#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_১০.
#ফাবিয়াহ্_মমো.
মোমবাতি নিভানোর পর কেবল তপ্ত নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। সেই তপ্ত নিশ্বাসের প্রতিটা ঝাপটা মেহনূরের গালের উপর আছড়ে পরছিলো। মেহনূর বিমূঢ় অবস্থায় বসে থাকলেও মাহতিমের হাতের মুঠোয় ছোট্ট নরম হাতটা শক্ত করে আবদ্ধ ছিলো। মাহতিম কি করতে চাইছে এখনো সেটা অস্পষ্ট, তাই মেহনূর পরিস্থিতির উপর নির্ভর হয়ে চুপচাপ সব সহ্য করছিলোম এমনি সময় হঠাৎ করে মাহতিম নিরবতা চ্ছিন্ন করে একটুখানি কাশলো। কোমল আর্দ্র নরম কন্ঠে অসহায় সুরে বললো,
– আমি যে অসভ্য সেটা আরেকটু প্রমাণ করলাম মেহনূর। তবে সেদিন রাতে এমনই করে তুমি আমার হাতটা ধরতে চেয়েছিলে। সেটা ঘুমের ঘোরেই হোক বা অন্য কোনো কারনে, তুমি কিন্তু আমার হাতে চুমু খেয়েছিলে। আমি যেহেতু অসভ্য, তাই সেটার শোধবোধ নিশ্চয়ই করতে পারতাম। কিন্তু করিনি।
মাহতিম কথাটুকু শেষ করে মেহনূরের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য থামলো। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে মেহনূর ঝরঝর করে কেদেঁ উঠলো, কিন্তু শব্দ হলোনা একটুও। মেহনূরের কান্নার শব্দ যখন হেচকির সুর তুললো, তখন ওই মূহুর্তে আকড়ে ধরা হাতটা মাহতিম ধীরগতিতে উপরে উঠালো। অন্ধকারে মুখও দেখা যাচ্ছিলোনা মাহতিমের, সেই অবস্থায় হঠাৎ করে হাতের উল্টোপিঠে নরম ওষ্ঠের উষ্ণছোঁয়া অনুভব করলো মেহনূর। অস্ফুট শব্দ করে তুমুল আকারে কেঁপে উঠলো সে। কিন্তু মাহতিম সেটা দমন করে মৃদ্যুকন্ঠে বলে উঠলো,
– হিসাব সমান-সমান হলো। সবসময় একটা জিনিস মনে রাখবে, নিজেকে এতোটাও বেকুব বানিয়েও না, যেটা তোমার জন্য ক্ষতির কারন হবে। আজ শুধু একারনেই এসেছি, মলমটা দিয়েছো কিনা সেটা দেখতে। কিন্তু আফসোস, ভংচং করে সেটা আর লাগাওনি। যাইহোক পরবর্তীতে ইনফেকশন হলে শহরে আসার অনুরোধ রইলো। আর পারলে অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো ভুলার চেষ্টা করো। আজকের পর থেকে না তুমি আমায় চিনো, না আমি তোমায় চিনি। পূর্বে যেভাবে ছিলে, সেভাবেই যেনো সব চলতে থাকে। আমি মাত্র কিছুদিনের জন্যই আছি, তাই কষ্ট করে আমার সামনে থেকে নিজেকে একটু দূরে রাখার চেষ্টা করো।
কথা শেষ করতেই হাত ছেড়ে দিলো মাহতিম। সেটা এমনভাবে ছেড়ে দিলো, সেটা যেনো ছুঁড়ে মারার মতো ঘটনা হলো। বিছানা থেকে নেমেই টেবিলের উপর মোমবাতি রেখে দিলো। পাশ থেকে দিয়াশলাই নিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে চুপচাপ ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গিতে চলে গেলো। একবারও পিছু ফিরে তাকালোনা মেহনূরের দিকে। ফিরেও দেখলোনা মেহনূর কতটা আশ্চর্য হয়ে হকচকিয়ে গিয়েছে। হতভম্ব মেহনূর তার হাতটা ঘুরিয়ে উল্টোপিঠের দিকে তাকালো, নাক টেনে বাম হাতের তালুতে চোখ মুছে সেই ওষ্ঠ স্পর্শ করা জায়গাটা দেখতে লাগলো। আজ এবং এই প্রথম বোধহয় পুরুষের স্পর্শ পেলো মেহনূর,হাতের উল্টোদিকটা অনিমেষ নয়নে দেখতে থাকলে আচমকা পুরো রুম আলোকিত হয়ে কারেন্ট চলে এলো। ভেজা চোখে রুমের চারপাশ দেখতেই মনে হলো, এই অন্ধকার, এই কারেন্ট, এই নিস্তব্ধতা যেনো মাহতিমের ইচ্ছায়, স্বেচ্ছায়, ইশারায় হয়েছিলো। এতে যেনো কাকতলীয় ঘটনা ছিলোনা।
.
সকালের নির্মল পরিবেশটা সূর্যের তীব্রতায় দুপুরের দাপটে পরিণত হলো। বাড়িতে আজ বড় করে খাওয়া-দাওয়ার ধুম লেগে গেলো। শুরু হলো রান্নার জন্য মহিলাদের দৌড়াদৌড়ি, পানি আনার জন্য মেয়েদের ছুটাছুটি, সবজি কুটার জন্য সকলের হাতাহাতি একসঙ্গে শুরু হলো সকাল থেকে।সুজলা, শেফালী, মাহমুদা রান্নাঘরে গিয়ে সব কাজ দেখতে লাগলো, মারজা এসে যুক্ত হলো ধনিয়াপাতা বাছার কাজে। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন কাজের একটা এসে পরলো শেফালীর কাধে। কচুর লতি কাটার মতো ভয়াবহ চুলকানির কাজটা শেফালীর করতে হবে। উপায় ঠাহর করতে না পেরে ডালাভর্তি কচু এনে আঙিনায় এসে বসলো তখন। এদিকে শানাজ, সাবা, সুরাইয়া, মেহনূর উঠানের দিকে বড়ই পারার কাজে ছিলো, হঠাৎ সেদিকে চোখ পরতেই শেফালী এক হাঁক দিয়ে সবগুলাকে আঙিনায় এনে হাজির করলো। শানাজ কচুর ডালা দেখেই বুঝে যায় মেজো মা এখানে খাটাতে ডেকেছে। শেফালী সবগুলার দিকে তিরিক্ষি দৃষ্টি ছুড়ঁলে শেষমেশ প্রতিশোধের মেজাজটা মেহনূরের উপর ফলিয়ে বললো,
– এ্যাই ঢঙি, এইদিকে আয়। এই পিড়িতে বসতে পারবিনা তুই? নাকি কোমর নিয়া টাফালিং করবি?
