মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব-২৮

0
487

#মিষ্টিমধুর_প্রতিশোধ
#পর্বঃ২৮
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ইভানা রুমে চুপচাপ বসেছিল। এমন সময় ফাহিম রুমে প্রবেশ করলো। ফাহিমকে দেখে ইভানা কিছুটা অভিমান নিয়েই বললো,
‘আপনি সারাদিন এত ব্যস্ত থাকেন কেন? আমার সব বান্ধবীদের কাছে শুনি তারা রোজ কোথাও না কোথাও ঘুরতে যায়। আর আমি সারা দিব বাড়িতে বসে বসে বোর হই। লাইফে কোন এন্টারটেইনমেন্টই নাই।’

ফাহিম মুচকি হেসে বলে,
‘ওহ, এইবার বুঝলাম। তুমি ঘুরতে যেতে চাও তাইতো?’

‘চাই তো। তাছাড়া আমাদের হানিমু…’

কথাটা বলতে গিয়ে জড়তার কারণে আটকে যায় ইভানা। তার ভীষণ লজ্জা করতে থাকে। কি একটা কথা বলে ফেললো এখন ভাবলেই লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে। ইভানা সম্পূর্ণ কথাটা না বললেও ফাহিমের যা বোঝার বোঝা হয়ে গিয়েছিল। সে ঠোঁট টিপে হাসল কিছু সময়। অতঃপর বলল,
‘তোমার হানিমুন করার এত শখ হয়েছে আমায় আগে বলতে পারতে। তাহলে তোমায় কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতাম গ্রামের বাড়ি না নিয়ে গিয়ে। ওখানে যা কাহিনি হলো! আরেকটু হলেই দ্বিতীয় বিয়ে করতে হতো। এখন তো আমার ছুটিও শেষ। তাই বাইরে যাওয়াও যাবে না। তবে আজ আমি ফ্রি আছি। তুমি চাইলে কোথাও ঘুরতে যেতে পারি।’

ইভানা মুহুর্তেই খুশি হয়ে যায়। বলে,
‘আপনি সত্যি বলছেন? ঘুরতে নিয়ে যাবেন আমায়?’

‘হুম চলো হাতিরঝিল থেকে ঘুরে আসি।’

ইভানা যেন এটারই অপেক্ষায় ছিল। ফাহিম বলতে না বলতেই দ্রুত তৈরি হতে শুরু করে। লাল কালারের একটি লং গ্রাউন পড়ে নেয়। অষ্টাদশী কিশোরী হওয়ায় এসবে তাকে বেশ ভালোই মানায়। ফাহিম ইভানাকে দেখে নতুন করে মুগ্ধ হয়। তার কাছে এসে বলে,
‘এখন তো আমার ঘুরতে যেতে একদম ইচ্ছা করছে না। অন্যকিছু করতে মন চাইছে।’

ইভানা ফাহিমের মনোভাব বুঝতে পেরে বলে ওঠে,
‘আপনি যেটা ভাবছেন সেটা কিন্তু মোটেও হবে না বলে দিলাম। আমি কত কষ্ট করে তৈরি হলাম ঘুরতে যাওয়ার জন্য। প্লিজ চলুন না।’

ফাহিম নিজেকে সামলে নেয়। ইভানাকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। ড্রয়িংরুমে এসে ফারজানা বেগমসহ ঝর্ণার পুরো পরিবারের মুখোমুখি হয়। ফারহানা বেগম দুজনকে একসাথে বের হতে দেখে বলেন,
‘তোরা দুইজন যাচ্ছিস কই?’

ফাহিম বলে,
‘একটু বাইরে ঘুরতে যাচ্ছি।’

‘আচ্ছা সাবধানে যাস।’

ঝর্ণা এরমধ্যে বলে ওঠে,
‘বাহ, পিচ্চি। বউকে নিয়ে তো খুব এনজয় করছিস লাইফ।’

ফাহিমও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে বলে ওঠে,
‘তুমিও তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে নাও। তারপর নিজের জামাইকে নিয়ে এনজয় করিও।’

‘তা তো করবোই। সেজন্যই তো এসেছি।’

‘মানে?’

‘মানে পরে বুঝবি। আগে যেখানে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিস সেখানে যা।’

ফাহিম আর কথা না বাড়িয়ে ইভানাকে নিয়ে রওনা দিলো।

৫৫.
ইভানাকে নিয়ে বেশিদূর আসতে পারলো না ফাহিম তার মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। দুজনে রিক্সাতে করে আসছিল। রিক্সার পাল্লা উঠিয়ে দিয়ে গায়ে প্লাস্টিক জড়িয়ে নিলেও দুজনে যথেষ্ট ভিজে যাচ্ছে। ফাহিম বিরক্ত হলো বেশ। বলল,
‘ধুর, আজকেই বৃষ্টিকে আসতে হলো। আমি তো আকাশের দিকে খেয়াল না করেই বেরিয়ে পড়লাম।’

ইভানার অবশ্য বৃষ্টি নিয়ে কোন সমস্যা নেই। বরং বৃষ্টি তার কাছে ভালোই লাগে। এখন তো ইভানার ইচ্ছা করছে বৃষ্টিতে ভিজতে। ফাহিমের সাথে বৃষ্টিবিলাস করতে। মুডটাকে রোম্যান্টিক করার জন্য সে ফোন বের করে রিমঝিম ধারাতে গানটা চালিয়ে দিল। বৃষ্টির শব্দকে ডিঙিয়ে মোবাইলের সাউন্ড খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না। ইভানা আফসোস করতে লাগল। যদি তারা গাড়িতে থাকত তাহলে সাউন্ড বক্সে গানটা খুব ভালো শোনা যেত।

বিষন্ন মনটাকে প্রসন্ন করার জন্য ইভানা ফাহিমের কাছে আবদার করে বলল,
‘চলুন না আমরা একসাথে বৃষ্টিতে ভিজি?’

‘হোয়াট? একদম না। আমরা কি ছোট বাচ্চা নাকি? তাছাড়া এই আষাঢ়ের বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হতে পারে।’

ইভানার মন খারাপের পরিমাণ বেড়ে গেলো ফাহিমের কথা শুনে। সে গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। স্ত্রীর এমন অবস্থা দেখে স্বামীর মনে দয়া হলো৷ তাইতো ফাহিম ইভানাকে নিয়ে রিক্সা থেকে নামলো। অতঃপর দুজনে মিলে বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে লাগল। বিন্দু বিন্দু জলরাশি এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছিল দুজনকে। এ যেন এক অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হঠাৎ করেই ইভানা ও ফাহিম একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। তাদের এই অপলক তাকিয়ে থাকার মাঝেই হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালো। ইভানা ভয়ে ফাহিমের বুকে মাথা গুজল। ফাহিমের হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগল। ফাহিমও চোখ বন্ধ করে জড়িয়ে ধরে নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে। সে চাইছিল সময় যেন এখানেই থমকে যায়! এই অপূর্ব দৃশ্য যেন স্থায়ী হয় যুগের পর যুগ, শতকের পর শতক। যার সাক্ষী হোক পুরো পৃথ্বী।

৫৬.
ফারহান ইতিমধ্যেই বাড়িতে ফিরে এসেছে। সদর দরজা পেরিয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই জিয়াউল ইসলাম তাকে দেখে বলে উঠল,
‘আরে ইয়াং ম্যান এসো এসো, তোমাকে নিয়েই তো কথা হচ্ছিল।’

ফারহান কিছুটা অবাক হয়ে বলে,
‘আমাকে নিয়ে কি কথা হচ্ছিল?’

ফাতেমা খানম আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন,
‘তোমাকে আমার মেয়ের জামাই করতে চাই। তোমার মারও খুব পছন্দ আমাদের ঝর্ণাকে। আশা করি তোমারও ওকে পছন্দ হবে। ঝর্ণার মধ্যে সব যোগ্যতা আছে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের বউ হওয়ার।’

ফারহানের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এমনিতেই সে আদাজল খেয়ে নেমেছে তোহাকে নিজের করে নেওয়ার জন্য। সেইজন্যই তাকে কত কাঠখড় পো*ড়াতে হচ্ছে। তারমধ্যে আবার নতুন ঝামেলা এসে হাজির। ফারহান বিরক্তিমাখা মুখে বলে উঠল,
‘জ্বি, না। ঝর্ণাকে আমি আমার যোগ্য মনে করি না। আমার স্ত্রী হিসেবে আমি এমন একজনকে চাই যে রূপে গুণে অতুলনীয় হবে। আপনাদের মেয়ে গুণে যেমন তেমন কিন্তু রূপে মোটেই আমার মনের মতো নয়। ওকে ওর চেহারা আয়নায় দেখতে বলিয়েন। শ্যামলা গায়ের রং তার উপর আবার মুখভর্তি ব্রণ। এমন মেয়েকে আমার পাশে মানাবে না।’

ফারহানের কথা শুনে সবাই হতবাক হয়ে গেলো। ঝর্ণার চোখে তো জলই চলে এলো৷ আজ অব্দি কেউ তাকে এভাবে অপমান করে নি। হ্যাঁ, তার গায়ের রং ফর্সা নয় তবে উজ্জ্বল ফরসা, যা তার শরীরের গঠন অনুযায়ী মানানসই। মুখে ইদানীং ব্রণ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তাই বলে এসব নিয়ে তাকে অপমান করবে। ভালোবাসার মানুষটার থেকে এমন অপমান শুনে ঝর্ণার মনটাই ভেঙে গেল। চোখের জল যেন বাধা মানতে চাইছিল না। তবুও ঝর্ণা তার চোখের জলকে কার্নিশ বেয়ে নামতে দিলো না। তার আগেই লেপন করল।

ফাতেমা খানম রেগে বললেন,
‘কোন সাহসে আমার মেয়ের নামে এরকম কথা বলছ তুমি? ছিলে তো গ্রামের সাধারণ ছেলে। ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে কি সা’পের পাঁচ পা দেখেছ? আমাদের মেয়ে লাখে একটা।’

ফারহানের মেজাজ আরো গরম হয়ে গেলো। বোধজ্ঞান হারিয়ে বলল,
‘তো আপনার মেয়ের জন্য আমাকে পাত্র হিসেবে বেহা’য়ার মতো চাইতে এসেছেন কেন? আর কেউ কি নেই ওকে বিয়ে করার জন্য? নাকি কোথাও মু’খ কালো করে এসেছে জন্য আমার ঘা’ড়ে ঝুলিয়ে দিতে চাইছেন?’

ঝর্ণা গর্জে উঠে বললো,
‘ব্যস, থামো এবার। অনেক হয়েছে আর না। আমাকে যথেষ্ট অপমান করেছ তুমি ফারহান ভাই। আমি এত কিছু ডিজার্ভ করি না।’

বলেই উঠে দাঁড়ালো ঝর্ণা। ফারজানা বেগম ছেলেকে কিছু কঠিন কথা শোনালেন। কিন্তু সেগুলো ফারহান গায়ে মাখলো না। ঝর্ণা ফারহানের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। মলিন হেসে বললো,
‘ভালোবাসি তোমায়, খুব ভালোবাসি৷ সে ছোটবেলা থেকে। আজ বুঝতে পারছি তোমাকে ভালোবাসাই আমার জীবনে সবথেকে বড় ভুল ছিল৷ তাই নিজের মা-বাবার সামনে এভাবে অপমানিত হতে হলো। কিন্তু তুমিও মনে রেখো প্রকৃতি কখনো কোন হিসাব বাকি রাখে না। প্রকৃতি সবকিছুর শোধ তোলে। আজ আমাকে তুমি যেভাবে অপমান করলে একদিন এর থেকেও বেশি অপমানিত হবে তুমি। মিলিয়ে নিও আমার কথা। আমার ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দিলে তো, ভালোবাসার মানুষ কষ্ট দিলে কেমন লাগে সেটা তুমিও বুঝবে।’

কথাগুলো বলে পুনরায় নিজের চোখের জল মুছল ঝর্ণা। অতঃপর নিজের মা-বাবাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো ফারহানদের বাড়ি থেকে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