মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-০৪

0
735

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ.
#পর্বসংখ্যা_০৪ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

তোপের মুখে পদত্যাগ করলো চেয়ারম্যান। পুরো গ্রামবাসীর অবস্থা বিষ্ময়ে চূর্ণ। ঘন্টাখানিকের ভেতর পুরো খেলাটা যেনো উলটে গেছে। দাবার গুটিগুলো শেষমূহুর্তে ঘুরিয়ে দিয়েছে। পদত্যাগের পেছনে কে জড়িয়ে ছিলো কেউ জানে না। তানভীরের দুই চোখ শুধু কৌতুহলে দপদপ করছে। সামান্য একটা ফোনকলে সমস্ত আয়োজন ভণ্ডুল হয়ে যাবে, এমন কিছুর কল্পনাও করেনি সে। সুজলা অজস্র প্রশ্নের হিসাব নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। আজ যেখানে মেহনূরের অবস্থা খারাপ হতো, সেখানে চেয়ারম্যানের অবস্থা বারোটা বেজে গেছে। এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা না। গুরুতর টোপ না ফেললে মেহনূর আজ বাঁচতো না। সুজলা হাতমুখ ধুয়ে নিজের ঘরে গেলেন। ফ্যানের সুইচে টিপ দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলেন। স্থির ফ্যানটা জড়তা ভেঙ্গে তিন পাখায় ঘুরতে আরম্ভ করলো। গরমের জন্য গলাটা শুকিয়ে কাঠ। একগ্লাস ঠান্ডা শরবত পেলে বুকটা ঠান্ডা হয়ে যেতো। শরবতের কথাটা ভাবতে-না-ভাবতেই কাঠের দরজায় ‘ ঠকঠক ‘ শব্দ হলো। বিনয়ী সুরে ডেকে উঠলো,

– ও ভাবী?

কন্ঠ চিনতে দেরি হয়নি। দরজার দিকে চোখ রেখে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে আসতে বললেন তিনি। সুজলার অব্যক্ত ইশারা পেয়ে চন্ঞ্চল পায়ে শেফালি ঢুকলো। শেফালির রোদে পোড়া মুখটা আজ বেশিই করুণ দেখাচ্ছে। চেহারায় কি মলিন ছাপ! দিনের-পর-দিন সংসারের পেছনে খাটাটা সহজ কর্ম ছিলো না। আজ শেফালির আন্তরিকতা দেখে মনটা ঠান্ডা হয়ে গেলো। লেবুর শরবতটা নিয়ে আফসোস করছিলেন, ওমনেই শেফালি বন্দোবস্ত করে এলো। ঠান্ডা গ্লাসটা সুজলার হাতে ধরিয়ে প্রথম প্রশ্ন করলো,

– চিন্তায় থাকবার পারতাছি না ভাবী। ওইহানে কি হইছে এল্লা খুইলা কন। পরানডা এহনো ফড়ফড়াইতাছে।

শেফালির উদ্বিগ্ন চেহারা দেখে হাসলেন সুজলা। চিন্তায়-চিন্তায় প্রহর গুণেছে এটুকু নিশ্চিত। পাশে বসার ইঙ্গিত ঠুকে ঠান্ডা গ্লাসটায় চুমুক দিলেন। তৃপ্তির স্বাদে চোখদুটো বন্ধ করে গলাটা ভিজিয়ে নিলেন। শেফালি এখনো অস্থির চাহনিতে ছটফট করছে। যে পযর্ন্ত পুরো ঘটনা না শুনবে, সেই পযর্ন্ত শান্তি নেই। আত্মাটা ঠান্ডা হবে না। সুজলা গ্লাসটা খালি করে বিছানার উপর রাখলেন। মাথাটা ঠান্ডা করে কয়েক মিনিট চুপ রইলেন। ঘটনাটা ঠিকঠাক মতো বলার জন্য গুছিয়ে নিলেন, গভীর চিন্তা থেকে ডুব দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললেন,

– সারাবছর যেই এমপির খোঁজ নেই। সেই এমপি আজ চেয়ারম্যানকে ফোন করেছে, এ কথা তোমার বিশ্বাস হয়?

শেফালি অবুঝ দৃষ্টিতে ভ্রুঁ কুঁচকালো। আসল মানেটা বোঝার জন্য বললো,

– এমপি মানে?

এবার শেফালির দিকে দৃষ্টি ঘুরালেন তিনি। মূল কথাটি বলতে কোনোপ্রকার ভণিতা করলেন না। জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে ভাবুক গলায় বললেন,

– সবকিছু গোলমাল লাগছে। আজকের ঘটনার জন্য এমপির কল আসাটা চাট্টিখানি ব্যাপার না। এখানে পলিটিক্স খাটিয়ে সবকিছু উলটে দিয়েছে। মেজো বউ, যেই চিন্তা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলাম, সেখানে তার কিছুই হয়নি। প্রচুর সন্দেহ কাজ করছে। আজকের মতো তাজ্জবের ঘটনা দ্বিতীয়টা দেখিনি। সামান্য সালিশি ব্যাপারের জন্য এমপি কক্ষনো এসবে ভিড়ায় না। এসব ছোটখাট মীমাংসা দুপক্ষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে মিটে যায়। অথচ দেখো, আজকের ঘটনাটা মেয়র ডিঙিয়ে সোজা এমপির কাছে চলে গেছে। এমপি সাব তো ইজ্জত মেরে শেষ। ওই বদমাশটা যেই অপমান করেছিলো, আমার মেহনূরকে যেসব কথা বলেছে, মনে করলেই ঘেন্না পায়। মেহনূরকে পা ধরে ক্ষমা চাইতে বলেছিলো, আমি একদম ‘ না ‘ করে দিয়েছি। পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছিলো, তখনই কোত্থেকে এমপির ফোন আসলো, সবকিছু ঝড়ের মতো ভণ্ড করে শেষ। চেয়ারম্যান ভয়েই পারেনা লুঙ্গি ভিজিয়ে দেয়। পরে মাফ-টাফ চাইলো, মেহনূরকে যেতে দিলো, আমিও চুপচাপ ওদের নিয়ে চলে এলাম। কি ধরনের মসিবত থেকে রক্ষা পেয়েছি বলে বুঝাতে পারবো না। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া মেয়েগুলোকে সহি-সলামত আনতে পেরেছি। সারা রাস্তায় শুধু এটাই ভেবেছি, কে এমপির কানে খরবটা দিলো।

পুরো ঘটনা শোনার পর শেফালি যারপরনাই অবাক! আজকের দিনে কেউ দু-পয়সা দিয়ে সাহায্য করে না, সেখানে এমপির কানে দূত পাঠিয়ে দিলো? কে করলো এই কাজ? এতো বড় সাহসের কাজ আরামপ্রিয় গ্রামবাসীরা করবে? অসম্ভব! শেফালি সাথে-সাথে নিজের মত পেশ করে বললো,

– আমার তো বিষয়ডা সুজা ঠেকতাছে না। মানুষ মানুষের লাগি কিচ্ছু করবার চায় না, ওইহানে এতো বড় উপকার করবো? আপনের কি সবকিছু ঠিকঠিক লাগতাছে?

শেফালির প্রসঙ্গটা অযৌক্তিক নয়। গ্রামের একটা মানুষও ঝামেলার ভেতর জড়াতে চায় না। সবাই গা বাঁচিয়ে চলতে প্রস্তুত। এমতাবস্থায় বাইরে থেকে সাহায্য আসাটা ভেলকি ছাড়া কিছুই না। সুজলার মনটা সেই থেকে খচখচ করে যাচ্ছে। আসল খটকাটা ধরতে না পারলেও কিছুটা যেনো বুঝতে পেরেছেন। সুজলাকে চুপ থাকতে দেখে প্রশ্ন করলো শেফালি,

– কিছু ধরবার পাইছেন নি? বুঝছেন কিছু?

