মনের কোণে পর্ব-২৬+২৭

0
272

#মনের_কোণে🥀
#আফনান_লারা
#পর্ব_২৬
.
সকালে মর্জিনার ডাকে উঠেছিল লিখি আর নাবিল।সে বলছিল তারা দুজন ঘর থেকে বের হবে এখন,কাজে যেতে হবে তাদের।ওরা যদি থাকতে চায় তবে চাবিটা রেখে দিতে।
নাবিল শুরুতেই বলে দিলো তারা চলে যাবে,আর থাকবেনা।মর্জিনা আর রাকিবের সাথে তাই ওরা দুজনও বেরিয়েছে।বুকের ভেতর হাজার ভয়।ওসমান তো নিশ্চয় এখনও দাঁড়িয়ে আছে ওখানে।
কিন্তু বাইরের পরিস্থিতি ঠিক সেরকম হয়ে আছে যেরকম লিখি বুঝিয়েছিল মিসেস সামিয়াকে।তিনি কথামতো জনাব অনাবিলকে কথা জানিয়ে দু গ্রুপে ভে*জা’ল লাগিয়ে দিয়েছেন সেটাই দেখছে ওরা দাঁড়িয়ে থেকে।

নাবিল অপেক্ষা না করে লিখির হাত ধরে ঐ জায়গা দিয়ে পাশ কাটিয়ে কলোনীতে ঢুকে গেছে।মামার বাসায় ভুলেও ঢোকা যাবেনা,ওখানে বাবা থাকতে পারে।সকাল থেকে মা তো একবার কলও দেয়নি তারমানে বি’পদ আছে।
তাই দুজনে সোজা ভাঁড়া নেওয়া বাসায় এসে উঠেছে।দুজনে দুরুমে ঢুকে সবার আগে ফ্রেশ হয়ে একসাথে এসে বসলো ফ্লোরে।আসবাব না থাকলেও এটা নিজের বাসা মনে করে আরাম লাগছে,অন্য মানুষের বাসায় সেই আরাম পাওয়া যায়না।
নাবিল ভাবছে অন্য কিছু।মায়ের সাথে একবার হলেও কথা বলা জরুরি।ঐদিকের কি হাল তা জানতে হবে কিন্তু সমস্যা হলো যদি ফোনটা বাবা ধরে??
সকাল নয়টা বাজে তখন।মাকে ফোন না করে নাবিল আর থাকতে পারছেনা, শেষে বুদ্ধি করে বাবুকে কল করলো।কিন্তু তার ফোন সুইচড্ অফ,চিন্তা এবার হাজারখানেক বেড়ে গেলো।
“একবার গিয়ে দেখে আসবো??”

লিখি তখন উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’আপনার বাবা তো আমাকে চেনেননা,আমি বরং মামার বাসা ঘুরে আসি’

‘ওসমান যদি বাই চান্স ওখানে চলে আসে?তুমি কোথাও যাবেনা।বসে থাকো।’

দুজনে আবারও গাপটি মে*রে বসে রইলো।পেটে সকালের খিধে আর মাথায় শতে শতে চিন্তা।কিরকম পরিস্থিতি ওখানে আর এখানে বইছে।কবে সব ঠিক হবে!!

সকাল দশটা বাজার ঠিক দশ মিনিট আগে মিসেস সামিয়ার কল আসলো নাবিলের নাম্বারে।তার সন্দেহ হলো বলে লিখিকে রিসিভ করতে ওর হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়েছে সে।লিখি ভয়ে ভয়ে রিসিভ করে হ্যালো বললো।ওপার থেকে মিসেস সামিয়া বললেন,’নাবিল কোথায়?ওর বাবাকে সেসব বলেছি লিখি!! তুমি যা যা বলতে বলেছিলে।সেরকম ঘটনা ঘটছে আপাতত, উনি গেটের বাইরে।চোখ বড় বড় করে দেখছেন কোথাও নাবিল আছে কিনা।তোমরা ভুলেও বাসা থেকে বের হবানা,আর এখানেও আসবেনা।উনি কয়েকবার এখানে এসেও ঘুরে গেছেন’

লিখি হাঁপ ছেড়ে কলটা কাটলো।এবার সমস্যা হলো খাবার পাবে কই।নাবিল তখন দুষ্টুমি করে বললো,’চিকনি চামেলীকে বলবো নাকি খাবার দিয়ে যেতে?’