মেহনূরের ঘা-টা সকাল থেকেই শুকিয়ে আসছে, কিন্তু বেশি চাপের কাজ করলে জায়গাটা ফের কাঁচা হয়ে যাবে। মেহনূরের ওমন নিরবতার দেখে ধমকে উঠলো শেফালী। একসঙ্গে চারবোনই প্রচণ্ডরূপে ভয়ে চমকে উঠলো। মুখ কালো করে চোখ নিচু করে সবাই কাঁচুমাচু করছিলো। কিন্তু শেফালী সেটা ভঙ্গ করে হাত ধরে টেনে মেহনূরকে পিড়িতে বসিয়ে দিলো। রান্নাঘরের দিকে একপলক দৃষ্টি দিয়ে মাথার ঘোমটা আরেকটু মাথায় টেনে এবার বাকি তিনজনের দিকে ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো। কপাল কুঁচকে এমন গালি দিলো কেউ আর দাড়ালো সেখানে। মেহনূর জানে, সে যদি এই মূহুর্তে একটা টু শব্দ উচ্চারণ করে তাহলে ঠাস করে চড় মারতেও এই মহিলা দেরি করবেনা। বাড়িতে সৌভিক, নীতিরা গ্রাম দেখতে মাইক্রো নিয়ে বেরিয়েছে। কাছাকাছি সুন্দর জায়গাগুলো দেখতে কিছুসময়ের জন্য বাইরে গেছে। মাহতিমও জিপ নিয়ে কিছু সময়ের জন্য ভিজিটিং স্পট দেখতে গিয়েছে। এদিকে ঘন্টার-পর-ঘন্টা কচু কেটে হাত কালো হয়ে যায় ওর, মারাত্মক চুলকাতে শুরু করে হাতের তালু। একদিকে হাত চুলকাতে থাকে, অন্যদিকে কাত থাকে কচু। দূর থেকে শানাজ, সাবা সব দেখলেও মেজো মার ভয়ে একপাও এগুতে পারছেনা, অপরদিকে সুরাইয়া শেফালীর সাথে চৌকিতে বসে এ্যালোভেরার জেল বের করছে। ফেসপ্যাকের জন্য চন্দন গুড়া, মুলতানি মাটি মিক্স করে সেখানে এ্যালোভেরার জেল নিংড়ে রাখছে। হঠাৎ আরো উপাদান মিশানোর জন্য শেফালী দ্রুত মেয়েকে নিয়ে ঘরের মধ্যে চলে গেলো। ঠিক ওইমূহুর্তেই জিপের শব্দ তুলে মাহতিম এসে ভিড়লো। কানে ফোন এঁটে পকেটে হাত গুঁজিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বাড়িতে ঢুকলো মাহতিম। মেহনূর যে আঙিনার মাঝখানে বসে কচু কাটার যন্ত্রণায় হাঁশফাস করছিলো সেটা একপলকের জন্যও দৃষ্টিগোচর হলোনা মাহতিমের। দ্রুতপায়ে আঙিনা পেরিয়ে সোজা সিড়ি ধরে উপরে উঠলো, ওই অবস্থাতেই রুমের দরজা খুলে সেটা ভিড়িয়ে দিলো। মেহনূর আড়চোখে মাহতিমের কীর্তিকলাপ পর্যবেক্ষণ করলেও এই মূহুর্তে বীভৎস জ্বালায় নাস্তানাবুদ হয়ে গেলো। কাজ শেষে পুরো হাত কালো কুচকুচে হয়ে তীব্র চুলকানিতে বিষিয়ে উঠলো। এদিকে কলপাড়ে যেয়ে নিরব চিত্তে হাত ধুচ্ছে মেহনূর। সাবা কল চেপে দিলে শানাজ মগ কাত করে ওর হাতে পানি ঢালছে। শানাজ রাগে গজগজ করতেই ক্ষীপ্র সুরে বলে উঠে,
– মেজো মা এই কাজটা ইচ্ছে করে করলো। সে ঠিকই জানতো তোর অবস্থা এখন খারাপ, আর তুই কচু কাটার জন্য উপযোগী না। এই বদমাইশ মহিলা আমাদের শান্তি দিলো না মেহনূর, একটুও শান্তি দিলো না। কাকা যে কেমন বজ্জাত মহিলাকে বিয়ে করেছে সেটা যদি এক ইঞ্চি কাউকে দেখাতে পারতাম? পোড়া কপাল! কেউ জানেও না এই শয়তান মহিলা আমাদের তিনজনকে খাটিয়ে মারছে। অথচ দ্যাখ, নিজের মেয়েকে রূপচর্চা করাচ্ছে। ফালতু মহিলার জায়গায় এখন সুরাইয়ার উপর জিদ উঠে! কষিয়ে যদি মারে পারতাম? হারামিটা কেমন পল্টি মেরে মায়ের সাথে ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে গেলো। এমন বোন কিভাবে জুটলো রে মেহনূর? আমাদের সাথে থাকার পরও এতোটা নির্লজ্জ, বেহায়া, স্বার্থপর হয়েছে সেটা মুখে বলতেও লজ্জা করে। দেখি তুই উঠ, আর হাত ডলিস না।
শানাজ মগটা সাবার হাতে দিয়ে কলপাড়ের টুল থেকে মেহনূরকে দাড় করিয়ে দিলো। দুবোন একসাথে যখন ভেতরে ঢুকে রুমের দিকে গেলো, তখন শানাজ রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে অবাক হয়ে দাড়িয়ে পরলো। চৌকির কাছে ফেসপ্যাকের কাছে মাহতিমকে কি যেনো করতে দেখলো। শানাজ কৌতুহল হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
– ভাইয়া? আপনি ওটা কি করছেন?
মাহতিম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ফেসপ্যাকের বাটিটা নাকের কাছ থেকে সরিয়ে নিলো। দৃষ্টি তুলে শানাজের দিকে তাকিয়ে ফেসপ্যাকের বাটি দেখিয়ে বললো,
– এগুলো কি জিনিস সেটাই বুঝার চেষ্টা করছি। আচ্ছা এগুলো কি কোনো মশলা? রান্নার কাজে দিবে?
