মরুর বুকে বৃষ্টি ২ পর্ব-১৬+১৭

0
348

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-১৬
®মেহরুমা নূর

★আদিত্য আজ অফিসে যায়নি। আজ সে নূরের সাথে পুরোটা সময় কাটাবে বলে মনস্তাপ করেছে।গত কয়েকদিনের ঘটনায় আদিত্যর মনে হচ্ছে সে নূরের ঠিকমতো খেয়াল রাখতে পারছেনা। তাই হয়তো নূর এমন উল্টো পাল্টা আচরণ করছে। এটা ভেবেই আদিত্য আরও বেশি করে নূরের খেয়াল রাখতে চায়। যাতে নূরের সবকিছু সে বুঝতে পারে। এঞ্জেলটাকে কোনরকম কষ্ট পেতে দিবেনা সে। নূরের মন প্রফুল্ল করতে পুল সাইডে ছোট্ট পার্টির আয়োজন করেছে আদিত্য। বাইরের কেউ না,শুধু নিজেরা নিজেরাই করবে। পার্টির কথা শুনতেই আবির সকাল সকালই চলে এসেছে। তাকে এত সকাল সকাল দেখে বিহান ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলল,
“কিরে হালা! ছকাল ছকাল কি কু,ত্তায় দৌড়ানি দিছে নি?”
“আবির পুলের পাশে রাখা ছাতা বিশিষ্ট চেয়ারে বসে বলল,
” আর বলিসনা ইয়ার! মানুষের মাঝে আজকাল মানবতাই নাই! রাতভর এত নিঃস্বার্থ সেবা করলাম মেয়েটাকে। নিজের কথা একবারও ভাবলাম না। কত খাটুনি করে তার সেবা করলাম। অথচ দেখ কি অকৃতজ্ঞ! সকাল সকাল তাড়িয়ে দিলো আমাকে! এই কি সেবার প্রতিদান! নাহয় একটু নামটাই ভুলে গেছি তার। সকালে ঘুমের ঘোরে নাহয় অন্য নাম বলে ফেলেছি তাই বলে এভাবে নির্দয়ের মতো তাড়িয়ে দিবে! তাও খালি গায়ে! পড়নে শুধু শটস ছিলো। ওই অবস্থায়ই তাড়িয়ে দিলো। শেষে দারোয়ানের কাছ থেকে কাপড়চোপড় ধার নিয়ে পড়তে হয়েছে। বল এইডা কোনো কথা! আরে ভাই শেক্সপিয়ার মামা কি বলেছে! ‘হোয়াট ইজ দ্য নেম’। কিন্তু এই তুচ্ছ বোকা নারীজাতি! এত মহৎ ব্যাক্তির উক্তিও ভুলে গেছে। কি হবে এদের! ”
আবিরের কথায় হাসতে লাগল বিহান। তারপর বলল,
“এক্কেরে ঠিক কাজ হইচে। তোর লগে এমতেই হওন উচিত। বাইদাওয়ে, তুই ভুলে কার নাম লইছিলি? আহানার?”
আবির কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“শাট আপ ইয়ার। আহানাকে কখনো আমি ওইসব সময়ে মনে করিনা৷ আসলে ওকে আমি ওইভাবে কখনো মনেই করিনা। তবে যখনই হুট করে মনে উদয় হয় ওর কথা তখন শুধু গিয়ে একবার দেখে আসি। আর ওকে ইচ্ছেমত জ্বালিয়ে আসি। ব্যাস এতটুকুই। এরবেশি না ওর প্রতি আমার চাহিদা, আর না প্রয়োজন।”
“তো কতদিন এমতে চলবি! আহানা যদি অন্য কারো লগে ছাদী কইরা ফালাই তহন কি করবি?”
আবির স্মিথ হেঁসে বলল,
“কি করব,একটা প্রেসার কুকার গিফট করে দিবো।জানি ওরজন্য অনেক বড় গিফট হয়ে যাবে। এতবড় গিফট ওর চৌদ্দ গুষ্টি মিলেও হয়তো দিতে পারবেনা। আমার কাছ থেকে এতবড় গিফট পেয়ে বিস্ময়ে অজ্ঞান বনেও যেতে পারে। এখন আমি মানুষটাই এত মহান, কি আর করার!”
বলেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসতে লাগল আবির।বিহান অসহায় ভঙ্গিতে মাথা দুই দিকে নাড়াল। এই পাগলটার সুবুদ্ধি কবে হবে কে জানে! অনেক দেরি না করে ফেলে।

ওদের কথাবার্তার মাঝে আদিত্য নূর চলে এলো। নূরকে পাঁজা কোলে করে নিয়ে আসছে আদিত্য। নূর আবিরদের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে হাত নাড়াল। আবির বলে উঠল,
“আসেন আসেন ভাবি,আপনিইতো পার্টির প্রধান অতিথি।”
নূর খুশিমনে হাসলো। পুলের পাশে মিউজিক সিস্টেম লাগানো হয়েছে। আবির তাতে গান ছেড়ে দিয়ে উড়াধুড়া এলোপাতাড়ি নাচতে লাগল। সাথে বিহানও যোগ দিলো। নূর এসব দেখে হেঁসে কুটিকুটি হচ্ছে। আর আদিত্য নূরের খুশিতে মন জুড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সবাই সুইমিং পুলে নামল। সেখানেও ইচ্ছেমত মাস্তি করতে লাগল। নূূর সাতার জানে না, তাই আদিত্য তারজন্য একটা পাম্প দেওয়া সুইমিং বেডের ব্যবস্থা করেছে। পানির উপর ভাসছে বেডটা আর নূর তারউপর বসে আছে। আদিত্য পুলের মাঝে দাঁড়িয়ে নূরের বেডটা ধরে পানির উপর এদিক ওদিক ভাসাচ্ছে। তাতে নূর ভীষণ খুশি। হাতে তালি বাজিয়ে বাচ্চাদের মতো প্রফুল্লচিত্তে হাসছে সে। দুষ্টুমি করে আদিত্যর দিকে ছুঁড়ে মারছে। অনেক আনন্দ হচ্ছে তার। তাদের এইসব আনন্দ উল্লাস দেখে জ্বলে পুড়ে ছারখার হচ্ছে ঝুমুর। ছাঁদের উপর দাঁড়িয়ে নিচের সবকিছু দেখছে সে। তারা পার্টি করছে অথচ ঝুমুরকে একবার জানালও না। রাগে ফেটে যাচ্ছে সে। এতকিছুর পরেও এত আনন্দ কিভাবে করছে এই লোক! নাহ, এভাবে আর চলবে না। আমাকে এবার অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে। বড় কিছু করতে হবে যাতে পাগলী সারাজীবনের জন্য দূর হয়ে যায় আদিত্যর কাছ থেকে। আদিত্য যাতে চাইলেও আর ফিরে না পায় তাকে এমন কিছু করতে হবে। মনে মনে নিজের প্ল্যান সাজাতে বসলো ঝুমুর।
__

পরদিন আদিত্য অফিস যেতেই ঝুমুর সুযোগ বুঝে নূরের রুমে এসে ওর পাশে বসলো। মুখে মিথ্যে আতঙ্কের ছাপ এনে বলল,
“জানো আপু তোমার জন্য আমার খুব চিন্তা হচ্ছে? ”
নূর বুঝতে না পেরে বলল,
“কেন? আমার কি হয়েছে?”
“কেন, দেখলেনা কিভাবে তোমাকে সেদিন চড় মারল আদিত্য। আমারতো খুব খারাপ লাগল দেখে। আসলে সে তোমাকে পছন্দই করে না৷ তাইতো ওভাবে মারল।”
নূর ভাবনাগ্রস্ত মুখ করে বলল,
“কিন্তু হিরোতো মাফ চেয়েছে। বলেছে আর করবেনা এমন।”
“আরে ধুর, ওসবতো উপরে উপরে বলেছে। আসলে মনে মনে সে তোমাকে একদমই পছন্দ করে না।”
নূর মলিন মুখে বলল,
“পছন্দ করেতো। এইযে দেখ কত খেলনা এনে দিয়েছে আমাকে! আরও অনেক কিছু করে। হিরো অনেক ভালো।”
“আপু তুমি না অনেক সরল। তাই ওই লোকের চালাকি বুঝতে পারছনা। সে একদমই তোমাকে পছন্দ করে না। তোমার সাথে এসব করে কারণ সে সবার চোখে ভালো থাকতে চায়। সবাই যাতে ভাবে সে তোমাকে ভালোবাসে তাই এমন করে। আসলে আদিত্যর মনে চলছে অন্য ফন্দি।”
নূর প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,
“ফন্দি! এটা আবার কি?”
“আরে ফন্দি মানে তোমার খারাপ কিছু করার চিন্তা করছে।”
নূর আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে বলল,
“খারাপ কিছু! কি খারাপ কিছু? ”
ঝুমুর অনেকটা নাটকীয় ভঙ্গিতে ত্রাসিত কন্ঠে বলল,
“আমারতো বলতেও ভয় করছে। জানো আদিত্য অনেক ভয়ংকর লোক! সে একদমই ভালো না। আদিত্য তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করে তারপর একদিন তোমাকে চুপ করে একসময় চা,কু দিয়ে জ,বাই করে মেরে ফেলবে। আর সবাইকে বলবে তুমি কোথাও পালিয়ে গেছ।এমনটাই করার সিদ্ধান্ত করেছে সে।”
নূর আৎকে উঠল। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে বলল,
“না না এসব কি বলছ! আমার হিরো এমন করবেনা। সে আমাকে মারবে না।”
“আমি জানতাম তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবেনা। তাই আমি তোমাকে নিজের কানেই শোনাব। আমি বুদ্ধি করে আদিত্য সব কথা ফোনে রেকর্ড করেছি। এই দেখ।”
ঝুমুর একটা ভিডিও প্লে করল। যেখানে একটা লোক বসে ফোনে কথা বলছে। তার পেছন সাইড দেখা যাচ্ছে। আদিত্যর মতো পোশাক পড়া। ঝুমুর তাকে জানাল এটা আদিত্য। অবুঝ নূর তাই বিশ্বাস করে নিলো। আদিত্যর কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। সে ফোনে বলছে,
“শোন, সব রেডি রেখেছিস তো! খুব জলদিই এই পাগলীটাকে জ,বাই করবো আমি। একে আর সহ্য হচ্ছে না আমার। জাস্ট নিতে পারছিনা আর। না চাইতেও ওই পাগলীর সাথে ভালো ব্যবহার করতে হচ্ছে। খুব জলদিই এটার বলি দিতে হবে।তোরা সব ঠিক ঠাক করে রাখিস।”
ভিডিওটা দেখে স্তব্ধ,আতঙ্কিত হয়ে গেল নূর। কষ্টও হচ্ছে তার অবুঝ মনে। তার হিরো তাকে মেরে ফেলবে! ভাবতেই ভীষণ রকম কষ্ট হচ্ছে তার। চোখে জমছে নোনাজল। তা দেখে ঝুমুর বাঁকা হাসল। তার প্ল্যান কাজ করছে। পাগলী বুঝতেই পারেনি এটা আদিত্য না, অন্য লোক। যাকে ঝুমুর আদিত্যর কন্ঠ কপি করিয়েছে। প্ল্যানের ধাপ বাড়িয়ে ঝুমুর বলল,
“দেখলেতো কত ভয়ংকর লোক সে! একদম ভালো না৷ মানুষ মারা তার রোজকার কাজ। এক নাম্বারের জল্লাদ। তোমাকেও মেরে ফেলবে।”
নূরের মাঝে ভয় আর কষ্টের সংমিশ্রণে পীড়াদায়ক অনুভূতি হচ্ছে।যার মর্ম নূর সঠিক বুঝতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারছে হিরোর এইরূপ দেখে তার একটুও ভালো লাগছে না। খুব পঁচা লাগছে। তার হিরোটা এত পঁচা! নূরকে মেরে ফেলতে চায়! নূর কি করেছে এমন! কাঁদতে লাগল নূর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। ঝুমুর বলল,
“দেখ আপু কাঁদলে হবে না। তোমাকে পালাতে হবে এখান থেকে। নাহলে মেরে ফেলবে তোমাকে।”
“পালাব! কিন্তু কিভাবে! আর কোথায় পালাব!”
“আমি সব ব্যাবস্থা করে দিবো। তোমাকে আমি এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা করে দিবো। তুমি বাইরে গিয়ে যেকোনো গাড়ি ওয়ালাকে বললেই তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিবে।দেখ আমি তোমার সাথে যেতে পারছিনা এখন। কারণ দুজন গেলে আদিত্য সন্দেহ করবে। তাই তুমি যাও, আমি থাকি।”
“সত্যি? ”
“আরে হ্যাঁ, আমি একদম ঠিক বলছি। এখন চলো আমার সাথে। তোমাকে পালানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
নূর মলিন মুখে মাথা দুলিয়ে ঝুমুর সাথে রুমের বাইরে এগুলো। তার কেমন যেন ভীষণরকম কষ্ট হচ্ছে। কোথাও ব্যাথা করছে অসহনীয়। যা অবুঝ নূর ধরতে অক্ষম। শুধু দুচোখ ভরে আসছে তার। অভিমান হচ্ছে খুব করে। তার হিরোটার উপর অভিমান হচ্ছে। ঝুমু ঠিকই বলেছে,নূর চলে যাবে এখান থেকে। পঁচা হিরোর কাছে আর থাকবেনা সে। একদম না।

অভিমান বুকে চেপে মলিন,ব্যাথিত হৃদয়ে ঝুমুরের সাথে বাইরে এলো নূর।লিভিং রুমে তখন তেমন কেউ ছিলোনা। ঝুমুর চারিদিকে চোখ বুলিয়ে সাবধানে নূরকে নিয়ে দ্রুত মেইন দরজার বাহিরে এলো। এবার শুধু গার্ড গুলোর চোখ ফাঁকি দেওয়ার পালা। ঝুমুর নূরকে ফিসফিস সুরে বলল,
“শোনো আপু,আমি যখন ইশারা করবো তখন তুমি দৌড়ে গেটের বাইরে চলে যেও কেমন!”
নূর ঘাড় কাত করে সম্মতি দিলো। ঝুমুর নূরের কাছ থেকে সরে গিয়ে সুইমিং পুলের কাছে এসে ইচ্ছে করে পা পিছলে পানিতে পড়ে গেল। মিছামিছি পানিতে ডুবে যাওয়ার ভং ধরে চিল্লাতে লাগল বাঁচাও বাঁচাও। তা দেখে গেটের গার্ডগুলো সব তার দিকে ছুটে এলো বাঁচাতে। ঝুমুরের হাত ধরে তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। ঝুমুর সুযোগ বুঝে নূরকে ইশারা করল গেট দিয়ে বেড়িয়ে যেতে। নূর তা বুঝতে পেরে গার্ডদের অগোচরে গেটের দিকে চলে গেল। গেটের কাছে এসে একবার কান্নাভেজা চোখে বাসার দিকে আবার তাকাল। তারপর দ্রুত বেড়িয়ে গেল গেট পার হয়ে। নূর যেতেই ঝুমুরের ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটল। ফাইনালি তার পথের কাটা বিদায় হলো। এই পাগলী আর কখনোই নিজের ঠিকানা খুঁজে পাবেনা। তাই ঝুমুরের করা কাজের কথাও কেউ জানতে পারবেনা৷এমনকি আদিত্যও না। ঝুমুর সব বুঝে শুনেই কাজ করেছে। সে ভালো করেই জানে বাসায় সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। তাইতো সে প্রতিবারই এমন পদ্ধতিতে কাজ করেছে যে সিসি ক্যামেরায় তেমন কিছু বোঝা যায় না। সেই কৌশলেই ক্যামেরা আড়াল করে সে সব কাজ করে এসেছে ।আজও ক্যামেরায় মনে হবে নূর একা একাই বেরিয়ে গেছে। তাইতো তারউপর সন্দেহও আসবেনা। একেই বলে এক ঢিলে দুই শিকার। সাপও মরল, আর লাঠিও ভাঙল না।
__

আদিত্য একটা আউটডোর বিজনেস এসোসিয়েশন কনফারেন্সে এসেছিল। বাসা থেকে সোজা এখানেই এসেছে সে। দুপুরের দিকে শেষ হয় কনফারেন্স। কনফারেন্স শেষ করে গাড়িতে উঠে বসেই আগে নূরের নাম্বারে ফোন দেয় সে। মনটা কেমন যেন অস্থির লাগছে তার হঠাৎ। কেমন অশান্ত হচ্ছে মন। নূরের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত ভালো লাগবেনা তার। কনফারেন্সে থাকায় ফোন করতে পারেনি সে। তাই বের হয়েই আগে ফোন করেছে সে। কিন্তু নূর ফোন ধরছেনা। পরপর কয়েকবার দিলো কিন্তু নূর ফোন ধরছে না। আদিত্য ভাবল হয়তো ফোন রেখে অন্য কোথাও গেছে। অফিসে থাকা অবস্থায় একটু পরপরই সিসি ক্যামেরায় দেখে নূরকে। এখানেতো তাও পারছেনা। সকাল থেকে নূরকে না দেখে মনটা ভীষণ অস্থির হচ্ছে তার। সামনে থেকে বিহান নিজের বলে যাচ্ছে,
“হালার এছআর গ্রুপের মুখটা দেখছছ আদি! তোরে `বিজনেসম্যান অফ দ্য ইয়ার` হইতে দেইখা কেমতে জইলা পুইড়া কয়লা হইয়া যাইতাছিল। আমারতো জব্বর মজা লাগতাছিল ওইটা দেইখা। কত চেষ্টা করল আমগো হারানোর, তোরে মারার কিন্তু কোনোডাই কাজে দিলোনা। তয় একখান কথা আদি। আমগো কইলাম ছাবধানে থাকোন লাগব। ওই হালায় চুপ থাকবো না৷ আজকের পরতো আরও ক্ষ্যাপা কু,ত্তা হইয়া যাইবোগা। তোর ক্ষতি করার জন্য উইঠা পইড়া লাগব। তাই আমগো আরও ছাবধান হওন লাগব। হুনতাছস কি কইতাচি?”
আদিত্য বোয়ালখালী ভঙ্গিতে বলল,
“হুম হ্যাঁ! সাবধানতো হতে হবে। আমার জন্য না। নূরের জন্য। আগের মতো হলে আমি এসব নিয়ে ভাবতামইনা৷ তবে এখন আমি ভয় পাই। নূরের ক্ষতি হওয়ার ভয় পাই। ওকে হারানোর ভয় পাই। তাই বাসার সিকিউরিটি আরও বাড়িয়ে দে। আমি কোনো কমতি চাইনা।”
“আইচ্ছা তুই এইছব নিয়ে চাপ লইছ না।”
বিহান বললেও আদিত্য কেন যেন শান্ত হতে পারছেনা। সে আবার ফোন করল নূরের নাম্বারে। কিন্তু আবারও ফোন ধরলনা সে। আদিত্যর অস্থিরতা কেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে এবার বাসার ল্যান্ডলাইন নাম্বারে ফোন দিলো। একটু পর জমিলা ফোন রিসিভ করলে আদিত্য বলল,
“নূর কোথায়? কি করছে ও?”
“বউমনিতো রুমেই আছে।”
“রুমে আছে তাহলে ফোন ধরছে না কেন? একটু গিয়ে দেখুনতো কি করছে? ফোন ধরতে বলুন।”
“আচ্ছা আমি দেখছি এখুনি।”
ফোন রাখার পর আদিত্য অপেক্ষা করতে লাগল জবাবের। কিন্তু সময় গড়িয়ে দশ মিনিট হয়ে গেল কিন্তু কোনো রেসপন্স এলোনা। অধৈর্য হয়ে আদিত্য নিজেই আবার ফোন করল। প্রথমে নূরের নাম্বারে করল কিন্তু আবারও রিসিভ হলোনা। তারপর বাসার নাম্বারে ফোন দিলো। জমিলা রিসিভ করলে আদিত্য অস্থির,উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“আপনাকে বললাম না নূরকে ডেকে দিতে! তো কি করছেন আপনি!”
ওপাশ থেকে জমিলা কিছুটা ভীতিগ্রস্ত কন্ঠে বলল,
“আ….আসলে বউমনি…”
“বউমনি কি? নূর কোথায়? ”
“আসলে বউমনি রুমে নেই। বাসার কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না তাকে।”
জমিলার কথাটা যেন কথা ছিলোনা। এ যেন বজ্রপাতের ন্যায় আদিত্যর কানে বিস্ফোরণ ঘটালো। যা আদিত্যর ভেতর বাহিরের সবকিছু মুহুর্তেই স্তম্ভিত করে দিলো। পরপরই আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
“পা….পাওয়া যাচ্ছে না মানে! এমন ফালতু কথা বলার সাহস কি করে হলো আপনার! এটা বলার জন্য আপনাদের রাখা হয়েছে! যান ভালো করে খুঁজুন। নিশ্চয় কোথাও বসে খেলছে। ভালো করে খুঁজুন।”
আদিত্য কেটে দিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“বিহান গাড়ি ঘোরা। বাসায় চল।”
“কি হইচে আদি! এমন করাতছছ ক্যালা!”
“তুই দ্রুত বাসায় চল।”
“আইচ্ছা আইচ্ছা রিল্যাক্স হ। যাইতাছি।”
আদিত্য কিভাবে রিল্যাক্স হবে! তারতো হৃৎস্পন্দনই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হাত পা মৃদু কাঁপছে।বুকটা শুঁকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। এসির মাঝেও ঘেমে পুরো ভিজে যাচ্ছে সে। ওর এঞ্জেলটা কোথায় গেল! কোথাও যায়নি। নিশ্চয় সেদিনের মতো কোনো কোণায় বসে খেলছে। হ্যাঁ হ্যাঁ তাই হবে। বাসায় গেলেই পেয়ে যাবো পাখিটাকে।

নূর ঘন্টাখানিক ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদছে। পুতুলটা এক হাতে পেঁচিয়ে ধরে হাতের উল্টো পিঠে কান্না মুছতে মুছতে যাচ্ছে সে। তার খুব কষ্ট হচ্ছে।হিরোর পঁচা রুপ তাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে। হিরোটা এমন কেন করল তার সাথে। সে’তো হিরোকে একদম জ্বালায়নি। লক্ষী মেয়ে হয়ে ছিলো। তাহলে তাকে কেন মারতে চাইলো! পঁচা হিরো।কখনো কথা বলবোনা তার সাথে। এসব ভেবে ভেবে নূর কাঁদতে কাঁদতে এগুচ্ছিল। তখনই রাস্তায় একটা বাস দাঁড়ান দেখতে পেল সে। তার মনে পড়ল ঝুমুর বলেছিল গাড়ি ওয়ালাকে বললেই ওকে বাড়ি পৌঁছে দিবে। নূর সেই মোতাবেক আস্তে আস্তে শঙ্কিত মনে বাসে উঠে এলো। বাসে তখন যাত্রী ছিলোনা। ড্রাইভার আর হেল্পার বসে সিগারেট খাচ্ছিল। নূরকে গাড়িতে উঠতে দেখে হেল্পার বলল,
“কই যাইবেন ম্যাডাম? ”
নূর কাচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,
“নূর বাড়ি যাবে। আমাকে বাড়ি দিয়ে আসেন।”
হেল্পারের ভ্রু কুঁচকে আসল। দুজন নূরকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত স্ক্যান করতে লাগল।কুরুচিপূর্ণ তাদের চোখের নজর। যা অবুঝ নূর বুঝতে পারল না। হেল্পার আর ড্রাইভার দুজন দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে রহস্যময় হাসল। তারপর নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ হ অবশ্যই। আপনি বহেন৷ আপনারে বাড়ি পৌঁছাইয়া দিমুনে আমরা। কোনো চিন্তা কইরেন না।”
নূর ঘাড় কাত করে একটা সিটে গিয়ে বসল। হেল্পার ড্রাইভার বাঁকা হেঁসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। অবুঝ নূর জানলও না কোন ভয়ংকর ফাঁদে পা দিলো সে।

চলবে…..

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-১৭
®মেহরুমা নূর

★বাসায় এসেই গাড়ি থেকে নেমেই পাগলের মতো বাসার ভেতর দৌড়াল আদিত্য। ঢুকেই উচ্চস্বরে নূরকে ডাকল। কিন্তু নূর এলোনা। তার পরিবর্তে এলো জমিলাসহ বাসার সার্ভেন্ট গুলো। যাদের মুখে স্পষ্ট ভীতির ছাপ।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ওরা৷ তাদের এমন ভাবভঙ্গি দেখে আদিত্যর বুকের মাঝে কামড়ে ধরল। তাহলে কি নূরকে এখনো পাওয়া যায়নি! আদিত্য পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরেও যেন মানতে চাইল না। উত্তেজিত,কম্পিত স্বরে বলল,
“কি হলো! এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন সবাই? নূর কোথায়? রুমে আছে বোধহয় তাইনা! জানতাম দুষ্টুটা কোনো কোণায় বসে খেলছে। আমাকে টেনশনে রাখা ছাড়া কোনো কাজ নেই দুষ্টুটার।”
সার্ভেন্টদের মাঝে ভীতি আরও বেশি হলো। জমিলা সাহস জুগিয়ে বলল,
“ছোট সাহেব বউমনিকে পাওয়া যায়নি। আমরা সব কোণায় কোণায় দেখেছি। কোথাও নেই।”
আদিত্যর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল যেন। সে উত্তেজিত, রাগী গলায় বলল,
“কোথাও নেই মানে কি! এতগুলো মানুষ থাকতে এঞ্জেল হারিয়ে গেল! তোমরা তাহলে কি করছিলে! কিসের জন্য রেখেছি তোমাদের! এতগুলো মানুষ মিলে একজনকে দেখে রাখতে পারোনি! আরে বাসা ছেড়েতো আর যায়নি! তাহলে পাওয়া যাবে না কেন? তোমাদের দ্বারা হবেই না কিছু। সরে যাও আমার চোখের সামনে থেকে। আমি নিজেই খুঁজে বের করছি আমার এঞ্জেলকে। দেখ এখুনি পেয়ে যাবো।”
বলেই আদিত্য পাগলের মতো সব জায়গায় খুঁজতে লাগল তার এঞ্জেলকে। সব কোণায় কোণায় খুঁজছে তাকে। করুন, মায়াময় গলায় ডাকছে,
“নূররর…মাই এঞ্জেল, বের হয়ে এসো প্লিজ। দেখ তোমার হিরো এসেছে। আর লুকিয়ে থেকোনা। প্লিজ এসোনা সোনাপাখি।”
তন্নতন্ন করে সব জায়গায় খুঁজেও যখন নূরকে পেলনা তখন চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখতে পেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। মস্তিষ্ক ফেটে যাচ্ছে তার দুশ্চিন্তায়। আদিত্য দুই হাতে মাথার চুল টেনে ধরে হাঁটু গেড়ে ধপ করে নিচে বসে গগনবিদারী চিৎকার করে বলল, “নূররররর……”। বিহান দৌড়ে এলো আদিত্যের কাছে। ওকে সামলানোর চেষ্টা করে বলল,
“শান্ত হ আদি,ভাবিরে পাইয়া যামু আমরা। আগে দেখতে হইবো ভাবি বাছার ভেতর আদৌও আছে নাকি বাইরে কোথাও চলে গেছে।আমি গার্ড গুলারে জিগাইলাম। ওরা কইলো ভাবিরে নাকি বাইরে যাইতে দেহে নাই।বাছায়ওতো পাওয়া গেল না। তাইলে গেল কই? ”
হঠাৎ আদিত্যর কিছু মনে পড়তেই সে উঠে দ্রুত তার রুমের দিকে দৌড়াল। বিহানও দৌড়ালও তার পেছনে। রুমে এসে আদিত্য ওর ল্যাপটপ চালু করল। সিসি ক্যামেরার রেকর্ড কানেক্ট করল তার সাথে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখার চেষ্টা করল নূর কোথায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে কোথাও দেখা যাচ্ছে না তাকে। আদিত্য সময় রিভার্স করে আধাঘন্টা পূর্বে গেল। তখনও পেলনা তাকে। পরে আরও রিভার্স করে এক ঘন্টা পেছনের সময়ে গেল। তখন দেখতে পেল নূরকে। বাইরে দেখা যাচ্ছে তাকে। নূরকে দেখে যেন আদিত্যর নজরে করুন মায়া ভেসে উঠল।এইতো তার প্রাণভোমরাটা! কিন্তু কিছুক্ষণ পরই দেখল ঝুমুর পুলের মাঝে পড়ে গেল। আর গার্ডগুলো সেখানে গেল। তখনই নূর সেই ফাঁকে ধীরে ধীরে গেটের দিকে এগুচ্ছে। তা দেখেই আদিত্যর চোখে মুখে আতঙ্ক ছেয়ে গেল।উত্তেজিত, কম্পিত গলায় সে বলতে লাগল,
“নো নো নো,নূর নো, নো মাই এঞ্জেল, ডোন্ট গো।”
একসময় নূর গেটের কাছে চলে গেল। আদিত্য ল্যাপটপের স্ক্রিনে পাগলের মতো হাত বোলাতে বোলাতে অস্থির কন্ঠে বলল,
“প্লিজ জান, যাস না, ফিরে আয়।”
কিন্তু নূর চলে গেল। থেমে গেল আদিত্যর হৃদপিণ্ড। থমকে গেল তার পুরো পৃথিবী। কিছু সময়ের জন্য অনুভূতি শূন্য হয়ে গেল আদিত্য। তারমানে নূর একঘন্টা আগেই বাসার বাইরে চলে গেছে! তা ভাবতেই আদিত্যর শরীরের সব বোধশক্তি যেন হ্রাস পেল। সে শরীরের ব্যালেন্স হারিয়ে দুই কদম পিছিয়ে পড়ে যেতে নিলে বিহান এসে ধরে ফেলল তাকে। আদিত্য বিমর্ষ, বিভৎসকর আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
“বি….বিহান আমার এঞ্জেল! আমার এঞ্জেল চলে গেছে কোথাও।”
বিহান আদিত্যকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
“ছান্ত হ আদি।”
আদিত্য উত্তেজিত অশান্ত স্বরে বলল,
“শান্ত হবো আমি! কিভাবে শান্ত হবো? আমার নূর, আমার এঞ্জেল এক ঘন্টা হলো বাসার বাইরে! ভাবতে পারছিস তুই! নূর তোর আমার স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন না। কোথায় যেতে হবে, কি করতে হবে কিছুই জানে না ও। এই শহরের কিছুই চেনেনা ও। কতটা ভয়ংকর ব্যাপার তুই ভাবতে পারছিস! ওর সাথে কি কি হতে পারে তা চিন্তা করতেও আমার রুহ কেঁপে উঠছে।”
আদিত্য কিছু একটা মনে করে আরও বেশি ভয়ার্ত, বিভ্রান্ত চোখে এলোমেলো ভাবে তাকিয়ে বলল,
“আল্লাহ না করুক যদি আরএস গ্রুপের হাতে পড়ে যায় তখন! ওরাতো তাকেই আছে আমার যেকোনো ভাবে ক্ষতি করার। যদি নূরকে ধরে ফেলে ওরা তখন কি করবো আমি! কি করবো বিহান! ওর কিছু হয়ে গেলে আমি পুরো দুনিয়ায় আগুন লাগিয়ে দেবো বিহান। সব ধ্বংস করে দিবো আমি।”
“আদি, আদি একটু শান্ত হ আগে। এমতে পাগল হইলে কিছু মাথায় আইবো। একটু মাথা ঠান্ডা কইরা ভাবতে হইবো কেমন খুঁজমু আমরা ভাবিরে। আমি গ্যাংয়ের লোক ছবগুলারে অহনি কইয়া দিতাছি ভাবিরে খুঁজবার লাইগা। তুই চিন্তা করিছনা আমরা পাইয়া যামু ভাবিরে।”
আদিত্য বিহানের কথা শুনল কিনা তা বোঝা গেলনা। সে হঠাৎ কোন কিছু না বলেই ল্যাপটপ টা নিয়ে দ্রুত বেগে ছুটল বাইরের দিকে। বিহানও ঘাবড়ে গিয়ে আদিত্যকে ডাকতে ডাকতে তার পিছে পিছে ছুটল। আদিত্য দৌড়ে বাইরে এসে সোজা গাড়িতে গিয়ে বসল। বিহানও আদিত্যর পাশে দ্রুত বসে পড়ল। এই অবস্থায় আদিত্যকে একলা ছাড়লে অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে তাই বিহান চিন্তিত স্বরে বলল,
“কই যাইবার চাছ? আমি গাড়ি চালাই।”
আদিত্য যেন কিছু শুনলই না৷ গাড়ি নিয়ে ফুল স্পিডে বেড়িয়ে পড়ল। গাড়ি চালাতে চালাতে অন্য হাতে ল্যাপটপ চালু করে কিছু একটা করে ল্যাপটপটা বিহানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা দেখতে থাক। আর এখানে দেখানো লোকেশনটা বল আমাকে।”
“এইটা কিছের লোকেছন?”
“নূরের লোকেশন। ও প্রথম যেদিন হারিয়ে গিয়েছিল তার পরদিনই ওরজন্য একটা পেনডেন্ট কিনে এনেছিলাম। আর এই পেনডেন্টে ট্রেকার লাগানো আছে। এখন এখানে দেখা যাচ্ছে নূরের লোকেশন।”
“বাহ! বহুত ভালা কাজ করছস। অহনতো খুব সহজেই ভাবিরে খুইজা বাইর করমু।”
বিহান ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে লোকেশন চেক করল। সে দেখতে পেল লোকেশন এক জায়গায় স্থির নেই। রানিং চলছে। বিহান আদিত্যকে জানাল,
“আদি, ভাবির লোকেশনতো রানিং দেখাইতাছে৷ তারমানে ভাবি কোনো যানবহনে আছে অহন।”
আদিত্যর ভয় যেন আরও বাড়ল। যানবাহনে আছে মানে! নূর কোন গাড়িতে উঠেছে! কোথায়ই বা যাচ্ছে সে! আদিত্যর হাত পা অবশ হয়ে আসছে যেন। আদিত্য বলল,
“এক কাজ কর লোকেশন আগে কোথায় কোথায় ছিলো সেটা দেখ।”
বিহান তাই করল। আগের সব চেক করে বলল,
“ভাবি আমগো বাছা থাইকা বাম দিকে গেছে প্রথমে। তারপর দশ মিনিট আগপ ****সিগনালের কাছ থাইকা রানিং চলতাছে। অহন গাজীপুরের দিকে যাইতাছে।”
“আচ্ছা যে সিগনালের কাছ থেকে গাড়িতে উঠেছে ওখানে যেতে হবে আগে। সিগনালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যেতে পারে।”
“হ হ ঠিক কইছস। চল যাই।”
আদিত্য গাড়ি দ্রুত চালিয়ে ওই সিগনালের কাছে এলো। তারপর ট্রাফিক পুলিশের অফিসে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাইলো। আদিত্যকে চেনে না এমন লোক কমই আছে।তার ক্ষমতা সম্পর্কেও ধারণা আছে সবার।তাই তাকে মানা করলনা পুলিশ। সিসিটিভি ফুটেজে ওরা দেখতে পেল নূর হাঁটতে হাঁটতে এসে একটা বাসের ভিতরে উঠল। তার খানিক পরই বাসটা ছেড়ে দিলো। এটা দেখেতো আদিত্যের ভয়ে হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল যেন৷ নূর একটা অপরিচিত বাসে উঠেছে! বাসটা ওখানে দাঁড় করানো ছিলো। তারমানে বাসে তখন অন্য কোনো যাত্রী ছিলোনা৷ যাত্রী ওয়ালা বাসতো আর থামিয়ে রাখেনা ওভাবে। তারমানে নূর ওই বাসে একা শুধু। নূর কোন সিচুয়েশনে আছে তা ভাবতেই আদিত্যর সারা শরীর কাঁপছে। বোধশক্তিহীন হয়ে পড়ছে সে। বিহান পাশ থেকে বলে উঠল,
“আদি, ভাবির কিছু হইবো না। গাড়িতে উঠেছে বেশিক্ষণ হয়নি। মাত্র দশ বারো মিনিট হইছে। আমরা জলদিই ধইরা ফালামু গাড়ি।”
আদিত্য বিধ্বংসী নজরে তাকিয়ে বলল,
“নূরের কিছু না হলেই ওদের জন্য ভালো। নাহলে ওরা পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার জন্যেও পস্তাবে।”
বলেই আদিত্য দ্রুত বেড়িয়ে পড়ল। দুজন আবারও গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। বিহান বলল,
“আমি গাড়ির নাম্বার নোট কইরা নিছি। গ্যাংয়ের লোক গুলারে কইতাছি গাড়ি ধরতে।”
আদিত্য মাথা নেড়ে সায় দিলো। আপাতত মন মস্তিষ্ক প্রচন্ড আতঙ্কে আছে তার। নূরের কিছু হয়ে যাওয়ার ভয় তাকে সহস্রবার মৃত্যু যন্ত্রণা দিচ্ছে। ওর এঞ্জেলটাকে সহিসালামত ফিরে পায় এটাই শুধু ওর একমাত্র চাওয়া। আদিত্য লোকেশন দেখে দেখে গাড়ি ফলো করতে লাগল। ফুল স্পিডে চালিয়ে বাস ধরার চেষ্টা করছে। হঠাৎ বিহান বলল,
“আদি ভাবির লোকেশন এখন এক জায়গায় দেখাইতাছে। তারমানে বাস কোন জায়গায় থামাইছে মনে হয়।”
আদিত্যর হাত পা যেন চলছে না আর। বাস থামিয়েছে তারমানে কি নূরের সাথে খারাপ কিছু হতে চলেছে! না,কিছু হতে দিবেনা সে এঞ্জেলকে। কিছু না। বিহান আবার জানাল,
“আদি ভাবির লোকেশন আবার অন্যদিকে যাইতাচে অহন। মনে হয় হাইটা যাইতাছে কোনোহানে।”
“আচ্ছা কোনদিকে যাচ্ছে সেটা বল।”
বিহান আদিত্যকে লোকেশন জানাতে লাগল আর সেই অনুযায়ী যেতে লাগল আদিত্য। মিনিট বিশেক পর ওরা লোকেশনের অনেকটা কাছে চলে এলো।তখন বিহান ববার জানা,
“ভাবির লোকেশন অহন এক জায়গায়ই দেহাইতাছে। প্রায় কাছাকাছিই আইয়া পড়ছি আমরা। জলদিই পাইয়া যামু ভাবিরে।”
আদিত্য খেয়াল করল লোকেশন অনুযায়ী যেখানে এসেছে জায়গাটা কেমন গাছপালায় ঘেরা জঙ্গলের মতো। আদিত্যর ভয় বাড়ছে এটা ভেবে যে নূর এখানে কি করছে! বাসের ড্রাইভার ওকে এখানে নিয়ে আসেনিতো! আদিত্যর নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে। নূরের সাথে খারাপ কিছু করার চেষ্টাও করলে ওদের কি ভয়ংকর অবস্থা করবে তা আদিত্য নিজেও জানে না। আদিত্য গাড়ি চালিয়ে একদম লোকেশনের কাছে চলে এলো। সামনে একটা টিনের বাসা দেখতে পেল সে। বিহান জানাল,
“ভাবির লোকেশন এইহানেই দেহাইতাছে।”
আদিত্য আর এক মুহুর্তও না দেরি করে গাড়ির দরজা খুলে প্রাণপনে ছুটলো বাসাটার দিকে। দরজায় এসে জোরে জোরে লাত্থি মারতে লাগল আর নূরের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে,
“নূর…..মাই এঞ্জেল! দেখ আমি এসে গেছি। তোমার হিরো এসে গেছে। ভয় নেই আর।”
এক পর্যায়ে দরজা এসে খুলে দিলো কেউ। বৃদ্ধ বয়সী একটা লোক এসে দরজা খুলে দিয়ে বলল,
“কেডা আপনে? এমনে দরজা ভাঙতাছেন কেন?”
আদিত্য ক্রোধে পাগল হয়ে এক হাতে বৃদ্ধ লোকটির গলা চেপে ধরে বলল,
“নূর কোথায়? কি করেছিস তুই ওর সাথে? কোথায় আমার নূর? বল?”
তখনই হঠাৎ বৃদ্ধ লোকটির স্ত্রী দৌড়ে এসে আদিত্যর কাছ থেকে নিজের স্বামীকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“আরে আরে কি করতাছেন? ডাকাত নাকি আপনে? ছাড়েন উনারে।”
কিন্তু আদিত্য ছাড়লোনা। সে উন্মাদের মতো বলতেই লাগল,
“আমার নূর কোথায়? বল কোথায়?”
হঠাৎ পেছন থেকে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে পেছনে ফিরে তাকালো আদিত্য। দেখতে পেল তার প্রাণভোমরাটাকে। নূর দাঁড়িয়ে আছে ভয়ার্ত নজরে তাকিয়ে। হাতের প্লেটটা পড়ে গিয়েই শব্দ হয়েছে। নূরকে দেখে যেন থেমে থাকা হৃৎস্পন্দন এতক্ষণে সচল হলো আদিত্যর। নিষ্প্রাণ দেহে প্রানের সঞ্চালন হলো যেন।ঠোঁটে ফুটল অমূল্য রত্ন পাওয়ার খুশি। আদিত্য এবার লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুত ছুটে গেল নূরের কাছে। দৌড়ে গিয়ে নূরকে দুই হাতে সর্বশক্তি দিয়ে বুকের মাঝে জাপ্টে ধরল। এইটুকু সময়ে কতবার মরেছে আদিত্য তা শুধু সেই জানে। প্রাণটা সত্যিই বুঝি বেড়িয়ে যাচ্ছিল তার। এবার একটু স্বস্তি পাচ্ছে। আদিত্য এতটাই আবেগী হয়ে গেল যে লোকজন কে আছে না আছে তা খেয়াল না করে দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে পাগলের মতো নূরের সারা মুখে সহস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো। তারপর আবারও বুকের মাঝে লিপ্টে নিয়ে ধরা গলায় বলল,
“কোথায় চলে গিয়েছিলি এঞ্জেল? এভাবে বাসা থেকে কেউ বেড়িয়ে যায়! তোর কিছু হয়ে গেলে কি করতাম আমি! জান বেড়িয়ে যাচ্ছিল আমার।”
নূর কেমন যেন চুপসে আছে। কিছু বলছেনা। আদিত্য নূরের মুখে হাত বুলিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে এঞ্জেল? আমাকে বলো? ওরা কিছু করেছে তোমার সাথে?”
পেছন থেকে বৃদ্ধ লোকটি এবার বলে উঠল,
“আপনি কি মাইয়াডার কিছু হন?”
আদিত্য এবার লোকটার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আমি ওর হাসব্যান্ড।”
“ও আচ্ছা, আপনি একটু বাইরে আসেন।”
আদিত্য নূরেে রেখে বাইরে আসলো। বিহানও সেখানে আসলো। বৃদ্ধ লোকটি বাইরে আসতেই আদিত্য চোয়াল শক্ত করে বলল,
“এবার বলুন নূরকে এখানে কেন এনেছেন? কি মতলব আপনার?”
বৃদ্ধ বলল,
“আপনে ভুল বুঝতাছেন। আসলে আমি কামে থাইকা বাড়ি ফেরার সময় বাসে আসি। সিগনালে বাসটা দাঁড়িয়ে ছিল দেইয়া আমি ওই বাসে গিয়া উঠি। আমাকে উঠতে দেইহাই হেল্পার কইল,” বাস নাকি যাইবো না।” আমি তহন এই মাইয়াডারে বইসা থাকা দেখলাম। দেইহা কইলাম,”যাত্রীতো তুলছেনই তাইলে যাইবেন না ক্যা?” হেল্পার তহন রাগ দেহাইয়া কইল, “আরে মিঞা এত প্যাঁচাল পারেন ক্যা! কইলাম যাইবো না মানে যাইবো না। আপনে নামেন তো।” আমার কেমন জানি খটকা লাগল ব্যাপারডা। আমি মাইয়াডারে জিগাইলাম, “তুমি কই যাইবা।” মাইয়াডা কইল,”আমি বাড়ি যাবো। ওরা আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিবে।” আমি জিগাইলাম,”তোমার বাড়ি কই?” মাইয়াডা কইল,”আমার বাড়িতো, বাড়িতে।” আমি বুঝবার পারলাম মাইয়াডা স্বাভাবিক না। আর এই ড্রাইভার আর হেল্পার ওর সরলতার সুযোগ নিয়া ওর সাথে খারাপ কিছু করার চিন্তা ভাবনা করতাছে। তাই আমি কইলাম, “আসো আমি তোমারে বাড়ি পৌঁছাইয়া দিমু।” তহন ড্রাইভার আর হেল্পার ক্ষেপে গিয়ে আমাকে গাড়ি থাইকা নামাই দিবার চাইলো। কিন্তু আমি কইলাম,”দেহেন মাইডারে না ছাড়লে আমি ওই রাস্তায় দাঁড়াইনা পুলিশেরে কিন্তু সব কইয়া দিমু।” ওরা তহন ভয় পাইলো। আমি অনেক বুঝাইয়া মাইয়াডারে আমার লগে মাত্রই এইহানে লইয়া আইলাম। আমার বউ ওরে খাইতে দিছিল মাত্রই।”
সব শুনে আদিত্যর কপালের রগ ফুলে নীল হয়ে উঠল। সে বিহানের দিকে তাকাতেই বিহান বলল,
“চিন্তা করিসনা, আমগো লোক ওই বাস ধইরা ফালাইছে। আমি ওইহানে গিয়া দেখতাছি। তুই বরং ভাবিরে নিয়া বাড়ি যা।”
বলেই বিহান ওখান থেকে চলে গেল দ্রুত। আদিত্য এবার বিনয়ী সুরে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলল,
“আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো আমার জানা নেই। আপনি শুধু নূরকে না৷ আমার জানটাকে বাঁচিয়েছেন৷ আপনার এই ঋন ভোলা অসম্ভব। আমার জীবন দিয়ে দিলেও এর প্রতিদান কম হবে।”
“আরে এগুলা কি কন! ওর মতো আমারও মাইয়া আছে। তাইলে চোখের সামনে এতবড় অন্যায় কেমনে হইতে দিতে পারি!”
“আচ্ছা আমি তাহলে নূরকে নিয়ে যাই এখন।”
“আচ্ছা।”

আদিত্য ভেতরে এসে নূরের হাত ধরে বলল,
“চলো এঞ্জেল, বাড়ি যাই এখন।”
বলেই আদিত্য যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই হঠাৎ নূর ঝটকা মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আদিত্যর বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে নারাজ কন্ঠে বলল,
“নাহ,যাবোনা আমি তোমার সাথে। তুমি পঁচা। পঁচা হিরো। যাবোনা আমি। ”
আদিত্য বিস্মিত হতভম্ব হয়ে গেল নূরের প্রতিক্রিয়ায়। যেন প্রচন্ড বেগে ধাক্কা খেল সে। আদিত্য বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল,
“এঞ্জেল! কি বলছ তুমি! বাড়ি যাবে না কেন? কি হয়েছে তোমার?”
বলতে বলতে আদিত্য আবারও নূরকে ধরতে চাইলে নূর সেখান সরে গিয়ে বৃদ্ধ মহিলাটির পেছবে লুকিয়ে ভয়ার্ত, উত্তেজিত গলায় বলল,
“না না আমার কাছে আসবেনা। তুমি পঁচা। একদম ভালো না৷ আমাকে মেরে ফেলবে তুমি। আমি যাবোনা তোমার সাথে। তুমি যাও চলে এখান থেকে।”
আদিত্য স্তব্ধ হয়ে গেল। কি বলে নূর! আদিত্য ওর এঞ্জেলকে মারবে! ওর এঞ্জেলটা এমন কেন করছে! আদিত্য নূরের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে করুন সুরে বলল,
“কি বলছ এসব এঞ্জেল! আমি কেন তোমাকে মারবো! কি হয়েছে তোমার? এমন কেন করছ? কোনো কিছু নিয়ে আমার উপর রাগ করেছ তুমি? বলনা সোনা কি হয়েছে?”
নূর যেন আরও লুকিয়ে গিয়ে বৃদ্ধ মহিলাটির উদ্দেশ্যে বলল,
“ও ওকে যেতে বলো। ও মেরে ফেলবে আমাকে। ও পঁচা। যেতে বলো ওকে।”
বৃদ্ধ দুজন কিছুই বুঝতে পারছেনা কি করা উচিত তাদের। আদিত্য আবারও নূরকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলল,
“নূর সোনা এমন করে না। বলোনা আমাকে কি হয়েছে! কেউ কিছু বলেছে! প্লিজ আমার কথাটা শোনো।”
বলেই আদিত্য নূরের কাছে যেতে চাইলে নূর আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে গেল। কেমন অস্বাভাবিক ভাবে আশেপাশের জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারতে মারতে বলল,
“কাছে আসবেনা। বললাম না যাবো না! যাও এখান থেকে। সরে যাও। পঁচা তুমি। যাও বলছি।”
ধীরে ধীরে নূরের অবস্থা বেগতিক দেখে আদিত্য ভয় পেয়ে গেল। সে নূরকে ঠিক রাখতে বলে উঠল,
“আচ্ছা আচ্ছা, আমি চলে যাচ্ছি। তুমি শান্ত হও প্লিজ। এইযে আমি চলে যাচ্ছি।”
বলেই আদিত্য দ্রুত বাইরে বেড়িয়ে এলো। বৃদ্ধটিকে চোখের ইশারায় ডাক দিয়ে এনে অনুরোধের সুরে বলল,
“ওর খেয়াল রাখুন প্লিজ। ওকে শান্ত করুন। নাহলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
“আইচ্ছা আপনে চিন্তা কইরেন না। আমরা দেখাতাছি।”

আদিত্য বাইরে এসে কেমন বিধ্বস্তের মতো হয়ে গেল। হৃদয়টা ব্যাথায় জর্জরিত হচ্ছে তার। তার এঞ্জেলটা আজ তাকে দুশমন ভাবছে। তাকে পঁচা বলছে। ওর কাছে আসতে চাইছে না। এই যন্ত্রণার তীব্রতা আদিত্য কিভাবে বহন করবে! গাড়ির কাছে এসে জানালার কাঁচে এসে সজোরে ঘুষি মেরে দিলো সে। তার নূর এভাবে পর কিভাবে হয়ে গেল! আদিত্যর প্রতি এসব ধারণাই বা কিভাবে হলো! সব যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নূর যদি আর কোনদিন ওর কাছে না আসে তাহলে কি করবে ও! কিভাবে বাঁচবে ওকে ছাড়া। না, না নূরকে ও দূর হতে দিবেনা। কিছুতেই না। যতই সরিয়ে দিক তবুও আদিত্য ওর এঞ্জেলকে সরে যেতে দিবেনা। কিছুতেই না।

আদিত্য ওভাবেই গাড়ির সাথে পিঠ ঠেকিয়ে নিচে বসে রইল। ধীরে ধীরে সময় গড়িয়ে রাত নামল। তাও আদিত্য ওভাবেই বসে রইল। এরমাঝে বৃদ্ধ লোকটি অনেকবার ডাকল তাকে ভেতরে। কিন্তু আদিত্য গেলনা। নূর হাইপার হয়ে যেতে পারে সেই ভয়ে গেলনা। ওখানেই ওভাবে বসে রইল। ধীরে ধীরে রাত ভার হলো। একসময় মেঘ ঘনিয়ে আকাশ চিঁড়ে বৃষ্টি নামল। আদিত্য তাও বৃষ্টির মাঝে ওভাবেই বসে রইল। গাড়ির ভেতরও গেলনা। যেখানে ওর জানটাই ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তখন এই আরাম আয়েস ওর কাছে কোনো কাজেরই না। আদিত্য বৃষ্টির মাঝেই বসে রইল। বৃদ্ধ দম্পতির আদিত্যর জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে। তারা বুঝতে পারছে ছেলেটা কত ভালোবাসে নূরকে। তবে খারাপ শুধু ওদের লাগছে না। খোদ নূরেরও কষ্ট হচ্ছে। জানালা দিয়ে সে দেখতে পাচ্ছে তার হিরো কিভাবে বৃষ্টির মাঝে বসে কষ্ট পাচ্ছে। তারও কষ্ট হচ্ছে হিরোর জন্য। কিন্তু ঝুমুরের বলা কথাগুলোও যেন ভুলতে পারছেনা। অবুঝ নূর দ্বিধায় ভুগছে। তখনই বৃদ্ধ মহিলাটি নূরের পাশে এসে বসল। নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে নরম সুরে বলল,
“কষ্ট হইতাছে তারে এমনে দেইখা?”
নূর মলিন মুখে মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বুঝাল। বৃদ্ধ মহিলা তখন মুচকি হেঁসে বলল,
“তাইলে যাইতাছ না কেন হ্যার কাছে?”
নূর বাচ্চাদের মতো করে মুখ মলিন করে বলল,
“কিন্তু ঝুমুতো বলল হিরো পঁচা। আমাকে মেরে ফেলবে।”
“শোনো,কে কি বলল সেটা দেখার আগে তোমার মন কি কয় সেইটা মানবা। তোমার মন কি কয়? তোমার কি মনে হয় তোমার হিরো এমন করবার পারে?”
নূর মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে বলল,
“না, আমারতো মনে হয় হিরো আমাকে অনেক ভালোবাসে।”
“ঠিকই মনে হয় তোমার। এইযে দেখ তোমার জন্য কখন থাইকা ওইভাবে বৃষ্টিতে বইসা আছে! এত কষ্ট কইরা কেন আছে! তোমার লাইগাইতো বইসা আছে। আমিতো হলফ কইরা কইতে পারি ওই পোলা তোমারে মেলা ভালোবাসে। কহনো তোমার ক্ষতি হইবার দিবোনা৷ তাই কে কি কইল সেই কথা মাইনো না৷মনে রাখবা অনেক সময় নিজের মানুষই তোমারে ভুল বোঝাইবো।কারণ তোমার খুশি চায়না হ্যারা। তাই তুমি তাগো কথা শুইনো না। তুমি তোমার মনের কথা শোনো। তোমার হিরোর কাছে যাইতে মন চাইতাছে?”
নূর কাঁদো কাঁদো মুখ করে মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বুঝাল। বৃদ্ধ মহিলা ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,
“তাইলে যাও।”
মহিলাটির বলতে দেরি নূরের ছুট দিতে দেরি হলোনা। নূর দৌড়ে ছুটে গেল বাইরে।

আদিত্য মাথা আকাশের দিকে করে চোখ বুজে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। নূর দৌড়ে সেখানে এসে করুন কাঁদো কাঁদো সুরে ডাক দিলো,
“হিরোওওও….”
ঠাস করে চোখ খুলে তাকালো আদিত্য। নূরকে দেখে হকচকিয়ে ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে। চিন্তিত স্বরে বলল,
“এঞ্জেল! তুমি বৃষ্টির মাঝে বাইরে এসেছ কেন! ঠান্ডা লেগে যাবেতো।”
নূর কিছু না বলে ঝট করে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরলো। কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
“হিরোওওওওও….তুমি পঁচা না। নূর পঁচা। নূর পঁচা মেয়ে।”
আদিত্যর মন জুড়ে এবার সুখময় শীতল বর্ষণ হলো। সে নিজেও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে তার জানপাখিটাকে। আদিত্য দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে সারা মুখে চুমু খেয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“উহুম, আমার নূরসোনা একদম পঁচা না৷ সেতো আমার এঞ্জেল। আমার জান৷”
নূরের কপালে আরও একটা চুমু এঁকে দিয়ে নূরকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো। তারপর গাড়ির দরজা খুলে নূরকে কোলে নিয়েই ড্রাইভিং সিটে বসল। নূরও আদিত্যর গলা জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিশে রইল। নূরকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো আদিত্য।
তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ দম্পতি মুচকি হাসলো। ভালোবাসা আসলেই সুন্দর। সত্যিকারের ভালোবাসা গুলো ভালো থাকুক আজীবন।

চলবে…………