#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_12
#ইয়াসমিন_খন্দকার
সুনীতি উদাস মনে নিজের ঘরে বসে আছে। তার পরনে এখনো বিয়ের পোশাক। নয়না খন্দকার সুনীতির কক্ষে প্রবেশ করেন। তার সাথে অহনাও এসেছে। নয়না খন্দকার সুনীতির কাছে গিয়ে তার গা থেকে গহনা খুলতে খুলতে বলেন,”তোমাকে আর এগুলো পরে থাকতে হবে না, মামনী। এখন খোলো এসব। আর কতক্ষণ এভাবে শোক পালন করবে?”
সুনীতি নয়না খন্দকারকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলে,”আমার সাথে কেন এমন হলো মা, আমি তো কারো কোন ক্ষতি করিনি। তাহলে সাজিদ ভাইয়া আর ফুফু মিলে কেন আমায় ঠকালো? সবাই আমার কত বদনাম করলো। আমার কিছু ভালো লাগছে না।”
অহনা এগিয়ে এসে বললো,”শুকরিয়া আদায় কর যে বিয়ের আগে সবকিছু প্রকাশ পেয়েছে। নাহলে যদি একবার বিয়েটা হয়ে যেত তাহলে এখনকার থেকে আরো হাজার গুণ বেশি অপমান আর মানসিক ট্রমার মধ্যে দিয়ে যেতে হতো। আমি সেই কষ্টটা বুঝি..কারণ আমি আমার মাকে সেই কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে দেখেছি।”
কথাটা বলতেই অহনার চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করে। সুনীতি অহনার দিকে লক্ষ্য করে। অহনার জীবনের ব্যাপারে সে জানে। অহনার যখন মাত্র ৫ বছর বয়স ছিল তখন ওর বাবা আরেকজন মহিলাকে বিয়ে করে অহনার মাকে ডিভোর্স দেন। এরপর অহনার মা ছোট্ট অহনাকে নিয়ে নিজের বাপের বাড়িতে যান। সেখানেও নানা জঘন্য কথা শুনতে হয়। এসব খোটা শুনেই অহনা বড় হয়েছে। তাই এখন সে আর সমাজকে ওতোটা পরোয়া করে না। সুনীতিকেও সে এখন এই ব্যাপারে বোঝাতে চাইছে। সুনীতি নিজের চোখের জল মুছে অহনার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে,”এই সমাজের খেতায় আগুন। আমরা না খেয়ে থাকলে কেউ একবেলা খাবার দিতে আসে না কিন্তু কথা শোনাতে ওস্তাদ। তুই ঠিকই বলিস অহনা, আমি আর এখন থেকে এই সমাজের মানুষের কথায় পাত্তা দেব না। আর তাছাড়া অন্যায় তো আমার সাথে হয়েছে। তাহলে আমি কেন কষ্ট পাবো? যে অন্যায় করেছে তার কষ্ট পাওয়া উচিৎ।”
নয়না খন্দকার নিশ্চিত হয়ে বলেন,”তোমার কথা শুনে আমার ভীষণ ভালো লাগছে মামনী। এভাবেই সবসময় স্ট্রং থেকো।”
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ইভা বিধ্বস্ত অবস্থায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। সাজিদকে সে সত্যি অনেক ভালোবাসত। তাই তো সাজিদের এক কথায় সে নিজের পরিবার, পরিজন সবাইকে ছাড়তে দুবার ভাবেনি। কিন্তু এই ভালোবাসার বিনিময়ে সে কি পেলো? শুধুই ধোকা। ইভা এখনো ভেবে উঠতে পারছে না, সাজিদ কিভাবে তাকে ছেড়ে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হলো? এই ছিল সাজিদের খাঁটি ভালোবাসা? ইভার এখন চিন্তা নিজের অনাগত সন্তানকে নিয়ে। সাজিদের কাছে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা তার আর নেই। তাহলে সে এই বাচ্চাটিকে একা কিভাবে মানুষ করবে? তাকে তো তাহলে সিঙ্গেল মাদার হতে হবে। এসব ভেবেই ইভার চোখে জল চলে এলো। আমেরিকায় বড় হলেও ইভা অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা। সাজিদের আগে তার জীবনে কেউ আসেনি। সে অন্য মেয়েদের মতো একাধিক সম্পর্ক কিংবা বারে গিয়ে ড্রিংকও করেনি। বরং সে সবসময় চাইতো একজন খাঁটি প্রেমিক তার জীবনে আসুক যে তাকে নিজের সবটা উজার করে ভালোবাসবে। যার জন্য সে সবকিছু করতে পারবে। কিন্তু দিনশেষে প্রত্যাশা অধরাই থেকে গেলো। ইভা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এমন সময় সে নিজের পেছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করল। পিছন ফিরে তাকিয়েই সাগরকে দেখল। সাগর ইভাকে বলল,”আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাবি। ভাগ্যিস আজ আপনি সঠিক সময় আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে দরজা খুলে মুক্ত করেছিলে। নাহলে কি যে হতো!”
ইভা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”সাজিদকে ফোনে না পেয়ে আমি অনেক দুশ্চিন্তা করছিলাম। এত ভালো একটা খবর ওকে দেয়া হলো না। যখন থেকে আমি জানতে পেরেছি আমি প্রেগন্যান্ট তখন থেকে এই খবরটা ওকে জানানোর জন্য ছটফট করছি। এরপর হঠাৎ সাজিদের ফোন বন্ধ হয়ে গেল। তখন আমি আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলাম। একদম উদ্ভ্রান্তের মতো করতে লাগলাম। আমার এই অবস্থা দেখে আমার বেস্ট্র ফ্রেন্ড এলিনা সাজিদের অফিস থেকে ওর ঠিকানা বের করে আনল। আমার অনেক আগে থেকেই ভাবনা ছিল বাংলাদেশে আসার। সাজিদ সবসময় বলতো ওর পরিবারকে ও মানিয়ে নেবে। কিন্তু আমি ওর মধ্যে একটা ভয়ও দেখতাম। সাজিদকে বাংলাদেশে আসার কথা বলতেই ও এড়িয়ে যেত। তাই আমি গোপনে অনেক আগেই বাংলাদেশের পাসপোর্ট, ভিসা করিয়ে রেখেছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে ভিসার মেয়াদ থাকায় আমি সাজিদের ঠিকানা পাওয়ার সাথে সাথে পরবর্তী ফ্লাইটেই ঢাকায় ছুটে আসি। তারপর তোমার বাসায় ছুটে যাই। দারোয়ানকে অনেক রিকোয়েস্ট করে শেষপর্যন্ত ডলারের লোভ দেখিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকি। তারপর তোমার গলার আওয়াজ শুনে আমি তোমার দরজাটা খুলে দেই আর তারপর তো…”
ইভার গলায় স্বর আটকে যায়। নিজের ভালোবাসার মানুষটার প্রতারণা যে সে ভুলতে পারছে না। সাগর ইভার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আপনি কিন্তু চাইলে আমার ভাইয়াকে আরেকটা সুযোগ দিতে পারেন। ও কিন্তু সত্যি আপনাকে অনেক ভালোবাসে। শুধুমাত্র আম্মুর প্ররোচনায় এত বড় একটা অন্যায় করতে যাচ্ছিল।”
“ও আমার ভালোবাসার মূল্য দেয়নি। তাই আমিও আর ওর কাছে ফিরব না।”
ইভার একথার পরে সাগর আর কিছু বলার মতো খুঁজে পায়না। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সাজিদের দিকে তাকায়। সাজিদই তাকে পাঠিয়েছিল ইভাকে বোঝানোর জন্য। কিন্তু ইভা এখনো যথেষ্ট রেগে আছে। তাই তাকে বোঝানো সহজ নয়। এর জন্য সময় প্রয়োজন। ইশারা করে নিজের ভাইকে এটাই বোঝালো সে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
অভিক বাসায় ফিরতেই দেখে তার মা রাহেলা খাতুন বেশ খোশমেজাজে আছেন। আহসান চৌধুরীকে তিনি বলে চলেছেন,”একেই বলে কর্মা। খন্দকার সাহেবের মেয়ে আমার ছেলেকে প্রত্যাখ্যান করেছিল না..আর আজ দেখো এতগুলো মানুষের সামনে কিভাবে ওর বিয়ে ভেঙে গেল। একদম ঠিক হয়েছে।”
“আহ, রাহেলা। এসব কি ধরনের কথা।”
রাহেলা খাতুন আরো কিছু বলতে যাবেন এমন সময় অভিককে দেখে কথা বদলে বলেন,”কিন্তু অভিক..তুমি কিন্তু তখন ঐ ছেলেটার গায়ে হাত তুলে একদম ঠিক কাজ করোনি। কি দরকার ছিল অন্যের ঝামেলা নিজের কাঁধে টেনে নেয়ার?”
“অন্যায় দেখলে আমি চুপ থাকতে পারি না, মা। এটা তো তুমি জানোই। তোমার ভাষায় এটাই আমার ❝বদভ্যাস❞”
রাহেলা খাতুন আর কিছু বললেন না। কারণ তিনি জানেন অভিককে আর কিছু বুঝিয়ে লাভ নেই। এরমধ্যে অভিক নিজের ঘরে গিয়ে কাপড়চোপড় গোছাতে গোছাতে বলে,”কালকেই আমি সেনাবাহিনী ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছি।”
আহসান চৌধুরী বললেন,”আচ্ছা, তাহলে তুমি সব গোছগাছ করে নাও।”
রাহেলা খাতুন দুঃখ প্রকাশ করে বললেন,”আমার কত ইচ্ছা ছিল এবার অভিক ক্যাম্পে ফেরার আগেই ওর বিয়েটা করিয়ে দেব। আমার সেই ইচ্ছা অপূর্ণই থাকতে পারে।”
আহসান চৌধুরী বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন,”উফ! তুমিও না। আচ্ছা, এমনো তো হতে পারে তোমার ইচ্ছাটা কোনভাবে পূরণ হয়ে গেল।”
“কিভাবে হবে?”
“আল্লাহ চাইলে সব সম্ভব। তিনি চাইলে তোমার ছেলের বউকে খুব শীঘ্রই তোমায় বরণ করে ঘরে তুলতে হবে।”
রাহেলা খাতুন আর এসব নিয়ে না ভেবে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
~~~~~~~~~~~
সুনীতি আজ সকাল সকাল ভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। সুনীতিকে তৈরি হতে দেখে নয়না খন্দকার বললেন,”আজ ভার্সিটি না গেলেই নয়? কাল এতকিছু হয়ে গেল আর আজ..”
সুনীতি বলল,”আমি এসব মনে রাখতে চাই না, মা। ভার্সিটি গেলে মনটা একটু ভালো হবে।”
নয়না খন্দকার আর কিছু বলতে যাবেন তার আগেই সামিউল খন্দকার বললেন,”ওকে যেতে দাও নয়না। আমার মেয়ে এতটা সহজে ভেঙে পড়ার মেয়ে নয়। ও কোন অন্যায় করেনি যে ঘরে মুখ লুকিয়ে বসে থাকবে।”
সুনীতি নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে একটা চওড়া হাসি উপহার দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। সে জানে বাইরে বের হয়ে তাকে অনেকের তীর্যক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।অনেকে তাকে বাকা চোখে দেখবে। কিন্তু এসব সে পাত্তা দিবে না। আর হলোও ঠিক তাই। সবাইকে উপেক্ষা করে সে এগিয়ে গেল। কিছু মহিলা তাকে দেখে বলল,”কালই বিয়ে ভাঙলো আর আজ ডেং ডেং করে ভার্সিটি যাচ্ছে। মেয়েটার লজ্জা বলে কিছু নেই!”
একটু এগিয়ে গিয়ে দেখল রাস্তা বেশ ফাকা। এমন সময় হঠাৎ করে একটা কালো গাড়ি এসে তার সামনে থামলো। সেই গাড়ি থেকে নেমে কেউ একটা তাকে টেনে গাড়িতে তুলল। ঘটনার আকস্মিকতায় সে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারল না। গাড়িতে উঠেই ভয়ে সিটিয়ে গেল। অস্ফুটস্বরে বলল,”মন্টু…!”
To be continue…….