মন বলেছে পর্ব-০৬

0
46

#মন_বলেছে
#তাহিরাহ্_ইরাজ

[৬]

” ওই উজবুকটা এখনো ভ্যালভ্যাল করে তাকিয়ে আছে দেখ। এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন পড়ে না চোখের পলক। শা*! আর দুই সেকেন্ডের মধ্যে যদি চোখ না সরায়, ওটার নোংরা চোখ দু’টো পুরো উপড়ে ফেলবো কিন্তু। ”

ভেতরকার হিং-স্র সত্তা জাগ্রত হয়েছে যেন। ক্ষুরধার দৃষ্টিতে কিছুটা সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে সে। মেপে নিচ্ছে আপাদমস্তক অবয়ব। নাজমুল তো হতবিহ্বল নজরে তাকিয়ে বন্ধুর নজরে। হোয়াট দ্য আশ্চর্য ইজ হ্যাপেনিং ইয়ার…?!

রাত্রি নেমেছে বসূধায়। অবশেষে রেডি দুই পরিবারের সদস্যরা। একে একে বাড়ি হতে বেরিয়ে এলো তারা। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দুই গ্রুপ। ইনজাম ও ওদিকে শয়ন দরজায় তালা আটকে দিচ্ছে। আকস্মিক সাফা বলে উঠলো,

” দাদান, দেখো তোমাদের সেম সেম আউটফিট। ”

অলিউল সাহেব কথাটা শুনেই ওই গ্রুপে তাকালেন। চোখ আটকালো মোতালেব সাহেবে। লহমায় ওনার অভিব্যক্তি পরিবর্তিত হলো। সত্যিই তো। ওনাদের দু’জনের আউটফিট একদম একই দেখতে। পাঞ্জাবির ডিজাইন হুবহু এক। শুধুমাত্র পাঞ্জাবির রঙে ঈষৎ তফাৎ। অলিউল সাহেব কিছু বলার আগেই মোতালেব সাহেব বলে উঠলেন,

” অ্যাই অ্যাই। বুড়ো তোমার সাহস তো কম নয়। আমাকে নকল করেছো কোন সাহসে? ”

” এই যে মশাই। আমি নকল করেছি না তুমি? পুরো কলোনি জানে আমি সে-ই সন্ধ্যায় রেডি। নিজে তো সবে রেডি হলে। মানে আমাকে কপি করলে।‌ কপিবাজ একটা। ”

‘কপিবাজ’ শব্দটা আত্মসম্মানে বেশ আঘাত করলো। মোতালেব সাহেব চড়া গলায় বললেন,

” একদম ফালতু কথা বলবে না। পুরো কলোনি এটাও জানে কে কারে করে কপি। নিজে কপিবাজ হয়ে অন্যকে দোষারোপ করা হচ্ছে? নাকলি বুড়ো! হুহ্! ”

ব্যাস আর কি? কথায় কথায় লেগে গেল দুই পরিবারের মধ্যে। ঝগড়াঝাঁটি করতে করতেই পায়ে হাঁটা আরম্ভ করলো তারা। গন্তব্যস্থল কাছেই। তাই পায়ে হেঁটেই যাচ্ছে তারা। শয়ন মোবাইল স্ক্রলিং করতে করতে হাঁটছে। তবে তার চোরা দৃষ্টি মাঝেমধ্যে নোঙর ফেলছে একটু সামনে পদচারণায় লিপ্ত কন্যায়। তমসাচ্ছন্ন তিমির। স্ট্রিট লাইটের হলদে আলোয় আবছায়া পরিবেশ। চন্দ্রের হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতি অন্তরীক্ষে। মায়াবী ঘোর লেগে আসছে যেন নয়নে। ইফানা তার ভাবীর পাশাপাশি হাঁটছে। কথা বলতে বলতে যাচ্ছে তারা। মেয়েটির ঠোঁটে উপস্থিত মুচকি হাসি। দুই পরিবারের ঝগড়া আপাতত বিরতি নিয়েছে। নিজেদের মতো পথ চলছে তারা। ইফানা মেয়েটির আজকের লুক বড় আকর্ষণীয়! বুকে অবিরাম ডামাডোল বাজিয়ে চলেছে সে-ই প্রথম দর্শন হতে। অ্যাঙ্কল লেন্থ আনারকলি গাউন পড়েছে মেয়েটি। টিল ব্লু রঙা চিনন ফ্যাব্রিকের গাউনটি। বাঁ কাঁধে ঝুলছে দোপাট্টা। হিজাবে আবৃত পিঠ অবধি দৈর্ঘ্যের কেশরাশি। মুখে কৃত্রিম প্রসাধনীর প্রলেপ। স্মোকি মোহাচ্ছন্ন দুই চোখের জাদুতে মোহিত হয়ে যাচ্ছে শয়ন। বারবার শতবার নিজেকে হারিয়ে ফেলছে সে। আনমনে কয়েকবার ফটোও তুলেছে। সাইড প্রোফাইল ফটো। মায়াবিনী কন্যার দু চোখের হাসিতে আনমনে হেসে ফেলছে সে নিজেও। নিজের এই অভাবনীয় পরিবর্তন সম্পর্কে পরিজ্ঞাত কি সে বান্দা? হয়তো হ্যাঁ কিংবা নয়।

.

কলোনির এক প্রতিবেশী খাইরুল সাহেব। ওনার কনিষ্ঠ কন্যার বিবাহ আজ। সে উপলক্ষে পুরো কলোনীই নেমন্তন্ন পেয়েছে। খাস নেমন্তন্ন পেয়েছে বলাকা ও শেষের কবিতার লোকেরা। খাইরুল সাহেবের সঙ্গে আলাদাই এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে তাদের। তাই তো ওনার অনুরোধ ফেলতে পারলো না এরা। সপরিবারে আসতেই হলো। খোঁচাখুঁচি বিদ্যমান। একে অপরকে ঠেলেঠুলে বিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো দুই পরিবারের সদস্যরা। খাইরুল সাহেব হাসিমুখে তাদের স্বাগত জানালেন।

” আসুন আসুন আপনারা। সবাই মিলেমিশে একসাথে এসেছেন খুব খুশি হয়েছি। ”

মোতালেব সাহেব ও অলিউল সাহেব একনজর একে অপরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দৃষ্টি হটিয়ে নিলেন। হাসিমুখে কথা বলতে লাগলেন খাইরুল সাহেবের সঙ্গে।

বিয়ে বাড়ির ঝলমলে কৃত্রিম দ্যুতি ছড়িয়ে চারপাশে। বহু লোকের আগমন হয়েছে আজ। বাড়ির আঙ্গিনা ভর্তি লোকজন। কথাবার্তার শোরগোল। বাচ্চারা ছোটাছুটি করে খেলছে। বড়রা দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কারো কারোর হাতে সফট ড্রিংকসের গ্লাস। শয়ন ও নাজমুল আঙ্গিনার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। এই কলোনীর বাসিন্দা হিসেবে নাজমুল নিজেও নিমন্ত্রণ পেয়েছে। এসেছে সাহেবী বাবু সেজে। কথার এক পর্যায়ে কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠে সে বলে উঠলো বন্ধুকে,

” দোস্ত! আজ কি লুক দিয়েছিস রে! মাশাআল্লাহ্! থু থু থু। বল্লার দল হতে আল্লাহ্ বাঁচাক তোকে। ”

” বল্লা! এখানে বল্লা পেলি কোথায়? ” জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে শয়ন।

নাজমুল মিটিমিটি হেসে বললো,

” বোঝো না তুমি? ফিডার খাওয়া কচি খোকা? ”

শয়ন দাঁত খিচে বললো,

” কানের নিচে দেবো না এমন এক। ”

” ধ্যাৎ তেরেক্কি। তুই একটা ফাউল পোলা। কথায় কথায় খালি ভায়োলেন্ট হয়ে যাস। ” মুখ বেজার করে নিলো নাজমুল।

শয়ন ত্যাছড়া হেসে বলল,

” বোঝার জন্য থ্যাংকস। ”

” জুস বানিয়ে খা তোর ওই থ্যাংকস। হুহ্! ”

শয়ন শব্দহীন হেসে উঠলো। বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বলল,

” আচ্ছা আচ্ছা। আর ভায়োলেন্ট হবো না। এবার তো বল। ”

” কি বলবো? ”

” এটাই যে বল্লা পেলি কোথায়। ”

নাজমুল দুষ্টু হেসে উঠলো,

” আশপাশে একটু নজর ঘুরিয়ে তাকাও সোনামণি। লেডি বল্লা’র অভাব নেই। ”

শয়ন ভ্রু কুঁচকে নিজের আশপাশে তাকালো। বেশি সময় লাগলো না। পুরোটা স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো মস্তিষ্কে। কালো রঙের কুর্তা, পাজামা আজ পড়েছে সে। কুর্তার ওপর ধূসরাভ লং জ্যাকেট। ফুল স্লিভ সে জ্যাকেটের। স্ট্যান্ড কলার। একদম স্টাইলিশ এথনিক ওয়্যার। গৌরবর্ণের শাফায়েত শাহরিয়ার শয়ন এই লুকে মাশাআল্লাহ্ লাগছে! তাই তো লেডি বল্লা’রা দৃষ্টি ফেরাতে ব্যর্থ। বারবার ঘুরেফিরে ওর আশপাশেই ভনভন করছে। অহেতুক রঙঢঙ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করার বৃথা চেষ্টা করছে। শয়ন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নাজমুলের দিকে তাকালো।

” এদের কথা বলছিস? আমি যেখানে এরা সেখানে। আফটার অল ম্যায় কিতনা সুন্দার হু! হায়েএএ! ”

নাটুকে কণ্ঠ শয়নের। নাজমুল সশব্দে হেসে উঠলো। আসলেই তার বন্ধুটা বেশ সুদর্শন! তাই তো এর সাথে ঘুরঘুর করে আজ অবধি মেয়ে পটাতে পারলো না সে। সো স্যাড!

ভীড় থেকে একটুখানি স্বস্তির খোঁজে নিরিবিলি এক স্থানে চেয়ারে বসে রয়েছে ইফানা। হাতে ছোট্ট বাটি। আইসক্রিম খাচ্ছে সে। লা জাবাব স্বাদ! তৃপ্তির অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছিল মেয়েটার মুখভঙ্গিতে। সহসা ধুম করে পাশের খালি চেয়ারে এসে বসলো কেউ একজন। আহ্লাদে কণ্ঠে বললো,

” তুমি কি গো হা? এভাবে আমায় ফেলে একা একা খাচ্ছো কি করে? একটুও খারাপ লাগছে না আমাকে এভাবে মনোবেদনা দিয়ে? ”

ইফানা নির্বিকার। আইসক্রিমে মগ্ন সে। বরাবরের মতই জবাব না পেয়ে শয়ন সাত সাগর দুঃখসম কণ্ঠে বললো,

” কি পাষণ্ড গো! এখনো মুখে কুলুপ এঁটে থাকবে? আল্লাহ্ পাপ দিবে পাপ। ”

ইফানা কিছু বললো না। শয়ন জমিনে দৃষ্টি ফেলে একাকী বিড়বিড় করে উঠলো,

” ফণা তোলা সাপের হলোটা কি? বোবায় ধরেছে নাকি? উহু হু। বাকি সবার সঙ্গে তো ঠিকই বলে। আমার সঙ্গেই শুধু নীরবতা। ঘটনা কি হা? ”

শয়ন মনের কথা মুখে এনে জিজ্ঞেস করতে উদ্যত হলো। অমনি লাগা জোর কা ঝাটকা! ইফানা গায়েব! গেল কোথায় এরমধ্যে? ভূতপ্রেত হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়নি তো? শয়ন অনুসন্ধানী চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে আশাহত হলো। পুঁচকে মাইয়াটা ওই তো যাচ্ছে। হেলেদুলে আইসক্রিমের বাটি হাতে ওকে অ্যাভোয়েড করে চলে যাচ্ছে।

” শা.. ”

গালিটা বলতে গিয়েও বিনা চিবিয়ে হজম করে নিলো সে। মেয়ে মানুষ এক আকাশ ভালোবাসার। গালমন্দের নয়। শয়ন হতাশ হয়ে উঠে দাঁড়ালো। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছোট ভাই রুহান। ডাকলো সে,

” রুহান। ”

রুহান তাকালে ইশারায় এদিকে আসতে বললো। রুহান অগ্রসর হলো এদিকে।

_

আঙ্গিনার একপ্রান্তে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারা দু’জনে। কৌতূহলী, লাজুক চোখে তাকিয়ে কন্যা। হাত বাড়িয়ে সম্মুখে। ছেলেটি মিটিমিটি হাসছে। মেয়েটির কিউট ফেস দেখে আর অপেক্ষা করাতে মন চাইলো না তার। তাই তো দুষ্টুমি বাদ দিয়ে পিঠের কাছে রাখা হাত দু’টো সামনে আনলো। মেয়েটি বিস্ময়াবিভূত চোখে তাকিয়ে! ছেলেটি ইশারা করলে লজ্জালু হেসে ছোট ছোট দু হাতে তুলে নিলো একটি গোলাপ ফুল। টকটকে লাল গোলাপ। মেয়েটির পরিহিত লাল আকর্ষণীয় ফ্রকের সঙ্গে বেশ মানিয়েছে। গোলাপ হাতে কন্যা বড় খুশি। ছেলেটি উদগ্রীব হয়ে শুধিয়ে উঠলো,

” ভালো লেগেছে? ”

রিনি তার রিনিঝিনি কণ্ঠে লজ্জার ভঙ্গিতে বললো,

” খুব সুন্দুত। ”

রনি চওড়া হাসলো। যাক। তার পরিশ্রম স্বার্থক তবে। বিয়ে বাড়ির সাজসজ্জা হতে ফুল চুরি যেনতেন বিষয় নয় কিন্তু। বহুত কাঠখোড় পোহাতে হয়েছে তাকে। তবেই না মিলেছে লাল টকটকে গোলাপ। এ যেন খুদে গোলাপের হাতে আরেকটি গোলাপ। রনি মনে মনে খুশিতে বাকবাকুম করছিল তখনই রিনি আস্তে করে বলে উঠলো,

” থ্যাংক কু। ”

” ইয়্যু আর মোস্ট ওয়েলকাম। ” হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো রনি।

” তুমি আমাকে সুন্দুত দেখে ফুল দিলে। আমি কি দিবো? ” ভাবুক হয়ে প্রশ্ন করলো রিনি।

রনি মুচকি হেসে ওর নরম তুলতুলে গালটা টিপে দিলো। বললো,

” কিছু চাই না আমার। ”

অতঃপর গুরুজনের মতো করে বললো,

” তোমাকে না.. কিছু দিতে হবে না। ভালো বাবুর মতো থাকবে শুধু। এই যে এখানে বিয়েতে। অনেক আঙ্কেল, আন্টি এসেছে। অচেনা অচেনা। ওদের কাছে যাবে না কিন্তু। সবসময় আমার সাথে সাথে থাকবে। নইলে তোমার আম্মুর সাথে থাকবে। ঠিক আছে? ”

রিনি ভদ্র বাচ্চার মতো মাথা নাড়লো। হ্যাঁ, বপ্পেনের কথামতোই চলবে সে। বপ্পেন যা বলেছে তার ভালোর জন্যই তো বলেছে। রিনি ইতিবাচক সম্মতি পোষণ করায় রনি খুশি হয়ে আরেকবার গাল টিপে দিলো ওর। জানতে চাইলো,

” কিছু খাবে? ক্ষুধু লেগেছে? ”

” হু। ” ছোট করে বললো রিনি।

” আচ্ছা চলো। আমরা গিয়ে আইসক্রিম খাই। খাবে? ”

রিনি দ্রুত মাথা নাড়লো। হ্যাঁ, অবশ্যই খাবে সে। রনি ওর ছোট্ট হাতটা ধরে হাঁটতে লাগলো বিয়ে বাড়িতে অবস্থিত ভ্রাম্যমাণ আইসক্রিম পার্লারের উদ্দেশ্যে। রনির হাতের ভাঁজে রিনি। রিনির হাতে গোলাপ।

” দোস্তোওওও! মাশাআল্লাহ্! তোকে কি অসাম লাগছে রে! একদম পরী। ডানাকাটা পরী‌। ”

ইফানাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভেসে উঠলো বান্ধবী ছন্দা। ইফানা হেসে উঠলো। বান্ধবীকে আলতো করে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বললো,

” তোকেও একদম জোশ লাগছে রে ভাই! কি দারুণ সেজেছিস! ”

ইফানা বান্ধবীকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে প্রশংসা করলো। ছন্দা মেকি ভাব নিয়ে বললো,

” হু। কইছে তোমারে। আমরা হলাম গিয়ে মেকআপ সুন্দরী। মেকআপ ছাড়া পিওর বান্দরনী। আর তুমি তো মিয়া ন্যাচারাল বিউটি। ”

ইফানা ওকে নকল করে সুর টেনে বললো,

” হু। কইছে তোমারে। ”

একত্রে হেসে উঠলো দুই বান্ধবী। ইফানা একটু হতাশ চিত্তে বললো,

” মিলা’টাকে মিস করছি রে। ”

” হ রে। বান্ধবী আমগো কপাল গুণে এই কলোনীর বাসিন্দা হইলো না। তাই তো বিয়াতে নো এন্ট্রি। ”

” হ্যাঁ। আ’ম শিওর মিলা এখানে থাকলে সে-ই হতো। ”

” সে আর বলতে? এতক্ষণে ছেমড়ি ক্রাশ খাইতে খাইতে বিয়ার খাওন খাইতে ভুলে যাইতো। ”

সশব্দে হেসে উঠলো দুই বান্ধবী। ঠিক তখনই সেথায় আগমন হলো এক তরুণের। আলাপচারিতা চলতে লাগলো তিনজনের। ওদিকে সামান্য একটু দূরেই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ভস্ম হচ্ছে এক অন্তর। গোলাকার এক টেবিলকে কেন্দ্র করে কয়েকটি চেয়ার। মুখোমুখী দুই চেয়ারে বসে শয়ন ও নাজমুল। শয়নের নি-ষ্ঠুর চাহনি এদিকেই গেঁথে রয়েছে। ইফানা হাসছে। হেসে হেসে কথা বলছে। এতক্ষণ বান্ধবী। এখন ওই পো’ড়ামুখোটার সঙ্গে। কি সুন্দর হাসিমুখে কথা বলছে রে। শুধু ওর সঙ্গেই দুনিয়ার সমস্ত গম্ভীরতা। গাম্ভীর্য। তখন যেন মুখে কুলুপ এঁটে দেয় কেউ। ঠাডা পড়ে। শব্দমালা হিমালয়ে পালিয়ে যায়। বোবায় ধরে। তাই তো কথা বলে না। কিছুক্ষণ আগেও তো আইসক্রিম খেতে খেতে এড়িয়ে গেল। যেন যে অদৃশ্য, অস্পৃশ্য। আর এখন হি হি হা হা করে হাসছে। হাসি আর ধরে না মুখে। হুহ্! ক্ষ্যাপাটে শয়ন টেবিলে বিছিয়ে রাখা শুভ্র রঙা টেবিল ক্লথ খামচে ধরে, অসহ্যকর সিনারি সহ্য করছে। এদিকে ওর হাবভঙ্গি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত নাজমুল, আশপাশের ললনাদের দলবল দেখে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে নিজের সেলফি তুলছে। যদিওবা কেউ তাকে পাত্তা দিলে তো। মেয়েরা তো শয়ন মিয়ায় ডুবে। আর শয়ন মিয়া ওই অজ্ঞাত ছেলেটার হাবভাব দেখছে। দেখছে কিভাবে ওটা চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে ওর ফণা তোলা সাপটাকে। শয়ন রাগে গজগজ করতে লাগলো। ফলস্বরূপ কণ্ঠনালী হতে নিঃসৃত হচ্ছে অদ্ভুতুড়ে কিছু শব্দ। রাগের বহিঃপ্রকাশ যা। এই অদ্ভুতুড়ে শব্দে নাজমুল এদিকে আকৃষ্ট হলো। বিভ্রান্ত চাহনি ফেলে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে সে। তখুনি শয়ন বলে উঠলো,

” ওই উজবুকটা এখনো ভ্যালভ্যাল করে তাকিয়ে আছে দেখ। এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন পড়ে না চোখের পলক। শা*! আর দুই সেকেন্ডের মধ্যে যদি চোখ না সরায়, ওটার নোংরা চোখ দু’টো পুরো উপড়ে ফেলবো কিন্তু। ”

ভেতরকার হিং-স্র সত্তা জাগ্রত হয়েছে যেন। ক্ষুরধার দৃষ্টিতে কিছুটা সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে শয়ন। মেপে নিচ্ছে আপাদমস্তক অবয়ব। নাজমুল তো হতবিহ্বল নজরে তাকিয়ে বন্ধুর নজরে। হোয়াট দ্য আশ্চর্য ইজ হ্যাপেনিং ইয়ার…?!

” দোস্ত! কি হয়েছে তোর? কার কথা ব.. ”

প্রশ্নটা সম্পূর্ণ করতে পারলো না নাজমুল। তন্মধ্যে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে শয়ন। হনহনিয়ে হেঁটে গেল কোনো এক দিকে। ওদিকে সেই আগন্তুক তরুণ সে-ও ইফানাদের ওখানে অনুপস্থিত। হচ্ছেটা কি ভাইইইই…….?!

মিঠে রোদমাখা এক সুবাহ। হিমেল হাওয়ার ঝাপটানি আদুরে পরশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে দেহমনে। বাড়ির ঠিক ডান পাশেই ছোট একটি বাগান। শায়লার শখের তৈরি বাগান। হরেক রকমের ফুল রয়েছে সেই বাগানে। ফুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা চারিধার। সকাল, বিকেল অবসরে এই বাগানের যত্ন করে শায়লা। কখনোবা মা রেহানা করেন। শায়লার আজ মনকাননে কৃষ্ণ মেঘ জমেছে। ফুলের আদুরে আদল তার মন ভালো করতে ব্যর্থ। তাই তো চুপটি করে বাগানে অবস্থিত মাঝারি আকারের দোলনায় বসে সে। দোলনার স্ট্যান্ডে মাথা ঠেকিয়ে বসা। মুখশ্রীতে ঘন কালো আঁধার। আনমনে কি যেন ভেবে চলেছে। ইফানা তখন এই বাড়ির পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। কোথাও গিয়েছিল সে। এখন বাড়ি ফিরবে। চলতি পথে হঠাৎ দৃষ্টি আটকালো শায়লায়। ইফানার চলন্ত পদযুগল থেমে গেল। কৌতূহলী নজরে সে তাকিয়ে রইলো। আপুর কি হয়েছে? ওভাবে মন খারাপ করে বসে আছেন কেন? কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো ইফানা। কৌতূহলী মনটাকে দমাতে না পেরে শেষমেষ পা বাড়ালো ওই বাড়ির বাগানে। ধীরপায়ে এসে ইফানা দাঁড়ালো শায়লার পাশে। আলতো করে জিভে ঠোঁট সিক্ত করে অনুমতি চাইলো,

” বসতে পারি আপু? ”

অন্যমনস্ক শায়লা শুনতে পেল না। তাই সাহস করে ইফানা বসে পড়লো দোলনায়। শায়লার বাম পাশে। মেয়েটা বসতেই দোলনা হালকা নড়ে উঠলো। এতে কিছুটা চেতন ফিরে পেল শায়লা। নিজের বাম পাশে তাকাতেই অবাক হলো ইফানাকে দেখে!

” তুমি! তুমি এখানে কি করছো? ”

” কারোর মন কেমনের দুঃখে অংশীদার হতে এসেছি। ”

শায়লা চমকালো বেশ! শুধালো,

” ঠিক বুঝলাম না। কার দুঃখে অংশীদার হতে এসেছো হা? আর এখানে এসেছ কোন ধান্দায়? মা জানলে কিন্তু হাউকাউ করবে। ”

ইফানা মুচকি হেসে বললো,

” ধান্দায় আসিনি তো আপু। ধান্দা করতে জানি না ঠিকঠাক। এসব কিভাবে করে একটু শিখিয়ে দেবে? ”

শায়লা ভ্রু কুঁচকে বললো,

” আমাকে একা পেয়ে মশকরা করছো? ”

” একা পেয়ে?! নিজেকে কি দুর্বল ভাবছো আপু? কিন্তু তুমি তো দুর্বল নও। রিনির মা তুমি। একজন নারী। নারী মানেই মহিয়সী। নারী মানেই সাহসী। ”

কথাগুলো কেমন মনে হালকা কড়া নাড়লো। ভেতরে কি যেন এক অদৃশ্য মনোবল জাগ্রত হলো। শায়লা আস্তে করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। জমিনে স্থির দৃষ্টি। ইফানা একাকী বলতে লাগলো,

” মন খারাপ হলে তা শেয়ার করতে শেখো আপু। দেখবে সমস্ত মন খারাপ আস্তে ধীরে পালিয়ে যাবে। ভেতরটা ফুরফুরে লাগবে। ”

” কাউকে নিজের যন্ত্রনা, দুর্বলতা বলতে নেই। এতে নিজেকে হেয় করা হয়। হাসির, উপহাসের পাত্রী বানানো হয়। ”

ইফানা কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে বললো,

” জানো আপু। আমার দাদী সবসময় বলে সুখের মতো দুঃখও ভাগ করে নিতে হয়। এতে জীবন সহজ হয়। ঝামেলামুক্ত হয়। হ্যাঁ, ভুল ব্যক্তিকে বললে অসুবিধা হতে পারে। তবে নিজের পরিবারকে তো বলা যেতেই পারে তাই না? ওরা তো তোমার আপনজন। একদম নিজের লোক। ওরা নিশ্চয়ই উপহাসের পাত্রী বানাবে না। তাই না আপু? ”

শায়লা বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে ইফানার দিকে! এতটুকুনি একটা মেয়ে। এইচএসসি দেবে সবে‌। আঠারো চলছে। এই তো সেদিন যেন চোখের সামনে জন্মালো। আস্তে আস্তে বড় হলো। হয়তো পূর্ণাঙ্গরূপে প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি। তাতে কি হয়েছে? মানসিকভাবে বেশ বেড়ে উঠেছে। মন মানসিকতা, চলনবলনে.. সভ্যতা, ভদ্রতা, নম্রতা রয়েছে। শায়লা প্রসন্ন চোখে তাকিয়ে ছিল। ইফানা বিভ্রান্ত চাহনি ফেলে জানতে চাইলো,

” আমি কি ভুল কিছু বলেছি? রাগ করলে আপু? ”

” না। রাগ করিনি। রাগ করার মতো কিছু বলেছো বলে তো মনে হলো না। ”

ইফানা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। উফ্! ভয় পেয়ে গেছিল সে। আফটার অল নেইবার দ্য এনিমি কিনা! ধুমধাম কখন কোথায় কিভাবে রিয়েকশন দেয়, বোঝা মুশকিল। ইফানা একবার হাতে থাকা মোবাইলে সময় দেখে নিলো। বললো,

” আপু আমি তবে যাই। আম্মু টেনশন করবে নাহয়। আসছি। মন খারাপকে টাটা বাই বাই জানিয়ে চিল করো। চিল। আল্লাহ্ হাফিজ। ”

মুচকি হেসে দোলনা হতে উঠে দাঁড়ালো ইফানা। হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে সেথা হতে চলে গেল। তপ্ত শ্বাস ফেললো শায়লা। নতুন মাসের শুরুয়াত আজ। শোকের মাস এটি। তার জীবনে। তাদের মা, মেয়ের জীবনে। স্বামী নামটা ছায়াসঙ্গী চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে চারটে বছর হতে চলেছে। আর এক সপ্তাহ বাদে মৃ`ত্যুবার্ষিকী। এই এক জীবনে ভালোবাসার মানুষ, তার মনের মানুষটির অভাব পূরণ হবার নয়। যতদিন বাঁচবে এই কষ্ট বুকে চেপেই বাঁচবে। একমাত্র মেয়েটার জন্য বাঁচবে। অন্য কারো সনে জীবন বেঁধে নেয়ার দুঃস্বপ্ন ভাবেও না সে। এক পুরুষে আসক্ত অন্তর। বাকি জীবনটা গালিব মাহমুদ এর বিধবা হয়েই বাঁচবে মিসেস শায়লা। কথা দিয়েছিল যে একদা… কখনো অন্য কারো হবে না। সে-ই প্রতিশ্রুতি এত সহজে ভুলবে কি করে? হৃদয় বিদীর্ণ করা কষ্টকর নয় কি তা?

” এটা কি করলেন আপনি শয়ন ভাই? মাথামুণ্ডু খারাপ হয়ে গেছে নাকি? ”

ফণা তোলা সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে মেয়েটি। বিপরীতে দাঁত কেলিয়ে গা জ্বালা দেয়া হাসি হাসছে শয়ন সাহেব। বেশ হয়েছে। যা হয়েছে আচ্ছা হয়েছে। এবার বোঝো ঠেলা। হুহ্!

চলবে।