মন বাড়িয়ে ছুঁই ২ পর্ব-১৮+১৯

0
632

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_১৮ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

মাহতিম কোনোদিন আঁচ করতে দেয়নি। ঘুণাক্ষরে বুঝতে দেয়নি। খুবই শান্ত-ধীর-চতুরতার সাথে প্রতি পদক্ষেপ এগিয়েছে। বুঝতে দেয়নি কেন মেহনূরকে সরিয়ে আনলো। কেন মা মরা শোকের মধ্যে থাকতে দিলো না। কেন সেদিন রওনার জন্য অস্থির ছিলো। কেন পথিমধ্যে দূর্ধর্ষ হামলার শিকার হলো। এতোসব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েও মাহতিম চুপ থেকেছে। শক্ত কারণটা বলেনি সে। বলাটা নিজের ভেতর গোপন রেখে সবার কাছে লুকোচ্ছে। মোল্লাবাড়িতে আসার পর যেটুকু সময় থেকেছে, পুরোপুরি মেহনূরকে সঙ্গ দিয়েছে। তন্মধ্যে মাহমুদার গমন ছিলো আকস্মিকভাবে। সেখানে মানুষের হাত ছিলো না। প্রকৃতির নিয়মে যে চলে যাচ্ছে, তাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা মানুষের নেই। বিপর্যস্ত পরিবেশ থেকে মেহনূরকে তুলে আনাটা প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু অনুমানের বাইরে ছিলো রাত দশটার হামলা। এরকম কিছু আন্দাজ করার ক্ষমতা মাহতিমের ছিলো না। সে কাউকে বলেনি, কাউকে জানায়নি সেই রাতে সে ফিরছে। যেহেতু সে জানায়নি, তার মানে এখনো কেউ নজর রাখছে। নিশ্চয়ই মোল্লাবাড়ির পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনা বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছায়। নাহলে এতো সুক্ষ্ম হামলার চিন্তা সঠিকভাবে হতো না। ভাগ্য সহায় ছিলো, মাহতিম সেদিন মোকাবিলা করতে পেরেছে। কিন্তু আর কতো? দফায়-দফায় এসব কাণ্ড যেন বেড়ে চলেছে। থামার অবকাশ নেই। নাটকীয়ভাবে প্রতিবার বেঁচে গেলেও শেষপর্যন্ত আশা নেই। কখন কি হবে কেউ জানে না। রাজনৈতিক পলাবদল যখন সঙ্গোপনে ঢুকে গেছে, তখন লড়াই ছাড়া উপায় নেই। যতপ্রকার কুকর্ম, অসৎকর্ম, উগ্রপন্থী আছে, এবার সব একযোগে মাঠে নামবে। বাঁচার জন্য ফাঁকফোঁকর যে থাকবে, তা অবশ্য আশা করা যায় না। রহসের গাছকে ছুঁয়ে ফেলেছে মাহতিম। ধীরে-ধীরে পাতায়, শাখায় ধাবমান হয়ে মাটিস্থ শিকড়ের দিকে এগোচ্ছে। এবার হয় শিকড় সুদ্ধো উপড়ে ফেলবে, নয়তো মূল-সহ ভষ্ম করে দেবে। কিন্তু একদণ্ড ছাড় দিবে না সে। জীবনের যেই ক্ষতযুক্ত সময় সে কষ্টের সাথে কাটিয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ যন্ত্রণা এবার রোমে-রোমে ভোগ করিয়ে ছাড়বে। চর্তুলোভী মানুষের ছায়া খরার মতো ধ্বংস করবে মাহতিম। আর ছাড় নয়। আর ছাড় নয়। মূলহোতা, মূল ব্যক্তিকে ধরার জন্য বদ্ধপরিকর সে। এজন্যই সবদিক থেকে রাস্তা ক্লিন করে সামনের দিকে এগুচ্ছে। মাকে পাঠিয়ে দিয়েছে বিদেশ। চিকিৎসার অজুহাতে আঁটকে দিয়েছে সে। সৌভিকের কাকা সৌভিককে বেশ ভালোভাবে জব্দ করেছে। দেশের মাটিতে পা ফেলার ফুরসত দেয়নি কাকা। নীতি-প্রীতিরা যথেষ্ট মডার্ণ। এদিক থেকে বিপদের গন্ধ পেলে তারা নিজেরাই সটকে পরবে। তৌফরা একধাপ বেশি চালাক। ঘুড়ির নাটাই হাতে নিয়ে চড়কি ঘুরাতে প্রস্তুত। বাকিটা যদি মাহতিম বাতলে দেয়, তখন মুখোমুখি রণক্ষেত্র হতে বেশি দেরি নেই। সমুদ্রের বুকে মাহদির খুন হয়েছে। মাহদি যেখানে বাঘের মতো বড়ভাইকে ভয় পেতো, মাহতিমের প্রতিটি কথা মেনে চলতো, সেখানে বেশি পানিতে যাওয়াটা ঠিক অপ্রত্যাশিত ব্যাপার। কি কারণে মাহদি সেদিন পানিতে নামলো? কি শুনে ওইটুকু ছেলে সমুদ্রের বুকে নেমে পরে? ওর নিষ্পাপ কানদুটোতে কিসের বুলি শুনিয়েছিলো শকুনের দল?

– আপনি ঘুমাচ্ছেন?

চিন্তার-ভাবনার-আক্রোশের দুনিয়া থেকে চোখ খুললো মাহতিম। মুখের উপর ঝুঁকে আছে হাসিমাখা মুখ। গালে হাত বুলিয়ে তাকিয়ে আছে মেহনূর। যখনই মাহতিম পুরোনো কাহিনি নিয়ে মশগুল হয়ে পরে, তখনই সে বিক্ষিপ্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। অজানা কারণে তার মনটা ক্ষুণ্ণ হয়। ঘাসের উপর শুয়ে আছে মাহতিম, মাথার নিচে তার হাতদুটো পাতা। সটান হয়ে শুয়ে আছে কোয়ার্টারের পেছন দিকটায়। যেখানে বড়-বড় গাছের সুশীতল ছায়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়। কচি ঘাসের মৃদ্যু-মৃদ্যু পরশে মন ঠান্ডা হয়। প্রকৃতির প্রাণখোলা বাতাসে গরমের রেশটা উবে যায়। শহরের মতো কানজ্বালা হর্ণ এখানে নেই। কান পেতে থাকলে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ শোনা যায়। বাতাসে মিশে আছে মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ। মাহতিম চোখদুটো পুনরায় বন্ধ করে গম্ভীর সুরে বললো,

– না, ঘুমাইনি।

গালে হাত বুলানো থামিয়ে দিলো মেহনূর। চোখে কৌতুহল টেনে গম্ভীর মুখটার পানে চাইলো। এই সুন্দর মূহুর্তে কেন কর্কশকণ্ঠে জবাব দিলো? কিছুক্ষণ আগে তো সব ঠিক ছিলো। ঘাসের উপর বসে-বসে মাহতিমের গালে-বুকে আদুরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। কখনো চুলে হাত ডুবাচ্ছিলো, কখনো ছুঁয়ে দিচ্ছিলো মাহতিমের মুখ। আসল কারণটা জানার জন্য আঁকুপাঁকু করছে মেহনূর। ক্লিনশেভের গালটায় হালকা চাপ দিয়ে বিনীত সুরে বললো,

– আমাকে বলা যায় না? বললে ক্ষতি হবে? কখনো তো চাপ দিয়ে জিজ্ঞেস করিনি। সবসময় তো ‘ না না ‘ বলে কথা এড়িয়ে যান। আজ নাহয় বলুন। দেখি কতটুকু শুনতে পারি। না-বললে তো কিছু বুঝবো না।

মাহতিম এক মূহুর্ত্তের জন্য ভাবলো। যে কথাগুলো চিন্তা করলেই মন-মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, সেগুলো বলার সময় যদি গলা চড়িয়ে ফেলে? বলা যায় না। সে তো মেহনূরের সাথে উচ্চকন্ঠে কথা বলে না। যতটা পারে, রয়েসয়ে শান্তভাবে উত্তর দেয়। কিন্তু যে ব্যাপারে ও জানতে চাচ্ছে, সেটাতো এখন বলা সম্ভব না। মাত্রই শোকের মূর্ছা থেকে তুলে আনলো, এখন যদি এসব কথা বলে দেয়, তাহলে তো ঘায়ের উপর করাঘাত পরবে। মাহতিম চিন্তা শেষে চোখদুটো খুললো। যতটা সম্ভব শান্ত হয়ে নির্মল গলায় বললো,

– তোমাকে বললে ক্ষতি নেই। ক্ষতি তাদের জন্য হয়, যারা কথা রাখতে জানে না। তোমাকে তো সবই বলি, লুকানোর কিছু নেই। আমার কাছে জীবনটা রহস্যখেলা লাগে। কখন-কোনদিক দিয়ে পানি বয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। তুমি এখন আমার বুকে হাত রেখে বসে আছো। আমার পাশে সময় কাটাচ্ছো। এরকম চিন্তা গতবছর করতে পারতে? তোমার সাথে না-ছিলো যোগাযোগ, না-ছিলো কথাবার্তা। ছ’মাস আগেও আমরা আলাদা ছিলাম, দুই বছর আগেও তোমার মা সুস্থ ছিলো, তিন বছর আগেও মাহদি বেঁচে ছিলো। অথচ, আজ দ্যাখো, চোখ খুললেই কেউ নেই। মাত্র কটা বছরের মধ্যে সুন্দর ছবিটা পালটে গেলো। আমাদের জীবন কত অদ্ভুত মেহনূর। এখন তো নিজেকে নিয়ে চিন্তা হয়। এই ইহজীবনে আর কতটুকু আয়ু আমার জন্য বরাদ্দ আছে জানি না। আর কতদিন চাকরিজীবন করতে পারবো, শেষপর্যন্ত তোমার পাশে থাকতে পারবো কিনা তাও জানি না। আমরা কত অনিশ্চয়তার সাথে দিন কাটাচ্ছি, তাই না?

মেহনূর করুণ চোখে তাকিয়ে রইলো। গ্রীষ্মের থমথমে প্রকৃতির মতো চোখের পলক যেনো পরলো না। শব্দগুলোর মধ্যে বিষ মাখানো কিছু ছিলো, যেটা শোনার পর বাক্য ফুটতে চাইছে না। গাল থেকে নীরবে হাত সরালো মেহনূর, কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিষণ্ণবদনে বললো,

– তবুও আমরা আশা রাখি। সব পাওয়া-না-পাওয়ার হিসেব চুকিয়ে রাতে ঘুমোতে চাই। এটা কোনোদিন ভাবি না, আদৌ আমাদের জন্য আগামীকালটা বরাদ্দ আছে কিনা। জানেন, এখনকার দিনে বিচ্ছেদ হওয়াটা সহজ। আলাদ হওয়াটা কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু, আমার মতো যারা একপাক্ষিক, যারা ভালোবাসার মর্ম শুধু একমাত্র পুরুষের কাছে শিখেছে, তাদের ক্ষেত্রে পুনরায় ভালোবাসাটা কোনোদিন সম্ভব না। অন্য পুরুষের ছোঁয়া, আবার সংসার করা, এসব ভাবলেই মাথাটা ভোঁ-ভোঁ করে। আমার রুচিটা বোধহয় আদিকালের মতো। মানুষ শুনলে খুব হাসবে। এসব কথা তো মানুষকে বলতে পারি না, তারা আমাকে ‘ সেকেলে ‘ উপাধি দিবে। আপনার কাছে বলতে কোনো বাধা নেই। মন খুলে সব বলতে পারি। আপনার একটা জিনিস খুব সুন্দর। আপনি মানুষের কথাকে খুব মন দিয়ে শোনেন। আজকাল তো এরকম দেখি না। দুটো কথা কারোর কাছে বললে সেও একদিন বিরক্তমুখ দেখায়। দুনিয়াতে কথা শোনার মানুষ কম। সেদিন যদি আপনি একগুঁয়েমি করতেন, আমিও যদি রাগ রেখে বিমুখ হয়ে যেতাম, সেদিনের ছোট্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরো প্যাঁচাতাম, তাহলে বোধহয় আমাদের সম্পর্ক টিকতো না। তখন সকলের মুখে-মুখে আমাদের বিচ্ছেদ নিয়ে মুখরোচক ঘটনা শোনা যেতো। আপনার চরিত্র নিয়ে নাক ছিঁটকাতো, আমার ভাগ্য নিয়ে অপয়া বলতো, আরো কত কুৎসিত কথা যে বলতো। কিন্তু ভেতরকার কথা তো শুধু আমরা জানি। কিভাবে ছোট-ছোট ঘটনা মিলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলো, সেই কথা তো কেউ জানে না। আমি বড্ড ভুল করেছি জানেন। সম্ভবত সেটার জন্য এতোগুলো মাস কষ্টভোগ করলাম। আমার উচিত ছিলো দুটো মিনিট আপনার কাছে বসা। যা যা অভিযোগ ছিলো, সব আপনাকেই শোনানো। যদি এই কাজটা করতাম, তাহলে আপনিও সব ভুলে চুপচাপ কথাগুলো শুনতেন। আমার সমস্যাটা বুঝতে আপনি পারতেন। আমি সেটা না-করে উলটো আপনাকেই দোষারোপ করেছি। যার হিতে-বিপরীতে দুজনই খুব দুঃখ পেলাম।

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহতিম। ঠোঁটে মৃদ্যু-মৃদ্যু হাসি। মুখের উপর প্রশান্তিময় ছাপ। মেহনূরের চুপচাপ মূর্তিটা মনে পরলো ওর। এভাবে কথা শোনার জন্য খুব উদগ্রীব থাকতো। মেহনূর হবে স্পষ্টভাষী বক্তা, মাহতিম হবে মুগ্ধ শ্রোতা। সেই বক্তার সুমধুর কন্ঠে দিনভর ডুবে থাকবে, শুধু চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনবে। মাহতিম বুক ফুলিয়ে গভীরভাবে নিশ্বাস নিলো, মাথার নিচ থেকে ডানহাত বের করে মেহনূরের গাল ছুঁয়ে সশব্দে দমটা ছাড়লো। ঠোঁটে গর্বসূচক হাসি ঠেলে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললো,

– হাতের মুঠোয় করে ছোট্ট একটা চারাগাছ এনেছিলাম। আমার গাছটা বড় হয়ে গেলো। যেদিন আমি বার্ধক্যে পৌঁছে যাবো, সেদিন তার প্রতি আমার দায়িত্ব শেষ।

মেহনূর প্রাণবন্ত ঠোঁটে হাসলো। ইঙ্গিতটা বুঝে গেছে।

.

কর্তব্য নিয়ে হেলা করেনি মাহতিম। যথাযথ ভাবে পালন করেছে। তিনদিনের ভেতর মেহনূরের বোর্ড পালটে অন্য বোর্ডে ফিরিয়ে এনেছে। সবটুকু কাজ সম্পন্ন করলো ক্ষমতার জোরে। সুপারিশের খত পাঠিয়ে দিলো উর্ধ্বতন জায়গায়। যেখানে ঘুষ দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো, সেখানে খাটালো বুদ্ধি। কিছু শক্ত ব্যক্তিদের আওতায় এনে কাজ করালো মাহতিম। যদিও এই বিশেষ লোকেরা মাঝে-মাঝে সাহায্য করে। পুরোপুরি সাহায্যের ব্যাপারে আসে না। এখানে তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। সবাই নিজেদের গদি আঁটকাতে ব্যস্ত। ক্ষমতার লোভ কে ছাড়তে চায়? তারা সেদিক দিয়ে বেশি এগিয়ে। মাহতিম যেহেতু ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে হেডঅফিস থেকে সুপারিশ চেয়েছে, তাই কর্তৃপক্ষ সাহায্য করতে বাধ্য ছিলো। যেহেতু মাহতিমের হাতে সব কেস গ্রীন সিগন্যাল দিতো, তাই কর্তৃপক্ষ দ্বিধা করেনি। কিন্তু এ পন্থা অন্যান্য মেম্বারের জন্য খাটেনি। তাই নিয়ে অন্যান্য সদস্যরা বেশ ঈর্ষার চোখে দেখছে। এটা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই মাহতিমের। সবকটাকে একরেখায় টেনে মৃদ্যু টাইট দিলেই কাজ শেষ। জঘন্যভাবে নাকানিচুবানি খাবে। সবার বিরুদ্ধে একটা-না-একটা জালিয়াতির প্রমাণ আছে। সেটা যদি কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে অনেকের চাকরি নিলামে উঠবে। এদিক দিয়ে মাহতিম স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক। কেউ তার সামনে চোখ তুলে তাকায় না, গলার স্বর উর্ধ্ব করে না, কোনোরূপ অসভ্য নেচার দেখায় না। রুলস মোতাবেক, কোনো শক্ত কারণ ছাড়া উচ্চপদস্থ কাউকে হেয় করলে সাথে-সাথে বরখাস্ত। এ নিয়ে মামলা অবধি করতে পারে। তাই আগ বাড়িয়ে মাহতিমকে ক্ষেপায় না। ক্ষেপাতে গিয়ে নিজেরাই বিপদে পরে। সব কাগজপত্র ঠিকঠাক করে কোয়ার্টারে ফিরে মাহতিম। টয়েটো গাড়িটা গ্যারেজে রেখে ঘরে ফিরে সে। দরজার নব্ মোচড়ে ভেতরে ঢুকতেই হাসিমুখে ডাক দেয়,

– ও মেহনূর?

থমকে দাঁড়ায় সে। দুই ভ্রুঁ একত্র করে চর্তুদিকে তাকায়। প্রচণ্ড বিষ্ময় নিয়ে আবার ডাকতে থাকে,

– মেহনূর? তুমি কি ঘরে নেই? এ্যাই মেয়ে কোথায় গেছো?

চারিদিকে নজর বুলালো সে। তাড়াতাড়ি খাটের উপর ফাইল ছুঁড়ে দিলো। বারান্দায় চুপি দিলো সে, ওখানে কেউ নেই। ওয়াশরুম চেক করলো, সেখানেও খালি। পাশের বেডরুমে নব্ মোচড়ে ঢুকলো, রুমে কেউ নেই। এদিকে লেফট পকেট থেকে মোবাইল জানান দিচ্ছে, রিংটোনের তীব্র আওয়াজ চর্তুদিকে ছড়াচ্ছে। মনেহচ্ছে দেয়ালে-দেয়ালে দামামা করছে রিংটোন। মাহতিমের সেদিকে একদম হুঁশ নেই। তার বুকের ভেতর ধড়ফড়-ধড়ফড় করছে। এখান থেকে বের হবার পূর্বে সব ঠিক ছিলো। মেহনূরও টেবিলে বসে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। ও কোথায়? ও এখানকার কিছুই চেনে না। এখনো কোয়ার্টারের বাইরে নিয়ে যায়নি মাহতিম। দু-একজন অফিসারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাও ফর্মাল পরিচয়। মাহতিম কারো সাথেই মাখো-মাখো সম্পর্ক রাখে না। রিংটোন বাজতে-বাজতে বন্ধ হতেই আবার বেজে উঠলো। সংবিৎ পেলো মাহতিম। চমক ভাঙ্গার মতো কেঁপে উঠতেই পকেটে হাত ঢুকালো। বস্তুটাকে ঠান্ডা করে কানে চাপলো সে। ভেতর থেকে কথা বেরুতে চাচ্ছে না, তবুও ঠেলেঠুলে বললো,

– হ্যালো,

বিপরীত পাশ থেকে জবাব দিলো,

– আমাকে চিনতে পেরেছেন?

সতর্ক হলো মাহতিম। কপালের ভাঁজগুলো আরেকটু কুঁচকে গেলো। ঠোঁটের কোণাটা কামড়ে ভেবেচিন্তে বললো,

– সাগ্রত?

মার্জিত গলায় সায় দিলো সাগ্রত। হালকা কেশে বললো,

– জ্বী স্যার, তাশরিফ সাগ্রত বলছিলাম। মার্ডার কেস রিলেটেড। আপনি সম্ভবত বহুদিন আগে ইমেইল করেছেন, আমি ব্যস্ততার জন্য দেখতে পাইনি। সরি ফর মাই ইনকম্পিট্যান্স। আপনি যদি ফ্রি থাকেন, তাহলে একটা টাইম ফিক্সড করুন। আপনার সাথে আর্জেন্ট মিটিং জরুরি। কথাগুলো সামনা-সামনি বলতে চাই। আপনি যে ব্যাপারে ডাউট করছেন, সেটা ঠিক। ওটা এক্সিডেন্ট ছিলো না। গভীর বুদ্ধিসম্পন্ন খু:ন ছিলো। আপনিতো বডি পোস্ট মর্টাম করতে দেননি। আই নো, আপনার সফট কর্নার ছিলো। আপনি কাঁটাছেড়া চাননি। সেদিন পোস্ট মর্টামের অর্ডার দিলে আপনি সবটা জেনে যেতেন।

ধাক্কাটা নিতেই চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। কানে ফোন চেপে ঢোক গিললো সে। চোখের অন্ধকার পর্দায় মাহদির ছবিটা ভাসছে।বিশেষ কিছু বললো না মাহতিম। কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে ছোট্ট করে বললো,

– টাইমটা ম্যাসেজ করে দিবো। আজ রাখি।

কলটা কেটে দিলো সে। ওমনেই পেছন থেকে দুটো হাত আস্তে করে জড়িয়ে ধরলো। আবেগময় কন্ঠে উচ্ছল সুরে বললো,

– আপনার কোয়ার্টারটা খুব সুন্দর। সবচেয়ে বেশি সুন্দর এই বাড়ির ছাদটা। ওখানে এতো ফুল, আমার না ছাদেই ভালো লাগে।

মাহতিম নির‍্যুত্তর। কোনো প্রতিক্রিয়া দিলো না। বুকের কাছ থেকে হাতযুগলটা খুলে দিলো। কোনোকিছু না-বলে বিমুখ ভঙ্গিতে চলে গেলো। একবারও পিছু ফিরে মেহনূরকে দেখলো না। বেডরুমে চলে যেতেই ওয়াশরুমের দরজাটা ঠাস করে লাগালো। উৎকট শব্দের চোটে শিউরে উঠলো মেহনূর। তখনও অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিলো সে। পুরো মুখে আশ্চর্যের ভেলকি। মাহতিমের সরিয়ে দেওয়া হাতদুটো এখনো অটল। রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থমকে গেছে মেহনূর।

চলমান .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_১৯ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

একটু ভয়, একটু জড়তার সাথে তাকালো। ছোট-ছোট পা ফেলে সামনে এগুলো। রুমের চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ছোট্ট ঢোক গিললো। দরজাটা চাপানোর জন্য হাত বাড়িয়ে ঠেললো। আস্তে-আস্তে দরজাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রুমের চর্তুদিকে ক্রমশ শান্ত অবস্থা। বড়-বড় জানালা দিয়ে গজরানো বাতাস ঢুকছে। পর্দাগুলো হেলেদুলে লুটোপুটি খাচ্ছে। শাড়ির শেষপ্রান্তে খুঁট পাকাচ্ছে মেহনূর। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বারান্দার দিকে চেয়ে আছে। দুপুরের পর সামনে যায়নি সে। খাবারের টেবিলে বসে থাকলেও মাহতিম তখন ব্যস্ত ছিলো। বাইরে থেকে আসার পর মাহতিম বেশ চিন্তিত। কি নিয়ে গবেষণা করছে মেহনূর জানে না। একটু পরপর নোমানের সাথে কথা বলছে। তাও কর্কশকণ্ঠে ধমকের সাথে চেঁচাচ্ছে। নোমানের অবস্থা এখন কতটা নাজেহাল, সেটাই চিন্তা করছে মেহনূর। একেকটা রামধমক খেয়ে চুপসে যাচ্ছে নোমান। বেচারার জন্য মায়া হলো ওর। মাহতিমকে আঁটকানোর পন্থা জানা থাকলে সুবিধে হতো। মেহনূর নিজেই যেখানে বেকুব বনে আছে, কেন ওর হাতদুটো ছুটিয়ে মাহতিম ইগনোর করলো, কেন ওয়াশরুমের দরজাটা বিকট শব্দ করে লাগালো, খাবার‍ের টেবিলে অপেক্ষা করার পরও কেন এলো না, মেহনূর অবশ্য জানে না। বারান্দা থেকে উচ্চকন্ঠের হুংকার ভেসে আসছে। কন্ঠের ঔদ্ধত্য দেখে সাহস পাচ্ছে না সে। যদি মাহতিম চটে যায়? যদি বিরক্ত হয়ে ক্ষোভ দেখায়? কিন্তু কেন রাগ করবে মাহতিম? মেহনূর তো এমন কোনো দোষ করেনি, যার জন্য ভয় পাওয়া লাগবে। বাইরে পড়ন্ত বিকেল। বারান্দাটা খোলামেলা। রেলিংয়ের কাছে দাঁড়ালে শান্তি লাগে। দূর থেকে দেখা যায় শহর। অদূরে যানবাহন চলছে। এখান থেকে সেটা পিঁপড়ার মতো লাগে। আকাশে তাকালে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। সূর্যাস্তের দৃশ্যটা কি চমৎকার! কোনো উপমা দিয়ে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। মেহনূর পা বাড়িয়ে বারান্দায় ঢুকলো। মুখটা ফেরালো ডানদিকে, যেদিকে মাহতিম ফোনে কথা বলছে। পুরুষ্টু পিঠটা ওর দিকে ফেরানো, ডানহাতে ধরা ফোন। বসে আছে ঝুলন্ত কাউচে। গায়ে কালো স্ট্রিপের অফ হোয়াইট শার্ট। শার্টের বোতাম বোধহয় লাগায়নি। পেছন থেকে শার্টের দুপাশটা হাওয়ায় থেমে-থেমে উড়ছে। তাড়াহুড়োর জন্য স্লিভদুটো ফোল্ড করেনি। মেহনূর সেদিক বরাবর দৃষ্টি রেখে পা চালিয়ে দিলো। দুটো হাত পেটের কাছে মুচলেকা করছে সে। জড়োসড় চোখদুটোতে অপ্রস্তুত ভয়। বাঁপাশ থেকে টাটকা হাওয়া ছুটে আসছে, ডানদিকে রুমটার আয়তাকার জানালা। মেহনূর এগুতে-এগুতে কাউচের ঠিক পেছন এসে থামলো। বুকভর্তি দম নিয়ে মিহি গলায় কাশলো। ধমকের শেষ মূহুর্তে আঁটকে গেলো মাহতিম। শব্দটা তার কানে পৌঁছেছে। কানে ফোন ধরা অবস্থায় ফ্লোরে পা ঠুকে পাক দিয়ে ঘুরলো। মেহনূরের দিকে চড়া দৃষ্টি ফেলে উত্তরের জন্য তাকালো। মেহনূর আমতা-আমতা করে সরল গলায় বললো,

– বেলা চারটা বাজে। খাবেন না?

মাহতিমের চোখদুটো ডানে-বামে ঘুরলো। বুঝাই যাচ্ছে, কিছু একটা ভাবছে। কয়েক মূহুর্ত চুপ থেকে চোখদুটো স্থির করলো সে, মেহনূরের দিকে চোখ ফেলে স্বীকৃত গলায় বললো,

– আনো, তবে আমি বেশি খাবো না।

দুঠোঁটে মুচকি হাসলো মেহনূর। পেটের কাছে হাতদুটো স্বাভাবিক হলো তার। খাবারের জন্য চটপট ভঙ্গিতে ছুটে গেলো সে। ফিরে এলো কাঁচের প্লেট নিয়ে। ডানহাতে প্লেট, বাঁহাতে পানির বোতল নিয়ে কাউচের সামনে বসলো। মাহতিম তখনও কথার জরিপে ব্যস্ত। মেহনূর যখন পায়ের কাছে ফ্লোরে বসে পরলো, তখন নিচে বসার জন্য ঘোরতর আপত্তি জানালো মাহতিম। উঠে এসে পাশে বসার জন্য বাক্য ব্যয় করলো। কিন্তু, শুনলো না মেহনূর। ঠোঁটের কাছে আঙ্গুল রেখে চুপ করতে বললো। মাহতিম অবাক! কান থেকে ফোনটা বন্ধ করে মেহনূরের দিকে তাকালো। তার প্রতিটি কথাকে পরাস্ত করে আপনমনে ভাত মাখাচ্ছে মেহনূর। ঝাল-ঝাল বাদাম ভর্তার সাথে ভাত মাখিয়ে লোকমা তুলে ধরলো। বাড়িয়ে দেওয়া লোকমার দিকে একপলক তাকালো মাহতিম, পুনরায় মেহনূরের দিকে দৃষ্টি রেখে সেটা মুখে পুড়ে নিলো। এই ছোট-ছোট আচরণগুলো মায়ের কথা ভাবাচ্ছে। ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরলে মা এভাবে খাইয়ে দিতো। মাহতিম বসতো বিছানায়, মা বসতো মেঝেতে। পাশে বসার জন্য মাহতিম যখন রাগারাগি করতো, তখন এভাবেই ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে চুপ করাতো সে। আজ মাহতিম বড় হয়ে গেছে। মা হয়েছে বৃদ্ধ। শৈশবের স্মৃতিগুলো এখন অতীতকাল। পুরোনো দিনগুলো ঠিক স্বর্গীয় সুখ। হাতছানি দিয়ে সেই যুগটা চলে গেছে। আজ বড়বেলায় কোনো আনন্দ নেই। কোনো সুখ নেই। ছোটবেলার মতো শাষন নেই। ধীরে-ধীরে বড় হতে গিয়ে সবকিছু বদলে গেছে। একসময় মাকে জড়িয়ে ধরা যেতো, কোনো বাছবিচার ছিলো না। আর এখন দুহাত মেলে ধরতে গেলে অনেক কিছু ভাবতে হয়। সে আজ বড় হয়ে গেছে, আগের মতো ছোট নেই। আজ মা কতদূরে আছে। কতদিন দেখা নেই। আগে তো মায়ের আঁচল ছাড়া চলতো না। আর এখন? আনমনে লোকমাটা গিলতেই ঠোঁটের কাছে দ্বিতীয় লোকমার আর্বিভাব হলো। একটু ম্লান হাসলো মাহতিম। লোকমার দিকে তাকিয়ে শূন্য গলায় বললো,

– একসময় বড় হবার জন্য ছটফট করতাম। আজ আমি মুক্ত, স্বাধীন। আজ পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে।

লোকমাটা ধীরে-ধীরে নামিয়ে ফেললো মেহনূর। প্লেটটা কোলের উপর রেখে মাহতিমের উরুতে হাত রাখলো সে। তার মনটা স্বস্তি পাচ্ছে না। ইদানিং মাহতিমের কথাগুলোর ভেতর এমন সুক্ষ্ম কিছু লুকানো থাকে, যেটা ভয় ধরিয়ে দেয়। মেহনূর নিজেকে শান্ত রেখে নম্রভাবে বললো,

– পুরোনো দিন মনে করে লাভ আছে? ওগুলো সুন্দর স্মৃতি। ওগুলো রেখে দিন। বড় হবার বাসনা সবার থাকে। সবাই চায় শাসনের বেড়াজাল ছিঁড়ে উড়াল দিতে। কিন্তু, শাসনগুলো যে বড়দের আদর ছিলো, সেটা অবশ্য বোঝা যায়নি। বড়রা আমাদের বুঝতে দেয়নি। ছোটবেলায় সব ব্যথা-কথা মুখ ফুটে বলা যেতো, বড়বেলায় সেটা মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। দাড়িপাল্লা দেখেছেন তো? দুটো পাল্লা সমান-সমান করার জন্য একটায় বাটখারা, অন্যটায় সামগ্রী রাখা হয়। যদি কোনোভাবে গড়মিল হয়, তাহলে কিন্তু উঁচুনিচু হয়ে যায়। আপনার অবস্থাটা এখন ভারী পাল্লার মতো। আপনি কথার পাহাড় নিয়ে এতো মশগুল থাকছেন যে, আমাদের সম্পর্কের মধ্যে উঁচুনিচু অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। এইযে আপনি কথা চেপে সহ্য করছেন, সেটা কি ঠিক? আপনার চেহারায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আপনি মুষড়ে পরছেন। আপনার সহকারীকে যেভাবে ধমকাচ্ছেন, ওই বেচারা তো ভয়েই নাকাল হচ্ছে। শুনুন, খাওয়ার সময় কখনো মিথ্যা বলা যায় না। সত্য বলা নিয়ম। যেই দক্ষতার সাথে সবটা চেপে যাচ্ছেন, সেই দক্ষতার সাথে আমাকে খুলে বলুন।

মাহতিম মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটে-মুখে তৃপ্তির ঝিলিক। ডানহাত উঠিয়ে স্নেহার্দ্রে মেহনূরের মাথা বুলিয়ে দিলো। স্ত্রী হিসেবে এমন সৎ নারীকে পেয়ে গর্বে বুকটা জুড়িয়ে গেলো। মনটা ভীষণ আপ্লুত হলো তার। এমন নিবিড় আবেদন ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। মাথায় হাত বুলিয়ে স্বচ্ছ কন্ঠে বললো,

– সমুদ্র কিছু নিলে তা একসময় ফিরিয়ে দেয়। যেই সমুদ্রের বুকে মাহদির দম গেলো, ওটা এক্সিডেন্ট ছিলো না। ওকে খুন করা হয়েছে। হয়তো বাঁচার জন্য অনেক ছটফট করেছে, কিন্তু মাহদি পারেনি।

মাহতিম নির্লিপ্ত ভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার কাতর দৃষ্টি এখন আকাশের দিকে। কথাগুলো বলার পর মেহনূরের দিকে তাকায়নি। ওই দুঃখী-দুঃখী চোখে তাকাতে পারবে না। আপন কারোর দুঃখ দেখা খুব মুশকিল। উপর দিয়ে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে, কিন্তু ভেতর-ভেতর পুড়ে যাচ্ছে সব। মাহতিমের মনে হলো, এই নিয়মটা শুধু সরল মানুষের জন্য খাটে। তারা আপনজনের দুঃখ নিতে পারে না। যদি মেহনূর সামনে না থাকতো, তবে তার চোখ দিয়েও দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরতো। কিন্তু সে স্বাভাবিক। যেনো কিছুই হয়নি। এরকম ঘটনা যেনো অহরহ ঘটে। কানে দু-একবার নাক টানার শব্দ পেলো, তবুও সেদিকে দৃষ্টি দিলো না। এরপর দ্বিতীয় যেই শব্দটা পেলো, সেটা শোনার সাথে-সাথে মুখ নামালো সে।

– খাওয়াটা শেষ করুন। খাবার নষ্ট করবেন না।

মাহতিম কোনো আপত্তি করলো না। চুপচাপ ছোট-ছোট হাতের লোকমাগুলো নীরবে খেয়ে নিলো। মেহনূরের চোখ-মুখ বড্ড লাল। নাক টানার শব্দ হলেও ফিসফিস জাতীয় আওয়াজ নেই। চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝরছে, মুখ একদম স্বাভাবিক। যেনো খাইয়ে দেওয়াটা মূখ্য কর্ম। অন্যদিকে হুঁশজ্ঞান নেই। এরকম মূহুর্ত্তের জন্য বোধহয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কথাটি লিখেছিলো,

‘ যারা শান্তরূপে সহ্য করে, তারা গভীরতর রূপে আহত হয় ‘।

.

জীবনের প্রতিটি ক্ষণ এখন বাক নিচ্ছে। মোড় নিচ্ছে অজানা পথের দিকে। সেই পথের দিশা কোথায় ঠেকছে কেউ জানে না। মেহনূর কথাগুলো মেনে নিয়েছে। সে এখন শান্ত। মাহতিমকে পালটা প্রশ্ন করেনি। রান্নাঘরে এঁটো প্লেটটা রাখতে গিয়ে চোখ থেকে টলটল করে অশ্রু পরছিলো। মুখ চেপে শব্দটা আঁটকে নিয়েছে সে। তার যতটা যন্ত্রণা হচ্ছে, এর চেয়ে কঠিন যন্ত্রণা মাহতিমের হচ্ছে। এই নির্মম সত্যটা জানার পর উনি নিশ্চয়ই থেমে নেই। ফোনের-পর-ফোন করাটা স্বাভাবিক। মেহনূর যদিও খুনির ব্যাপারে শক্ত কিছু জানে না, কিন্তু খুনটা কে করতে পারে, সেটা সে আঁচ করেছে। এবার হচ্ছে দেখার পালা। মেহনূর চোখের পানি মুছে নিজেকে স্থির করলো। কি কারণে মাহদির করুণ দশা হলো, জানতে চায় সে। তথাকথিত কি কারণে পেছনে লেগেছে? এটা কি প্রতিহিংসা? না অর্থের লোভ? কি কারণে চাল ফেলছে খুনিপক্ষ? মেহনূর ক্যালেন্ডারের পাতায় গোল মার্ক করলো। আজ ফেব্রুয়ারির আঠারো তারিখ। আসন্ন পরীক্ষার জন্য সময় নেই। বর্তমানে মাধ্যমিকের পরীক্ষা চলছে। এরপর শুরু হবে উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা। মনটা শক্ত করলো মেহনূর। তাকিয়ে রইলো ক্যালেন্ডারের দিকে। ঠিক তখনই বেজে উঠলো মোবাইল ফোন। ধ্যান ভাঙ্গলো ওর। মাথা ঘুরিয়ে বিছানার দিকে চাইতেই সেদিক বরাবর চলে গেলো। ফোনটা তুলে দেখলো, শানাজ দিয়েছে। মাহতিম এখন ঘরে নেই। সে গিয়েছে জরুরী কাজে। ফিরতে কিছুটা দেরি হবে সঙ্গে এটাও জানিয়েছে। মেহনূর কথাটা শোনার পর একটা মাত্র প্রশ্ন করেছে,

– সঙ্গে ভারী জিনিসটা নিয়েছেন?

দরজাটা খুলেই মাথা ঘুরায় মাহতিম। মেহনূরের দিকে তাকিয়ে আলতো করে হাসে। জুতা পরা ডান পা-টা ঠকঠক করে ফ্লোরে ঠুকে। ইঙ্গিতটা শান্তভাবে ছুঁড়ে নব্ মোচড়ে বেরিয়ে যায়। সদর দরজাটা নিজ থেকে লেগে যায়। শানাজের কলটা রিসিভ করে মেহনূর। প্রথম শব্দটা সে-ই বললো,

– আসসালামুআলাইকুম বুবু। কেমন আছো?

শানাজ একরাশ দুঃখ নিয়ে বললো,

– তুই কি আগের মতো…ওয়াআলাইকুমসসালাম। আছি কোনোরকম। এখন তো হাঁটাচলা করতে পারি নারে। পেটের বাবুটা এতো যন্ত্রণা দেয় যে কি বলবো। রাতে ঘুমাতে পারি না। তোর কথা বল। তুই কেমন আছিস? ওখানে সব ঠিক আছে তো?

মেহনূর যথাসম্ভব প্রফুল্ল কন্ঠে বললো,

– শান্তিতে আছি বুবু। এখানে কোনো সমস্যা নেই। শুধু একটা ব্যাপারে খারাপ লাগে। উনি যখন বাইরে যান, তখন খালি বাড়িতে থাকা যায় না। যেদিকে তাকাই, শুধু ভয়-ভয় লাগে। গা ছমছম করে। ভালো লাগে না।

ফিক করে হেসে ফেললো শানাজ। হালকা টিটকারি মেরে বললো,

– কিরে, বিয়ে তো আমার আগে করলি। এখনো আদর-ফাদর আদায় করলি না?

কথা শুনে মেহনূর চোখ বড়-বড় করে হা করলো। কি তাজ্জব কথা! বুবু এসব কি বলছে! মেহনূর সঙ্গে-সঙ্গে কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

– ছিঃ ছিঃ, কিসব বলছো বুবু! তুমি দেখছি লজ্জা-শরম ধুয়ে ফেলেছো।

শানাজ হো-হো করে হাসতেই বললো,

– ওমা! তুই লজ্জা পাচ্ছিস? তোর কি এখনো লজ্জা পাওয়ার বয়স আছে? সেইযে মাহতিম ভাইয়াকে চিনলি, এরপর থেকে তো তার কাছেই লুকাস। বাড়ির ঘটনাও দু-একটা শুনলাম। মরিচ পুড়িয়ে কি জঘন্য শিক্ষা দিলি! আবার বলে রান্নাঘরে খুচুর-মুচুর করেছিস? ডিফেন্সের ব্যাটারা সারাবছর দূরে থাকে তো। ওদের মনে প্রেম বেশি। তার উপর কোমলমতি বউ! আহাহাহারে, তুই জিতে গেছিস রে মেহনূর! তুই জিতে গেছিস।

রাগে কঠিন হতেই হেসে দিলো মেহনূর। ডানহাতে কপাল চাপড়ে চোখ বুজে ফেললো। ওপাশ থেকে শানাজ বকবক করে যাচ্ছে। এপাশ থেকে মেহনূর সব শুনে হাসছে। হঠাৎ সদর দরজায় ‘ ঠকঠক ‘ শব্দ হলো। মেহনূর হাসি থামিয়ে কৌতুহলী চোখে রুমের বাইরে তাকালো। শব্দটা বাইরে থেকে আসছে। আবারও ‘ ঠকঠক ‘ শব্দটা দরজায় আঘাত দিলো। এবার স্পষ্ট শুনেছে মেহনূর। চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। শানাজ এখনো কথা বলে যাচ্ছে, সেদিকে মনোযোগ নেই মেহনূরের। সে এখন দরজার দিকে চেয়ে আছে। কানে ফোন আঁটা অবস্থায় নিচু স্বরে বললো,

– কলটা কাটো বুবু। কে যেনো এসেছে। দরজায় ‘ খটখট ‘ করছে।

চকিতে থেমে গেলো শানাজ। তৎক্ষণাৎ সাবধানী গলায় বললো,

– এ্যাই? ভাইয়া কি দারোয়ান রেখে যায়নি? তুই ফট করে দরজা খুলিস না। আগে দাঁড়া, ‘ কে ‘ সেটা জিজ্ঞেস কর।

মেহনূর স্থির চোখে দরজার দিকে এগুচ্ছে। আর কয়েক কদম দূরে আছে দরজাটা। শানাজের চাপা উদ্বেগের কন্ঠ শুনে মেহনূর ওকে আশ্বস্ত করলো। রয়েসয়ে বললো,

– চিন্তা কোরো বুবু। উনি শুধু দারোয়ান না। গার্ডও লাগিয়েছে। বাড়ির সামনে দুটো, পেছনে দুটো। মোটমাট চারটা লোক রাইফেল হাতে পাহারা দেয়।

শানাজ তবুও শান্ত নেই। বিপদ কখনো বলে-কয়ে আসে না। মেহনূর এখন একা আছে। যদি কিছু হয়ে যায়? শানাজ প্রচণ্ড ভয় নিয়ে কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই মেহনূরের গলা ভেসে এলো। কিন্তু কথাটা যেনো ওকে না, অন্য কাউকে বললো। কলটা এখনো কাটেনি। সবটা শুনতে চায় শানাজ। আবারও পেটের পীড়াটা বাড়ছে। ব্যথায় কপাল কুঁচকালো সে। বাঁহাতে ফুলা পেটটা বুলাতে-বুলাতে ঠোঁট কামড়ে রইলো। এখনো ডান কানে ফোন চেপে আছে। মেহনূর যেনো বললো,

– চিঠি? এই চিঠি কে পাঠালো? এখন কি চিঠির যুগ? আমার কোনো আত্মীয় তো চিঠি লেখে না। এটা কোথায় পেলেন মাসুদ ভাই?

শানাজ চুপ করে শোনার চেষ্টায় আছে। ওপাশ থেকে একটা মোটা কন্ঠ শুনতে পেলো,

– এটা ফেলে দিবেন না ম্যাম। এটা রেখে দিন। এটা আপনার জন্য না। এটা আনসারী স্যারের জন্য। এখানে কিছু কাগজ আছে। যেটা এসেছে বনানী থেকে। বাড়ির নাম ‘ স্বপ্নমহল ‘। আপনি বাইরে বেরুবেন না। দরকার পরলে আমাদের ডাক দিবেন।

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .