#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_43
#ইয়াসমিন_খন্দকার
অভিক সুনীতিকে নিজের বুকে সাথে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিল। ভোরের আলো চোখে পড়তেই অভিকের ঘুম ভেঙে যায়। সে দ্রুত উঠে বসে। সুনীতির স্নিগ্ধ মুখের পানে তাকিয়ে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে। সুনীতি, তার স্ত্রী। যে তার মানসিক শান্তির কারণ।
অভিক ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। আজ সকাল সকালই তাকে বেরিয়ে পড়তে হবে নতুন মিশনের জন্য। তাই সে দ্রুত উঠে পড়ে তৈরি হতে থাকে। সুনীতি ঘুমাচ্ছে দেখে তাকে আর বিরক্ত করল না। যাওয়ার আগে সুনীতির পেটে হাত বুলিয়ে বলল,”নিজের মায়ের খেয়াল রেখো লিটিল চ্যাম্প। তোমার বাবার জন্যেও দোয়া করো। যেন আজ আমি যেই মিশনে যাচ্ছি সেটা সফল হয়।”
বলেই অভিক বেরিয়ে যায়।
আরাফাতও মিশনে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। গতকাল রাতে সে অহনাকে সারপ্রাইজ-গিফট হিসেবে একটা ডায়মন্ড পেন্ডেট গিফট করেছে। তবে অহনার তরফ থেকে যে সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা ছিল সেটা সে এখনো দেয়নি। তাই আরাফাত যাওয়ার আগে অহনাকে মনে করিয়ে দিল,”আজ যেন ফিরে এসে নিজের সারপ্রাইজটা পাই।”
অহনা বলে,”নিশ্চয়ই পাবে। আমি তো আল্লাহর কাছে সেই প্রার্থনাই করছি যেন তোমাকে সারপ্রাইজটা দিতে পারে।”
বলেই একটা রহস্যময় হাসি দেয় অহনা। আরাফাত যাওয়ার সময় রুমের দরজা পার হওয়ার সময় হঠাৎ করেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। অহনা এ ঘটনায় ভীষণ ঘাবড়ে যায়৷ আরাফাতকে টেনে তুলে বলে,”তুমি ঠিক আছ তো?”
“হুম, পায়ে সামান্য চোট পেয়েছি৷ এটা কোন ব্যাপার না। আমায় এখনই বের হতে হবে।”
অহনাকে ভীষণ চিন্তিত লাগছিল। অহনা আর থাকতে না পেরে বলেই দেয়,”আজ তোমার না গেলে হয়না? কাল থেকে আমার মনটা কেমন জানি কু গাইছে, মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হতে চলেছে। আজ আবার যাওয়ার সময় এই বাঁধা।”
আরাফাত একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”তুমিও না অহনা। এসব নিয়ে এত ভেবো না। এসব তোমার মনের ভুল৷ তুমি আমাকে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তা করো তো তাই এমন ভাবছ। আদতে আমার কিছুই হবে না। এর আগেও আমি এমন কত মিশনে গিয়েছি।”
তবুও অহনার মন মানতে চায়না। সে অভিকের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমাকে কথা দাও, তুমি একদম সহি সালামত ফিরে আসবে।”
“ইনশাআল্লাহ।”
“আচ্ছা, সাবধানে যেও। আল্লাহর নাম নিও। উনি তোমায় সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।”
আরাফাত অহনাকে একটা গভীর আলিঙ্গনে স্নিগ্ধ করে তোলে। অহনা আরাফাতকে ভীষণ শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে। যেন ছেড়ে দিলেই অনেক দূরে চলে যাবে। আরাফাত অহনাকে বলে,”এখন ছাড়ো, আমায় যেতে হবে।”
অহনার বুক হঠাৎ করেই ধক করে ওঠে। সে বলে,”তোমাকে কিন্তু আবার আমার কাছে ফিরতেই হবে।”
“তোমার কাছে না ফিরে কোথায় যাব?”
বলেই অহনার কপালে একটু চুমু খেয়ে বিদায় নেয় আরাফাত। আরাফাত যখন যাচ্ছিল তখন অহনার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বাড়ছিল। বুকে চিনচিন ব্যাথা অনুভব হচ্ছিল। কেন জানি তার মনে হচ্ছিল তার হৃৎপিণ্ডটা কেউ তার বুক চিরে বের করে নিচ্ছে। অহনা চোখ বন্ধ করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলল,”তুমি আমার স্বামীকে রক্ষা করো আল্লাহ। ওর যেন কোন বিপদ না হয়।”
বলেই কিছু দোয়া পড়ে। কিন্তু তবুও তার মন থেকে দুশ্চিন্তা দূর হয়না।
সেনা ক্যাম্প থেকে আজ সীমান্ত মিশনের জন্য দুটো আলাদা টিম করা হয়েছে। এর মধ্যে একটা টিমের নেতৃত্বে রয়েছে মেজর অভিক অন্য টিমের নেতৃত্বে মেজর আরাফাত। সাগর মেজর আরাফাতের টিমে রয়েছে। ক্যাম্প থেকে দুটো টিমে ভাগ হয়ে সবাই দুটি ভিন্নপথে রওনা দেয়।
আরাফাত নিজের টিমে থাকা সকল সেনা সদস্যের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তোমরা সবাই সতর্ক থাকবে। ওরা যেকোন দিক দিয়ে অতর্কিত হামলা চালাতে পারে। আজ যেকোন কিছুর বিনিময়ে আমাদের ঐ পাচারকারী চক্রকে সমূলে উৎখাত করতে হবে। নাহলে আমাদের দেশের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।”
সাগর সহ উপস্থিত বাকি সকল জওয়ান একসাথে বলে ওঠে,”জ্বি,মেজর। আমরা সবদিকে খেয়াল রেখে চলার চেষ্টা করব।”
আরাফাত একটা তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলে,”গুড। তোমাদের মধ্যে এই স্পিরিটটাই দেখতে চাই।”
সাগর সহ বাকি সকল সেনা সদস্য আরাফাতকে অনুসরণ করে তার পিছু পিছু যেতে থাকে। যাওয়ার পথে আরাফাত তাদেরকে বিভিন্ন নির্দেশনাও দেয়।
~~~~~~~~~~~~~~~
সুনীতি আজ তার মাসিক চেকআপের জন্য হাসপাতালে এসেছে। সুনীতির সাথে এসেছে অহনাও। সুনীতি অহনার কাছে দুঃখপ্রকাশ করে বলে,”জানিস, অভিক আজ মিশনে যাওয়ার সময় আমাকে একবার বলেও যায়নি। আমার খুব মন খারাপ হয়েছে ওর উপর। আজ শুধু ওকে একবার আসতে দে। ওর সাথে আর কথাই বলব না।”
অহনা হেসে বলে,”তোদের তো এটা নিত্যদিনের ঘটনা।”
হঠাৎ তার মুখটা মলিন হয়ে যায়। সে বলে,”আমিও আরাফাতকে আজ যেতে মানা করেছিলাম। আমার মনটা বড্ড কু ডাকছে জানিস। আল্লাহ না করুক, কোন বিপদ হয়ে গেলে!”
“তুই এসব চিন্তা মনে আনিস না। এটাই তো ওদের দায়িত্ব। ওরা দেশের সেবার সবসময় এমন ভাবে নিয়োজিত থাকে জন্যই তো দেশের মানুষ নিশ্চিন্তে থাকতে পারে।”
“এটা অবশ্য তুই ঠিক বলেছিস। আমাদের তো নিজেদের স্বামীকে নিয়ে গর্ব করা উচিৎ।”
সুনীতি অহনার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুই কি আরাফাত ভাইকে ব্যাপারটা জানিয়েছিস গতকাল?”
অহনা বলে,”না রে। আমি শিওর না হয়ে জানাতে চাই নি। তাই তো আজ একেবারে হাসপাতালে প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট করাতে চলে এসেছি।”
সুনীতি বলে,”তুই তো বললি, অনেক সিম্পটম মিলে গেছে। তোর নাকি বমি, মাথা ব্যাথা হয়। পিরিয়ডও নাকি অফ। আমার মনে হয় রিপোর্ট পজেটিভই আসবে।”
সুনীতির বলা কথাটা শেষ হতে না হতেই একজন নার্স এসে অহনাকে ভেতরে যেতে বলল। সুনীতি আগেই ডাক্তারকে দেখিয়েছে। ডাক্তার বলেছে সবকিছু নর্মাল। এখন শুধু অহনার রিপোর্ট আসা বাকি।
কিছুক্ষণ পরেই অহনা খুশি মনে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে সুনীতিকে জড়িয়ে ধরে বলল,”রিপোর্ট পজেটিভ দোস্ত৷ আমি মা হতে চলেছি।”
সুনীতি উৎফুল্ল হয়ে বলে,”অভিনন্দন দোস্ত। আমাকে কিন্তু এক প্যাকেট মিষ্টি খাওয়াতে হবে।”
“হুম, খাওয়াবো খাওয়াবো।”
“শুধু তুই খাওয়ালে তো হবে না। আরাফাত ভাইয়ার পকেটও তো ফাঁকা করতে হবে। প্রথমবার বাবা হতে চলেছে।”
“আমি তো ভাবতেই পারছি না। আরাফাত এই খবরটা পেয়ে কতটা খুশি হবে! গতকাল ও আমাকে অনেক সুন্দর একটা সারপ্রাইজ দিয়েছে আর আজ আমি ওকে দেব।”
বলেই একটা স্মিত হাসি দেয়।
~~~~~~~~~
সীমান্তে তুমুল গোলাবর্ষণ চলছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও অস্ত্র পাচারকারী চক্রের মধ্যে। কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়। গুলি করতে করতে সাগর সহ কিছু সেনা সদস্য সেফজোনের বাইরে একটু বেশিই এগিয়ে গেছিল। আরাফাত ব্যাপারটা খেয়াল করে। এরইমধ্যে ২/৩ জন সেনাসদস্য গুলিবিদ্ধ হয়। সাগর সহ আরো ১০/১৫ যখন তখন বিপদের মুখোমুখি। আরাফাত বুঝতে পারে সে যদি এখন কিছু করে তাহলে এই ১০/১৫ জনের কাউকেই বাঁচানো যাবে না। এজন্য আরাফাত নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে যোগ দেয়। সাগর তাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”মেজর, আপনি নিরাপদে থাকুন। এখানে বিপদ হতে পারে। আমরা সবটা সামলাচ্ছি।”
“আমি তোমাদের সবাইকে এভাবে বিপদে ঠেলে দিয়ে একা নিজের কথা ভাবতে পারব না। এখানে তোমরা সবাই আমার দায়িত্বে আছ। তাই তোমাদের রক্ষা করাও আমারই দায়িত্ব।”
বলেই সে বন্দুকযুদ্ধ চালিয়ে যায়। ধীরে ধীরে অপরপক্ষকে অনেকটাই ধরাশায়ী করে দেয়। কিন্তু এরমধ্যে হঠাৎ একটা গুলি ছুটে এসে আরাফাতের বুক ভেদ করে যায়। আরাফাত সাথে সাথেই বুকে হাত দিয়ে লুটিয়ে পড়ে। সাগর চিৎকার করে বলে ওঠে,”মেজর!!”
আরাফাতের বুক থেকে তীব্র রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল তার সময় ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। শেষবারের মতো অহনার চেহারা ভেসে ওঠে আরাফাতের মানসপটে। সে একটা মলিন হাসি দেয়। সাগর আরাফাতের পাশে বসে পড়ে বলে,”মেজর! চোখ খোলা রাখার চেষ্টা করুন। উই উইল সেইভ ইভ।”
আরাফাত অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,”অহনা,,আমার অহনা,,,”
“মেজর,,”
আরাফাত বলে,”অহনার আমি ছাড়া আর কেউ নেই,,ওর খেয়াল,,,”
কথা সম্পূর্ণ করার আগেই আরাফাতের কথা চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যায়। সাগর একটা বিকট চিৎকার করে বলে,”না,,,মেজর চোখ খুলুন,,চোখ খুলুন প্লিজ,,”
বলেই কান্না শুরু করে দেয়।
To be continue……