ফেসপ্যাক নিয়ে এমন উটকো প্রশ্ন শুনে মৃদ্যুভঙ্গিতে হেসে দেয় শানাজ। এগিয়ে এসে মাহতিমের উদ্দেশ্য বলে উঠে,
– ভাইয়া এগুলো রূপচর্চার জিনিস। আপনি চাইলে আপনিও দিতে পারেন। তবে আপনার না দিলেই ভালো হবে। আপনিতো এমনেতেই হ্যান্ডসাম।
মাহতিমও সৌজন্যের সঙ্গে হেসে দিয়ে ফেসপ্যাকের বাটিটা চৌকির উপর রেখে দিলো। শানাজও রান্নাঘর থেকে লেবুর টুকরো নিয়ে রুমের দিকে চলে গেলো। কিন্তু বিপত্তি শুরু হলো বিশ মিনিট পর। এক তুমুল চিৎকার দিয়ে বাড়িঘরের নিরবতা ক্ষুণ্ণ হয়ে গেলো। হাউমাউ করে চিৎকার করতেই দাপাদাপির শব্দ শোনা গেলো নিচ থেকে! কেউ গলা ফাটিয়ে ‘ মা, ও মাগো, বাঁচাও ‘ বলে আহাজারি করছে। শানাজ,সাবা, মেহনূর তৎক্ষণাৎ রুম থেকে বেরিয়ে সিড়ি ধরে নিচে নামে। কোমরের ব্যথার জন্য আবারও জায়গাটা চিনচিন করে উঠলে মেহনূর সেটা দাঁতে কামড়ে নিচে এসে হাজির হয়। এসেই দেখে শেফালী পাগলের মতো কপাল চাপড়ে ‘ হায় হায় ‘ করছে। অন্যদিকে সুরাইয়া মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে কান্নারত অবস্থায় দুগাল চুলকিয়ে যাচ্ছে। সুজলা এসেই ভেজা আচঁল দিয়ে ওর ফেসপ্যাক তুলে চুপ করার জন্য সান্ত্বনা দিচ্ছে। মাহমুদা চটজলদি কলপাড় থেকে ঠান্ডা পানি এনে মুখ ধুয়াতে থাকে। মারজা দ্রুত শেফালীকে ঠান্ডা হতে বলে। শানাজ এতোটা আশ্চর্য হয়ে যায় সে আর কিছুই বলতে পারলোনা। সাবাও মুখে দুহাত দিয়ে বিস্ফোরণ চাহনিতে তাকিয়ে আছে। মেহনূর কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও পুরো ঘটনা নিয়ে মন খচখচ করতে থাকলো। কি মনে করে যেনো, অপজিট দোতলায় তাকালো, ওমনেই দেখতে পেলো বারান্দার রেলিংয়ে দুহাত ফেলে মাহতিম শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টিতে চোখাচোখি হতেই মাহতিম অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাঁকা হেসে দিলো।
#চলবে
#FABIYAH_MOMO
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_১১.
#ফাবিয়াহ্_মমো.
মাহতিমের ধূর্ত চালটা কেউ বুঝতে পারলো না সেদিন। সুরাইয়াকে কঠিন শিক্ষা দিয়ে চুপচাপ কেটে পরেছে সেখান থেকে। শেফালীও এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তুলকালাম ঝগড়া সৃষ্টি করেছে। কিন্তু হান্নান শেখের ভয়ে ঝগড়াটা আর বাড়তে পারেনি। সুজলা কঠিন গলায় শেফালীকে কড়া ভাষায় কথা শুনিয়ে দমিয়ে দিয়েছে সেদিন। রাতের খাবার শেষে হান্নান শেখ মারজার কাছ থেকে পুরো ঘটনা জানতে পারলেন। সুরাইয়ার ফেসপ্যাকে বিচুতি পাতার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, আর সেটা ব্যবহারের ফলেই সুরাইয়ার মুখে মারাত্মক চুলকানি শুরু হয়েছে। মেহনূর নিরব মুখে সবার অবস্থা অবলোকন করলো, শেষমেশ নিজের খাবারটা মায়ের হাতে খেয়ে বিছানায় যেয়ে শুলো। জানালাটা খুলে পুরো পর্দা সরিয়ে অন্ধকার রুমটা স্বল্প আলোয় পরিপূর্ণ করলো। শান্ত নিবির বড়-বড় চোখদুটোর দৃষ্টি আকাশের দিকে ফেললো। মনের মধ্যে জট বাঁধানো প্রশ্নগুলো নানাভাবে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। মাহতিমের আচরণ নিয়ে প্রচণ্ড দ্বিধায় ভুগছে মেহনূর। লোকটা কখনো সভ্যতার সাথে কথা বলে, কখনো অসভ্যতার মতো নিজেকে জঘন্য প্রমাণ করে যায়। আসলে লোকটা কি চায়, কি নিয়ে এমন দুমুখো আচরণ করে সেটাই কোনোভাবে মাথায় ঢুকছেনা ওর। বাড়িতে অতিথি আসার পর থেকে দাদাভাইয়ের সাথেও আড্ডা দিতে পারছেনা মেহনূর। এদিকে পড়াশোনার দিকেও ধ্যান দেওয়া জরুরী, কিন্তু বারবার ওই অসভ্য লোকটার কথা মনে পরার কারনে বইয়ের পাতা ওল্টাতেও ইচ্ছে করেনা। যখন-তখন, যেখানে-সেখানে ম্যাজিক ম্যানের মতো উপস্থিত হয় লোকটা, আবার অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বেপরোয়া ভঙ্গিতে চলে যায় তৎক্ষণাৎ। বয়সের দিক দিয়ে লোকটা খুব বেশিই বড়, কিন্তু চরিত্রের দিক দিয়ে যেনো সবচেয়ে ছোট। কে জানে আগামী দিনগুলোতে কি কি অপেক্ষা করছে ওর জন্য।
.
পরদিন সুরাইয়ার অবস্থা বেগতিক হয়ে উঠলো। গালের চামড়া লাল হয়ে কয়েক জায়গায় ছিলে গেলো। কোনোভাবেই চুলকানির আচঁ পুরোপুরি কমলো না ওর। তরুণ কাল সন্ধ্যার দিকে যখন আসলো, সুরাইয়ার এমন অবস্থা দেখলো, তখ সে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কিভাবে এমন অবস্থা হলো কেউ সে ব্যাপারে বলতে পারেনা, কিভাবে বিচুতি পাতা ফেসপ্যাকে মিশে গেলো কেউ সেটা জানেনা। নীতি, সৌভিক, সিয়াম, তৌফ সকলের অগোচরে মূখ্য ব্যক্তিকে চিনে ফেলেছিলো ততক্ষণে। কে এই কাজ করেছে, কেনো এই বিচুতি পাতা মিশিয়েছে সবই কাটায়-কাটায় বুঝে গেলো। সাবির, সামিককে এই ঘটনার ব্যাপারে জানানো হলে অবাকে নিবার্ক হয়ে যায় তারা। হান্নান শেখ বাড়িতে না থাকলেও তাঁর আদেশে তৎক্ষণাৎ সুরাইয়াকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যায় তরুণ ও শেফালী। সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে নীতি তখন মাহতিমের রুমে যায়। মাহতিম বিছানায় শুয়ে খবরের কাগজ পরছিলো, নীতিকে দেখে চট করে একটা পাতা উলটে পড়তে লাগলো। নীতি এসে বিছানায় বসলে মাহতিমের দিকে তীক্ষ্ম নজরে তাকালো। দৃষ্টি তীক্ষ্ম করে শান্ত গলায় বলে উঠলো,
– ভাইয়া, তুমি সুরাইয়ার ফেসপ্যাকে বিচুতি পাতা মিশিয়েছো কেনো? ওর এই অবস্থা তুমি কেনো করলে? মেয়েটাকে এইভাবে কষ্ট দেওয়ার মানে আছে?
ডার্ক নেভি ব্লু জিন্স, হাঁটু পযর্ন্ত কালো টপস, গলায় কালো রঙের ওড়নাটা একপাক পেঁচিয়ে বুকের দুপাশে ঝুলিয়ে রেখেছে নীতি। চুলটা সম্পূর্ণ পেছনে নিয়ে ডানপাশে একটা ফ্রেন্ঞ্চ বেণি করে রেখেছে সে। বোনদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান বোন নীতি হলেও আদরের দিক দিয়েও সবচেয়ে কাছের ও। মাহতিম ওর প্রশ্ন শুনে এমন একটা ভান করলো যেনো কানের মধ্যে কিছুই ঢুকেনি। নীতি তার ভাইয়ের এমন আচরণ দেখে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে ছোঁ মেরে খবরের কাগজটা নিয়ে ফেললো। সেটা তিনভাঁজ করতে থাকলে মাহতিম চোখ রাঙিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো,
– এসব কি হচ্ছে? হাত থেকে নিলি কেন? আমিযে এটা পড়ছি সেটা তুই চোখে দেখতে পাচ্ছিস না?
নীতি বিছানা থেকে উঠে ভাঁজ করা কাগজটা নিয়ে টেবিলের উপর রেখে আসলো। পুনরায় ওর পাশে বসে কিছুটা শক্ত কন্ঠে বললো,
– তুমি একজনের দোষে আরেকজনকে কষ্ট দিচ্ছো কেন? তুমি কাল কি করেছো আমি সেটা বুঝিনি ভেবেছো? তুমি সুরাইয়ার ফেসপ্যাকে বিচুতি মিশিয়েছো কেনো?
মাহতিম ওর কথার ভঙ্গি দেখে চোখ ছোট করলো। এটিটিউট স্টাইলে কঠোর ভঙ্গিতে মাথার নিচে দুহাতের তালু রেখে চোখ বন্ধ করলো। ঠোঁট ভেদ করে ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
– বাইরে বিচুতির স্টক বেশি ছিলো। তাই চিন্তা করলাম এগুলো একটু মানবতার কাজে ব্যবহার করলাম।
নীতি এমন উলটা উত্তর মোটেই আশা করেনি। শেষে নিজেই উত্তরের কপাট খুলে তেজালো গলায় বললো,
– তুমি আমাকে একটা সত্য কথা বলবে ভাইয়া? তুমি জাস্ট এই উত্তরটা ঠিকমতো দিবে, তুমি কি মেহনূরকে পছন্দ করো? আমি কোনো মিথ্যা শুনতে চাইনা। আবার জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি মেহনূরকে পছন্দ করো?
নীতির এমন ঠাস-ঠাস প্রশ্ন শুনে তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে তাকালো মাহতিম। মাথার নিচ থেকে দুহাত সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো ধীরগতিতে। কপালে কয়েকটা ভাঁজ ফেলে কিছুক্ষণ নিরব দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগলো। এদিকে নীতি যতই সাহস দেখাক না কেনো, মাহতিমের ওমন চুপটি দেখে ভয়ে অবস্থা টাইট হচ্ছিলো। যদি মাহতিম ধুম-ধাম করে চড় মারলো তখন? নীতি আস্তে করে ঢোক গিলতেই মাহতিম হঠাৎ গলা চড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
– তুই কি দিনদিন গাধা হয়ে যাচ্ছিস নীতি? তুই আমাকে কেমন প্রশ্ন করলি এটা? আমি কিনা ওই রামবলদকে পছন্দ করবো? ওর মধ্যে কি আছে যে আমি পছন্দ করবো?
নীতি বাঁ ভ্রুঁ-টা উপরে তুলে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো। মাহতিম ওর ভঙ্গি দেখে কিছুটা অপ্রতিভ হলো, কিন্তু সেটা একটুও বুঝতে না দিয়ে চড়ানো সুরেই বললো,
– ওকে একটা ফ্রক পরিয়ে দিস। তাহলেই বুঝতে পারবি এমন কথা কিজন্য বলছি।
নীতি মুখ শক্ত করে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বললো,
– আহা, নিজে যে কত্তো বড় ফন্দিবাজ সেটা তো আমি বুঝে গেছি ভাইজান। আমার সামনে এমন নাটক না করলেই পারো। ওকে যদি ফ্রক পরিয়ে তোমার সামনে আনি তাহলে তো তুমি ঠিক থাকতে পারবেনা সোনা ভাই।
মাহতিম ওর মুখ কুচঁকানো বিরক্তি ভঙ্গির কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো। সশব্দে হাসতে থাকলে নীতি আরো বিরক্ত হয়ে বললো,
– একদম হাসবানা ভাই, একদম হাসাবানা! তুমি খুবই খারাপ! ওকে দেখলে যে তোমার দিল কুড়কুড় করে, সেটা আমি কালকের ঘটনা দিয়েই বুঝে গেছি। ওর মেজো মা ওকে কচুর লতি কাটিয়েছে বলে তুমি এইদিকে মেজো আন্টির মেয়ের উপর শোধ তুলেছো। এটা তুমি ভালো করোনি ভাই। শেফালী আন্টির দোষের জন্য তুমি সুরাইয়াকে ভিক্টিম বানিয়েছো, এটা তুমি একদম ঠিক করোনি।
হঠাৎ হাসি থমকে গেলো মাহতিমের। চেহারার উপর থেকে হাসির আভাসটুকু মুছে গেলে শান্ত-স্থির ভঙ্গিতে মাহতিম বলে উঠে,
– তুই আমাকে শিখাবি আমি কি করবো, না-করবো? শেফালী আন্টির মতো ব্যক্তি আমাদের বাড়িতে চাকরানী হওয়ারও যোগ্যতা রাখেনা। কেমন বজ্জাত ধরনের মহিলা তুই দেখছিস? আমিতো ভাবতেও পারিনা এই মহিলা এতোদিন ধরে বাড়ির প্রতিটা মেয়েকে জ্বালিয়েছে। আচ্ছা মহিলা যে এমন ঘটনা ডেলি-ডেলি করতো সেগুলো কি কারোর চোখে পরেনি?
নীতি হতাশার সাথে নিশ্বাস ছাড়তেই বললো,
– মনে হয়না। কারন, এই মহিলা প্রচুর চালাক। কিভাবে ওদের ভয়ের মধ্যে রেখেছে সেটাতো দেখতেই পাচ্ছো। আর বিশেষ করে মেহনূরকে এই মহিলা সহ্য করতে পারেনা।শি ইজ ফার্স্ট্রেড।
শেষোক্ত কথা শুনে মাহতিম আবার প্রশ্নসূচকে তাকালো। দুচোখের ভেতর কৌতুহল ফুটিয়ে জিজ্ঞাসা সূচকে বললো,
– কেনো ফার্স্ট্রেড? এই মহিলার সমস্যা কি? ওর সাথে এতো ঘেঁষাঘেষি কিসের?
নীতি আবার চোখ ফিরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো। প্রশ্নবিদ্ধ ভঙ্গিতে কিছু চিন্তা করতেই ফট করে বললো,
– শানাজ বলতে পারবে ভাইয়া। আমি এ ব্যাপারে জানিনা। কিন্তু যতদূর বুঝলাম, হিংসার জন্যই সম্ভবত এমন আচরণ করে। আর মেহনূর তো চাপা স্বভাবের। ওর সাথে টিংটিং করতে মহিলার একটু বেশি মজা লাগে।
মুখ ভার করে কিছু চিন্তা করতে লাগলো মাহতিম। নীতি আর কথা উঠালো না এ বিষয়ে। চুপচাপ রুম থেকে চলে গেলে মাহতিম আবার বিছানায় শুয়ে পরে।
আকাশের তপ্ত সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তে চলে এসেছে। আকাশের রঙটা গোলাপী আভায় ছেয়ে গেছে। প্রকৃতির দাপুটে ভাব কমে গিয়ে শান্ত-নির্জনে পরিণত হয়েছে। সবাই চা-নাস্তার জন্য আঙিনায় বসে গল্পগুজব করছে। সৌভিকরা বাইরে এসে ডানদিকের পুকুরঘাটে আড্ডা বসিয়েছে। পুকুরটা হান্নান শেখ নিজের টাকায় পরিবারের জন্য বানিয়েছে। পুকুরের চারপাশে সবুজ ঘাসের পাশাপাশি সারি সারি নারকেল গাছও দাম্ভিকতার সাথে দাড়িয়ে রয়েছে। সঙ্গে সুউচ্চ সুপারি গাছও রয়েছে কয়েকটা।পুকুরের কিনারায় গোল হয়ে ঘাসের উপর বসেছে সৌভিক ও শানাজরা। মাহতিম একটা জরুরী কাজে ঘন্টা আগে শহরে গিয়েছে। তাই বাড়ির আনাচে-কানাচে শান্তিমতো মেহনূর ঘুরতে পারছে। সৌভিক, নীতি, সাবির, প্রীতি, সামিক, সাবা, সুরাইয়া, মাহদি, শানাজ ও ফারিন পরপর একসাথে বসেছে। মাঝখানে তেঁতুল, বড়ই, চালতা, আমের বিভিন্ন আচার সাজানো রয়েছে। সবাই যখন বিকেলের আড্ডায় বাইরে বসে মত্ত, মেহনূর তখন গোয়ালঘরে চৌকির বিছানায় ‘ শাপমোচন ‘ নিয়ে মগ্ন। তরুণ দুপুরের ঘুম শেষে কলপাড়ে এসে হাত-মুখ ধুতেই দূরে আড্ডারত সাবার দিকে তাকালো। সাবার গায়ে নীল রঙের শাড়ি, সাদা রঙের পাড়, ব্লাউজটা সাদা, চুলগুলো একপাশে বেণী করা। চোখদুটোতে কাজল দেয়া, হাতে সাদা রেশমী চুড়ি, কানে ছোট্ট পাথরের টপ পরা এবং পাদুটো খালি। ব্লাউজের পেছন গলাটা একটু বড় বিধায় খালি পিঠটা দেখা যাচ্ছে। সেটাই চাপকল চেপে পানি তুলার সময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে তরুণ। ওমন উন্মুক্ত পিঠটা দেখে তাল সামলাতে পারছেনা ও। কেমন ঝিমঝিম করা অস্থিরতা কাজ করছে শরীরে। তরুণের উৎদ্ভট দৃষ্টিটা হঠাৎ তৌফের নজরের পরলো। তৌফ প্রথমে মনের ভ্রম ভাবলেও শেষে ঠিকই আবিষ্কার করলো যে, তরুণ সাবার দিকেই তাকিয়ে আছে। তৌফ সাথে-সাথে সিয়ামকে একটা গুতা মারলো। সিয়াম গুতা খেয়ে তৌফের দিকে তাকালে ওর স্থির দৃষ্টি লক্ষ্য করে জায়গামতো তাকালো। তৌফ ও সিয়াম একসঙ্গে যখন তরুণের অবস্থা দেখছিলো তখন হুট করেই সৎবিৎ ফিরে পেলো তরুণ। তাড়াতাড়ি দৃষ্টি সরিয়ে চুপচাপ পায়ে পানি ঢেলে ভেতরে চলে গেলো ও। সৌভিক আড্ডার মজলিশে হঠাৎ শানাজের উদ্দেশ্যে বললো,
– শানাজ? তোমরা মেহনূরকে একা রেখে এসেছো কেনো?ওকে নিয়ে আসলে কি সমস্যা হতো? আমরা তো বড় ভাই ছাড়া কিছুই না। তাছাড়া আমরা এক হিসেবে রিলেটিভও। যাও তো, ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এসো। আমাদের সাথে বসুক, মিশুক, কথা বলুক। ধীরেধীরে ওর জড়তা কেটে যাবে।
শানাজ এমন কথা শুনে কিছু বলতে নেবে হঠাৎ সাবা ওর হাত ধরে মিনতি সুরে বললো,
– বুবু, ওকে নিয়ে আসি চলো। ও শুধু-শুধুই ভাইয়াদের সামনে আসতে চাইছেনা। ভাইয়ারা তো খারাপ মানুষ না। চলো না, ওকে নিয়ে আসি?
