মন বাড়িয়ে ছুঁই ২ পর্ব-২২+২৩

0
546

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_২২ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

এটা খারাপ কিছু। এটা স্বাভাবিক না। ভয় লাগছে। কিন্তু কি করবে? মাহতিম নিশ্চয়ই শুনবে না, আঁটকাতে চাইলে থামবে না। কি করা যায়? চিঠিটা সাধারণ না। মাথা চাপড়াচ্ছে মেহনূর। প্রচণ্ড ভয়ে তটস্থ। কেন পাঠালো চিঠি? ইচ্ছে করছে কুটিকুটি করতে; কিন্তু পারছে না। অস্থির ভাবে পায়চারি করতেই থেমে গেলো সে। চোখের সামনে আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। চটজলদি ফোন তুলে কল বসালো মেহনূর। ফোনটা রিং হচ্ছে, কল যাচ্ছে, কিন্তু ধরছে না। বাজতে-বাজতে ফোনটা বন্ধ হলো, কেউ ধরলো না। মেহনূর পাগলের মতো আবার কল দিলো। ফোনটা এবার বাজতে-বাজতে রিসিভ হলো। হাঁপ ছাড়লো মেহনূর, বিচলিত গলায় বললো,

– কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আগে আমার কথা শুনুন। আমি টেনশনে আছি। আমি শান্তি পাচ্ছি না। গতকাল একটা চিঠি আসে। ওটা ভুলবশত পড়ে ফেলি। ওখানে স্পষ্ট করে অনেককিছু লিখা নেই। কিন্তু, ওটা বিপদজনক। ওখানে মালিবাগ যাওয়ার কথা আছে। তাও রাত এগারোটার দিকে। খুব জরুরী ভিত্তিতে সোমবার একা যেতে বলেছে। কিন্তু, আমার ভয় লাগছে ভাইয়া। আপনি দয়াকরে কিছু করুন। উনাকে একা যেতে দিবেন না। উনি যতবার এসব কাজে একা নেমেছে, উনি সুস্থ ভাবে ফিরেনি। হয় আহত হয়ে ফিরেছে, নয় দূর্বল ভাবে। আমি নিশ্চিত এবারও গণ্ডগোল হবে। যেটা সামান্য গণ্ডগোল বলে মনে হচ্ছে না। এবার উনি দলবল কিচ্ছু নিবেন না। উনার ঝাঁপিয়ে পরার স্বভাবটা ভয় জাগাচ্ছে। উনি যে সরাসরি এ্যাকশন নেন, যদি কিছু হয়? আপনি কিছু করুন, উনার যাওয়াটা আঁটকে দিন। আপনার বস্ আমার কথা শুনবে না। হাসিঠাট্টায় উড়িয়ে দিবেন। আমি নিরুপায় হয়ে কল দিয়েছি ভাইয়া। কিছু করুন।

একনাগাড়ে বলে ফেললো মেহনূর। হাঁপাচ্ছে খুব। নিশ্বাসে টান পরছে। কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। কথাগুলো চুপচাপ শুনলো নোমান। তার অবস্থা এখন শোচনীয়। ঠিক সামনে যে ব্যক্তি দম্ভ কায়দায় বসে আছে, তাকে নিয়েই কথাগুলো বলছে। নোমান ঠেলেঠুলে একটা হাসি দিয়ে বসের উদ্দেশ্যে বললো,

– স্যার, একটু যাই? মানে কথা বলছিলাম তো —

নোটপ্যাডে কলম থামালো মাহতিম। চোখ তুললো সে। নোমানের অবস্থা আপাদমস্তক দেখে সন্দিগ্ধ চোখে চাইলো। কপালের মধ্যখানে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে খটকা গলায় বললো,

– এ্যানি সিরিয়াস কেস? মুখ ফ্যাকাশে লাগছে কেন?

সাংঘাতিক! বস্ ধরে ফেললো নাকি? বসের চতুরতা নিয়ে সন্দেহ নেই; কিন্তু, তাই বলে এতো সতর্ক? নোমান দ্রুত নিজেকে আড়াল করলো। অপ্রস্তুত অবস্থাকে শান্ত করলো। হাসি দিয়ে বললো,

– নো, স্যার। নো ইস্যুস।

টালমাটাল বাহানা দিয়ে কেটে পরলো সে। কেবিন থেকে বেরুতেই সাইডে চাপলো নোমান। পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার করে শুনলো। তাকে কিছু জানানো হয়নি। গুরুতর চিঠি সম্পর্কে কিছুই বলেনি। বস্ সব লুকোচ্ছে। প্রত্যেকটা কথা শোনার পর তার অবস্থা কাহিল। এবারের প্রতিপক্ষ কোনো ফেরারী আসামী নয়। প্রতিপক্ষ দল প্রচুর চতুর, ক্ষমতাবান। তাদের বিরুদ্ধে যাওয়া মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু! বস্ কেন এসব করছে? মাহদির কেস নিয়ে অতোদূর কেন যাচ্ছে? নাকি ষড়যন্ত্রের ফলা অন্য রাস্তায় ঢুকেছে? এবার তো মনেহচ্ছে, কঠিন কিছু! সব যেন একটা-আরেকটার সাথে যুক্ত। তাহলে কি ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা এই কেসে যুক্ত?

.

মেহনূর লজ্জায় চোখ বুজে আছে। এই মূহুর্তে তাকাতে পারছে না। কি এক যন্ত্রণা! তাকাতে গেলে ভয়-ভয় লাগে; আবার না-তাকিয়েও হচ্ছে না। মেহনূর ঢোক গিলে বললো,

– না করলে হয়না? ভয় লাগছে। আমি পারবো না। যদি কেটে যায়?

মাহতিম মুখ শক্ত করলো। অনুচিত সুরে বললো,

– কাটলে কাটুক। হাত চালাও।

মেহনূর ঢোক গিলে তাকালো। হাত কাঁপছে। খুব কাঁপছে। তবুও, হাতটা গালের উপর রাখলো। আসল কথাটা কখন বলবে? মেহনূর অনুনয় করে বললো,

– কাটলে কি করবো? আমিতো আপনার মতো পটু না।

মাহতিম গাল বাড়ালো। কোনো কথা শুনলো না। গালে শেভিং ফোম মাখা। বিছানায় বসেছে সে। সামনে মেহনূর দাঁড়িয়ে। রেজারটা চালাতে বলে ছোট্ট সুরে বললো,

– কাটলে চুমু দিও।

সমস্ত গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো ওর। মেহনূর লজ্জায় চোখ সরালো। নিচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ালো সে। তা দেখে মাহতিম হাসি আঁটকে রেখেছে। মেহনূর আবার সাহস জুগিয়ে চোখ তুললো। হাতের রেজারটা শক্ত করে ধরলো। মাহতিমের প্রখর দৃষ্টি এড়িয়ে রেজারটা গালে বসায় সে। সাবধানে কাঁপতে থাকা হাতটা চালাতে থাকে। কোথাও যেন না-কাটুক, এমন চিন্তায় ডুবে আছে। মাহতিম একদৃষ্টিতে স্বচ্ছ ঠোঁটে হাসছে। মায়ার সাথে নির্মল ক্ষণটা উপভোগ করছে খুব। এভাবে দেখতে পারার আকাঙ্ক্ষায় যদি গাল কাটে; কেটে যাক, আফসোস নেই। তার হাতদুটো ধীরে-ধীরে ওর কোমর জড়িয়ে ধরলো। মেহনূর একটু কাঁপলো যেনো; তবুও শক্ত হয়ে রইলো। এখন ভোর‍ের সময়। ঘড়িতে পাঁচটা বিশ। এখনো অরুণ গোলাটা উঠেনি। জানালা দিয়ে ভোরের টাটকা হাওয়া ঢুকছে। রন্ধ্রে-রন্ধ্রে শীত লাগানো হাওয়া, আহা! গোটা শহরটা কি নীরব! একটুখানি শোরগোল নেই। এমন নীরব-নিস্তেজ প্রকৃতির কাছে দুটো জাগ্রত প্রাণ নিজ-নিজ কর্মে যুক্ত। মেহনূর স্বচ্ছভাবে শেভিং শেষ করলো। গালের অবশিষ্ট ফোমগুলো মুছতে-মুছতে বললো,

– একটা কথা ছিলো। আবদার হিসেবে বলবো?

মাহতিম তখনও স্থির নেত্রে তাকিয়ে ছিলো। তার দুচোখে নেশা-নেশা ঘোর। সে আবেগী কিছু আবদারের জন্য উন্মুখ ছিলো। ভেবেছিলো, মেহনূর তাকে আর্দ্র কিছু বলবে। সে নরম সুরে বললো,

– বলো দেখি।

মেহনূর মলিন চোখে চাইলো। সদ্য শেভ করা গালটা টেনে ছোট্ট চুমু খেলো। মাথাটা দুহাতে বুকে জড়িয়ে নিলো। উন্মুক্ত পিঠটায় হাত ছুঁয়ে অনুরোধের সাথে বললো,

– না গেলে হয়না? মালিবাগ নামটা স্বস্তি দিচ্ছে না। আজ তো বুধবার। এখনো চারদিন সময় আছে। আপনার সহকারীকে ছুটি দিয়ে দিন। নোমানকে বলে দিন মালিবাগ যেতে। উনি আপনার বিশ্বস্ত লোক; উনি সুন্দরভাবে কাজটা করে দিবেন।

এমন অদ্ভুত বায়না শুনে সমস্ত আবেগ যেন চুরচুর করে ভাঙ্গলো। কোমল বাহুবাশ থেকে ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়ালো মাহতিম। থমথমে মুখে ওর দিকে তাকালো। ক’মিনিট শুধু তাকিয়েই রইলো। আবদার ও আজ্ঞার মাঝে ঝুলে আছে সে। কি বললো মেহনূর? কি চাইলো সে? কন্ঠে তেজ মিশিয়ে ক্ষিপ্ত সুরে বললো,

– মাথা ঠিক আছে? আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছো? কোথায় তুমি ঘুরতে যাওয়ার কথা বলবে, সেটা না; তুমি ছুটির কথা তুলছো! এমন আবদার আশা করিনি মেহনূর। সাতসকালে এই জাতীয় কথাবার্তা একদম পছন্দ করি না। তুমি, তুমি দেখি…

দাঁত খিঁচালো মাহতিম। রাগে কথা বলতে পারছে না। রাগটা কন্ট্রোল করতে হবে। ধপ থেকে বিছানা থেকে উঠলো। ওয়াশরুমের দিকে যেতে-যেতে হঠাৎ পা থামিয়ে বললো,

– আমার ইউনিফর্ম রেডি করো; গোসলে যাচ্ছি।পনেরো মিনিটের মধ্যে নাস্তা তৈরি করবে। এই টপিক যেন এখানেই শেষ হয়। এটা নিয়ে কেচ্ছা বানাতে যেও না। একটা সুন্দর সকাল শুরু করতে চেয়েছিলাম, সেটা নষ্ট করে দিলে।

মেহনূর নির‍্যুত্তর মুখে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে নিজের হাতদুটির দিকে। যে হাত দিয়ে হৃদয়মৃণালের একমাত্র মানুষটিকে শক্ত করে ধরেছিলো, সে যেন ভুল বুঝেছে। আঙ্গুল গুটিয়ে হাতটা মুঠো করলো সে। ওয়াশরুমের বন্ধ দরজার দিকে নীরব চোখে তাকালো। বুকের গভীরতম শ্বাসটা ছাড়তে-ছাড়তে চোখ বুজলো মেহনূর। এখনো সময় আছে। এখনো চারদিন বাকি। বৃহস্পতি-শুক্র-শনি-রবি।

.

মেহনূর পরাস্ত হয়ে মারজার কাছে গেলো। খুলে বললো ঘটনা। সবটা শোনার পর চুপ হয়েছে মারজা। একদিকে ছেলের জেদ, অন্যদিকে বউয়ের চিন্তা। দুটোই ঠিক, আবার দুটোই ঠিক না। কাকে রেখে কাকে বলবে বুঝতে পারছেন না। মারজা কিছুক্ষণ নীরব থেকে আপনমনে ভাবলেন। যোগ্য সুরে বললেন,

– তোকে কোনোদিন ছেলেবউয়ের মতো দেখিনি। নিজের সন্তানের মতো দেখেছি। মেয়ের মা হয়ে একটাই কথা বলবো, তুই কি ওর ইচ্ছাতে নিজের সুখ বিসর্জন দিবি? আমি এতোদিন জানতাম, তোরা স্বামী-স্ত্রীর মতো চলছিস। দেখেও তোদের বুঝতে পারিনি। একত্রে আছিস, একত্রে চলছিস, তাও তোদের মধ্যে ফারাক? মানলাম তোদের আত্মিক সম্পর্ক হয়ে গেছে। কিন্তু, অন্যান্য সম্পর্ক নিয়ে ঢিলেমি? তোরা কি বিয়েটাকে ফাজলামি পেয়েছিস? তুই কি জানিস না, সব সম্পর্ক একটা-আরেকটার সাথে জড়িয়ে আছে? এ কেমন চিন্তাধারায় চলছিস তোরা? ও তোকে দূরে রাখলো, তুইও হেসে-খেলে দূরে থাকলি? তোদের উপর যথেষ্ট রাগ হচ্ছে মেহনূর। যেই কারণে মাহতিমের সমস্ত কথা আমি শুনলাম, ও দেখি একটাও শোনেনি। আমি বারোটা মাস অসুস্থ থাকি বলে তোরা ধোঁকা দিবি? এই চটক দেখাবি? আমি কিন্তু সহ্য করবো না! ওকে ফোন দে। এক্ষুনি ফোন দিবি। না ধরলে দিতেই থাকবি। নে, ফোন ধর্।

মারজার বাড়িয়ে দেওয়া ফোনে কল দিলো মেহনূর। দুটো কলিং টিউন যেতেই রিসিভ করলো সে। ব্যস্ত গলায় বললো,

– হ্যাঁ মা। শর্টকাটে বলো,

মারজা জুত করে বসলেন। গলাটা চড়া করে ক্রোধের সাথে বললেন,

– আমার সাথে নাটক করিস? কল কাটবি না! যা জিজ্ঞেস করছি ঠিকঠাক মতো উত্তর দিবি।

বিষম খেলো মাহতিম। ওপাশ থেকে নীরব হলো সে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আন্দাজের সুরে বলে,

– বাহ্, চমৎকার! চালাকির লেভেল এই পযর্ন্ত এসে গেছে? মাহদির ভাবীকে বলে দিও ওর কথা…

ক্ষেপে উঠলেন মারজা। প্রচণ্ড ধমকে উঠলেন তিনি,

– চুপ ! ‘ মাহদির ভাবী, মাহদির ভাবী ‘ করবি না। ও তোকে নাচায়, না তুই ওকে নাচাস? তোর কানটা ছিঁড়ে ফেলবো মাহতিম! আমার সাথে ওস্তাদিপনা বন্ধ করবি। তোর বাপ যা করেছে তা করে গেছে। এখন যদি আমার সাথে বাটপারি করিস, আজন্মের মতো শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো।

মাহতিম ক্ষণিকের জন্য চুপ হলো। পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরে জব্দ গলায় বললো,

– তুমি আমার উপর ক্ষেপে আছো কেন? ওর হিসাব তো বুঝলাম। বেচারি অতিরিক্ত চিন্তার ঠ্যালায় লাউ-কদু বলছে। কিন্তু, তুমি আমার উপর হাউকাউ করছো কেন?

মারজা নাক ফুলিয়ে দম ছাড়লেন। ক্রোধটা ঠান্ডা করে প্রস্তুত গলায় বললেন,

– চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো। এতো বড় হয়েছিস এখনো বুঝতে পারিস না? কি নিয়ে ক্ষেপতে পারি জানিস না? আমি মরলে পরে সন্তান নিবি?

হাঁফ ছাড়লো মাহতিম। কপালে ঠাস করে ডানহাত রাখলো। হায়রে মহিলা মানুষ রে! জিন্দিগী একেবারে তামা-তামা হয়ে শেষ। এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে বাপ পযর্ন্ত কথা তুললো। মাহতিম ডেস্কের নোটপ্যাডটা বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিলো। চোখদুটো বন্ধ করে ক্লান্ত গলায় বললো,

– তুমি আছো সুখের চিন্তায়, আমি আছি কাজের ঠ্যালায়। মেহনূর পাশে আছে? থাকলে সাইডে পাঠাও।

মারজা ছেলের কথা শুনে বউয়ের দিকে তাকালেন। যদিও চায়ের তেষ্টা নেই; তবুও ফরমাশ করলেন তিনি। মেহনূর বাধ্য বউয়ের মতো বিদায় হলে কলটা লাউডে রাখলেন। আরাম করে বললেন,

– হ্যাঁ, গেছে।

চেয়ারে দোল খাচ্ছে মাহতিম। গোল-গোল পাক খেতেই প্রসন্ন সুরে বললো,

– আমার ইচ্ছা তোমাকে ডজনখানেক নাতি-নাতনী দিবো। কিন্তু, সবকিছুরই সময় আছে মা। তুমিও যদি আট-দশটা মায়ের মতো কথা বলো, তাহলে কিভাবে হবে বলো? ওকে এসবের জন্য বকাবকি কোরো না। ওর তো দোষ নেই। আমি নিজেই থেকেই পিছিয়ে আছি। আমি একটা কেসে খুবই ব্যস্ত মা। সামনে ওরও ফাইনাল এক্সাম। আমি কোনো চাপের মধ্যে থেকে প্ল্যানিং করতে চাচ্ছিলাম না। তাছাড়া ওর যদি ইচ্ছে থাকতো, এতদিনে মুখ ফুটে বলতো। ও আমাকে বলেনি। হয়তো মেন্টালি প্রস্তুত না। সবটা গোছাতে টাইম নিচ্ছে। মাত্রই তো কোয়ার্টারে এনে উঠালাম। ওকে একটু খাপ খাওয়ানোর সুযোগ দিচ্ছি। স্বামী হিসেবে এইটুকু কর্তব্য যদি পালন না-করি, তাহলে কি বাইরের মানুষ এসে পালন করবে? ভবিষ্যতে যদি আমার একটা মেয়ে হয়, তাহলে ওর ভাগ্যে আমার কুকর্ম জুটবে না?

