#মনমোহিণী
#Part_10
#Writer_NOVA
‘ভাই, ভাবীরে হাত ধইরা সাবধানে নিয়া যাইয়েন। ঘুমের জ্বালায় চোহে দেকতাছে না।’
এনাজ উনার কথায় উত্তর দিলো না। গম্ভীর চোখে সিএনজি ওয়ালার দিকে তাকিয়ে মানিব্যাগ বের করে ভাড়া দিলো। ল্যাগেজ, ব্যাগ নিয়ে আমার পাশে দাঁড়াতেই বললাম,
‘উনি আমাকে ভাবী বললো আপনি কিছু বললেন না কেনো?’
‘কি বলবো?’
‘আশ্চর্য, কি বলবেন মানে? আমি কি আপনার বউ নাকি যে সে ভাবী বলবে।’
‘বলে ফেলছে তো ফেলছেই। এর জন্য কি আমি ঝগড়া করবো নাকি।’
‘ঝগড়া করতে কে বললো? বাধা দিয়ে বলতে পারতেন আপনার ভুল হচ্ছে ভাই। ও আমার স্ত্রী নন।’
‘আচ্ছা পরেরবার থেকে বলবোনি।’
‘আমি জানি, আপনি ইচ্ছে করে এমনটা করছেন।’
এনাজ কথার উত্তর না দিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলো। আমিও মুখ গোমড়া করে তার পিছনে হাঁটছি। আজকে ঘাটে প্রচুর ভিড়। তাড়াতাড়ি হেঁটেও এনাজের পাশাপাশি থাকতে পারছি না আমি। তাই এনাজ হাঁটা থামিয়ে এক সাইডে দাঁড়ালো।ডান হাত থেকে ল্যাগেজটা বাম হাতে নিলো। ডান হাতে আমার বাম হাতটাকে শক্ত করে ধরে এগিয়ে যেতে লাগলো। অবশেষে ভিড় ঠেলে আমরা লঞ্চে উঠতে সক্ষম হলাম। দোতলায় উঠে পাশাপাশি দুটো সিট নিয়ে বসে পরলাম। এনাজ ক্লান্ত হয়ে হেলান দিয়ে বসে পরেছে।
‘আপনার খারাপ লাগছে?’
‘কিছুটা অস্থির লাগছে।’
‘পানি খাবেন?’
‘দাও।’
সাইড ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দিলাম। উনি খানিকটা পানি খেয়ে বোতল ফেরত দিলো। ঘাটে যতটা উপচে পরা ভিড় ছিলো এখন ততটা নেই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একেকজন বাইরের পরিবেশ দেখছে। ছোলাবুট ওয়ালা বোল ভর্তি ছোলা নিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে অন্য দিকে চলে গেলো। দই, ঝালমুড়ি, পানি, সফট ড্রিংকস, চিড়া নারিকেল নানা রকম হকার ওয়ালারা তাদের জিনিসপত্র ফেরি করছে।
‘ছোলাবুট খাবা?’
আমি মাথা নাড়িয়ে না বুঝালাম। কিন্তু সে শুনলো না। বারান্দা দিয়ে ছোলাবুট ওয়ালা যেতেই দুজনের জন্য ছোলাবুট কিনলো। একটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আরেকটা নিজে খেতে লাগলো। মিনিট দশের ভেতরে লঞ্চ ছেড়ে দিলো। বাইরে তাকালে নজরে পরে চারিদিকে পানি আর পানি। হালকা বাতাস বইছে। ইচ্ছে ছিলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের পরিবেশ উপভোগ করবো। কিন্তু এনাজ যে আমায় একা ছাড়বে না তা আমি জানি। তাছাড়া তাকে সাথে নিয়ে গেলে ব্যাগ, ল্যাগেজ হাওয়া হয়ে যাবে।
‘আরো কিছু খাবে?’
‘না!’
‘লজ্জা পেয়ে মানা করো না।’
‘আমি মোটেও লজ্জা পাচ্ছি না।’
‘না, পেলেই ভালো।’
কিছু সময় পর টিকিট কাটতে এলো। এনাজ দুটো টিকিট কেটে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
‘অপ্রয়োজনীয় কাগজ ভেবে ফেলে দিয়ো না। তাহলে জরিমানা দিতে হবে।’
‘তাহলে আপনার কাছে রাখেন। আমি কোন ফাঁকে গোল করে মুড়িয়ে পানিতে ফেলে দেই তার ঠিক নেই।’
টিকিট দুটো ভাজ করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। আমি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করতে নিলে প্রিয় লিপবামটা পেলাম।এটা সবসময় আমার ব্যাগে থাকে। দেখে দিতে মন চাইলো। খাপ খুলে ঠোঁটে দিতে না দিতেই উনি ছোঁ মেরে আমার থেকে নিয়ে নিজের ঠোঁটে ঘষলো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতবাক।
‘এটা কি হলো?’
‘দেখতেই পেলে।’
‘আমাকে বললে আমি দিতাম। চিলের মতো থাবা দেওয়ার দরকার ছিলো না।’
হাতে লিপবাম ফেরত দিতে দিতে বললো,
‘নাও দিয়ে দিলাম।’
উনার ঠোঁট ছুঁয়েছে এটা। আমি কি আর এটা দিবো। উনার হাতে তুলে দিয়ে বললাম,
‘এটা আপনার কাছে রেখে দিন, আমি নিবো না।’
‘থ্যান্কস!’
সাথে সাথে লিপবামটা নিজের পকেটে পুরে ফেললো। আমার পছন্দের লিপবাম ছিলো ঐটা।কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে রাখলাম। পদ্মা সেতু এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। সবেমাত্র পিলারের কাজ চলছে। সেতু উদ্বোধন হলে লঞ্চ বন্ধ হয়ে যাবে। হঠাৎ এনাজের দিকে তাকাতেই দেখলাম সে মিটমিট করে হাসছে।
‘হাসছেন কেনো?’
‘এমনি।’
‘উহু এমনি নয়। কারণ বলেন।’
‘সত্যি বলবো?’
‘হ্যাঁ!’
‘আমার ফিল আসছে বউ নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি।’
‘ওহ আচ্ছা।’
আনমনে ওহ আচ্ছা বলতেই খেয়াল হলো উনি কি বলেছে। চোখ দুটো বড় বড় করে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি বললেন,
‘এভাবে তাকিয়ে থাকবে না। আমার লজ্জা করে।’
লজ্জা পাওয়ার ভান করে বললো। আমি আহাম্মকের মতো উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
দেড় ঘন্টা পর মাওয়া ঘাটে পৌঁছালাম।সময় মনে হচ্ছে ঝড়ের বেগে চলে যাচ্ছে। বাস স্ট্যান্ডের সামনে আসতেই আব্বুকে দেখতে পেলাম। আব্বুকে দেখে এনাজ সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলো। আমি এনাজকে আব্বুর সাথে পরিচয় করে দিলাম। আব্বুর সাথে টুকটাক কথা বললো। এনাজ এখান থেকে ঢাকার বাসে উঠে যাবে। আমার থেকে এনাজ বিদায় নিতে এসে বললো,
‘সময়টা যে এতো দ্রুত চলে গেলো বুঝতে পারলাম না। জীবন পাতায় যত্ন করে স্মৃতিটুকু আগলে রেখে দিবো। খুব শীঘ্রই দেখা হবে। অপেক্ষা করো, মনমোহিণী।
আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে উনি ভিড়ে হারিয়ে গেলো। আমি নিষ্পলক চোখে তাকে খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। সময়টা একটু ধীরে চললে কি হতো? বিদায়ের সময়টুকু বিষাদ ঘেরা ছিলো যে।
★
কেটে গেছে অনেক দিন। মাস ঘুরিয়ে নতুন মাস এলো। কিন্তু এনাজ এলো না। খানিকের সময় পরিচয়ে আমার মন নিয়ে সে যে পালিয়ে গেলো এর জন্য কি শাস্তি দেওয়া যায়? একবার আসুক! খবর আছে। তায়াং ভাইয়া নিজে থেকে আমাকে এনাজের মোবাইল নাম্বার দিয়েছিলো। আমি সেভ করে রেখে দিছি। কিন্তু কল করার সাহস হয়নি। আজও কন্টাক্ট লিস্ট থাকা এনাজ নামটা খুঁজে বের করলাম৷ কল দিবো কিনা দিবো ভেবে রেখে দিলাম। দিবো না কল। উনি তো চাইলে দিতে পারতো। আমি দিবো কেন?তবে প্রায়সময় একটা নাম্বার থেকে ম্যাসেজ আসে। ম্যাসেজগুলো এমন-
‘মনমোহিণী, কেমন আছো? জানি ভালো আছো।আমায় ভুলে ভালো তো থাকবেই।’
‘আমায় কি মনে পরে না?’
‘এতো সহজে ভুলে গেলে?’
‘মন চুরি করে এখন ভুলে যাওয়ার ভান করছো মনমোহিণী? এটা কিন্তু ঠিক নয়।’
আমার মন বলে এটা এনাজের কাজ। কিন্তু কল দিলে সিম বন্ধ বলে। তাই কল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।
কিছুদিন গোয়েন্দা হয়ে অনুসন্ধান করেও ফলাফল শূন্য। কিছু পেলাম না। তাই এসব চিন্তা ঝেরে পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে গেছি। হরদমে ক্লাশ শুরু হয়েছে। কলেজ থেকে বাসা, বাসা থেকে কলেজ। এই অব্দি আমার দৌড়।
সেদিন দুপুরবেলা কলেজ থেকে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। আম্মু এসে বলছে,
‘হাত-মুখ না ধুয়ে এভাবে শুয়ে পরলি কেন?’
মাথা উঠিয়ে আম্মুর চোখের দিকে তাকিয়ে আবার ঠাস করে শুয়ে পরলাম। ক্লান্তিতে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আম্মু হাত ধরে টেনে তাড়া দিয়ে বললো,
‘বাসায় মেহমান এসেছে। এভাবে শুয়ে থাকিস না।’
কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কে এসেছে?’
‘হাত-মুখ ধুয়ে ভালো একটা জামা পরে আয়।’
‘কে এসেছে বলবে তো।’
‘তুই আগে ফ্রেশ হয়ে আয় বলছি।’
ভেবেছিলাম উঠবো না। আম্মুর পিড়াপিড়িতে উঠতে হলো। ফ্রেশ হয়ে এমব্রয়ডারির একটা সুতি থ্রি পিস পরে ওয়াসরুম থেকে বের হতেই ছোট বোনের সাথে দেখা। ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কে এসেছে রে?’
‘আমি চিনি না।’
‘সত্যি বল।’
‘সত্যি চিনি না বোইনে। পাঞ্জাবি পরা একজন মধ্যবয়স্ক লোক।আব্বুর থেকে উনার বয়স বেশি হবে।’
‘কখন এসেছে?’
‘এই তো বারোটার দিকে। আমার কি মনে হয় জানো বোইনে?’
ফিসফিস করে ছোট বোন বললো। আমি তােয়ালে দিয়ে মুখ মুছে চেয়ারের ওপর রেখে ঘুরে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি?’
‘তোমাকে দেখতে এসেছে।’
‘ধ্যাত!’
‘হ্যাঁ, সত্যি কথা। আসার পর থেকে তোমাকে দেখতে চাইছে।’
ছোট বোনের কথায় যতটা না কপালে চিন্তার ভাজ পরছে তার থেকে মেজাজ গরম হয়ে গেলো। বাবা-মা কে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছি এখন বিয়ে করবো না। আব্বু রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
‘নোভামণি একটু এদিকে আসো তো।’
‘জ্বি আব্বু বলো।’
‘মাথায় সুন্দর করে ঘোমটা দাও।’
‘কে আসছে আব্বু?’
আব্বু উত্তর দিলো না। আমি ঘোমটা টেনে আব্বুর পিছন পিছন পাশের রুমে গেলাম। সুন্দর করে একটা সালাম দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। লোকটা সালামের উত্তর নিয়ে বললো,
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। এসো মা মণি! তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’
আমি একবার আব্বুর দিকে তাকিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেই উনি খুশি হয়ে গেলেন। উনার চেহারার দিকে ভালো করে তাকাতেই কিছুটা চমকে গেলাম। উনি আমাকে বললো,
‘আমার ছেলেটা সহজে আমার কাছে কিছুর জন্য বায়না করে না। কিন্তু এবার আমার হাত ধরে বাচ্চাদের মতো করে করুন সুরে বায়না করে বললো, বাবা আমার একটা মেয়েকে অনেক পছন্দ হয়েছে।আমার শুধু ওকে চাই।বিয়ে করলে ঐ মেয়েকেই করবো। তুমি তোমার ছেলের জন্য ওকে এনে দিতে পারবে না?’
#চলবে