মনোহারিণী পর্ব-২২+২৩

0
321

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২২.
আমাদের যাত্রা শুরু হলো সকাল সাড়ে সাতটায়। সংখ্যায় দশ জন সদস্য আমরা। রাজ ভাই, তাজ ভাই, শ্রেয়ান ভাইয়া, আদনান ভাইয়া, জুম্মান ভাইয়া, সৌরভ ভাইয়া, জেনিফার ভাবি, আমিরা আপু, আনহা আপু আর আমি। মিনহা আপুর পরীক্ষার কারণে সে যেতে পারবে না। আমাদের এই ট্যুরের কথা শুনে বেচারি প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল। তাজ ভাই তাকে সান্ত্বনা দিয়েছে সুযোগ বুঝে তাকেও কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবে। গতকাল সবাই অনেক রাত পর্যন্ত নিজেদের ব্যাগপত্র গুছিয়েছিল। তাই ঘুমানোর জন্য বেশি সময় পায়নি। ঘুমকে উড়িয়ে দিয়ে সকাল-সকাল সবাইকে উঠতে হয়েছে। সকালের নাস্তা সেরে, রেডি হয়ে তবেই বাসস্ট্যান্ডে এসেছি। বাসে ওঠার সময় ঘটল বিপত্তি। তাজ ভাই হুট করে আমার হাত চেপে ধরে পেছনে দাঁড়িয়ে রইলেন। এহেন কাণ্ডে আমি অবাক হয়ে গেলাম। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারলাম না। চাপা স্বরে রাগ দেখালাম, তাতেও লাভ হলো না। একে-একে সবাই বাসে ওঠার পর উনি নিজে উঠে তবেই আমাকে উঠতে দিলেন। ততক্ষণে একে-একে সবাই সিটে বসতে শুরু করেছে। লোকজন সিট দখল করতে লেগে পড়েছে। সেই ফাঁকে তাজ ভাই আবার আমার হাত টেনে ধরে মাঝের সারির দিকে নিয়ে গিয়ে জানালার পাশের সিটে ঠেলে বসিয়ে, নিজে পাশে বসে পড়লেন। আমি সঙ্গে-সঙ্গে আপত্তি জানালাম।
“আমি আমিরা আপুর সাথে বসব। আপনি উঠুন।”
“আমিরা আনহার সাথে বসেছে দেখতে পারছিস না? এখন বসতে চাইতে পারিস শুধু ভাবির সাথে। কিন্তু তাহলে তো আমার ভাইয়ের হানিমুনের শুরুতেই ব্যাঘাত ঘটে যাবে। ভাই হয়ে ভাইয়ের এত বড়ো ক্ষ’তি তো আমি করতে পারি না। তাই যেখানে আছিস সেখানেই সন্তুষ্ট থাক।”
“সারা রাস্তা আপনার আজাইরা কথা শুনে আমার পক্ষে সন্তুষ্ট থাকা সম্ভব না। মিনহা আপুকে এখানে আসতে বলে আমি আমিরা আপুর সাথে বসব। সরুন।”
“পারলে বল।”
মিনহা আপুরা সামনের দিকে বসায় এত মানুষের সামনে ডাকতেও পারলাম না। ফোন বের করলাম ম্যাসেজ করার জন্য। কিন্তু ম্যাসেজ টাইপ করা ধরতেই পাশের ব’দ লোক ছোঁ মে’রে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বিপরীত দিকের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। আমি ফোন নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। কিন্তু উনি বললেন,
“ফোন নিষিদ্ধ।”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
“সবসময় ফাজলামি ভালো লাগে না তাজ ভাই। ফোন ফেরত দিন।”
“এখন তো আরও আগে দিবো না। পৃথিবীর এক শ্রেষ্ঠ ভদ্র ছেলেকে তুই ফা’জিল বলেছিস। তাই এটা তোর শা’স্তি।”
ইচ্ছে করছে এখান থেকে উঠে চলে যেতে। কিন্তু ততক্ষণে বাস ছেড়ে দিয়েছে। উঠলে বেরোতেও দিবে না এই লোক। কিছুক্ষণ বৃথা রাগ দেখিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। এই লম্বা জার্নি যে কতটা বিরক্তিকর হতে চলেছে, ভাবতেই জানালা টপকে লাফিয়ে নেমে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এমন হলে আজই এই ধরায় আমার জীবনের শেষ দিন হবে। এত সহজে জীবন উৎসর্গ দিতে আমি মোটেও রাজি নই। সিদ্ধান্ত নিলাম সারা পথ এই আপদের সাথে একটাও বাক্য ব্যয় করব না। আট ঘন্টার মৌনব্রত পালন করব। মাথা উঁচিয়ে দেখলাম বাস ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের টিম ঘুমে ঢুলুঢুলু করছে। আগামী কয়েক মিনিটের মধ্যেই হয়তো সবাই ঘুমের দেশে পাড়ি জমাবে। ঘুম যে আমারও আসছে না তা নয়। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আমি ঘুমাতে চাইছি না। কিছুক্ষণ পর একটু ঘুমিয়ে নিব। তারপর ঘুমটা কা’টিয়ে উঠে প্রকৃতি উপভোগ করব। জানালা দিয়ে বেশ ফুরফুরে বাতাস আসছে। আমি জানালার একদম কাছ ঘেঁষে বসে বাতাসটা গায়ে মাখালাম। তাজ ভাই নিজের ফোন বের করে বসেছেন। অথচ আমার ফোনটা জিম্মায় রেখে দিয়েছেন। পাজি লোক। নিজে শান্তিতে থাকবে, আর সব অশান্তির ভূত খুব যত্ন সহকারে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিবে। খুব বেশিক্ষণ উপভোগ করতে পারলাম না। বাকিদের মতো আমার চোখেও ঘুম ভর করছে। না চাইতেও বারবার ঘুমে ঝিমাচ্ছি। ঠিকঠাক মতো ঘুমটা আর হচ্ছে না। হুট করে তাজ ভাই আমার মাথাটা ওনার বাহুতে রাখলেন। আমি তড়াক করে সোজা হয়ে বসে সরু চোখে তাকালাম। উনি আবার একই কাজ করলেন। আমিও আবার সরে এলাম। উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“মুরগির মতো ঝিমালে জানালা দিয়ে ক্রিকেট বলের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিবো।”
আমি প্রত্যুত্তর না করে গাল ফুলিয়ে সিটে মাথা এলিয়ে দিলাম। তা-ও লাভ হলো না। একটু ঘুম এলেই বারবার সিট থেকে মাথা গড়িয়ে পড়ছে। ঘুমের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম তাজ ভাই চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি ঠোঁট ফুলিয়ে হাত পেতে আরেকবার মিনতি করলাম,
“ফোন দিন না।”
“কানের নিচ বরাবর দিবো,” চাপা স্বরে ধমকে উঠলেন উনি।
আমি মুখ কালো করে হাত নামিয়ে নিলাম। মিনিট খানেক বিমর্ষ মুখে বসে রইলাম। তারপর বিরক্তি নিয়ে নিজেই ওনার বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। উনি একটু নড়েচড়ে বসলেন। নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“ঠান্ডা লাগছে? জানালা বন্ধ করব?”
“উঁহু।”
বাহুতে হেলান দেওয়ায় পারফিউমের তীব্র সুগন্ধ হুরহুর করে নাকে ঢুকে পড়ছে। গন্ধটা সুন্দর, কিন্তু এই মুহূর্তে গন্ধটা ভীষণ বিরক্ত লাগল। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।
“সবসময় এমন পারফিউমের বোতল ঢেলে দিবেন না তো। খালি মেয়ে পটানোর ধান্দা?”
“মেয়ে পটানোর জন্য আমার পারফিউমের প্রয়োজন পড়ে না, ইলুবতী। মেয়েরা আমাকে দেখলে এমনিতেই পটে যায়। হিং’সুটে মেয়েরাও কিন্তু পটে যায়।”
“যেই না চেহারা, তার আবার কত অহং’কার!”
“বুঝি, বুঝি। হিং’সুটেরা সুদর্শনদের এটুকু হিংসা করেই। আই ডোন্ট কেয়ার।”
আমি কিঞ্চিত রাগত চোখ তুলে তাকালাম। উনি এক ভ্রু উঁচিয়ে মৃদু হাসলেন। ক্রো’ধে ওনার বাহু চেপে ধরে শক্ত মুখে বললাম,
“ঘুমাব আমি।”
উনি আমার মাথা পুনরায় বাহুতে রেখে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলেন। চোখে পুরোদস্তুর তন্দ্রা নামতে খুব বেশিক্ষণ সময় লাগল না। বেশ লম্বা একটা ঘুম দিলাম। তবে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটার কারণেই ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে বুঝলাম তাজ ভাই নিজেই ইচ্ছে করে ঘুম ভাঙিয়েছেন। হামি তুলে সোজা হয়ে বসে শুধালাম,
“কী হয়েছে?”
“সারা রাস্তা পড়ে-পড়ে ঘুমালে ট্যুরে যাওয়ার কী দরকার?”
“জার্নিতে আমি অত ঘুমাতে পারি না।”
“এতক্ষণ কে ঘুমাল? আমি?”
“সে তো রাতে ঘুম হয়নি বলে ঘুমিয়েছি। আর সিটে হেলান দিলে বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারতাম না।”
“তো যাকে বালিশ বানানো হলো তাকে বিনিময়ে কিছু দিন।”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
“কেউ যেচে বালিশ হতে চাইলে আমার কী করার?”
“তখন তো দয়া করেছিলাম, তা-ও দয়া ভালো লাগেনি। কিন্তু পরেরবার তো কেউ ইচ্ছে করেই ঘুমাল। এখন আমি তো আমার পাওনা ছাড়ব না।”
আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
“আপনার মতো দয়ার সাগর হঠাৎ বিনিময়ের হিসাব করছে কেন?”
“আমি কোনো স্বার্থপরদের দয়া করি না।”
“কিসের স্বার্থ?”
“ভালো থাকার।”
“আপনি খারাপ থাকেন কবে? পারলে তো চব্বিশ ঘন্টার পঁচিশ ঘন্টা চিল মুডে থাকেন।”
উনি কেমন আপন মনে হাসলেন। ব্যাগ থেকে জুসের বোতল বের করে এগিয়ে ধরলেন। আমি গলা ভিজিয়ে নিলাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন,
“ক্ষুধা পেয়েছে?”