ছেলের কথা শুনে শান্ত হলেন মারজা। কিছুটা কোমল হয়ে বললেন,

– বাবা রে, তুই যে দেরি করছিস এটা কি আশেপাশের মানুষ বুঝবে? তারা তো নাক গলাবে, হাসি-ঠাট্টা করবে, বউকে নিয়ে নানান কথাও শোনাবে। আমিতো বাবা আজ আছি, কাল নেই। মেয়েটার জন্য খারাপ লাগে। ওর তো দেখভালের জন্য কেউ নেই। সারাটা দিন তোর কোয়ার্টারে পরে থাকে। এমন জায়গায় রেখেছিস ওর কেউ নেই। ওর দিকটা তো ভাবতে হবে। এমনেই মানুষ তোর বিয়ে নিয়ে কত কথা বলছে। ওগুলো মানা যায় বল্?

স্মিত হাসলো মাহতিম। প্রত্যুত্তরে যুক্তি ছুঁড়ে বললো,

– প্র‍্যাক্টিক্যালি ভাবতে হয় মা। ধরো, মেহনূরের সাথে চুটিয়ে চার বছর প্রেম করলাম। কোনো বিয়ে-ফিয়ে করলাম না। তখন সমাজ আমার চরিত্র নিয়ে যেই সার্টিফিকেট দিতো, আজও বিয়ে করার পর একই সার্টিফিকেট দিচ্ছে। তখন সোজাসুজি মুখের উপর ‘ লুইচ্চা ‘ বলতো, আজ ইনিয়ে-বিনিয়ে বয়সের খুঁত ধরছে। এটা হাস্যকর মা। সমাজের ছুঁচোলো কথায় যদি বেঁকে বসি, আমার বিপদের বেলায় কেউ হেল্প করতে যাবে না। সবাই গা বাঁচাতে পটু। আমার বউ, আমার সংসার; ইনকামটাও আমিই করি। ওকে পেলে-পোষে বুড়ি করবো, না জননী বানাবো সেটাও আমার চিন্তা। তুমি মানুষের কথা বাদ দাও তো। কটা দিন শান্তিমতো কাটাও। আমি বিকেলের দিকে ফিরছি। বাসায় এসে বাকি কথা বলবো।

মারজা আর তর্কে গেলেন না। কথাগুলো কোনো অংশে ভুল না। বিয়ে ছাড়া প্রেম করলে বিপদ। আবার, বিয়ের পর প্রেম করলে সমস্যা। ছেলের মোক্ষম কিছু যুক্তির কাছে মান্য হলেন মারজা। নতশীর হয়ে ফোনটা কেটে দিলেন তিনি। দরজার ওপাশ থেকে সবটা শুনে ফেললো কেউ। তার হাতে ছোট্ট একটা ট্রে; তাতে ধোঁয়া উঠা এক কাপ চা।

.

বহুদিন পর বই নিয়েছে মেহনূর। বুকের তলায় বালিশ রেখে উপুড় হয়ে পড়ছে। মাথার উপর ত্রি-ফলা ফ্যানটা ফুলস্পিডে ঘুরছে। বেসামাল হাওয়ায় চুলগুলো মৃদ্যু-মন্দ উড়ছে। সেই পুরোনো দিনের মতো অনুভূতি হচ্ছে। সেই গোয়ালঘর, সেই গ্রামের গন্ধ, সেই ছোট-ছোট স্মৃতি! ওগুলো মনে পড়লে শিরশিরে হাওয়া লাগে। মেহনূর যেন সবই অনুভব করছে। এখনো আসেনি মাহতিম। আজ বড্ড দেরি করছে। সুলেখক নিমাই ভট্টাচার্যের চমৎকার একটি উপন্যাস। ‘ মেমসাহেব ‘ বইটা পড়তে-পড়তে ডুবে গেলো সে। এক অদ্ভুত রোমান্ঞ্চে বশীভূত হলো। দেখতে-দেখতে সময়ের কাটা বহুক্ষণ পেরুলো। বইটা যখন মধ্যভাগে এসেছে, ঠিক তখনই মেহনূর চমকে গেলো। দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়িতে চাইলো। কি সর্বনাশ! ইয়া আল্লাহ্! ঘড়িতে দশটা বাজে কেন? মেহনূর ধপ করে শোয়া করে উঠলো। চটপট দুহাতে খোপা পাকিয়ে বিছানা থেকে নামলো। উদ্দেশ্য এখন ফোন করবে। কিন্তু ফোন কোথায়? ফোনের জন্য এদিক-ওদিক তাকাতেই হঠাৎ বাতি নিভে গেলো। কি ব্যাপার? বাতি নিভলো কেন? এখন তো লোডশেডিং হয় না। ঢোক গিললো মেহনূর। কেমন যেন লাগছে। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। মেহনূর দেয়াল হাতড়ে-হাতড়ে রুম থেকে বের হলো। অন্ধকারটা চোখ সয়ে গেছে। এক-পা এক-পা করে এগুতেই হঠাৎ গা শিউরে উঠলো! থেমে গেলো মেহনূর। একটা সুক্ষ্ম শব্দ পেছন থেকে আসছে। শব্দটা খুব মিহি। ওর দিকেই আসছে। মেহনূর যেন ঠান্ডা হয়ে গেলো। কোয়ার্টারে কেউ ঢুকেছে? এতো সিকিউরিটি সত্ত্বেও কেউ প্রবেশ করেছে? মেহনূর সাহস সন্ঞ্চার করে একটু-একটু করে পিছু ঘুরতে নিলো। পেছনের দিকেই ঘুরতেই প্রচণ্ড ধাক্কা খেলো সে! আর্তনাদে গোঙানি দিতেই মুখ চাপলো কেউ। মেহনূর অস্থিরভাবে নড়াচড়া করতেই শূন্যে তুলে ফেললো। মেহনূর শব্দ করতে পারছে না! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, শব্দ হচ্ছে না।
প্রচণ্ড ভয়ে হাত-পা ছেড়ে দিলো মেহনূর। এক ভয়াবহ ত্রাসের কাছে নত হয়ে সংজ্ঞা হারালো সে।

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_২৩ . ( টুকরো ০১)
#ফাবিয়াহ্_মমো .

চিৎ/কা/র করার সুযোগ পেলো না! মেহনূর বে/হুঁশ হয়ে গেলো। সমস্ত শরীরের ভার একনিমেষে ছেড়ে দিলো। নিসাড় দেহটা লুটিয়ে পরতে নিলে একজোড়া পুষ্ট বাহু তার দিকে অগ্রসর হলো। আহত-ব্যথিত ছোট্ট প্রাণীর মতো পাঁজকোলে আবদ্ধ করলো। ছোট্ট প্রাণীর দেহটা যেমন খুব নরম হয়ে কুঁকড়ে যায়, তেমনি মেহনূরের ছোট্ট দেহটা গুটিশুটি পাকিয়ে ক্ষুদ্র হয়ে গেলো। পাঁজকোলে নিয়ে তিমির রাত্রিরে বাইরে বেরুলো সে। আকাশে কোনো তারা নেই। আশেপাশে মানুষ নেই। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই অন্ধকার। বড্ড শোঁ শোঁ করে আসন্ন বৃষ্টির হাওয়া বইছে। গাছের ডালপালা আছড়া-আছড়ি করে প্রচণ্ড শব্দ করছে। এমনই একটি ছমছমে জায়গায় হেঁটে-হেঁটে আসলো সে। হাতদুটো নিচু করে ঘাসের উপর শুইয়ে দিলো। ডানহাতের মুঠোয় সামান্য পানি নিয়ে হুঁশহীন মুখে ছিটিয়ে দিলো। বৃষ্টির মতো ছিঁটেফোঁটা পেয়ে চোখ কুঁচকালো মেহনূর। শরীরের অঙ্গপ্রতঙ্গ সামান্য নড়াচড়া করে খুবই ধীরে-ধীরে চোখ খুললো। চোখ কয়েকবার ঝাপটা দিতেই যা দেখতে পেলো, তাতে থমকে গেলো মেহনূর। সামনে যে বসে আছে, তার মুখের অবস্থা করুণ। অজানা শঙ্কায় বুকের হৃদপিন্ড ছুটছে। পলকহীন দৃষ্টিতে ঘন-ঘন নিশ্বাস নিতেই প্রশ্ন করলো মেহনূর,

– আপনি..আপনি একটু আগে কি করলেন?

ক্ষি/প্র ভঙ্গিতে হাতের বোতলটা ছুঁড়ে মা/র/লো মাহতিম! হিং/স্র ভঙ্গিতে মেহনূরের দিকে একধাপ এগুলো। তৎক্ষণাৎ ঘাসের উপর মোবাইলের ফ্লাশ জ্বা/লালো সে। চোয়াল শ/ক্ত করে হু/ঙ্কার মেজাজে বললো,

– মায়ের কাছে বিচার দিয়েছো কি জন্যে? কি প্রয়োজন ছিলো? এই ধরনের ছেলেমানুষি কাজ করতে ল/জ্জা করে না? তুমি কোন সা/হসে নোমানের কাছে ওসব কথা বলেছো? মোল্লাবাড়িতে সব বোঝানোর পরও তোমার ঘি/লুতে কথা ঢুকেনি? বে/কু/বের মতো করলে কেন? জবাব দাও মেহনূর, জবাব দাও! চুপ করে থেকে আমার রা/গ তুলো না!

চরম ধ/মকা/নি খেয়ে শিউরে উঠলো মেহনূর। ভয়াবহ ক্রোধের কাছে মিইয়ে গেলো সে। বুকটা হাতুড়ির মতো ধ্বক-ধ্বক করছে। দুটো ক্রু/দ্ধ চোখের দিকে থরথর করে দাঁত কাঁপাচ্ছে। ভয় যুক্ত চোখে কিছু বলার জন্য ঠোঁট কাঁপালো মেহনূর; কিন্তু আমতা-আমতা করে কিছুই বলতে পারলো না। মাহতিম তখন চূড়ান্তরূপে নিজেকে দমানোর চেষ্টায় আছে। রাগের তীব্র উচ্ছ্বাসে তার প্রশস্ত বুকটা ফুলে-ফুলে উঠছে। নিচের ঠোঁটটা দাঁতের দংশনে কা/মড়ে রেখেছে ও। হাতের মুঠোয় কচি-কচি ঘাসগুলো নি/ষ্ঠুরভাবে ছিঁড়লো। উপর থেকে সব দেখতে পাচ্ছে সিয়াম। সে গার্লফ্রেন্ডের সাথে লুতুপুতু ফোনালাপ সারতে জানালার ধারে এসেছে। হঠাৎ নিচের দিকে চাইতেই যে দৃশ্যটা দেখতে পেলো, তাতে ওর চোখদুটো আতঙ্কে নিবদ্ধ।

– সিয়াম? কথা বলছো না কেন?

সিয়াম কথাগুলো শুনলোই না। একদম বেখেয়ালি সুরে জবাব দিলো,

– গান গাবো? না বাবু। আজ কোনো গান হবে না।

মেয়েটা ভিড়মি খাওয়ার মতো হকচকিয়ে গেলো। কি বলছে? কিসের গান? গানের কথা তো বলেনি। আহাম্মকের মতো কিছু বলবে, সেই সুযোগটাও দিলো না। সিয়াম কল তো কাটলোই, উলটো ফোনটাই বন্ধ করে দিলো। তাড়াতাড়ি তৌফকে হুলস্থুল কায়দায় ডাকতে শুরু করলো,

– বন্ধু? ও বন্ধু? ওই বা/ন্দি:র পো/লা হুনোস না? তাড়াতাড়ি এদিকে আয়! দেইখা যা কি হইতাছে।

বিনা কারণে গা/লি খেয়ে ভ্রুঁ কুঁচকালো তৌফ। সে গভীর মনোযোগে গেম খেলছিলো, কিন্তু সিয়ামের ওমন উৎসুক চাহনি দেখে চটপট ছুটে গেলো। কাধে হাত দিয়ে ‘ ডাকলি কেন? কি হইছে — ‘ বলতে নিবে, ওমনেই তার চোখদুটো সিয়ামের মতো দৃষ্টিবদ্ধ হলো। বিষ্ময়ে হতবাক হলো তৌফ! মুখটা কাতলা মাছের মতো হা করে চিন্তিত সুরে বললো,

– নিচে হইতাছে কি মামু? ওরা কি ঝ/গড়া করতাছে? পরিস্থিতি তো সুবিধার লাগে না! মাহতিম ওমনে খিঁ/চ্চা আছে কেন? নিচে যাবি?

সিয়াম সাথে-সাথে বাঁধা দিয়ে থামালো। নিচু সুরে বললো,

– ধুর ব্যাটা! নিচে গিয়া কি করবি? মিয়া-বিবির মধ্যে ঢুকবি? উলটা মাহতিম তো/রে মোরব্বার মতো ক্যাচা-ক্যাচা কইরা দি/বো। আমার মন কইতাছে, ভাবী মনেহয় কিছু করছে।

তৌফ আরেকটু মনোযোগ দিয়ে তাকালো। মেহনূরের হতবিহ্বল মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলো। মনে-মনে একটা অনুমান করে বললো,

– তোর মন তো কতকিছুই কয়। টয়লেটে গেলে রিয়া, খাইতে গেলে বিয়া, শুইতে গেলে খালি বাবু-বাবু করোস। তোর এই ন/ষ্ট মনরে আমি পা দিয়া ল/;ত্থি মা;রি। আউলফাউল লজিক না মা/ই;রা খা/ম্বার মতো তাকায়া থাক।

তৌফের কাছে একপ্রস্থ ক/টু:ক্তি শুনে ক্ষে/পে গেলো সিয়াম। তৌফের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কপাল কুঁচকে বললো,

– তোর এতো চু;ল/কা;নি ক্যান? কথায়-কথায় রিয়ার টপিক না-উঠাইলে চলে না? ছ্যাঁ:চ/ড়ার মতো কথা শুনাস কোন দুঃখে?

বাইরে থেকে চোখ সরালো তৌফ। সিয়ামের দিকে একপলক তাকাতেই দুম করে এক কিল বসালো। সিয়াম পিঠের ব্যথায় ‘ উঃ রে ‘ বলে চোখ খিঁচালে তৌফ তখন মুখ ভেংচিয়ে বললো,

– আমার চুলকানিও নাই, চু/স্কামিও নাই। তোর মতোন বুইড়া বাবু পালি না। ফারিনরে যদি বাবু ডাকি, ওয় আমার কা/ন এক টানে ছিঁ;ই/:ড়া লুভ্যর মিউজিয়ামে চালান দিবো। এখন এই মোমেন্টে আর ছ্যা;ব;লা/মি না-কইরা সিচুয়েশনটা বুঝতে দে।

তৌফের এক ঘা/য়ে জব্দ হলো সিয়াম। দুজনই উপর থেকে বাকিটুকু দেখতে লাগলো। যদি পরিস্থিতি বিপর্যয়ের দিকে যায়, তাহলে ওরা নামবে, নইলে নামবে না। মেহনূর দুহাতের তালুতে ভর দিয়ে উঠে বসলো। চোখ নিচু করে কাতর সুরে বললো,

– মা বাধ্য করেছে তাই বলেছি। আমি কারো নামে অভিযোগ করিনি। সকালে চুলার ধারে অন্যমনষ্ক হয়ে কেন হা/ত পুড়লাম, ওটা দেখতে গিয়ে মা কসম দিয়েছে। এখন সে যদি কসম কেটে জানতে চায় আমি কি মিথ্যা বলবো?

মেহনূর নিচু মুখেই বাঁহাতটা বাড়িয়ে দিলো। হাতের মুঠো খুলতেই মাহতিম দেখলো, তেলোর ফর্সা চামড়াটা কালচে হয়ে আছে। আগুনের ছ্যাঁকায় জায়গাটা কিন্ঞ্চিত দগ্ধ। হাত থেকে চোখ সরিয়ে নতমুখটার দিকে তাকালো। কোলের উপর টপটপ করে অশ্রুফোঁটা ঝরছে। দৃশ্যটা দেখে মাহতিম দাঁড়ালো না। সশব্দে নিশ্বাস ছেড়ে মোবাইলটা নিয়ে চলে গেলো। অন্ধকারে শীতল হাওয়ার মাঝে পরে রইলো মেহনূর। সেই পুড়ে যাওয়া হাতটা পুনরায় মুঠোয় চেপে নিঃশব্দে অশ্রু ফেললো। প্রকৃতির বাতাস বারবার চোখের পানি শুষ্ক করতে চাইলো, কিন্তু হায়! নীরব অশ্রু বড় সাংঘাতিক। মেহনূর কোলের দিকে মুখ রেখে ডুকরে কেঁদে দিলো।

উপর থেকে সবই দেখলো ওরা। তৌফের মনটা খুব খারাপ হলো। মনে-মনে মাহতিমকে প্রচুর গা:লা:গা:ল করলো। কেন যে ওদের মধ্যে সমস্যাটা হলো, সেটাই ওরা জানে না। সিয়াম হাপিত্যেশ করে বুক ভারী নিশ্বাস ছাড়লো। তৌফের কাধে হাত রেখে আস্তে করে বললো, ‘ চল বন্ধু, ঘুমায় পর ‘ ।
.

অন্ধকারে পা টিপে-টিপে ফিরে আসলো মেহনূর। রুমের কাছাকাছি আসতেই চোখদুটো আরেকবার আঁচলে ঘষে নিলো। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বিছানায় চোখ পরলো; দেখলো, মানুষটা ড্রিমলাইটের আলোয় শুয়ে পরেছে। আজ তার জন্য অপেক্ষা না-করেই ঘুমাতে এসেছে। দরজাটা লক করে বিছানায় আসলো মেহনূর। খাটের বাঁদিকটা খালি রেখে ওপাশ ফিরে শুয়েছে। যতটুকু বল নিয়ে রুমে ফিরলো, তার চেয়ে শতগুণ যন্ত্রণা এইটুকু দৃশ্য দেখে হচ্ছে। কোয়ার্টারে এখন পযর্ন্ত আলাদা ঘুমায়নি, মাহতিম সজ্ঞানে কখনো পিঠ দিয়ে শোয়নি; অথচ, আজ সামান্য কারণে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মেহনূর বালিশ ঠিক করতে-করতেই হঠাৎ হাতে কি যেনো স্পর্শ করলো। একটু বিষ্মিত হয়ে জিনিসটা মুঠোয় টেনে আনলো। ডানহাতের উপর মোবাইলের আলো ফেলতেই অবাক হলো সে! সাদা কাগজে ছোট্ট একটা চিরকুট। সেখানে টানা-টানা অক্ষরে নীল কালিতে লিখা,

‘ কাল আমার সাথে ঘুরতে যাবে? ‘

বারবার, বহুবার, অসংখ্যবার চিরকুটটা পড়লো মেহনূর। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়তেই থাকলো। খুশিতে-আমোদে-প্রফুল্ল হয়ে ওই অবস্থায় কেঁদে দিলো সে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ফিসফিসিয়ে উঠছে। ভেজা চোখে ওই মানুষটার দিকে চাইলো মেহনূর। এমুখো পিঠ দেওয়া ওই নিষ্ঠুরটাকে পেছন থেকে জাপটে ধরলো। পিঠের কাছে নিজের মাথাটা উন্মাদের মতো লুকিয়ে নিলো। তার বুকের উপর রাখলো নিজের বাঁ-হাত। মাহতিম দগ্ধ হাতটা তুলে ঠোঁটে এনে রাখলো। ঘুম-ঘুম চোখে তেলোর ক্ষতে আদর করতে লাগলো। যতক্ষণ পযর্ন্ত দু’চোখের পাতা কঠিন ঘুমে তলিয়ে না-গেলো, ততক্ষণ সে ছুঁয়ে দিলো, ছুঁয়ে দিলো, ছুঁয়েই দিলো।

.

খুব সকালে উঠলো মেহনূর। নাস্তা বানিয়ে সবকিছু রেডি করে ফেললো। একে-একে সবাই ঘুম থেকে উঠে নাস্তা পর্ব সারলো। তখনই সবাই জানতে পারলো, মাহতিম আজ বেরুবে। সঙ্গে একটু অফিশিয়াল কাজ এবং দুটো দিন বেশি ছুটি পাচ্ছে। এই সুযোগে মেহনূরকে নিয়ে একটু পরেই বের হবে। কথাটা শুনে মিটিমিটি হাসছে তৌফ। সিয়ামের দিকে ভ্রুঁ নাচিয়ে ওর কানের কাছে বললো,

– ফিলিং জুশ মামু। কাহিনি কিছু বুঝছো?

সিয়াম তৌফের সাথে তাল মিলিয়ে ফিসফিস করে বললো,

– হ, মামু। কালকের আশিকি টু দেইখাই বুঝছি।

দুজনের ফিসফিসানি কারবারটা দেখতে পেলো ফারিন। সে সবেমাত্র ডালের বাটিতে রুটি ঘুরাচ্ছিলো, ঠিক তখনই ওদের চুপিচুপি আলাপ দেখে ডানপাশে কনুই গুঁতা মারলো। হঠাৎ মুখে রুটি পুড়তে গিয়ে বিষম খেলো সৌভিক। কনুইয়ের গুঁতা খেয়ে বিরক্ত চোখে তাকালে ফারিন চক্ষু ইশারা করলো। ফারিনের ইশারা ধরে সামনে তাকাতেই দুই বদমাশের ফুসুর-ফুসুর দেখতে পেলো সে। সৌভিক কিছু না-বলে ফারিনের দিকে বোতলের ক্যাপ এগিয়ে দিলো। ফারিন গোল ক্যাপটা তুলে তৌফের কপাল বরাবর মারলো ছক্কা! সাথে-সাথে আর্তনাদে চিৎকার দিলো তৌফ,

– ও মা গো! কি রে, কি হইলো? উহঃ রে, কপালটা মনে হয় গেছে।

কপালে হাত বুলাতেই ফারিনের হাসিটা দেখতে পেলো তৌফ। রাগে নাক ফুলিয়ে সোজা মারজার কাছে নালিশ করলো,

– দ্যাখছেন আন্টি? আমার মতো সুস্থ পোলারে ক্যামনে ইন্ঞ্জুর্ড করলো দ্যাখছেন? ফারিনরে যদি কিছু না-বলছেন, আমি এখুনি খাবার রাইখা উঠলাম!

ঠাস করে মাথায় এক গাট্টা খেলো তৌফ। মুখটা বিকৃত করে পিছু তাকাতেই মাহতিমকে দেখতে পেলো। মাহতিম ডানহাতে তুড়ি বাজাতে-বাজাতে বললো,

– উঠ, উঠ; তুই উঠ্! অলরেডি চারটা রুটি গিলে ভদর-ভদর করছিস। আর গেলা লাগবে না, উঠ।

তৌফ দুই ভ্রুঁ এক করে গর্বের সাথে বললো,

– আপনা টাইম আয়ে গা। আজকে যেই অপমানটা করলি না? এটার প্রতিশোধ অবশ্যই নিমু বন্ধু। তোমার পোলাপানরে দেখিও আমার বাচ্চাকাচ্চা দিয়া ভাগায়া আনমু।

হো-হো করে হেসে দিলো সবাই। সৌভিক হাসির চোটে রুটিই খেতে পারলো না, নীতি তাক-লাগা হাসিতে জমে আছে, প্রীতি হাসতে-হাসতে মাথা নিচু করেছে। মারজা হাসি থামাতে-থামাতে আবার হেসে ফেলছেন। মাহতিম হাসতে-হাসতে হঠাৎ চোখ আঁটকে ফেললো। পেটফাটা হাসিতে মেহনূরের মুখটা লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। এই লালাভ মুখের দৃশ্যটা মাহতিম দুটো কারণে দেখলো। প্রথমটা ছিলো সন্ধিক্ষণের লজ্জায়, পরেরটা হলো এই হাসির রাজ্যে।

.

আকাশটা দারুণ দেখাচ্ছে। একটু অভিমানী চেহারায় গুমিয়ে আছে। মাঝে-মাঝে উত্থাল হাওয়াটা শীত ধরিয়ে দেয়। মেঘলা আকাশের ফাঁকে-ফাঁকে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ হচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে আবারও গ্লাসটা ঝাপসা হয়ে গেলো। একটা সুইচ অন করতেই দু’পাশ থেকে দুটো কাটা বৃষ্টির ছাঁট সরাতে লাগলো। টয়েটো গাড়িটা ঘন্টায় ষাট কি.মি.তে ছুটছে। পাশেই মেহনূর জানালার কাঁচ নামিয়ে বৃষ্টির পানির বুলাচ্ছে। মাহতিম ড্রাইভের ফাঁকে-ফাঁকে লক্ষ করতেই প্রসন্ন গলায় বললো,

– তোমার কি ভিজতে মন চাচ্ছে?

মেহনূর জানালা থেকে মুখ ঘুরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো। ভেজা হাতদুটো পরস্পর ঝারা দিতেই বললো,

– না, হালকা বৃষ্টিতে আমেজ নেই। ঝুম বৃষ্টি হলে শান্তি। যদি সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস থাকে, একটু নিরিবিলি জায়গা হয়, কয়েক হাতের মধ্যে বড় একটা গাছ থাকে, তাহলে তো আরো আনন্দ। আমি ওরকম বৃষ্টিতে চাই। ওরম বৃষ্টির জন্য আপত্তি করবেন?

মাহতিম স্পিড বাড়িয়ে একটু হাসলো। ওর দিকে একপলক চেয়ে ফের ড্রাইভ করতেই বললো,

– অবশ্যই করতে হবে। ওরকম বৃষ্টিতে ভিজলে তোমার সমস্যা। তোমার শুধু জ্বর-ঠান্ডা লাগে না। তোমার ডিরেক্ট নিউমোনিআ হয়ে যায়। তোমাকে নিয়ে কেন বের হই না জানো? একমাত্র বৃষ্টির জন্য। যখনই একটু স্পেস নিয়ে বের হই, ওমনেই দেখি বৃষ্টি হাজির।

হঠাৎ আধ ঘন্টার ভেতর তুখোড় বৃষ্টি নামলো। আকাশটা যেন আরো কালো করে আছে। রাস্তাগুলো জনশূন্য। গাড়ির ভেতরটা সন্ধ্যার মতো অন্ধকার। বৃষ্টির প্রবল ধারায় পথঘাট শেষ। গাড়িটা পাকা রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় উঠেছে। জায়গাটা গ্রামও না, শহরও না; ছিমছাম একটা মফস্বল। জানালার বাইরে দেখতে-দেখতে মেহনূর প্রশ্ন করলো,

– এখানেও আপনার কানেকশন আছে?

মাহতিম কথাটা শুনে ফিক করে হাসলো। গাড়িটা ডানে নিতে-নিতে বললো,

– জায়গাটার সাথে স্মৃতি জড়ানো আছে। তাই তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।

মেহনূর উৎসুক চোখে তাকালো। কৌতুহল গলায় বললো,

– কেমন স্মৃতি?

এটার জবাবে মাহতিম শুধুই হাসলো। আপাতত মেহনূর কিছুই জানলো না। ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় পুরোনো একটা বাড়ির কাছে গাড়ি থামলো। দোতলা বাড়িটায় কেমন সেকেলে-সেকেলে ভাব। তবুও একটা শৌখিনতার ছোঁয়া এখানে-সেখানে গেঁথে আছে। যেন কেউ খুব যত্ন করে এখনো বাড়িটা আগলে রেখেছে। একটা ছাতা খুলে দুজন একসঙ্গে ভেতরে ঢুকলো। মেহনূর চারপাশের অবস্থা দেখে অবাক হয়ে বললো,

– এখানে কি কেউ থাকে? দেয়াল-মেঝে সব চকচক করছে।

মাহতিম ছাতা বন্ধ করে সিঁড়ি ধরে বললো,

– হ্যাঁ, একজন বিধবা খালা থাকেন। এই বাড়িটা দেখভাল করার জন্য উনাকে বেতন দেওয়া হয়। আজ যে এখানে আসবো, তাই উনি বিশেষ ভাবে যত্ন করেছেন।

দরজাটা ধাক্কা দিতেই দ্বারদুটো খুলে গেলো। সুবিশাল একটি রুম, জানালায় আদিকালের মতো লম্বা-লম্বা শিক দেওয়া, চারিদিকে বিভিন্ন ঘরোয়া আসবাবপত্র। সবচেয়ে বেশি নজর কাড়লো শোবার খাটটা। স্ট্যান্ড খাটটা যেন নবাবী আমলের রাজা-বাদশাদের মতো। খাটের চর্তুদিকে পর্দা দিয়ে আবৃত। ফিনফিনে সাদা পর্দাগুলো বাতাসে খুব দুলছে। মাহতিম ট্রাভেল ব্যাগ থেকে জরুরী কিছু বের করছে। ঠিক তখনই মেহনূর ইতস্তত চোখে বললো,

– শুনুন,

মাহতিম চোখ তুলে তাকালো। আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে দম্ভের সাথে বললো,

– বাইরে যাওয়া নিষেধ।

মেহনূর সংশয়ের চোখে তাকালো। অনুনয় করে বললো,

– একটু ভিজে আসি?

মাহতিম কড়া গলায় জানালো,

– না।

মেহনূর আবার আকুতি-মিনতি করে বললো,

– একটু ভিজি? বেশি না, একটু? শুধু পাঁচ মিনিট?

মাহতিম একটু ভাবলো। চিন্তা করে বললো,

– আচ্ছা, ঠিকআছে। পাঁচ মিনিট, কিন্তু বেশি দেরি কোরো না।

মেহনূর সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে গেলো। ছুটে গেলো ভিজতে; দু’হাত ছড়িয়ে বৃষ্টির আস্বাদন নিতে; চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাতে। এই ঠান্ডা পরশ জাগানো বৃষ্টি যেন সব ধূলো-ময়লা ঘুচিয়ে দিক। প্রাণে-প্রাণে হৃদয়ে-হৃদয়ে চান্ঞ্চল্যকর অনুভূতি পৌঁছে দিক। দোল লাগিয়ে প্রফুল্ল করুক মন। মেহনূর প্রাণভরে দু’হাত জুড়ে ভিজতে লাগলো। গুনগুন করলো মনে-মনে। সময়ের হিসেব রইলো না, ভিজতে-ভিজতে বহুক্ষণ পেরিয়ে গেলো। অপরদিকে মাহতিম আইপ্যাডে ব্যস্ত। কিছু ডকুমেন্ট চেক করতে-করতে হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। আইপ্যাডটা সাইডে রেখে ফোনটা হাতে নিলো মাহতিম। আইপ্যাডটা সাইডে রেখে সাগ্রতর কলটা রিসিভ করলো,

– হ্যালো,

ধীরে-ধীরে দরজা খুলে গেলো। ঘরে প্রবেশ করলো সদ্য স্নাতা মানবী। স্নিগ্ধ সেই মুখ; নেশাময় সেই বেশভূষা। টুপটুপ করে ফ্লোর ভিজে যাচ্ছে। গা চুয়ে-চুয়ে ঝরছে অসংখ্য বৃষ্টি-ফোঁটা। গায়ে হালকা হলুদ রঙের শাড়িটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। হলুদের নিচে কালো ব্লাউজটা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। শীতে কাঁপছে ওই স্নাতা দেহ; চোখ লুটিয়ে রেখেছে মেঝেতে। মাথার ডানপাশে সিঁথি; লম্বা-লম্বা কেশরাশি বুকের দুপাশে ঝুলছে। এখনো ফর্সা চামড়ায় অসংখ্য বিন্দু মুক্তোর মতো জ্বলছে। যেন ছোঁয়া পাবার আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষা করছে। লজ্জায়-কুণ্ঠায় ছোট্ট মুখটা এখনো নুইয়ে আছে। যদি চোখ তুলে তাকায়, তাহলে সাংঘাতিক কিছু একটা হয়ে যাবে! মাহতিম সম্মোহন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে তখনও জানতো না, তার জন্য কি অপেক্ষা করছে। এখনো ফোনের ওপাশ থেকে সাগ্রত চেঁচিয়ে যাচ্ছে, আপ্রাণভাবে জানিয়ে যাচ্ছে কিছু! কিন্তু, সেদিকে হুঁশ নেই মাহতিমের। তার দৃষ্টিজোড়া শুধু দরজার দিকে আবদ্ধ। মেহনূর অনেকক্ষণ পর চোখ তুলে তাকালো, সেই চাহনিটুকু দেখে মনটা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো মাহতিম আনসারীর। সে আকুল চোখে ব্যকুল ঠোঁটে শান্তির হাসি দিলো। সেই হাসিতে অধীর হয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বললো,

‘ প্রহর শেষে রাঙা আলোয় সেদিন চৈত্রমাস,

তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনা/শ ‘

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_২৩ . শেষ
#ফাবিয়াহ্_মমো .

মাহতিম বিভোর হলো, মুগ্ধ হলো, ডুবে গেলো। সে শুধু অপলক চাহনিতে তাকিয়েই রইলো। তার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি, তার চোখে আকাঙ্ক্ষিত মূহুর্তের জন্য খুশি, তার দেহের প্রতিটি রোমে-রোমে প্রফুল্লতার সন্ঞ্চার। মাহতিম আবিষ্ট নজরে উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে, ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে মেহনূরের সামনে গেলো। বুকটা ফুলিয়ে বড্ড গভীরভাবে শ্বাস নিলো সে। ডানহাত এগিয়ে নতমুখটার থুতনি উঁচিয়ে ধরলো, ওই স্বচ্ছ-সরল-মায়াকাতর নয়নদুটিতে চোখ জড়ালো মাহতিম। আলতো ঢোক গিলে সুকোমল দৃষ্টিতে বললো,

– যেই সময়টার জন্য আমি অপেক্ষা করেছি মেহনূর, আমি জানি আমি ভুল ছিলাম না। যেই মেহনূরের ফুটন্ত নূরে আমি তিনবছর আগে ফেঁসে গিয়েছি, সেখান থেকে নিজেকে কোনোদিন মুক্ত করবো না। আমার বউ, আজ তোমাকে এমন জায়গায় এনেছি, যেখানে একসময় আমার বাবার স্মৃতি ছিলো। আমার বাবার জীবনে মায়ের প্রথম আগমনটা এই বাড়িতে। তখন এই বাড়িতে ছিলো আমার বুড়ো দাদী, আমার ফুপু, আমার চাচা। আমার বাবার জীবনে সবচাইতে আনন্দের মূহুর্ত এই বাড়িতে কেটেছে। বাবা-মায়ের সব স্মৃতি এই বাড়িতে আবদ্ধ, এই রুমের আনাচে-কানাচে মধুর দিনগুলো মিশে আছে। তোমাকে তো আমার জীবনের সবটুকু ভালোবাসা দিয়েছি। শুধু অধিকার মেশানো ভালোবাসা দেইনি। আজ আমি বয়সের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শুধু এটুকু বলতে চাই, জানিনা ক’বছর তোমার পাশে, তোমার মাথায় ছাউনি দিয়ে থাকবো। ঠিক ক’বছর তোমার চারিদিকে আমার অস্তিত্ব থাকবে। কিন্তু তিনটে বছরের দূরত্ব দিয়ে তোমার মনে যেই প্রণয়ের বীজ বুনেছি, আজ শুধু তোমার দেহে আমার ভালোবাসাটুকু রাখতে চাই। যেন,

এটুকু বলেই মাহতিম দুহাত বাড়িয়ে ওর মুখটা ধরলো। আরো গাঢ় হয়ে শীতল কন্ঠে বললো,

– যেন আমার অনুপস্থিতিতে সেই ছোট্ট-ছোট্ট হাতদুটো তোমায় ছুঁয়ে দেয়। তোমাকে বুঝিয়ে দেয়, ‘ আমি আছি ‘।

বলেই মাহতিম প্রাণপূর্ণ মায়ায় হাসি দিলো। মেহনূর জানে না এমন অদ্ভুত কথার মানে কি। কেন ‘অনুপস্থিত’ কথাটা কাটার মতো ফুঁটলো। মেহনূর সরল চোখে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে দুচোখ ভরে টলমল অশ্রু ছুটে এলো। ঠোঁট কাঁপিয়ে ভেজা গলায় বললো,

– পার্থিব জীবনের পরিসীমা খুব ছোট, তাই না?

মাহতিম শুধু তৃপ্তির হাসিটুকু দিলো। নীরবে মেহনূরের কপালটা নিজের ওষ্ঠছোঁয়ায় চেপে গভীর চুমু খেলো। মেহনূর চোখদুটো বন্ধ করতেই দু’কোল ঘেঁষে টপ করে দু’ফোঁটা মোটা অশ্রু ঝরে পরললো। ভেজা হাতদুটো মাহতিমের পিঠ ছুঁয়ে সাদা শার্টটা মুঠোয় মোচড়ে ধরলো। বুকটার মধ্যে মাথা রেখে পরম সান্নিধ্যে নিজেকে মাহতিমের ডেরায় সমর্পণ করলো মেহনূর। নিজের উষ্ণ-নরম-পরিস্ফুটিত মনটা ক্ষণেক্ষণে উদ্বেলিত করার জন্য তার কাছে তুলে দিলো। তার দেহে মাহতিমের ভালোবাসাটুকু বপনের জন্য অন্তরালে সম্মতি বোঝালো। বাইরে বৃষ্টির তোলপাড়। ঘরের ভেতর নিস্তব্ধ অবস্থা। মূহুর্মূহু নিরবতায় শীতে কাঁপছে মেহনূর। উষ্ণতার কুঠিরে নিজেকে লুকোনোর জন্য প্রচণ্ড আনচান করছে। হঠাৎ মেহনূরের দু’বাহু ধরে বুক থেকে সরিয়ে দিলো মাহতিম। মেহনূর আচানক এমন কাণ্ডে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। শীত সহ্য করতে না-পরে তৎক্ষণাৎ হাতদুটো বুকের কাছে আড়াআড়ি করে রাখলো। শীতে যুঝতে থাকা মেহনূর আরক্ত চোখে মানুষটার পানে তাকালো। তার একান্ত সৌম্য মানুষটা সাদা শার্টটার বোতাম খুলছে। গা থেকে শার্টটা খুলে বাঁদিকে ছুঁড়ে মারতেই সেটা খস করে চেয়ারে যেয়ে পরলো। কোমরের কালো বেল্টটা ডানহাতে একটান মারলো সে। ধীরপায়ে মেহনূরের দিকে এগুতে-এগুতে সেটাও বাঁ-পাশে অনির্দিষ্ট জায়গায় ছুঁড়ে দিলো। দৃশ্যটুকু দেখে মেহনূরের সর্বাঙ্গে এক অদ্ভুত শিহরণ ছড়িয়ে পরলো। মৃদ্যু অনূভূতিতে চোখ বন্ধ করলো মেহনূর। অনুভব করলো, তার ভেজা বাহুদুটোতে হাত রেখেছে সে। ছুঁয়ে-ছুঁয়ে একটা হাত গলায় রেখে অন্য হাতটা কাধে ফেলেছে। কাধের বাঁ-পাশে দু’আঙ্গুলে চাপ দিয়ে খুলে ফেললো সেফটিপিন। তখনই কর্ণ-লতিতে অনুভব করলো প্রখর চাপ। ঈষৎ কম্পনে কুঁকড়ে গেলো মেহনূর। হাতের মুঠোদুটো আঙ্গুলে-আঙ্গুলে মুষ্টিবদ্ধ করলো। সেই কোয়ার্টারের প্রথম রাতটা ঝাপসা-ঝাপসা মনে পড়ছে। ঠিক একইভাবে কাধ থেকে ভেজা আঁচলটা ফ্লোরে লুটিয়ে পরলো। গা থেকে সমস্ত সিক্ত বসন খুলে দিলো মাহতিম। সবটুকু গাত্রাবরণী উন্মুক্ত করে নিজের বুকটার মধ্যে দ্রুত মেহনূরকে লুকিয়ে নিলো। এমন ভাবে লুকালো, যেন এই মেহনূরকে কেউ না-দেখুক। এমন ভাবে বাহুপাশে আবদ্ধ করলো, যেন তার দেহের আবরণে আবৃত হোক। চট করে কোলে তুললো মাহতিম। সাথে-সাথে নিজের দুহাতে মুখ ঢাকলো মেহনূর। ফিনফিনে সাদা পর্দা সরিয়ে শয়নশয্যার মধ্যভাগে শুইয়ে দিলো। পায়ের তলা থেকে নরম কম্বল নিয়ে বুক অবধি ঢেকে দিলো। জানালার ফাঁক গলে এক টুকরো নরম আলো আসছে। সেই আলোতে একবার আরক্তিম মুখটা দেখার জন্য ডাকলো। ব্যাকুল সুরে আদর মিশিয়ে বললো,

– ও মেহনূর,

ঝিমঝিম করে কিছু একটা হলো। মেহনূর বশীভুত হয়ে ঢোক গিলে হাতদুটো সরালো। অশান্ত নিশ্বাসে চোখ মেলে চাইতেই মাহতিমের ধারালো-প্রখর-সুগভীর চাহনিতে আঁটকা পরলো। পরমাদরে ক্ষুদ্র আহ্বান করলো মেহনূর। বিছানা থেকে মৃদ্যুভাবে হাতদুটো তুলে তাকে কাছে আসতে বললো। আজ গম্ভীর-রুক্ষ-বিচক্ষণ মানুষটার মুখে শুধু পরিপূর্ণ হাসির ঝলক। একটুও দেরি না-করে মেহনূরের উষ্ণ বাহুডোরে নিজেকে ছেড়ে দিলো। মেহনূর হৃদয়কাননের একান্ত মানুষটিকে দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরলো। তাকে ঢেকে দিলো কম্বলের আবরণে। মেহনূরের বাহুডোর থেকে মুখ তুললো মাহতিম। ওর মুখের উপর ঝুঁকে মৃদ্যু স্বরে বললো,

– আই লাভ ইউ।

মেহনূর তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো আবার শুনতে চাইলো। এ যেন ছুঁতে পাওয়া সোনার হরিণ। নির্ভার কন্ঠে বললো,

– আবার,

মাহতিম মুখ নামিয়ে ঠোঁটে চুমু খেলো। আবার তাকিয়ে বললো,

– আই লাভ ইউ। নে/ভির এই আনসারী আপনাকে খুব ভালোবাসে ম্যাডাম। আপনার প্রতি তিনবছরের জমানো লোভটা আজ আপনার জিম্মায় ছেড়ে দিতে চাই।

বজ্রপাতের দামাল শব্দে কেঁপে উঠলো দালান। শব্দে মেহনূর একটুও কাঁপলো না। খুব আস্তে-আস্তে তার হাতদুটোকে দখল করছে মানুষটা। আঙ্গুলের ফাঁকে-ফাঁকে গুঁজে দিচ্ছে আঙ্গুল। বিছানার সাথে সরু হাতদ্বয় চেপে ধরতেই কপালে চুমু খেলো। হৃদয়ের প্রতিটি স্তরে-স্তরে মানুষ যেমন অধিকার ফলায়, তেমনি নিজের অধিকার ফলালো মাহতিম। চোখের পাতায়, নরম গালে, সুডৌল নাকে, থুতনির মধ্যখানে ছুঁয়ে দিলো সে। গলার ওই ছোট্ট তিলতুল্য বিন্দুতে ওষ্ঠাধর চাপলো মানুষটা। মেহনূর সৌহার্দ্যে, সোহাগে, স্নেহের ভূষণে তলিয়ে যাচ্ছে। আজকের এই আনসারীকে চেনা বড্ড মুশকিল। তাকে নিয়ে রুক্ষ-গম্ভীর-শক্ত মূর্তির চেহারা কল্পনা করা যাচ্ছে না। কল্পনা করা যাচ্ছে, বেহিসেবি আদর করা অনুরক্ত পুরুষ। দীর্ঘ অধরচুম্বনের আশ্লেষে অবগাহন করলো মেহনূর। এই মাহেন্দ্রক্ষণটা তার দেহের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে শিরশির অনুভূতি ছড়ালো। এক নৈসর্গিক ভুবনের কাছে মুখপাত হলো। মেহনূর ভুলেই গেলো, আজ প্রকৃতি বড্ড চন্ঞ্চল। বাইরে বৃষ্টির হুঁ-হুঁ শোরগোলটা বেশ ভয়ানক। মফস্বলের আবহাওয়াটা খুব খারাপ। মেহনূর সমস্ত শরীরে মাহতিমকে অনুভব করলো; আরো অনুভব করলো, এক নিবিড়-আকুল-অব্যক্ত সন্ধি।

.

শব্দটা একবার হলো, দুবার হলো, তৃতীয় বার হতেই চমকে উঠলো রজনী। অস্থিরভাবে ঘুম থেকে উঠে ফোন খুঁজতে লাগলো। ফোনটা অসহ্য রিংটোনে বাজছে। ঝট করে বিছানা থেকে নেমে ওয়ারড্রবের কাছে গেলো। সেখানেই পেলো ফোনটা। কলার আইডি দেখে বুকটা খরার মতো শুকিয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উ/ন্মাদের মতো নামলো। অন্ধকার হলরুমে দৌঁড় লাগিয়ে চিৎকার করলো, ‘ ভাইজান! কোথায় গেছেন? ‘

কোত্থেকে যেনো সাড়া দিলো,

– রজু, আমি এখানে। এদিকে চলে আয়।

শঙ্কিত চিত্তে ঢোক গিললো রজনী। চট করে তাকালো ডানদিকে। হ্যাঁ, ওইতো! ওইতো ওই রুম থেকে আলো জ্বলছে। রজনী তড়িঘড়ি করে ছুট লাগালে ফোনটা বাজতে-বাজতে বন্ধ হলো। বিশাল রুমটায় গিয়ে হাঁপাতে লাগলো রজনী। বড় ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলো ফোনটা। তার ভাই জনাব রোকনুজ্জামান সিদ্দিকী। তিনি ইজিচেয়ারে বসা অবস্থায় ফোনটা হাতে নিলেন। সদ্য আসা কলটা চেক করে তিনি বিস্ফোরণ চোখে তাকালেন। ধপাস করে চেয়ার থেকে উঠে বিস্ময় চোখে বললেন,

– একি! এর মানে কি! কি হচ্ছে রজু? তোমাকে এ/ম/পির প/দ দিয়ে বড় ভুল করলাম নাকি? তুমি কি আমাকে ডো/বা/তে চাচ্ছো? এদের দ/ল তোমাকে কল দিচ্ছে কেন?

রজনী অপরা/ধীর মতো চোখ নিচু করলো। আফসোসের সুরে নত হয়ে বললো,

– কথা শুনুন ভাইজান, আমি খা/রাপ কিছু করিনি। সরদার মা//রা যাওয়ায় আমাদের যেই ক্ষ#তিটা হয়, ওটা ফিলাপের জন্য কল দিয়েছিলাম। এখন ওরা আমাকে শা/ষা/চ্ছে। বলছে আ/ন্ডা/রগ্রা/উ/ন্ডেও যেতে পারছে না। ওদের সবদিক থেকে ঘিরে ফেলছে। ওরা ধ/রা পরলে খুব বি/প/দ ভাইজান। চোখ বন্ধ করে আমাদের না/ম নিবে।

রোকনুজ্জামান সিদ্দিকী রা/গে টেবিলের উপর এক ঘু/ষি মা/র/লো। টেবিলের সমুদয় জিনিস কিন্ঞ্চিৎ কেঁ/পে উঠলো। গজগজ করে বললো,

– কালাম সরদার সব খ/ত/ম করে গেলো! ওর জন্য কো/টি টা/কার অ/র্ডার এখন সা/প্লাই দিতে পারছি না। এইসময় পাঠাতে পারলে দ্বিগুণ দাম বসাতে পারতাম। সব শে/ষ করলো! সব শে/ষ করলো! রজু? এ্যাই রজু শোন, তুই আমাকে শুধু বল, এই খবরটা কিভাবে লিক হয়েছে? কোন্ বেজ/;ন্মা/র বা;/চ্চা স/রদারের ঘট/না ফাঁ/স করলো?

রজনী গভীরভাবে দম ছাড়লো। টেবিল থেকে গ্লাস তুলে ঢকঢক পানি গিলে বললো,

– নাম বললেও কি/ছু করতে পারবেন না। আমি ব্যর্থ হয়েছি ভাইজান। এখন কোনো কূলকিনারা পাচ্ছি না। বুঝতেই পারছিনা, মাহদির খু;//ন থেকে কিভাবে এসব হলো। কোথায় মাহদির খু;//ন; আর কোথায় আমাদের ব্যবসা। এখন দুটোকে তছনছ করে দিচ্ছে ভাইজান। এরকম চলতে থাকলে খুব তাড়াতাড়ি প/দ হারাবো। পা;/র্টি থেকে গ/লা/ধা:ক্কা মা;র/;বে।

এর মানে এসবের সাথে মাহতিম জ/ড়িত। মাহদির খু//ন নিয়ে ত/দ/ন্ত করতে গিয়ে নিশ্চয়ই অনেক কিছু জেনেছে। নাহলে পা\গ:লা কু/কু/রের মতো পেছনে লাগতো না। এভাবে চলতে থাকলে সব ধা/ন্দা ব/ন্ধ হতে বাধ্য! এটা অসম্ভব! না, না, না! ওর আগানো চলবে না। ওকে রুখতে হবে। ওকে পথ থেকে স/রা/তে হবে। এই ভ/য়া\বহ বি/পদ যদি কোনোভাবে ফাঁ/স হয়, দে:শে;র মা\নুষ তাদের ছা/ড়বে না! এটা হতে দেওয়া যায় না, এটা হতে দেওয়া যায় না। চটপট ভঙ্গিতে টেবিল থেকে ফোন তুলে নিলো। একটা বিশেষ নাম্বারে কল দিয়ে বসালো। এখন বিকাল চারটা। ফোনটা ধরতে অসুবিধা হবে না। সত্যি-সত্যিই কলটা রিসিভ হলো,

– আসসালামুয়ালাইকুম ভাই। কেমন আছেন? কি খবর?

রোকনুজ্জামান কোনো কুশন না-সেরে সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করলো,

– কোনো খবর আছে? নতুন কোনো খবর থাকলে এখনই জানাও। দেরি কোরো না, দেরি কোরো না।

ওপাশের ব্যক্তি চুপ মে/রে গেলো। কিছুক্ষণ তাকে লাইনে রেখে হঠাৎ বলে উঠলো,

– জ্বী ভাই, এইতো পাইছি। মাহতিমের ফো/ন থেকে কিছু পাওয়া যায় নাই। কিন্তু একটা ইর্ম্প/ট্যান্ট ক্লু পা/ইছি। উনার বউ মেহনূর আছে না? উনি নোমানকে ফোন দিছিলো, ক/লে মালিবাগের ক/থা ব/লছে। মনেহয় মাহতিম আ/র্জেন্ট ওখানে যাবে। আর এটা নিয়ে মেহনূর অনেক চি/ন্তায় আছে। এখন বাকিটা বুঝে নেন। আমার কাছে মনে হচ্ছে গো/পন ম/জ/লিশ।

এমন চমকপ্রদ ঘটনা শুনে ভদ্রলোক আনন্দে হাসি দিলো। ঠিক যেন পৈ/শা/চিক/তার হাসি। শি/কারীর নাগালে যখন লো/ভনীয় শি/কা/র ফাঁ/সে, তখন তাকে মা/র/তে পা/রার যেই হিং/স্রা/ত্মক আনন্দ, ঠিক তেমনি একটা অপ/বি/ত্র হাসি দিলো। রজনী কয়েক হাত দূরত্ব থেকে সবকিছু দেখলো। সে এই হাসির অর্থ জানে; তবুও সে সন্তুষ্টির জন্য শুধালো,

– ভাইজান? সুখবর?

নির‍্যুত্তর রইলো রোকনুজ্জামান। ইজিচেয়ারে দোল খেতে-খেতে একপর্যায়ে উত্তর দিলো,

– আনসারীকে ক/য়টা টু/ক/রা করা যায় রজু? কয়টা পি/স করলে শান্তি পা/বো? এই জা/নো/য়া:রের বা/চ্চাকে পিস-পিস করে কু/;কু;র দিয়ে খাও/য়াবো। আমাকে চিনে না। আমার ধা/ন্দায় যদি গু/ল/তি মা;র/;তে আসে, আমি রোকনুজ্জামান ওকে ছিঁ;/ড়ে-ছিঁ/;ড়ে মা/র/বো। আমার ঘু\ম হা/রা/ম করে তুই মালিবাগ যা/বি? ওই মালিবাগের রাস্তায় তো/কে শু/ইয়ে দিবো জা/নো/য়া;রের বা/চ্চা!

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .