মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-০২

0
52

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#২য়_পর্ব

ঐন্দ্রিলার বিস্ময় চরম শিখরে পৌছে গেলো যখন সকলের সামনে বেপরোয়ার মতো টুপ করে তার গালে চুমু খেলো অভ্র। নরম গালে রুক্ষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই শিরদাঁড়া বেয়ে অদ্ভুত শিহরণ নেমে গেলো। মস্তিষ্ক ধপ করে অসাড় হয়ে গেলো। নিজেকে ধাতস্থ করতেই রাগে গা রি রি করে উঠলো। জুনিয়ররা গুলো হা করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। বিনা পয়সায় যেনো রঙ্গ দেখছে। ঐন্দ্রিলা কিছু বলতেই যাবে অভ্র তার সফেদ দাঁত গুলো বের করে নির্লজ্জের মত বললো,
“দিস ইজ নট ফেয়ার বাবু। আমি ওখানে দু ঘন্টা রোদে বসে আছি আর তুই এখানে গল্প করছিস। আমাকে দু ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য এটা তোর শাস্তি বাবু।”

বাবু? কে বাবু? কার বাবু? তোকে রোদে শুটকি মাছ বানানোর জন্যই তো দাঁড় করিয়ে রাখা। ঐন্দ্রিলার এতো রাগ হলো যে সে বাকশক্তি হারিয়ে ফেললো। অনেক কিছু বলার ইচ্ছা থাকলেও রাগের চোটে সব তালগোল পাকিয়ে গেলো। অভ্রকে যদি কষিয়ে থা’প্প’ড় মারা যেত তাহলে বোধ হয় শান্তি লাগত। কিন্তু সামনে জুনিয়র গুলো চোখ বের করে এনে তাদের দেখছে। ঐন্দ্রিলা কিড়মিড়িয়ে বললো,
“তুই এখানে কি করছিস?”
“ওমা তোকে নিতে এসেছি। এগুলো কি তোর জুনিয়র নাকি? হ্যালো?”

জুনিয়রদের হ্যালো বলায় তারাও গণহারে হ্যালো বললো। একটি ছেলে শুধালো,
“ভাইয়া আপনি?”
“পরিচয়টা দেই, আমি তোমাদের আপুর উড বি। আগামী ……”

কথা শেষ করতে পারলো না অভ্র। তার মধ্যেই ঐন্দ্রিলা জুনিয়রদের বললো,
“থাকো তোমরা আমরা আসছি”

বলেই অভ্রের হাত একরকম টেনে নিয়ে গেলো সে। অভ্র তখনো তার নির্লজ্জতা কমালো না। ঢং করে হাত নেড়ে নেড়ে সবাই “বাই” বললো। ঐন্দ্রিলা অভ্রকে নিয়ে গেলো একটি ফাঁকা স্থানে। এটা দুই বিল্ডিং এর মাঝে সরু একটি জায়গা। সাধারণত প্রেম বা নেশা করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা এমন জায়গা খুঁজে। এখন এখানে কেউ নেই। এখানে এসেই ঐন্দ্রিলা অভ্রের হাত ছেড়ে দিলো। রাগে গজগজ করছে ঐন্দ্রিলা। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো মস্তিষ্ক ঠান্ডা করতে। অভ্র আশপাশটা ভালো করে দেখলো। জায়গাটা খুব নিরিবিলি। ফলে সাংঘাতিক একটি কাজ করে বসলো সে। মুহূর্তের মধ্যে ঐন্দ্রিলাকে চেপে ধরলো দেওয়ালের সাথে। ফিচেল হাসি হেসে বললো,
“এখানে কি প্রেম করার জন্য ডেকে এনেছিস?”
“এটা কি ধরণের অসভ্যতা?”

রোষানলে দগ্ধ কন্ঠে শুধালো ঐন্দ্রিলা। যা একটু রাগ কমেছিলো তা আবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। চোখ থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হতে লাগলো। এতে অবশ্য তার কোমরখানা বাজেয়াপ্ত করা সুঠাম দেহী শ্যামপুরুষের কিছুই যায় আসছে না। তার দৃষ্টি স্থির, গভীর। সেই দৃষ্টি যে কারোর নয়নাভিরাম করতে যথেষ্ট। ঐন্দ্রিলার রাগে লালচে মুখখানা দেখে যেনো বাঁকা হাসি বর্ধিত হলো মানবের মুখে। রুক্ষ্ণ তর্জনী ঐন্দ্রিলার কোমল গালে বিচরণ করতে করতে বললো,
“তোকে শেষ বারের মতো ওয়ার্নিং দিচ্ছি, আমার কথার অন্যথা হলে ভালো হবে না৷ আজ শুধু সবার সামনে চুমু খেয়েছি। অন্যবার এর থেকেও ড্যাঞ্জারাস শাস্তি দিবো”

বদমাইশ, অভদ্র অভ্রের এমন সতর্কবানীতে আরেকদফা রাগে গা জ্বলে উঠলো যেনো ঐন্দ্রিলার। চোখ রাঙ্গিয়ে ক্ষীপ্ত গলায় বললো,
“আমাকে হুকুম দেওয়ার তুই কে রে? আমার বাবা?”

সম্মুখের মানুষটির হাসি এবার প্রশস্ত হলো যেনো মুখখানা ঝুকিয়ে নিলো ঐন্দ্রিলা বরাবর। দূরত্ব খুব ই কম। এখন ই ঠোঁটজোড়া মিশে একাকার হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বান্দা তা করলো না। বরং কানের কাছটায় ঠোঁটখানা মিশিয়ে স্বর খাঁদে নামিয়ে বললো,
“উহু, তোর বাবার জামাই”

একটা মানুষ এতো নির্লজ্জ হয় কি করে! সৃষ্টিকর্তা কি এই বেয়াদবকে একটুও ভালো বুদ্ধি দেন নি? না আর সহ্য হলো না ঐন্দ্রিলার। গায়ের যত শক্তি আছে তা দিয়ে এই দানবদেহের পায়ে সজোরে লাথি বসিয়ে দিলো সে। অতর্কিত লাথিতে অভ্র পিছিয়ে গেলো। ব্যাথা পেলো বোধ হয়। মুখ কুচকালো কিঞ্চিত। রাগে গজগজ করতে ঐন্দ্রিলা বললো,
“আরেকবার আমাকে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করলে দু হাত বেঁধে ঐ বিশ্রী ঠোঁটে বিচুটি ঘষে দিবো”

অভ্র পা ঘষতে ঘষতে হাসতে লাগলো। এই হাসি পৃথিবীর সবচেয়ে কলঙ্কিত হাসি। ঐন্দ্রিলা কপাল কুচকে তা দেখলো। অভ্র তখন নির্লজ্জ গলায় বললো,
“সেটা সময় বলে দিবে। বিয়েটা হতে দে, আমি দিনরাত খালি চুমুই খাব। দেখবো আমার হাত কি করে বাঁধিস”
“বে’য়া’দ’ব। প্রথমত আমি তোকে বিয়ে করবো না, আর যদি বিয়ে হয়ও আমি তোর জীবনে আগুন ধরিয়ে দিব”

ঐন্দ্রিলার গলার নালী ফুলে উঠছে শুধু। এতো রাগ হচ্ছে। এই নব্বই কেজির হনুমানটিকে ইট মেরে মাথা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মাথা অবধি তার উচ্চতা নয়। তাই মাথা ফাটাতে পারছে না। অভ্র এখনো হাসছে। সদর্পে বললো,
“আমি তখন দমকল মানে শ্বাশুড়ি মাকে সামনে দাঁড় করিয়ে দিব”

মার কথা শুনতেই ঐন্দ্রিলা চুপ করে গেলো। অভ্র টিটকারি মেরে বললো,
“কি দম ফুরালো? এবার বাড়ি চল। দমকল অলরেডি তিনবার ফোন করেছে”
“আমি মরে গেলেও তোর সাথে যাব না, আমি তো বুঝছি না তুই কলেজে ঢুকলি কি করে?”
“পাত্তি দিয়ে। একশ টাকায় দারোওয়ান ব্যাটা সালাম ঠুকে ঢুকতে দিয়েছে। আর মরার শখ হলে নিজে মর, আমাকে টানবি না। আমি শ্বাশুড়িকে ফোন করে বলে দিচ্ছি, তার মেয়ে আমার সাথে আসছে না”

আবার কুপোকাত করলো অভ্র ঐন্দ্রিলাকে। নাহ, মায়ের সাথে একটা দফারফা করতেই হবে। এই বজ্জাতের সাথে বাড়ি ফিরতে হবে ভাবতেই মুখ কুচকালো ঐন্দ্রিলা। অভ্র তখন ভেঙ্গিয়ে বললো,
“লাগে তো চুন্নীর মত, আর কত মুখ কুচকাবি”
“হ্যা, এই চুন্নী তোর মাথা খুলে র’ক্ত খাবে।“
“জানি তো, এ আর নতুন কি”

সারাটা রাস্তা ঝগড়া করতে করতেই বাড়ি ফিরলো তারা। ঐন্দ্রিলাকে গেটে নামিয়ে ভাব নিয়ে বলল,
“শ্বাশুড়ি বলেছে প্রতিদিন তোকে কলেজ দিয়ে এবং নিয়ে আসতে। সকালে আমার সময় হবে না। আমি রিক্সা ঠিক করে দিবো তা দিয়ে যাবি। প্যা পু করবি না। একেই দু ঘন্টা রোদে বসে আমার ঘিলুর কাবার হয়ে গেছে”
“আমার বয়েই গেছে তোর সাথে যেতে”

বলেই হনহন করে ঘরে চলে গেলো ঐন্দ্রিলা। একটা ধন্যবাদও দিলো না। অভ্র কিছু সময় শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার যাবার পানে। তারপর গাড়িতে স্টার্ট দিল।

*****

অভ্রর পরম বন্ধু এবং সাগরেদ বিল্লালের মুখে বিস্ময়। অভ্র বিয়ে করবে কথাটা হজম হচ্ছে না তাও আবার ঐন্দ্রিলাকে। পাড়ায় এদুজন বিশ্ব ঝগরুটের খেতাব প্রাপ্ত মানব-মানবী। একে অপরকে নিঃসন্দেহে গরল পান করিয়ে দিতেও এরা দ্বিধাবোধ করবে না। সাপ আর নেওলে কি ঘর করতে পারে? অভ্রকে দেখলেই তো ফোঁস করে উঠে ঐন্দ্রিলা। অভ্র তখন সারের হিসাব মিলাচ্ছিলো। বিল্লালের বিস্মিয় ড্যাবড্যাবে নজর তাকে বিরক্ত করলো। হিনহিনে স্বরে শুধালো,
“বলে ফেল?”
“তুই আসলে বিয়ে করছিস?”
“নকলে কি করে বিয়ে করে?”

বিল্লাল চ সূচক শব্দ করলো। টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে বললো,
“তুই ঐন্দ্রিলাকে আসলেই বিয়ে করছিস?”

অভ্র ভনীতা ছাড়া উত্তর দিলো,
“হ্যা”
“কেন? ঐন্দ্রিলা কেনো? তোদের যা অতীত তাতে সংসার তো যুদ্ধ ময়দান হয়ে যাবে রে”

অভ্র হাসলো। যা দূর্বোধ্য ঠেকলো বিল্লালের কাছে। বিরক্তি নিয়ে বললো,
“হাসিস না তো, বিরক্তি লাগছে। কি উদ্দেশ্যে বিয়ে করছিস সেটা বল”
“কোনো উদ্দেশ্য নেই। উদ্দেশ্যহীন বিয়ে আমার”
“তাই বলে ঐন্দ্রিলা”
“ওর থেকে ভালো আর কে আছে? শোন বিবাহিত জীবন মানেই স্বাধীনতার অবক্ষয়। মনোরঞ্জনের দূর্যোগ। ঐন্দ্রিলার সাথে থাকলে এদুটো কখনোই হবে না। হয় ও আমার মাথা ফাটাবে নয় আমি ওর। কিন্তু জীবনেও বোর হব না”
“ও তোকে ঘৃণা করে অভ্র”

বিল্লালের শেষ উক্তিতে থেমে গেলো অভ্র। কিছুক্ষণ চুপ রইলো। তারপর সহাস্য কন্ঠে বললো,
“এজন্যই তো কখনো বোর হব না”

বিল্লাল কথা বাড়ালো না। লাভ নেই এই আধপাগলের সাথে কথা বাড়িয়ে।

******

সকাল থেকে নীলম্বরের মনখারাপ। সূর্যের তেজ ক্ষীণ। মেঘ করেছে দক্ষিণে। বাতাস নেই, তবে বৃষ্টি হতে পারে। ঐন্দ্রিলা বের হল দেরি করে। কেঁচিগেট খুলতেই শান্ত মেজাজ খিঁচিয়ে গেলো। সামনের দোকানে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে অভ্র। হাতে একটি জ্বলন্ত সিগারেট। বিল্লাল একটি রিক্সা ডেকে বললো,
“ভাবী রিক্সায় উঠেন”

ভাবী শব্দটা বিষের মত ঠেকলো যেন। সাপের মত ফোঁশ করে উঠলো ঐন্দ্রিলা,
“এই আমি তোমার কোন ভাইয়ের বউ? একদম আজেবাজে দামে ডাকবে না। আপু বলে ডাকবে আমায়”

বিল্লাল বিপাকে পরলো এই সাপে নেওলের যুদ্ধে সে মনে শহীদ হবে। আমতা আমতা করে বলল,
“আচ্ছা আপু, রিক্সায় উঠেন”

রিক্সায় উঠতে যাবে অমনি কোথা থেকে অভ্র এসে বললো,
“ও কি তোর মায়ের পেটের বোন? আপু বলছিস কেন? আমার বউ ও। ভাবী বল”
“আমাকে ভাবী ডাকলে তোমার খবর আছে বিল্লাল”
“ওকে ভাবী না ডাকলে তোকে গোডাউনেই ঢুকতে দেবো না। খাইস আর সিগারেট”
“বিল্লাল ভালো হবে না কিন্তু”

দুজনের যন্ত্রণায় অতিষ্ট হয়ে গেলো বিল্লাল। অধৈর্য্য হয়ে বললো,
“ধ্যাত, থামবি তোরা। এই ভাবিআপু আপনি রিক্সায় উঠেন। এখন উঠবেন। নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না”

বিল্লালের ধমকে উভয় শান্ত হল। বাধ্য হয়ে রিক্সায় উঠলো ঐন্দ্রিলা। কারণ বৃষ্টি নামবে। এই বেয়াদবের জন্য সে ভিজবে কেন?…………

*****

বিকালের মেঘলা অম্বর তলে ঘাসের উপর বসে রয়েছে ঐন্দ্রিলা। অপেক্ষা নিজের গাদা প্রেমিকের। হ্যা, ঐন্দ্রিলা প্রেম করে। প্রেমের বয়সকাল তিনমাস। প্রেমটা গতানুগতিক ধারাতেই হয়েছে। ছেলেটি তার কলেজেই পড়তো। সেই সময় থেকেই তাকে পছন্দ করতো। সেই পছন্দের সূত্র ধরে প্রেম। ঐন্দ্রিলার মাঝে মাঝে প্রশ্ন হয় তার মত রগচটা, ঝগরুটে মানুষের সাথে এই ছেলেটা কি করে মানিয়ে নিচ্ছে? অবশ্য দরকারের সময় তাকে কোনোকালে পাওয়া যায় না। এই যে তিনদিন যাবৎ হন্নে হয়ে ঐন্দ্রিলা তাকে খুঁজছে মহাশয়ের টিকিও পেলো না। আজ ফোন খুলেছে। ঐন্দ্রিলা ফোন ধরতেই বললো,
“তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে”

ফলে বিয়ের কথাটাই বলতে পারলো না ঐন্দ্রিলা। গাধার নাম পিয়াল। আধ ঘন্টা হয়ে গেছে এখনো পিয়ালের দেখা না মেলায় বিরক্ত হয়ে উঠে যেতে নিলেই তার দেখা মিললো। রাগী স্বরে শুধাতেই নিবে দেরির কারণ, লক্ষ করলো ছেলেটির চোখের নিচে কালচিটে। বা হাত গলায় ঝুলছে। অস্থির স্বরে শুধালো,
“এগুলো কি হয়েছে?”
“কি আবার হবে মা’র খেয়েছি”
“কে মে’রেছে তোমাকে?”
“কে আবার, তোমার পাড়ার গু’ন্ডাটা, অভ্র। শুধু মারেই নি, বলেছে তোমার সাথে কথা বললে ও আমাকে আইসিউতে পাঠিয়ে দিবে। ঐন্দ্রিলা আমি আগে জানলে কখনো তোমার সাথে প্রেম করতাম না। আমাকে মাফ কর। আজ থেকে তোমার আমার ব্রেকাপ…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি