মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব-০৪

0
19

#মায়াবতীর_ইচ্ছা
#ইশরাত_জাহান
#পর্ব_৪
🦋
কনকনা শীতে ঘেরা ঢাকা শহর।আকাশে একটি চাঁদের ঝলক তার চারপাশে ঘোরাঘুরি করতে থাকে কিছু ক্ষুদ্র তারা।ছোট ছোট তারারা যেনো এক জায়গায় স্থির না।তারা তাদের মতো করে এদিক থেকে ওদিক হতে থাকে।নির্জন নিরিবিলি পরিবেশ। শেয়াল কুকুরের ডাক ছাড়া কোনো কিছুর শব্দই পাওয়া যায় না।এমন এক নির্জন পরিবেশে আলিশান এক বাড়ির ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আছে মায়া।আখি তার ওই চাঁদের দিকে।
চাঁদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলে বলতে থাকে,”তারারা কি সুন্দর ঘোরাঘুরি করতে থাকে।ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তারা হয়েও সঙ্গী নিয়ে ঘুরতে পারে।যেনো এরা হাসিখুশি এক পরিবার। আর চাঁদ!যে কি না এতগুলো তারার সমতুল্য হয়ে আছে সে তো বৃহৎ হয়েও একা।ঠিক আমার জীবনের মতো।সবকিছু আছে আমার কিন্তু ভালোবাসা নেই,পরিবার নেই,কিছুই নেই তাও লোকের কাছে আমি পুর্ণ।”

ভেবেই চোখ বন্ধ করে কল্পনা করে তার অতীত।এই সাতাশ বছরের জীবনে সফলতা আসলেও সহ্য করতে হয়েছে তাকে অনেক কিছুই।এই যে আজ এই আলিশান বাড়ি তৈরি করেছে কিন্তু তার মা তার কাছে নেই।মায়ের মমতা থেকেও সে দূরে আছে আজ সাতটি বছর।এসবের জন্য তো ওই একটি লোক দায়ী।উহু না একটু ভুল দায়ী তো আরো আছে। ভুগতে হবে সবাইকে।

মায়ার ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটায় তার ফোন কল।ঘরের ল্যান্ড ফোনে কল এসেছে।ঘরে ঢুকে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে,”মোহন সরদারের ফ্যাক্টরির বিভিন্ন প্রোডাক্ট হবে দুই নাম্বার। খাদ্যের ভিতর প্রচুর ভেজাল পাওয়া যাবে, ম্যাম।সব কাজ খুব ভালোভাবে কমপ্লিট করা হয়েছে।”

ঠোঁট বাকা করে রহস্যের হাসি দিলো মায়া।সাথে সাথে তার সিক্রেট এসিস্টেন্টকে বলে,”সিসিটিভি ফুটেজ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছো তো? আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট কিন্তু অনেক ডেভেলপ তাই হ্যান্ড গ্লাভস পড়ে ছিলে?”

“সিসিটিভি ফুটেজ আমি ডিলেট করে দিয়েছি আর হ্যান্ড গ্লাভস পড়েই সবকিছুতে পয়জন অ্যাড করেছি।”

“আর নকল রোগীদের ব্যাবস্থা?”

“বস্তি থেকে কিছু চাচী দাদীদের অফার দিয়েছিলাম।টাকার চেহারা দেখে তারা মিথ্যা রোগী সাজতে রাজী।”

“গুড ভেরি গুড। আর খেয়াল রেখো বাকিরা খাবারগুলো খাওয়ার আগে যেনো মিথ্যে রোগীদের নিউজ আগে আসে। তা নাহলে তো ভালো লোকেরাও অসুস্থ হয়ে পরবে।”

“চিন্তা করবেন না,ম্যাম।খাবারের ফ্যাক্টরি খোলা হয় সকাল আটটায় আর বিভিন্ন দোকানে পৌঁছাবে তার কিছুক্ষণ পরই আমার লোকেরা দোকানে এসে খাবারগুলো কিনবে।সামান্য কিছু খেয়ে বাকিটা না খেয়েই শুধু অভিনয় করবে।পয়জনের পরিমাণ তাদের শরীরে ৫% পাওয়া যাবে আর খাবারগুলো ল্যাবে স্কেন করা হলে ওভার ফুড পয়জনিং দেখা দিবে।”

“এতেই আমার কাজের প্রথম স্টেপ কমপ্লিট হবে।তোমার অ্যাকাউন্ট চেক করে নিও।এই মায়ার ইচ্ছা পূরণ করেছো তুমি।তোমার ক্যাশটিও তো পারফেক্টলি বুঝিয়ে দিতে হবে।”

বলেই কল কেটে দিলো মায়া।
ঘড়ির কাঁটায় ঠিক বারোটা দেখাচ্ছে।সেদিকে তাকিয়ে মায়া ভিলেনি হাসি দিয়ে বলে,”হ্যাপি বরবাদ ডে মোহন সরদার।”

অপরদিকে~~~
সারাদিন কাজ করে মাত্র বাসায় আসে রাজ।বাসায় আসার সাথে সাথেই রাজের মা মিসেস মালিনী ছেলের কাছে আসেন।এসে বলেন,”সারাদিন বাইরে ছিলি।কি না কি খেয়েছিস!আয় এখন খাবি।”

“তুমি কেনো এত রাত জেগে থাকো বলোতো?আমি আমার মতো এসে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে যাবো।তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।তুমি তোমার মতো ঘুমিয়ে যাবে। রাত জাগার দরকার নেই।”

“সন্তানদের জন্য মায়ের যে কি চিন্তা এটা তুই কি বুঝবি বল! তুই যতই বলিস না কেনো আমি তোর জন্য অপেক্ষা করবই।এখন আয় তোর জন্য খাবার রেডি করে রেখেছি।”

মায়ের সাথে না পেরে রাজ খাবারগুলো খেয়ে ঘরে আসে।ঘরে আসার পর কল করে তার পার্সোনাল অ্যাসিসট্যান্ট পিয়াশ এর কাছে।লোকটি প্রথম কল রিসিভ করে না।রাজ রেগে এসএমএস দেয়,”বসের কপালে বউ জোটেনি আর বেটা তুমি বউ নিয়ে মধুচন্দ্রিমা করতে ব্যাস্ত!মধুচন্দ্রিমা ছেড়ে তাড়াতাড়ি আমার কল ধরো।তানাহলে কাল থেকে এই মধুচন্দ্রিমা বাড়িতে নয় রাস্তায় ভিকিরির সামনে করবে।”

এর ঠিক পাঁচ মিনিট পর কল ব্যাক করলো পিয়াশ।রাজ বিছানায় মাথা এলিয়ে কল রিসিভ করে বলে,”পাঁচ মিনিট দেরি হয়েছে।এর মানে কাল থেকে তুমি তোমার বউয়ের সাথে এক ঘরে ঘুমাবে না।তুমি এক ঘরে তোমার বউ আরেক ঘরে।”

বসের মুখে এমন কথা শুনে গলা শুকিয়ে গেলো পিয়াশের।শুধু বস হলে মানা যায় এটা তো মন্ত্রী বস।

রাজ আবার বলে,”আমার ইনফরমেশন গুলো কোথায়?আদৌ কি আমার মধুচন্দ্রিমার রানির তথ্য নেওয়া হয়েছে নাকি নিজেরটা পেয়ে আমার ব্যাপারে ভুলে গেলে?এমনটা করলে কিন্তু তোমার বউকে অন্যের বউ বানিয়ে তোমাকে আনার সাথে দেবদাস করে রেখে দিবো।”

পিয়াশ হাসবে নাকি কান্না করবে নাকি ভয় পাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।এই শাহমীর রাজ যেমন রাগী তেজী ঠিক তেমন লাগামহীন।রাজকে আর কিছু বলতে না দিয়ে পিয়াশ বলে,”পেয়েছি বস।সকল তথ্য পেয়েছি আমি। ম্যামের নাম মেহেরুন জাহান মায়া।বাবা মা ঢাকাতে থাকেন না,তারা গ্রামে থাকেন। ম্যাম ঢাকাতে এসেছে আজ সাত বছর হয়েছে।ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।নিজস্ব ব্যাবসা ছিলো তাই সেই ব্যাবসার হাত ধরেই এত বড় সফলতা পেয়েছে।গুলশানে বাড়ি করেছে সে নিজে।লোকেশনটি আপনার বাড়ির থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের দুরত্বেই।”

“গাধা,সব গড়গড় করে বলছো আর এটা বলছো না যে সে সিঙ্গেল নাকি মিংগেল!”

“উনি সিঙ্গেল স্যার।বায়োডাটা তে সিঙ্গেল শো করেছে। আর ওনার ফ্যাক্টরিতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি উনি এখনও বিবাহ করেন নি।”

“ভেরি গুড ইনফরমেশন।এরপর থেকে মায়াবতীর সকল ইনফরমেশন আমাকে দিবে।ও কখন কোথায় যায় কি করে কার সাথে মিশে সবকিছু। আর হ্যা বউ থেকে সাত দিনের জন্য দূরে থাকবে এটাই তোমার শাস্তি।তানাহলে কিন্তু পার্মানেন্ট বউ হারাবে।এরপর থেকে সঠিক সময়ে আমার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবে,রাখছি।”

বলেই কল কেটে দেয় রাজ। পিয়াশ হতাশ হয়ে বসে থাকে। পিয়াশের বউ মৌ বলে,”কি হয়েছে?”

“আর কি হবে!সাইকো বস আমার।নিজের ভালোবাসার তথ্য পায়নি বলে আমাকে বউ ছাড়া সাতদিন অন্য ঘরে থাকার আদেশ দিয়েছে।তানাহলে নাকি তোমাকে অন্য কারো বউ করে দিবে।কত শখের বউ আমার।”

বলেই কপাল চাপড়ায় পিয়াশ। মৌ মিটমিট হাসতে থাকে।কারণ মৌকে তুলে নিয়ে বিয়ে করে পিয়াশ।বিয়ের পর এক মাস মৌ চুপ ছিলো পরে আস্তে আস্তে সেও পিয়াশকে ভালোবেসে ফেলে।

দুপুরে~~~
সরদার বাড়িতে সবাই নিরবতা পালন করে।রাজ বাইরে থেকে মাত্র এসেছে খাবার খেতে।সবাইকে চুপচাপ দেখে জিজ্ঞাসা করে,”কি হয়েছে?”

মাহমুদ সরদার বলেন,”হসপিটাল থেকে কল এসেছে টিভিতে নিউজ হয়েছে।সবাই বলছে আমাদের ফ্যাক্টরি নাকি জালিয়াতি করে টাকা কামাই করে।খাবারে এক্সট্রা মেডিসিন ও নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে আমরা খাবারের পরিমাণ বৃদ্ধি করি।”

“জনগন একটু ভুল বলেছে। আমরা করি না এগুলো,করে তোমার ছোট ভাই।”

মোহন সরদার ক্ষিপ্ত সুরে বলেন,”ব্যাবসার ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য অনুসারে দ্রব্যসামগ্রীর ব্যাবহার হয়।তুমি এগুলোর কি বুঝবে?তুমি তো তোমার মত মন্ত্রী হয়ে বসে বসে জনগণের সেবা কর।এখন পরিবারের লোক বিপদে পরেছে।তাকেও সাহায্য কর।

হামি তুলতে তুলতে রাজ বলে,”কেনো?আমি কেনো?তোমার গর্বের বংশধর কোথায়? যার জন্য প্রথম বউ ও সন্তান ছাড়লে।ওহ একটু ভুল হয়েছে।ওই ছেলেকে তো বিয়ের আগে জন্ম দিয়েছিলে।তো সেই গুণধর ছেলেকেই বলো যে তোমাকে সাহায্য করতে।ছেলেকে বিদেশ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করিয়েছো এখন বাবার ব্যাবসা দেখুক।”

রুদ্র বাইরে থেকে মাত্র ঘরে ঢুকতে থাকে।ঘরে এসেই রাজের কথা শুনতে পায়।রাজকে উত্তর দিতে রুদ্র বলে,”সরি ব্রো,এসব ফ্যামিলি বিজনেস আমি দেখতে পারবো না।আমি চিল মুডে আছি।আপাতত আমি আমার মতো হ্যাপি।”

রাজ হেয়ালি করে উত্তর দেয়,”As your wish.”

মোহন সরদার রুদ্রের উপর রেগে বলেন,”অপদার্থ ছেলের জন্ম দিয়েছি আমি।”

রুদ্র যেনো মোহন সরদারের কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে নিলো।

(রুদ্রর পুরো নাম রৌদ্রদ্বীপ রুদ্র।এক বছর হলো গ্র্যাজুয়েশন করেছে।শাহানা পারভীন যখন মায়াকে গর্ভে ধারণ করেন মোহন সরদার তখন মিসেস সোনালীর দিকে ঝুঁকে থাকতেন।দুই মাস সম্পর্কের পর মা হওয়ার খবর পান মিসেস সোনালী। যার ফল এই রুদ্র।মোহন সরদার শাহানা পারভীনকে অনেকভাবে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলেন।কিন্তু উপায়ন্তর না পেয়ে সোনালীকে বিয়ে করে এনে অপমান করে শাহানা পারভীনকে তাড়িয়ে দেন।ডিভোর্সের কয়েকদিন পর রুদ্রকে ওর নানুর কাছ থেকে এনে পরিবারে রাখা হয়।তারপর গ্র্যাজুয়েশনের জন্য রুদ্রকে বিদেশ পাঠানো হয়।)

মিসেস মালিনী রাজের কাছে এসে রাজের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”বাবা রাজ,এমন করে না।কাকা তো তোমার আপনজন।সে বিপদে পড়েছে তোমার এখন তাকে সাহায্য করা উচিত।তুমি একজন মন্ত্রী হয়ে যদি পরিবারের কাজেই না আসতে পারো এতে লোকে কি বলবে?”

কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে রাজ বলে,”ওকে মা।আমি দেখছি কি করা যায়।But this is first and last help.”

সবাই এতেই খুশি।খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাজ চলে গেলো।নিজের অফিসে এসে চেয়ারে বসে ভাবতে থাকে মায়ার কথা।ঠিক তখনই পিয়াশ এসে বলে,”ম্যামের আরও কিছু আপডেট পেয়েছি স্যার।”

ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে রাজ তাকালো পিয়াশের দিকে।বলে,”কি জানতে পেরেছো?”

“ম্যাম সকাল বেলা মর্নিং ওয়াক করে।তারপর ফিটনেসের জন্য জিম করে তারপর সময়মত ব্রেকফাস্ট করে অফিসে যায়। ম্যামের তিনটি ফ্যাক্টরি আছে।যেগুলোর একটি চট্টগ্রাম একটি ঢাকা ও আরেকটি শিবচরে।ম্যাম শিবচরে থাকতেন।গ্রামে ম্যামের নানুবাড়ি আছে। ওদিকে ম্যামের আত্মীয়রা দেখাশোনা করে।ম্যাম ঢাকার ফ্যাক্টরি দেখাশোনা করেন আর এমনিতেও মাসে মাসে ম্যাম টুর দিতে যায় ওদিকে।দুপুরের দিকে ম্যাম তার নিজস্ব অনাথ আশ্রমে যেয়ে খেয়ে আসেন।ম্যাম একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন।আশ্রমটি অনেক পুরনো তাদের পারিবারিক।ম্যাম ছোট ছিলেন এবং একা তাই কয়েক বছর আশ্রমটি বন্ধ ছিলো।এখন আবার আশ্রম ওপেন করেছেন।ম্যাম সবসময় টাইম মেইনটেইন করে চলে।সময়ের হেরফের করা তার পছন্দ না।সবথেকে ইন্টারেস্টিং পার্ট ম্যাম নিজেই একজন ফাইটার।একদম আপনার সাথে মানানসই।শুধু পার্থক্য আপনি বিদেশ থেকে ফাইট শিখেছেন আর ম্যাম বাংলাদেশের সংস্থা থেকে ফাইট শিখেছে।”

পিয়াশের বলা প্রতিটি কথা চোখ বন্ধ করে মনোযোগ দিয়ে শুনলো রাজ।তার মায়াবতীর বিষয়ে এতকিছু জেনে ভীষণ ভালো লাগছে।তার মায়াবতীও ফাইট জানে।তবে রাজের শক্তির কাছে এই ফাইট একদম ফিকে পড়ে যাবে।তাতে কি হয়েছে মায়াবতী অন্যদের থেকে তো নিজেকে সুরক্ষা করতে জানে।এটাই অনেক।

পিয়াশ রাজের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে বলে,”স্যার!”

চোখ বন্ধ রেখেই রাজ বলে,”হুম,সবকিছুই মন দিয়ে শুনেছি।এবার তুমি যেতে পারো। আর শুনো,সাত দিন বউয়ের থেকে দূরে থাকতে হবে না।শুধু পাঁচদিন দূরে থাকবে।”

পিয়াশ আশাহত হয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে বলে,”সাইকো মন্ত্রী।নিজে বউ জুটাতে পারলো না এই আটত্রিশ বছর বয়সে।আমাকেও বউয়ের কাছে থাকতে দিবে না।কপাল থাকা লাগে কপাল। যার কপালে সাইকো মন্ত্রী জুটে সে কি আর পারে মধুচন্দ্রিমা করতে!”

চলবে…?