মরুর বুকে বৃষ্টি ২ পর্ব-৩৬+৩৭

0
365

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-৩৬
®মেহরুমা নূর

★আদিত্য মহা বিরক্ত। যাকে বলে একেবারে অসহ্য পরিমাণের বিরক্ত। গলা পর্যন্ত বিরক্তিতে ভরে গেছে তার। বিরক্তির কারণ তার বন্ধু নামের শত্রুগুলো। সে ভেবে পায়না এগুলো আদৌও তার বন্ধু নাকি জাতশত্রু। একেকটা মিশা সওদাগরের চেয়ে বড়ো লেভেলের ভিলেন। এমন বন্ধু থাকলে আর শত্রুর কি দরকার! আজ এদের জন্য বউটাকে কাছে পাচ্ছে না সে। নূরকে নিয়ে আসার পরেই সে হিয়ার বাচ্চা হওয়ার কথা শুনে সেখানে চলে যায়। কারণ হিয়ার কাছে একজন মেয়ে মানুষের থাকার খুব দরকার হচ্ছিল।বাচ্চাকেও সামলাতে হয় আবার হিয়াকেও দেখতে হয়। বিহান একা সবটা বুঝতে পারছিল না। তাই নূর আসার পর গত দু-রাত হসপিটালে হিয়ার কাছেই ছিলো সে। আজ বাচ্চাসহ হিয়াকে বাসায় আনা হয়েছে। আদিত্য ভেবেছিল এবার হয়তো সে তার একটু শান্তিমতো কাছে পাবে। কতদিন তার থেকে দূরে ছিলো। একটু মনমতো তাকে কাছে বসিয়ে দেখবে সে। বুকের মাঝে আগলে নিয়ে মন জুড়াবে। আদরে ভরিয়ে দিবে তার এঞ্জেলটাকে। কিন্তু না, তা আর হতে দিলোনা ওই বদগুলো। বাসায় আসতেই তারা নতুন সঙ আরম্ভ করে দিয়েছে। এখন নাকি তারা আদিত্য,নূরের নতুন করে বিয়ে দিবে। একেবারে নতুন করে শুরু থেকে সব অনুষ্ঠান করে নাকি ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন হবে। কারণ হিসেবে তারা বলে আগের বিয়ের কোনো ভ্যালিড নাই। কারণ নূর তখন অবুঝ ছিলো। তাই নতুন করে সব হবে। আদিত্যর সমস্যা এসবে না। তারও সম্মতি আছে এসবে। শুধু একবার কেন, সে’তো তার নূরকে হাজার বার বললেও বিয়ে করতে রাজি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওদের করা আইনে। যে আইন অনুযায়ী বিয়ের আগপর্যন্ত আদিত্য আর নূরকে আলাদা আলাদা থাকতে হবে। শুধু তাই নয়। তাদের একজন আরেকজনকে দেখাও যাবে না। মানে এটা কোনো কথা হলো! আদিত্য এর বিপরীতে ঘোর বিপত্তি জানালো। সে বলল এটা সে কিছুতেই মানবে না। দূরে দূরে থাকার কনসেপ্ট একদমই অবমাননীয় তার কাছে। কিন্তু তার মানা মানার ধার ধারলোনা কেউ। বরং উল্টো হুশিয়ারী দিয়ে দিলো, কথা না মানলে দরকার হলে নূরকে তার যেকোনো মায়ের বাড়িতে রেখে আসা হবে। তারপর সেখান থেকেই বিয়ে হবে। তা শুনে আদিত্য আৎকে ওঠে। এটাতো আরও ভয়াবহ ব্যাপার। বেচারা পড়ে যায় গেরাকলে। একদিকে নদী তো একদিকে কুয়া। সে বাঁচার জন্য শেষ অবলম্বন স্বরূপ নূরের দিকে সাহায্যের আশায় তাকালো। কিন্তু সেখানেও ধোঁকা খেল বেচারা। নূরও যেন তাদের দলে সামিল হয়ে আদিত্যকে পর করে দিলো। কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলো। রাগ আর বিরক্তিতে আদিত্য আর না পেরে কপট রাগ দেখিয়ে উঠে এলো আলোচনা থেকে। তখন থেকেই এভাবে বিরক্তি নিয়ে বসে আছে সে। নূর একবারও এলোনা তাকে দেখতে। সেজন্য আরও রাগ হচ্ছে তার। মেয়েটার কি কোনো মায়াদয়া নেই! কোথয় এতদিন পর কাছে পেয়ে তাকে একটু আদর সোহাগ করবে। তা না ওই বর্বরদের ষড়যন্ত্রে সামিল হয়ে গেছে! দেখে নিবে সবগুলোকে।

অন্যদিকে নূরেরও যে খারাপ লাগছেনা তা না। কিন্তু সবার সামনে দ্বিধায় কিছু বলতে পারছেনা সে। নতুন করে বিয়ের ব্যাপারটাতে সে’ও খুশি। প্রথমবারতো সে তখন অবুঝ ছিলো। কিভাবে সব হয়েছে নিজেও জানে না। বিবাহের সেই পবিত্র মুহূর্ত টা পুরো সজ্ঞানে অনুভব করতে তারও খুব করে ইচ্ছে। কিন্তু এভাবে আদিত্যর কাছ থেকে দূরে থাকাটা তারও ভালো লাগছে না। এতকিছুর পর আদিত্যকে কাছে পেল সে। তার সাথে একান্ত সময় কাটানোর ইচ্ছে নূরেরও কম নেই। কিন্তু কি করবে! সবার সামনে কি আর বলতে পারে সে! লজ্জা যে গলা টিপে ধরে তার। আর ওরাও কি ভাববে! ওরাতো অনেক উৎসাহ নিয়ে এই বিয়ের আয়োজন করেছে। তখনতো আবার রাগ করতে পারে ওরা৷ তাইতো নূর চেয়েও বলতে পারেনি কিছু। কিন্তু আদিত্যর রেগে চলে যাওয়াটাও ভালো লাগছেনা নূরের।সই কখন থেকে রুমে ঢুকেছে আর বেরই হচ্ছে না। মন আনচান করছে নূরের একটিবার তাকে দেখার জন্য। লোকটার এভাবে রাগ হয়ে থাকাটা সহ্য হচ্ছে না তার। কতবার উঁকি ঝুঁকি দিয়েছে নূর। কিন্তু সে পুরুষের দেখা কই! তার কাছে যেতেওতো পারছেনা। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত নূরকে নিচে হিয়ার রুমে থাকতে বলা হয়েছে। এমনিতেও হিয়া বাচ্চা নিয়ে একা পেরে ওঠে না।নূর থাকলে একটু সাহায্যও হবে। আর ওদের দূরে থাকাটাও হবে।বিহান ততদিন অন্য রুমে থাকবে। তাই নূর এখন নিচের রুমে অবস্থান করছে। কয়েকবার সিঁড়ির কাছে গিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিয়েছে আদিত্যের রুমে। তবে কেউ না কেউ সামনে পড়ায় আর এগুতে পারছেনা সে। সবগুলো নজর গেড়ে রেখেছে তাদের উপর। যেন কোনো চোর তারা। নূরের ফোনটাও নিয়ে নেওয়া হয়েছে। এমনকি রাতের খাবারটাও নূর আর আদিত্যকে যার যার রুমে গিয়ে দিয়ে আসা হলো। নূরের মুখে খাবার উঠবে কিভাবে! সে’তো জানে আদিত্য রেগে না খেয়েই আছে নিশ্চয়। তাহলে নূর কিভাবে খাবে! হিয়া জোরাজোরি করলে নূর বলল তার কেমন এসিডিটি হচ্ছে তাই খাবে না। হিয়াও শেষমেশ হার মেনে আর কিছু বলল না।

মলিন মনেই হিয়ার রুমে রাতে থেকে গেল নূর। মনটা পড়ে রইলো ওই রুষ্ট পুরুষের আঙ্গিনায়। রাতে হিয়ার বাবুটা কেঁদে ওঠে। হিয়া অনেক চেষ্টা করেও থামাতে পারছেনা। নূরও কিছুক্ষণ নিয়ে হাঁটল। কিন্তু থামছেনা কিছুতেই। নূর তখন বলল,
“বাবুর বোধহয় পেট ব্যাথা করছে।পেটে একটু কুসুম গরম ভাপ দিলে হয়তো ভালো লাগবে। আমি নিয়ে আসছি এখুনি।”
হিয়া বাচ্চাকে কোলে দোলাতে দোলাতে বলল,
“আচ্ছা ভাবি আনুন।”
নূর রান্নাঘরে গিয়ে জলদি একটু গরম পানি করে আনলো। তারপর একটা কাপড়ে হালকা ভাপ নিয়ে বাচ্চার পেট আর মাজা ছেঁকে দিলো। এবং কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে বাবু শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেল। হিয়া কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলল,
“থ্যাংক ইউ ভাবি। আপনি না থাকলে বাবুকে শান্তই করতে পারতাম না আমি। সত্যি আপনি অনেক ভালো একজন মা হবেন৷”
লজ্জাভাব প্রকাশ পেল নূরের মুখয়বে। পানির পাত্র রাখতে আবারও রান্নাঘরের দিকে এগুলো সে। রান্নাঘরের বেসিনে গরম পানিটুকু ঢেলে পাত্রটা রেখে হাত ধুতে লাগল বেসিনের পানিতে। ঠিক তখনই আচমকা একটা হাত পেছন থেকে এসে চেপে ধরল তার মুখ। অন্য আরেকটা হাত বেসিনের ট্যাপ বন্ধ করে দিয়ে সেই হাতেই নূরের দুই হাতসহ পেট পেঁচিয়ে ধরল শক্ত করে। নূর কোনোকিছু বুঝে উঠার আগেই আগুন্তক তাকে পেঁচিয়ে ধরে নিয়ে যেতে লাগল বাইরের দিকে। নূর আৎকে উঠেছে। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য নড়াচড়া করতে গিয়েও এই শক্ত বাঁধনের জোরে পেরে উঠছে না সে। ভয়ে অন্তর কাঁপছে তার।ভয়ের তোড়ে সে অনুভব করতে পারছেনা আসলে ব্যক্তিটা কে। তার ছটফটানির মাঝেই ব্যক্তিটি তাকে বাইরে পুলের কাছে নিয়ে এলো। সুইমিং পুলের পাশে এনে থামল সে। নূর ছাড়া পাওয়ার চেষ্টায় তখনও তোড়জোড় চালাচ্ছে। হঠাৎ তখনই কানের কাছে উষ্ণ কন্ঠস্বর পেল,
“আমাকে আগুনে পুড়িয়ে খুব আরামে আছো তাইনা! এরচেয়ে ভালো এই পানিতে ডুবিয়েই মেরে ফেলো।”
থমকিত হলো নূর। স্থির হলো সকল ছটফটানি তার। শান্ত হলো আতঙ্কিত হৃদপিণ্ডটা। বুঝতে পারল এটা তারই আপন পুরুষটা। আদিত্যর বাঁধন ঢিলা হলো। হাত সরিয়ে নিলো নূরের মুখের উপর থেকে। ধীরে ধীরে ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনে তাকালো নূর।কাঁধের পাশেই রুষ্ট মানবের তপ্ত নজরে নজর গাঁথল তার। চোখ পিটপিট করে কন্ঠ খাদে নামিয়ে হালকা বিস্ময় ভরা সুরে বলল,
“তুমি! এভাবে কেউ আনে! জানো কতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি!”
আদিত্য চোয়াল শক্ত করে বলল,
“তো কি করতাম! তুমিতো আরামে গিয়ে শুয়ে পড়েছ। আমার চিন্তা কই তোমার! এভাবে না আনলেতো আর জনাবা আর আসতেন না। তোমার কি আর এত টান আছে!”
বলেই নূরকে ছেড়ে উল্টো দিকে চলে যেতে নিলো আদিত্য। তবে তার আগেই নূর এক হাত ধরে ফেলল আদিত্যর। আটকাতে চাইলো তাকে। কিন্তু রুষ্ট আদিত্য সেদিকে না তাকিয়ে উল্টো দিকেই ফিরে থেকে নিজের হাত ছাড়াতে চাইলো নূরের হাত থেকে। ছাড়লোনা নূর। সে দুই হাতে শক্ত করে ধরল আদিত্যর হাতটাকে। করুন সুরে বলল,
“রেগে আছো?”
