মন বাড়িয়ে ছুঁই ২ পর্ব-১৬+১৭

0
588

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_১৬.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

গায়ে জ্বর। অসহন জ্বর। মাথা ঘুরছে। সবকিছু অসহ্য লাগছে। ঘোরের মধ্যে কাতরাচ্ছে মেহনূর। ঠোঁট ফাঁক করে থেমে-থেমে দম ছাড়ছে। লাগাতার জলপট্টি করছে মাহতিম। কি করলে জ্বর কমবে বুঝতে পারছেনা। মুশকিল হলো, রাত গভীর। বাইরেও ঝুম বৃষ্টি। হাসপাতালে যেতে চাইছে না। গায়ের চামড়া যেন দগ্ধ অনলের মতো পুড়ছে। মোটা কম্বল টেনে গলা পযর্ন্ত ঢেকে দিলো। তবুও থরথর করে কাঁপছে মেহনূর। কপাল থেকে গরম পট্টিটা নিতেই ফোন বাজলো মাহতিমের। পাশেই মাহতিম শুকনো মুখে তাকিয়ে আছে। কারোর জন্য অপেক্ষা করছে। হঠাৎ কানে ‘ ঠকঠক ‘ জাতীয় শব্দ এলো। মাথাটা ডানদিকে ফিরাতেই দরজার দিকে চাইলো। দরজার কাছে রুমানা ম্যাম দাঁড়িয়ে আছে। ত্রস্তভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো মাহতিম, অনুমতিজ্ঞাপনে মাথা দুলিয়ে ভেতরে আসতে বললো। আজ্ঞা মতো ভেতরে ঢুকলো রুমানা। পা চালিয়ে কাছে আসতেই শঙ্কিত মুখে বললো,

– তুমি এই রাতে এসেছো কেন? তোমার কি একটুও জানের ভয় নেই? সঙ্গে আবার বউ নিয়ে এসেছো! কেন তুমি বারবার রিস্ক নিচ্ছো মাহতিম? আমাকে কি একটু বলবে? তোমার এমন কাজকর্ম দেখলে আমিতো ভেবেই পাই না। আজ যে এভাবে আসলে, পথে যদি কিছু হতো? ওরা কি ছেড়ে দেওয়ার লোক?

রোষের সাথে কথাগুলো শোনালো। তার রাগ হচ্ছে এখন। মাহতিমের এমন উদ্ভট কীর্তি দেখলে মাথা ঠান্ডা থাকে না। ওর নির্ভীক চেতনা দেখলে ভয় পেতে হয়। বড্ড ভয় লাগে। ছেলেটা এমন বেপরোয়া আচরণ করে যে, মাঝে-মাঝে দুশ্চিন্তায় ভুগতে হয়। চোখে চশমা এঁটে বিছানায় বসলো রুমানা। ডানহাতের উলটোপিঠে মেহনূরের কপাল স্পর্শ করলো। চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো মাহতিম। হাতদুটো বুকের কাছে ভাঁজ করে ছোট্ট প্রশ্ন করলো,

– ওকে হাসপাতালে নেবো?

কপাল থেকে হাত সরালো রুমানা। সঙ্গে আনা ছোট্ট চামড়ার ব্যাগে হাত ঢুকালো সে। প্রত্যুত্তরে বললো,

– দাঁড়াও, একটু দেখে নেই। এখনই কিছু বলতে পারবো না। জ্বর তো সিরিয়াস কেস। এভাবে আনাটা ঠিক হয়নি আনসারী। জার্নি প্লাস জ্বরে মেয়েটা সাফার করছে।

ব্যাগ থেকে যন্ত্রটা বের করলো সে। যন্ত্রটা ছিলো ডিজিটাল থার্মোমিটার। থার্মোমিটারের চোখা দিকটা ওর দুঠোঁটের মাঝে গুঁজে দিলো। ব্যাগ থেকে পুনরায় ছোট্ট একটা নোটপ্যাড ও কলম বের করলো রুমানা। কলমে কিছু খসখস লিখতেই পেজটা ছিঁড়ে মাহতিমের দিকে বাড়িয়ে দিলো। হাতদুটোর বন্ধন খুলে পেজটা হাতে নিলো মাহতিম। বাঁ ভ্রুঁটা উঁচু করে লেখাগুলোয় তীক্ষ্ম চোখ বুলালো। অন্যদিকে রুমানা টেমপারেচার দেখে বললো,

– দেখেছো? প্রায় একশো চার। কয়েক পয়েন্ট কম আছে। বাকিটা তুমি জানো। এভাবে কিন্তু রাখা যাবে না।

ডানহাতের পেজটা থেকে চোখ সরালো মাহতিম। মেহনূরের দিকে একপলক তাকিয়ে রুমানার দিকে চাইলো। কয়েক মিনিট আপনমনে চিন্তা কষে কাগজটা পকেটে পুড়লো। রুমানার দিকে বিদায়সূচক ইঙ্গিত দিয়ে শান্ত গলায় বললো,

– জ্বর নামানোর দায়িত্ব আমার। আপনার প্রেসক্রাইভ মোতাবেক, এইস এক্স-আর ছয়শো পঁয়ষট্টি এম.এল. এটা আমার কাছে আছে। বাকিটা আমি দেখতে পারবো।

রুমানা ব্যাগের চেইন লাগিয়ে বসা থেকে দাঁড়ালো। লম্বা ফিতাটা কাঁধে ঝুলিয়ে অনুযোগ করে বললো,

– হ্যাঁ, কিন্তু জ্বর কমলে দুই বেলা। জ্বর কিভাবে নামে জানোই তো? স্পন্ঞ্জ নাহয় গোসল। এখন আসি। যদি কোনো সমস্যা হয় ফোন দিবে। আমি সজাগ আছি।

কাজ শেষে বিদায় নিলো রুমানা। দরজাটা আঁটকে দিলো মাহতিম। ফিরে এলো বিছানার কাছে। জ্বরটা নামাতে হবে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সোফার দিকে ছুঁড়লো। বাঁহাতের ঘড়িটা খুলতে-খুলতে মেহনূরের দিকে তাকালো। মোটা কম্বলটার নিচে কুঁকড়ে আছে মেহনূর। চক্ষুকোলের শেষপ্রান্ত থেকে অবদমিত অশ্রু ঝরছে। দৃশ্যটুকু দেখে মাহতিমের অন্তঃপুরটা কেমন গুমরে উঠলো। হৃদয়ের আলিসান প্রাসাদে মেহনূরের বেদনার্ত চিত্রটা নিতে পারলো না। ব্যথিত দৃষ্টিতে বিছানায় বসে মেহনূরের দিকে এগুলো। ডানহাতের ভরটা বালিশে ফেলে মুখটার উপর ঝুঁকলো। পূর্ণ দৃষ্টিদুটো চোখে-ঠোঁটে-কপালে রাখতেই বাঁহাত দিয়ে ওর গালটা পাঁচ আঙ্গুলে ছুঁলো। নরম গালটায় মৃদ্যু ঝাঁকুনি দিতেই নরম সুরে ডাকলো,

– ও মেহনূর?

