মায়া মহল পর্ব-১৪+১৫

0
167

#মায়া_মহল (১৪)
কলমে #রেহানা_পুতুল
মায়ার সমস্ত অনুভূতি অবশ হয়ে আছে। প্রাণহীন মানুষের মতন অচল শরীরে কাত হয়ে আছে বিছানায়।

আর এই জঘন্যতম! ঘৃণিত! অভিশপ্ত কাজটি করলাম আমিই নিজহাতে। আমিও সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী!

দুইহাত জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল পরশ।

মায়া কোনমতে উঠে বসলো। মৃগী রোগীর ন্যায় থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো তার সমস্ত শরীর। কি নৃশংসভাবে জীবন দিতে হলো তার মা, বাবাকে। ভেবেই তার মনটা দমকা হাওয়ার মতো হুহু করে উঠলো এক অসীম শূন্যতায়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল,

যাদের জন্য অন্যায়ভাবে সে এতিম হয়েছে। পিতা মাতার আদর,স্নেহ,মমতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, লাঞ্চিতার জীবন পেয়েছে,তাদের কাউকেই সে ছাড়বে না। কাউকেনা। সে বজ্র হয়ে তাদের একে একে শেষ করে দিবে। এই পৃথিবী থেকে তাদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দিবে।

তার মনে হলো সে কোন ভিনগ্রহের মেয়ে। এই মাটির ভুবনে এত অতি আশ্চর্যজনক,অদ্ভুত, অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটা অকল্পনীয়! সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এত জায়গা জমি,ধন সম্পদের মালিক সে? কিভাবে সম্ভব! কিভাবে! ভ্রুকুঁচকে প্রচন্ড ঘৃণা, ক্রোধ, দুঃখভরা হৃদয়ে জিজ্ঞেস করলো পরশকে,

চাচা আমার মনে হয়, আমার সব প্রশ্নের জবাব আপনি দিতে পারবেন। এবং আপনি যা জানেন তা হয়তো অন্যরাও জানে না। তাই এই মহল ও এই পরিবার সম্পর্কে আপনি যা জানেন বলেন? আপনিই আমার একমাত্র ভরসার কেন্দ্রবিন্দু চাচা।

পরশ তফুরার দিকে চাইলো। নমনীয় স্বরে বলল,
দেখছেন আপা, কইলাম না। মায়া ভীষণ বুদ্ধিমতী। পরশ কাঁধের বড় গামছাটা দিয়ে কপালের ও ঘাড়ের চিকন ঘামগুলো ঢলে মুছে নিলো। দৃষ্টি স্থির করলো দেয়াল ঘড়িটার দিকে।

বলল,
তোমাকে সব জানানোর সময় হয়ে গিয়েছে। নয়তো তুমি অত্যাচারিত ও রক্তাক্ত হতেই থাকবে এদের হাতে।

মায়ার ও তফুরার পূর্ণ মনোযোগ পরশের মুখের দিকে। পরশ বলতে লাগলো,

আমাদের পরিবারে কয়েক প্রজন্ম ধরেই কোন কন্যা সন্তান বাঁচে না। জন্মের পর কোন না কোন ছুতোয় তার মৃত্যু হয়। এর কারণটা অজ্ঞাত। কেউই জানে না। অনেক ফকির, দরবেশ,ডাক্তার,কবিরাজ ধরেও এর কোন সদুত্তর বা সুরাহা মেলেনি। এইটা আমার বাবা জমির উল্লা মানে তোমার দাদার মুখেই শুনা। এবং আমিও দেখেছি। আমার, আমার বাবার, আমার দাদার, দাদার বাবার, কোন বোন ছিলো না।

আমার বাবার প্রথম স্ত্রী অর্থাৎ তোমার দাদী মারা যায় দুজন পুত্র সন্তান রেখে। সেই ঘরের বড় পুত্র হলো কায়রুস ভাই। ছোট পুত্র হলো তোমার বাবা আমিনুল। তখন আমার মাকে দ্বিতীয় বিয়ে করে তোমার দাদা। সেই ঘরে আমি জন্ম নিই। আমার আর কোন ভাইবোন নেই। আমার জন্মের সময় তোমার বাবার বয়স ছিলো দুই বছর। বলতে গেলে আমরা দুই সৎ ভাই ছিলাম পিঠাপিঠি। আমাদের খাতির ছিলো তুই তাকারি করে দোস্তর মতো। সবাই কইতো জমির উল্ল্যার ছোট দুই পোলারে দেখলে মনে হয় এক মায়ের প্যাটে হইছে। কয়েক বছর আগে আমার মাও মারা যায় বেমারে পড়ে।

আমি পড়াশোনায় কাঁচা ছিলাম। তাই ফাইভ পাশের পর আমার আর পড়াশোনা হয়নি। বড় ভাইজান কিছুদূর পড়াশোনা করছে। তবে আমিনুল আরো বেশি লেখাপড়া করছে। তার মাথা ভালো ছিলো। আর পারিবারিকভাবে আমরা আগে থেকেই অনেক সচ্ছল ছিলাম। তাই আমি তেমন কোন কাজ কর্ম করতাম না। নিজেদের নারকেল, সুপারির বাগিচা, ধানি জমি, মাছের পুকুর,গরুর ফার্ম,বাজারের মিল, এগুলো দেখাশুনা করতাম। আর ঘুরেফিরে খাইতাম।

বাবার খুব শখ ছিলো নিজের কোন কন্যা সন্তান নেই যেহেতু ,তাই তেমন করেই বড় পুত্রের বিয়ে ধুমধাম করে দিবেন। এবং তিনি একটা পাত্রীও ঠিক করেছেন নিজে দেখে। পাকা কথাও দিয়ে ফেলেছেন তাদেরকে।
কিন্তু ভাইজান হলো খুব অবাধ্য,স্বার্থবাদী। নিজের ইচ্ছারেই গুরুত্ব দেয় বেশি। সে হুট করেই এক মেয়েরে বিয়ে করে নিয়ে এলো। বাহানা দিলো সেই নাকি পরিস্থিতির শিকার।

এদিকে বিয়ে ঠিক করা পাত্রীর পিতা তোমার দাদাকে অপমান করলো অনেক। আমার বাবার ভয়ানক রাগ হলো সেদিন। তিনি চুপেচুপে আমারে সঙ্গে নিয়ে সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি তোমার বাবার নামে লিখে দিলো,এবং আমার নামেও দিলো কিছু। আমি নিজ থাইকাই বাবারে কইছি,
আমিনুলরে সব দেন। আমারে অল্প দিলেই হবে। কারণ আমিনুলরে আমি অনেক ভালোবাসতাম। এটা কেউই জানতো না। আমিনুলও জানতো না। তার কিছুদিন পর বাবা মারা গেলো। বড় ভাবির ঘরে দুটো পুত্র সন্তান হলো। জুবায়ের ও শাহের বাবাজি। তাদেরও কোন বোন হল না।
আমার সাদীর দায়িত্ব কেউ নেয়নি।
আমিও সেইভাবে পারিনি কাউকে পছন্দ করতে। তাই আমার আর সাদি করা হয়নি।।

তবে উপর দিয়ে পরিবারের সবার সঙ্গেই সবার সুসম্পর্ক ছিলো। আমিনুলের সঙ্গে প্রায় বড় ভাইর মনোমালিন্য হতো। আমি অশিক্ষিত। তাই সব জেনেও চুপ থাকতাম। কিন্তু আমিনুল ছিলো সৎ,নির্ভীক, প্রতিবাদী,দৃঢ়চেতার মানুষ! সেটা পরে বলছি। আগে তোমার ইতিহাস কই।

তোমার বাবা পড়াশোনা শেষ করলো। শহরে অনেক বড় সরকারি চাকরি পেলো। বাবা,মা,বোন নেই। তাই বাধ্য হয়ে একসময় আমিনুলও নিজের পছন্দে তোমার মা কাজলকে বিয়ে করলো। তোমার মাও শিক্ষিত ছিলো। বিয়ের বছর চারেক পরে তোমার মা সন্তান সম্ভবা হলো। তখন তোমার বাবার মনের ফূর্তি আসমান ছোঁয়া।

এক বিকেলে চা খাইতে খাইতে তোমার বাবা আমগো সকলরে শুনায়া কইলো,
সবাই দোয়া করেন,
আমাদের বংশে যেন একটা কন্যা সন্তানের আবির্ভাব ঘটে।

তখন তোমার বড় চাচা হেসে আমিনুলরে কইলো,

আল্লাহ যেন তোর মনের আশা পূরণ করে। তোর কন্যা হলে আমি আম্মাজানরে অনেক বড় উপহার দিমু।

আপনি দিবেন আর আমি পিতা হয়ে দিব না?

কি দিবি তুই?

আপনি কি দিবেন বলেন তো?

আমি আমার ভাগের সম্পত্তি থেকে আম্মাজানরে একখান জমি তার নামে লিখে দিবো উপহার হিসেবে।

আমিনুল খুশিখুশি দিলে কইলো,

আমার মেয়ের নাম রাখবো মায়া। সবার মায়ায় মায়ায় সে বেড়ে উঠবে। আমি বিশাল একটা ঘর বানাবো ভাইজান। রাজা বাদশাগো মহলের আদলে। নাম দিবো #মায়ামহল। মহলের সামনে জ্বলজ্বল করে জ্বলবে নামটি। সেই মায়া মহল ও আমার ভাগের সব আমার কন্যার নামে উইল করে দিয়ে দিবো। আর এই মহলে সে রঙিন প্রজাপতির মতো স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে। হাসিখুশি থাকবে। মায়া মহল মাতিয়ে রাখবে তার নুপুরের ছন্দে।

তখন তোমার আম্মা পাশ থেকে কইলো,
আমার মায়াকে সোনার নুপুর বানিয়ে দিবো আমি।

বাহবা! তোমরাতো দেখি মেয়ে পৃথিবীতে না আসতেই তার লাইফ সেটেল করে দিয়েছো। আগে ভালোর ভালো তাকে দুনিয়াতে আসতে দাও। মেয়ে না ছেলে হয় সেটা আরো পরে বলা যাবে।

তাচ্ছিল্যের সুরে বলল বড় ভাইজান। কারণ তার অগাধ বিশ্বাস ছিলো,কখনোই এই বংশে কন্যা সন্তান পয়দা হবে না। হলে পাঁচ সিঁড়ি ধরে হয়না ক্যান।

সেইদিন আমি আমিনুলরে জানায়া দিলাম যে, সকল সম্পত্তি বাবা ওর নামে দিয়েছে এবং কারণও জানাইলাম। অবশ্য আমিনুল এতে ততটা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। বরং বলল,

আব্বার এটা কিছুতেই উচিত হয়নি। এরপর আমিনুল আমারে সঙ্গে নিয়া সব তোমার নামে দলিল কইরা দিয়া দিছে।

দুনিয়াতে তোমার আসার সময় হইলো। মালিকের হুকুম মতে এক চান্দের রাইতে ঘর আলো কইরা তুমি জন্মাইলা। তোমার বাবা,মার আনন্দ বুক সমান। সারা গেরামে মিঠাই বিতরণ হইলো। দলে দলে লোকজন তোমারে দেখতে আইলো। উপহার দিতো। কোলে নিতো তোমারে। দোয়া করতো। কিন্তু তোমার বড় চাচা চাচীর পৃথিবী আন্ধার হইয়া গ্যালো। তাদের মুখে নাইমা আইলো অমাবইশ্যা। সারাদিন মুখ কালো কইরা রাখতো। কারণ পরিবারের একমাত্র কন্যা তুমি। তোমার হিসাব নিকাশই আলাদা সবার কাছে। আমিনুল তোমার জন্মের পর তিনমাসে এই মহল বানালো রাজ প্রাসাদের মত কইরা। নাম দিলো মায়া মহল। মুখ ফসকে কইলেও কায়রুস ভাই কিন্তু তোমারে আর জমি দেয়নাই। আমিনুল মাঝে মাঝে মজা করে বলতো,

ভাইজান কথার বরখেলাপ করলেন তো।

তিনি নয়ছয় করে পাশ কাটায়া যাইতেন।

তোমার বয়স যখন ছয়মাস। তখন বর্ষাকাল ছিলো। খুব ঝড় তুফান হইতাছিলো সেই মুহূর্তে। তো সেই গুপ্তধন নিয়া এক দুই কথায় তারা দুই ভাইয়ে তর্ক শুরু করে দিলো। এক পর্যায়ে আমিনুল বলল,

আমি আর সহ্য করবো না। পুলিশে জানিয়ে দিবো সব। অন্যের সোনাদানা কেন আপনি ভোগ করবেন?