আদিত্য ফিরে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“নাতো,আমিতো খুশিতে নাচছি! আমার বউ ওদের ষড়যন্ত্রে সামিল হয়ে গেল তাতে খুশিতে বুক ফুলে গেছে আমার।”
“আরে এভাবে বলছ কেন? আমার কি দোষ!”
“হ্যাঁ, কি দোষ তোমার! সবার সামনে একটা কথা বললে না এ আর এমন কি দোষ! আসলে তোমার কোনোকিছু যায় আসে না। তাইতো কিছু বললে না। একবার আমার কাছে আসার চেষ্টাও করলে না। আমিই পাগল যে মরে যাচ্ছি তোমাকে দেখার জন্য। তোমারতো কোনো আগ্রহ নেই। ঠিক আছে যাও তাহলে।”
রাগ দেখিয়ে চলে যাওয়ার জন্য হাত ছাড়াতে চাইলো আদিত্য। নূর তখন কাঁদো কাঁদো গলায় করুন সুরে বলল,
“প্লিজ এভাবে বলো না!আমিও তোমাকে দেখার জন্য কখন থেকে উতলা হয়ে আছি। অনেক চেষ্টা করেও পারিনি যেতে। আমি কি করতাম! সবার সামনে কিভাবে বলি আমি! ওরা কি ভাববে কতটা নির্লজ্জ আমি! আর তাছাড়া ওরা কতটা উৎসাহ নিয়ে আমাদের জন্য এতকিছুর আয়োজন করছে। এখন আমরা মানা করলে ওদের মন ভেঙে যাবে না! শুধু কয়েকটা দিনেরইতো ব্যাপার। এটাকে আমাদের জীবনের নতুন একটা অনুভব মনে করো। বিয়ের আগের যে সময়টার অনুভূতি সেটাও হবে। প্লিজ রাগ করোনা।”
আদিত্য এবার একটু নরম হলো। সে এগিয়ে এসে দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে কপালে কপালে ঠেকিয়ে আবেগী স্বরে বলল,
“এতকিছু আমি জানি না। আমার শুধু তোমাকে চাই তাই জানি। খুব করে চাই। সর্বক্ষণ চাই। এতদিন পর তোমাকে কাছে পেয়েছি আমি। নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে চাই তোমাকে। তৃষ্ণার্ত হৃদয় জুড়াতে চাই তোমার সান্নিধ্যে। চোখের সীমানা জুড়ে তোমার বিচরণ চাই।নিঃশ্বাসে মাখিয়ে নিতে চাই তোমার সুবাস। চোখের পলক সমান দূরত্বও সহ্য হচ্ছে না আমার।”
আদিত্যর বিমোহিত কথনে দ্রবীভূত নূরের ভেতর বাহির। সে’ও বিপরীতে দুই হাত রাখলো আদিত্যর গালে। মায়াময় সুরে বলল,
“আমিতো তোমারই। সবটাই তোমার। তোমাতেইতো আমার নির্বাসন। শুধু কয়েকটা দিনেরইতো দূরত্ব। তারপর শুধু তোমার চোখের তারায় আমার বসবাস হবে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। তবে আজকের রাত তুমি আমার কাছেই থাকবে। আজ তোমাকে দূরে যেতে দিবোনা আমি।”
“কিন্তু….
কথা শেষ করার আগেই নূরের ঠোঁটের উপর আদিত্য তর্জনী আঙুল ঠেকিয়ে বলল,
” হুঁশশ! এরপর আর কোনো কথা না। যা বললাম তাই হবে। এখন আগে বলো খেয়েছ? খবরদার মিথ্যে বলবেনা।”
নূর মাথা নুইয়ে দুই দিকে নাড়িয়ে বুঝালো সে খাইনি। আদিত্য বলল,
“জানতাম, না খেয়েই পড়ে আছ।”
“যেন তুৃমি বড়ো খেয়ে বসে আছো! জানি তুমিও খাওনি। রাগে ফুলে যে আছো। আর তুমি না খেলে আমি কি করে খাবো!”
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমারও অনেক ক্ষুধা লেগেছে। চলো দুজন একসাথে খাই।”
“আচ্ছা তুমি বোসো। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
বলেই নূর বাসার দিকে পা বাড়াতে নিলেই আদিত্য তার হাত ধরে টান মেরে নিজের সাথে মিশিয়ে বলল,
“কোথাও যেতে হবে না তোমার। আমি সব ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছি। দূরে যাওয়ার কোনো স্কোপ নেই আজ তোমার।”
বলেই আদিত্য দুই হাতে পাঁজা কোলে তুলে নিলো নূরকে। নূর শুধু তার লাজে রাঙা মুখ লুকাতে ব্যস্ত। আদিত্য নূরকে নিয়ে পুলের অন্য সাইডে এলো। সেখানে আদিত্য আগে থেকেই বসার জন্য চাদর বিছিয়ে রেখেছিলো। চাদরের উপর খাবারের টিফিনবাক্স রাখা আছে। সাথে প্রয়োজনীয় প্লেট গ্লাসও আছে। নূর সেসব দেখে একটু অবাকই হলো। তারমানে জনাব আগে থেকেই এসব প্ল্যান করে রেখেছে। আদিত্য নূরকে কোলে নিয়েই চাদরের উপর বসলো। নূরে কোল থেকে নেমে সরে বসতে চাইলে আদিত্য আরও চেপে ধরে বলল,
“কি হলো এতো লাফালাফি করছ কেন?”
“আরে খাবার না খাবে। না নামলে কিভাবে খাবে?”
“হ্যাঁ তো খাবার খাওয়া আর নামার সাথে কি সম্পর্ক। যা করবে এখানে বসেই করবে। নো নামানামি।”
অগত্যা নূর আদিত্যর কোলে বসেই বক্স থেকে খাবার প্লেটে বাড়ল। তারপর হাতে লোকমা নিয়ে এগিয়ে ধরল আদিত্যর মুখের সামনে। লোকমাসহ পুরো পুরো আঙুল গুলোই মুখের ভেতর পুরে নিলো আদিত্য। পরবর্তীতে তা বের করতে নিলে আঙুলগুলো চুষে নিলো সে। মুখে লেপ্টে আছে দুষ্টু চাহুনিপূর্ণ হাসি। নূরের মুখে লাজের রঙ। আদিত্য হাত ধুয়ে প্লেট থেকে খাবার নিয়ে সে’ও নূরকে খাইয়ে দিলো। এভাবেই খাবার শেষ হলো তাদের। আদিত্য তার এটো মুখ টিস্যু দিয়ে মুছে দিতে বলল নূরকে। তাই করল নূর। আদিত্যর মুখ মোছা হলে এবার নূর নিজের মুখ মুছতে গেলে বাঁধা দিলো আদিত্য। বলল,
“উহুুম, আমি মুছে দিবো।”
নূর তার হাতের টিস্যুটা আদিত্যর দিকে এগিয়ে দিলো মুছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আদিত্য তা নিলো না। নূরের টিস্যু এগিয়ে দেওয়া হাতটা ধরে আস্তে করে নামিয়ে দিলো নিচে। নূর বুঝতে না পেরে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো আদিত্যর মুখপানে।আদিত্যর চাহুনি যেন অন্য কিছু বলছে। তার একাগ্র তীক্ষ্ণ নজর শুধু নূরের অধর পানে। ওই নজরে নেশার পারদ। নূর বিমূঢ় হচ্ছে। এই চাহুনির অর্থ বুঝতে পেরে ঝংকারিত হচ্ছে তার হৃদকম্পন। আদিত্য মাথা ঝুকালো আরও। অগ্রসর হলো কম্পিত ওই পই অধর পানে। মিলিত করল অধর যুগল দ্বয়। কোমল স্পর্শের আলোড়নে সৃষ্টি করল অব্যক্ত মধুর অনুভূতির বর্ষণ। এক হাত নূরের চুলের মাঝে, অন্য হাতের বিচরণ চলছে কোমড়ে। এহেন প্রক্রিয়ায় নূর বেসামাল। শক্তিহীন হচ্ছে তার সকল ইন্দ্রীয়।শিহরণে পা গুটিয়ে আরও দলা হয়ে গেল। নিজেকে সামলাতে দুই হাতে আঁকড়ে ধরল আদিত্যর কাঁধের টিশার্টের অংশ। আদিত্যর স্পর্শ গভীরতর হচ্ছে। থরথর কম্পনে জ্ঞান হারাবে বুঝি নূর। নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে। নূর যে আর পারছেনা। আদিত্য তাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে! আদিত্য থামছে না। আরও নিবিড় থেকে নিবিড় হচ্ছে তার আলিঙ্গন। একপর্যায়ে নূরও নিজেকে আটকাতে পারলোনা৷ আদিত্যর ক্রিয়ায় তাল মিলালো নিজেও। একপাক্ষিক ক্রিয়া এবার দ্বিপাক্ষিক ভাবে সংঘটিত হলো। আদিত্যর হাতের বিচরণও আরও অবাধ্য হচ্ছে। এই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া চলতে চলতে একপর্যায়ে নূরের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো যেন। আদিত্য ইতি ঘটালো তখন। অধর যুগল আলাদা করল। কপালে কপাল ঠেকিয়ে হাপাতে লাগল দুজন। খানিক পর ধাতস্থ হয়ে আদিত্য নেশালো কন্ঠে বলল,
“অনেক কষ্টে নিজেকে আটকালাম এঞ্জেল। আমি আমাদের সেই মধুর সময় অনেক স্পেশাল করতে চাই। এভাবে না। তাই আজকের জন্য রেহাই দিলাম তোমাকে।”
নূর দ্রুত ঝট করে মুখ লুকালো আদিত্যর বুকের মাঝে। লাজুক হাসি তার মুখে। আদিত্য শব্দ করে হেঁসে নূরকে জড়িয়ে নিলো বুকের মাঝে। দুষ্টু সুরে বলল,
“আজকেতো বেঁচে গেলা। তবে নিজেকে তৈরি করো সোনাপাখি। খুব জলদিই ধ্বংসযজ্ঞ সইতে হবে তোমাকে।”
নূর আদিত্যর বুকে কিল মেরে লাজুক সুরে বলল,
“অসভ্য!”
শরীর কাঁপিয়ে হাসলো আদিত্য।

চলবে…….

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-৩৭
®মেহরুমা নূর

★”ছি ছি ছি! এটা কি দেখলাম! এটা দেখার আগে আমার চোখে মাশকারা পড়ল না কেন! ছেলে মেয়ে বংশের নাম বাথটাবে ডুবিয়ে দিলো একেবারে! তাও সাবান ছাড়া। হায় হায় একি হয়ে গেল! এইদিন দেখার আগে এই বিহাইন্যার পাছায় ফোঁড়া হয়ে গেলনা কেন! এখন সমাজে বডি দেখাবো কিভাবে আমি!”
বিহান পাশ থেকে ঘাড় বাঁকিয়ে আবিরের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“তুই ছমাজে বডি দেখাইয়া বেড়াছ? ছমাজে মুখ কেমনে দেখামু এইডা না কবি!”
আবির মুখ চোখা করে বিরক্তির সুরে বলল,
“মুখ দেখায় তোদের মতো আবালরা। আবিরের এই হট বডিটা থাকতে মুখ কোন দুঃখে দেখাতে যাবো! এত খাটুনি করে বডি বানাইছি কি পাথর ঘাটায় খোয়া ভাঙার জন্য! তুই অফ যাতো। এখানে পোলা মাইয়া চুরি করে দেখা করে বংশের এলইডি লাইট নিভিয়ে দিচ্ছে আর তুই পড়ে আছিস শরীরের অঙ্গ প্রত্যাঙ্গ নিয়ে!”
“হ কথাতো এক্কেরে হাঁচাই কইছচ! আদি এইডা এক্কেরে ঠিক করে নাইক্কা। আমগো কথা অমান্য কইরা এমতে চুরি কইরা দেখা করবার আইছা দিলে চোট দিছচ!”
নূর বোধহয় আজকের মতো লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে জীবনেও পড়েনি। লজ্জায় মাটি খুঁড়ে ঢুকে যেতে পারলে বাঁচে সে। রাতে আদিত্যর সাথে এখানেই ঘুমিয়ে পড়ে নূর। আদিত্য তাকে জড়িয়ে নিয়ে গাছের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে যায়। ওভাবেই সকাল পর্যন্তও থাকে তারা। ঘুম ভাঙে ওদের হৈচৈ-এ। যখন চোখ খোলে তখন মুখের উপর ঝুঁকে থাকা কয়েক জোড়া চোখ ফুটবল আকার করে গেড়ে ছিলো ওদের উপর। হকচকিয়ে উঠে সোজা হয়ে বসে নূর। আর তখন থেকেই আবিরের মহান উক্তিগুলো শুরু হয়। লজ্জায় মরি মরি হয়ে যায় নূর। না পারছে এখানে বসে থাকতে, না পারছে কারোর দিকে তাকাতে। কিন্তু বিপরীতে আদিত্য একেবারেই ভাবলেশহীন। বরং তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে চরম বিরক্ত এদের উপস্থিতিতে। পারলে তাদের এই মুহুর্তে বিরক্ত করার অপরাধে এই সবগুলোকে নাম না জানা কোনো গ্রহে ছুঁড়ে মারে। নাহয় মিসাইল দিয়ে ব্লাস্ট করে দেয় সবগুলোকে। সকাল সকালই এই সি গ্রেড ফিল্মের থার্ড গ্রেড ভিলেন গুলোকে মেজাজটাই চিড়চিড়ে হয়ে এলো। আবিরের বিলাপ তখনও চলছে। হায় হায় করেই যাচ্ছে সে।গ্রামের মহিলাদের মতো মাটিতে হাত আছড়ে চুরি ভাঙাটাই বাদ আছে শুধু। এক পর্যায়ে ঠাস করে উঠে দাঁড়াল আদিত্য। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে চোখ মুখ শক্ত করে এগিয়ে আসতে লাগলো আবিরের দিকে। অবস্থা বিপরীতমুখী হতে দেখে আবিরের প্রতিক্রিয়া তৎক্ষনাৎ পরিবর্তন হতে সময় লাগলো না। সে ভীতিগ্রস্ত পর্যায়ে ধীরে ধীরে পেছাতে লাগল। আদিত্য তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
“কি হলো পিছাচ্ছিস কেন? কি বলছিলি সামনে দাঁড়িয়ে ভালো করে বল! ওখান থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম না।”
আবির ফিচেল হেঁসে বলল,
“আরে আমি আবার কি বলছিলাম! আমিতো মাছুম ভোলাভালা। বেচারা এখনো পর্যন্ত তার এই দুনিয়ায় পয়দা হওয়ার কারণটাই জানতে পারলোনা। আর তুই বলছিস তোকে কিছু বলবো! এত দুঃসাহস এই অধমের!”
আবিরে পেছাতে পেছাতে বিহানের কাছে এসে দাঁড়াল। ফট করে বিহানের হাত ধরে তাকে আদিত্যর সামনে এগিয়ে দিয়ে নিজে বিহানের পেছনে দাঁড়িয়ে বলে উঠল,
“আরে সবতো এই বিহাইন্যা বলছিলো। আমি কিছু বলিনি সত্যি বলছি। তোর চুলের কসম। তুই আমার ফুসফুসের বন্ধু। তোরে কিছু বলার আগে আমার জিহ্বা না ছিড়ে পড়ে! সত্যি বলছি এই বিহান তোকে একটুও দেখতে পারে না। খালি তোর বদনাম করে।”
বিহান ধড়ফড়ানো কন্ঠে বলল,
“ওই হালা কি কছ এল্লা! আমি কহন কি কইলাম! নিজে পাদ মাইরা আমার নাম দিতাছচ! দুমুখো হালা! আমারে বলির পাঠা বানাই দিতাছচ! আমার পোলাডারে বাপ ছাড়া করতে চাছ!”
আদিত্য চোয়াল চিবিয়ে বলল,
“মনে হচ্ছে তোদের দুজনের উপর অনেক দিন মার না পড়ে পড়ে জং ধরে গেছে। আজ বোধহয় জং ছাড়াতেই হবে।”
আবির বিহানের পিছন থেকেই মিছে সাহস দেখানোর ভঙ্গিতে বলল,
“দে….দেখ আদি,এটা কিন্তু একদম ঠিক করছিস না তুই। এটা কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে। পুরাই অস্প্রদায়িক কর্মকান্ড সংঘটিত হচ্ছে। একেতো নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিরোধী পক্ষের সাথে গোপন মিটিং হচ্ছে। হাত মেলানো হয়েছে। শুধু হাত মেলানো না, আরও অনেক অঙ্গ প্রত্যাঙ্গ মেলানো হচ্ছে! ছি ছি ছি! আমারতো মুখে বলতেও শরমে লেমন জুস,লেমন জুস হয়ে যাচ্ছি। আর তুই উল্টো আমাদেরই হুমকি দিচ্ছিস! এটাতো পুরাই মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে! আমরা এর বিরুদ্ধে নিন্দা আর ঘোর আপত্তি জানাচ্ছি! কিরে বিহান ক!”
বিহানও সহমত পোষণ করে বলল,
“হ হ হাঁচাই কইছচ! আদি তুই এইডা ঠিক করতাছচ না। দিলে চোট পাইলাম!”
আদিত্য হালকা ঘাড় বাঁকিয়ে চোখ বুজলো খানিকের জন্য। হাতে কাঁধ ঘষলো খনিক। তারপর আচমকা চোখ খুলেই আবির,বিহানদের দিকে আক্রমণাত্মক হলো সে। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা টোলা টোপলা তুলে ভোঁ দৌড় লাগালো। পড়িমরি করে একজন আরেকজনের উপর দিয়েই পাড়িয়ে, মারিয়ে দৌড়ে নিজেদের জান বাঁচাতে ব্যাস্ত। আদিত্যও তাদের ধরার জন্য ছুটছে আর বলছে,
“দাঁড়া হারামির দল, পালাচ্ছিস কেন? তোদের মানবাধিকার ভরপুর করে দিচ্ছি আয়।”
সুইমিং পুলের চারিদিকে চারিদিকে সবগুলো দৌড়াচ্ছে। ওদের কান্ড দেখে হিয়া হেঁসে কুটিকুটি। নূরও মুখ লুকিয়ে লাজুক হাসছে।
___

যেহেতু আদিত্য-নূরের বিয়েটা নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে সব অনুষ্ঠান করতে চায় সবাই। তাই আজ প্রথমে মেয়ে দেখার প্রোগ্রাম করা হয়েছে। যদিও এই মেয়ে দেখার কনসেপ্ট আদিত্যর কাছে হাস্যকর লাগছে ভীষণ। নিজের বউকে আজ প্রথম বার দেখার মতো এক্টিং করতে হবে। কেমন পাগলাটে কাজ! আবির আদিত্যর রুমে এসে তাকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে ঘড়ি পড়তে দেখে হতাশ কন্ঠে বলল,
“কিরে! তুই এখনো রেডি হোসনি! আমরা যাবো কখন? মেয়েপক্ষ কি ভাববে! আমরা সময় মেইনটেইন করতে পারি না! মনে রাখবি ফাস্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্য লাস্ট ইম্প্রেশন।”
আদিত্য পিছে না ফিরেই বলল,
“এসব বাচ্চামো না করলে কি হয়না! এগুলো একটু বেশি বেশি হচ্ছে না! মানে এখন এই মেয়ে দেখাদেখি ড্রামার কোনো মানে হয়! সোজা বিয়েটা করে ফেললেইতো হয়ে যায়! এতসবের কি দরকার! ”
আবির আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বলল,
“দরকার নেই মানে? কি বলছিস তুই? আরে প্রটোকল অনুসরণ করেই কাজ করতে হবে তাইনা! মাঝের ধাপ খেয়ে ফেললে কেমন দেখাবে! এখন তুই যদি প্রথমে বাসর তারপর বিয়ে করিস তাহলে কি বিষয়টা ভালো দেখাবে? তাই প্রটোকল অনুসরণ করেই চলতে হবে। যা প্রথম সেটা আগে করতে হবে। পরেরটা পরে। এখন সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি কর। সবকিছু বুঝিয়ে দিতে হয় তোদের। আমি না থাকলে যে কি হতো তোদের! তাও কখনো ক্রেডিট নিলাম না৷ এমন মহান ব্যক্তি তোর বন্ধু এজন্য তোর তিনবেলা নিয়ম করে বুড়িগঙ্গায় স্নান করে আসা উচিত। তাও সাবান ছাড়া। নে এখন রেডি বাইরে আয়।”
বকবক শেষ করে প্রস্থান করল আবির। স্মিথ হাসলো আদিত্য। এই আবিরটা আসলেই সবাইকে মাতিয়ে রাখে। এমন একটা আবির সবার জীবনেই অনেক দরকার। রেডি হয়ে বের হলো আদিত্য। লিভিং রুমে আসতেই বিহান মুখে দুই আঙুল পুরে শিস বাজিয়ে উঠে বলল,
“আরেব্বাস মামা! কি লাগতাছচ! পুরাই কাতিলানা! মাইয়াতো আইজ ফিট খাইয়া যাইবোগা!”
আবির হঠাৎ নাক টেনে নেকা সুরে বলল,
“পোলাডা আমার কত্তো বড়ো হইয়া গেল! এখন মায়ের আঁচল ছাইড়া বউয়ের আঁচল ধরবো। পোলা আমার পর হইয়া গেল গা!”
আদিত্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো আবিরের দিকে।তা দেখে আবির আবারও স্বাভাবিক মোডে এসে বলল,
“আরে ইয়ার আমি আন্টির ডায়লগ গুলো বললাম। মায়েরা এসবই বলে।”
মুচকি হাসলো আদিত্য। মায়ের কথা সত্যি আজ অনেক মনে পড়ছে তার৷ আজ তার মা-বাবা থাকলে কত আনন্দই না হতো! তার জীবনে কোনো কমতিই থাকতোনা আর।

তারা বাইরে এলো। পুল সাইডে মেয়ে দেখার প্রোগ্রাম সেট করা হয়েছে। মূলত ওটাই মেয়ে পক্ষের এড়িয়া। আবির,বিহান হলো ছেলে পক্ষ। আর হিয়া নূরের পাশের মেয়ে পক্ষ। আদিত্যরা মেয়ে পক্ষের এড়িয়াতে এসে দাঁড়াল। আবির অপ্রয়োজনীয় দাম্ভিকতার সহিত বলল,
“আরে বাড়িতে কেউ আছে নাকি! এ কেমন লোকজনরে বাবা! ছেলেপক্ষ এসে দাঁড়িয়ে আছে আর স্বাগত করার জন্য কেউ আসলোই না! আমাদের ছেলের সোনার অঙ্গ রোদে পুড়ে গেলে ক্ষতিপূরন কে দিবে!”
বিহান বলে উঠল,
“আব্বে রোদ কই পাইলি তুই?অহনতো ছন্ধ্যা হইবার যাইতাচে!”
বিহানের উক্তিতে আবির এমন অসন্তুষ্ট মুখ বানালো যেন এমন একটা কথা বলার জন্য তাকে এই মুহুর্তে তারকাঁটার চাবুক মারা উচিত শতখানেক। মুখ চোখা করে আবির বলল,
“ইয়ার তুই কি পোয়াতি হইছস? তা নাহলে কথায় কথায় বমি করস কেন? তোর মুখের ঢাকনা একটু বন্ধ কর। আরে এটা হলো ছেলে পক্ষের আজাইরা দাম্ভিকতা। এটা দেখানো কম্পলসারি। নাইলে ছেলেপক্ষের প্রভাব কমে যাবে। দেহস না আমি কেমন চেস্ট ফুলিয়ে ব্লাউজ বানিয়ে ফেলেছি! তুইও কর।কারণ আমরা ছেলেপক্ষ। আমাদের আর কিছু থাকুক ,না থাকুক। আজাইরা অহংকার থাকা ইজ ভেরি মাচ ইম্পর্ট্যান্ট। সবকিছু আমারই বুঝিয়ে দিতে হয় তোদের। আমি না থাকলে যে কি হতো!”
ওদের কথার মাঝে হিয়া এগিয়ে এলো। অভ্যর্থনা জানিয়ে বসতে দিলো তাদের। অতঃপর বলল,
“মাফ করবেন আসলে কনেকে রেডি করছিলামতো। একা হাতে সব করতে হচ্ছে। মেয়ে পক্ষেরতো আমি একাই। কয়টা সামলাবো!”
আবির হাতল ওয়ালা চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে অপ্রয়োজনীয় দাম্ভিকতা বজায় রেখে বলল,
“শুনে অনেক দুঃখ হলো! ছেলে পক্ষের পাল্লা ভারি। কারণ আমরা এমনিতেই বেশি ক্ষমতাবান। তারউপর মেয়ে পক্ষের জনসংখ্যাও কম। এখনতো আমরা আরও এগিয়ে। সো স্যাড।”

“কে বলল মেয়ে পক্ষে মানুষ কম! এইতো তাদের পক্ষের সদস্য এসে পড়েছে।”
মেয়েলী কন্ঠের বাণীটি কানে আসতেই পেছনে ফিরে তাকালো তখন সবাই। আবিরও ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো পেছনে। মেরুন রঙের লং গোল জামায় আবৃত আহানা তখন চোখের সামনে প্রতিয়মান হলো। পাতলা ছিমছাম গড়নের মেয়েটি, চিকন হিলের জুতো পড়ে কদম বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। পিঠময় মেলে থাকা চুলগুলো হাঁটার তালে তালে দোল খাচ্ছে। চিকন মুখে লেপ্টে আছে সুক্ষ্ম মিষ্টি হাসি। তাকে এমুহূর্তে এখানে দেখাটা আবিরের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত বটে। তার ধারণা ছিলনা এই বিষয়ে। কিছুটা বিস্মিত সে।আহানা ততক্ষণে সবার মাঝে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“হিয়া ভাবি টেনশন নট। আমি এসে গেছি। এবার মেয়ে পক্ষ আর ছেলে পক্ষ এবার সমান সমান। এক্সুলি সমান সমান না। কজ গার্লস আর অলওয়েজ দ্য বেস্ট!”
চোখের সানগ্লাসটা চোখের উপর থেকে কিছুটা নামিয়ে নাকের ডগায় এনে ঠেকালো আবির।ঘাড় হালকা কাত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবলোকন করলো আহানার আপাদমস্তক। বাঁকা হাসির রেখা তখন তার ঠোঁটের কোণে। অতঃপর বলল,
“হ্যারে ভাই বিহান, কথা কিন্তু মিছা না। মেয়ে পক্ষ আসলেই ভীতিকর হয়ে গেল এবার। পেত্নীর সর্দারনী খোদ যেখানে এসে হাজির হলো সেখানেতো কোনোকিছু বলাই বাহুল্য। এই সাধারণ মনুষ্যর কি সাধ্য আছে পেত্নীর নানীর সাথে পাঙ্গা নেওয়ার! এখনতো যার যার জানমালের ক্ষয়ক্ষতির চিন্তা করতে হবে। কখন নাজানি পেত্নীর সর্দারনীর ডিনারের টেবিলে আমাদের সাজিয়ে দেয়।”
বলেই হো হো করে হাসা শুরু করে দিলো আবির।সাথে বিহানও হাসিতে ফেটে পড়ল। আহানা হাত ভাজ করে এক ভ্রু উঁচিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। আবিরের হাসির মাত্রা কমে এলে আহানা পাল্টা জবাবে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“হয়েছে? ফালতু পাঞ্চ মারা শেষ? বাইদাওয়ে পেত্নীরদেরও এতো দূর্দশা আসেনি যে আপনাদের মতো বাসি বস্তু খেতে যাবে! তাদেরও একটা লেভেল আছে। বুঝেছেন মিঃ বিয়াই সাহেব!”
আবির দুই ভ্রু উঁচিয়ে টান টান করে করে বলল,
“ওওও..এই কথা! লেটস সি দেন মিস বিয়াইন সাহেবা। তো মেয়ে দেখা কার্যক্রম শুরু করা যাক! নাকি আমাকেই দেখে যাবেন শুধু! জানি আমি অনেক হ্যান্ডসাম। চোখ সরাতে পারছেন না আপনি! কিন্তু একটুতো লজ্জা শরম রাখুন! এভাবে সবার তাকিয়ে থাকলে লজ্জা করে না আমার বুঝি! আপাতত মেয়েকে নিয়ে আসুন। পরে আমাকে দেখার আরও সুযোগ করে দিবো আপনাকে।”
বলেই চোখ টিপ মারলো আবির। আহানা ভেংচি কেটে ভেতরে গেল নূরকে আনতে। ঠোঁটে এক আঙুল চেপে হাসলো আবির।

একটু পর আহানা নূরকে ধরে নিয়ে এলো বাইরে। হালকা গোলাপি রঙের শাড়িতে নিজেকে জড়িয়েছে। মাথায় ঘোমটা টেনে রেখেছে সে। আদিত্য হাতলে হাতের কনুই ঠেকিয়ে তালুতে গাল ঠেকিয়ে অপলক দৃষ্টি গেড়ে রইল তার বঁধুর পানে। আদিত্যরও যেন এই দেখাদেখির প্রোগ্রাম এবার সত্যি ভালো লাগছে। এইযে ওর নূর এভাবে শুধু ওরজন্য সেজে এসেছে। তার চোখে পছন্দনীয় হওয়ার জন্য। যেমনটা সত্যি সত্যি দেখতে আসলে কোনো মেয়ে করে। এই অনুভূতিটা অসাধারণ। যা এমুহূর্তে আদিত্যর হচ্ছে। সে তার বঁধুকে মুগ্ধ নয়নে দেখে যাচ্ছে। নূর এগিয়ে এলো তাদের সামনে। হাতে তার চায়ের ট্রে। একে একে চা দিলো সবাইকে। সবশেষে এলো আদিত্যর সামনে। আদিত্যর সামনে ঝুঁকে চায়ের ট্রে থেকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলো তার দিকে। আদিত্যর অপলক নয়ন। নূরের চোখ সে চোখে পড়তেই এক চোখ টিপ মেরে দিলো আদিত্য। সাথে ঠোঁট চোখ করে চুমুও দেখালো ফট করে। নূরের হাত থেকে চায়ের ট্রে পড়তে পড়তে বাঁচল যেন। লজ্জায় দ্রুত সরে গেল নূর। শব্দহীন হাসলো আদিত্য। নূরকে বসানো হলো আদিত্যর মুখোমুখি সামনের চেয়ারে। আদিত্যর বেয়ারা একাগ্র নজর নূরের পানে স্থির। তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে সে। নূর মাথা নুইয়ে আছে৷ তার কেমন যেন সত্যি সত্যি দেখতে আসার মতো লজ্জা লাগছে। আবির মুরুব্বিদের মতো বলে উঠল,
“হ্যাঁ তো বিয়াইন সাহেবা মেয়ের সম্বন্ধে কিছু বলেন আমাদের।”
“কি জানতে চান বলুন? আমাদের মেয়ে সর্বগুণ সম্পূর্ণ। সে সব গুণেই গুণান্বিত। রুপে অপরুপা,রান্নায় অন্নপূর্ণা, সকল কাজেই পারদর্শী সে।”
“আরে এসবতো পুরানো ট্রেন্ড। এখন আর এসব দেখেনা মানুষ। এখন ডিজিটাল জামানা। তাই প্রশ্নও ডিজিটাল হবে। এই যেমন, মেয়ে কি টিকটক করতে পারে? সে কি “কাভালিয়া” গানে কোনো ভিডিও বানিয়েছে? তার কি পেইজ আছে? মেয়ের কতগুলো ফলোয়ার আছে? দেখো ছেলের কিন্তু ১মিলিয়ন ফলোয়ার। সেখানে মেয়ের অন্তত পঞ্চাশ লাখতো হওয়াই দরকার। তাহলে না ম্যাচ হবে? আরে আমাদের ছেলের জন্যতো ২ মিলিয়ন ফলোয়ারের মালিক মেয়েরা পাগল।”
আহানা বলে উঠল,
“ওহ তাই নাকি! তো মিঃ বিয়াই সাহেব, আমরা মেয়েকে হিরোর সাথে বিয়ে দিতে চাই। কোনো হিরো আলমের সাথে না।”
আবির লাফিয়ে উঠে বলল,
“কিহ! এত্ত বিশাল অপমান! বুর্জ খলিফার চেয়েও বড়ো অপমান এটা! নাহ, এরপর আর এক মুহূর্তও আমরা থাকবোনা এখানে। আমাদের ছেলের জন্য কি মেয়ের জন্য অভাব নাকি! চল আদি এখান থেকে! ”
কিন্তু বেচারার অপ্রয়োজনীয় দাপটের কেউ এক ছটাক দামও দিলোনা৷ আদিত্য আয়েসি ভঙ্গিতে বলল,
“মেয়ে আমার পছন্দ। আমরা একটু একা কথা বলতে চাই।”
বলেই উঠে দাঁড়িয়ে আদিত্য কারোর ধার না ধেরে নূরের হাত ধরে দাঁড় করিয়ে সোজা ভেতরে নিয়ে গেল। বেচারা আবির আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“পোলাপান মানুষ করতে পারলাম না।”
সবগুলো হেসে লুটিয়ে পড়ল।

আদিত্য নূরকে নিজের রুমে এলো। রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। নূরের কেন যেন হঠাৎ অনেক লজ্জা লাগছে। যেন সত্যি সত্যি আজ প্রথম লোকটা তার কাছে এসেছে। আদিত্য দরজা লাগিয়ে নূরের হাত ধরে বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসালো। তারপর বলল,
“নিচে আমি তোমাকে ভালো করে দেখতে পাইনি।যে ভারত পাকিস্তানের বর্ডারের মতো ঘোমটা টেনে ছিলে! এখন দেখবো। ঘোমটা খোলো চুল দেখাও আমাকে। আমি দেখতে চাই আমার হবু বউয়ের চুল কতবড়। এগুলো দেখা অনেক জরুরি বুঝেছ! নাও নাও ঘোমটা সরাও।”
নূর কিছুটা থতমত খেয়ে গেল আদিত্যর কথায়। নূরকে চুপ থাকতে দেখে আদিত্য নিজেই নূরকে ঘুরিয়ে বসিয়ে মাথার উপর থেকে ঘোমটা সরিয়ে দিলে। পিঠময় এলোকেশ দেখতে পেল আদিত্য। চুলের উপর আঙুলের উল্টো পিঠ বুলিয়ে দিতে লাগল। ধীরে ধীরে মাথা ঝুঁকিয়ে নাক ডুবিয়ে দিলো চুলের মাঝে। ঘ্রাণ টেনে নিলো নিঃশ্বাসে। চোখ বুঁজে নিলো নূর। ভারী হলো শ্বাসপ্রশ্বাস তার। আদিত্য ধীরে ধীরে তার এক হাত গলিয়ে দিলো শাড়ির ফাঁকে নূরের কোমড়ে। কোমড় পেঁচিয়ে ধরে তাকে আরও কাছে টেনে নিলো নিবিড় ভাবে। কম্পিত হলো নূর। হৃদকম্পন হলো বেসামাল। কাঁধে আদিত্যর উষ্ণ নিঃশ্বাসে কাটা দিয়ে উঠল তার লোমকূপ। কোনোরকমে নিজেকে সামলাতে সে বলল,
“চুলা দেখার সাথে সাথে কি এসব করারও রীতি আছে নাকি!”
আদিত্য নূরের কাঁধের উপর থেকে চুল সরিয়ে সেথায় অধর লেপ্টিয়ে ফিসফিসানির সুরে বলল,
“হুম আছেতো। তবে সবার জন্য না। আমার মতো কিছু স্পেশাল কেসের ক্ষেত্রে আছে। যারা নিজের বউকেই আবার নতুন করে বিয়ে করার সৌভাগ্য পায় শুধুমাত্র তাদের জন্য এই রীতি।”
নূরের কানের ঝুমকায় টোকা দিয়ে বলল,
“বুঝেছ আমার বউ কম হবু বউ!”
হেসে দিলো নূর। মুখ গুঁজল আদিত্যর বুকে। আদিত্যও হেঁসে জড়িয়ে নিলো নূরকে।

চলবে…..