গালটা ধরে মৃদ্যু ঝাঁকুনি দিতেই মেহনূর নড়েচড়ে উঠলো। দু’চোখের পাতা খুব ভারী। মনেহচ্ছে কেউ যেন পাথর বসিয়ে রেখেছে। গলা কেমন শুষ্ক-শুষ্ক ঠেকছে। যেন কতদিন সে পানি খায়নি। শরীরটা এতো অদ্ভুত লাগছে, এতো শূন্য-শূন্য অনুভূতি, যেনো প্রতিটি অঙ্গপ্রতঙ্গে অন্য কিছুর নিয়ন্ত্রণ। মেহনূর জ্বরের আড়মোড়া ভেঙ্গে চোখদুটো খুলল। লাল-লাল চক্ষু মেলতেই খুব সামনে, অতি নিকটে একটি সম্মোহন মুখ দেখলো। অতিশয় ব্যগ্র হয়ে তাকিয়ে আছে। তার চুপটি দেখে হাসলো মেহনূর। খুবই হালকা ঠোঁটে হাসলো। আলতো গলায় বললো,

– এভাবে তাকালে আমার লজ্জা করে। আপনার চোখদুটোর চাহনি খুব প্রখর। মনেহয় এই চোখ দিয়েই আমায় ছুঁয়ে দিচ্ছেন।

মাহতিম হাসতে চাইলো, কিন্তু পারলো না। এমন মূহুর্তে কি হাসা যায়? গালটা দৃঢ়ভাবে ধরে ওর দিকে আরেকটু ঝুঁকে এলো। গাড়িতে যেই ক্ষণটুকুর জন্য মন বিহ্বল ছিলো, নোমানের কারণে যেই লগ্নটা ছেড়ে দিয়েছে, অনুরাগের যেই অল্প সময়টুকু তখন পেয়েছিলো, সেটা আবারও উদ্ধার করলো মাহতিম। মেহনূরের উষ্ণ-জরাক্রান্ত-নীরস ঠোঁটদুটোকে নিজের অধর ভাঁজে ছোঁয়ার জন্য উদ্যত হলো সে। মাহতিমের অভিলাষী ইচ্ছাটা বুঝতে পেরে মেহনূর বাধা দিলো। মাথাটা ডানে-বামে নাড়িয়ে দূর্বল সুরে বললো,

– আমার ঠোঁটে এখন রাজ্যের জীবানু। খবরদার, চুমু খেতে যাবেন না।

মাহতিম শুনলো না। ড্যাবড্যাব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই মুখ নামিয়ে দিলো। চোখদুটো বন্ধ করে দীর্ঘ আশ্লেষের ছোঁয়া বসালো। পরোয়া করলো না কিছুই। তোয়াক্কা করলো না জ্বর। মেহনূরের গালটা ধরে গভীর-অধীর-অতল উষ্ণতা দিয়ে ঠোঁটদুটো আবদ্ধ করলো। নিজের অধরযুগলের কারাগৃহে ক্ষণেক্ষণে বন্দি মেহনূরকে বিহ্বল করে দিলো। ভাবাবিষ্ট মেহনূর আকম্প অধরসন্ধিতে বশবর্তী হয়ে ডুবে গেলো। খুব নির্মল কায়দায় কম্বলের নিচ থেকে ডানহাতটা বের করলো সে। মাহতিমের পিঠ ছুঁয়ে, ঘাড় ছুঁয়ে, মাথায় হাত রাখলো। হাতের তেলোয় আদুরে চুলগুলোকে নাড়াচাড়া করতেই হঠাৎ খামচে ফেললো মেহনূর। চোখদুটো খিঁচুনি দিতেই ঠোঁটে সুক্ষ ব্যথা অনুভব হলো। মূহুর্ত্তের দাড়িপাল্লায় ওই পরিমাণটুকু ভারী হলো না। হেরে গেলো মাহতিমের দেওয়া সুখদ অনুভূতির কাছে। কিছু সময় পর নিচের অধর দংশনটা মুক্ত হলো। ওকে ছেড়ে দিতেই চোখের দিকে চাইলো মাহতিম। গালটা ছেড়ে দিয়ে শরীর থেকে কম্বল উঠাতে-উঠাতে বললো,

– এখন তো পালাই-পালাই করলে চলবে না ম্যাডাম। আমিতো ছাড়ার জন্য কোয়ার্টারে আনিনি। পুরোটা রাস্তায় যেমন কম্বলে মুড়িয়ে বুকে করে এনেছি, এখানেও আমার অধিকার খাটাতে প্রস্তুত। দুই বছর তো কম না। সতের করে আনলাম, এখন তো বিশ ছুঁই-ছুঁই। এই বিশের বয়সটা নাহয় আমার সাথেই কাটান। দেখেন, মাহতিম আনসারী আপনাকে যত্ন-আত্তি করে কিনা।

কম্বলটা পুরোপুরি সরিয়ে ফেললো মাহতিম। মেহনূর অনুরক্ত দর্শকের মতো সবকিছু দেখছে। কিভাবে গা থেকে মোটা কম্বলটা উঠালো, দেহটা গুটি পাকিয়ে কোলে তুললো, এরপর রওনা দিলো ওয়াশরুমের দিকে। সেখানে সিলভার ট্যাপের কাছে ছোট্ট একটা টুল পাতা আছে। মেহনূরকে পাঁজকোলে করে টুলটায় বসলো মাহতিম। ট্যাপটা ছেড়ে মেহনূরের মাথাটা এগিয়ে দিলো। মেহনূরের মাথায় যখন ট্যাপের ঠান্ডা পানিটা পরছে, তখন মেহনূর চোখ বন্ধ করে হাসি ছুঁড়ে বললো,

– পুরোনো জিনিসে এখনো মন ঘঁষবেন?

বাঁহাতে সিক্ত মাথা ধরেছে মাহতিম। ডানহাতে মেহনূরের লম্বা কেশে আঙ্গুল বুলিয়ে পানি ছোঁয়াচ্ছে। ওর মুখ থেকে এমন আপত্তিকর কথা শুনে চুলে হাত থামালো সে। কথাটার ঘোরতর আপত্তি করে চুলগুলো খামচে ধরে বললো,

– কি বললে?

চুলের কিন্ঞ্চিত ব্যথায় নিচের ঠোঁট কামড়ালো মেহনূর। চোখ খুলে মাহতিমের দিকে তাকালো। ট্যাপের পানির জন্য ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না। তবুও হিমশিম চাহনিতে তাকাতে গিয়ে খিলখিল করে হেসে ফেললো। নিকষ কালো অন্ধকারের রাত্রি কেটে যখন ভোরের আলো ফুটে, একবুক আশা নিয়ে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে প্রাণসঞ্চার করে, সমস্ত কালোদিন ধুয়ে-মুছে নববর্ষের মতো আনন্দ জাগায়, ঠিক তেমনি একটা স্বচ্ছ অনুভূতি টের পেলো মাহতিম। যেন একটা মোহ, যেন একটা আনন্দ, এই কয়েক মিনিটের মূহুর্ত্তকে মনোরম করে তুলেছে। হাস্যরত মেহনূরকে শক্ত করে ধরলো মাহতিম। যেই বেদনাগ্রস্ত শোকটা মনে বুনে এসেছিলো, সেই বুননটা অদৃশ্য কাঁচিতে খুলে যাচ্ছে। বয়ে আনা ক্ষতটার যেনো ধীরে-ধীরে শুকিয়ে আসছে। মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বহুক্ষণ পর প্রাণটা জুড়িয়ে এলো। ঠোঁটে তৃপ্তির হাসিটুকু ঝুলিয়ে মাহতিম শান্তি পেলো।

.

ছল করেছে মাহতিম। পুরো বোকা বানিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেকটা পদক্ষেপ এমনভাবে রেখেছে, যেখানে কোনো সংশয় নেই। রজনী চোখদুটো বন্ধ করলো। ইজিচেয়ারে দুলতে-দুলতে নিজেকে শান্ত রাখলো। তার কার্যকরী মাথাটা খুব খাটাতে হবে। এখনো উদ্দেশ্যটা সফল হয়নি। মাহতিম এখন আগের চেয়েও চালাক। গোপনে-গোপনে কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কিচ্ছু বুঝা যাচ্ছে না। গভীর ষড়যন্ত্রের রসাতলে দিনদিন ডুবছে। যদি সে মাহদির ঘটনা জেনে যায়? যদি জেনে যায় ওর মৃত্যুটা স্রেফ দূর্ঘটনা না, তখন? অবশ্য প্রমাণ রাখেনি রজনী। কিন্তু তাও সাবধানের মার নেই। একটা গুরুত্বপূর্ণ কলের জন্য আবারও অপেক্ষা করছে। দুলতে-দুলতে ডান পাশে হাত বাড়ালো সে। গোল টেবিল থেকে কাঁচের গ্লাসটা তুলে ঢকঢক করে গিললো। তিঁকুটে স্বাদটা গলা দিয়ে নামতেই কোলের বস্তুটা বিপ্ করলো। খালি গ্লাসটা টেবিলে রেখে রিসিভ করলো রজনী। কানে রাখতেই ওপাশ থেকে সাড়া চেয়ে বললো,

– হ্যালো,

রজনী আলাদা গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো,

– হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি।

একটা পুরুষালী কন্ঠ বেশ চিন্তার সুরে বললো,

– ম্যাডাম, খবরটা বেশি ভালা না।

কথাটা শুনে রজনী শান্ত রইলো না। তৎক্ষণাৎ দোল থামিয়ে স্থির হলো। কথাটা নির্ঘাত ভয়াবহ! রাত তিনটের দিকে স্বাভাবিক কল আসে না। রজনী কানে ফোন এঁটে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার শূন্যদৃষ্টি অদূরের কোনো ঝিকমিক সড়ক দেখতে ব্যস্ত। রজনীর সাড়া না-পেয়ে পুরুষ কন্ঠটা বললো,

– ম্যাডাম শুনতাছেন?

নিজের ভয়ংকর পরিপন্থী নিয়ে ভাবছে রজনী। ভাবনায় এতো মশগুল ছিলো যে, কলের ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। অতঃপর পুরুষ কন্ঠের ছোট্ট প্রশ্নে সংবিৎ ফিরে পেলো। ভাবনার দুনিয়ায় বহু-বহু হিসাব ঝুলছে। সেসব হিসাবের খাতা আঁটি করে শান্ত সুরে বললো,

– খবরটা বলো।

পুরুষ কন্ঠটা সময় নিলো। এদিকে ধুকপুক করছে রজনীর। শান্তি-স্বস্তি দুটোই নেই। তার চেহারার অবস্থা ম্লান। চোখের দৃষ্টি স্থির। ব্লাড প্রেশারটা খারাপ লাগছে। বুকের ধুকপুকনি কমেনি। রজনী অস্থির-চন্ঞ্চল-বেচইন হয়ে ঢোক গিললো। হঠাৎ বুঝতে পারলো তার শরীর ঘামছে। প্রেশারটা হাই হয়েছে। নিশ্বাসটা বেশ উত্থাল। অনেকগুলো নিশ্বাস ছাড়ছে। অস্বাভাবিক হারে দম নিচ্ছে। মনের মধ্যে ত্রাস কাজ করছে। রজনী উত্তেজনার চোটে কিছু বলবে, ঠিক তখনই লোকটা আতঙ্কের সুরে বললো,

– সব উলোট-পালোট করতাছে ম্যাডাম। জা;নো:য়ারের মতো সবাইরে ধরতাছে। কিচ্ছু বাদ রাখেনাই। শিবলুরে ধইরা ফেলছে। কই থেকে খুঁজছে জানি না। পাওয়ার পর কু;ত্তার মতো পি:টাইতাছে। এখনো ছাড়েনাই। শিবলু যদি মুখ খুলে বিরাট লস্ হইবো ম্যাডাম! ওয় কিলারের নাম বইলা দিবো। আপনের এই একটা কেসের লিগা সবাই ফাঁইসা গেছি। সবাই হায়-হায় কইরা মাথা থাপড়াইতাছে। এতোদিন ধইরা কত্তা মানুষ মারলো, কত্তাডি গুম করলো, কেউ টিকিটাও খুঁইজা পায়নাই। পুলিশও মাল খাইয়া সইরা গেছে। কেউ কাউরে বাজাইতে আহে নাই। এখন আপনের একটা কেসের লিগা সবাইর তেরোটা বাজতাছে। আমাগোর এখন শেল্টার লাগবো ম্যাডাম। সময় বেশি নাই। হাতে সময় খুব কম। কহন কোন্ দিয়া কি কইরা লায়, বুঝতে পারতাছি না। আপনে যদি এহন হেল্প না করেন, তইলে আমি সত্য বইলা দিমু। ওই স্যারের কাছে লুকাইতাম না। হেয় বহুত পাষাণ। যেই অত্যাচারডি করতাছে, হুনলে এহন ম:রতে চাইবেন।

চলমান .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_১৭ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

গভীর রাত। নিরিবিলি কোয়ার্টার। একটা ঠান ্ডা ভাব চর্তুদিকে ছড়িয়ে আছে। ট্যাপের ছলছল পানিতে মাথা ভিজছে। চুলের গোড়ায়-গোড়ায় আঙ্গুল চালিয়ে সিক্ত করছে। কখনো গরম মুখে ঠান্ডা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কখনো কপালের উপর পানি ছুঁয়ে জ্বর নিবারণ করছে। দীর্ঘকেশের গোছাটা বালতির মধ্যে ডুবে আছে। একরাশ শ্রান্তিতে চোখ বুজে আছে মেহনূর। তার সুতনু দেহে খুব যত্নের সাথে শুশ্রূষা চলছে। যখনই জ্বরতপ্ত মুখে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পায়, তখনই ওর শরীরটা অদ্ভুত ভাবে শিউরে উঠে। শিরশির অনূভুতিটা বিদ্যুতের মতো সমস্ত দেহে বিচরণ করে। পায়ের তলায় কেমন সুড়সুড়ি অনূভুতি হয়। প্রতিটা ক্ষণেক্ষণে মনটা নরম হয়ে আসে। অসুস্থতার সময় একটুখানি সেবা পাবার জন্য মন কেমন আকুলিবিকুল করে। এই আকুলতা নিজের একান্ত মানুষকেও বলা যায় না, কখনো তাকে বিশদভাবে বোঝানোও যায় না। শুধু মন থেকে একটু বিশেষ সমাদর পাবার জন্য মনটা খুব উৎকণ্ঠায় ভোগে। কেউ যেনো তার অসুস্থতার সময় সেবা করুক, তার প্রতি দর‍দ মাখা সৌহার্দ্য দেখাক, সান্ত্বনার বুলি দিয়ে ক্ষুদ্ধ মনটা প্রসন্ন করুক, সেই রোগাক্রান্ত মানুষটা শুধু এটুকুই চায়। মেহনূর কথাগুলো ভাবতে-ভাবতে আবেগান্বিত হয়ে গেলো। চক্ষুজোড়া একটুখানি খুলে মাহতিমকে দেখার চেষ্টা করলো। ডানহাতটা তুলে ওই মানুষটার গাল ছুঁয়ে অম্লানবদনে বললো,

– হাত ব্যথা করে না?

প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসলো সে। ওর কপাল থেকে হাত সরিয়ে ট্যাপ বন্ধ করলো। হাসিটুকু ঠোঁটে রেখে হালকা সুরে বললো,

– করছে না।

এমনই উত্তর আশা করেছিলো মেহনূর। মুখ ফুটে তো কোনোদিন বলবে না। ট্যাপটা বন্ধ করতেই হালকা একটা টান দিয়ে বসিয়ে নিলো। একটা শুকনা টাওয়েল দিয়ে ভেজা মাথাটা মুছিয়ে দিলো। ভরা বালতি থেকে চুলের গোছাটা উঠিয়ে চটপট লম্বা চুলগুলো ঝেড়ে দিলো। মেহনূর নিরবে-নিরবে দুই চক্ষু মেলে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কি সুন্দর, কি যত্নের সাথে সাদা টাওয়েলটা মাথায় পেঁচিয়ে দিলো। পুনরায় শরীর গুটিয়ে কোলে তুললো মাহতিম, রুমের দিকে হাঁটা ধরলে মুখের পানে চাইলো। আজ গলাটা জড়িয়ে ধরেনি মেহনূর, হাতদুটো বুকের কাছে মুঠো করে কাঁপা-কাঁপি করছে। তখনই মাহতিমের খেয়াল হলো, গায়ের শাড়িটা, কালো ব্লাউজটা ভিজে গেছে। এই অবস্থায় আরো কিছুক্ষণ থাকলে ভয়াবহ ঠান্ডা লাগবে। এই ঠান্ডায় নিউমোনিয়া হলে বিপদের-উপর-বিপদ! মাহতিম চটজলদি বিছানায় নামিয়ে আলমারির দ্বার খুললো। সেখান থেকে বিশালাকার এক স্বচ্ছ প্যাকেট ফ্লোরে বের করলো। সাদা চেইনটা বাম থেকে ডানে টানতেই প্যাকেটের মুখটা উঠিয়ে ফেললো সে। একটা মোটা-ভারী কম্বল বিছানার উপর রাখতেই ফ্যানের রেগুলেটর কমিয়ে বললো,

– দুই মিনিট।

ঠোঁট ফাঁক করে ঠকঠক করতেই চোখ খাটো করলো মেহনূর। ‘ দুই মিনিট ‘ কথাটার ভাষা বুঝতে পারেনি সে। শীতে তার সমস্ত শরীর যে-হারে কাঁপছে, তার বক্ষতালু পযর্ন্ত প্রচণ্ড শিহরণে ঠুকছে। মেহনূর কাঁপুনে গলায় ঠেকে-ঠেকে বললো,

– ফ্যানটা বন্ধ করলে হয় না?

চট করে সুইচ টেপার শব্দ হলো। চর্তুদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে চারধার আবদ্ধ হলো। রুমের ভেতর নূন্যতম আলো নেই। অন্ধ তমিস্রায় ঢেকে আছে রুম। জানালাগুলোতে লম্বা-লম্বা পর্দা দেওয়া। বাইরের এ্যানার্জি বাল্বের আলো ফাঁকফোঁকর দিয়ে ঢুকছে না। মেহনূর এহেন কাণ্ডে চরম বিষ্ময় প্রকাশ করলো। কেন বাতিটা বন্ধ করলো? উনি কি শীতের অবস্থা দেখছেন না? কম্বলটা নিয়ে কাছে আসবেন না? কেন অন্ধকারটা করে দিলেন? এটা কি ভুলবশত করে বসলেন? এমন সব প্রশ্নের কাছে জর্জরিত হতেই উঠে দাঁড়ালো মেহনূর, তখনই কাধের উপর হাত রাখলো কেউ। চমকালো না মেহনূর। হাতটা তার কাছে অন্ধের মতোই পরিচিত। সে চোখ বন্ধ করে এমন স্পর্শটা চিনতে পারে। অন্ধকারটা এখনো চোখ সয়ে আসছে না। বাঁ কাধের উপর হাতটা কিছু একটা করছে। কাধের কাছে ছোট্ট সেইফটিপিনটা খুললে চট করে সম্পূর্ণ আঁচলটা মেঝেতে পরে গেলো। আরক্ত মেহনূর তৎক্ষণাৎ হাতদুটো মুঠো করে ফেললো। সংকুচিত লজ্জায় ঢোক গিলে চোখ খিঁচালো সে। বুকের ছোট্ট যন্ত্রটা ঢিপঢিপ করে ছুটছে। দুটো শক্ত-দৃঢ় হাত মেহনূরের বাহুদুটো আঁকড়ে কাছে টেনে নিলো। সিক্ত দেহটা অনুভব করলো শক্ত উন্মুক্ত বুক। কপালটা আস্তে-আস্তে নিশ্চিতভাবে পেশিময় বুকটায় ঠেকিয়ে দিলো মেহনূর। হাতদুটোর মুঠো খুলে সৌষ্ঠব্য পিঠটা আঁকড়ে ধরলো সে। চোখ বন্ধ করে বিহ্বলচিত্তে মিশে যেতে চাইলো, অধীর ভাবে ব্যাকুরচিত্তে লুকিয়ে পরতে চাইলো। নিজেকে আবদ্ধ করতে চাইলো মাহতিমের কাছে। মেহনূরের টাওয়েল পেঁচানো মাথায় থুতনি রাখলো মাহতিম। চোখ বন্ধ করে বুক ফুলানো নিশ্বাস টেনে জড়িয়ে ধরলো মেহনূরকে। সেই বিদঘুটে দিন, সেই অবসন্ন বিকেল, সেই ছেড়ে যাওয়া ক্ষণটুকু স্মরণ করলো মাহতিম। বিচ্ছেদের ক্ষতটা রোমন্থন করতেই মেহনূরকে দস্যুর মতো জাপটে ধরলো। যেনো চুরি করা দামী বস্তুটা কেউ এক্ষুণি ছিনিয়ে নিবে। মেহনূর উষ্ণ আলিঙ্গনটুকু আশ্লেষের সাথে অনুভব করছে। এক নৈসর্গিক আবেশে ক্ষণেক্ষণে তলিয়ে দিচ্ছে। থেমে যাক মূহুর্ত, থেমে যাক। যখন গাছ থেকে অফুটন্ত ফুল ছেঁড়া হয়, মানুষ আকৃষ্ট হয়ে সেই নব্য ফুলের অস্ফুট পাতা একটা-একটা করে ছুটিয়ে ফেলে, তখন যেই ছোট্ট মুকুলটা বেরিয়ে সবশেষে আসে, ঠিক সেভাবেই মেহনূরের সমস্ত সিক্ত বসন একে-একে খুলে ফেললো মাহতিম। মাথার টাওয়ালটাও হালকা টানে খুলে দিলো। ভেজা চুলগুলো নিঃশব্দে ওর শরীর ছুঁয়ে হাঁটুর কাছে পরলো। সৌহার্দ্য আবেশে আচ্ছন্ন হৃদয়ে মেহনূরকে শুইয়ে দিলো মাহতিম। সদ্য আনা কম্বল দিয়ে গা ঢেকে নিজেও ওমের তলায় লুকিয়ে পরলো। নরম তুলতুলে বালিশটায় মাথা রাখলো সে। ডানদিক বরাবর কাত হয়ে দুহাত মেহনূরের দিকে বাড়িয়ে দিলো। অনুরোধের সুরে বললো,

– তোমার ভূষণ হবার সুযোগ দাও মেহনূর। আসো আমার কাছে।

চোখ সওয়া অন্ধকারে তাকিয়ে আছে মেহনূর। প্রচণ্ড শীত করছে। কম্বলের নিচে গুটিয়ে আছে সে। কিছুটা দূরত্বে শুয়ে আছে মাহতিম। বাড়িয়ে দেওয়া হাতদুটোতে একপলক চাইলো। আরক্তমুখে দৃষ্টি নামালো মেহনূর, লজ্জাতুর ক্ষীণ হাসিতে নিজের দিকে একপলক তাকিয়ে দু’চোখ বন্ধ করলো। এই বালিশ থেকে ওই বালিশের দূরত্বে যেতেই দুহাতে ওকে জড়িয়ে ফেললো মাহতিম। বুকের সাথে মিশিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ডানদিক থেকে বামদিকে এনে শোয়ালো। লম্বা চুলগুলো বালিশ ছাপিয়ে বিছানা গড়িয়ে ফ্লোরে যেয়ে পরলো। জড়িয়ে ধরা মেহনূরকে গভীর চুমু দিলো সে। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেই প্রসন্ন কন্ঠে বললো,

– ঘুমিয়ে নাও। ঘুম থেকে উঠলে পুরোটা এরিয়া ঘুরিয়ে আনবো।

মাহতিমের উষ্ণকুঠিতে নিজেকে অর্পণ করলো মেহনূর। শ্রান্তির, তৃপ্তির, আসুপ্তির মেলবন্ধনে দুচোখ বুজে এলো তার। আরক্ষক মানুষটার কাছে নিশ্চয়তার আশ্বাস পেয়ে অনুরক্ত হলো সে। ছোট্ট একটা আবদার জানিয়ে বললো,

– সেদিন সন্ধ্যার মতো একটা গান শোনাবেন?

কপালে চুমু খেয়ে মাহতিম হাসলো। নিজের অপারগ ব্যাপারটা প্রকাশ করে বললো,

– গান যে পারি না। আমার তো চর্চায় নেই। একদম ভুলে গেছি। অন্য কোনো আবদার করো মেহনূর। ওসব রাখার চেষ্টা করবো।

মেহনূর গোঁ ধরে বসলো। আকুতি-মিনতি জানিয়ে আরেকবার বললো,

– শুধু একবার, একটুখানি, ওইদিনের মতো চোখে-চোখ রেখে একটুখানি শোনাবেন। আমি কিচ্ছু চাই না, কিচ্ছু চাইবো না। শুধু —

ঠোঁটে একটু ভালোবাসা দিলো মাহতিম। মাথাটা বুকে জড়িয়ে বললো,

– তাহলে এখন না। এখন ঘুমোও। একটু সময় দাও, দেখি কি করা যায়।

মনে-মনে একটা ব্যাপারে ভীষণ হাসি পেলো মেহনূরের। এই মানুষটা নিজেকে নিয়ে কত কথা বলেছিলো। রসকসহীন, ভোঁতা অনুভূতি, ক্রুদ্ধ মেজাজি আরো কতো কি। নিজেকে নিয়ে যথেষ্ট আক্ষেপ ছিলো তার। কিন্তু দিনশেষে মানুষটা ভীষণ রোমান্টিক। মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতে জানে। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে পারে। কতটুকু আদর, কতটুকু যত্ন দিলে ভালোবাসার ব্যাখ্যাটা যথাযথ ভাবে বোঝানো যায়, সেটুকু সমাদর বুঝি মাহতিম আনসারী বুঝে।

.

শোকের ছায়াটা কাটেনি। বাড়ির অবস্থা থমথমে। সকাল এখন আটটা। মেহনূরের শূন্য রুমে বসে আছে শানাজ। পাশে কেউ নেই। শরীরটা বিছানার সাথে হেলান দিয়ে চুপ করে আছে। চোখদুটো ভরে-ভরে নীরব অশ্রু ঝরছে। ছোটমা নেই। বাড়িটা খালি হয়ে গেলো। যতবার চোখের সামনে ওই সরল-সহজ মুখটা ভাসে, বুকটা ডুকরে কেঁদে উঠে। নিজেকে খুব কষ্ট করে কান্না থেকে সামলায়। মনকে মিথ্যে কথার বুঝ্ দেয়। অনাগত সন্তানের জন্য নিজেকে শক্ত করে। পেটটা ফুলে উঠেছে ওর। আগের মতো অনেককিছুই করতে পারেনা সে। হাঁটাচলা করতে গেলেও সতর্ক হওয়া লাগে। খোলা দরজার কাছ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো তৌফ। হঠাৎ ঘরের ভেতরে চোখ পরতেই হাঁটা থামিয়ে ফেললো। দরজার কাছে ঠকঠক করে অনুমতি চাইলো তৌফ,

– ভাবী, আসি?

দরজার দিকে ধ্যান যেতেই হ্যাঁ জানালো শানাজ। হাতের উলটোপিঠে চোখ মুছে শান্ত হলো। অনুমতি পেয়ে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসলো তৌফ। আক্ষেপের সুরে সশব্দে নিশ্বাস ছেড়ে বললো,

– একা-একা কাঁদতাছো, এইটা ঠিক? এইসময় প্রেশার নিলে কেমন সমস্যায় পরবা জানো না? নিজের চিন্তা না-করলেও আমার ভাতিজার চিন্তাটা মাথায় রাইখো। আপাতত প্রেশার নিও না। খাইছো কিছু?

শানাজ চোখ বন্ধ করে নাক ফুলালো। গরম দু’ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে ঝরলো। হালকা করে ঢোক গিলে বললো,

– প্রেশার নিতে চাই না ভাইয়া। কিন্তু ছোটমা এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে ভাবতে পারিনি। আমার বাচ্চাটাকে দেখে যেতে পারলো না। এই দুঃখ কিভাবে বুঝাই? কিভাবে নিজেকে ঠান্ডা করি?

তৌফ পকেট থেকে ইনটেক টিস্যু বের করলো। প্যাকেটটা শানাজের দিকে বাড়িয়ে বললো,

– ঠান্ডা করা লাগবো। এছাড়া কোনো উপায় নাই। তুমি এভাবে হাউমাউ করে কাঁদলে আমার ভাতিজার প্রবলেম হইবো। টিস্যুটা ধরো। নাস্তা কিছু খাইছো?

তৌফের হাত থেকে টিস্যু নিলো শানাজ। চোখদুটো মুছে মাথাটা ‘ না ‘ ভঙ্গিতে নাড়ালো। নাক টেনে আস্তে করে বললো,

– গলা দিয়ে পানিই নামে না। খাবার কিভাবে খাবো? আপনি খাবারের জন্য জোরাজুরি করবেন না ভাইয়া। আমি সময় হলে খেয়ে নিবো। মেহনূরের কোনো খবর পেয়েছেন? কাল তো অনেকবার কল দিলাম। কেউ ধরলো না।

প্রসঙ্গ বদলে যেতেই চাঙ্গা হলো তৌফ। শানাজের কথায় সায় দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,

– না, ওরা ঠিকঠাক মতো পৌঁছাইছে। রাতে —

কথা শেষ করার আগে ঘরে ঢুকলো সৌভিক। তৌফকে ইচ্ছে করে থামিয়ে শানাজের উদ্দেশ্যে বললো,

– তোমাকে সাবা ডাকছে। কি জানি দরকার আমাকে বলেনি। ওখানে একটু যাও, গিয়ে দেখো কিসের জন্য ডাকছে।

শানাজ সম্মতি জানিয়ে বিছানা থেকে নামলো। পা টিপে-টিপে সাবধানতা অবলম্বনে ঘর থেকে বেরুলো। সৌভিক ওর যাওয়াটা শেষপর্যন্ত স্বচক্ষে দেখে তৌফের কাছে ছুটে এলো। অনেকটা অস্থির ভাবে কন্ঠ খাটো করে বললো,

– তোর কি মাথা খারাপ? কি করতে যাচ্ছিলি? খবরদার কাউকে বলবি না। এখন যদি না-আসতাম তুই বলদের মতো শানাজকে বলে দিতি। ভাগ্যিস দরজার বাইরে দিয়ে যাচ্ছিলাম। মাহতিম যে বারবার শাষিয়ে দিলো তোর কানে ঢুকেনি? রামবলদের মতো এই কথা ফাঁস করতে গেছিলি কি জন্যে?

তৌফ নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে জিহবায় কামড় দিলো। ডান কান ধরে অপরাধীর ভঙ্গিতে বললো,

– সরি ভাই, সরি। বলতে সময় খেয়াল ছিলো না। বিশ্বাস কর্, মাহতিমের কথা একেবারে ভুলে গেছিলাম। আমার তো টেনশন হইতাছে সৌভিক। রাতে ডেন্ঞ্জারাস কিছু হইতে পারতো। কালকে আবার ওয়েদারও ভালো ছিলো না। তোর কি মনে হয়?

তৌফের কথাকে মান্য করলো সৌভিক। বিছানায় বসে ফ্লোরে তাকালো সে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শঙ্কিত গলায় বললো,

– কালকে বড় ধরনের বিপদ হতে পারতো। আল্লাহ্ রহম করেছে। আমিতো ভেবেই পাচ্ছি না, কে কাজটা করলো। মাহতিম যেখানে হুট করে যাওয়া স্থির করলো, সেখানে অপ্রত্যাশিত এ্যাটাক মানা যাচ্ছে না। ও যে কিভাবে সিচুয়েশনটার সাথে ডিল করেছে ভাবতেই আমার ভয় হয়। একবার চিন্তা করে দ্যাখ, মেহনূর অসুস্থ ছিলো। তার মধ্যে সম্পূর্ণ ভার ও একাই নিয়েছে। নোমান ড্রাইভে ছিলো। আমার জানামতে মাহতিম অস্ত্র নেয়নি। ও দাফনের সময়ও অস্ত্র নিয়ে যায়নি। ও শূন্যহাতে গোরস্থানে গিয়েছে, শূন্যহাতে গাড়িতে উঠেছে। এই অবস্থায় পিস্তল ছাড়া কিভাবে কন্ট্রোল করলো? কথা তাও না। কথা হলো, এ্যাটাকটা কোন্ পক্ষ করেছে?

প্রতিটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো তৌফ। মনে-মনে উত্তরের ব্যাপারটা সাজিয়ে-গুছিয়ে নিলো। নিরঙ্কুশ গলায় শান্তভাবে বললো,

– পক্ষ একটাই। কেন করছে ওটাও বুঝিস। সবকিছু ব্যাখ্যা দিতে পারুম না। আঙ্কেলের একটা স্টেপের লিগা সব শেষ। সবকিছু বরবাদ। আফসোস লাগতাছে সৌভিক, যদি আঙ্কেল বাঁইচা থাকতো, অন্তত মাহতিমের কপালে দুঃখ আসতো না।

কথাটা শুনে বামে তাকালো সৌভিক। তৌফ একচুল ভুল বলেনি। তৌফের কথায় যুক্তি আছে। গভীর একবুক দম নিয়ে ধাতস্থ গলায় বললো,

– তৌফ? ওসব ডকুমেন্ট কোথায় আছে? এ ব্যাপারে তুই কিছু জানিস?

মাথাটা ‘ না ‘ করলো তৌফ। পরিস্কার জানিয়ে দিলো, ‘ জানে না ‘ । সৌভিক মুখটা ওর কাছ থেকে ফিরিয়ে নিলো। হাপিত্যেশের নিশ্বাস ছেড়ে স্থির চোখে বললো,

– ডকুমেন্ট মাহতিমের কাছেই আছে। নাহলে এ্যাটাক হতো না। কেন ওয়াসিফ পূর্ব চোখবন্ধ করে হেল্প করছে, এটাই বুঝতে পারছি না। সমস্যা হলো, পূর্ব ভাই মুখ খুলে না। কারণ জিজ্ঞেস করলে জীবনেও বলবে না।

.

রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া। শান্ত-নিবিড়-ছিমছাম জায়গা। কোনো লোকাল যানবাহন চলে না। দূর-দূরান্ত পযর্ন্ত কোলাহল নেই। চারিদিকে সবুজ প্রকৃতি। পায়ের নিচে পাকা রাস্তা। পরিস্কার করা পরিবেশ। ঘুম থেকে উঠলেই মিষ্টি সুগন্ধ নাকে আসে। নাম-না-জানা বহু ফুল একত্র হয়ে মিষ্টি সুভাস ছড়ায়। সকালে ঠান্ডা বাতাস, মিষ্টি রোদ্দুর মন প্রফুল্ল করে। একটা সতেজ ভাবাপন্ন অবস্থা দেহমনে ছড়িয়ে পরে। বুকভর্তি নিশ্বাস টানলে নির্মল অক্সিজেন পাওয়া যায়। কম্বলের নিচে নড়েচড়ে উঠলো মেহনূর। নিদ্রার ভাবটা কেটে যেতেই মুখ থেকে কম্বল সরালো। পুরো মুখের উপর এলোমেলো চুলগুলো সেঁটে আছে। মাথাটা ডানে-বামে নাড়া দিতেই কয়েকটা চুল সরে গেলো। মুখ হা করে হাই তুলতেই ডানদিকে হাত বাড়ালো। জায়গাটা শূন্য, কেউ নেই। ঘুম জড়ানো চোখে রুমের চারিদিকে তাকালো। ছিমছাম-সুন্দর-গোছানো রুমে উনি নেই। জ্বরটা ছাড়ার পর মাথাটা কেমন জানি করছে। শরীরটাও বুঝি দূর্বল। কম্বল সরিয়ে উঠতে যাবে, তখনই নিজের দিকে খেয়াল হলো। মেহনূর পুরোপুরি হকচকিয়ে গেলো। কম্বলটা বুকের কাছে দুহাতের মুঠোয় ধরলো। শাড়ি কোথায়? একটা বসন-ভূষণও গায়ে নেই। রাতের ঘটনা স্মরণ করলো মেহনূর। খুব জ্বর ছিলো, মাথায় পানি দিচ্ছিলো, এরপর… এরপর মনে পরলো ওর। শাড়িটা ভিজে যাওয়ার কারণে মাহতিম খুলে দিয়েছিলো। রাতের স্মৃতিগুলো ঘাঁটার জন্য চোখ বন্ধ করলো মেহনূর। কিভাবে বাহুডোরে আগলে রেখে আদর করেছিলো মাহতিম, কিভাবে আসঙ্গ মূহুর্তে — , ঠিক তখনই কানে ভেসে এলো পরিচিত সুর,

– ম্যাডাম উঠে গেছেন?

চোখ খুলে বামে তাকালো মেহনূর। কফি হাতে রুমে ঢুকছে মাহতিম। সরাসরি জানালার দিকে এগিয়ে দুহাতে পর্দাগুলো সরিয়ে দিলো। দিনের ফকফকা আলোয় পুরো রুমটা ঝকঝক করে উঠলো। মেহনূর কম্বলের নিচে আরেকটু সেঁটিয়ে বললো,

– আমার কাপড়?

থাই গ্লাসটা সরিয়ে দিলো মাহতিম। মাথা পিছু ঘুরিয়ে মেহনূরের দিকে চাইলো। ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে চোখদুটোয় ইশারা করলো। দেখিয়ে দিলো বিছানার কাছে। মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। একফালি সোনা রোদ্দুর মেঝেতে এসে পরেছে। জানালার পাটাতন থেকে কফির মগটা তুললো। গরম মগে ছোট্ট চুমুক দিয়ে আকাশে তাকিয়ে রইলো। নীল আকাশের বুকে থোকা-থোকা মেঘ। ভেসে বেড়াচ্ছে দিগ্বিদিক। কি চমৎকার! সুন্দর দৃশ্য, সাথে গরম কফি, সঙ্গে একটু গান। পকেট থেকে ছোট্ট রিমোট বের করে টিপ দিলো সে। হালকা ছন্দে মিউজিক সিস্টেমটা বাজতে লাগলো তখন। গানের মিষ্টি-মধুর সুরটা চমৎকার লাগছে। চোখ জুড়ানো আকাশে নয়ন রাখতেই পেছন থেকে কাশির শব্দ এলো। কফিতে আরেক চুমু দিয়ে পিছু ঘুরলো সে। সাথে-সাথে কফি হাতে হেসে ফেললো মাহতিম। মুচকি হাসিতে আপাদমস্তক চোখ বুলালো সে। হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি, মোটা পাড়টা টকটকে লাল। চুলগুলো ডানপাশে সিঁথি কেটে আঁচড়ানো। লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। ব্লাউজটা অবশ্য লাল। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতে-থাকতেই কফিটা রেখে দিলো মাহতিম। অপলক দৃষ্টিতে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলো। মেহনূর লজ্জা মাখানো চোখে মাহতিমের ডানহাতটা আস্তে-আস্তে ছুঁলো। আঙ্গুলের ফাঁকে-ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে কাছে এগিয়ে গেলো। খোলা জানালা দিয়ে দমকে হাওয়া আসছে। বেপরোয়া হাওয়ার তালে অদূরে বাজছে গান। মেহনূরের কোমরটা ধরে জানালার পাটাতনে বসিয়ে দিলো। হাতদুটো নিজের গলায় জড়ালো মাহতিম। চোখে-চোখ রাখতেই আবারও বাতাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে। মাহতিম হাসি-হাসি ঠোঁটে ছন্দ মিলিয়ে গান ধরলো, আদর মাখানো সুরে গেয়ে উঠলো,

আজ এক নাম না জানা কোনো পাখি,
ডাক দিলো ঠোঁটে নিয়ে খড়কুটো।
আজ এলো কোন অজানা বিকেল,
গান দিলো গোধূলি এক মুঠো।

তুমি যাবে কি? বলো যাবে কি?
দেখো ডাকছে, ডাকলো কেউ।
তুমি পাবে কি? পা-পাবে কি?
সামনে বেপরোয়া ঢেউ।

এটুকু গাইতেই হাসি দিয়ে থামলো মাহতিম। মেহনূরের দিকে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ বাকি কলিটুকু পূর্ণ করে মেহনূর গেয়ে উঠলো,

ছুঁয়ে দিলে সোনাকাঠি খুঁজে পাই।
যদি যাই ভেসে, এমনি ভেসে যাই।

আজ এক নাম না জানা কোনো হাওয়া,
চোখ বুজে ভাবছে বেয়াদব ধূলো।
টুপটাপ বৃষ্টিফোঁটা গেল থেমে,
ভেজা-ভেজা খিড়কি দরজা তুমি খুলো।

থেমে গেলো মেহনূর। আবারও কয়েক সেকেন্ড চোখাচোখি তাকিয়ে একসঙ্গে গিয়ে উঠলো তারা। প্রকৃতির বাতাস সোল্লাসের সাথে জানালা দিয়ে, বারান্দা দিয়ে রুমের ভেতর ঢুকলো। দুটো গলা, দুটো সুর, দুটো অদৃশ্য মন একীভূত হয়ে গাইলো,

তুমি যাবে কি? বলো যাবে কি?
দেখো ডাকছে, ডাকলো কেউ।
তুমি পাবে কি? পা-পাবে কি?
সামনে বেপরোয়া ঢেউ।

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .