মনের কোণে পর্ব-১০+১১

0
287

মনের কোণে🥀
#পর্ব_১০
আফনান লারা
.
সুমনের রুমের দরজা আলতো করে লাগানো ছিল।লিখি ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই পা টিপেটিপে ওর রুমের ভেতরে এসে হাজির।
নাবিলের খবর নেই।লিপস্টিক মুছে রাগ দমিয়ে খেতে বসে গেছে।
এদিকে লিখি আলো জ্বালিয়ে পুরো রুম সার্চ করে ড্রয়ারের ভেতর নাবিলের ফোনটা পেয়ে খুশিতে এক লাফ দিলো আর তখনই লোডশেডিং ঘটলো।অন্ধকারে হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কোনোমতে দরজা অবধি ফিরে যাচ্ছিল সে।হঠাৎ নিজের সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পেরে ভয় মনে বাসা বাঁধলো।ঢোক গিলে লিখি বললো,’সরি সুমন ভাইয়া।আমি আসলে ভুলে আপনার রুমে ঢুকে গেছি,অন্ধকার তো তাই আন্দাজ করতে পারিনি।’

অদ্ভুত!সামনের মানুষটা কিছু বলছেনা।লিখি সুযোগ বের করে চুপচাপ সরতে নিতেই মানুষটা তার হাত ধরে বললো,’আমাকে লিপস্টিক লাগিয়েছিলে না?দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা’

কথাটা বলে নাবিল লিখির মুখে তিব্বত ঘামাচি পাউডার ঘষে দিলো।লিখি মুখ ডলতে ডলতে বললো,’আপনি কি বাচ্চাদের মতন শুরু করলেন।আশ্চর্য ‘

‘লিপস্টিক লাগালে কোন সাহসে?’

‘পাউডার লাগালেন ভাল কথা,তাই বলে ঘামাচি পাউডার লাগালেন কেন?ছিঃ!এই পাউডার কেউ মুখে লাগায়?’

‘ছেলেরা কেউ লিপস্টিক লাগায়?’

‘ধরেন আপনার ফোন।অসহ্যকর একটা লোক’

নাবিল নিজের ফোন পেয়ে ফ্লোরে বসে গেলো পা ভাঁজ করে।তারপর লক খুলে নিজের ছবি সব আছে কিনা দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।লিখি অন্ধকারে দু একটা বাড়ি খেয়ে দরজার কাছে এসে দরজা হালকা ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করছে সুমনের বোন আর মা কি করে।
তারা মোমবাতি নিয়ে ওখানেই অপেক্ষা করছে ওদের আসার।

‘শুনেন।আমরা এখব পালাবো’

‘কি করতে?’

‘এখন যদি ডাইনিংয়ে যাই ওরা আমাদের পাহারাতে রেখে দিবে সকাল পর্যন্ত,তখন সুমন ও এসে যাবে।তার চেয়ে বরং ফোন যখন পেয়েই গেছি আমরা, এই মুহুর্তে পালিয়ে যাব’

‘তা ঠিক বলেছো।কিন্তু রুম থেকে বের হবো কি করে?’

‘বারান্দা আছেনা?দালানের কাজ বাকি আছে।বারান্দায় গ্রিল-টিল কিছু লাগানো হয়নি।চলুন আমরা ওখান দিয়ে পালাই’

নাবিল উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’কিন্তু আমাদের ব্যাগ তো ড্রয়িং রুমের সোফাতেই।সেগুলো আনবে কি করে?’

‘তাই তো।আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।এখন কি হবে?’

লিখি মাথা খাটাচ্ছে।ওপাশ থেকে সুমনের মা কয়েকবার করে ডাকছেন তাদের দুজনকে।শেষে লিখি নাবিলের মুখের দিকে চেয়ে বললো,’আমার ফোন আমার হাতে।ঐ ব্যাগে দুটো জামা ছাড়া আর কিছু নেই।পরে কিনে দিতে পারবেননা?ব্যাগ আনতে গেলে ধরা পড়ে যাব”

‘আমার ব্যাগেও জামা ছাড়া কিছুই নেই।ঠিক আছে চলো যাই’

দুজনে বারান্দা দিয়ে বেরিয়ে পড়লো সিদ্ধান্তে এসে।এখন আবারও সেই অন্ধকার পথে হাঁটছে দুজন।অনেকটা পথ আসার পর নাবিল বললো,’আমি তো নিজের খাবারটা খেলাম,কিন্তু তুমি তো কিছুই খেলেনা’

‘বেঁচে ফিরতে পারলে অনেক খাওয়া যাবে।আচ্ছা এইবার কই যাব আমরা?’

‘আমি জুনায়েদকে ফোন করে ছাত্রাবাসের খবর নিচ্ছি,তুমি হেনাকে ফোন করে হোস্টেলের খবর নাও।পরিস্থিতি কেমন সেটা জেনে নাহয় আমরা ঢাকায় ব্যাক করবো’
—-
দুজনে দুদিকে কল করেছে।জুনায়েদ জানিয়েছে নাবিলের বাবা পাঁচ- ছয়জন লোক পাঠিয়েছেন ছাত্রাবাসে।তারা গেটের বাহিরে অপেক্ষা করছে নাবিলের ফিরে আসার।
এদিকে হেনা জানিয়েছে লিখির বড় ভাই নাকি দলবল নিয়ে চন্দ্রাঘাট সহ পুরো হোস্টেলের এরিয়ার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।কয়েকবার ওদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেও দেখেছে সে।
এত বড় বিপদ সামনে দেখে দুজনে দুজনের দিকে তাকালো।
এই অচেনা শহরে তাদের ঠাঁই কোথায় হবে?কি করে কয়েকটা দিন তারা গা ঢাকা দিয়ে এখানে থাকবে।বাসা ভাঁড়া করে থাকা যায় কিন্তু তাতে হতে হবে দম্পতি। কিন্তু তারা তো বিবাহিত না।তবে কি করে থাকবে?
হেঁটে হেঁটে সেই বাস স্টেশন এসে থেমেছে তারা।রাত দুইটা বাজে তখন।পথে কুকুর ছাড়া আর কেউ নেই

লিখি ফুটপাতে ফু দিয়ে জায়গা পরিষ্কার করে বসে বললো,’কতদিন থাকতে হবে এখানে?’

‘জানিনা’

‘এক কাজ করেন,আপনি আপনার বাসায় ফিরে যান’

‘আর তুমি?’

‘আমি তো ফিরবো না।ফিরলেই….’

নাবিল ও বসলো পাশে।দুজনে গালে হাত দিয়ে ভাবছে কি করা যায়।

‘চলো হোটেলে থাকি’

‘কতদিন থাকবেন?’

‘তাও ঠিক।এতদিন থাকলে পকেটের সব টাকা দুদিনেই শেষ হবে।হোটেলে যে চওড়া দাম’

‘আচ্ছা ফেইক রেজিস্ট্রি পেপার বানানো যায়?’

‘যায় তো।তবে এই দুই নাম্বারি কাজের কারখানা খুঁজে পাবো কই?এই শহরের সবই তো নতুন লাগে।
তাছাড়া তুমি আমার সাথে একই ঘরে থাকবে?কিংবা আমি থাকবো?এটা তো অসম্ভব’

‘তো এক কাজ করি।রংপুরে মেসে থাকি।আমি চুরি করে পেট চালাতে পারবো।ব্যাপার না’

‘এটা ভাল বুদ্ধি।আমিও মেসে থাকার ব্যবস্থা করে নেবো।কিন্তু সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা তো করতে হবে,এই রাতটা এখানে কাটানো ছাড়া আর উপায় নেই দেখছি’

লিখির পেটে গুড়গুড় করে ডেকে উঠেছে।সে জিভ বের করে বললো,’হাসবেন না বলে দিলাম।আপনার ফোন খোঁজার চক্করে আমার কিছু খাওয়া হলোনা বলে আমার পেট আমায় গা*লি দিচ্ছে এখন’

‘দোকান ও বন্ধ, নাহলে চিপস কিনে দিতাম।যাই হোক ফোন ফিরিয়ে দিয়েছো, তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।’

লিখি কিছু বললোনা,চুপচাপ ফুটপাতে বসে পা দুলাচ্ছে।নাবিল ফোনের দিকে চেয়ে ভাবছে রংপুরে মেস কোথায় পাবে।

‘রাধাবল্লভ রোডে একটা মেস থাকার কথা যতদূর জানি,এর আগে যখন রংপুর এসেছিলাম তখন বাসে থাকতে দেখেছি’

‘তাহলে ওখানে তোমার থাকার ব্যবস্থা করে আমি আমার ব্যবস্থা করে নেবো’

লিখি মাথা নাড়িয়ে চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো।এখান থেকে চাঁদটাকে স্পষ্ট দেখা যায়।গাছ নেই বলে চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে গোটা বাসস্ট্যান্ড।চাঁদের আলো দেখলে খিধে কমে যায়,ভয় বেড়ে যায়।
ভয়ে ঢোক গিলে লিখি পাশ ফিরে তাকালো।নাবিল তার ফিরে পাওয়া ফোন ঘেঁটে দেখছে।
লিখি ও নিজের ফোন টিপে দেখলো চার্জ নেই বলে ফোন অফ হয়ে আছে অনেক আগেই।
সময় কাটানোর জন্য নাবিলের সাথে কথা বলবে বলে ঠিক করে সে বললো,’আচ্ছা আপনি তো চাকরি করেননা।তবে সবকিছুর জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা কোথা থেকে পান?’

‘আমার মা দেয়’

‘আমায় বেলায় আমার মা বাবা দুজনেই ভিলেন ছিল এবং আছে।কেউ সাহায্য করেনি’

নাবিল ঘুরে বসে বললো,’তুমি পালালে কেন?’

‘সে বিরাট কাহিনী।যেমনটা হয় মেয়ে দের সাথে! আইএ পাশ করলেই বিয়ে দেওয়ার প্রকোপ বাড়ে লিফটের গতিতে। বিদেশগামী এক বুড়ো ব্যাটার সাথে বিয়ে ঠিক করেছিল বাবা।বিশাল বড়লোক।বিয়ের পর নাকি আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে।ব্যাটার ভূড়ি দেখেই বুঝেছি বউ আরও ছটা আছে।’

‘এই জন্য পালালে?’

‘হুম,কারণ তারা আমার মতকে প্রাধান্য দিচ্ছিলো না’

‘তবে এখনও খুঁজছে কেন তোমাকে?ঐ বুড়োর তো এতদিনে তোমার বয়সের মেয়ে একটাও হয়ে যাওয়ার কথা’

‘হয়ত আরেক বুড়োর খোঁজ পেয়েছে।বুঝলাম না কোটিপতি সব কি বুড়োই হয়?সুন্দর দেখে কোটিপতি হতে পারেনা?ইয়াং’

‘টাকা কামাইতে গেলেই বুড়ো হয়।এই দেখো আমায়,আমি টাকা কামাই না।যখন কামাতে যাব তখন আমার বয়স ত্রিশে পড়বে।তখন কোনো এক যুবতীর কাছে আমিও হবো বুড়ো।ওসব বাদ দাও,আগে বলো চুরির মতন একটা কাজকে পেশা করে তুলছো কেন?’

‘সেটা আরেক কাহিনী।পরে কখনও বলবো’

নাবিল আর জিজ্ঞেস করেনি।লিখিও কথা বাড়ায়নি।তিনটা বাজার কয়েক মিনিট আগে লিখির চোখ ঝাপসা হয়ে রাজ্যের ঘুমের দেখা পেয়ে গেলো সে।ফুটপাতের সাথে থাকা দেয়ালে মাথা হেলান দিয়ে রেখে পা গুটিয়ে শুয়ে পড়ে সে।
নাবিলের মনে হলো একটা হোটেল নিলে ভাল হতো।কিন্তু হোটেল ম্যানেজমেন্ট তো হুট করে কোনো কাপলকে থাকতে দেবেনা।কাগজপত্রের ঝামেলা।রাতের ঘুম কি জিনিস তারাই বোঝে যারা রাত জাগে বাহিরে।এরকম অস্বস্তিকর পরিবেশে তাই নাবিলের চোখে ঘুম নেই।সে পাহারাদারের মতন বসে এদিক ওদিক ফিরছে।
লিখির হাতে মশা, পায়ে মশা বসেছে তাই বারবার নড়ছে এপাশ ওপাশ করে।নাবিল চুপ থেকে শুধু দেখছে।ফিল্মের নায়কদের মতন তার কাছে জ্যাকেট নেই খুলে পরিয়ে দেবে বলে।তাই হাত দিয়ে মশা তাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করেও সে অসফল।লিখি ঘুমের ঘোরে মশাকে ইচ্ছেমত ঝাড়ছিল।সাথে তাকেও ঝাড়ছে যার কারণে তার এতদূর আসা।
চলবে♥

মনের কোণে🥀
#পর্ব_১১
আফনান লারা
.
ভোরের আলো আকাশ পেরিয়ে রোডে পড়তেই নাবিলের মনে হলো লিখিকে জাগানো উচিত।সে কিন্তু পুরোটা সময় বসে ছিল।এক মূহুর্তের জন্য ও ঘুমায়নি।
একটা শান্তির স্থান নাহলে তার ঘুম নিজ থেকেই আসেনা,এতে তারই বা কি দোষ?
অথচ লিখির মতন একটা মেয়ে কেমন একটা জায়গায় ঠিক ঘুমিয়ে পড়েছে।এখনও ঘুমে সে।মনে হয় এটাই তার প্রতিদিনের শোবার জায়গা।
কতটা শান্তি বিরাজ করছে তার মনের মাঝে নাহলে কেউ ফুটপাতে এতটা স্বাভাবিক ভাবে ঘুমাতে পারে?যার কিনা অভ্যাসই নেই।
অনেকক্ষণ ধরে ওকে ডেকে তুলবে নাকি তুলবেনা ভেবে দিশ করতে না পেরে শেষে ডেকেই ফেললো।লিখি ঘুম ঘুম কন্ঠে জবাব দিলো এই ভোরে হোস্টেল খুলবেনা।
নাবিল কি আর করবে আগের মতন গালে হাত দিয়ে দেখছে মানুষের দেখা পাওয়া যায় কিনা।
নিজের ফোনের সব চার্জ শেষ করেছে সারাটা রাত ধরে গেমস খেলে।এখন কি করে সময় কাটানো যায়।দূরে একটা ফাস্টফুডের দোকান খুলছে মনে হলো।লিখিকে রেখে নাবিল সেদিকেই গেলো দ্রুত হেঁটে।পথে কয়েকবার থেমে পেছনে তাকিয়ে ওকে নজরে নজরে রেখে গেছে।দোকানটা থেকে দুইটা পানির বোতল আর পাউরুটি কলা নিয়ে সে আবার ফেরত আসলো।
যেন আলোহীন জীবনে সূর্য হয়ে এসেছে এই দোকান।সব পাওয়া গেলো যা যা দরকার ছিল।পানি নিয়ে মুখে ছিঁটিয়ে লিখিকে এবার ভাল করে ডেকে তুললো সে।

‘রাতে তো কিছুই খাওনি।মুখ ধুয়ে এগুলা খাও।আমি দেখি দোকানদারের সাথে হোস্টেল নিয়ে আলোচনা করে আসি’

লিখি মাথাটা দেয়াল থেকে সরাতেই ওর মনে হলো মাথা চ্যাপ্টা হয়ে গেছে।এরকম লোহার মতন শক্ত দেয়ালে ঘন্টার পর ঘন্টা মাথা এমন করে রাখলে তো এমনই হওয়ার কথা।কিছু মূহুর্তের জন্য মনে হলো মাথাটাকে কেউ বেঁধে রেখেছে এতক্ষণ। হঠাৎ করে বাঁধন খুলে দেয়ায় মনে হচ্ছে ঘোর কাটেনি।
দুহাত দিয়ে মাথা চেপে চোখের সামনে খাবার দেখে অন্য কিছু ভাবতে ইচ্ছে হলোনা আর।জলদি মুখটা ধুয়ে টপাটপ খেতে লেগেছে সে।ওদিকে নাবিল দোকানদারের কাছে জানতে পারলো মেস এখানে নিশ্চয় আছে।তবে এখন ভর্তির সিজন।একটা মেস ও খালি থাকার কথানা।তারপরেও তারা খবর নিয়ে দেখতে পারে।
নাবিল ফেরত এসে দেখলো লিখি খাবার সব শেষ করে এখন খালি প্যাকেট নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখছে।
নাবিলকে দেখে জিজ্ঞেস করলো মেসের ব্যাপারে।

‘খবর তো নিলাম।তবে ওইসবে যেতে সকাল দশটা অবধি অপেক্ষা করতে হবে।এত সকাল সকাল মেসের ম্যানেজার ঘুম ছেড়ে কাগজে সই নেবেনা।তুমি বরং আরেক দফা ঘুম দাও।তোমার ঘুমের যে জোর’

লিখি নিজের ফোন খুঁজে নিয়ে বললো,’এখানে কাছে একটা পার্ক আছে।চিকলি পার্ক।চলুন ঘুরে আসি।মর্নিং ওয়াক হয়ে যাবে’

নাবিল ধপ করে ফুটপাতে বসে বললো,’পার্ক তোমার বাপের তো যে সাত সকালে ঢুকতে দিবে’

‘বাপের না তবে আমার নিজের ও হতে পারে।পার্কে ঢুকতে আমার টিকেট লাগবেনা,দারোয়ান লাগবেনা।আমি দেয়াল টপকে ঢুকে আবার দেয়াল টপকে বের হতে পারবো।পরিবার ছাড়া বাহিরে থাকলে পোলাপানরা পিঞ্জা টেকনিক শেখে ফেলে’

‘নিঞ্জা টেকনিক শুনেছিলাম,পিঞ্জা টেকনিক এ প্রথম শুনলাম,আচ্ছা এর মানে কি?’

‘মানে হলো নিঞ্জা টেকনিকের মতনই কিছুটা তবে একটু ভিন্নতর। ধরেন,একই মাটিতে পেঁয়াজ, শালগম চাষ হয়।দুটো দেখতে এক এক মনে হলেও স্বাদ ভিন্ন।’

‘আহারে আমার উদাহরণ।চলেন যাই।যদি ঢুকতে না পারো তো দেখিও।তোমার দাঁত দিয়ে আমি পার্কের তালা ভাঙবো’

লিখি চললো সামনের দিকে আর নাবিল পিছু পিছু।ওমা যতটা কাছে মনে হয়েছিল ততটা কাছেনা।অনেকদূরে।তাও শেষে তারা পোঁছেই গেলো।সকাল ছয়টার সময় পার্কের দারোয়ান থাকলেও সে ঘুমে থাকে।তাছাড়া এসময়ে টিকেট কাটলেও ঢুকতে দিবেনা।এখন পার্ক বন্ধ।
লিখি গেটটা দেখে চললো পেছনের দিকে।ভাউন্ডারি খুঁজে এক কোণায় গিয়ে টপকাবে।নাবিল অবুঝের মতন ওর সাথে সাথে চললো।

লিখি দেয়াল ধরে লাফালাফি করেও টপকাতে পারেনি।এই নিয়ে পাঁচবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ।নাবিল দুম করে ওর মাথায় বাড়ি একটা বসিয়ে দিয়ে বললো,’চোরামি চিন্তা ঘুরে সারাদিন মাথায়?মাঝে মাাঝে ইচ্ছা করে এই মাথাকে কাপড় কাচার মতন আচড়িয়ে ওয়াশিং পাউডার দিয়ে ডলে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে’

‘আমি ভাবলাম এই দেয়াল টপকানো সহজ হবে।আচ্ছা আপনি হাত পাতুন।আমি উঠার চেষ্টা করে দেখি’

‘তা নাহয় টপকালে।পরে তোমাকে বাহির করে আনবে কে সেটা ভেবেছো?’

