মন বাড়িয়ে ছুঁই ২ পর্ব-২০+২১

0
648

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_২০ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে মেহনূর। কোত্থেকে এসেছে? কে লিখেছে? এ ধরনের কার্যকলাপ ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। এতো গুপ্তভাবে কাজ? কেন? কিসের প্রয়োজন এটা? মেহনূর এলোমেলো চিন্তায় অপেক্ষা করতে বসলো। ঘড়িতে এখন বিকেল পাঁচটা। ডানহাতে তামাটে রঙের খাম। উপরে বড়-বড় বোল্ড হরফে ‘ M. Ansari ‘ লিখা। লেখাটায় বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁইয়ে মেহনূর মোবাইলের দিকে তাকালো। একদম দেরি না-করে বডিগার্ড মাসুদকে ফোন করলো। কলের টিউন যেতেই ঢোক গিললো মেহনূর, সময়ক্ষেপণ না-করেই রিসিভ হলো কলটা।

– ম্যাম, কোনো প্রয়োজন? ভেতরে আসবো?

মেহনূর হুলস্থুল ভঙ্গিতে জবাব দিলো,

– আসতে হবে না। আপনি শুধু বলুন চিঠিটা আমি খুলতে পারবো কিনা। আপনার স্যার এখনো আসেননি। চিঠিটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ লাগছে।

মাসুদ একটু ভেবে হালকা গলায় বললো,

– জ্বী ম্যাম। স্যারের অনুপস্থিতিতে আপনি উনার কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন। এ ধরনের অর্ডার আমরা পেয়েছি। এতে সমস্যা নেই। আপনি চিঠি খুলুন।

মেহনূর খুব শান্তমনে খামের মুখটা ছিঁড়লো। খামটা কোলের উপর উপুড় করতেই ভাঁজকৃত চিঠিটা বেরুলো। বুকটা দুরুদুরু করছে। চিঠির পাতায় হুমকিস্বরূপ কিছু পাঠালো? কোনো ভয়াবহ সন্ত্রাসী সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে? খুনের জন্য আগাম বার্তা পাঠালেও আশ্চর্য হবে না সে। মাহতিমের কর্মকাণ্ডের পেছনে শত্রু থাকাটা স্বাভাবিক ও শক্ত। মেহনূর দুহাতে চিঠিটা মেলে চোখের সামনে ধরলো। স্পষ্টভাষায় সেখানে লিখা,

আনসারী,

খবর পেলাম আপনি কোয়ার্টারে উঠেছেন। রাস্তায় এ্যাটাকের শিকার হয়েছেন। শোকর আলহামদুলিল্লাহ আপনারা সুস্থ আছেন। ভাবীকে আমার সালাম। আপনার সাথে দেখা করাটা খুব জরুরী। আপনি খুব বাজেভাবে ফেঁসে যাচ্ছেন ব্রাদার। কেসটায় তদন্ত করতে গেলে বিপদ। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপের মুখোমুখি হবেন। আমি কিছু ইনফো পেয়েছি যেটা শোনা খুব দরকার। আপনি আগামী সোমবার, রাত সোয়া এগারোটা, মালিবাগের কাছে দেখা করবেন। গাড়ির রঙ নেভি ব্লু, শেষ চার সংখ্যা আট-তিন-শূন্য-ছয়।

পুনশ্চ : আমি ওয়াসিফ পূর্ব থাকতে আপনার বিপদ হতে দেবো না ব্রাদার! যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি; আপনার চারপাশ থেকে সব ধরনের বিপদ তুলে নেবো। আমার মানুষ অলরেডি চর্তুপাশে ছড়িয়ে গেছে। যেকোনো সময় রণক্ষেত্রের বাজ পরবে। আপনি তৈরি থাকুন। একসময় আপনি যেই হেল্পটা করেছিলেন, আমি ভুলিনি আনসারী সাহেব। আমার বিপদের বেলায় আপনার নিঃস্বার্থ অবদানটা কোনোদিন ভুলবো না। আমৃত্যু আপনার প্রতি সম্মান থাকবে। আজ আপনার জন্য কিছু করার সুযোগ এলে আমি জান-প্রাণ এক করে প্রতিদান দেবো। আপনার দুঃসময়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারবো না, সরি। কিছু দূর্নীতিবাজ, দুষ্ট লোকদের জন্য পিছু হটবেন না। আমার আকুল অনুরোধ! আমার হাত অন্যায়কারীরা বেঁধে দিয়েছিলো বলে সেদিন কিচ্ছু করতে পারিনি। আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে জোচ্চোরের দলটা সেদিন হেসেছিলো। কোনো মানুষ আমাকে সাহায্য করতে পারেনি। আমার কাছের মানুষ আমাকে ক্ষতি করে গেছে। সৎভাবে থাকাটা কতো কষ্টের আমি বুঝি। আপনি স্বতন্ত্র, মুক্ত, স্বাধীনচেতা মানুষ। আপনার কাছে চমৎকার বলবুদ্ধির ক্ষমতা আছে। আপনি যদি আমার মতো বন্দি মানুষকে বের করার ক্ষমতা রাখেন, সেখানে আপনি সুউচ্চ চিন্তাভাবনা রেখেছেন নিশ্চয়ই। ভাবীর প্রতি সতর্ক থাকবেন। (মানুষকে দূর্বল দিক জানাতে নেই। সুযোগমতো আঘাত করতে দেরি করে না।)

ওয়াসিফ পূর্ব,
স্বপ্নমহল, ঢাকা।

বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছে মেহনূর। চক্ষুকোটর স্থির। একনাগাড়ে চিঠিটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। মাথার উপর ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে; তবুও সারা মুখ ঘেমে গেছে ওর। নিশ্বাস নিচ্ছে ধীরে-ধীরে। মূঢ় ভঙ্গিতে চিঠিটা নামিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে ‘ আল্লাহ্ রহম করো ‘ বললো। এতোকিছু কোনোদিন ভাবেনি সে। এতো গূঢ়তার সাথে মাথা ঘামায়নি। আজ তার মাথাটা বড্ড এলোমেলো হয়ে গেছে। জীবনের গতিধারা কত সরল ভাবি। অথচ, আদৌ সেটা সরল? সরল নয় বলেই আমরা সাদামাটা গল্প খুঁজি। কোথায় একটু আনন্দের উৎস পাবো সেদিকে আকৃষ্ট হই। আজ মাহতিমের প্রতি মন দূর্বল হচ্ছে। অদ্ভুত কারণে তার প্রতি করুণার উদয় হচ্ছে। একটু-একটু করে অসহায় অনুভূতিটা বাড়ছে যেন। বেপরোয়া ভঙ্গিতে চলা শক্ত মানুষটা সবার কাছে যেমনই হোক; তার কাছে নরমসুলভ মানুষ। তার কাছে একটি সবুজ পাতার মতো মনোরম কেউ। ঠোঁটজোড়ার সরল হাসিটা যখন দেয়, তখন মনেহয় বাতাসে দুলতে থাকা নব্য ফুলের মতো স্নিগ্ধ। সেখানে কোনো মিথ্যে নেই, কৃত্রিমতার ছোঁয়া নেই, অভিনয়ের লেশ নেই। সে যেনো নিজের সরল মূর্তিটা মেহনূরের কাছে সপে দেয়। আপ্রাণ সুরে বলে, ‘ আমাকে পরমাহ্লাদে যত্ন করো, দিনশেষ আমি তোমারই হবো। ‘ চোখদুটো বন্ধ করলো মেহনূর। মনের ভেতর ভয়-সংশয়ের কুণ্ডলী পাক খাচ্ছে।

.

গোটা সূর্যটা অস্ত গেলো। দিনের শেষ আলোটা নিভে অন্ধকার হলো। আকাশে ছড়িয়ে পরলো বেগুনি রঙের আভা। নীড়ে ফেরা পাখ-পাখালি দলবেঁধে ফিরছে। তারও ইচ্ছে হয় সব তল্পিতল্পা গুছিয়ে বাড়ি ফিরতে। কিন্তু, ডিউটির জন্য সম্ভব হয় না। মাহতিম নীরবে আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনের দিকে চাইলো। পাকা রাস্তার দুধারে ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলেছে। বর্তমানে ড্রাইভে আছে নোমান। মাহতিম সদাসর্বদার মতো পায়ের-উপর-পা তুলে ভাবুক স্টাইলে গাড়িতে বসে আছে। তার পুরো ব্যক্তিত্বে যেনো সৌম্যতার ছাপ। তার ধারালো দৃষ্টিটা এখন নোমানের উপর বর্তমান। সুক্ষ্ম জিনিসটা ধরতে পেরে অকাট্য গলায় বললো সে,

– অকারণে স্পিড তুলতে নিষেধ করেছি। লাস্ট ওয়ার্নিং নোমান। অর্ডার না মানলে গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবো!

হঠাৎ এ ধরনের নির্দেশ শুনে বিষম খেলো নোমান। চোখদুটো একপলকের জন্য লুকিং মিররে রাখলো; পেছনে থাকা রাগী মুখটা দেখতে পেয়ে খাটো সুরে বললো,

– সরি স্যার, আর হবে না। খেয়াল রাখবো।

নোমানকে শক্ত কথা বলার পর ভাবনায় ডুবেছে মাহতিম। ডিউটি শেষ চারটার দিকে। এরপর যেতে হয়েছে আর্জেন্ট কাজে। স্বনামধন্য গোয়েন্দাতুল্য মানুষ তাশরিফ সাগ্রতের আমন্ত্রণ ছিলো। সেখানে কেটে গেছে চার-চারটি ঘন্টা। সাগ্রতের কাছে উপস্থিত হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। মুখোমুখি সোফায় দুজন বসতেই মোদ্দাকথা শুরু করে। হাতের ট্রান্সপারেন্ট ফাইলটা কাঁচের টেবিলে রাখতেই গলা খাঁকারি দেয় সাগ্রত। প্রথম কথাটা মার্জিত সুরে বললো,

– মাহদির মৃত্যুটা এক্সিডেন্ট না স্যার।

মাহতিম কথাটা শুনে গম্ভীরভাবে বললো,

– বুঝলাম। কিন্তু প্রমাণটা পেশ করুন।

সাগ্রত মাথা নাড়িয়ে সম্মতিয় জানালো। ফাইলটা খুলে কিছু কাগজ এগিয়ে বললো,

– এই ফাইলে পোস্ট মর্টাম রিপোর্ট আছে। যদিও কবরস্থ লাশ থেকে শক্ত ক্লু পাওয়া না। তবে এটা নিশ্চিত, ঘটনাটা পরিকল্পিত খুন ছিলো। এখানে মগজাস্ত্র ব্যবহার হয়েছে স্যার। শক্ত ব্লান্ট ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করা হয়নি। আই মিন, কোনো ছুঁড়ি-কাঁচি-পিস্তল এ ধরনের শক্ত জিনিস ইউজ করেনি।

ফাইলের কাগজে চোখ বুলাচ্ছে মাহতিম। প্রতিটি অক্ষর মন দিয়ে পড়তেই অন্যদিকে সাগ্রতের কথা শুনছে। সাগ্রত কাগজে হাইলাইট করা একটি লাইন দেখিয়ে বললো,

– এটা একটু খেয়াল করুন স্যার। এখানে ক্লিয়ার রেফারেন্স দেওয়া আছে। ওকে এমন কিছু খাওয়ানো হয়েছিলো; যেটা কিছু সময়ের জন্য ওর নার্ভ দূর্বল করে দেয়। এটার সাইড ইফেক্ট বডিতে পরেছে। রিপোর্টেও সাফ-সাফ লেখা। মানেটা বুঝতেই পারছেন, ভিক্টিমের দশা অনেকটা অচেতন ছিলো। ওইসময় আপনাকে যাই বলা হবে, আপনি চুপচাপ সেটাই করতে বাধ্য হবেন। আপনারা যেদিন সমুদ্র-সৈকতে নেমেছেন, সেদিনও একটা ঘাপলা হয়েছে। মৌসুমভেদে সী-বীচের কিছু জায়গায় মানুষের জন্য নিষেধাজ্ঞা থাকে। সেখানে কাউকে যেতে দেওয়া হয় না। মাহদি যেখানে ডুবেছে, ওই জায়গাটা সীল্ড জায়গা ছিলো। ফাইলের পরের পৃষ্ঠায় একটা ম্যাপ আঁকা আছে। সেখানে দেখবেন রেড ফ্ল্যাগ দেওয়া একটা মার্ক। এটাই সেই জায়গা। এখানে কিছু লোক পাহারায় থাকে। তবে, মাঝে-মাঝে জায়গাটায় কেউ না-এলে পাহারাদাররা উদাসীন হয়ে যায়। তারা অন্য কাজে ব্যস্ত হয়। আপনার স্টেটম্যান্ট মোতাবেক, আপনি সাঁতার কেটে সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু পথিমধ্যে থেমে যান, দ্যান ব্যাক করেন। স্যার, এবার আপনাকে আরো একটা তথ্য দেই।

দুহাতের ফাইল থেকে চোখ তুললো মাহতিম। সরাসরি সাগ্রতের দিকে তাকালো। সাগ্রত ডানহাতের মুঠোটা ঠোঁটের কাছে এনে হালকা কাশি দিয়ে বললো,

– আততায়ী একজন ভাড়াটে খু;নি। আমি সিক্রেট সোর্স থেকে জানতে পেরেছি, সে লাখ টাকার বিনিময়ে কাজটা সম্পন্ন করেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সাথে বহু আগে থেকেই যুক্ত। অনেককে সে টুকরো-টুকরো করেছে। কিন্তু, প্রশাসনের দূরবস্থার জন্য কোনোদিন শাস্তি পায়নি। ওর ফার্স্ট টার্গেট কিন্তু মাহদি ছিলো না। টার্গেটে ছিলো একটা মেয়ে। আমার ধারণা, আপনিও সেই টার্গেট সম্বন্ধে আগে থেকেই জানতেন।

দু’জোড়া বিচক্ষণ দৃষ্টি একে-অন্যের দিকে নিবদ্ধ।ফাইল ধরা অবস্থায় তাকিয়ে আছে মাহতিম। সাগ্রতের দূরদর্শী বুদ্ধিকে বাহবা দিতে হয়। অনেককিছুই অনুমান করেছে সে। মাহতিম ফাইলটা বন্ধ করে নিরুদ্বেগ গলায় বললো,

– হ্যাঁ, মেয়েটা আমার ওয়াইফ। ওকে টার্গেট করা হয় এটা জানতাম। শেষপর্যন্ত সব আমার কন্ট্রোলে ছিলো। কিন্তু, কোন ফাঁকে সামান্য ভুলটা হয়ে যায় ধরতে পারিনি। মাহদি কখন চোখের বাইরে চলে যায়, ওই হিসাব মিলানো দুষ্কর। খুনির হাতে কমপক্ষে পাঁচ-সাত মিনিটের মতো সময় ছিলো। যা করার এইটুকু সময়ের ভেতর করেছে।

সাগ্রত সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। শার্টের বুকপকেট থেকে ভাঁজকৃত কাগজটা মাহতিমের দিকে বাড়িয়ে বললো,

– আপনার মা থাইরয়েডের রোগী। এটার জন্য প্রায়ই উনাকে বিদেশে যেতে হয়। আপনার বাবা যেই উইলটা করে গেছেন, সেখানে আপনি সমস্যা করেছেন। এই ধরনের সমস্যাও ব্যতিক্রমভাবে দেখছি। আজীবন দেখলাম সম্পত্তির লোভে ভাইকে কতকিছু করে ফেলে। খুন করতেও দ্বিধা করে না। আর আপনি নিজের নাবালক ভাইয়ের জন্য নিজের অংশই ছেড়ে দিয়েছেন। মাহদি কি এটা জানতো?

মাহতিম বিষণ্ণ ঠোঁটে হাসলো। ভারী নিশ্বাস ছেড়ে করুণ হাসিতে বললো,

– নিজের সন্তানের মতো আদর করেছি তো, এজন্য কোনোদিন হিংসা করতে পারিনি। আমাকে ‘ ভাই ‘ বলে ডাকতো। স্কুলে গার্ডিয়ান হিসেবে আমার পরিচয়টা বাবার আগে দিতো। ওর জন্য বাবার উইলে নিজের অংশ চাইনি। যদি কখনো আমার ভেতর হিংসা ঢুকে যেতো, যদি কখনো ওর অংশের প্রতি খারাপ চিন্তা ঢুকতো, তখন কি করতাম আমি? ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ্ব লেগে যেতো। নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারতাম না। আমিতো বাবার ভালোবাসাটা পেয়ে গেছি। কিন্তু মাহদি তো কোনোদিন পেলো না। তাই ভাবলাম, আমার অংশে বাবার যতখানি উইল জুড়তো, সেটা ওর নামে কনভার্ট করে দেই। কিন্তু কে জানতো, দিনশেষে মাহদিই থাকবে না?

মুখটা নিচু করলো সাগ্রত। কি বলে সান্ত্বনা দিবে জানে না। মাহতিমের ফ্যাকাশে হাসিটা অনেককিছু বোঝাচ্ছে। কতখানি দুঃখ পেলে শোকের কথাটা হাসি দিয়ে বলছে! সাগ্রত ফাইলের কাগজ গুছাতে-গুছাতে বললো,

– স্যার, আমরা মানুষকে ‘ মানুষ ‘ মনে করি না। মনেকরি ‘ পশু’। মানুষ মনে করলে ভুলেও খারাপ কথা বলতে পারতাম না। চিন্তা করতাম দশবার। খুন —

মাহতিম কথাগুলো শুনলো কিনা বোঝা গেলো না। দূরে কোনো শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। এক অদ্ভুত হিংস্রতার সাথে বিড়বিড় করে বললো,

– ডু অর ডাই। কারেঙ্গে ইয়া মা;রেঙ্গে। হয় ম;রবো, নয় মা;রবো। ছেড়ে দিবো না কাউকে।

‘ – স্যার? কোয়ার্টার এসে গেছে। ‘

ঝটকা মেরে চোখ খুললো মাহতিম। ভাবনার চমক ভাঙতেই চারপাশে তাকালো। নোমান ড্রাইভিং সীট থেকে পিছু তাকিয়ে আছে। ডানপাশের দরজা খুলে বাইরে বেরুলো মাহতিম। মাথা থেকে ইউনিফর্মের টুপিটা খুলতেই ভেতরে প্রবেশ করলো সে। সঙ্গে-সঙ্গে কালো পোশাকের দুজন রাইফেলধারী গার্ড পা ঠুকে স্যালুট করলো। সম্মতি জানালো মাহতিম। টুপিটা বাঁহাতে বগলদাবা করে কলিংবেল টিপে দিলো। কি ব্যাপার? এখনো দরজা খুললো না? মাহতিম আবার কলিংবেল টিপলো। অপেক্ষা করলো কিছুক্ষণ। কিন্তু, না; দরজা তো খুলছে না। আবারও ছাদে গিয়ে ঘুরাঘুরি করছে নাকি? কি মসিবত রে বাবা! এই রাতেও ছাদে যাওয়া লাগে? চুল ছেড়ে ঘুরতে দেখলে আজ ইচ্ছামতো বকবে। গরমে হোয়াইট ইউনিফর্মের শার্টটা ভিজে আসছে। মাহতিম এক্সট্রা চাবির জন্য যেই ব্যাক পকেটে হাত দিলো, তখনই ভূতুড়ে কায়দায় দরজাটা খুলে গেলো তখন। মাহতিম পকেটে হাত ঢুকানো অবস্থায় খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ মেয়েলি সুরে গেয়ে উঠলো কেউ,

– ‘ দুঃখটাকে দিলাম ছুটি আসবে না ফিরে ‘,

মাহতিম অবাক হয়ে তাকাতেই হুট করে বাইরে চুপি দিলো নীতি। একগাল হাসি দিয়ে তাকাতেই নীতির পেছন থেকে আরো দুটো মিষ্টিমুখ উঁকি দিলো। নীতি ও ফারিনের মেয়েলি কন্ঠটা আনন্দের সাথে গাইলো,

– ‘ এক পৃথিবী ভালোবাসা রয়েছে ঘিরে ‘,

মাহতিম প্রচণ্ড খুশিতে আশ্চর্য হয়ে গেছে। আমোদের সাথে উচ্চকন্ঠে বললো, ‘ তোরা এখানে? ‘

ওরা মাহতিমকে কিছুই বলতে দিলো না। এবার যেনো তাল মিলালো সামিক-সৌভিকের কন্ঠ,

– ‘ মনটা যেন আজ পাখির ডানা ‘।

মাহতিম কয়েক মিনিটের জন্য সবকিছু ভুলে গেছে। ওদের আকস্মিক আগমনে সে বাক্যহারা! সিঁড়ির ধাপে পা ফেলে উঠতেই দরজাটা পুরোপুরি খুলে গেলো। হাসিতে-খুশিতে তৌফ ও সিয়াম একসঙ্গে সুর তুলে দিলো,

– ‘ হারিয়ে যেতে তাই নেইতো মানা। ‘

মাহতিম দরজা পেরিয়ে ঢুকতেই নীতি ফিসফিসানো ভঙ্গিতে ঠোঁটের কাছে হাত রেখে গাইলো,

– ‘ চুপি চুপি চুপি স্বপ্ন ডাকে হাত বাড়িয়ে ‘,

মাহতিম সরল হাসিতে প্রফুল্ল হতেই দুহাত দু’দিকে মেলে দিলো। সবাই একযোগে হুড়মুড় করে জাপটে ধরলো মাহতিমকে। চর্তুদিক থেকে ঘিরে ধরলো আট-আটটি শক্ত বন্ধন। তারা খেয়ালই করলো না, মাহতিম প্রচণ্ড ঘেমে গেছে। তোয়াক্কাই করলো না, ওর ঘামে জবজবা ইউনিফর্ম। সবাই একে-অপরকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে হঠাৎ নিরব হয়ে গেলো। পিনপতন নিরবতায় উল্লাসিত করিডোরটা থেমে গেলো। বেডরুমের কাছে মারজা ও মেহনূর একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে ওদের পুরো দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছে। কোনো এক অজানা কারণে সবাই মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। নিঃশব্দে প্রতিটি চোখের অশ্রু ঝরছে। হয়তো এই গানটা সেদিনের স্মৃতি, যেদিন ওরা সমুদ্রমুখী হয়েছিলো। একদিন এই গানের সমাবেশে আরো একজন যুক্ত ছিলো। সেই একজনের শূন্যতা আজ সবার অশ্রুতে দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি যেনো তৌফের পিঠটা কাঁপছে। তৌফের সাথে খুনশুটিটা সবচেয়ে মজবুত স্মৃতি ছিলো।

‘ মন চায়, মন চায়,

যেখানে চোখ যায়, সেখানে যাবো হারিয়ে… ‘

চলমান .
.
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_২১ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

আবহাওয়া ভালো নয়। খুব খারাপ হচ্ছে। কালো আকাশটা শাপিণীর মতো হুঙ্কার দিচ্ছে। থেমে নেই বৃষ্টিপাত। চোখের সামনে একটু পরপর দিনের আলো ফুটছে। ফুলেফেঁপে বজ্রনাদ করছে কালো আকাশ। থাই গ্লাসটা তাড়াতাড়ি টেনে দিলো মেহনূর। বৃষ্টির প্রবল ঝাপটা ঘরে ঢুকছে এখন। একটু আগে সশব্দে ট্রান্সমিটার গিয়েছে। তার বদৌলতে সবখানে অন্ধকার। কোয়ার্টারের চর্তুদিকে ছড়িয়ে আছে ঘুরঘুট্টি অবস্থা। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে। হাতদুটো ভাঁজ করা বুকের কাছে। দরজার নব্ মোচড়ে প্রবেশ করলো কেউ। শব্দটা শুনতে পেলো মেহনূর; আগত মানুষটার জন্য স্থির সুরে বললো,

– ডিউটি শেষ চারটায়, বাসায় ফিরেন পাঁচটায়; আজ আসলেন আটটায়। কোথায় ছিলেন আপনি?

কড়া প্রশ্নের কাছে থমকে গেলো মাহতিম। এখনো ভেজা শার্ট গায়ে; খুলার সুযোগ পায়নি। নীতিদের খপ্পরে ফ্রেশ হয়নি। দরজাটা ঠেলে দিলো সে। বিব্রত চোখে জানালার দিকে চাইলো। কাট-কাট প্রশ্নের উত্তরটা শান্তভাবে দিলো,

– একটু কাজ ছিলো বাইরে। এজন্য যেতে হয়েছে। তোমার কোনো জরুরি কাজ ছিলো?

উত্তর শুনে জোরে নিশ্বাস নিলো মেহনূর। থাইগ্লাসে দৃষ্টি হেনে সন্দিগ্ধ গলায় বললো,

– আপনি বিয়ের আগে কি করতেন, কিছুই জানতে চাইনি। আজ জানতে চাইবো। মিথ্যা বলবেন না। এই ওয়াসিফ পূর্ব কে? আপনাকে চিঠি দেওয়ার উদ্দেশ্য কি? আপনি এই ভদ্রলোকের সাথে যুক্ত কেন? আজ দুপুরে আপনার নামে চিঠি আসে। সেখানে ঠিকানা দেওয়া ঢাকার। বাড়ির নাম ‘ স্বপ্নমহল ‘। ব্যক্তির নাম ওয়াসিফ পূর্ব। আপনি গুপ্তভাবে কিসের সাথে জড়িত আছেন, সব শুনতে চাই আমি।

সবে শার্ট খুলছিলো মাহতিম। শেষ বোতামটা খুলতে গিয়ে স্থির হলো সে। তার চোখদুটো থমকে গেছে। অবাকের রেশটা নিয়ে চোখ তুললো সে। সোজাসুজি তাকালো মেহনূরের দিকে। কন্ঠে বিষ্ময় ভাব ফুটিয়ে প্রশ্ন করলো মাহতিম,

– তুমি ওটা পড়েছো?

ঘুরে দাঁড়ালো মেহনূর। সরাসরি তাকালো মাহতিমের দিকে। মাহতিমের চোখে বিষ্ময়ের ঢল। ঠোঁটদুটো কিন্ঞ্চিত ফাঁক হয়ে গেছে। মেহনূর পা বাড়িয়ে মাহতিমের কাছে আসলো। শার্টের শেষ বোতামটা খুলার জন্য যেই হাত বাড়ালো, ওমনেই বাঁধ সাধলো মাহতিম। হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিলো। তীক্ষ্ম দৃষ্টি ছুঁড়ে শক্ত গলায় বললো,

– পারমিশন নিয়েছো?

মেহনূর সামান্য ঢোক গিললো। সেটা ভয়ের না দ্বিধার, বোঝা গেলো না। আবছা অন্ধকারে পরিষ্কার কন্ঠে বললো,

– আমি মাসুদ ভাইকে বলেছি। উনি বলেছেন, আমি ওটা দেখতে পারবো। আপনার এরকম অর্ডার আগেই দেওয়া ছিলো। তাছাড়া, চিঠির ভাষাগুলো স্বাভাবিক না। ওখানে স্পষ্ট করে লেখা আপনি উনাকে সাহায্য করেছেন। ওই ভদ্রলোক কিসের কথা বলছে?

চিঠিটা গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি গুরুত্বপূর্ণ শান্ত থাকা। মেহনূরের উপর ক্ষেপা যাবে না। ও কিছুই জানে না। ভুলবশত খুলে ফেলেছে। সেটার কথা সাতপাঁচ করবে না সে। এটুকু ভরসা ওর উপর করা যায়। সাবধানতার জন্য দরজাটা লক করলো মাহতিম। ভেজা শার্টটা সোফার উপর ছুঁড়ে মেহনূরের দিকে এগুলো। কন্ঠটা খুব খাটো করে স্রেফ মেহনূরকে বুঝিয়ে বললো,

– এগুলো খুব জরুরী জিনিস। অনেক তথ্য এখানে লুকিয়ে আছে। এগুলো খুলো না মেহনূর। তোমার কাছে অনুরোধ, চিঠি এলে সেকেন্ড ড্রয়ারে রেখে দিবে। তোমাকে যা জানানোর তা জানাচ্ছি; কিন্তু প্লিজ চিঠি পড়তে যেও না। অনেক সেন্সেটিভ জিনিস ওখানে লিখা থাকবে, যেগুলো আমি চাই না তুমি পড়ো। আমার ফোন মাঝে-মাঝে ট্যাপ হয় তুমি জানো। সেখান থেকে কল রেকর্ড নেওয়া হয়। এসব কে করছে, পরে বলবো। আমি রিষ্ক নিতে চাই না। পলিটিক্সে ভালো-খারাপ দুটো দিক আছে। যারা ভালো, তাদের জন্য দেশ আগায়। যারা খারাপ, তাদের জন্য দেশ পিছায়। এই ভালোর সাথে ওয়াসিফ পূর্ব যুক্ত ছিলো। তুমি শুনলে খুব অবাক হবে, এই পূর্ব একজন সাংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি তাঁর পদ থেকে কিছু খারাপ মানুষের জন্য ছিটকে গেছেন। এখন তিনি পলিটিক্স করেন না। পরিবার-ব্যবসা নিয়ে দূরে আছেন। কিন্তু, আমার ভাগ্য খারাপ! আমার পরিবার থেকে কিছু মানুষ বাজে পলিটিক্সে যুক্ত। তারা দল ও দেশ দুটোর নাম ডুবাচ্ছে। নিজ পার্টির নাম ভাঙ্গিয়ে খারাপ কাজ করছে। কাজটা বহুদিন ধরে হচ্ছিলো; কিন্তু কারো কাছে প্রমাণ নেই। কালাম সরদার মারা যাওয়ার পর সেই অনৈতিক কাজ থামেনি। পাচারের কার্যক্রম এখনো চলছে। কে বা কারা মুখোশের আড়ালে আছে কেউ জানে না। কেউ কূলকিনারা ধরতে পারে না। সবার মধ্যে ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়। কালাম সরদারের মতো বহু শয়তান দেশে লুকিয়ে আছে। কিন্তু তাদের চালাচ্ছে কিছু ক্ষমতাসীন মানুষ। খবরটা আমাকে খোদ পূর্ব জানায়।

একটু থামলো মাহতিম। হাতঘড়িটা খুলে টেবিলে রেখে দিলো। চুপচাপ সব শুনছে মেহনূর। নিরব শ্রোতার মতো সম্পূর্ণ মনোযোগ মাহতিমের দিকে। মাহতিম আলমারি থেকে কাপড় নিতে-নিতে বললো,

– ইমেইলে এমন কিছু তথ্য ফাঁস করে, যার জন্য আমি ইনভল্ভ্ড হই। এই ফিল্ডের সাথে আমি যুক্ত না; আমার কাছে তথ্য থাকা মুশকিল। আমার প্রয়োজন ছিলো এমন এক মানুষ; যে কিনা ধূর্ত ও বুদ্ধিমান। আমি পূর্বকে একবার সাহায্য করেছিলাম। সাহায্যের বিনিময়ে শুধু এই কেস না, মাহদির কেসেও হেল্প করেছেন। দেশের নামকরা গোয়েন্দা তাশরিফ সাগ্রতকে হায়ার করে দিয়েছেন। কারণ, মাহদির ঘটনা তিনবছর হয়ে গেছে। এই পুরোনো কেসটাকে মার্ডার কেসে কনভার্ট করতে গেলে অনেক প্রমাণ দেখাতে হয়। যেটা একমাত্র সাগ্রত করে দিয়েছে। একটা ক্রাইম ডিপার্টমেন্ট যত আলামত সংগ্রহ করতে পারতো, তার চেয়েও সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম ডিটেইল বিভিন্ন সোর্স থেকে এনে দিয়েছে। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট থেকে বের করেছে বহু তথ্য। সব মিলিয়ে একটা মার্ডার কেসের তদন্ত চলছে। যেখানে সত্য উদঘাটন হলে আরো দশটা সত্য বেরিয়ে পরবে। পূর্ব আমাকে দেখা করতে বলেছেন। এই চিঠিতে মেবি টাইম-প্লেস সব লিখা। যদি তাই হয়, তাহলে এই সাক্ষাতের পর অনেককিছু খোলাসা হবে। বলতে গেলে, আমার আল্টিমেটাম কাউন্টিং শুরু। এরপর কেস ডিসমিস।

আলমারিটা লাগিয়ে ফিরে এলো সে। ডানকাধে পোশাক ঝুলিয়ে ওর কাছে আসলো। মুখটার দিকে একটু ঝুঁকে হালকা গলায় বললো,

– কবে যেতে বলেছে?

মেহনূর নির্মল চোখে তাকিয়ে আছে। প্রশ্নের প্রতি ভ্রুক্ষেপ নেই। ওমন অবুঝ চাহনির দিকে তাকিয়ে থাকলে মনটা আরো বিহ্বল হয়। আকৃষ্ট হয় খুব মোহের কাছে নত হয় মাহতিম। ছোট্ট মুখটার দিকে আরেকটু ঝুঁকলো সে। মধ্যবর্তী দূরত্ব কিন্ঞ্চিত রেখে আলতো গলায় শুধালো,

– আমাকে কবে যেতে বলেছে?

চোখে চোখ রেখেছে মেহনূর। একবুক ভয়, প্রচণ্ড সংশয়, অপ্রস্তুত চিন্তায় তাকিয়ে আছে। চিঠিটা যদি কুটিকুটি করে ধ্বংস করতো? যদি ওটার অস্তিত্ব নষ্ট করতো? কেন জানি ভয় হচ্ছে। ওই ঠিকানায় গেলে কিছু একটা হবে। স্থান : মালিবাগ। সময় : রাত এগারোটা। গাড়ির রঙ : নেভি ব্লু। গাড়ির নাম্বার : আট-তিন-শূন্য-ছয়। মেহনূর ঢোক গিললো। নিচের শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে ভীত সুরে বললো,

– সোমবার। মালিবাগ। রাত সাড়ে এগারো। নেভি ব্লু গাড়ি, আট-তিন-শূন্য-ছয়।

মাহতিম মৃদ্যু হাসলো। ওর নাকের ডগায় নাক ছুঁয়ে বললো,

– কন্ঠ কাঁপছে। ভয় পাচ্ছো?

ঠোঁট কামড়ালো মেহনূর। ভেতর থেকে কেউ যেনো চিৎকার করছে! কেউ যেনো বলছে ‘ ভয় পাচ্ছি, ভয় পাচ্ছি, খুব ভয় হচ্ছে ‘। মেহনূর দাঁত শক্ত করে নিজেকে সামলানো। গলা ভিজিয়ে ছোট্ট করে বললো,

– না, ঠিক… ভয় পা …

তবুও কেঁপে উঠলো কন্ঠটা। আভাস দিলো ভয়ের। বুঝিয়ে দিলো ভয় পাচ্ছে। ভিজে উঠছে চোখ। আবারও কিছু বলতে চাইলে এক ঝটকায় ঠোঁটদুটো বন্ধ হলো। আকস্মিক কাণ্ডে দম আঁটকালো মেহনূর। বলতে পারলো না কিছু। চোখদুটো বুজে ফেললো সে। মাহতিম সবটুকু সান্নিধ্য দিয়ে ব্যকুলরূপে চুমু খেলো। মেহনূরকে ছোট্ট হরিণীর মতো বুকে টেনে নিলো। অস্থিরভাবে জড়িয়ে ধরলো। দুটো হাতের বেষ্টন দিয়ে চেপে ধরলো ওকে। এই ছোট্ট মানুষটির প্রতি ভারী লোভ। একটু-একটু করে পরমা স্ত্রীকে আগলে রাখছে সে। তার প্রতি কখনো সদয় হয়েছে, কখনো যত্ন করছে; কখনো মাপ-যোগ করে ভালোবেসেছে। দুনিয়াতে এতো-এতো মেয়ের মাঝে এই মেয়েটাকেই নিজের-কাছের-একান্ত মনেহয়। এ যেনো নিজেরই কেউ। নিজের সমুদয় প্রেম-মহব্বত-ভালোবাসা। মেহনূর আপ্রাণভাবে জাপটে ধরলো তাকে। বুকের ভেতর বন্দি থাকা ভয়টা উপড়ে ফেলতে চাইলো। পাগলের মতোই হোক, বা নিঃস্ব কোনো অনাথা, মেহনূর তার শেষ অবলম্বনটুকু হারাতে চায় না। এইযে মনের ভেতর কেমন-কেমন বোধ হচ্ছে, বিচলিত ভাব হচ্ছে; এসবের কোনো ব্যাখ্যা আছে? তবুও একটা খটকা ভাব সুতোর মতো গেঁথেছে।
.

এখনো চোখদুটো দেখলে কেঁপে উঠে মানুষ। রেগে গেলে প্রচণ্ড ভয় পায়। সেই গম্ভীর, রাগী, স্বল্পভাষী মানুষটার ভেতরে অদ্ভুত কিছু আছে। ওই রাশভারী চেহারায় কি একটা সুক্ষ্ম টান খুঁজে পায়, কেমন একটা মোহ-মোহ অবস্থা তৈরি হয়, সেটার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল। কথা বলতে গেলে পুরো মুখটাই শক্ত হয়ে যায়। তার কঠোর ব্যক্তিত্বের উপর আলাদা জৌলুস দেখতে পায়। কথা বলতে গেলে তার কন্ঠস্বর দীপ্ত হয়; প্রতিটি মুখ নিঃসৃত বাক্য যেন আগুনের ফলা। সামনে বসা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী লোক, যতই উঁচুপদের বিতর্কিত মানুষ হোক; সে বাধ্য হয় শ্রোতা হতে, বাধ্য হয় চুপ হতে। তার নিজস্ব যুক্তি যেমন অকাট্য, তেমনি তার চিন্তাচেতনা গভীর। গায়ের শার্ট বা ধবধবে পরিষ্কার পান্ঞ্জাবীটা দুহাতে খুলে ফেললে চোখদুটো থমকে যাবে। থমকে যাবে তার দেহের অদ্ভুত সৌন্দর্যের কাছে। চোখের কাছে স্পষ্ট হবে দেহের কিছু পুরোনো দাগ। বুকের কাছে, পিঠের কাছে দেখা মিলবে কিছু নৃশংসতার চিহ্ন। আজও সেই বুকের কাছে দাগ কেটে আছে। পিঠের উপর তেরছাভাবে চিহ্ন বসে গেছে। ক্লান্ত দেহটা যখন বিছানার নরম জমিনে ছেড়ে দেয়, চোখদুটো যখন আলস্যভাবে বন্ধ করে, ফ্যানের ঠান্ডা হাওয়ায় মনপ্রাণ শান্ত হতে থাকে, ঠিক তখনই কপালে নরম হাতের স্পর্শ পায়। পরম আবেশে সেই হাতজোড়া নরম কোলের মধ্যে ক্লান্ত মাথাটা তুলে নেয়। খুব যত্নের সাথে সারা মুখে শাড়ির আঁচল ছুঁয়ে ঘাম মুছে দেয়। বদ্ধ চোখদুটোতে মমতার সাথে চুমু খায়। আজও ঠোঁটদুটোকে নব্যপ্রেমের মতো আকুল ভরে ছুঁয়ে দেয়। মিহি গলায় সুমিষ্ট সুরে ছোট্ট প্রশ্ন করে,

– এভাবে কাজ করলে সুস্থ থাকবে?

কঠিন মূর্তির চেহারাটা একপলকে হাসি-হাসি হয়ে যায়। প্রশ্নের প্রেক্ষিতে জবাব না-ছুঁড়ে কোলটার মধ্যে মুখ ডুবিয়ে দেয়। দুটো শক্তি সামর্থ্য হাত দৃঢ়ভাবে শাড়ি পেঁচানো কোমরটা জড়িয়ে ধরে। প্রশ্নের আখ্যানকে নাকোচ করে তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,

– আমি সহজে অসুস্থ হই না পূর্ণ। এ কথা তুমি ভালো করে জানো। একবার শুধু জেদের বশে অসুখ আমদানী করেছিলাম। আপির বাথটাবে বরফের সাথে গোসল। উফ! সেদিনকার টাইটানিক ফিলটা আজও ভুলবো না।

এমন কথা শুনে পূর্ণতার রাগ হবার কথা। কিন্তু, রাগের বদলে অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। বরফের সাথে গোসল দিয়ে যেই উচ্চমানের জ্বর ডেকেছিলো সেটা অবশ্য ভুলার মতো না। দুটো মন, দুটো আত্মা আবারও একীভূত হয়েছিলো। মিলেছিলো দুটো বিচ্ছিন্ন সত্তা। মধ্যকার বিচ্ছেদকে জানিয়েছিলো চিরতরে ছুটি। দিনটার কথা চিন্তা করতেই শূন্য গলায় বললো,

– একসময় কতো পাগলামি করেছি। আজ সেগুলো ভাবলে লজ্জায় ম;রে যাই। আমাদের ছোট্ট সংসারটা শেষমেশ হলো পূর্ব। কতো সাধনার পর আমাদের জীবনটা সুন্দর হলো। আজও ভাবলে চোখদুটো ভিজে আসে। জীবনের সেই কষ্টকর দিনগুলো ভুলতে পারি না।

এক অদ্ভুত আক্ষেপ চোখ বুজলো পূর্ণতা। কোলের কাছে পূর্বের মাথাটা এখনো বুলিয়ে যাচ্ছে। নিত্যকর্মের মতো চুলের ডগায় আঙ্গুল ছুঁয়ে দিচ্ছে। উপভোগ্য হিসেবে আরাম পাচ্ছে পূর্ব। সে আরাম পাচ্ছে প্রিয়তমার ক্রোড়ে। তার ক্ষণেক্ষণে আঙ্গুল ছোঁয়ানো স্পর্শে শান্তি পাচ্ছে। মাথা থেকে হাতটা টেনে ঠোঁটের কাছে আনলো। ছোট-ছোট চুমু বসিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো,

– ভুলে যাও পূর্ণ। আবারও বলছি সব ভুলে যাও। এখন তো আমি আছি, আমার দুটো সন্তান আছে। তাদের দিকে তাকিয়ে ওইদিনগুলো ভুলে যাও। তুমি ওসব ভেবে এখনো কাঁদো। কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছো পূর্ণ? তোমাকে আমি বারবার বলেছি, ওসব ভেবো না। কিছু অতীত ডিলিট অপশনের মতো মুছে ফেলতে হয়। ওসব স্মৃতি ট্রাশ বিনেও রাখতে নেই।

পূর্ণতা মাথা নিচু করলো। পূর্বের দিকে গাঢ়দৃষ্টি রেখে বিষাদের সুরে বললো,

– তুমি আমার জন্য সব ছেড়ে দিলে। ওই পাষণ্ডদের কাছে ক্ষমা চেয়েছো এটা ভাবলেই আমার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠে। তোমার সৎ আদর্শটা ওরা চুরচুর করে দিলো। কোনো মূল্যই দিলো না। তুমিতো কারো ক্ষতি চাওনি। তবুও ওরা তোমাকে কতখানি গুড়িয়ে দিলো। যেদিন তুমি ভোটে জিতলে তোমার মুখে যেই হাসিটা ছিলো, যেই উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে তুমি বিজয়ীর ভাষণ দিলে, সেদিনকার পূর্বকে আমি কোনোদিন ভুলবো না। নিজের চোখের সামনে তোমাকে গড়তে দেখলাম, একদিন আমার সামনেই সব শেষ হয়ে গেলো। যদি সেদিন ওই লোকটা হেল্প না-করতো? তুমি কি কোনোদিন সন্তানের মুখ দেখতে?

পুরোনো কথা উঠলে মনটা গুমিয়ে যায়। শুকনো ক্ষতের উপর ঘাঁ লাগে। টনটন করে ব্যথা হয়। পূর্ণতার কথা শুনে চুপ হলো সে। কিছুক্ষণ নিরব থেকে পুনরায় শীতল কন্ঠে বললো,

– নিজের প্রতি সৎ ছিলাম তো, তাই আল্লাহ্ রহম করেছে। নাহলে যেই নিষ্ঠুরতার ভেতরে ঢুকেছিলাম, সেখান থেকে লাশ আসতো। বয়সে জানো আমার চেয়েও ছোট। কিন্তু মাথাটা খুব ম্যাচিউর। কি কি ভয়ংকর প্রোসেস এ্যাপ্লাই করেছে মাই গড! তোমাকে তো কিছুই বলিনি।

পূর্ণতা কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

– তোমার এই জ;ঘন্য স্বভাব আমার একদম পছন্দ না! পেটের ভেতর কথা লুকানোর ব;দঅভ্যাস কবে যে যাবে! তোমার এইসব বা;জে-বা;জে জিনিস আমার ছেলেটা পাচ্ছে। আমি কিন্তু এসব একদম সহ্য করবো না পূর্ব! সময় থাকতে প্রণয়কে বুঝাও। ওর দেখাদেখি যদি প্রার্থীও তামাশা করে, এরপর কিন্তু তিনজনকে খেলা দেখাবো।

পূর্ব ফিক করে হেসে ফেললো। খোঁটা দিয়ে বললো,

– ওহহো, পুটলি-বোঁচকা বেঁধে বাপের বাড়ি যাবে নাকি? যাও না। মানা করেছে কে? যাবে ভালো কথা। কিন্তু, পাদুটো এই বাড়িতে ফেলে যাবে। ভাঙা পায়ের সাথে হাডুডু খেলবো।

পূর্ণতা ভ্রুঁ কুঁচকে ক্ষোভের সাথে বললো,

– তোমার এইসব বেআ;ই;নী প্যাঁচাল বাদ দিবে?

কথা আগালো না আর। বেজে উঠলো ফোন। কলটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ব চুপ করে আছে। কেটে যাওয়ার শেষ মূহুর্তে কলটা রিসিভ করলো। ফোনটা কানে চেপে কর্তৃত্বের সাথে বললো,

– ওয়াসিফ পূর্ব বলছি, বলুন।

কলার ব্যক্তি আর কেউ না, সেটা পূর্বের লোক। প্রাইভেট নাম্বার থেকে কল দিয়েছে সে। গোপনীয় কথাটা জানাতে উদ্বেগের সাথে বললো,

– টি-ই-এক্স-টি।

এরপরই কলটা কেটে গেলো। টি-ই-এক্স-টি মানে টেক্সট। অর্থাৎ, ম্যাসেজ আসবে। পূর্ণতা ইচ্ছে করে প্রাইভেসির জন্য সরে গেলো; বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। পূর্ব এবার নিরিবিলি কাজ সারতে পারবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই কাঙ্ক্ষিত টিউন বাজলো। এবং, সেখানে ক্লিক করতেই টেক্সট শো করলো। ডান থেকে বামে চোখ ঘুরাচ্ছে পূর্ব। মনে-মনে পড়ছে সে। সেখানে অবশ্য লেখা,

জান বাঁচাতে প্ল্যান ক্যানসেল করুন। খুব বড় বিপদে পরতে যাচ্ছেন। মাহতিম আনসারীকে থামতে বলুন। তাকে বলুন পিছিয়ে যেতে। সে এখন আগ্রাসী আকার ধারণ করেছে। কাউকে পরোয়া করছে না। মাহদি আনসারীর কেস তদন্ত করতে যেয়ে উনি চুলচেরা তথ্য টেনে ফেলছে। দু-একজন মানুষের জন্য পা;র্টি;র নাম খা;রা;প হবে। দয়াকরে থামতে বলুন। আপনার সাথে যা হয়েছে, তা উনার সাথে হলে খুবই খারাপ কাজ হবে।

Mahdi Ansari’s case :

MP Rajani is su/sp/ected for the cr;i/m/e and his brother is involved . The professional ki/l!le/r is nearby at Sheraton Hotel, Banani, Dhaka.

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .