মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব-১১

0
7

#মায়াবতীর_ইচ্ছা
#পর্ব_১১
#ইশরাত_জাহান
🦋
দেখতে দেখতে কেটে গেলো তিনদিন।এই তিনদিনে ভিন্ন কাজে ব্যাস্ত ছিলো মায়া।সাথে করে ছোটাছুটি করছে রাজ।ঢাকায় দুইজনের পিছনে লোক লাগিয়ে রেখেছে।এক মোহন সরদার আর দুই মোহন সরদারের পুত্র রৌদ্রদ্বীপ রুদ্রের দুর্বলতা হিয়া।দুর্বলতা কি না মায়া জানে না।হতেও পারে রুদ্রের মোহ।তবুও হিয়ার কাছে যাওয়া রুদ্রের উদ্দেশ্য। আর এটাই মায়ার চাবিকাঠি।তারেকের সাথে কয়েকদিনে হিয়ার ভালোই বন্ধুত্ত্ব গড়ে উঠেছে।এখন শুধু রুদ্রের ভেঙ্গে পড়া বাকি। আর এদিকে মোহন সরদারকে নিয়ে ভাবছে।সেদিনের মিটিংয়ে মোহন সরদার জিততে পারেনি।কিন্তু মায়ার লোকও সেদিন হেরে গিয়েছিলো। ডিল পেয়েছে অন্য কোম্পানি থেকে।মায়া বুঝতে পারছে না তার পিছনে কে এমন আছে যে তার শুভাকাঙ্খী।ব্যালকনিতে বসে এগুলো ভাবছিলো মায়া।মায়ার ভাবনার ছেদ ঘটলো কলিংবেলের আওয়াজে।রাতের খাবার আসার সময় হয়েছে।ভেবে মায়া বলে,”come in.”

ওয়েটার ভিতরে এসে মায়াকে বলে,”রাজ স্যার আপনাকে এইগুলো দিতে বলেছে ম্যাম।”

একটি প্যাকেট মায়ার হাতে দিয়ে বলে।মায়া প্যাকেটটি হাতে নিয়ে চোখ দিয়ে ওয়েটারকে চলে যেতে ইশারা করে।ওয়েটার চলে যায়।মায়া প্যাকেট খুলে দেখে এর ভিতর পিংক কালারের সুন্দর কারুকাজের জর্জেট শাড়ি।সাথে সাথে মায়ার ফোনে কল আসে।মায়া ফোন হাতে নিয়ে দেখে তাতে লেখা ‘মন্ত্রী মশাই’।মায়া ফোন রিসিভ করতেই রাজ বলে,”ওয়েটিং ফর ইউ মায়াবতী।”
“ফর হোয়াট?”
“ক্যান্ডেল লাইট ডিনার।”
বলেই কল কেটে দেয় রাজ।এখন কল না কাটলে মায়া আর্গুমেন্ট করবে। আর পরে রাজ এসে মায়াকে জোর করে নিয়ে যাবে।এটা মায়াও জানে।স্মিত হেসে মায়া শাড়ি পরে রেডি হয়।গার্ডদের লোকেশন দিয়ে বলে দেয় চারপাশে ভালোভাবে খেয়াল রাখতে। যাতে করে ঝামেলা না হয়।

রেডি হয়ে মায়া চলে আসে রাজের দেওয়া এড্রেসে।মায়ার হিলের শব্দ আসতেই চারপাশ থেকে আলো জ্বলতে শুরু হয়।চারপাশ থেকে গিটারের আওয়াজ আসতে থাকে।রাজ তাকিয়ে দেখতে থাকে তার মায়াবতীর আগমন।মায়া রাজের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে।রাজ ব্ল্যাক কালারের ব্লেজার সেট পড়ে আছে।রাজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করল মায়া।পারফেক্ট জেন্টেলম্যান লুকস রাজের।মায়া রাজের কাছে আসতেই রাজ চোখ টিপ দিয়ে বলে,”লেডি কিলার।”

ম্লান হাসে মায়া।রাজ হাত বাড়িয়ে দেয় মায়ার দিকে।মায়া রাজের হাতের উপর নিজের হাত রাখে।মায়ার হাত ধরে রাজ মায়াকে টেবিলের সামনে বসিয়ে দেয়।খুব সুন্দর ভাবে চারপাশ সাজানো।রক্ত লাল গোলাপের সাথে সাদা গোলাপগুলো মিক্সড করে ঝাড়বাতি দিয়ে রুমটি সাজিয়েছে।কিছু কিছু জায়গায় ছোট ছিট ডিজাইন করা মোমবাতি জ্বলতে থাকে।টেবিলের উপরে ভিন্ন রকমের খাবার।কক্স বাজারের আইটেমগুলো খুব সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রাখা এই টেবিলে।মায়াকে টেবিলের এক প্রান্তে বসিয়ে দিয়ে তার সামনের চেয়ারে বসে পরে রাজ।দূরত্ব প্রায় চার/পাঁচ হাত।চেয়ারে বসে আঙুলে তুরি বাজিয়ে ইশারা করে সার্ভেন্টদের।সাথে সাথে দুজন সার্ভেন্ট এসে মায়া ও রাজকে খাবার পরিবেশন করে দেয়।রাজ তার ডান হাত দিয়ে ইশারা করে মায়াকে বলে,”লেটস ইনজয় দ্যা সী ফুড।”

মায়া খাওয়া শুরু করে।রাজ মায়ার দিকে তাকিয়ে নিজের মতো করে খেতে থাকে।ডিনার শেষে রাজ মায়ার সামনে আসে।তারপর হাত বাড়িয়ে মায়াকে বলে,”ড্যান্স?”

মায়া নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাজের দিকে। যা দেখে রাজ মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে তোলে।রাজের হাতের উপর নিজের হাত রেখে মায়া দাড়িয়ে পড়ে।রাজ আবার তুরি বাজায়।সাথে সাথে চারপাশ থেকে স্লো ভয়েসের গান বাজতে থাকে।রাজ মায়ার ডান হাত নিজের কাধে রেখে মায়ার কোমরে নিজের বাম হাত রাখে,তারপর মায়ার বাম হাতের সাথে নিজের ডান হাত এক করে গানের তালে ড্যান্স করতে থাকে।

____
নির্জন নিরিবিলি পরিবেশ।শীতল হাওয়ার সাথে পোকার কিচির মিচির শব্দ।সমুদ্র সৈকত থেকে কিছুটা দূরে একটি গুদাম ঘর।সেখানে হাত পা বাঁধা অবস্থায় বসে দুটি মানব। বাঁধা অবস্থায় ছোটাছুটি করছে নিজেকে রক্ষার জন্য।মানব দুজনকে বেধে সামনে দাড়িয়ে আছে কিছু দেহরক্ষী।অপেক্ষা তাদের মালিকের আসার।চেয়ারে বসা মানব দুটির একজন বলে,”আমাদের শত্রুতা তো তোমাদের সাথে না।তাহলে আমাদেরকে কেন আটকে রেখেছো?”

“আমার মায়াবতীর সাথে তো তোদেরও কোনো শত্রুতা নেই।তারপরও কেনো খুন করতে এসেছিলি?”
লোকটির প্রশ্নে দূর থেকে বাতাসের সাথে ভাসতে থাকে কথাগুলো।কাঙ্ক্ষিত লোকটিকে দেখা যাচ্ছে না। মানব দুজন খুঁজতে থাকে কে বলছে এই কথাগুলো।দেখা যাচ্ছে না লোকটিকে তবে তার কথাগুলো শোনা যাচ্ছে।

লোক দুজনের চোখ দিয়ে চারপাশে পর্যবেক্ষণ করা দেখে পিয়াশ বলে,”আব্বে শা’লা।তোদের আজরাইল আসছে।এভাবে চাতক পাখির মতো আজরাইলকে দেখার শখ জেগেছে কেনো?”

পিয়াশের কথা শুনে লোক দুজন শুকনো ঢোক গিলতে থাকে।অতঃপর দেখতে পায় সামনে লম্বা আকারে এক ছায়ামূর্তি। আস্তে আস্তে তার আগমন অতি নিকট হতে থাকে।লোক দুজনের কাছে এগোতে এগোতে রাজ বলে,”কাম অন পিয়ু বেইবী!আমার মায়াবতীর জীবনের আজরাইল হয়ে আসতে চেয়েছিলো এখন তারাই পড়েছে আজরাইলের হাতে।বেচারা তো জানেই না যে মায়াবতীর রক্ষা কবচ স্বয়ং মন্ত্রী মশাই নিজে।”

রাগ মিশ্রিত উচ্চস্বরে কথাগুলো বলেই ভিতরে এন্ট্রি নেয় রাজ।মুখে ফুটেছে এক ভিলেন হাসি।রাজকে দেখে লোক দুজন বলে ওঠে,”মন্ত্রী শাহমীর রাজ!”

পিয়াশ বলে,”তোদের আজরাইল।”

“আমাদের ভুল হয়ে গেছে।আমরা আর এই ভুল করব না। দয়া করে ছেড়ে দিন।”
বলেই আকুতি মিনতি করতে থাকে লোক দুজন।রাজ শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,”তোদের প্রতি আমার লোকজনের দৃষ্টি না থাকলে তো তোরা আনার মায়াবতীকে মেরে ফেলতিস।তখন কি আমি চাইলে পেয়ে যেতাম আমার মায়াবতীকে?তোরা তো আমার মায়াবতীকে মারতে একবার দুইবার না বারবার চেষ্টা করেছিস।কি ভেবেছিস আমি কিছুই জানি না?”

বলেই পকেট থেকে বন্দুক বের করে রাজ।এই তিন দিনের কথাগুলো ভাবতে থাকে বন্দুকের দিকে তাকিয়ে।
(মায়া ও রাজ যখন ফ্যাক্টরি থেকে হোটেলে ব্যাক করে তখনই এদের দেখতে পায় রাজ।সাথে সাথে গার্ডদের কল করে সতর্ক করে দেয়।এর ভিতর একদিন মায়া একা একা আইসক্রিম পার্লারে যায়।রাজের লোক দেখতে পায় মায়ার দিকে এই লোক দুজন বন্দুকের নিশানা করে রেখেছিলো।রাজের গার্ড কিছু করতে যাবে তার আগেই কোথা থেকে কালো ধোঁয়া আসে। পরে মায়া নিজেই সেখান থেকে গায়েব হয়ে যায়।অনেক খোঁজাখুঁজির পর রাজ মায়াকে মায়ার রুমেই পেয়ে যায়।রুমে বসে আরাম করে আইসক্রিম খাচ্ছে মায়া।
রাজের লোকগুলোকে রাজ বলে দেয়,”এরা কোথায় কি করে আমাকে ডিটেইলস বলে দিবে।আমার মায়াবতীকে মারতে চেয়েছে।এর শাস্তি তো পেতেই হবে।”
রাজ ঠান্ডা মাথায় লোকগুলোর মালিককে আগে বেড় করতে চায়। আর তার থেকেও বড় কথা মেইন রাস্তায় হামলাকারীদের কিছু করলে রাজের ক্যারিয়ারে ঝামেলা হবে।সে তো কোনো না কোনো ভাবে এমনিতেই মায়াকে রক্ষা করছে।তাই রাজ সময় সুযোগ করে লোকগুলোকে এই গুদাম ঘরে বেধে রেখেছে।)

এগুলো ভাবতে ভাবতে রাজ গুলি তাক করে একটি লোকের সামনে।লোকটির কপাল বরাবর গুলির নিশানা টার্গেট করে বলে,”শাহমীর রাজের যতদিন নিশ্বাস আছে তার মায়াবতীকে কেউ এক চুল পরিমান ক্ষতি করতে পারবে না।এই মন্ত্রী হওয়াটা যেমন আমার পেশা ঠিক মায়াবতী হলো আমার নেশা।”

বলেই পরপর দুইবার শুট করে দেয় লোকটির কপাল বরাবর।কপাল ছিদ্র হয়ে রক্ত ঝরতে থাকে লোকটির।লোকটির এই অবস্থা দেখে পাশে থাকা লোকটি কাপতে থাকে।রাজের দেহরক্ষীরা ভয়তে থরথর করছে। পিয়াশ বেচারা হানিমুন করতে এসে বউ থুয়ে এখানে খুন দেখতে ব্যাস্ত।মনে মনে বলে,”কোন দুঃখে যে বসের সাথে হানিমুন করতে এলাম!এর থেকে বস আমার প্রী হানিমুন করতো আর আমি বউ নিয়ে নিজের ঘরে প্রেম করতাম।”

লোকটিকে গুলি করে রাজ এক পৈচাশিক হাসি দেয়।তারপর বলে,”পিয়ু বেবী! আর ইউ আপসেট ফর ইউর সুইট মোমেন্ট?”

তোতলাতে তোতলাতে পিয়াশ বলে,”ন ন নো বস।”

“ওওও পিয়ু বেবী।আমি কোথায় ভাবলাম তোমার সুইট মোমেন্ট ওয়েস্ট হলো এই জা*য়ার দের জন্য।তাই তুমি রাগ করে এদের কিমা বানাবে। তা না!উল্টো তুমি দেখছি হানিমুনে এসে বসের ভয়তে কাপছ।এমন এসিস্ট্যান্ট আমার কোনো কাজের না। এসিস্ট্যান্টকে দেখে লোক কাপে এমন দেখেই আমি লোক হায়ার করব।”

পিয়াশ কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।কোনো সময়ই পারে না।এখন তো আবার তার বস মানে শাহমীর রাজ তার মায়াবতীর হয়ে রক্তখেলায় নেমেছে।মাথা গরম থাকলে যদি একটা গুলি তার দিকে চলে যায় তাহলে সে আর ফিরবে না।রাজের চোখ লাল রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।রাজ এমনিতেও শ্যাম বর্ণের এখন আবার অতিরিক্ত রেগে যাওয়াতে রাজের শরীরের শিরা উপশিরা সবকিছু ফুলে নীল রং ধারণ করেছে।রাজের কপালের দিকেও এক শিরা ফুলে উঠেছে।যেটা স্পষ্ট দেখতে পারছে পিয়াশ।এর আগেও একটি খুন রাজ দিনের আলোতে করেছিলো তার সামনে।পুরনো কথা মনে পরে পিয়াশ শুকনো ঢোক গিলতে থাকে।রাজ গুলির দিকে এবার তাকিয়ে মৃত লোকটির পাশের লোকটির দিকে তাকায়।বলে,”নাও দ্যা টাইম ইজ ইউর।”

বলেই শুট করতে যাবে তার আগেই পিছন থেকে পরপর দুটো গুলি ছেদ করে যায় লোকটির বক্ষ বরাবর।রাজ পিছনে তাকায় না।কারণ তার কিছুটা অনুমান হয়েই গেছে কে হতে পারে এই খুনি।

“আগেই বলেছিলাম মায়াবতীর মায়া মুখ দেখে ফেসে যাবেন না মন্ত্রী মশাই।এই মায়াবতীর জীবনে ধ্বংসবতী হয়ে এসেছে।এটা শুধু একটি ট্রেইলার দিলাম।”
বলেই বন্দুকে হালকা ফু দিলো মায়া। পিয়াশ রাজ সম্পর্কে অবগত থাকলেও বেচারা এবার দেবার সাথে দেবীকেও একই রূপে দেখে আতকে উঠে।মনে মনে বলে,”আজ একটা হায়ার এডুকেশন এর সার্টিফিকেট থাকলে আপনার থেকে আমি নিজেই পালিয়ে যেতাম,মন্ত্রী মশাই।”

মায়া আস্তে আস্তে হেঁটে রাজের পাশে এসে দাঁড়ায়।রাজের বরাবর দাড়িয়ে মায়া বন্দুক নিজের প্যান্টের পকেটে রেখে বলে,”মায়া নিজেকে রক্ষা করতে জানে,মন্ত্রী মশাই।জীবনে চলতে যেয়ে একা পথে সবকিছুই শিখে নিয়েছি।”

রাজ হো হো করে হেসে দেয়।বলে,”মাঠে নামার আগে তো প্রশিক্ষণ নিয়েই নামতে হয়,মায়াবতী।তুমি এই রাজের তাজ মহল।তোমার রূপের আগে তোমার এই দেমাক আমার ভালোবাসার প্রধান কারণ,মায়াবতী।”

মায়া একটি ঠাট্টার হাসি মুখে ফুটিয়ে তোলে।তারপর নিজের গার্ডদের বলে,”এই দুজনকে মাটি চাপা দেও।”

কথাগুলো বলেই চলে যায় মায়া।
(রাজের সাথে মায়ার নজরেও পড়েছিলো ওই লোকগুলো।মায়া নিজেও তার গার্ডদের সতর্ক করে দেয়।আইসক্রিম পার্লারে যাওয়ার আগে মায়া উপর থেকেই দুরবিন দিয়ে লোকগুলোকে দেখে নেয়।তারপর নিজের গার্ডের সাথে কথা বলে প্লান করে।তাই তো লোকগুলো মায়াকে শুট করার আগেই মায়ার লোক চারিদিকে কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে দেয়। আর তারপর খুঁজে পায় না এই হামলাকারীদের।আজকে গার্ড দ্বারা খোঁজ পায় তার উপর হওয়া হামলাকারীকে রাজ আটক করেছে।বাকিটা তো জানতে পারলেন।)
_____
মায়ার যাওয়ার পর পিয়াশ এসে রাজকে বলে,”ছোট মুখে একটি বড় কথা বলি ,বস?”

রাজ তাকায় পিয়াশের দিকে।চোখ দিয়ে ইশারা করে,কি? পিয়াশ বলে,”এটা আপনার মায়াবতী না এটা হলো রক্তবতী।মন্ত্রীর সামনে কিভাবে খুন করে গেলো।সাহস আছে বলতে হয়।”

ঠোঁট বাকা করে হেসে রাজ বলে,”এটুকু দেখেই আমার মায়াবতীকে রক্তবতী বলে ফেলছো।সামনে তো আরো কিছু দেখবে।রেডি থেকো একেক চমকের জন্য।”

বলেই গুদাম ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে রাজ। পিয়াশ বলে,”সাইকো রাজার সাইকো রাণী।”

চলবে..?