শানাজ কিছুক্ষণ চিন্তা করে শেষমেশ সাবার সঙ্গে উঠে দাড়ালো। সৌভিকও ওদের পিছু-পিছু এসে গোয়ালঘরে ঢুকে মেহনূরকে সুন্দরমতো বুঝিয়ে আড্ডায় জয়েন্ট করালো। এই প্রথম আড্ডার মজলিশে বসে মেহনূরের একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো, কিন্তু পরক্ষণে সকলের সাথে ধীরেসুস্থে মিশতে গিয়ে হালকা-পাতলা আলাপ হয়ে গেলো। আড্ডার এক পর্যায়ে সুরাইয়া হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
– আচ্ছা, মাহতিম ভাইয়া কি করে?
তৌফ যেই কাঠিন্য মুখে উত্তর দিবে তখনই সিয়াম ফট করে উত্তর দিয়ে বলে,
– ঘুমায়, খায়। এখন একটা বউ পেলে কোলবালিশ বানিয়ে শুইতো।
সিয়ামের হাস্যকর উত্তর শুনে একযোগে হেসে দিলো সবাই। শুধু হাসলোনা সুরাইয়া। মুখটা পেচাঁর মতো কুচঁকে আবারও প্রশ্ন গলায় বললো,
– বলো না, সে কি করে? এটুকু বলতে কি সমস্যা?
সবার হাসির রোল তখনো বিরাজ করছে। সুরাইয়া নিরুত্তর ভঙ্গিতে মুখ কালো করে থাকলে হঠাৎ পেছন থেকে শক্ত গলার আওয়াজ আসে,
– আমি কি করি সেটা তোমার জেনে লাভ কি? আমাকে নিয়ে এতো টেনশন কেনো?
ক্যাটক্যাট গলার স্বর শুনতেই কর্পূরের মতো হাসি উড়ে গেলো সবার। সুরাইয়া ভয়-ভয় চাহনিতে মাথা পিছনে ঘুরিয়ে দেখে মাহতিম দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে। সবাই যখন মাহতিমের দিকে তাকিয়ে ছিলো, মেহনূর তখন ঘাস ছিঁড়ে সেগুলো টুকরো-টুকরো করছিলো। মেহনূর যে ইচ্ছে করেই ইগনোর করার মতলবে আছে সেটা বুঝে গেছে মাহতিম। তাই আর সেদিকে না এগিয়ে যেখানে ছিলো সেখান থেকেই বলে উঠলো,
– আমি বর্তমানে —
কথার মাঝখানে আকস্মিকভাবে দাড়ি বসালো সিয়াম! ওমনেই ঝড়ের বেগে উত্তর দিয়ে বললো,
– মাহ-মাহতিম আসলে বিজনেস-ম্যান। ও বাবার ব্যবসা দেখে। আঙ্কেলের বড় ব্যবসা তো, তাই সেগুলো এখন মাহতিমই দেখাশুনা করে।
সিয়ামের কথা শুনে মাহতিম তৎক্ষণাৎ তাজ্জব বনে গেলো। নীতি চোয়াল ঝুলিয়ে অবাক হয়ে গেলো, প্রীতি আমের আচারে কামড় দিতে গিয়ে থেমে গেলো, সৌভিক মুখ ঘুরিয়ে সিয়ামের দিকে তাকালো, তৌফ বিস্ফোরণ চাহনিতে তেঁতুল চুষতে ভুলে গেলো, সাবির মিটিমিটি করে হাসতে থাকলো, মাহদি সিওসি খেলা বাদ দিয়ে সবার ওমন আহাম্মক মার্কা চেহারা একে-একে দেখতে লাগলো। সবার চেহারা যখন অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো, তখন সিয়াম সবার দিকে দৃষ্টি দিতেই চাপা কৌতুহলে বললো,
– গাইজ, তোমরা আমাকে সেলিব্রেটির নজরে দেখছো কেনো? আমি এখনো সেলিব্রেটি হইনি।
সিয়ামের কথা শুনে মাহতিম তৎক্ষণাৎ পা থেকে স্যান্ডেল খুললো। ওই দৃশ্য দেখে সিয়াম তোতলানো সুরে বলল,
– দো-দো-দোস্ত, তুই স্যান্ডেল খুলিস কেন? আমি তো মিথ্যা কথা বলিনি। আরে ভাই, পায়ের জুতা পায়েই রাখ, আমারে মারিস না। মাহতিম রে!! ওই সৌভিক, হালা ধরোস না ক্যান!
সিয়ামের ভয়ার্ত অবস্থা দেখে সবাই হো হো করে হেসে দিলো। সবাই যখন তীব্র হাসিতে লুটোপুটি খাচ্ছে তখন তৌফ হাসির ছলে সিয়ামের কানের কাছে মুখ এনে বললো,
– তুই মিথ্যা বললি ক্যান বেটা? ওর হাতে কষানো থাবড়া খাওয়ার ইচ্ছা জাগছে নাকি?
সিয়াম খিচিমিচি করে দাঁত চিবিয়ে নিচু স্বরে বললো,
– পল্ট্রি মুরগী যদি জানে মাহতিম ময়না কি কাজ করে, তাহলে আর বিয়া খাওয়ার স্বপ্ন দেখা লাগবোনা চান্দু।
তৌফ হঠাৎ হাসি থামিয়ে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
– মানেটা কি বুঝাইলি? ওর জবের সাথে বিয়ের সম্পর্কটা ক্যামনে হইলো?
সিয়াম গলার স্বর আরো নিচু করে সর্তকতার সঙ্গে বললো,
– পল্ট্রি মুরগী এমনেই ওরে শেয়াল ভাইবা ভয় পায়। আর যদি শুনে মিয়াচান একটা বাঘ, তাইলে বাপু ওর কপালে আর এইটার সাথে বিয়া করা লাগবো না।
সিয়াম ও তৌফ সবার অগোচরে চোরের মতো গোপন আলাপ সারছে। এদিকে সবাই আচার খাওয়া নিয়ে মাহতিমের দিকে ঘুরে হাসাহাসি করে কথা বলছে। শুধু মেহনূর ঘাসের দিকে দৃষ্টি রেখে অসহায়ের মতো কচিপাতা খুঁটছে, হাসির জন্য তৌফ ও সিআমের কথা একচুলও শোনা যাচ্ছেনা। তৌফ সিয়ামের মিথ্যা বলার মর্মটা অনেকক্ষন পর বুঝতে পারলো। অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে ঘাসের দিকে দৃষ্টি দিয়ে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়াতে লাগলো। সেই অন্যমনার ভঙ্গিতে কন্ঠ নামিয়ে বললো,
– তাহলে মাহতিমের পরিচয় গোপন রাখা লাগবো, রাইট? কিন্তু মারজা আন্টি কি এতোদিনে ওর জব নিয়ে কথা উঠায়নি ভাবছোস? যদি আন্টি মেহনূরের মা-কে সব বলে দেয়, তাহলে মেহনূরের জানতে দুই সেকেন্ডও লাগবো না।
সিয়াম সাথে সাথে তৌফের মাথায় চাট্টি মেরে কর্কশকণ্ঠে বললো,
– পজিটিভ ভাবতে পারোস না বা*? আন্টি যদি বইলাই থাকে তাহলে এমন ব্যবস্থা করা লাগবো যেনো মেহনূর জানতে না পারে।
ওদের দুজনের মধ্যে ফুসুর-ফুসুর চললেও মাহতিম একটাবারের জন্যও মেহনূরের মুখ দেখতে পেলো না। মেহনূর ভুলেও পিছু ফিরে মাহতিমের দিকে তাকালোনা। এমন সুক্ষ অবহেলা দেখে মাহতিম রুক্ষ মেজাজে বাড়ির দিকে চলে যেতে লাগলো। সবাই আবার গোল আকারে বসে আড্ডা জমিয়ে দিলে মেহনূর বামে দৃষ্টি ফেলে সর্তকতার সাথে মাহতিমের যাওয়াটা একমনে দেখতে লাগলো। সেই দৃষ্টির মধ্যে ছিলো কিছুটা ভয়, কিছুটা অবহেলা, কিছুটা সংকোচ মনের উৎকন্ঠা। বারবার এই লোকটা এমন কায়দায় হাজির হয়, সেটা আগে থেকে বলা যায়না। কিন্তু চলে গেলে মনেহয় কোথাও যেনো শূন্যতা এসে ভর করেছে। সেই শূন্যতা যেনো হাড়ে-হাড়ে টের পাইয়ে দেয়, তাকে আগলে রাখো, আগলে ধরো, আগলে-আগলে দেখো তাকে। দেখার জন্য বিধিনিষেধ নেই মেহনূর, ছোট্টমনেই দেখো তাকে।
.
সুনশান রাত। বাইরে ঘুঘুর ডাক শোনা যাচ্ছে।বাড়ির সবাই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেছে। কেউ জেগে নেই এমন নিশিপ্রহরে। আকাশটা চাঁদশূন্য হয়ে ঘুট্ঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে। কোথাও আলো নেই গ্রামের আনাচে-কানাচে। এমন সময় পানির তেষ্টায় চোখ খুললো মাহতিমের। শয্যা ত্যাগ করতে ভারী বিরক্ত হলো সে। কিন্তু পানির জন্য গলাটা মারাত্মক শুকিয়ে আছে। নিরুপায় হয়ে বিছানা থেকে পানির জন্য নামতে হয়েছে। আজ ভুলবশত এ ঘরে পানি দিয়ে যায়নি। যার বদৌলতে এমন উটকো সময়ে ঘুমঘুম চোখে মাহতিমের উঠতে হয়েছে। দরজার ছিটকিনি খুলে চোখ ডলতে-ডলতে মাহতিম বারান্দা পেরিয়ে যাচ্ছে। অন্যহাতে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে আলো ধরে রেখেছে। সিড়ি দিয়ে নেমে আঙিনায় পৌঁছাতেই আচমকা অদ্ভুত একটা শব্দ কানে এলো। শব্দটা স্পষ্টভাবে শোনার জন্য মাহতিম চোখ পিটপিট করে চারপাশে তাকাতে লাগলো। কিন্তু শব্দটা কোথা থেকে আসছে সেটা বুঝতে একটু সময় নিচ্ছে মাহতিম। চাপাকান্নার মতো কান্নাকাটির শব্দ আসছে। মনেহচ্ছে কেউ অত্যধিক অত্যাচারে মুখ চাপা দিয়ে রেখেছে। মূহুর্ত্তের মধ্যেই মাহতিমের অবস্থাটা কৌতুহলপূর্ণ আচ্ছন্ন হলো। মোল্লা বাড়িতে এমন চাপাকান্নার আওয়াজ শোনাটা একদমই দূর্লভ! ভৌতিক বিষয় যদি হয়েই থাকে তাহলে মাহতিমও আজ হাতেনাতে সব দেখে ছাড়বে। চুপ করে ফোনের লাইটটা বন্ধ করে ফেললো মাহতিম। পানি খাওয়ার উৎকন্ঠা ভুলে সহসা কান্নার আওয়াজ নিয়ে এনালাইসিস শুরু করলো সে। ক্ষণিকের মধ্যে আবিষ্কার করলো বাড়ির সদর দরজা খোলা রয়েছে, আর সেই শব্দটা একনাগাড়ে বাইরে থেকেই আসছে। মাহতিম শান্ত ভঙ্গিতে ঠোঁট ভিজিয়ে দরজার দিকে এগুতে লাগলো। যতই এগুতে লাগলো, ততই মেয়েলি কান্নাটা জোরালো রূপেই শুনতে পাচ্ছিলো। দরজার দুই দ্বারের বাইরে পা ফেললো মাহতিম। অন্ধকার পরিবেশে ডানে-বামে সজাগ দৃষ্টিতে চোখ বুলালো। চোখের দৃষ্টি যখন অন্ধকারের মাঝে সয়ে গেলো তখন দূরের সেই পুকুরপাড়ের দিকে দৃষ্টি যেতেই পা থমকে গেলো ওর! সুপারি গাছের সাথে হেলান দিয়ে কে যেনো দাড়িয়ে আছে। ওইটুকু আবছা অন্ধকারের দৃশ্য দেখে মাহতিম আবারও চটপট ভঙ্গিতে ডানেবামে চোখ বুলিয়ে পেটানোর জন্য কাঙ্ক্ষিত একটা জিনিস খুজঁলো। ঠিক ওইসময়ই দরজার কাছে চার ফুটের একটা বাশঁ পেলে সেটা হাতের বলয়ে আঁকড়ে ধরলো মাহতিম। চোখ তুলে সেদিকে তাকাতেই হতবাক