‘যান।আর জীবনে ঘরে ঢুকতে দিবো না।ভেবে চিন্তে বাইরে পা রাখবেন’

ওর কথা শুনে নাবিলের পেট ফাটা হাসি আসলো, হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাচ্ছে সে।লিখি গাল ফুলিয়ে ওর হাসি দেখছে।নাবিলের হাসির রহস্য তার অজানা।শেষে হাসিটাকে থামিয়ে সে লিখির অজানাকে জানাতে রুপান্তরিত করেছে।বলে,’তুমি কি জে’লা’স হও??সেজন্য তোমার এত আয়োজন?’

‘কিসের আয়োজন?’

‘এই যে ঘরে ঢুকতে দেবেনা’

‘কোন বউ জামাইর চরিত্র এমন জেনে ঢুকতে দেবে?’

‘অবশ্যই দেবে’

‘আমি দেবোনা।যান তো আপনি!মেজাজ খারাপ করবেননা’

ধ’মক দিয়ে গালটা তালের মতন ফুলিয়ে অন্য রুমে চলে গেছে লিখি।এই তো বেশ ভাল ছিল কিছুক্ষণ আগে অথচ থার্ড পারসন ঢুকে যাওয়ায় আবার সে রেগে গেছে।তাকে রাগানোর একটাই পন্থা,ঐ চিকনি চামেলী।
লিখিকে রাগাতে তার ভীষণ ভাল লাগে,কিন্তু সে বোঝেনা এটা শুধু মজা করার জন্য বলে নাবিল।সে বোঝে উল্টো।
—-
‘ফাঁকা রুমে কতকাল একা বসে থাকা যায়?তাও শীতল মেঝেতে?
কেমন অদ্ভুত একটা সিচুয়েশন,নতুন বিয়ে করা বউ পাশের রুমে দিব্যি গাল ফুলিয়ে বসে আছে আর আমি তার নতুন বিয়ে করা বর হয়ে ;না তার রাগ ভাঙ্গাচ্ছি আর না আমরা আমাদের মন মালিন্যকে দূরে ঠেলে রোমান্টিকতার স্বাদ নিচ্ছি।কেমন বিবাহিত আমরা?সেই বিবাহিত জীবনে আবার জে’লা’স হওয়া।মানায় না তোমায় লিখি।অবশ্য,আমার বেলায় ও মানায় না তোমাকে জে’লা’স ফিল করানোর।আমরা সত্যিকারের হাসবেন্ড- ওয়াইফ না যে এগুলো আমাদের বেলায় খাটবে।’
—-
লিখি গাল ফুলানোর সময় ভাবছিল একই কথা।তারা তো সেরকম স্বামী- স্ত্রী না, কিংবা তাদের প্রেমের সম্পর্কও নেই যে এই সিচুয়েশনে তার মন খারাপ হবে,জে’লা’স ফিল হবে।তবে কেন সে রাগ করে এখানে চলে আসলো?নাবিল কি ভাবছে?’

‘লিখি??নিয়ে যাও,মনিশা পিঠা এনেছে।’

কথাটা শুনে লিখি মনে করেছে নাবিল আবারও মজা করতে ওর নাম নিয়ে ডাকছে।রেগেমেগে লিখি ছুটে এসে বললো,’আপনি আবারও মশকরা করছেন ঐ ফ*কি*ন্নি…..’

মনিশাকে তখন সামনে দেখে লিখির মুখের কথা আটকে গেলো।তার মানে নাবিল সত্যি বলছিল।
নাবিল হা করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।মুখে সাথে সাথে হাসি ফুটিয়ে লিখি ওর হাত থেকে পিঠার বাটি নিয়ে বললো,’আমি বলছিলাম অন্য এক মেয়ের কথা।আমাদের আগের বাড়ির কাছে থাকত সে।তুমি আবার ভু’লটু’ল বুঝোনা’

‘আমি কেন ভু’ল বুঝবো?আমি কি ফ*কি’র নাকি,আমি হলাম বড়লোকের মেয়ে।’

‘একদম।এই তো তুমি কত চালাক’

মনিশা নাবিলের দিকে তাকিয়ে বললো,’আপনি খেয়ে দেখে বলবেন কেমন হয়েছে।আমি নিজে ঐ লাভ শেফেরটা বানিয়েছি’

এটা বলে মনিশা চলে গেলো।লিখি দেখলো নাবিল বাটি নিয়েছে পিঠা খেতে।তখনই ঐ বাটি থেকে লাভ শেফের টা সে সরিয়ে নিয়ে মুখে পুরে ফেললো।নাবিলকে খেতে দিলোনা।নাবিলের আবারও হাসি আসলো কিন্তু কন্ট্রোল করে রেখেছে।
লিখি এবার ওর পাশে গোল হয়ে বসে বললো,’আপনার জন্য বানানো পিঠাতে মিষ্টি অতিমাত্রায় দিয়েছে’

‘সে জানেও না আমি মিষ্টি কম খাই’

এটা শুনে লিখি খিলখিল করে হেসে উঠলো।প্রাণখুলে হাসছে সে।নাবিল অবাক চোখে ওর হাসি দেখে।
——
ওসমান দূরে ছিল বলে মা*র তার গায়ে পড়েনি তবে তার সব দলবল অনাবিলের আনা লোকদের হাতে বিপুল মা*র খেয়েছে।কিন্তু ওরা যে বেঁচে গেলো তা কিন্তু হয়নি।ওসমানের লোকেরাও দুমদাম মে*রেছিল।
দু গ্রুপ এখন চা বিরতি নিচ্ছে।ওসমান ভাবছে লিখি এখন কোথায় হতে পারে।বাবার ফোন এসেছিল। ওকে গা*ধা নাম দিলেন বাবা।সেও রাগ করে বলে দিয়েছে লিখিকে ধরা যদি এতই সোজা তবে তিনি যেন নিজে এসে ওকে খুঁজে বের করেন।কথাটা বলে লাইন কেটে দিয়েছে।এবার নিজের সম্মান বাবার সামনে ধরে রাখতে হলেও লিখিকে আজ ধ’রেই ফেলতে হবে।
অনাবিলের হলো একই ধারণা।নাবিল হাতের কাছে জেনেও তিনি ধ’রতে পারছেন না ওকে।বিজন্যাস পার্টনাররা বারবার জানতে চায় ওনার বড় ছেলে এবার কিসে পড়ে,কি জব করে।তখন লজ্জায় তার মা’থা হে’ট হয়ে যায়।নাবিলকে যত দ্রুত সম্ভব বিদেশ পাঠিয়ে দিতে হবে।এরকম বে*কার ঘুরতে দেওয়া যাবেনা।
মিসেস সামিয়া ওকে ফিনান্সিয়াল হেল্প করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।সামিয়ার থেকে ওর টাকা পাওয়া আগে বন্ধ করতে হবে তারপর দেখা যাবে টাকা পয়সা ছাড়া কি করে সে বাসা থেকে দূরে থাকে।

মাথায় এই চিন্তা চাপিয়ে তিনি ফিরে আসলেন নাবিলের মামার বাসায়।এসেই সামিয়ার থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বললেন,’আজ থেকে তোমার ফোন চালানো বন্ধ।যতদিন না নাবিল আমার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে ততদিন তুমি ফোন হাতেও নিতে পারবেনা।’

সামিয়া বিশ্বাস ও করতে পারছেনা উনি এমন একটা ডিসিশান নিলেন।
এতে করে তো নাবিলের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে।ওর খবরাখবর ও নেওয়া যাবেনা।নির্ঘাত বুঝে গেছে ওর সাথে তার আলাপ চলত।
শুধু তাই নয়, তিনি ফেরার সময় সাথে সামিয়া আর নাহিদকেও নিয়ে গেছেন।
লোক রেখে গেছেন নাবিলের মামার বাসার বাহিরে।নাবিল যেন ওর মামার সাথেও যোগাযোগ রাখতে না পারে সেজন্য।
নাবিল এতকিছু জানতনা কিন্তু বাবু লুকিয়ে ওকে কল করে সবটা জানিয়ে দিলো।
এবার নাবিলের চিন্তা আরও বেড়ে গেছে।
লিখি পিঠা শেষটা খেতে খেতে বললো,’আপনার বাবা দেখি সত্যি সত্যি মা*রা’ত্নক,আমাকে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা।আপনার বাবার পকেট কে*টে আমি আমার সংসার চালাবো’

‘কি করে?’

‘চলুন এ বাসা ছেড়ে আপনাদের বাসার পাশে বাসা ভাঁড়া নিই।তারপর সেখানে সংসার পা’তা’বো।আপনার মা সকাল- বিকাল সাহায্য করবে আর আপনার বাবা জানতেও পারবেনা আমরা তার কত কাছে আছি’

‘বাসা থেকে বের হলেই তো দেখে ফেলবে’

‘আপনার বাবা কি দারোয়ান?তাছাড়া আপনি জানেননা না ঠিক কোন সময়ে আপনার বাবা বাসা থেকে বের হয়?’

‘তাও ঠিক,কিন্তু বাবার লোকজন তো আমায় চেনে।দেখে ফেললে তারা বাবাকে জানিয়ে দেবে’

‘বাসা থেকে বের হলে মাস্ক পরে বের হবেন।দূর থেকে দেখে চিনলেও ভাববে অন্য একটা ছেলে।কারণ তারা মনে করবে এত কাছে থেকে গা ঢাকা দেওয়ার মতন বো*কা লোক আপনি নন।মাঝে মাঝে বাঁচার জন্য বোকা হতে হয়।’

‘সব বুঝলাম কিন্তু বাসা ভাঁড়া নেওয়া তো এত সহজ না,এখানে তো মামা থাকায় কাজ হয়ে গেলো।ওখানে বাসা ভাঁড়া নিব কি করে?’

‘আপনার মা আছেনা?’

‘মাকে কল করবো কেমনে?মায়ের তো নাকি ফোন নিয়ে গেছে’

‘ইচ্ছে নেই আপনার এ কারণে উপায় পাচ্ছেন না।,ল্যান্ড লাইনে কল করে সব জানিয়ে দেবেন।’

‘আমার মাথা ঘু’রছে।এত সোজা হবেনা সব।তুমি তোমার ক্ষেত আইডিয়া অফ রাখো’
—-
লিখির সাজানো গোছানো প্ল্যানটাকে মাটি চা*পা দিয়ে দিয়েছে নাবিল।সে অন্য কিছু ভাবছে।আপাতত ভাবার মতন কিছু পাচ্ছে না বলে লিখি ভাবতে বসেছে যখন তাদের খাবারের প্রয়োজন পড়ে তখন ঐ চিকনি চামেলী কোথা থেকে খাবার নিয়ে হাজির হয়।এই ফ্ল্যাটে ক্যামেরা লাগানো নাকি?’

এটা ভেবে লিখি রুমের কোণায় কোণায় তাকালো আর ভেং’চি কা*টলো।আঙ্গুল তুলে মনিশাকে যা তা বললো।যদি সত্যি ক্যামেরা থেকে থাকে এত বকাঝকা শুনে কিংবা নিজের চোখে দেখে মনিশা নিজের রুমে বসে থাকতে পারবেনা।ছুটে আসবে ঝ*গ’ড়া করার জন্য।

লিখিকে তিরিংবিরিং করতে দেখে নাবিল একটা ধ’মক দিয়ে বললো,’সারাদিন মাথায় মনিশা ঘুরে??’

‘ওহো হো!!মনিশা।কি সুন্দর করে উচ্চারণ করলেন’

‘তুমি এত জে’লা’স কেন বলোতো সত্যি করে?আমায় ভালবেসে ফেলেছো?’

‘একদমই বা।আমি তো পারলে আপনাদের দুজনের বিয়ে দিয়ে দিতাম’

‘তো দাও।ডাকছি মনিশাকে’

‘ডাকুন না’

‘ডাকছি’

নাবিল দরজায় হাত রাখতেই লিখি ঠা’স করে পাশের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।এমনিতেও নাবিল যেতো না।শুধু দেখছিল লিখি কি করে।
‘মেয়ে তো প্রেমে পড়ে গেছে।আমার জিনিস চু*রি করে আমার উপরই ক্রাশড্।নাইস!’

লিখি দরজায় কান লাগিয়ে শুনছে ওরা এসেছে কিনা।বিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার ভয়ে সে রুমে ঢুকেছে মূলত।

চলবে♥

#মনের_কোণে🥀
#আফনান_লারা
#পর্ব_২৭
.
বুকের ভেতরটা ডিপডিপ করছে।ফাঁকা ফ্ল্যাট,সামনে নাবিলের দুষ্টু চাহনি, দরজা আটকাতে রোধ করা লিখির ভয়টা আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিলো।কাঁপা কণ্ঠে বললো,’কি হচ্ছেটা কি?বাধা দিচ্ছেন কেন?’

(কিছু সময় আগে…..)
লিখিকে ভয় দেখাতে নাবিল দরজা খোলার শব্দ করে আবারও দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে রুমের ভেতর লুকিয়ে পড়েছে।লিখি ভাবলো নাবিল বুঝি সত্যি সত্যি মনিশাকে আনতে চলে গেছে।তাই রুম থেকে বেরিয়ে মন খারাপ করে সে দরজা অবধি এসে ভ্যাঁত করে কেঁদে দিয়েছে।কাঁদতে কাঁদতে বললো,’খারাপ একটা লোককে বিয়ে করেছি আমি!খুব খারাপ।আমায় ভীষণ কষ্ট দেয়,সারাদিন অন্যদিকে তার মনযোগ।এটা ঠিক না!একদম ভাইয়াকে ডেকে আনবো আমি হুম’

কথাটা শেষ করে চোখের পানি মুছে দরজা খোলার জন্য হাত রাখতেই সে বুঝতে পারলো দরজা ভেতর থেকে লক।চমকে সাথে সাথে পেছনে তাকালো সে।নাবিল হাত ভাঁজ করে দেয়ালে হেলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।ওকে দেখে লজ্জায় কান্নাভেজা মুখ লাল টুকটুকে হয়ে গেছে লিখির।নাবিল যে সব নাটক করছিল ওসব এখন তার কাছে স্বচ্ছ কাঁচের মতন হয়ে গেছে।সে যে কাঁদলো ওটাও কি নাবিল দেখেছে??
তার কৌতূহলে আরেকটু মশলা মেশালো নাবিল।হেসে হেসে বললো,’এত প্রেম!!এত দরদ আমার জন্য?এত হারানোর ভয় আমাকে নিয়ে?’

লিখি চোখ নামিয়ে ওড়না দিয়ে মুখ মুছে- টুছে বললো,’একদমই না।আমি তো অন্য টপিক নিয়ে নিজের সাথে নিজে কথা বলছিলাম’

‘নিজের সাথে নিজে কথা বললে এমন কাঁদতে হয়?’

লিখি আর কথায় না পেরে রুমের দিকে দৌড় দিয়ে দরজা লাগাতে যেতেই নাবিল হাত ধরে আটকে ফেললো।মুখে তার দুষ্টু হাসি।
লিখির বুকের ভেতর ডিপডিপ করছে।ফাঁকা ফ্ল্যাট,সামনে নাবিলের দুষ্টু চাহনি, দরজা আটকাতে রোধ করা, ওর ভয়টা আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিলো।কাঁপা কণ্ঠে বললো,’কি হচ্ছেটা কি?বাধা দিচ্ছেন কেন?’

‘জামাই চাও,আদর চাও না?’

‘ককককক…কিসের আদর?’

‘ককককক….কঠিন আদর।’

লিখি এবার দরজা লাগাতে জা’নপ্রা/ণ লাগিয়ে দিচ্ছে কিন্তু নাবিলের এক হাতের সাথে সে দুহাত দিয়েও পেরে উঠলোনা।শত চেষ্টা করেও সে দরজা লাগাতে পারলোনা।
নাবিল দরজায় হাত রাখা অবস্থায় আবার বললো,’এত ভয় কেনো পাচ্ছো?তোমার কি মনে হয় আমি তোমার সাথে জোরজবরদস্তি করবো? মেয়ের অভাব পড়েছে আমার জন্য?’

লিখির গায়ে লাগলো কথাটা।গাল ফুলিয়ে বললো,’মেয়ের অভাব পড়েছে মানে?স্ত্রী তো একজন।’

‘তো স্ত্রী যদি দরজা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে সেক্ষেত্রে আমাকে তো অভাব পরা লাইনের দিকে তাকাতেই হবে।কত চিকনি চামেলী চারিদিকে’

‘আপনি কিন্তু ব্ল্যাকমেইল করছেন’

‘স্বামী নিজের অধিকার আদায়ের জন্য এমন ব্ল্যাকমেইল করতেই পারে।ইটস নরমাল ‘

‘আমার যেদিন ইচ্ছে হবে সেদিন দেখা যাবে।সরুন আপনি,আর একটা কথা!আমাকে ছেড়ে অন্য মেয়ের দিকে ঝুঁকলে মিসেস সামিয়ার কাছে নালিশ যাবে’

‘মা বলবে কি জানো লিখি??বলবে”আমার ছেলে যা করে, হাজার ভেবে তারপর করে।আমার ছেলের মস্তিষ্কে যে বুদ্ধি আছে সেটা তোমার হতে আরও পাঁচবছর বাকি’

‘আমি বুঝিনা উনি নিজের বড় ছেলে কি ঠিক কি মনে করেন’

‘বেস্ট মনে করে বুঝলে??’

কথার মাঝে লিখি আবারও দরজা লাগানো ধরলো কিন্তু নাবিল আটকাতে দেয়নি।উল্টে এগিয়ে এসে ওকে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে ফেলেছে।লিখির হার্টবিট বেড়ে গেছে আবার।তোতলাচ্ছে শুধু।নাবিল দেয়াল থেকে হাত সরিয়ে বললো,’তোমার হার্ট শব্দ করে বিট করে’

কথাটা বল সে চলে গেলো রুম থেকে।লিখি বুকে হাত দিয়ে দম ফেলছে অনবরত।কি সাং’গা’তিক এই ছেলে।আর একটুর জন্য হার্ট এটাক হতো।ভয়ে লিখি ওখানেই বসে পড়লো।আর বের হয়নি রুম থেকে।নাবিল বাবুকে ফোন করে বললো তাকে যেন কয়েকদিনের জন্য ওর ল্যাপটপটা দিয়ে যায়।আগে যে ফ্রিলেন্সিং করত সেটা এখন আবার স্টার্ট করবে,বাইরে বেরিয়ে জব খোঁজার চেয়ে এটা বেটার হবে তার জন্য।।বাবু বাসা থেকে বের হলে অনাবিলের লোকেরা ওকে ফলো করবে,কি করে ল্যাপটপটা নেবে সেটার বুদ্ধি বের করতে পারছিলনা দুজনে।শেষে নাবিল বললো লিখিকে পাঠাবে ল্যাপটপ আনার জন্য।লিখিকে তো ওরা চিনেনা।কাজ হয়ে যাবে
—–
লিখি ভয়ে চুপসে ছিল,নাবিলের তার রুমে আরও একবার আগমন ঘটায় চট করে আবার দাঁড়িয়ে পড়েছে সে।
থতমত খেয়ে জানতে চাইলো কেন এসেছে আবার।
নাবিল পেলো আরেকটা সুযোগ।যে ভয় পায় তাকে ভয় পাওয়াতে ওর দারুণ লাগে।এখনও হলো তাই।লিখিকে দেখিয়ে রুমে ঢুকে দরজার ছিটকিনি লাগালো সে। লিখি তো ভয়ে রুমের শেষ কোণায় চলে গেছে।নাবিল শার্টে হাত রেখে বললো,’ভীষণ গরম না আজকে?’

‘তততত…তো আমি কি করবো?আপনি জামা খুলছেন কেন?

‘জামা খুলছি কই?বোতাম খুলছি’

‘আপনি ছিটকিনি লাগালেন কেন?আমি কিন্তু চেঁচাবো’

‘চেঁচাও।মনিশা আসবে সবার আগে,তারপর ওকে নিয়ে আমি হানিমুনে যাবো’

লিখি দাঁতে দাত চেপে বললো,’বউ হলাম আমি আর হানিমুনে যাবেন ঐ চিকনির সাথে?’

‘তো কি করবো বলো?তুমি যেতে চাওনা,রুমের শেষ কোণায় থাকো।শেষ কোণায় থাকলে মুনে গেলেও হানি তো পাবোনা’

লিখি এবার স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ালো।দম ফেলে বললো,’মজা করছেন কেন?’

‘কোথায় মজা করছি?তুমি আমার বিয়ে করা বউ।বউ রুমে থাকলে সে রুমে ছিটকিনি লাগানো আমার স্বামীগত অধিকার’

‘কিসের বউ??দুদিন আগে বিয়ে হয়েছে।আরও সময় লাগবে আমার আপনাকে মেনে নিতে।দূরে থাকুন ততদিন ‘

নাবিল দু কদম এগিয়ে এসে বললো,’হলো তো কতগুলো দিন।আর যে সয় না’

লিখির চোখ কপালে উঠে গেছে।আবারও দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে বললো,’আপনি বের হোন রুম থেকে,আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে’

নাবিল হাসতে হাসতে বললো,’বাবুর কাছ থেকে আমার ল্যাপটপটা নিয়ে এসো।কাজে ব্যস্ত থাকি একটু!! নাহয় তোমায় সারাদিন জ্বালাবো।’

লিখি হাঁপ ছেড়ে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে চলে গেলো।
—–
মামাদের বাড়ির সামনে একটা কনফেকশনারির দোকান।সেখানে নীল পোশাকে বসে আছেন একজন ভদ্রলোক। হাতে ওয়াকিটকি।
মামাদের বাসার পেছনে ছোটখাটো একটা সবুজ বুনো ঘাসের উঠান।একেবারে ছোট।বড় সাইজের দুইটা ড্রাম রাখলে ঐ জায়গা দখল হয়ে যাবে, ঠিক সেখানে বসে আছেন ঐ নীল শার্ট পরা আরেকজন ভদ্রলোক। আরএফএলের একটা টুলে বসে পেপার পড়ছেন তিনি।
মোটকথা দুজনে এক টিমের।পাহারাদার তারা।মামার পুরো বাসাকে তারা দখলে রেখেছে।লিখি অর্ধেক পথ এসে এসব দেখে ঐ জায়গাতেই দাঁড়িয়ে পড়েছে।আর নড়ছেনা,শুধু দেখছে।তাকে হয়ত এই গলি থেকে আসা দেখলে ওরা সন্দেহ করে পিছু নিবে।ঘুরে অন্য গলি থেকে আসতে হবে ঠিক করে মামার বাসার সামনে দিয়ে সে চলে গেলো।
অন্য গলি দিয়ে ঘুরে আবারও এসে দাঁড়ালো একই জায়গায়।তাকে মামার বাসার সামনে দেখে কনফেকশনারিতে বসে থাকা লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।যেন সে পুলিশ আর লিখি চোর, ধরা পড়েছে তাই এখন আগে চোখ দিয়ে সার্চ করছে।
লিখির তো এসবের অভ্যাস পুরোনো।ভয় না পেয়ে,মুখ বাঁকিয়ে সে চলে গেলো মামার বাসায়।বাসায় ঢুকে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।ঐ লোকটা চেয়েছিল ওর পিছু পিছু বাসায় ঢুকতে,কিন্তু লিখি দরজা দিয়ে ফেলায় তিনি এখন বাগানে দাঁড়িয়ে থেকে ওয়াকিটকিতে কাকে যেন কিসব বলে যাচ্ছেন।লিখি চট করে বাবুর রুমে গিয়ে ল্যাপটপটা নিয়ে আসলো।মামি ওর হাতে নাড়ু এক বক্স দিয়ে বললেন নাবিলের জন্য বানিয়েছেন।লিখি বক্সটা সহ বের হলো তখনই ঐ ভদ্রলোক ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। গম্ভীর গলায় বললেন,’আপনি কে হোন ওনাদের?’

‘আমার ল্যাপটপ এই বাড়ির ছেলে বাবু ধার নিয়েছিল,নিতে এসেছি’

‘দেখি ল্যাপটপ?’

‘কেন দেখবেন?মেয়েদের জিনিস সার্চ করতে হয়না জানেননা?মেয়ে গার্ড আনুন তবে আমার পার্সোনাল ল্যাপটপ চেক করতে দেবো।এখানে আমার পার্সোনাল জিনিস আছে’

‘এত পার্সোনাল হলে একটা ছেলেকে ধার দিলেন কি করে?’

‘ঐ ছেলে আমার বয়ফ্রেন্ড হয়,আপনি কি আমার বয়ফ্রেন্ড?’

লোকটা থতমত খেয়ে কলার ঠিক করে বললেন,’আপনার বাসা কই?’

‘আপনাকে বলবো কেন?বিকাশ কখনও তার গ্রাহকের কাছে পিন জানতে চায়না’

‘এর মানে?’

‘মানে পুলিশ কখনও জনগণের অতি পার্সোনাল কিছু নিজে দেখার জন্য উঠে পড়ে লাগেনা।কমন সেন্স নাই আপনার?কেমন গার্ড আপনি?’

‘আপনি কিন্তু আমায় অপমান করছেন’

‘আমি তো বলিনি আমি শুধু আপনাকে মান করবে।’

‘যান তো!অসহ্যকর মেয়ে একটা’

লিখি মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো।আগের মতন ঘুরে অন্য গলির উপর দিয়ে গেলো,যাতে ওর পিছু নিলেও বাসার খোঁজ না পায় ওরা।
——
নাবিল বাসায় একা ছিল।মনিশা লিখিকে বের হয়ে যেতে দেখেছে।তাই সে পানির জগ আর মগ নিয়ে এসে কলিংবেলে চাপ দিলো তখন।
নাবিল ভাবলো লিখি এসেছে।সে ছুটে এসে দরজা খুলতেই দেখলো মনিশা দাঁড়িয়ে আছে।

‘এই মেয়েটার কাজ নেই নাকি!!সারাদিন এখানে আসার ধান্ধা, বড়লোকের মেয়ের জন্য কি ছেলের অভাব পড়েছিল?কেমন চোখ দিয়ে গি/লে খা’চ্ছে আমাকে।লিখি থাকলে চোখ ফু/টো করে দিতো।

‘আপনারা তো বাসার জন্য কিছুই কিনেননি।পানির তৃষ্টা পায়না??তাই পানি নিয়ে এলাম।রাতে কি খাবেন?’

‘কচু শাক খাবো।আছে?’

লিখির কথা শুনে মনিশা চমকে পেছনে তাকালো।লিখি এগিয়ে এসে নাবিলের হাতে ল্যাপটপ আর নাড়ু ধরিয়ে দিয়ে বললো,’শুনো!বাড়িওয়ালা হয়েছো বলে কারণে-অকারণে এত ডিস্টার্ব করার রাইট তোমার নাই।’

‘আমি আপনাদের ডিস্টার্ব করি?’

লিখি কোমড়ে হাত রেখে বললো,’নতুন বিয়ে করা কাপলের দরজার কড়া নাড়া মানেই ডিস্টার্ব, জানো না?জানবা কেমনে!তোমার তো বিয়েই হয়নি’

‘জানি আমি,আমি ডিভোর্সি ‘

‘হোয়াট!!তোমাকে সতিন ও মানবোনা আর কোনোদিম।ভাগো এখান থেকে’

লিখি দরজা লাগিয়ে দিলো।নাবিল হা করে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ। লিখি কি পরিমাণ হিং*সা করে মনিশাকে।পারছেনা রীতিমত বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে।বাড়িওয়ালার মেয়ে বলে ব*কা দিলো শুধু।
লিখি নাবিলকে কিছু না বলে ওর রুমে ফিরে এসে ধপ করে বসে গেছে ফ্লোরে।নাবিল পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে ওর রুমে দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে বললো,”এগুলো নিয়ে বাজারে গিয়ে ঘরের জন্য যা যা লাগে কিনে আনো।আমি তো বের হতে পারবোনা।আর তোমার ভাইয়া হয়ত এখন কলোনির বাইরে নেই।নিশ্চিন্তে যেতে পারো।’

‘আমি একা বাজার করতে যাইনা।আপনি সহ আসুন’

‘আমি গেলে আমাকে বাবার লোকেরা চিনে ফেলবে,তুমি যাও কিনে আনো’

‘এতসব জিনিস আমি একা হাতে আনতে পারবো?জগ লাগবে,মগ লাগবে,হাঁড়ি-পাতিল,তরিতরকারি, বিছানার চাদর,বালিশ,একটা গোটা তোষক,আমার জামা,আরও কত কি।’

‘এগুলো তো পাঁচহাজারে তাহলে হবেনা’

কথাটা বলে নাবিল পকেটে হাত দিয়ে আরও টাকা বের করছিল লিখি ওকে থামিয়ে বললো,’আমি পাঁচ হাজার দিয়ে এসব কিনে আনতে পারবো,আরও টাকা ফিরে ঘরে আসবে।আপনি আমার সঙ্গে চলুন’

‘তার মানে দামাদামি করবে তাই তো?না বাবা আমি যাচ্ছিনা।দামাদামি আমার পছন্দ না।’

লিখি বিরক্ত হয়ে পাঁচ হাজার টাকা নিয়েই চলে গেলো বাজার করতে।
—-
তখন বেলা বারোটা বাজছিল।সারাটা দুপুর ধরে নাবিল তার থেমে থাকা ফ্রিলেন্সিং আইডিটাকে ঠিক করলো।এতই ব্যস্ত ছিল সে যে কখন যে সন্ধ্যা নেমে গেছে সেটা ও টেরই পায়নি।
যখন কপাল টিপে পিঠটা দেয়ালে ঠেকিয়ে তাকালো বারান্দার দিকে তখন বুঝতে পারলো সন্ধ্যা হয়ে গেছে।সেসময়ে লিখির জন্য চিন্তা হলো তার।
নিচ থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙ্গে দরজার কাছে এসে দরজাটা খুলতেই তোষকের বাড়ি খেয়ে সরে দাঁড়ালো।লিখি লোক ধরিয়ে সব এক এক করে উপরে এনে রাখছে।জিনিস পাতির ঢল দেখে নাবিল আশ্চর্য হয়ে গেছে।পাঁচ হাজারে এত সব কি করে ম্যানেজ করলো এই মেয়ে!!!
সংসার তো!!!!আরে আমি ফ্রিলেন্সিং করে চল্লিশ হাজার কামাবো, তোমাকে এত কিপটামো করতে হবেনা ‘

চলবে♥