মন রাঙানোর পালা পর্ব-১৫

0
4

#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_15
#ইয়াসমিন_খন্দকার

অভিক ক্যাম্পে যাওয়ার পর দুটো মাস অতিবাহিত হয়েছে। আর মাত্র একমাসের অপেক্ষা তার ফেরার। অথচ এই সামান্য সময় যেন অনেক বেশি মনে হচ্ছে সুনীতির কাছে। সে চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় আছে লোকটার। সুনীতি কখনো ভাবতে পারেনি যেই লোকটাকে একসময় চরম অপছন্দের ছিল সে হঠাৎ করে এতটা কাছের হয়ে যাবে। এই যে, এত কাজের চাপের মধ্যেও প্রতিদিন রাতে সময় করে তার খোঁজ নেয়। এটুকুই সুনীতিকে ব্যকুল করে তোলে। সে বুঝতে পারে, এই সম্পর্কটাকে মন থেকে মেনে নিতে সক্ষম হয়েছে। এখন শুধু তার ফেরার অপেক্ষা।

আজকের রাত্রিটাও সুনীতির কাছে বিশেষ ছিল। সে চাতক পাখির মতো অভিকের একটি ফোনের অপেক্ষায় বসে ছিল৷ কিন্তু আজ তার অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হতে চাইছে না। সুনীতি বারবার ঘড়ির দিকে তাকায়৷ রাত ১ টা বাজতে চলল৷ অভিক তো প্রতিদিন রাত ১২ টার পরই ফোন দেয় অতঃপর সংক্ষিপ্ত বাক্যবিনিময় শেষে কল রেখে দেয়। কিন্তু আজ সেই সময় পেরিয়ে গেলেও অভিকের কল আসছে না। সুনীতি অস্থির হতে থাকে। অভিক তাকে বলেছে, নিজে থেকে যেন সে কল না দেয় কারণ তাকে অনেক মিশনে ব্যস্ত থাকতে হয়। এজন্য সুনীতি চেয়েও ফোন করতে পারছে না। সুনীতির চোখ জলে টলমল করতে থাকে। বুকের বা পাশে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভূত হয়। এভাবেই এক সময় সে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যায়।

ঘুম থেকে উঠে সুনীতি নিজেকে আবিষ্কার করে চেয়ারে অবস্থায়৷ কাল এভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। গতকাল রাতে অভিক ফোন দেয়নি ব্যাপারটা ভাবতেই বিতৃষ্ণায় তার মনটা বিষিয়ে যায়। একটা চাপা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে মন থেকে। সুনীতি ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে যায় ব্রেকফাস্ট করতে। নয়না খন্দকার সুনীতিকে দেখে বলেন,”তোমার চোখ এত ফোলা ফোলা লাগছে কেন মামনী? কাল রাতে কি ভালো ঘুম হয়নি?”

সুনীতি ইতস্তত বোধ করে বলে,
“না, মা। সেরকম কিছু না। আমাকে একটু জলদি খেতে দিবে প্লিজ।”

“তুমি বসো আমি খেতে দিচ্ছি। আজ সকালে বেশি কিছু করতে পারিনি তোমার বাবার অফিসে কিসের যেন তাড়া ছিল। তাই কোন রকমে জ্যাম পাউরুটি করে দিয়েছি।”

“আচ্ছা,অসুবিধা নেই। ওটাই দাও।”

নয়না খন্দকার সুনীতিকে খাবার বেড়ে দেন। সুনীতি বিষন্ন মনে খাবার খেতে থাকে। হঠাৎ করেই পেছন থেকে কেউ তার চোখ হাত দিয়ে ঢেকে দেয়। সুনীতি মলিন স্বরে বলে,”আমার এসব ভালো লাগছে না, অহনা।”

অহনা নয়নার চোখ থেকে হাত সরিয়ে বলে,”চিনে ফেললি! আমি তো এসেছিলাম তোর খোঁজ নিতে। কয়দিন থেকে কেন জানি ভার্সিটি যাচ্ছিস না! সামনে তো এক্সাম।”

“আমার ভালো লাগছে না কিছু।”

“কি হয়েছে আমায় বলবি?”

সুনীতি একবার আশেপাশে তাকায়। নয়না খন্দকার তাকে খেতে দিয়েই রান্নাঘরে চলে গেছেন। তিনি এখন রান্না করতে ব্যস্ত। তাই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,”মেজর অভিক প্রতিদিন রাত ১২ টার পর ফোন দিয়ে আমার খোঁজ নেন। এই দুই মাসে কোনদিনই এর বিচ্যুতি ঘটেনি। কিন্তু গতকাল রাতে উনি আমায় ফোন করেন নি।”

“ও, তাহলে এই ব্যাপার। এটা নিয়ে এত মন খারাপ করার কি আছে! উনি ফোন দেয়নি তো কি হয়েছে? তুই তো নিজে থেকেও ওনাকে ফোন করতে পারিস।”

“না,না এমনটা করা যাবে না। উনি আমায় বারণ করেছেন।”

“আরে রাখ তো তোর বারণ। মানছি উনি ব্যস্ত মানুষ। তাই বলে কি আমার পেয়ারি বান্ধবীর কষ্ট বুঝবে না? তুই এক্ষুনি ওনাকে কল কর।”

সুনীতি কাপা কাপা হাতে নাম্বারটা ডায়াল করে। কিন্তু তবু তার ভীষণ ভয় লাগছিল৷ এমনিতেই লোকটাকে ছোটবেলা থেকেই সে ভীষণ ভয় পায়। তাই সহসা কথা বলার সাহস হলো না। অহনা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সুনীতির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলল,”দাঁড়া আমি আগে ওনার সাথে কথা বলছি।”

~~~~~~~~
আরাফাতকে কিছুদিন আগেই সিলেটে পাঠানো হয়েছে। এখানে এসে সে তো ভীষণ খুশি কারণ এখানে তার প্রিয় বন্ধু অভিক আছে যে।

আরাফাত রুমে শুয়ে ছিল। অভিক গতকাল থেকে একটা আর্জেন্ট মিশনে ব্যস্ত। কাল বিকেলে হঠাৎ করেই তাকে একটু বাইরে যেতে হয় এবং এখনো অব্দি সে ফেরেনি। তাই আরাফাত একাই উদাস সময় পার করছিল। এমন সময় হঠাৎ তাদের রুমে থাকা টেলিফোনটা বেজে ওঠে।

আরাফাত উঠে টেলিফোনটা রিসিভ করে বলে,”হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”

বিপরীত দিক থেকে একটা সুমধুর কন্ঠ ভেসে আসে,”আমি আপনার শালী বলছি দুলাভাই!”

কথাটা শুনে যেন আরাফাত আকাশ থেকে পড়ে। আমতাআমতা করে বলে,”দুলাভাই মানে? কার দুলাভাই? কিসের দুলাভাই?”

“কেন? আপনি কি ভুল গেলেন যে আপনি বিবাহিত। আপনার স্ত্রী গতকাল রাত থেকে আপনার ফোনের অপেক্ষায় চাতক পাখির মতো বসে আছে। আর আপনি তাকে অপেক্ষায় রেখে বসে আছেন!”

“আমার মনে হয় আপনার কোন ভুল হচ্ছে।”

“ভুল? আমার ভুল? আপনি শুধু আসুন একবার। তারপর আপনাকে দেখাব। আমার বান্ধবীকে দেওয়া প্রত্যেকটা কষ্টের পাই টু পাই হিসাব নেব।”

“এই কে আপনি? কিসব স্টুপিডের মতো কথা বলছেন?”

“কি আমি স্টুপিড? দেখেছিস তোর জামাই আমাকে স্টুপিড বলছে। নিজের শালিকে কেউ এভাবে বলে। এবার তুই ওনার ক্লাস নে তো।”

বলেই অহনা ফোনটা সুনীতির হাতে তুলে দেয়। সুনীতি ফোনটা হাতে নিয়ে বলে,”হ্যালো, মেজর অভিক আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না প্লিজ আসলে..”

আরাফাত এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারে। অভিক তাকে সুনীতির সাথে বিয়ের ব্যাপারে সবটা অনেক আগেই বলেছে। তাই সে মৃদু হেসে বলে,”আসসালামু ওয়ালাইকুম, ভাবি। আমি অভিক নই আমি ওর বন্ধু আরাফাত। অভিক একটা গুরুত্বপূর্ণ মিশনে আছে।”

সুনীতি এবার রাগী দৃষ্টিতে অহনার দিকে তাকিয়ে আরাফাতের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”দুঃখিত ভাইয়া। আমার বান্ধবী কিছু না বুঝেই আপনাকে অনেক কিছু বলে ফেলেছে।”

“আরে কোন ব্যাপার না। আপনাকে সরি বলতে হবে না। শুধু আপনার বান্ধবীকে বলে দেবেন একটু মেলোড্রামা কমাতে। যেভাবে কথা বলছিল আমি তো ভেবেছিলাম যে..”

ফোন লাউড স্পিকারে দেওয়া ছিল জন্য অহনা সবটাই শুনতে পায়। তেড়ে গিয়ে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলে,”কি বললেন আপনি? আমি মেলোড্রামা করি? আর আপনি কি করেন? মেয়েদের কিভাবে সম্মান দিতে হয় জানেন না? অসভ্য লোক কোথাকার।”

“আপনি কিন্তু নিজের সীমা অতিক্রম করছেন।”

“হ্যাঁ, বেশ করেছি। কি করবেন শুনি?”

“মেয়েদের এত বার ভালো না।”

“বার কি শুধু ছেলেরাই বারতে পারে? মেয়েরা পারে না?”

সুনীতি বিরক্ত হয়ে বলে,”আহ, অহনা। কি হচ্ছে টা কি? এমন বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছিস কেন?”

“আমি? আমি বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছি? আর উনি যে..”

অহনা নিজের কথা শেষ করতে পারল না৷ তার আগেই কেউ একজন রাশভারি কন্ঠে বলল,”কে ফোন দিয়েছে আরাফাত?”

আরাফাত পেছনে ফিরে অভিককে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,”তোর শালী ফোন দিয়েছে।”

“শালী মানে?”

“তোর বউয়ের বান্ধবী। নে কথা বল।”

বলেই সে অভিককে টেলিফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বাইরে চলে যায়। অভিক হ্যালো বললে, অহনা বলে,”আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। নিন, আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলুন।”

এটা বলে সে সুনীতির হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বাইরে চলে যায়। সুনীতি ফোনটা হাতে নেয় কিন্তু কিছু বলতে পারে না। কিছুক্ষণ নীরবতার পর অভিক বলে,”নীতি..”(অভিক সুনীতিকে ভালোবেসে নীতি বলে ডাকে)

“জ্বি, বলুন।”

“গতকাল রাতে নিশ্চয়ই আমার ফোন না পেয়ে চিন্তিত ছিলে।”

“হুম।”

“আসলে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিশনে কাল বাইরে যেতে হয়েছিল। তাড়াহুড়োয় তোমাকে জানানো হয়নি। মন খারাপ করো না।”

“না, না। আমি মন খারাপ করিনি।”

“তোমাকে একটা ভালো খবর দেয়ার আছে। আগামী সপ্তাহেই আমি ফিরছি।”

“সত্যি?”(কন্ঠে চরম আনন্দ নিয়ে বলে সুনীতি)

” হুম, সত্যি। এবার ফিরলে সমস্ত নিয়ম মেনে বিয়ে করে তোমায় ঘরে তুলবো। প্রস্তুত থেকো।”

বলেই অভিক ফোনটা রেখে দেয়। সুনীতির মুখে হাসির রেখা উদয় হয়। অভিক ফোন রেখে বলে,”আমি শীঘ্রই আসছি নিজের ভালোবাসার রঙে তোমার মন রাঙাতে!”

To be continue…….