মন বাড়িয়ে ছুঁই ২ পর্ব-২৬

0
579

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_২৬ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

হাত-পা বাঁlধা। বাঁlচার উপায় নেই। যেকোনো সময় মৃlত্যু হাজির। শরীর ক্ষlতবীlক্ষlত; একটা হাত ভাlঙা। অlনাহাlরে, অত্যাlচাlরে শোlচনীয় অবস্থা। নিশ্বাস নিলে খুব কlষ্ট হয়। চোখের পাতা খুললে ঝাপসা দেখে। তৃষ্ণায় গলাটা খসখস লাগে। মাত্র একদিন, স্রেফ একদিন সে চোখ ভিজিয়ে কেঁদেছিলো। সেই নীরব কান্নার অশ্রু কাউকে দেখায়নি। সেদিন সে কেঁদেছিলো অনাগত সন্তানের জন্য। যেই সন্তানের জন্য তার মন-প্রাণ কাতর ছিলো, পা।গল ছিলো, অস্থির ছিলো; প্রতিটি সেকেন্ডে-সেকেন্ডে যlন্ত্রlণায় ভুlগছিলো সে। তার সাজানো-গোছানো নতুন সংসার টুকরো-টুকরো করে ভাঙ্গে। নিজের শেষ মনোবলটুকু চূর্ণবিচূর্ণ কাঁচের মতো গুড়িয়ে নেয়। তার আত্মগরিমার স্বচ্ছ সম্মানটুকু পাlপীlদের পlদতলে বাড়িয়ে দেয়। তবুও পার পায়নি সে; ছাlড়া পায়নি জেlল থেকে। নিজেকে ধ্বংlস করে দিনের-পর-দিন কাlরাবাlসী হয়। আশা নেই। আশার ছোট্ট জানালাও যখন চর্তুদিক থেকে বন্ধ, তখনই সদর দরজা ভেঙ্গে প্রখর সূর্যের আলো ঢুকলো। এক অদ্ভুত জাগরণ নিয়ে দীপ্তিময় দ্যুতির সাথে প্রবেশ করলো দূত। কাlরাকক্ষেlর গাlর্ড সেদিন রেডি হতে বললো। কেন বললো, কি কারণ, তখনও জানে না সে। শুধু শুনতে পেলো নামকরা ব্যাlরিষ্টাlর আসছে। একজন সফলতম ব্যাlরিষ্টাlর। একটু পরই ছোট্ট গেট দিয়ে প্রবেশ করলো সে। পূর্বকে আশ্বস্ত করে ভদ্রলোক চলে গেলো। মাত্র দু’মিনিটের ছিলো সাক্ষাৎটা। মাত্র দু’মিনিট! এই দু’মিনিটের তাlণ্ডlবলীlলা এমনভাবে ফললো, যেটা দেখতে পায় ঠিক দু’দিন পর। হঠাৎই কাlরাlগাlর থেকে মুlক্তির আlজ্ঞা আসে। পূর্ব তখন আগের মতো সুlস্থ নেই। দীর্ঘদিন শাlরীlরিক নিlর্যাতlনে তার অবস্থা করুlণ। তাড়াতাড়ি নেওয়া হয় হাসপাতাল চত্বরে। ইউনাইটেড হসপিটালে তৎক্ষণাৎ শুরু হলো চিকিৎসা। গুরুতর অবস্থার জন্য টানা ৭২ ঘন্টা অবভারভেশানে রইলো। একটু সুস্থ হলে আয়মানের কাছে সমস্ত ঘটনা শুনলো। এবার যে অবাক হওয়ার পালা! তাকে সাহায্যের জন্য সরlকাlরি বাহিlনীlর হাত আছে। কিছু বিlশেষ সদlস্যরা এগিয়ে এসেছে। পুরো ঘটনা দিন-থেকে-রাত বানিয়ে ছেড়েছে। এমন তাlজ্জবের কথা বলতে-বলতে আয়মান আরো বললো,

– ভাই, ক্যামনে কি হইলো? আপনার সাথে নিlরাপত্তা বাlহিlনীর খাতির আছে?

পূর্ব দূর্বল চোখে তাকায়। হালকা করে মাথাটা ‘ না ‘ সূচকে নাড়ায়। কথা বলার মতো শক্তি নেই। কাকে নিয়ে কথা বলছে তাও বুঝতে পারছে না। আয়মান আরো অবাক হয়। বিষ্মিত স্বরে বলে,

– আপনারে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ডাইরেক্ট গlভঃমেlন্টেlর অlর্ডার আসে ভাই! আপনার উপর যেই-যেই রেlসট্রিlকশাlন ছিলো, সব তুlলে নিছে। পুরা কেlস রাতারাতি ক্লোlজ্ড! ঘটনা বুঝতাছেন ভাই? একমাত্র তলে-তলে এইসব ভূlতুড়া কাlণ্ড চলে। সাগ্রতও টাষ্কি খাইয়া আমার অফিসে বইসা আছে। এখন চলেন, আর এদিকে থাকোন লাগবো না। পূর্ণতা আপনার জন্য অপেক্ষা করতাছে।

পূর্ব সেদিন নাকোচ করে দেয়। রোগা সুরে জানায়,

– আমি খুব দূর্বল আয়মান। কিচ্ছু করতে পারছি না। কারা হেল্প করেছে তাও জানি না। আমার হাতটা এখনো ভাlঙ্গা। চোখ খুললে এখনো ঝাপসা দেখি। আমাকে সময় দাও আয়মান। হাতটা জোlড়া লাগুক। ও আমাকে এই অবস্থায় দেখলে স্বাভাবিক থাকতে পারবে না। আমার দেখভাল করতে-করতে শরীরের দিকটা ভুলে যাবে। আমি চাই না বিপদ হোক। ও কোনো ক্ষlতি ডাকুক। আমি আর ধাlক্কা নিতে পারবো না। আমি একটু সুস্থ হই, একটু নরমাল হয়ে নেই; আমি নিজেই ওর কাছে ছুটে যাবো। কিন্তু, এইমূহূর্তে যাওয়া সম্ভব না। তুমি ফিরে যাও আয়মান। আমার কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করো। প্লিজ খারাপভাবে নিও না। তুমিতো জানো, ওকে দেখার জন্য কেমন হাঁসফাঁস করছি। আমিও চাই ওর কাছে ফিরে যেতে। কিন্তু পারবো না। আজ চলে যাও।

বিরস মুখে ফিরে যায় আয়মান। পূর্বকে অমান্য করেনি সে। এখনো সেই দিনগুলো স্পষ্ট করে ভাসে। চিন্তায় ডুবে থাকতেই গাড়ির হর্ণ বেজে উঠলো। আস্তে-আস্তে চোখ খুললো পূর্ব। একটা সাদা গাড়ি মুখোমুখি হয়ে থামছে। পুরো রোড অন্ধকার! আশেপাশে নির্জনতা। সম্মুখ গাড়ির হেডলাইট দুটো অন্ধকার চিঁড়ে অন-অফ হচ্ছে। ড্রাইভিং সীটে বসে আছে পূর্ব। তার দৃষ্টি সামনের দিকে অটল। বুকটা অদ্ভুত কারণে ধুকপুক করছে। খটাস করে আগত গাড়ির দরজাটা খুলে গেলো। পূর্ব একপলকের জন্য নিজের বাঁ-হাতে তাকালো। একনাগাড়ে বিপ-বিপ করছে ঘড়িটা! একদম সোয়া এগারোটা! একটুও লেট হয়নি। দারুণ অবাক হয়ে সামনে তাকালো সে। এতো পাংচুয়েল কিভাবে? একটুও এদিক-ওদিক হয়নি, এক্যুরেট সোয়া এগারোটায় এসেছে। সেই অতীতের দিনটা আবারও চোখে ভাসছে। কেবিনের দরজা খুলে প্রবেশ করলো কেউ। শব্দ শুনে চোখ খুললো পূর্ব। ঝাপসা চোখে তাকাতেই সামনে কেউ দাঁড়ালো। ধীরে-ধীরে ঝাপসা ভাব কেটে যেতেই পরিষ্কার চোখে দেখলো। হ্যাঁ, এই সেই মুখ, এই সেই চালচলন। সেদিন পড়নে ছিলো সাদা ইউনিফর্ম। বুকের একপাশে ছিলো নেমপ্লেট। মাথায় ছিলো সাদা ব্যাlচধারী টুপি। পুরো বেশভূষায় ছিলো প্রখর ব্যক্তিত্বের ছাপ। আজ সেখানে সিlভিল ড্রেস; বুকের পাশটা খালি। গাড়িটা ‘ টুট টুট ‘ আওয়াজে লক করলো সে, রিমোটটা খুব কায়দার সাথে প্যান্টের পকেটে ঢুকালো। এবার সে আসছে। ঠিক এদিকেই আসছে। দুটো গাড়ির মধ্যবর্তী দূরত্ব পার করে পূর্বের কাছে আসলো। পূর্বের গ্লাস উঠানো জানালায় দু’আঙ্গুলে ‘ টকটক ‘ জাতীয় শব্দ করলো। মাথাটা ডানে ঘুরিয়ে জানালার কাঁচ নামাচ্ছে পূর্ব। ক্ষণিকের জন্য চোখাচোখি হলো তাদের। অপর প্রান্তের ব্যক্তিটা মার্জিত হাসিতে বললো,

– কেমন আছেন ব্রাদার?

পূর্ব মুচকি হাসি দিয়ে গাড়ি থেকে নামলো। হ্যান্ডশেকের জন্য ডানহাত বাড়িয়ে দিলো। একগাল হাসিতে প্রফুল্ল হয়ে বললো,

– আপনি আসবেন বলে কথা। আপনার মতো ডেlন্ঞ্জাlরাlস পার্সনকে সামনে পাচ্ছি। আমাকে তো ফিট এ্যান্ড ফাইন থাকতেই হতো। আপনি চেন্ঞ্জ হননি আনসারী, আগের মতোই আছেন। তোমাকে দেখতে পেয়ে খুব ভালো লাগছে।

চমৎকার আচরণ পেয়ে হেসে দিলো মাহতিম। পূর্বর হাতটা সম্মানের সাথে হ্যান্ডশেক করলো। ভ্রাতৃত্বপূর্ণ কায়দায় পূর্বকে আলিঙ্গন করলো সে। সন্তুষ্ট গলায় বললো,

– বlদলে গেলে বlদlলা নিতে পারতাম না। মানুষগুলো আমাকে শান্তি দেয়নি। আমার জীবন থেকে যেই সুlখটুকু কেlড়ে নিয়েছে, ওটার খেlসাlরত আজ-নয়তো-কাল দিlতেlই হlতো। এখন সেই সময় এসে গেছে।

পূর্ব উদাস হয়ে যায়। মাহদি নামক চেহারাটা জ্বলজ্বল করে মানসপটে ভাসে। মাহতিমের শক্ত-প্রশস্ত পিঠে দুটো সান্ত্বনার চাপড় মাlরে। ভেতর থেকে গভীরতম শ্বাস ছাড়লো সে। এই জুনিয়র ছেলেটা একদিন তাকে মৃlত্যুlর মুlখ থেকে বাঁlচিয়েছে। নিঃস্বাlর্থেরl মতো পরোlপকার করতে বিনা চিন্তায় ঝাঁlপিয়ে পlরেছে। ছেলেটার অবদান কোনোদিন ভুলবে না পূর্ব। যেই বিlপlদের সময় কেউ পাশে দাঁlড়াlতে পারেনি, তখন এই ছেলেটা দূর্দান্ত কাজ করেছে। এই ঋণ কিভাবে শোধ করবে? আদৌ সেটা সম্ভব হবে? অন্দরমহলে প্রাথমিক আবেদনটা সেই-ই হেlডঅফিসে পাঠায়। সেখানে থাকা এক কেlন্দ্রীয়l ব্যক্তি সাহায্য করে মাহতিমকে। সেই ব্যক্তি আর কেউ না, স্বয়ং অশোক সেন ছিলেন। মাহতিমের অসংখ্য কেlসেlর সফলতা ও পlদোlন্নতির জন্য মহাজন বেশ তৎপর আচরণ করেন। সেই ব্যক্তির সংস্পর্শে কাlজ আগায় আনসারী। কিছু শক্ত প্রlমাlণ জোlগাড় করে রিlপোlর্ট বানায় সে। সেখানে উল্লেখ্য ছিলো, ক্ষlমতাlপ্রাlপ্ত কিছু নেlতাlদের অসাlমঞ্জlস্য ঘটনা এবং ওয়াসিফ পূর্বের সমগ্র জরিপের ইlতিহাস। রিlপোlর্টটা এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যে, টপ লেlভেlলের সুপাlরিlশ হিসেবে ডাlইরেক্ট পাlর্টিlর কাছে যায়। পাlর্টিlর একদম কেlন্দ্রীlয় নেlতা, যার কাছে দেlশেlর সlর্বস্ব প্রশাlসlনিক ক্ষlমlতা, এবার তার কাছে পৌঁlছায়। তিনি ভুলটা পরোখ করে দ্রুত সংশোlধনের আlজ্ঞা দেন। এ বিষয়ের সাথে যে যে জlড়িlত ছিলো, তাদের ধlরার নিlর্দেশ দেন। সেই সাথে নিরাlপlরাধ ব্যlক্তিকে তাৎক্ষlণিকlভাবে ছেlড়ে দেওয়ার আদেlশ জাlরি করেন। অবশ্য প্রlধানlমlন্ত্রী হিসেবে এটুকু দায়িত্ব না-পালন করলে বিlরাট ক্ষlতি। যেহেতু নিlরাlপlত্তা বাহিlনীlর কাছ থেকে এমন তথ্য এসেছে, সেখানে তৎপরতা না-দেখালে সlমস্যা। কাlরাlগার থেকে সফlলভাবে মুlক্ত হয় পূর্ব। বেরিয়ে আসে বlন্দিজীlবন থেকে, প্রাণ খুলে নিশ্বাস নেয় সে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে নিত্যজীবনে ফিরে।

মাহতিম তার জন্য অশেষ রহমত ছিলো। বিপlদের যেই মাকামে কোনো আশাই ছিলো না, তখন ছিলো আগমন। আজ মিlথ্যাlর ছlন্দকে তাল কাlটাlতে মাহতিম ছুটে এসেছে। পরোয়া করেনি মৃlত্যুlকে। এবারের ঘটনা আরো সাংlঘাlতিক। এর সাথে যেই ব্যক্তিlরা জড়িlত, তাদের মুখোlশ উlন্মোlচন হলে দেশের ভেতর চরlমাlবস্থা সৃষ্টি হবে। শেষপযর্ন্ত মাহতিম সত্য-মিlথ্যাlর লlড়াlইয়ে মিlথ্যাlবাlদীদের বেlফাঁlস করতে পারে কিনা, তাই দেখবার বিষয়। বছরের-পর-বছর যেই ব্যlক্তিlরা ‘ নেlতা ‘ উlপাlধি পেয়ে জlনগlণের ক্ষlতিসাধন করে আসছে, বিভিন্নভাবে ব্যlবlহার করlছে, ক্রমাগত শোlষlণ কlরছে, সেসব ব্যক্তিরা কি নিlরাlপlরাlধ? যারা ক্ষlমতাlর অlপব্যlবহার করে মানুষের সুlস্থজীবনকে দূlর্বিসহ করছে, তারা কি সাlধু? পূর্বকে ছেড়ে দিলো মাহতিম। নিজের তেজালো রূপটা ঠান্ডা করে নিলো। অদম্য আভাসে স্বাভাবিক সুরে বললো,

– খবরটা বলুন। হাতে সময় কম। আপনাকে দশ মিনিটের ভেতর ফিরতে হবে। আমি চাই না আপনার কোনো ক্ষlতি হোক। আপনাকে যে করেই হোক, সুস্থভাবে ফিরতে হবে। আমার পেছনে লোlক লেlগেছে। কতক্ষণ ওদের ধোঁlকা দিয়ে চলবো জানি না। আমার মতে, ওরা আমাকে বাঁlচিlয়ে রাখবে না। ওরা সব বুঝে গেছে। আমাকে মেlরে ফেলার জন্য পেlশাlদার খুlনি হায়ার করা। আপনি দ্রুত ডকুমেন্টটা নিয়ে আসুন। আমি সই করে দিচ্ছি।

পূর্ব শঙ্কিত মুখে চাইলো। মাহতিমের কথা শুনে কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। এটাই কি তবে শেষ দেখা? পূর্ব বিষন্নভাবে তাকালো, একটু পরাস্ত গলায় বললো,

– আপনার ওয়াইফ? তাঁর জন্য চিন্তা করেছেন? আপনি কিন্তু আমার মতো ভুল করবেন না।

মাহতিম পকেট থেকে ফোন বের করছিলো, হঠাৎ প্রশ্ন শুনে চমকের সাথে চাইলো। মুখে বাক্য আসছে না। এই একটা শব্দ শুনলেই নেতিয়ে পরে সে। মনের উপর ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আমার বউ, আমার মেহনূর, ও কি ভালো থাকবে? ওর ছোট্ট মুখটা মনে পরলেই বুকটার মধ্যে রাখতে ইচ্ছে করে। এতোদূর এসেও ওর কথা ভুলতে পারেনি। ও শূন্য কোয়ার্টারে থাকতে পারবে? বিছানায় যখন ঘুমাবে, তখন কি চোখদুটো বন্ধ হবে? রুমের লাইট নিভিয়ে শান্তির ঘুম দিবে? ও কখনোই দিবে না। হয়তো এখন চুপ হয়ে গেছে। বালিশে মাথা রেখে অন্ধকার রুমে শুয়ে আছে, চোখ থেকে ফোঁটায়-ফোঁটায় অশ্রু ঝরছে। বাড়ির কাউকে বুঝতে না-দিয়ে শান্ত হয়ে গেছে। মাহতিম চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়লো, তার ভেতরটাও অবসাদগ্রস্ত কাঙ্গালের মতো ঠেকছে। কিন্তু উপায় নেই। মনের অঙ্কুরোদ্গম চিন্তাকে শান্ত করে নিশ্চল সুরে বললো,

– ও আমার বাlঘিlনী। ও সব পারবে। আমি যদি না-ও থাকি, ও সবকিছু সামলে নেবে। আমার মৃlত্যুlতে কাঁদার মানুষ কম। আমার মা-টা কাঁদবে ছেলে-স্বামী হাlরানোর জন্য, আমার বউ কাঁlদবে দুনিয়ার বুকে একেবারে নিঃlস্ব হওয়ার জন্য। তেমন আর কেউ নেই। সবাই নিত্যজীবনের প্রতি ব্যস্ত হয়ে আমার মতো মানুষকে ভুলতে বাধ্য। তবে আমার বিশ্বাস তারা সবকিছু সামলে উঠবে। মেয়েদের মনে অদ্ভুত জোর আছে। তারা চাইলে সকল পlরাভূlত শlক্তি টলাতে পারে। তাদের মনোবল নিয়ে বিন্দুমাত্র সংকোচ নেই। আফটার অল, আনসারীর ফ্যামিলি বলে কথা। সেখানে ভঙ্গুর চেহারার নারী মানায় না। তারাও ভাঙ্গবে না বলে বিশ্বাস!

পূর্ব নিরব শ্রোতার মতো সব শুনলো। আজ পযর্ন্ত কেউ তার কাছে এতদূর বক্তা হতে পারেনি। কেউ একনিশ্বাসে বলার সুযোগ পায়নি। সেখানে আজ নির্জীব চেতনার মতো ওয়াসিফ পূর্ব মুগ্ধ হয়ে শুনলো। এই সুপুরুষ ছেলেটার মাঝে অদ্ভুত কিছু গুণাগুণ আছে। তার বাচনভঙ্গি দেখলে ভেতর থেকেই সম্মান কাজ করে। সুপ্রসন্ন ভক্তির মতো টান আসতে বাধ্য করে। পূর্ব মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাহতিমের কাধে ডানহাত রাখলো। বেশ সম্মানের সাথে অনুরক্ত কন্ঠে বললো,

– আবার দেখা হবে তো? দেlশেlর মানুষের মুখে সlত্য উপহার দিয়ে স্বপ্নমহলে আসবেন? আপনার জন্য আমার বাড়ির দরজা সবসময় খোলা। আপনাকে আমার বাড়ির অতিথি হিসেবে পেলে নিজেকে ধন্য মনে করবো। ওয়াদাটা রাখবেন ভাই। আমি জীবনে যেটা করতে পারিনি, তা যেন আপনি করেন। আমিতো অন্যাlয়কাlরীদের ছেlড়ে দিয়েছিলাম। ওদের বিlরুlদ্ধে যাওয়ার মতো ক্ষlমlতা ছিলো না। যেই আপনি সাহস দেখিয়েছেন, যেই উদ্দীপনার সাথে এই কাজে নেমেছে, তাতে আপনার প্রতি গর্ব বোধ করছি। ওদের র‍্যাlকেlটটা এমনভাবে ভেlস্তে দিন, যেন মুখ তুলে তাকানোর স্পlর্ধা না দেখায়।

কথাটুকু বলেই মাহতিমের দিকে ডকুমেন্ট বাড়িয়ে দিলো। মাহতিম সেটা হাতে তুলে জায়গামতো সই করে দিলো। সময় সত্যিই কম, তাড়াতাড়ি বেরুতে হবে। ফাইলটা বন্ধ করে ফিরিয়ে দিতেই অপরদিকে ফোন বাজছে। পূর্ব ফাইলটা নিতে-নিতেই মাহতিমের প্যান্টের পকেটে তাকালো, মাহতিম সংযত ভঙ্গিতে হাত ঢুকিয়ে ফোনটা বের করলো। স্ক্রিনে একপলক তাকিয়ে কলটা রিসিভ করলো সে,

– হ্যালো,

বাকি কথাটুকু ব্লুটুথ ডিভাইসে শুনলো। বাঁ-কানের ওই ছোট্ট ডিভাইসে কি কি কথা শুনলো, তা জানে না পূর্ব। কিন্তু গাড়ির হেডলাইটের আলোয় এটুকু বুঝতে পারলো, নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কিছু হয়েছে। মাহতিমের মুখটা প্রচণ্ড গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। মাহতিম ব্লুটুথ ডিভাইসে কল কাটতেই তাড়াহুড়ো কন্ঠে বললো,

– ব্রাদার আমাকে যেতে হবে। আপনি বেরিয়ে পরুন। সবকিছু রেডি করে দিয়েছি, এখন শুধু মিডিয়ার কাছে পৌঁছবে। আগামীকাল যে বিlধ্বংlসী খেলাটা হবে, সেটার জন্য মন-প্রাণ শক্ত করুন। আমি আসি, আল্লাহ্ হাফেজ ব্রাদার।

পূর্ব কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। কথা বলার সময় নেই। ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। কথা ছিলো দশমিনিটের, কিন্তু পনের মিনিট চলে গেছে। ডকুমেন্টটা নিয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠলো সে, গাড়ির একটা সিক্রেট জায়গায় ডকুমেন্টটা লুকিয়ে রাখলো। মাহতিমও তড়িঘড়ি ভঙ্গিতে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেললো, কেউ কিছু বোঝার আগে তাকে মালিবাগ ছাড়তে হবে। তাড়াতাড়ি দুজনকে আলাদা হতে হবে। অন্তত খবরটা ফাঁস না-হওয়া অবধি কড়া সাবধানতায় থাকতে হবে। একইসাথে দুটো মুখোমুখি গাড়ির ইন্ঞ্জিন স্টার্ট নিলো। রাস্তার ডানদিক বরাবর মাহতিমের গাড়ি ছুটলো, বাঁদিক বরাবর পূর্বের গাড়ি শোঁ-শোঁ করে চললো। নিমিষের ভেতর আলোকিত জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে তলিয়ে গেলো। চর্তুপাশে ছড়িয়ে গেলো ছমছমে নিরবতা।

.

রাত্রি তখন বারোটা। বারোটার চেয়ে এক-দু মিনিট বেশি। রুমের লাইটটা তখনও নেভায়নি। আলমারির বাঁ-পাশটা এলোমেলো হয়ে গেছে। সব জিনিস ফ্লোরে ফেলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছে। তন্নতন্ন করে কিছু শক্ত জিনিস খুঁজছে মেহনূর। এটা-ওটা উলটে-পালটে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। মেহনূর উন্মাদের মতো কিছু একটা খুঁজতেই ফ্লোরে গিয়ে বসলো। আসন পেতে বসতেই কাগজ সরিয়ে-সরিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করলো। একটু আগে আলমারি থেকে একটা উদ্ভট জিনিস পেয়েছে। মাহতিমের ড্রয়ার থেকে এমন একটা কাগজ পেয়েছে, যেখানে খামের উপর হাসপাতালের নাম লেখা। খামের ভেতর যেই কাগজ ছিলো, ওটা পোlস্ট মlর্টাlম রিপোlর্ট। পেশেন্টের নাম ছিলো, ‘ মেহেদি শরীফ আনসারী ‘। তার মানে রিপোর্টটা শ্বশুর মশাইয়ের। কিন্তু অতো পুরোনো রিপোর্ট নতুনের মতো চকচক দেখাচ্ছে কেন? দেখে মনেহলো কিছুদিন আগে তোলা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ এই রিপোর্টের প্রয়োজন পরলো কেন? উনি কি গোঁড়া থেকে কিছু টেনে আনছেন? এবার খুঁজতে-খুঁজতে আরো একটা জিনিস পেয়ে গেলো। একটা এ্যালবাম সাইজের পুরোনো কালের ছবি। ছবির মুখটার সাথে মাহতিমের চেহারায় আংশিক মিল আছে। চোখের তীক্ষ্ম চাহনিটা একদম মাহতিমের মতো। ভদ্রলোকের পড়নে আর্মিদের মতো পোশাক, আরেকজন আর্মি বেশভূষা লোকের কাধে বন্ধুসুলভ হাত রেখেছেন তিনি। দুজনের মুখে স্মিতসূচক হাসি। কিন্তু অন্য লোকটার নাম কি? মনেহচ্ছে শ্বশুর মশাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ছবিটার পেছনে ছোট-ছোট অক্ষরে দুটো নাম লেখা, ‘ Mehedi Sharif Ansari, Jafor Uddin ‘. এই লোকটা নিশ্চয়ই অনেককিছুই জানে। যদি উনাকে কল দেওয়া যায় তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে?

মাহতিম বেজায় স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে। রাস্তায় এখন জ্যাম নেই। ফাঁকা-ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বেসামালা স্পিড তুলেছে, তার ইচ্ছা ঢাকা শহর ছেড়ে কোয়ার্টারমুখী হওয়া। অনেকেই ভাবতে পারে, সামান্য একটা সইয়ের জন্য কেন আসতে হলো? এই সইটা উইলের জন্য। উইলের পেছনে হাত ধুয়ে লেগেছে রজনী। যেহেতু আনসারীর বংশে আর কোন ওয়ারিশ নেই, তাই কয়েক একরসমেত জমিটা জব্দ করতে চাইছে। মালিকানা পাবার উছিলায় উন্মুখ হয়ে আছে। সেই সঙ্গে ধরা পরেছে রজনীর কাlলোবাlজার। রাlজনীlতিতে ক্ষlমতার অপlব্যবlহার করে দিনের-পর-দিন অlস্ত্র-নাlরী-শিlশু-ড্রাlগসেlর আদান-প্রদান চালাচ্ছে। এ মাlমলায় জlড়িত শীlর্ষ চারজন নেlতার নাম কাল খবlরের কাগজে হেlডলাইন হবে। ইতিমধ্যে নিউlজ পোlর্টালের কাছে খাপে-খাপ তথ্য পৌঁছে গেছে। এমন জম্পেশ নিউজ পেয়ে সাংlবাদিlকরা খোশ-আমোদে গদগদ। সোনার হরিণ পাওয়ার মতো সুখবিলাসে ফূর্তি চলছে। অন্যদিকে বাসার জন্য টেনশন করছে মাহতিম। পালটা আlক্রlমণটা নির্ঘাত বাlজেভাবে হবে। যদি ওরা মাlরমুখি হয়ে কোয়ার্টারের দিকে চোখ দেয়? যদিও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে খোদ অশোক সেন জবান দিয়েছেন, উনার উপর বিশ্বাস করা যায়। এবার রইলো উইলের কাগজ। বাঁ-পাশের গদিটা একটান দিয়ে উঠিয়ে ফেললো। সেখান থেকে বড় খামে আঁটা পুরোনো ডকুমেন্টটা বের করলো। ডানহাতে ড্রাইভ করছে বলে সুযোগ পাচ্ছে না। এবার ডকুমেন্টটা তড়িৎবেগে দু’ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরলো সে। মুখে শক্ত করে ধরতেই বাঁ-হাতে খুলে ফেললো সেটা। হঠাৎ পেছন থেকে হর্ণের আওয়াজ শুরু হলো। একনাগাড়ে বাজিয়েই যাচ্ছে হর্ণটা। চকিত হলো মাহতিম! ডকুমেন্টটা কোলের উপর রেখে গাড়ির সাইড মিররে তাকালো। সকালের মাইক্রোটা আবার পিছু লেগেছে। তারাই হুঁশিয়ারি ইঙ্গিতে হর্ণ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? হর্ণ দিয়ে কি বুঝাতে চাইছে? পূর্বকে দেখেছে? না, সম্ভব না। ডকুমেন্টটা বহু পুরোনো বলে কাগজটা হলদেটে হয়ে গেছে, একপাশে এখনো বাবার সইটা দৃশ্যমান। মাহতিম ঢোক গিলে ডকুমেন্টটা রোল পাকিয়ে বাঁহাতে রাখলো। স্টিয়ারিংয়ে হাতদুটো রেখে স্পিডটা ধাপে-ধাপে বাড়ালো। জানালা দিয়ে ঝড়ের বেগে বাতাস ঢুকছে, মাইক্রোটা একই তালে ছুটে আসছে পিছে। ওই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ফোনটা আবার বিপ্-বিপ্ করে বাজছে। ভেবেছিলো কলটা ধরবে না, ইগনোর করবে; কিন্তু কলার আইডি দেখে স্থির রইলো না। সৌভিকের কলটা একদিকে ধরতে দেরি, ওমনেই পেlছন থেকে প্রচণ্ড জোরে ধাlক্কা লাগলো! চূlর্ণবিচূlর্ণ হয়ে পেছনের কাঁচ ভেlঙ্গে সিlটে পরলো। মাহতিম এক মূহুর্ত্তের জন্য পিছু ফিরে পেছনের অবস্থা দেখলো। অন্যদিকে সৌভিক হাসিখুশি হয়ে প্রফুল্লচিত্তে বললো,

– কোথায় আছিস?

মাহতিম ওকে কিছু বুঝতেই দিলো না। কন্ঠে স্বাভাবিকতা রেখে বন্ধুর উত্তরটা দিলো,

– গাড়িতে আছি, গাড়িতে। কখন আসবো জানি না। কি জন্যে ফোন দিয়েছিস সেটা বল।

হাlমlলা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আজ পাশে নোমান নেই। গাড়ি চালিয়ে পালটা এ্যাlকশlনে নামা যাচ্ছে না। অতlর্কিlত গুlলিবlর্ষণ না-করলেও হুটহাট এ্যাlটাlক চলছে। সৌভিক তার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দটা বলতে যাচ্ছিলো, জানাতে চাচ্ছিলো আজ তার কোলজুড়ে ছোট্ট ছেলে ঘুমিয়ে আছে। আজ নিয়তি যেন সুযোগই দিলো না। সৌভিক তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু, তার ভাইতুল্য মানুষ, তার সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিটাকে জানাতে পারলো না। এই বিশাল আনন্দটা বলার আগেই একটা মালবাহী ট্রাক এসে সব চুরমার করে দিলো। ডানদিক থেকে মৃত্যুর মতো সোল্লাসে ছুটে এলো। মাহতিমের গাড়িটা এতো স্পিডে ছিলো যে, আগত গাড়িটা দেখেও মাহতিম ব্রেক কষতে পারেনি। খুব সুন্দর করে ট্রাকটা গগনবিদারী শব্দে খেলনার মতো তার গাড়িটায় ধাlক্কা দিlলো। প্রচণ্ড ধাlক্কায় দ্রুতগামী গাড়িটা শব্দে-সশব্দে ছিlটকাতে-ছিlটকাতে দূরে যেয়ে পরlলো। রাস্তা থেকে বিচ্যুত হবার জন্যে গাড়িটা কয়েক গজ দূরে উlলটে গেছে, চাকাগুলো তখনও উর্ধ্বমুখী হয়ে গোল-গোল হয়ে ঘুরছে। গাড়ির সমস্ত কাঁlচ ভেঙ্গে রাস্তায় ছড়িয়ে গেছে। সেই ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র কাঁচের উপর রlক্তাlক্ত হাতটা নিlষ্প্রাlণের মতো পরে আছে। রlক্তেlর বlন্যায় রাস্তাটা ভেসে যাচ্ছে। গাড়ির ভেতরে তখনও সিটবেল্ট বাঁধা অবস্থায় মাহতিম নিশ্বাস নিচ্ছিলো। চোখের ঘোলাটে দৃষ্টি সবকিছু ঝাপসা দেখছে। একেকটি দম নেওয়ার জন্য প্রাণপণে যুlদ্ধ চালাচ্ছে, বাঁচার জন্য শেষ শক্তিটুকু ক্ষয় করে সচল থাকতে চাইছে। পৃথিবীর বুকে একটুখানি নিশ্বাlসের জন্য হাঁlশফাঁশ করছে মাহতিম, তার শরীর নিস্তেlজের দিকে ভিড়ছে। মুখ খুলে নিশ্বাস নিতেই মানসপটে নৈসর্গিক মূহুর্তগুলো ভেসে উঠলো। তার শৈশবের স্মৃতি, বাবার কাধে চড়ে ঘুরে বেড়ানো, মায়ের কlড়া শাlষন, মাহদিকে প্রথম কোলে নেওয়া, তৌফ-সিয়ামদের অকlথ্য ভাষায় আড্ডা, নীতিদের উপস্থিত বুদ্ধি, সর্বশেষ মেহনূরকে নিয়ে জীবনের মধুর স্মৃতিগুলো। আস্তে-আস্তে দু’চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। মেহনূরের কোমল মুখটা মনে পরতেই দু’ফোঁটা অশ্রু চক্ষুকোল ঘেঁষে পরলো। রlক্তাlক্ত ঠোঁটটা ঠেলে-ঠেলে ক্ষীণভাবে উচ্চারণ করলো,

– মেহ — নূর,

চলমান .

.