দুইটা সপ্তাহ ধরে পু’ড়ছে হৃদয়।‌ হঠাৎ এমন হচ্ছে কেন? হৃদয়ে কিসের এত রান্নাবান্না হচ্ছে যে যখন তখন ছ্যাত করে পু’ড়ছে?

শাফায়েত শাহরিয়ার শয়ন। বেসরকারি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষ পড়ুয়া Gen-Z এর তাগড়া এক যুবক। মস্তিষ্ক ভরা যার কিলবিলে দুষ্টু বুদ্ধি। পাশের বাড়িতে তার সবচেয়ে প্রিয় এবং আকর্ষণীয়া প্রতিদ্বন্দ্বী হলো ইফানা ইকবাল। এইচএসসি পরীক্ষার্থী বেবিগার্ল ওটা। বয়সে বেশ ছোট। এতটুকুনি একটা মেয়ে। তবুও ওর সাথেই জমে বেশ। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করা। তর্ক বিতর্ক। কথায় না পেরে ওঠে ফোঁস ফোঁস করা। শ্যামাঙ্গিণী মুখটা রাগে র’ক্তবর্ণ ধারণ করা। সবটাই উপভোগ্য। তাড়িয়ে তাড়িয়ে বেশ উপভোগ করে শয়ন। এভাবেই ঝগড়াঝাঁটি করে বেশ কাটছিল দিনকাল। তবে বিগত চারটা সপ্তাহ ধরে তার জীবনটায় অদৃশ্য এক ফুলস্টপ বসিয়ে দিয়েছে যেন কেউ। বরাবরের মতই দুই বাড়ির লড়াই চলমান। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে অবতীর্ণ রয়েছে দুই পরিবার। শুধু তার প্রতিদ্বন্দ্বী ই অজানা কারণে গুটিয়ে গিয়েছে। উহু ছ্যাঁকা খাইয়া ব্যাকা হওয়ার মতো গুটিয়ে যায়নি। পুরোটাই আগের মতো আছে। শুধু ওর সঙ্গেই এক অদৃশ্য দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। যে দূরত্ব দেখা যায় না। ছোঁয়া যায় না। অনুভব করা যায় শুধু। আর অন্তরে দগ্ধ পোড়া ছাই বিছিয়ে যায়। বিগত চার সপ্তাহ অর্থাৎ এক মাস যাবত ইফানা ওকে একপ্রকার এড়িয়ে চলছে। ঝগড়া করছে না। তর্ক বিতর্কের সুযোগ দিচ্ছে না। দেখলেই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। এমন ভাব যেন শয়ন সাহেব রাতারাতি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। ইনভিসিবল ম্যান। এজন্য কতবার যে শয়ন আয়নায় নিজের অস্তিত্ব পরীক্ষা করেছে অগণ্য তা। তাকে তো ঠিকই দেখা যাচ্ছে। ছোঁয়া যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে। তবে হলোটা কি ফণা তোলা সাপের? ওটা অমন গুটিয়ে গেল কেন? পেট খারাপ থুক্কু মাথা খারাপ হয়নি তো?

সে কি জানে… কেউ একজন তার সঙ্গে দিবারাত্রি ঝগড়া করতে না পেরে ভিটামিন এনমিটি(enmity)’র অভাবে শুকিয়ে কালা কাউয়্যা হয়ে যাচ্ছে?

শয়ন দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে। অন্যদিনের মতো আজও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করছে সে। গালটা ফুলো লুচির মতো ফুলছে। পেটটাও গুলুমুলু লাগছে কিছুটা। নাহ্! আর সহ্য করা যাচ্ছে না। ঝগড়ার অভাবে দিন দিন তার শারীরিক অবনতি হচ্ছে। এরকম চলতে থাকলে শীঘ্রই সে বিশ্বসেরা পেউড্ডা’র খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলবে। উঁহু হু। তা হতে দেয়া যাবে না। এর আগেই তাকে ঝগড়া করতে হবে। ঝগড়া করে করে ওয়েট লস করতে হবে। শরীরচর্চা করেও যে কাজ হচ্ছে না। এখন একমাত্র উপায় ঝগড়া। ইয়েস। ঝগড়াআআ…

তমস্র, শান্ত এক রাত্রির। বলাকা ও শেষের কবিতা অবশ্য শান্ত, স্থির থাকতে নারাজ। জমজমাট পরিবেশ সেথায়। রেডি হবার ধুম লেগেছে দুই বাড়িতে। হৈচৈ কলরব।

” আব্বা আর কতক্ষণ লাগাবেন আপনি? দেরী হয়ে যাচ্ছে তো এবার। ”

ইকবাল হোসেন দাঁড়িয়ে বসার ঘরে। উঁচু কণ্ঠে ডেকে উঠলেন বাবা মোতালেব সাহেবকে।

” আরে বাপ, সবুর কর একটু। আমাকে রেডি হতে দে তো। ”

মোতালেব সাহেব বেডরুম থেকে সাড়া দিলেন। ইকবাল হোসেন হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বললেন,

” তাড়াতাড়ি করেন আব্বা। আমরা সবাই অলমোস্ট রেডি। এরপর দেরি হয়ে যাবে তো। ”

” আরে দাঁড়া আসছি আসছি। ”

মোতালেব সাহেব আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। ওনার পাশেই দাঁড়িয়ে ইনজাম। দাদা’কে পোশাক নির্বাচন করতে হেল্প করছে। খাটে দাঁড়িয়ে চিপস খাচ্ছে রনি। সবাই রেডি। শুধুমাত্র মোতালেব সাহেব একাই দ্বিধাগ্রস্ত। কোন পাঞ্জাবি যে পড়বেন বুঝেই উঠতে পারছেন না।

” আরে না না। এই রঙটা ভালো না। পড়লে বুড়ো দেখাবে আমাকে। ”

মোতালেব সাহেব একটা পাঞ্জাবি অবলীলায় রিজেক্ট করে দিলেন। ইনজাম অধৈর্য হয়ে বলল,

” দাদাভাই, এসব কি শুরু করলে বলো তো? তুমি তো বুড়োই। বুড়োকে বুড়ো দেখাবে না তো আন্ডার টুয়েন্টি দেখাবে? ”

মোতালেব সাহেব তৎক্ষণাৎ চটে উঠলেন,

” এই এই কি বললি ছোকড়া? আমি বুড়ো? বুড়ো তোর বাপ। জানিস.. এখনো রাস্তায় নামলে মেয়েরা আমাকে দেখে ভিমড়ি খেয়ে যায়। আকারে ইঙ্গিতে প্রপোজ করে। ”

মোতালেব সাহেব নিজের বুড়ো যৌবন নিয়ে যথেষ্ট গর্বিত। ইনজাম তো ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে। মাথা ভনভন করছে। আশির ওপরে বয়স দাদাভাইয়ের। এনাকে দেখে মেয়েরা এখনো ভিমড়ি খায়? হাউ ইজ দিস পসিবল? এক জীবনে সে করলো টা কি? ছিঃ! তার তো পিঙ্ক বি:ষ খেয়ে কচুগাছে ঝোলা উচিত।

” দাদাভাই, এই যে নাও। এটা পড়ো। তোমাকে একদম এস.আর.কে লাগবে। ”

ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো ইনজাম। লক্ষ্য করলো ছোট বোনটা এসেছে তার। দাদাভাইয়ের জন্য সুন্দর একটা পাঞ্জাবী সিলেক্ট করে দিয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে পছন্দ হয়েছে বুড়োর। উফ্! স্বস্তি! পাঞ্জাবিটা পড়লে একদম শাহরুখ খানের মতো লাগবে শুনে, মোতালেব সাহেব তো খুশিতেই গদগদ। আত্মহারা। ঝটপট রেডি হতে লাগলেন উনি। ইনজাম স্বস্তির হাসি হাসলো। থাম্বস আপ দেখিয়ে শুকরিয়া আদায় করলো বোনের। ইফানা বিপরীতে মুচকি করে হাসলো।

.

অবশেষে রেডি দুই পরিবারের সদস্যরা। একে একে বাড়ি হতে বেরিয়ে এলো তারা। পাশাপাশি দুই বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে দুই গ্রুপ। ইনজাম ও ওদিকে শয়ন দরজায় তালা আটকে দিচ্ছে। আকস্মিক…

চলবে।