সশব্দে নিশ্বাস ছাড়লেন সুজলা। নিশ্বাসের শব্দটা অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ শব্দযোগে ছেড়েছেন। শেফালি হয়তো গোঁড়ার দিকটা এখনো বুঝতে পারেনি। কিন্তু তিনি সেটা স্পষ্ট ভাবে বুঝে গেছেন। ধীরেসুস্থে সব হিসাব আয়নার মতো দেখতে পেলেন। পাশ থেকে শেফালি নানা ধরনের প্রশ্ন করে যাচ্ছে, বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে শঙ্কা অনুভব করছে, মেহনূরের উপর শকুন-দৃষ্টি পরলো কিনা সেটা নিয়ে কথা তুলছে। ঠিক ওইসময় শেফালির কথাকে অগ্রাহ্য করে সুজলা নড়েচড়ে উঠলেন। অনেকটা অন্যমনষ্ক দৃষ্টিতে শান্তসুরে বললেন,

– মেজো বউ, শেষের চালটা যে ফেলেছে, তাকে তুমি চেনো।

অপ্রস্তুত ভাবে ভ্রুঁ কুঁচকালো শেফালি। চেনো মানে? ভাবীর কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? মেহনূর যে ঘোরতর বিপদ এবং অশ্রাব্য অপমান থেকে বেঁচে গেলো, এতে কার লাভ হবে? চিন্তার চাকাটা ঘুরাতে-ঘুরাতে হিমশিম খাচ্ছে শেফালি। ‘ কে হবে, কে হবে, কে হবে, ‘ একনাগাড়ে ভাবতে থাকলে চট করে দৃষ্টি থামলো। চোখ স্থির করে অপলক চাহনিতে সুজলার দিকে তাকালো। সুজলা তখন ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। দুজনের দৃষ্টি যখন একীভূত হয়ে মোদ্দাকথায় বসলো, তখনও শেফালি নিশ্চল চাহনিতে মূঢ় হয়ে আছে। ঘরের ভেতর টিকটিকির ‘ ঠিক-ঠিক-ঠিক ‘ আওয়াজ হচ্ছে। আওয়াজটা একপর্যায়ে থেমে গেলে শেফালি খুবই অবাকসূচকে বললো,

– মাহতিম?

সুজলার শক্ত মুখটা ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে নড়ে উঠলো। প্রত্যয়ী ভঙ্গিতে সুশীল কান্তিতে বললো,

– দূরত্ব বাড়িয়েছে, গুরুত্ব কমায়নি।

.

যোহরের ওয়াক্ত শেষ। দুপুরের দ্বিপ্রহর চলছে। মোল্লাবাড়িটা নিরব হয়ে আছে। সবাই নিজ-নিজ কাজে ব্যস্ত বলে কোথাও কোনো সাড়া নেই। বাড়িতে আগের মতো হুল্লোড় নেই। শেফালির গজগজানি ঝগড়া নেই, সুরাইয়া ও সাবার চুলাচুলি নেই, সুজলার কর্কশ কন্ঠের ভয় নেই। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন, আজ হান্নান শেখ জীবিত নেই। বাড়িতে ছয়টি মানুষ বসবাস করলেও আগের মতো কিছু নেই। বাড়িটা এখনো মৃত্যুপুরী লাগে। রাত যত গভীর হয়, গা তত ছমছম করে। মাঝে-মাঝে পল্লিবিদ্যুতে সমস্যা হলে পুরো রাত কারেন্ট থাকে না। তখন মোমবাতি জ্বালানো হয়, হারিকেন ধরানো হয়, কুপির ডিবা লাগানো হয়। বাড়িটার মধ্যে কোনো পুরুষ মানুষ নেই, তবুও বিপদের আশঙ্কা নিয়ে ভয় নেই। সবার বুকেই যেনো তিমিরের ভয় কেটে গেছে। এখন অন্ধকারেই স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে। কলপাড় থেকে গোসল সেরে রুমে ফিরলো মেহনূর। আজকের ঘটনাটা তার মন ও মস্তিষ্কে গভীর দাগ ফেলেছে। যতবার মগভর্তি পানি মাথায় ঢালছিলো, তখন গুনগুন সুরে ওই বাজে কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিলো ।এসব মানুষের জন্য গ্রামে শান্তি টিকে থাকে না। গ্রামবাসীরাও বড্ড খারাপ আছে। অন্যায় আচরণ দেখেও তারা চুপচাপ সহ্য করে। যদি সত্যি-সত্যিই ওই ভণ্ড লোকটার পা ধরত হতো? ছিঃ! ভাবতেই গা-টা গুলিয়ে উঠে। নীতির প্রবচন গেয়ে শেষমেশ লোকগুলো দূর্নীতিতে জড়ায়। দেশের মধ্যে ছোট-ছোট দূর্নীতিবাজ জন্মে-জন্মে পুরো সিস্টেমটাকে নষ্ট করে ফেলেছে। মানুষ এখন যেখানেই যায়, সেখানেই দূর্নীতির ছোঁয়া লেগে থাকে। গায়ে লিনেনের কালো কামিজ, সাদা রঙের সালোয়ার। জর্জেট কাপড়ের সাদা ওড়নাটা বেশ পাতলা। আয়নার সামনে এসে চুলের গামছা খুলতেই পূর্ববৎ ঘটনাগুলো মনে পরলো। চুল মুছতে-মুছতে মাথা ঘুরিয়ে সেই দরজার দিকে তাকালো। যেই দরজার প্রবেশদ্বারে থমকানো দৃষ্টিতে নিজেকে সংযত রেখেছিলো মাহতিম, তাঁর বিষ্ময়ীভূত মুখটা এখন কল্পনায় চিন্তা করে মেহনূর। সেদিন বুঝি কঠিন লজ্জা পেয়েছিলো, নাহলে মানুষটা অপ্রতিভ হয়ে পালাতো না। মনে পরলেই খিলখিল করে হাসে মেহনূর। দরজা থেকে চোখ সরিয়ে ফের আয়নায় দেখলো। চুল মুছা শেষ করে মাথার মধ্যভাগে সিঁথি করলো। ভেজা চুলগুলো পিঠের পেছনে ছেড়ে দিয়ে সাদা ওড়নাটা গলায় নিলো। ডানহাতে ফোন এবং বামহাতে ভেজা গামছা নিয়ে সোজা নিচে নামলো। আঙিনার কাছে আসতেই সুরাইয়াকে দেখতে পেয়ে গামছা বাড়িয়ে দিলো,

– বুবু, গামছাটা একটু নেড়ে দিও।

হাত থেকে গামছা নিয়ে কাধে ফেললো সুরাইয়া।মুখে বললো,

– ঠিকআছে।

হাতে লাল বালতি নিয়ে রান্নার পানি আনতে যাচ্ছে। মেহনূর খাবারের প্লেট সাজিয়ে মায়ের কাছে গেলো। মাগরিবের আগ পযর্ন্ত মায়ের কাছেই থাকবে। ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতর ঢুকলো মেহনূর। বিছানার কাছে এসে প্লেট নিয়ে বসলো। মাহমুদাকে ধরে-ধরে উঠিয়ে হেডসাইডের সাথে হেলান দিয়ে বসালো। পানিভর্তি স্টিলের গ্লাসটা মায়ের ঠোঁটে ধরতেই বললো,

– আজ খাবার নষ্ট করবে না। যেটুকু খাওয়াবো, সব খাবে। তুমি নষ্ট করলেই আমি খাব না।

মেয়ের শাষন দেখে মাহমুদা হাসে। যেদিন অসুখের কথা ঠিকঠাক মতো জানলো, সেদিন মেহনূরের কি কান্না! মাকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলো। প্রথমে দাদা, পরে বাবা, এখন সম্ভবত মায়ের ছায়াটা হারিয়ে যাবে। যখন বিপদ আসে, তখন একটার-পর-একটা আসতেই থাকে। নিস্তার নেই, স্বস্তি নেই, প্রাণ খুলে শ্বাস নেওয়ার সাহস নেই। মাথার উপর সবকিছু ভেঙ্গে যায়, কূলকিনারা হারিয়ে অকূল পাথারে জীবন হারায়, চোখে সবকিছু অন্ধকার লাগে। জীবনের বিভীষিকা সত্য, করুণ সত্য, নিটোল সত্য বোধহয় একটাই, মানুষ একদিন চলে যাবে। চিরন্তন এই সত্যবাণীকে মানুষ কতটা অগ্রাহ্য করে! এই সত্য অগ্রাহ্য করার ফলে আকস্মিক যাত্রাটা মেনে নিতে পারে না। অসহ্য আকারে পীড়া দেয়, অব্যক্ত দহনে হৃদয় ছাড়খার করে। মাহমুদা জানেনা, তার এই অভাগা মেয়েটির কপালে আরো কি কি লেখা আছে। জীবনের সব নাটকীয় ঘটনা যেনো মানিকটার সাথেই ঘটে। আসন্ন মৃত্যু নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। বুকে শুধু এটুকুই ভয়, তার মেয়েটা কি করবে? যার হাত ছেড়ে পুরোনো বাড়িতে চলে এলো, তাকে কি মেনে নেবে? মেহনূর ভাত মাখিয়ে ছোট্ট লোকমাটা মায়ের মুখে ধরলো। নরম করে বললো,

– বিসমিল্লাহ্ বলে খাও আম্মা। নষ্ট কোরো না।

দূর্বল কাতর ঘোলা দৃষ্টিতে মুখ খুলে সে। ফ্যাকাশের ঠোঁটদুটোর ফাঁক গলে মেহনূর লোকমা গুঁজে দেয়। দাঁতের শক্তি ক্ষয় হয়ে আজ চিবোনো মুশকিল। নরম খিচুড়ি গিলে-গিলে যতদূর টেকা যায়। মেহনূর প্লেটের দিকে দৃষ্টি ফেলে লোকমা বানাতে ব্যস্ত। মাহমুদা ক্ষীণ স্বরে বললো,

– মা-মাহ-হতিমের কাকা-ছে যাবি না?

নামটা শুনেই মেহনূরের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। লোকমা পাকানো হাতটা আপনাআপনি থেমে গেলো। প্লেটের দিকে দৃষ্টি রেখে উত্তরের জন্য হাতড়াতে লাগলো। কিন্তু কি উত্তর দিবে? অসুস্থ মায়ের মুখে কি উত্তর এগিয়ে দিবে? আবার লোকমা পাকিয়ে মুখ তুললো মেহনূর। দ্বিতীয় লোকমাটা আগের মতো খাইয়ে দিতেই নিরুত্তেজ গলায় বললো,

– উনি আমাকে চান না আম্মা। দুটো বছর তো পেরিয়ে গেলো। উনি কি খোঁজ নিয়েছেন? নেননি। আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই না। তুমি চুপ করে খাও তো। খাওয়ার সময় কথা বলতে হয় না।

প্রসঙ্গটা এড়াতে চাইলো মেহনূর। মনের উপর পাথর চেপে দুঃখটা শিথিল করে রাখলো। কিন্তু মায়ের তাড়নায় পারলো না। আবার প্রশ্নের যাঁতাকলে ফেঁসে গেলো,

– ও-কে তুতু-ই ছেড়ে এসেছিস। ভুভুললটা কি তোর না?

মায়ের প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি থেকে দৃষ্টি নামালো মেহনূর। দুচোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। উত্তরে প্রত্যুত্তর করতে মন আগাচ্ছে না। নিরবতাকে সাঙ্গ করে মেহনূর একদম চুপ হয়ে গেলো। মাহমুদা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শেষমেশ উত্তরের আশা ত্যাগ করলো। বহু কষ্টে সবটুকু খিচুড়ি গলা দিয়ে নামালো। আজকাল একটু বেশি খেলেই পেট ভারি লাগে, প্রচণ্ড বমিভাব হয়, পানি পযর্ন্ত গিলতে ইচ্ছে হয়না। মেহনূর প্লেট রেখে হাত ধুয়ে ঔষুধ ছিঁড়ে নিলো। ট্যাবলেটগুলো গুঁড়ো করে পানিতে মিশিয়ে খাওয়ালো। আগের মতো শুইয়ে দিয়ে চুলে-কপালে বুলিয়ে দিলো। মাহমুদা একটু আরাম পেয়ে চোখের পাতা বুজে ফেললো। তন্দ্রার রাজ্যে ডুবে গিয়ে গভীর ঘুমে তলালো। ঘুমন্ত মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে মেহনূর। ডানহাতের আঙ্গুলগুলো চুলের গোঁড়ায় নড়ছে। যে গর্ভে নয়টা মাসের পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখলো, সেই নারীটা যাওয়ার দিন গুণছে। হাতের উলটোপিঠে চোখ ঘষলো মেহনূর। পানিগুলো টপটপ করে বিছানায় ছিঁটকে পরলো। শুকিয়ে যাওয়ার কঙ্কালসার মুখটার দিকে নিচু হলো সে, কপালের ভাঁজ পরা চামড়ায় ঠোঁট ছুঁয়ে স্নেহের চুমুটা বসিয়ে দিলো। নাক টেনে মুখ উঠিয়ে গায়ে কাঁথা দিয়ে দিলো। মায়ের পাশে গুটি মেরে শুয়ে পরলো মেহনূর। ভেজা দীঘল চুলগুলো বিছানা গড়িয়ে আজও ফ্লোরে যেয়ে পরলো। মায়ের ‘ মা, মা ‘ গন্ধের কাছে ঘণীভূত হয়ে চোখ বুজলো সে। পাপড়ি গড়িয়ে অশ্রু ঝরতেই ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পরলো।

.
রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হারিকেন ধরাচ্ছে সাবা। পাশে কেরোসিনের বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুরাইয়া। দু’বোন এখন অন্ধকার ঘুচাতে নিচে নেমেছে। একসাথে চারটা হারিকেন, দুটো কুপি জ্বালিয়ে সবার ঘরে দিতে হবে। গরমের উৎপাত বাড়তে দেরি, পল্লিবিদ্যুতের লোকেরা নিষ্ঠুরভাবে কারেন্ট টেনে নেয়। এক এলাকায় বন্ধ রেখে অন্য এলাকায় সাপ্লাই দেয়। ঠিক এরকম ধারণা নিয়ে ক্ষোভ পুষেছে সুরাইয়া। সেটাই এখন জিদের সাথে প্রকাশ করে বললো,

– এইসময় কারেন্ট গেলে চলে? মেজাজটা খারাপ লাগে না? পড়তে বসবো, এদিকে কারেন্ট পকাৎ! গরমের জ্বালায় টেকা যাচ্ছে সাবা বুবু।

সাবা হারিকেনে পলতে ঠিক করতেই হাত থামালো। সুরাইয়ার দিকে বিরক্তির দৃষ্টি ছুঁড়ে বললো,

– ওই? কারেন্টের ব্যাটারা কি আমার জামাই লাগে? আমি বললেই ওরা কারেন্ট দেবে? বেশি ভটভট করলে একদম হারিকেন তুলে মা:রবো!

সাবার তেজালো হুঙ্কারে শান্ত হলো সুরাইয়া। একে-একে সব হারিকেনে বাতি ধরিয়ে কুপিগুলো হাতে নিলো। সুরাইয়ার কাছে তিনটা হারিকেনের হাতল ধরিয়ে পাঠালো। বাকি একটা হারিকেন নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে গেলো। সুরাইয়া দুটো হারিকেন বিতরণ করে সবশেষে সুজলার কাছে গেলো। পর্দা দেওয়ার রুমটার কাছে যেতেই হঠাৎ ভেতর থেকে আওয়াজ এলো। সুজলা কার সাথে যেনো আলাপ করছে। ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে,

– তুমি হেসো না। তোমাকে চিনি বলেই চুপ আছি। তুমি যে আজ কি কাহিনি করেছো, সেটাই একটু আগে শেফালির সাথে আলোচনা করলাম। আমি টাকাটা নেবো না। কারোর বউ পালার টাকা আমি রাখবো কেন? ও আমার মেয়ে। এই শেখ বংশের নাতী। ওর দেখভালের জন্য ওর দাদা নেই ঠিকই, কিন্তু এখনো তিন-তিনটা মা বেঁচে আছে। ধানের কারবার থেকে যা আয় হয়, আলহামদুলিল্লাহ। না, আমি কোনো কথা শুনবো না। টাকাপয়সার লেনদেন আমার সাথে না। হ্যাঁ, যা বলেছি তাই। আমি এক আনাও নিতে রাজী নই। জোর কোরো না মাহতিম। বাড়াবাড়িটা বেশি হচ্ছে। যেখানে বাড়াবাড়ি প্রয়োজন সেখানে —।

হঠাৎ থেমে গেলেন সুজলা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওপাশ বন্ধ। সুরাইয়া ব্যাপারটা দেখার জন্য পর্দা ফাঁক করতেই বিষম খেলো সে। সুজলা চরম উত্তেজনা নিয়ে অস্থির কন্ঠে বলছেন,

– কি! সত্যি? কবে?

.

গ্রাম্য চরাচর আধারে ডুবেছে। নেই কোথাও আলো। বিদ্যু যেতে দেরি, পুরো গ্রামের উপর অন্ধকার ঘনাতে দেরি না। রুমের সবগুলো জানালা খুলে দিয়ে টেবিলে বসেছে মেহনূর। টেবিলের ডানদিকটা জুড়ে একাডেমির বই, বাঁদিকটা জুড়ে উপন্যাসের বই জায়গা নিয়েছে। চারকোণা টেবিলটায় সবকিছু সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা। কলমদানিতে চারটা কলম দাঁড়িয়ে আছে। সেটার পাশেই এখন কুপির ডিবাটা স্থান নিয়েছে। হলদে আলোয় টেবিলের চর্তুদিকটা উজ্জ্বল। চেয়ার টেনে খাতা মেলে অংক মেলাচ্ছে মেহনূর। শেষ মূহুর্ত্তের প্রস্তুতিটা নাকে-মুখে করছে। আর মাত্র চারটা মাস বাকি আছে। এরপরই কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ভার্সিটিমুখো হবে। ঘড়িতে রাত এগারোটা বাজে। দিনের গরম শেষে রাতটা এখন ঠান্ডা হয়েছে। খোলা জানালা দিয়ে সতেজ বাতাসটা মূহুর্মূহু গা শিউরে দিচ্ছে। চুলগুলো খোঁপায় গুঁজলেও লাভ হয়নি। এলোচুলগুলো বারবার চোখের সামনে এসে বিরক্ত করছে। জটিল একটা অংক নিয়ে বসে আছে মেহনূর। দুই পৃষ্ঠায় অংক কষে শেষপর্যন্ত মিলিয়ে ছাড়লো। বিরাট একটা হাঁফ ছাড়তেই অংকের শেষে ‘ Ans.’ লিখলো। শেষের বিন্দুটায় কলম রাখতেই থমকে গেলো মেহনূর। কুপির আলোতে লেখাটা যেনো স্থিরনেত্রে দেখছে। আরো নিখুঁতভাবে দেখতে-দেখতেই হেসে ফেললো মেহনূর। হাসি-হাসি চোখে কলম ঘুরিয়ে আরো তিনটে অক্ষর জুড়ে দিলো। নিজের অজান্তেই অদ্ভুত প্রীতিডোরে আরক্ত হলো সে। কি লিখতে যেয়ে কি লিখলো মেহনূর! আন্সার (Ans.) শব্দটাকে যোজন করে ‘ Ansari ‘ বানিয়ে ফেললো। কি সাং:ঘাতিক! কি সর্বনা:শ!

চলমান .

#FABIYAH_MOMO