‘ওহ হ্যাঁ তাই তো’

‘মেয়ে মানুষ এমন কেন?তাদের ধারণা পৃথিবীটা খুব সহজ,দুহাত নাড়ালেই দেয়াল টপকানো যাবে,ছোঁ মেরে সাধ্য হাসিল করা যাবে।তাদের মাথায় ঢুকেনা এটা সহজ না।এটা কঠিন!
এটা!!!’

‘হ্যালো??কি ভাবছেন?’

‘ভাবছি লিখি মেয়ে মানুষরা অসাধারণ হয়’

‘আপনার চেহারার ভাব দেখে মনে হলোনা আমার প্রশংসা করছিলেন,যাক গে!আপনার কাছ থেকে আমি প্রশংসা আশাও করিনা।আমি জানি আমি বেস্ট বেস্ট’

কথা বলতে বলতে লিখি দেয়াল ধরে একাই টপকানোর চেষ্টা আবারও শুরু করেছে।দূর থেকে পার্কের দারোয়ান এগিয়ে আসলেন, অনেকক্ষণ যাবত খেয়াল করছিলেন তিনি; লিখি যেভাবে বানরের মতন লাফালাফি করছিল

‘কে আপনারা?উনি এমন করতেছেন কেন?’

‘ও আসলে পা*গল আই মিন পা*গলী।
পাবনা যাবার পথে বাস আমাদের ভুলে রংপুরে নামিয়ে দিয়েছে।দেখুননা দেয়াল টপকাতে কেমন ডলাডলি করছে দেয়ালের সাথে।আপনি এসবে ঢুকবেননা।নিজের কাজ করেন নাহলে গেট দিয়ে কেউ পার্কে ঢুকে যেতে ওারে’

‘ওহ আচ্ছা।আমি ভাবলাম এত ভোর বেলা কোন দর্শনার্থী দেয়াল টপকাতে চাইবে।উনি যে পা*গল তা বুঝিনি।মানুষকে দেখে বোঝা যায়না সে পা*গল নাকি অন্য কিছু’

আরও কত কি বিড়বিড় করতে করতে লোকটা চলে গেলো।লিখি এই কথপকথনের কিছুই শুনেনি।শুনলে আগুন ধরে যেতো নাবিলের গায়ে।

ক্লান্ত হয়ে সে বললো,’দেয়াল টপকানো আমার বাম পায়ের খেল।কিন্তু আজ শক্তি নেই।কিছু খাইনি তো তাই।চলুন মেসের দিকে যাই।দরকার হলে গেটে বসে থাকবো’

‘সময় নষ্ট করা কেউ তোমার থেকে শিখুক’

কথাটা বলে নাবিল হনহনিয়ে চলে গেছে,লিখি গাল ফুলিয়ে ওর পিছু পিছু চললো।পার্কের সামনে দিয়ে যাবার পথে দারোয়ানকে দেখলো ওকে দেখে ভয়ে দূরে সরে দাঁড়িয়েচে।সে বুঝলোনা তাকে দেখে ভয় পাবার কি আছে।তাই নিজের গায়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।সবই তো ঠিক আছে, তবে ভয় পাইলো কেন!!

হোস্টেলে আসার জন্য রিকশা পেয়ে গেলো দুজনে।শান্তিতে দম ফেলে এবার ফাইনালি তারা যাচ্ছে হোস্টেলে।প্রথমে লিখির থাকার ব্যবস্থা হবে এরপর নাবিলের।
হোস্টেলে যখন তারা আসলো তখন সকাল নয়টা বাজে।মানে হাতে এখনও এক ঘন্টা বাকি।লিখি হোস্টেলের বাহিরে আঁকিবুকি করা জ্ঞান দেওয়া উপদেশগুলো গড়গড় করে পড়ছে।নাবিল এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছিল সময় কাটানোর জন্য।সেসময়ে গেটের বাহিরে দেখা হয়ে গেলো জনাম মিরাজ উল্যার সাথে।তিনি হলেন এই হোস্টেলের ম্যানেজার।নাবিল এগিয়ে এসে হাত মিলিয়ে বললো লিখিকে সে এখানে ভর্তি করাতে চায়।
লোকটা লিখিকে আর ওকে দেখে নিয়ে ভেতরে আসতে বলে চলে গেলেন।দুজনে দেরি না করে তার সাথে সাথে চললো।আজ তিনি জলদি এসেছেন মনে হয়।দারোয়ান তো বলেছিল দশটার আগে আসবেনা।এখন সাড়ে নয়টা বাজে।

ম্যানেজারের রুমে এসে দুজনে দুপাশে চেয়ার টেনে বসলো।উনি সবার আগে বললেন ভর্তি হতে হলে পিতা-মাতার স্বাক্ষর প্রয়োজন।অথবা তাদের উপস্থিতি অথবা তাদের আইডি কার্ডের ফটোকপি,অন্য কোনো আত্নীয়র উপস্থিতি।যেটার কিছুই তাদের দুজনের পক্ষে আনা অসম্ভব। মুখ কালো করে দুজনেই বের হয়ে আসলো ওখান থেকে।

‘এখন কি করবেন?’

‘চলো ফিরে যাই ঢাকায়।এখানে আর থাকা যাবেনা।ভাগ্যে ধরা খাওয়া লেখা আছে’

বিশাল আকার মন খারাপের ঝুড়ি হাতে দুজনে ঢাকার বাস ধরলো।সিটে গাল ফুলিয়ে দুজনে দুদিকে মুখ করে বসে ছিল।সেই তখন থেকে একটা লোকের ভারী গলায় গল্প শোনা যাচ্ছে।নাবিল ইয়ার ফোন খুলে লোকটার গল্প শুনতে মন দিয়েছে।ইয়ারফোনটা পকেটে থাকায় যাত্রা সহজ করা যাচ্ছিল।
লিখির খবর নেই। সে জানালার সাথে মাথা লাগিয়ে বাহিরেটা দেখছিল।ভাবছিল ঢাকা নেমে যেদিকে চোখ যায় চলে যাবে তাও চন্দ্রাহাটে ফিরবেনা।

‘হইছিল কি!!একটা মেয়ে আর একটা ছেলে,তাদের ইচ্ছা ছিল ক্যারিয়ার ঠিক করে তারপর বিয়ে করার।কিন্তু তাদের পরিবার হলো নাছোড়বান্দা।তাদের ধরে অন্য কারোর সাথে বিয়ে দিবেই দিবে।কিন্তু তাও দুজনের সাথে দুজনের বিয়ে দিবেনা।এই হলে মূল সমস্যা।
তো আমি একটা সুন্দর সমাধান করে দিলাম।বলুন তো কি দিলাম??

সবাই বললো,’কি দিলেন?’

‘আমি নকল রেজিস্ট্রি বানিয়ে দুই পরিবারে হোম ডেলিভারী করে দিলাম।ব্যস হয়ে গেলো তাদের বিয়ে বাদে বিয়ে’

‘বিয়ে বাদে বিয়ে??’

“হ্যাঁ।মানে বিয়ে হলোনা কিন্তু বিয়ে হলো।মানে সবাই জানলো বিয়ে হলো কিন্তু বিয়ে হলোনা।মেয়ে আর ছেলে খুশি, আমি খুশি,তাদের পরিবারের আগুনে পানি ঢালাও হয়ে গেলো,দিনশেষে তারাও খুশি।বলুন কেমন মহৎ কাজ করেছি?😎’

‘বাহ বাহ বাহ’

নাবিল ভ্রু কুঁচকে বললো,’পুলিশে ধরেনা?’

‘ধরে মানে!!এখন বাসে উঠছি কেন?এই পুলিশের থেকে পালিয়েই তো।যেখানে যাব সেখানেই ছড়িয়ে দিব ফেইক রেজিস্ট্রি।তবে আমি দুই নম্বরি কাজের জন্য ফেইক বানাইনা।যথেষ্ট প্রমাণ দিবেন তারপর বানাই দিব।
লাগবে নাকি কারোর?এই নেন আমার কার্ড।শুধু ফোন করবেন।একবারের বেশি দুবার করলে নাম্বার ব্লক লিস্টে ফেলে দিব’

কথা বলতে বলতে লোকটা উঠে এক এক করে সবার হাতে কার্ড ধরিয়ে দিলো
চলবে♥