“না।”
সময়গুলো বেশ ভালোই কা’টল। বাইরের প্রকৃতি উপভোগ করলাম মনভরে। ট্যুরের বিষয়ে নানা প্রশ্ন করলাম। উনি সব শুনলেন, প্রতিটা উত্তর দিলেন। হাত চেপে ধরে শাসা’লেন,
“ওখানে গিয়ে যদি অবাধ্য হয়েছো, তাহলে ডিরেক্ট সমুদ্রে ভাসিয়ে দিবো।”
“আপনার থেকে দশ হাত দূরে থাকব।”
“শ্রেয়ানের প্রোটেকশনে?” চাপা স্বরে বললেন উনি।
“প্রয়োজনে তাই করব। শ্রেয়ান ভাইয়া আপনার মতো ব’দ না। যথেষ্ট ফ্রেন্ডলি।”
“আচ্ছা? তাহলে শ্রেয়ানের কপালে এক আস্ত বলদ আছে না কি ?”
“ওমন হলে আপনার বন্ধুর সাত কপাল হবে।”
“আশা আছে মনে হচ্ছে?”
“থাকতে দোষ আছে?”
সঙ্গে-সঙ্গে উনি আমার বাহু চেপে ধরে মিষ্টি হেসে বললেন,
“গোটা পাঁচেক ইট বেঁধে সমুদ্রের মাঝ বরাবর ডু’বিয়ে দিবো।”
আমি চোখ-মুখ কুঁচকে বললাম,
“কেন? আপনার এত সমস্যা কিসে? আপনি যখন সুইডিশ সুন্দরীদের সাথে ইংরেজিতে প্যাঁক-প্যাঁক করেন, তখন তো আমি বলতে যাই না আপনার ল্যাপটপ পানিতে ডুবিয়ে দিবো।”
“ওরা আমার ফ্রেন্ড, জাস্ট ফ্রেন্ড। কেউ যে মনে-মনে ওদের হিংসা করে জ্ব’লে ম’রে, তা আমার জানা আছে।”
“এই আপনি কথা বলবেন না তো আমার সাথে।”
“তোকে কে বলতে বলেছে? নিজেই একশো বার বলিস কথা বলবেন না, আবার নিজেই বকবক শুরু করিস। আগে নিজের মুখ বন্ধ রাখ।”
“আপনি যে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে কথা বের করেন, সেই বেলায়? এখন সাধু সাজছেন? আপনিও মুখ বন্ধ রাখুন, আর এই হাতটাও,” আমার বাহু ধরা ওনার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললাম।
কিন্তু এত দীর্ঘ পথ কি আর মুখে কুলুপ এঁটে পার করা যায়? মহাশয় নিজেই মিনিট দশেক পার হতেই মুখের বাঁধ খুলে ফেললেন। আমি আনমনে হাসলাম। একটু পরেই আবার বলবে আমি বকবক করে তার মাথা খাই। দীর্ঘ আট ঘন্টার বাস ভ্রমণ মন্দ কা’টল না। কখনও মনোযোগ দিয়ে গল্প করা, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ, একটু-আধটু ভিডিয়ো করা, খাওয়া-দাওয়া, আবার ক্ষণে-ক্ষণে কথা কা’টাকা’টি, খুনসুটি। এভাবেই পেরিয়ে গেল গোটা পথ। বিকাল সাড়ে তিনটায় আমরা কক্সবাজার পৌঁছালাম। আমাদের লক্ষ্য সোনাদিয়া দ্বীপ। কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়েছে আগামীকাল সকালে সোনাদিয়া দ্বীপে যাত্রা শুরু হবে। আজকের রাতটা রাজ ভাইয়ের এক ঘনিষ্ট বন্ধুর বাড়িতে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। আমাদের আসার খবর শুনে রাজ ভাইয়ের বন্ধু নিজেই এই আবদার করেছেন। আমন্ত্রণটা আমাদের জন্য ভালো মনে হয়েছে, বিধায় সবাই সানন্দে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। রাজ ভাইয়ের বন্ধুর নাম ফাহিম। রাজ ভাই বউ সাথে নিয়ে এসেছে বলে ফাহিম ভাইয়ার মা নিজেই তাকে দিয়ে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ফাহিম ভাইয়া আমাদের রিসিভ করার জন্য বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিলেন। তার সাথেই আমরা তার বাড়ি গেলাম। বাড়িতে তার মা, বাবা আর ভাবি ছাড়া অন্য কাউকে দেখা গেল না। বাড়ি পৌঁছে তাদের সাথে টুকটাক কথা বলে আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ফাহিম ভাইয়ার মা-ভাবি আমাদের জমজমাট আপ্যায়ন করলেন। বউ, শাশুড়ি দুজনের আচরণই খুব সুন্দর। যতটুকু বুঝলাম, ফাহিম ভাইয়ার ভাবিকে তার মা নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন। তা দেখে আমিরা আপু আফসোস করে বলল,
“তাজ ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে হলে কাকিও আমাকে এমন মাথায় তুলে রাখবে, তাই না? আমার তো ভাবতেই আনন্দ লাগছে, আহ্!”
আনহা আপু মুখ বাঁকিয়ে কটাক্ষ করে বলল,
“ফুপি তার ছেলের বউদের মাথায় করেই রাখবে, তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু সে কি একবারও বলেছে তোমাকে ছেলের বউ করবে?”
“কাকি কি আর আমার মনের কথা জানে? জানলে হয়তো বউ করবে।”
“স্বপ্ন দেখা ভালো,” তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল আনহা আপু।
সন্ধ্যায় হালকা নাশতা করে রাজ ভাই আর ফাহিম ভাইয়ার বন্ধুত্বের গল্প শুনছিলাম। ফোনটা রুমে রেখে এসেছিলাম। ভাবলাম ফোনটা নিয়ে এসে আবার তাদের আড্ডায় বসব। কিন্তু রুমে ঢুকে আর বেরোনোর পথ পেলাম না। হুট করে তাজ ভাইও সেখানে উপস্থিত হলেন। কড়া গলায় আদেশ করলেন,
“রুম থেকে যেন আর বেরোতে না দেখি।”
“কেন?”
“না বলেছি তাই।”
“কেন? সমস্যা কী?”
“এত কৌতুহল কেন?”
“আপনি এই সন্ধ্যাবেলা রুম থেকে বেরোতে বারণ করছেন, তা জিজ্ঞেস করব না? ওখানে সবাই কত মজা করে আড্ডা দিচ্ছে, দেখেননি?”
“আড্ডায় মন টানছে, না ফাহিম ভাই?”
আমি খানিক থমকালাম। অবাক হয়ে বললাম,
“এসব কোন ধরনের কথা?”
“ফাহিম ভাই বারবার প্রেমময় চোখে তাকাচ্ছে দেখলাম। শ্রেয়ানকে ঘোলাজল খাইয়ে ফাহিম ভাইকে পটানোর চেষ্টা চলছে?”
আমি মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,
“আপনার আজাইরা কথাগুলো এই মুহূর্তে অন্তত বন্ধ রাখুন। আমি তো দেখলাম ফাহিম ভাইয়া মিনহা আপুর দিকে বারবার তাকাচ্ছে। আমার মনে হয় আপনার চোখের ডাক্তার দেখানো দরকার। নিন আপাতত আমার চশমাটা কাজে লাগান।
কথাটা বলেই আমি নিজের চশমাটা ওনার দুই কানের ফাঁকে গুঁজে দিলাম। উনি চশমাটা পুনরায় আমার চোখে পরিয়ে দিয়ে বললেন,
“নিজে কানা বলে আশেপাশের সবাইকে কানা মনে হয় তোর? আগে নিজের চোখের ট্রিটমেন্ট করা। দেখ আবার চোখের মাথা খেয়ে বসে আছিস কি না।”
“সরুন তো আপনি, যেতে দিন।”
ওনার পাশ কা’টিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই উনি হাতের কবজি টেনে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললেন,
“না বলেছি একবার।”
“আজব! আমি একা ঘরে বসে থাকলে সবাই কী ভাববে?”
“সে কথা আপনাকে না ভাবলেও চলবে। বিশ্রাম নিন, নইলে কালকের ট্যুরে যদি শুনি শরীর খারাপ লাগছে, রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যাব। পান থেকে চুন খসলেই তো বিছানায় পড়ে থাকেন।”
ওনার বাড়াবাড়িতে আমি মুখ গোমড়া করে বসে রইলাম। ওনার সাথে কথা বাড়াতে না পেরে হতাশ হলাম। বিরক্তির সুরে বললাম,
“তো আপনি এখানে এসে বসে আছেন কেন? যান এখান থেকে। বাড়াবাড়ি ভালো লাগছে না। নিজে গিয়ে বিশ্রাম করুন।”
উনি আর কথা না এগিয়ে চলে গেলেন। আমি ফোন নিয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়লাম। দুই মিনিটের মাথায় ম্যাসেজ এল।
“ভালোবাসার বিনিময়ে আমি কেবল অজস্র যাতনাময় বিনিদ্র রজনী উপহার পেয়েছি। আর কত, মনোহারিণী?”
থমকানো দৃষ্টিতে চুপচাপ সেই ম্যাসেজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে এই প্রথম এক গভীর অভিযোগে অভিযুক্ত হলাম। মিনিট তিনেক পর টাইপ করলাম।
“ছয় বছরেও এক অভিশপ্ত চিরকুটের ক্ষ’ত মুছতে তো কেউ আগ্রহ দেখায়নি। আর কত?”
ম্যাসেজটা সেন্ড করে ফোন রেখে দিলাম। হাতের ওপর মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিলাম। ঘুম প্রয়োজন। ‘বিনিদ্র রজনী’ শব্দটা বুকের ভেতর কেমন নাড়া দিয়ে উঠল। আমার অভিযোগের মূল্য তো কেউ দেয় না। জেনেশুনেও অভিযোগ এড়িয়ে চলে। তবে আজ কেন উলটো অভিযোগ করা হচ্ছে?

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৩.
মনোহারিণী,
আমার প্রতি তোমার অভিমানের মাত্রা ঠিক কতটুকু বলো তো? আকাশ কিংবা সমুদ্র সমান? না কি সমগ্র ভূপৃষ্ঠের সমান? তুমি কি জানতে, আমার হাহাকার ছিল তোমার আকাশ, সমুদ্র, ভূপৃষ্ঠের চেয়েও দ্বিগুণ? জানতে না। তাই বলেই তো আমার অবহেলায় তুমি আজও দুঃখ পাও। কখনও কি বুঝতে চেয়েছ যা তোমার চোখে অবহেলা, তা আমার কাছে কী? এই অবহেলাটা আমার চোখে ছিল সতর্কতা, শুভ কামনা। সেই সাড়ে ছয় বছর আগে যখন নিজের দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি চলছিল, তখন আমার তরুণ মনে ছিল তরতাজা য’ন্ত্রণা। তারও বহু আগে যে ছোট্ট একটা হরিণীর দুটো গভীর নেত্র আমার মন হরণ করেছিল। দেশে থাকাকালীন না হয় তাকে কয়েক মাস পর হলেও একবার দেখে চোখ জুড়াতাম। সুদূর সুইডেনে আমি তাকে কোথায় খুঁজতাম? তাকে জানানোও হয়নি আমার ভেতরের য’ন্ত্রণার খবর। সে যে তখন পনেরোতে পা রাখা এক ছোট্ট কিশোরী। টগবগে যুবক তার জন্য পু’ড়ছে, এ কথা জানতে পারলে সে আবেগে ভাসত। পড়াশোনা গোল্লায় তুলে মাথায় আবেগ চড়িয়ে দিন কা’টাত। অভিমান, অভিযোগে গাল ফুলিয়ে আমার পড়াশোনাও রসাতলে দিত। তারপর কী হত? দুজনের ক্যারিয়ারের বারোটা বাজিয়ে প্রেমের গান গাইতে হত। আমার মতো সচেতন নাগরিক এতটা কেয়ারলেস কী করে হত? আবেগকে জলাঞ্জলি দিয়ে বিবেক দিয়ে ভেবেছিলাম। পাঁচ বছরের ব্যবধান। সময়টা হয়তো দীর্ঘ ছিল, কিন্তু স্মৃতিগুলো ছিল স্মরণীয়। সুইডেনের নিরিবিলি ফ্ল্যাটের গভীর অন্ধকারে আমি আমার ছোট্ট হরিণীকে খুঁজে বেড়াতাম। বুকের ভেতর র’ক্তক্ষ’রণ হত কতশত বার! অথচ হরিণীটা তখন নিশ্চিন্তে ঘুমাত। সবার সাথে কথা বলার সময় আমার চোখ দুটো একটা বহুল আকাঙ্ক্ষিত মুখ খুঁজত। কিন্তু সে একটাবারও দেখা দিত না। কতবার তার নাম নিতে গিয়েও বুকে পাথর চেপে নিজেকে সামলে নিয়েছি! সে আমার অভ্যাসে পরিণত হলে যে দু-দুটো ক্যারিয়ার ধ্বংস হবে। তার চোখ দুটো আমায় দূরত্ব ভুলিয়ে দিবে। পরিবারের চোখে দায়ী হলে সেই আমিই হতাম। আমার ছোট্ট হরিণী ধীরে-ধীরে বড়ো হয়ে গেল, আবেগ ভুলে গেল, অভিযোগ করতে শিখে গেল। ভেবেছিলাম মুখোমুখি দাঁড়ালে সে আবার বোকা-বোকা চোখে তাকিয়ে বলবে, ‘চিঠিটা আমি দিইনি তাজ ভাই। আমি এসব লিখতে পারি না।’ অথচ দেশে ফিরে তার সাথে প্রথম সাক্ষাতে আমার ভেতরের ছটফটানি সে টেরও পেল না। চাপা রাগ আর অভিযোগ ঢেলে দিলো। তবু আমি তার শক্ত মুখের আড়ালের সেই বাচ্চা হরিণীকে খুঁজে পেয়েছিলাম। পাঁচটা বছরের য’ন্ত্রণার জার্নিটা খুব সহজ ছিল না। তা যদি বাচ্চাটা বুঝত; তবে অভিমান, অভিযোগের আগে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করত, ‘এতগুলো বছর আপনি কেমন ছিলেন? আপনার বুকের ব্যথা কমেছে?’ তাকে কখনও জানাতে ইচ্ছে হয়নি, ক্যারিয়ার আর জীবনের কথা ভাবতে গিয়ে আমি তার চোখে অপরাধী হয়েছিলাম। সব ব্যথা সহ্য করে নিয়েছিল এক সান্ত্বনায়, ফিরে এসে আজীবনের জন্য তাকে হরণ করে নিব। আমি ফিরলাম, কিন্তু তাকে হরণ করতে গিয়েও সেই ব্যথাই পেলাম। সে জানতে চাইল না আমার ব্যথা কিসের। আমি যে সবসময় তাকে ওপরের খোলসটুকুই দেখিয়েছি। আমার হরিণী নিজে বলল অভিশপ্ত চিরকুট তার ক্ষ’তর কারণ। এরপর কী করে আড়ালে থাকি? সে জানুক সাড়ে ছয় বছর আগে আমি দোষী ছিলাম, সাড়ে ছয় বছর পরে এসেও আমিই দোষী। এটা তার অভিযোগ নয়, আমার স্বীকারোক্তি। আমার হরিণীটা যে বাচ্চাসুলভ। তাকে যা বুঝিয়েছিলাম, সে তো তার বেশি বোঝেনি। যা দেখিয়েছিলাম, শুধু তার নির্ভরতায় আমায় দোষী সাব্যস্ত করেছিল। দোষটা আমারই ছিল। এই দোষ নামক য’ন্ত্রণা আমি আজীবন বয়ে বেড়াতে পারব। তার বিনিময়ে আমার নিষ্পাপ হরিণী য’ন্ত্রণামুক্ত থাকুক। তার সবটুকু যন্ত্রণা শুষে নিক আমার দোষী মন। আমি না হয় ওই গভীর চোখে, দীঘল কেশে, গালের ওই মিশমিশে তিলে য’ন্ত্রণা ভুলব। দোষী তাজ তার মনোহারিণীর কাছে কেবল একটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। মন হরণ করা কি দোষের নয়? তার চোখে কি সে নির্দোষ? উত্তরটা আমার চাই-ই চাই, এমনটা নয়। তার ইচ্ছেই সই। আমার চাওয়া কেবল আমার বাচ্চা হরিণী। এক্ষেত্রেও সে না চাইলেও সই। অনুভূতির য’ন্ত্রণা চাপিয়ে দেওয়া আমার ধাতে নেই। সে আমি একাই দিব্যি বয়ে বেড়াতে পারি। সে কেবল একটু সুখানুভূতি বয়ে বেড়াক, আর কিচ্ছু চাই না।
ইতি
মনোহারিণীর দোষী তাজ

দুই পৃষ্ঠা ভর্তি পরিচিত হাতের লেখার দীর্ঘ চিঠিটা আজ সকালে ব্যাগ হাতড়াতে গিয়ে পেয়েছি। সম্পূর্ণ চিঠি পড়ার পর আমি ঠিক কতটা সময় মূর্তির মতো অটল হয়ে ছিলাম ধারণা নেই। ভেতরটা ডুকরে উঠলেও বাইরে প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। পাছে সবাই না আবার প্রশ্ন করে বসে। চিঠি পাওয়ার পর থেকে ওনার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়নি। ফাহিম ভাইয়াদের বাসা থেকে বিদায় নিয়ে আমরা সকালেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। কক্সবাজার কাস্তুরিঘাটে ট্রলারের জন্য অপেক্ষা করার সময়ও ওনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনি বোধ হয় ইচ্ছে করেই সুযোগ দিলেন না। আমাকে তব্দা খাইয়ে বসিয়ে রেখে সে দিব্যি হেসে-খেলে উপভোগ করছে। আমিও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। ট্রলারে উঠেই ওনার পাশে জায়গা দখল করে নিলাম। উনি কপাল কুঁচকে বললেন,
“ট্রলারে উঠেছিস, না কি প্রাইমারি স্কুলে আগেভাগে বেঞ্চ দখল করছিস?”
আমি ওনার কথার প্রত্যুত্তর করতে গিয়েও করতে পারলাম না। ওই চোখে চোখ আটকাতেই চিঠির প্রত্যেকটা লাইনের লুকায়িত য’ন্ত্রণা হৃদয় গহ্বরে খোঁচা মা’রল। সঙ্গে-সঙ্গে আমার কান্না পেয়ে গেল। কথার আগে কান্না আসার স্বভাবটা বড্ড ঝামেলার। বেপরোয়া চোখ জোড়া স্থান, কালও মানে না। আমি তড়িঘড়ি করে দৃষ্টি নামিয়ে শক্ত হয়ে বসে রইলাম। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চোখ ঝাপটে চোখের পানি সামলানোর চেষ্টা করলাম। উনি নিচু স্বরে বললেন,
“ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করলে এক ধা’ক্কায় সমুদ্রে ফেলে দিবো।”
ট্রলারে সময়টা মন্দ কা’টল না। আমাদের গ্যাং বেশ আড্ডা জমিয়ে দিলো। আমিও উপভোগ করলাম। কিন্তু হুটহাট ওই লোকটার দিকে তাকালেই ভেতরে কেমন তীব্র অস্বস্তি আর ব্যথায় জ’র্জরিত হয়ে পড়ে। সমুদ্রের পানির ঢেউ আর ভাসমান গাঙচিলের সৌন্দর্য দেখতে-দেখতে মন অনেকটা হালকা হলো। চারদিকে থৈ-থৈ পানি আর নীল আকাশের মাঝেই ডুবে রইলাম কতটা সময়। প্রকৃতির মাঝে সত্যিই দৈব এক জাদু আছে। প্রকৃতির কাছাকাছি এলে প্রকৃতি নিজ দায়িত্বে দুঃখগুলো শুষে নেয়। সে চায় কেবল আনন্দ দিতে, মানুষকে হাসাতে। জুম্মান ভাইয়া আর শ্রেয়ান ভাইয়া নিজেদের ক্যামেরায় সকল দৃশ্য ফটাফট বন্দি করে ফেলছেন। এখন সে ব্যস্ত জেলে নৌকাগুলোর ছবি তুলতে। আমিরা আপু আর আনহা আপু প্রবল আগ্রহে সবার ছবি তুলছে। সৌরভ ভাইয়া একবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে, আবার ফাঁকে-ফাঁকে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। রাজ ভাই আর জেনিফার ভাবি একপাশে বসে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করছে আর হাসিমুখে গল্প করছে। আদনান ভাইয়ার হাতে ক্যামেরা থাকলেও, সে ছবি তুলছে কম। সমুদ্রের পাড়ে ট্রলারের কারখানা দেখে তাজ ভাই সৌরভ ভাইয়াকে ডেকে বললেন,
“জনাব সৌরভ, চব্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত মানুষ। তোকে একটা সাজেশন দিই, শোন। তুই বরং এখানেই থেকে যাস। ওই জেলেদের সাথে সারাদিন মাছ ধরবি, না হয় ওই কারখানার ট্রলারে ঠুসঠাস করবি। তবু তো তোর সময়গুলো একটা কাজের কাজে ব্যয় হবে।”
সৌরভ ভাইয়া ভ্রুকুটি করে বললেন,
“এটা সাজেশন, না মা’রার প্ল্যান?”
“অফ কোর্স সাজেশন। এখন তুই যদি নেগেটিভ চিন্তা-ভাবনা করিস, তাতে আমার কী করার আছে? আমি তোর বড়ো ভাই হিসেবে একটা দায়িত্ব পালন করলাম। অনিক কোনোদিন এটুকুও করেছে?”
রাজ ভাই হেসে বললেন,
“অনিকের অনুপস্থিতিতে ওর নামে বদনাম করছিস?”
“তুমি নিজেও এটুকু দায়িত্ব পালন করোনি ভাইয়া। এই গা’ধা ফোনের পেছনে জনম পার করে দিচ্ছে। এখন বড়ো ভাই হিসেবে আমাদের উচিত ওকে সঠিক পথে আনা। তো এসব কাজে লাগিয়ে দিলে ওর ফোনের সাধ এমনিতেই মিটে যাবে,” বিজ্ঞের মতো বললেন উনি।
আমিরা আপু কটাক্ষ করে বলল,
“এখানে রেখে যাওয়ার আগে একটু দয়া করে গা’ধার ফোনটাও দিয়ে যাবেন। ওটা ওর প্রাণভোমরা তো। সব দুঃখে ও হাসতে পারবে, শুধু এই ফোনের দুঃখে ও ম’রেও যেতে পারে। তারপর উপকার করতে গিয়ে উলটো আমাদেরই কেস খেতে হবে।”
শ্রেয়ান ভাইয়া সহমত পোষণ করলেন,
“এটা ঠিক বলেছ। অক্সিজেন ছাড়াও সৌরভ বাঁচতে রাজি আছে,‌ কিন্তু ফোন ছাড়া নয়।”
আমি বললাম,
“তারপর দেখা যাবে সৌরভ ভাইয়া কাজ ফেলে রেখে মাছের বা ট্রলারের ছবি তুলবে, আর ফেসবুকে পোস্ট করে ক্যাপশন দিবে, গাইস দেখুন আমার নিজ হাতে ধরা মাছ, আমার নিজ হাতে তৈরি ট্রলার। আবার আকাশে উড়ে যাওয়া বিমানের ছবি তুলেও বলতে পারে, গাইস দেখুন আমার নিজ হাতে তৈরি বিমান।”
সবাই হুঁ-হা করে হেসে উঠল। সৌরভ ভাইয়া চুপসানো মুখে বলল,
“কী আশ্চর্য আপু! শেষমেষ আপনিও ওদের দলে নাম লেখালেন? এজন্যই বলে, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”
“না ভাইয়া, আপনি নিজেই ফোনের প্রেমে পড়ে দল থেকে ফসকে যাচ্ছেন।”
তারপর আদনান ভাইয়ারা গলা ছেড়ে গান ধরলেন। একটার পর একটা গান টেপ রেকর্ডারের মতো চলছে। মাঝে-মাঝে আবার একেকজন আলাদা করেও গান গাইছে। জুম্মান ভাইয়া হেড়ে গলায় হাঁক ছাড়লেন,

নদীর ঢেউয়ের পরে ঢেউ এসে
ভাঙেরে দুই কূল
মনের দুই কূল ভাঙল তবু
ভাঙল না তার ভুল, আমার
মনের দুই কূল ভাঙল তবু
ভাঙল না তার ভুল।

গানের মাঝেই আদনান ভাইয়া জুম্মান ভাইয়ার মাথায় সজোরে এক গাট্টা মে’রে বললেন,
“হুপ ব্যাটা, এটা তোর নদী না, সমুদ্র। বিরহের গান ধরছিস কোন দুঃখে? তোর বউ তার এক্সের সাথে ভাগছে?”
জুম্মান ভাইয়ার সাধের গানে ব্যাঘাত ঘটায় সে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেলল।
“ধুর ভাই, গানের মুডটাই নষ্ট করে দিলে।”
তাজ ভাই বললেন,
“সমুদ্রে বসে নদীর গান না গেয়ে বাতাসের গান গাইতে পারিস। যেমন ধর,

গুরুজনে কইছিল, প্রেমের বাতাস নিয়ো না
প্রেমের বাতাস গায়ে লাগলে
হইবা তুমি দিওয়ানা।

তাজ ভাই মাথা দুলিয়ে যেভাবে গানটার সুর তুললেন, তাতেই সবার হাসতে-হাসতে গানের বারোটা থেকে চৌদ্দটা বাজিয়ে দিলো। তাজ ভাই ধমকে উঠে বললেন,
“এত্ত সুন্দর একটা গানকে এভাবে অপমান করার অপরাধে তোদের সবকটাকে প্রেমের বাতাস থেকে দূরে থাকার শা’স্তি দেওয়া হবে।”
রাজ ভাই বললেন,
“আমার এই বাতাস খুব প্রয়োজন। নইলে বউ টিকবে না ভাই।”
জুম্মান ভাইয়া বলে উঠলেন,
“প্লিজ ভাই, এই শা’স্তিটা সম্পূর্ণ আমার ওপর মঞ্জুর করো। তবু যদি প্রেমের বাতাসের কৃপায় কপালে একটা প্রেম জোটে।”
আমিরা আপু মুখ কুঁচকে বলল,
“কয়টা লাগে তোর? এখন কি এক্সকেও ফেরত চাস?”
সৌরভ ভাইয়া বললেন,
“এসব বাতাস-টাতাস আমি নিব না ভাই। আমার বাপ আমাকে ডিরেক্ট বাতাসের সাথেই উড়িয়ে দিবে।”
আনহা আপু অনুরোধ করল,
“তাজ ভাই, ভালো একটা গান ধরুন তো।”
তাজ ভাই কিছুক্ষণের মধ্যেই গান ধরলেন,

আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি
তোমার দ্বিধায় পু’ড়ে যাই,
এমন দ্বিধার পৃথিবীতে
তোমায় চেয়েছি পুরোটাই।
আমি তোমার স্বপ্নে বাঁচি
তোমার স্বপ্নে পু’ড়ে যাই,
এমন সাধের পৃথিবীতে
তোমায় চেয়েছি পুরোটাই।

গানের সাথে দু-এক জন সুর মিলাল। পুরো গান শেষে শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,
“আহা ভাই, কী ফিলিংস নিয়ে গাইলি! কেউ আছে না কি?”
তাজ ভাই স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলেন,
“অবশ্যই আছে।”
আমি চমকে উঠলাম। সতর্ক চোখে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সবাই খুব উৎসুক হয়ে উঠেছে তাজ ভাইয়ের কেউ একজনের পরিচয় শোনার জন্য। আমিরা আপু আহত মুখ করে বসে আছে। বেচারি বোধ হয় শক খেয়েছে। শ্রেয়ান ভাইয়া আমার ভয় তুঙ্গে তুলে দিয়ে বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করে বসলেন,
“আরেহ্! ডিটেকটিভ বাবুরও তাহলে কাউকে মনে ধরেছে, অথচ আমিই জানি না! তুই এটা করতে পারলি তাজ? আচ্ছা যা আনন্দর ঠেলায় মাফ করে দিলাম। এবার আমাদের হবু ভাবির পরিচয় শুনি, বল, বল। কী নাম? কোথায় থাকে?”
“তোর শ্বশুরবাড়ি।”
তাজ ভাইয়ের উত্তর শুনে সবাই কপাল কুঁচকে ফেলল। শ্রেয়ান ভাইয়া চোয়াল ঝুলিয়ে বললেন,
“আমার শ্বশুরবাড়ি তো আমিই চিনি না, তুই চিনলি কীভাবে? আর আমার শ্বশুরবাড়িতে তোর বউ এল কোত্থেকে? তোর মতলব খারাপ হলে তো আমি শ্যালিকা দেখে বিয়ে করব না। ওই আশা ছেড়ে দে।”
“তোর শ্যালিকা কে চায়? তোর বউই তো আমার বউ।”
তাজ ভাইয়ের উত্তর শুনে সবাই হাসতে লাগল। শ্রেয়ান ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
“তাহলে তো তোর বউও আমার বউ। শোধবোধ।”
“আমার বউ তোর ভাবি।”
“অ্যাহ্! নিজের বেলায় ষোলো আনা, পরের বেলায় চার আনা?”
“আজব ব্যাপার! আমি যখন বললাম তোর বউ আমার বউ, তখন তো তুই প্রতিবাদ করলি না। আমার বউ পাওয়ার লোভে মেনে নিলি। আমি তো মেনে নিইনি। তাই তোর বউ আমার বউ, আমার বউ তোর ভাবি। সোজাসাপ্টা ক্যালকুলেশন।”
আমাদের গল্প, আড্ডায় ট্রলার মহেশখালীর বাঁকে পৌঁছাল। মহেশখালী বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ। আমরা আড্ডা রেখে দূর থেকে মহেশখালী দ্বীপ দেখতে ব্যস্ত হলাম। জুম্মান ভাইয়া আবার ছবি তুলতে লেগে পড়েছেন। জেনিফার ভাবি তার ব্যাগ থেকে চকোলেট বের করে সবার মাঝে বিলি করলেন। তাজ ভাই তার চকোলেট খুলে এক কামড় খেয়ে আমার‌ বাঁ হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি তখন ডান হাতের চকোলেট মুখে পুরেছি। ভ্রু কুঞ্চিত করে ওনার দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি বললেন,
“পচা কাঁদার মতো স্বাদ।”
“কই? মজাই তো লাগছে। আপনি পচা কাঁদা খেয়েছেন মনে হয়?”
উনি আমার মাথায় মৃদু টোকা মে’রে বললেন,
“না, ছোটো বেলায় তুই খেয়েছিলি, আমি দেখেছিলাম।”
“আজাইরা কথা।”
ট্রলার বাঁকখালী নদীর একটু ভেতরে প্রবেশ করতেই হঠাৎ ঢেউ উঠল জোরেশোরে। আমরা শক্ত হয়ে বসলাম। রাজ ভাই বললেন,
“সমুদ্র পার হলাম কত সুষ্ঠুভাবে। এখন নদীতে এসে ঢেউ উঠল। এই ঠিক করে বস সবাই।”
তাজ ভাই হুট করেই আমার দিকে সরে বসে এক হাত চেপে ধরলেন। আমি সতর্ক দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
“সরে বসুন। আমি বাচ্চা নই।”
উনি সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,
“ওহ্, আপনি তো খুব বুড়ি। নদীতে ফেললে উঠে আসতে পারবেন?”
“উঠে আসার কী দরকার? না এলেই তো আপনার সব য’ন্ত্রণা চিরকালের জন্য বিদায় হবে।”
উনি চোখে হাসলেন। কিঞ্চিত তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,
“আগে জানলে সুইডেন যাওয়ার আগে ঠান্ডা মাথায় একটা মা’র্ডার করে য’ন্ত্রণা বিদায় করে যেতাম।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

(ভুলত্রুটি মার্জনীয়।)