তুই কি করতে চাস আমিও দেখতে চাই।
রক্তচক্ষু নিয়ে বলল বড় ভাইজান।

তখন আমিনুল ক্রোধান্বিত হয়ে বলল,

আমি কি করতে চাই দেখবেন আপনি? আমি যদি না পারিও, আমার মেয়ে মায়া বড় হলে আপনার এই আত্মসাৎ করা সোনাদানা রাখতে দিবে না। সে এসব মহৎ কাজেই লাগাবে। দেখবেন আপনি। আমি আর কাজল মায়াকে সেই আদর্শেই গড়ে তুলবো। আর এই সবকিছুই মায়ার নামে। বাবা আমার নামে দিয়েছে। আমি আমার মায়ার নামে রেজিষ্ট্রেশন করে দিয়েছি।

আমি তাদের আড়ালে থেকে সব শুনছি দেখতে না পেলেও। সেই রাতেই তোমার বাবার হাত পা বেঁধে কায়রুস নিজ হাতে জবা করে ফেলে চাপাতি দিয়ে। জল্লাদ রুস্তম তাকে সহযোগিতা করছে। আরো দুজন সহযোগী ছিলো। তারা নেই এখন। মারা গিয়েছে। এবং মহলের কবরস্থানেই সেই গভীর রাতের নির্জনতায় আমিনুলের লা*শ কবর দিয়ে ফেলেছে জানাযা ছাড়াই।

মায়া নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে।শপথ করে বলে,
খু*নী কায়রুস, তোর প্রাণ আমার হাতেই। কসম খোদার।

চলবে… ১৪

#মায়া_মহল (১৫) #রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
আমি তাদের আড়ালে থেকে সব শুনছি দেখতে না পেলেও। সেই রাতেই তোমার বাবার হাত পা বেঁধে কায়রুস নিজ হাতে জ*বা করে ফেলে চাপাতি দিয়ে। জল্লাদ রুস্তম তাকে সহযোগিতা করছে। আরো দুজন সহযোগী ছিলো। তারা নেই এখন মারা গিয়েছে। এবং মহলের কবরস্থানেই সেই গভীর রাতের নির্জনতায় আমিনুলের লাশ কবর দিয়ে ফেলেছে জানাযা ছাড়াই।

মায়া নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে।শপথ করে বলে,
খু*নী কায়রুস, তোর প্রাণ আমার হাতেই। কসম খোদার।

মায়ার সৎ চাচা পরশ আরো বলতে লাগল,
এসবে আমিও ছিলাম । নিরুপায় ছিলাম মা। চাকরের মতো সব মাইনা নিই আর খাইটা চলি বলেই আজও দম ফালাইতে পারতেছি এই দুনিয়ায়। সেদিন যদি তার বিপক্ষে যাইতাম, তাইলে সেই রাইতে আমারেও জিন্দা কবর দিতো। আমার বাবা,মা,বইন কেউই নেই। কে করবে আমার হয়ে প্রতিবাদ। কায়রুসের হিংস্রতার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতাম না। আর এই দুনিয়া টাকার গোলাম। তাই কেউ তার বিরুদ্ধে থানা,পুলিশ করার কথা চিন্তাও করে না।আবার সরাসরি কারো চউক্ষে তার সব অপরাধ ধরাও পড়ে নি।

তো তারপরের রাইতেই কায়রুস আমারে ডাইকা শীতল গলায় কইলো,

ধানের গোলায় আমিনুলের বউ বন্দী আছে। ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে রেখেছি। তার মেয়েকেও ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। মরার নয় সেটা। ঘুমিয়ে থাকার। তার মায়ের চার ঘন্টার আগে জ্ঞান ফিরবে না। ফিরতে ফিরতে সে আর বেঁচে রইবে না। কোলের মেয়ে এমনিতেই মরে যাবে। চরের জঙ্গলে নিয়ে যা গাড়িতে করে। বেঁধে রেখে তোরা চলে আসবি। তোর সঙ্গে কদম ও কাল্লু যাবে। কাল্লু গাড়ি চালিয়ে নিবে।

ব্যাস যেই হকুম সেই কাজ। নিয়ে গেলাম তোমারে সহ তোমার মায়েরে। চরের গহীন জংগলে সুপারি গাছের লগে বাইন্ধা রাখি। তারপর আমরা চইলা আসি। এই হইলো তোমার পরিবারের নিষ্ঠুরতম কালো বেদনাদায়ক ইতিহাস।

যেই অপরাধ, অনুশোচনা সাপের ছোবলের মতো প্রতিমুহূর্তে আমার বিবেকরে দংশন করে।
তুমি মহলে আওনের পরেই যখন লাগাতার তিনজন মানুষ মইরা গেলো, তখনই আমার ডাউট হইতেছিলো তোমার উপরে। তুমি কি এই বাড়ির একমাত্র কন্যা নাকি। সবার মরণের বিষয়ে তুমি জাননা এটা সত্যি। তোমার তাবিজের বিষয়টাও আমি বলি শোন,

তুমি জন্মাবার পর তোমার মাকে নিয়া তোমার নানার বাড়িতে যাই আমি। তোমারে দেইখা সবাই অবাক চোখে চাইয়া থাকতো। কইতো এত্ত সুন্দর কাজলের মাইয়া। আবার তোমার মাও ডরাইতাছিল খুউব। যদি তুমি মইরা যাও তাই। কারণ এই বংশের সব কন্যারা মইরা যায়। তোমার নানী করলো কি, তোমার মা,ও আমারে নিয়া অনেক দূরে এক বিখ্যাত দরবেশের কাছে গেলো। সব কইলো। সেই দরবেশ তোমার কোমরে থাকা এই তাবিজটা দিলো। এবং তোমার মাকে কইলো,

তোর মেয়ের শরীরে সবসময় এই তাবিজ বাইন্ধা রাখবি। দেখবি সহজে তার কোন অসুখবিসুখ হইবো না। ইনশাআল্লাহ। সব নিয়মগুলা মেনে চলবি তিনমাস পর্যন্ত। তবে তার বিয়ার পরে এই তাবিজ সঙ্গে না রাখলেও চলবে। রাখতে পারলেই ভালো তবে।

কেউ কখনো তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কেউ যদি তার শরীরে বদ নজরে হাত দেয়,কুদৃষ্টি নিক্ষেপ করে, তারপরেই সে মারা যাবে।

এই বিষয়টা আমি ছাড়া এই মহলের দ্বিতীয় কেউই জানে না। কাজল আমারে অনুরোধ করে বলছিলো বিষয়টা যেন গোপন রাখি। তুমিও জানতানা এইটা।

মায়া আশ্চর্য হলো শুনে। তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। দুলে উঠলো তার সমস্ত পৃথিবী। তারজন্য এতগুলো মানুষ মরে গেলো! কেন যে তারা তার শরীরে হাত দিলো। হায় খোদা! সে কোমরে থাকা তাবিজটার উপরে হাত বুলিয়ে নিলো। কৃতজ্ঞতা জানালো নানীকে। শুকরিয়া আদায় করলো স্রষ্টার প্রতি।

পরশকে বলল,

চাচা আঞ্জুমান আরার হাত নেই আমাদের বিষয়ে?

আছে মানে? পুরাই আছে। আমিতো কইতে ভুইলা গ্যাছি। সেইতো আসল ভিলেন। কাইন্দা কাইটা কায়রুসরে নরম কইরা ফালাইছে। তবে সে মারতে কয়নাই। বাইর কইরা দিতে কইছে তোমারে ও তোমার মায়েরে।

শুনে তার প্রতি মায়ার সমস্ত মায়া,শ্রদ্ধা এক লহমায় উবে গেলো কর্পূরের ন্যায়। ঘৃণায় রিরি করছে তার অনুভব অনুভূতি।

সে পরিতাপের স্বাস ছাড়লো। তার দৃষ্টিতে আগুন খেলা করছে। আকস্মিক তার মনে ও শরীরে যেনো অসুরের শক্তি ভর করলো। তার দূর্বল চাহনি প্রখর হয়ে উঠলো সূর্যের আলোর ন্যায়। সে তেজোদীপ্ত কন্ঠে বলল,

চাচা আপনি কাউকে কিছুই বলবেন না আশাকরি। আর যেহেতু আমি এই বাড়ির মেয়ে। সুতরাং আমি কোথাও যাব না। কিন্তু আমার পরিচয়ও প্রকাশ করা যাবে না আপাতত। নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই সকল অন্যায়ের। নিজের বাড়িতে অবহেলা আর দাসত্বের জীবন থেকে আমি আপনাকে মুক্ত করবো। আপনি জীবন যাপন করবেন মর্যাদার সাথে।

বোকা মেয়ে। আমিই সব কইলাম তোমারে। আর তুমি আমারে সতর্ক করতাছো। ম্যালা সময় হইলো। আমি যাই অহন। তুমিও অভিনয় কইরা চইলো সবার সাথে। আগের মতোই কথাবার্তা বইলো মাথা নিচু কইরা।

কৃতজ্ঞতার ভাষায় বলে পরশ রুম হতে প্রস্থান নিলো। কায়রুসের রুমে গেলো পরশ।

ভাইজান কিছু লাগবে?

নাহ। তবে শোন।

কিহ?
আচ্ছা সেদিন কাজল ও তার মেয়ে মায়া মারা যায়নি?

গেছেতো অবশ্যই। তা না হলে এতদিনে এটার খবর পাইতেন না? ওই চরে ঝড়ের মইধ্যে শিশু মায়া ক্যামনে বাঁচবো? আশেপাশে কোন বাড়িঘরতো নজরে পড়ল না,যে কেউ আইসা বাঁচাইবো। আর আমিতো দেখছি এই মহিলারে। এ তফুরা। কাজল নয়। মায়া তফুরার মাইয়া। তার গরিবি বেশ। কথা কয় গেরামের ভাষায়। এই মায়া সেই মায়া নয় ভাইজান। আপনে নিশ্চিন্তে থাকেন। ঘুমান। আমি গেলাম।

তার একটু পর মর্জিনা এলো। মায়া ও তফুরার জন্য রাতের খাবার দিয়ে গেলো। এবং তফুরার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁথা বালিশ দিয়ে গেলো। তারা মা মেয়ে খেয়ে নিলো। মেঝেতে পরিপাটি করে বিছানা করে দুজন শুয়ে গেলো। তফুরা নানান জল্পনা কল্পনা করছে মায়াকে নিয়ে। মায়ার চিন্তাভাবনার বিপুল পরিবর্তন এলো। মানসিকভাবে দুর্দান্ত সাহসী হয়ে উঠলো। একদিকে লোকাল বাসের জার্নি দীর্ঘ পথের। আরেকদিকে আসার পর শুনতে হলো এক ভয়াবহ ইতিহাস। সব মিলিয়ে অবসাদ নেমে এলও তফুরার মুখাবয়বে। ঝিমিয়ে আসছে তার দুচোখ। মায়ার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এলো।

মায়া দরজা খোল। আমি আসতেছি। জরুরী দরকার আছে।

মায়া খুলছে না দরজা। দ্বিধায় পড়ে গেলো। দরজায় আস্তে করে ঠকঠক আওয়াজ হলো। মায়া মনে মনে বলল,

আমারে ধরতে আসলেই অক্কা যাবেন ছোটবাবু। আসেন। নয়তো রাতে কি দরকার আমাকে। আমি বুঝি না কিছু?

উঠে গিয়ে নিঃশব্দে দরজা খুলে দিলো মায়া। শাহের ভিতরে এলো।
তফুরা মোচড় দিয়ে উঠে বসলো।

আপনার কোন অসুবিধা হচ্ছে ঘুমাতে?

না বাপজান। সব ঠিকাছে। কোন সমস্যা নাই। আমরা মা মাইয়া আরামেই আছি।

আচ্ছা বুঝলাম। আপনার মেয়েকে একটু আমার রুমে নিয়ে যাবো। খুব দরকার। নিরিবিলি বলতে হবে কথাগুলো। আপনি ভুল বুঝবেন না।

তফুরা দোনোমোনো শুরু করলো। মায়া চোখের ইশারায় তফুরকে আস্বস্ত করলো। পরক্ষণেই শব্দ করে বলল,

আম্মা সমস্যা নাই। তুমি ক্লান্ত অনেক।
ঘুমায়া যাও। ছোটবাবু খুব ভালো মানুষ। হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান নয়। আমার সঙ্গে উনি কখনো দুর্ব্যবহারটুকুও করেনি। থাকতো আবার গায়ে হাত দিয়ে মারবে।

আইচ্ছা মা। তাড়া কইরা চইলা আসিস।

মায়া চলে গেলো শাহেরের পিছু পিছু। তফুরার দুচোখ বুঁজে এলো হাই দিতে দিতে।

শাহের ভিতর থেকে দরজা ভিড়িয়ে দিলো। কিন্তু বন্ধ করলো না। মায়াকে বসতে বলল। মায়া জড়োসড়ো হতে শাহেরের মুখোমুখি একটি চেয়ারে বসলো।

যা জিজ্ঞেস করবো সত্যি আনসার দিবে বাঁচতে চাইলে।
রুষ্ট কন্ঠে বলল শাহের।

জ্বি ছোটবাবু। সত্যিই বলব।

ওকেহ। যেই মানুষগুলো তোমার কারণে মারা গেলো, এদের মাঝে কেউ কি তোমাকে রে*প করেছে? এবং তুমি কেন এসব আমাকে বা আম্মাকে জানাওনি? এই দুটো প্রশ্নের জবাব চাই আগে।

মায়া বিমূঢ় হয়ে শাহেরের চোখের দিকে চাইলো। মনে মনে বলল,
তুমি কি জানো আমি তোমার আপন চাচাতো বোন?

চলবে…