হয়ে গেলো সে! একটু আগে ওখানে কাউকে দেখেছিলো ও, অথচ এখন সেখানে কেউ নেই! এটা কি করে সম্ভব? মাহতিম হন্যে হয়ে চারদিকে খুঁজতে লাগলো, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ বাশঁ ফেলে বাড়িতে ঢুকতেই আরেকবার আশ্চর্য হয়ে গেলো। সৌভিক কেমন চোরের মতো উত্তর দিকের সিড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে। অন্যদিকে সাবা দক্ষিণ দিকে সিড়ি বেয়ে কান্নাসুরে দ্রুতগতিতে উপরে উঠছে। সৌভিককে ডাক দিতে গিয়ে আর কন্ঠ উঠলো না মাহতিমের। রান্নাঘরের দিকে আড়নজরের দৃষ্টি পরতেই সেখানে মেহনূরকে দেখতে পেলো মাহতিম। মেহনূর একহাতে হারিকেন ধরে অন্যহাতে চায়ের পানিতে চামচ নাড়ছে। জগতের সবকিছু অন্ধকার, ঘুটঘুটে অন্ধকার, শুধু হারিকেনের আলোয় ওই উজ্জ্বলবর্ণের চেহারা যেনো আকর্ষক হচ্ছে। চুম্বকের মতো কঠিনভাবে সেদিকে টানতে চাইছে। দৃষ্টি শান্ত করে স্থির করে দিয়েছে। মাহতিম অন্যভুবনে পদচারনার মতো ধীরপায়ে রান্নাঘরে এগিয়ে যাচ্ছে। যখন রান্নাঘরের নিকটে এসে পদচারনা থামলো, তখনই মেহনূরের মায়াপূর্ণ বড় বড় চোখের দৃষ্টি দুটো মাহতিমের দিকে পরলো। বুকটা ছ্যাত করে উঠলো মাহতিমের। ওই শান্ত দৃষ্টির কেশবহুল বালিকা পূর্ণদৃষ্টিতে হকচকিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। চুল খোলা মেহনূরের, সেগুলো হাটুর কাছে এসে জমায়েত হয়েছে। মাহতিম দৃষ্টি তুলে আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখলো ওর। হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি পরেছে, কালো ব্লাউজের হাতাদুটো কনুই ছাড়িয়ে কবজির একটু আগে এসে ঢেকেছে। মাহতিম মাথা-থেকে-পা অবধি নির্বিকারে চোখ বুলালো। বাঁকা হেসে রান্নাঘরের ভেতরে পা ফেলে ঢুকলো। মেহনূরের অবস্থা তখন পুরোই কাহিল, দিনশেষে আবারও অপ্রত্যাশিত ভাবে এই লোকটার সাথে দেখা হয়ে গেলো ওর। রাতে উপন্যাসের বই পড়ার সময় চা খাওয়ার অভ্যাস আছে মেহনূরের। তাই নিয়ম মোতাবেক আজও এসেছে চা বানাতে, কিন্তু মাহতিমের এমন আগমন দেখে ভয়ে পালাতে ইচ্ছে করছে। মাহতিম চুলার কাছে এসে দেখলো, ছোট পাতিলে চা বানানো হচ্ছে। চায়ের দিকে দৃষ্টি রেখে শান্ত সুরে বললো মাহতিম,
– এক কাপ চা দেওয়া যাবে? টেস্ট করতাম আরকি।
শীতের পরশ পাওয়ার মতো শিউরে উঠলো মেহনূর। সৎবিৎ ফিরে পেলে আমতা-আমতা করে বললো,
– চা-চা-চা স-সত্যিই খা-বেন?
মাহতিম সরল গলায় বললো,
– হ্যাঁ খেতেই তো চাচ্ছি।
মেহনূর যে ভয়ে কাঁপছে সেটা ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছে মাহতিম। হাতের প্রতিটা আঙুলই ভয়ংকরভাবে কাঁপছে ওর। মাহতিম একবার ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার ওর হাতের দিকে তাকাচ্ছে সে। মেহনূর কম্পমান হাতেই মাহতিমের দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিলো। মাহতিম চায়ের কাপে চামচ নেড়ে চামচটা চুলার পাশে রেখে দিলো। কাপের হ্যান্ডেলে তর্জনী পেচিঁয়ে ছোট্ট একটা ফু দিয়ে এক চুমুক খেলো। খেতেই মূখের অবস্থা বীভৎস ভাবে কুঁচকে সাথে-সাথে মেহনূরের হাতে ধরিয়ে দিলো। বিরক্তির সাথে বললো,
– কি চা বানিয়েছো এটা? সামান্য চা-ও তুমি বানাতে পারো না? ছিঃ! খেয়ে দেখো। খেয়ে দেখো কেমন ফালতু চা বানিয়েছো।
এই প্রথম খারাপ মন্তব্য পেলো চায়ের জন্যে। চায়ের মধ্যে কি গলদ করেছে সেটা তাড়াতাড়ি বুঝার জন্য এক চুমুক দিয়ে খেয়ে দেখলো মেহনূর। কিন্তু গলদের কিছুই যখন ধরতে পারলো না, তখন মাহতিমের দিকে উজবুক দৃষ্টিতে তাকালো। কিছু বলার জন্য ঠোঁটে খুলবে তার আগেই মাহতিম ওর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে নিলো। মেহনূর এমন উদ্ভট কারবার দেখে কপাল কুঁচকে তাকালে মাহতিম বাম পকেটে হাত ঢুকিয়ে চায়ের কাপে ফুঁ দিলো। চোখ বন্ধ করে চায়ের কাপে শান্ত ভঙ্গিতে চুমুক দিলো। এদিকে মেহনূর যে বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, সেদিকে বিন্দুমাত্র নজর দিলোনা ও। চুমুক শেষে মাহতিম চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে হঠাৎ পা থামিয়ে মেহনূরের দিকে ঘুরে দাড়ালো। বাম পকেট থেকে হাত বের করে কাপের যেদিকটায় চুমুক দিয়েছিলো,সেদিকটায় দুই আঙ্গুলে টোকা মেরে বাকাঁ হেসে কি যেনো ইশারা করলো। মাহতিমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতেই চিন্তা করতে লাগলো মেহনূর। আচ্ছা লোকটা চায়ের কাপে টোকা মেরে কি ইশারা করলো?তাও আবার চুমুকের জায়গাটা ইশারা করার মানে কি হলো?
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO