মুগ্ধতায় তুমি আমি পর্ব-১৩

0
14

#মুগ্ধতায়_তুমি_আমি
লেখিকা: #ইয়ানূর_মাশিয়াত
#পর্ব_১৩ (উপহার 🤍)

আরশ যখন তার মাকে বললো আমি সন্তানসম্ভবা তখন তিনিও বেশ অবাক হন। কিন্তু খুশি হন খুব। শ্বশুর শাশুড়ি আমার সাথে স্বাভাবিক আচরণই করলেন। জানি না আরশ তাকে আমার বলা কথাগুলো বলেছিল কিনা। শাশুড়ি এরপর থেকে আমার প্রতি ভীষণ দুর্বল হয়ে যান। আমার খেয়াল রাখা শুরু করেন। জেনিসা সেদিন নেচে নেচে সারা বাড়ি মাথায় তুলেছে। আরশ ওকে বলেছিলেন , জেনিসা আমাদের বাসায় একটা ছোট্ট বাবু আনবো। তোমার একটা ভাই-বোন আনবো।

জেনিসা আরশকে বললো, ভাই আনবে নাকি বোন আনবে? নাকি দুটোই আনবে?

আমি হেসে ফেলেছিলাম ওর কথায়। ওকে কোলে নিয়ে বললাম, যখন আনবো তখন বলতে পারবো আম্মু।

কখন আনবে? কাল আনবে?

না। আরো অনেকদিন পর।

এক্ষুনি নিয়ে আসো না! আমি ওর সাথে খেলবো। অনেক মজা হবে।

আরশ বললেন, এক্ষুনি আনা যাবে না মামণি। আর ও অনেক ছোট থাকবে। তুমি ওর সাথে খেলবে কি করে?

কত ছোট থাকবে ও?

একদম ছোট।

জেনিসা তখন কি বুঝলো জানি না। বললো, আমি ওর নাম রাখতে পারবো?

আরশ হেসে ওকে তার কোলে নিয়ে গেল। বললো, ইয়েস! আমার মামণিই তো নাম রাখবে।

ও কিছুক্ষণ ভাবলো। আমরা দুজনেই অনেক আগ্রহ নিয়ে বসে আছি ও কি বলে। এরপর ও বললো, আমার ওর নাম জুবাইদ রাখবো।

আরশ বললেন , জুবাইদ তো ছেলেদের নাম। তোমার জন্য বোন আনলে তখন কি রাখবে?

আমার ভাই লাগবে। তুমি আমার জন্য ভাই আনবে। আমি একটা ভাই চাই।

আরশ বললেন, বোন ভালো লাগে না তোমার?

লাগে। কিন্তু আমার ভাই লাগবে। আমার জন্য ভাই না আনলে আমি দাদুর কাছে বিচার দিব।

আমি আর আরশ দু’জনেই হেসে ফেললাম। আরশ ওকে বললেন, ঠিক আছে তাই হবে।

.

এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান জন্ম দিলাম আমি। জেনিসা ওর নাম রাখলো জেনিফার। তার জন্য ভাই আনি নি দেখে মুখ ফুলিয়ে থেকেছিল প্রথমে কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ঠিক হয়ে যায়। সারাদিন জেনিসা জেনিফারের সামনে বসে থাকে। জেনিফারকে অনেক ধরনের কথা বলে। ওর কথার ধরন গুলো অনেকটা এরকম যে জেনিফারকে দ্রুত বড় হতে হবে, ওর সাথে খেলতে হবে , জেনিসার সাথে একসাথে স্কুলে যেতে হবে। জেনিফার কি আর এতকিছু বুঝে? জেনিসা যখন এসব বলে হয়তো সে এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকে নাহলে ঘুমায়। জেনিসা একা একাই বকবক করতে থাকে।

জেনিফার হওয়ার পর আমাকে নিয়ে ঢাকা চলে আসেন আরশ। আমার ততদিনে অনার্স শেষ হয়ে গেছে। আমাদের ঢাকা নিয়ে আসার পর আরশ বলেন,এখন বাসায় থাকলে মন আর রাজশাহীতে পড়ে থাকবে না।

আমি হেসে ফেললাম। বললাম, মন রাজশাহীতে ছিলো কেন?

উনি বললেন,বউ বাচ্চা দূরে থাকলে মন কি আর বাসায় থাকে? মেয়েদের না দেখে থাকাটা ধীরে ধীরে কঠিন থেকেও কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে। দূরে থাকলে মনে হয় আমার রূহ আমার কাছে নেই।

আর বউ? তাকে ছাড়া থাকা যায় তাই না?এক কাজ করুন আপনি। আপনি মেয়েদের নিয়ে থাকুন আমি ফিরে যাচ্ছি রাজশাহীতে।

বলে মিথ্যে রা’গ দেখিয়ে চলে যেতে চেয়েছিলাম আমি। আরশ আমাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, বউ তো বউই। বউ ছাড়াও থাকা যায় না। আমি ফ্যামিলি ছাড়া থাকতে চাই না মৌ। আমি আমার ফ্যামিলি নিয়ে খুব সুখে বাঁচতে চাই।

আরশকে আমি যতই দেখি ততই মুগ্ধ হই। উনি নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। বোনের মেয়ের জন্য উনি যা করেছেন আমাদের জন্য কতটুকু করবেন বোঝা বাকি নেই আমার। বোনের মেয়ে, নিজের মেয়ে, আমি কিংবা বাবা মা সবাইকে আগলে রাখেন। ওনার আপন মানুষগুলোকে খুব গুরুত্ব দেন উনি। ওনার সাথে বিয়ে হওয়ার পর কিংবা সত্যি জানার পর কখনোই উনি আমাকে আমার অতীতের ব্যাপারে কিছু বলেন নি আর না স্মরণ করেছেন। আমার শ্বশুর শাশুড়িও করেন নি। আরশের সাথে আমি ভালো আছি। আমাদের দুই সন্তানকে নিয়ে আমাদের ছোট সংসার সাজিয়েছি আমরা। কিন্তু আর বেশিদিন বাংলাদেশ থাকা হবে না আমাদের। মাত্র কয়েকটা দিন। এরপর ভিসা বের হলেই আমরা বাংলাদেশ ছেড়ে সুইজারল্যান্ড চলে যাবো। আরশ বাংলাদেশ থাকতে একদম ইচ্ছুক নন। ওনার কথা হচ্ছে যদি আমরা বাংলাদেশ থাকি তাহলে জেনিসা কিছুদিন পরেই জেনে যাবে জেনিসা আমার মেয়ে নয়। আশেপাশের লোকজন বলে দেবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই সুইজারল্যান্ড এ স্যাটেল হতে চাচ্ছেন উনি। আমরা সবাই চলে যাবো। আমার শ্বশুর শাশুড়ি, জেনিসা, জেনিফার সহ সবাই। সাথে আমার মাও যাবেন। আরশ নিজেই ওনাকে নেওয়ার কথা বলেছেন। মা নাকচ করে দিয়েছিলেন। আরশ বিভিন্ন উপায়ে রাজি করিয়ে ছেড়েছেন ওনাকে। আমার মাও প্রায়ই আমাদের বাসায় আশা যাওয়া করেন। জেনিসার সাথে এখন আমার মায়ের প্রচুর ভাব। মাকে আমি জেনিসা আর জেনিফার দুজনকেই সমান করে দেখতে বলেছি। নিজের নাতনি আর পরের নাতনি এমন মনোভাব থাকলে তা দূরে ফেলে দিতে বলেছি। আমার মা এখন তাই করেন।

কিছুদিন পর হঠাৎ আমার মা ঢাকায় এলেন। আমাদের বাসাতেই এলেন। আরশই তাকে নিয়ে আসলেন। ঘন্টাখানেক আগেই জরুরি কাজ আছে বলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। জামাই আর শাশুড়ি মিলে আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছে। ট্রেনের টিকেট কেটে মা ট্রেনে চড়েছেন আরশ তাকে নামিয়ে এনেছে। মা আসাতে জেনিসা ভীষণ খুশি। নানু নানু বলে মায়ের কোলে চড়ে গেলো। মা ওর সাথে কথা বলতে বলতে ভিতরে চলে গেলেন। আমি আরশকে জিজ্ঞেস করলাম, এই আপনার জরুরি কাজ?

আরশ আমার গাল টেনে দিলেন। বললেন, বউকে খুশি করা জরুরি কাজ থেকে কম কিসের?

আমি অবাক হলাম। বললাম, আমি আবার অখুশি ছিলাম কবে?

‘গত পরশু’

বলেই আরশ চলে গেলেন। আমার খেয়াল হলো। গত পরশু রাতে জেনিফার আমাকে একটুও ঘুমাতে দেয় নি। অনেক জ্বালিয়েছে মেয়েটা। এতো চিৎকার করে কেঁদেছে যে জেনিসাও উঠে গেছে। জেনিসা উঠে মনে করেছে আমি বাবুকে মে’রেছি তাই বাবু কাঁদছে। এরপর সেও কেঁদে ফেলেছে আর বার বার বলছে আমি বাবুকে মে’রেছি কিনা। দুই মেয়ে আমার মধ্যরাতে কাঁদার প্রতিযোগিতা লাগিয়েছিল। জেনিসা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে আর জেনিফার চিৎকার করে। জেনিসাকে বললাম আমি মা’রি নি ও ঘুম থেকে উঠে এভাবে কাঁদছে। ও শান্ত হলো কিছুটা। কেন কাঁদছে আমি নিজেও জানি না। কিন্তু জেনিফারকে তো আমি সামলাতে পারছিলাম না। আরশও উঠে বসে আছে। সে জেনিফারকে কোলে করে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলো। আমি জেনিসাকে আবার ঘুম পাড়াতে নিলাম। ওইদিকে আরশও জেনিফারকে ঘুম পাড়িয়ে ফেলেছে। দুইজনকে শুইয়ে যখন নিজে শুলাম ঘন্টার মাথায়ই আবার জেনিফার উঠে গেলো। আমি হুড়মুড়িয়ে উঠলাম। ওকে নিয়ে অন্যঘরে চলে গেলাম। আরশকে ডাকলাম না। তার সকালে অফিস আছে। আর ও ঘরে থাকলে নিশ্চিত ও আবার জেনিসাকে উঠিয়ে দিবে। মেয়েটাও সকালে স্কুলে যাবে। তাই আমি অন্যঘরে ওকে নিয়ে পায়চারি করতে লাগলাম। এই মেয়েটাও হয়েছে অনেক বদমাশ। গত ছয় মাসে আমাকে কম জ্বালায় নি। ও মাঝে মাঝেই রাতের বেলা এমন কেঁদে কুটে আমার ঘুমের বারোটা বাজায়। আমি যখন ওকে নিয়ে পায়চারি করছিলাম তখন আরশ এলেন। বললেন, ও আবার উঠে গেছে? দাও আমার কাছে দাও।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওনাকে বললাম, আমি সামলাতে পারবো। আপনি যান। সকালে আপনার অফিস আছে।

আরশ হেসে দিলেন। বললেন, আমি জানি। কিন্তু এটাও জানি যে আমার মেয়েকে সামলানোর শক্তি আমার বউয়ের নেই। আমাকে দাও। এভাবে কাঁদছে খাওয়াও নি?

খাইয়েছি তো। বুকের দুধ মনে হয় ঠিক মতো পাচ্ছে না। আমি দুধ বানিয়ে আনছি দাঁড়ান।

আমি দুধ বানিয়ে গিয়ে দেখি জেনিফার ঘুমিয়ে গেছে। ততক্ষণে ফজরের আযান দিচ্ছে। আমি দুধটা টেবিলের উপর রাখলাম। আরশ বললেন, ঘুমিয়ে গেছে। আবার উঠলে তখন দিও।

বাচ্চারা ঘুমের মধ্যেও খেতে জানে।

বলে জেনিফারের মুখের সামনে ফিডারটা ধরলাম। ও খাওয়া আরম্ভ করলো। আরশ অযু করে মসজিদে চলে গেলো। আমিও নামায পড়ে নিলাম। সেদিন সারাদিন আমার একটুও ভালো কাটে নি। রাতে ঠিকমতো না ঘুমাতে পারায় মাথা ধরে ছিলো সারাদিন। কিন্তু আমি অখুশি ছিলাম না। এইজন্য উনি আমার মাকে নিয়ে আসবেন? এটা তো হতে পারে না। নিশ্চয়ই এর পিছনে অন্য কোন কারণ আছে। আমি ওনার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এ কারণে তো মা আসে নি। আসল কারণ বলুন।

উনি হাসলেন। বললেন, বিয়ের দাওয়াত পেয়ে এসেছেন। উনি বলেছিলেন কার যেন বিয়েতে যাবেন। আমার মনে নেই। তুমি মাকে গিয়েই জিজ্ঞেস করো।

মা আবার কার বিয়েতে যাবেন? এখানে তো আমাদের কেউ নেই। তবে কার বিয়েতে যাবেন মা? আমি আরশকে কিছু না বলে মায়ের কাছে গেলাম। মা জেনিসার সাথে কথা বলছেন আর জেনিফার তার কোলে। আমাকে দেখে বললেন, কিরে ওদের ঠিকমতো খাওয়াস না? এই অবস্থা কেন দুজনের?

হতাশ হলাম আমি। আমার মা আর আরশের মা দুজনে যে একথা আমাকে কতবার বলেছে হিসেব নেই। ফোন করলে বা ওদের দেখলে তারা একথা বলবেই। দাদা নানাদের এটা বোধহয় একটা অভ্যাস। আমি মায়ের কথাকে এড়িয়ে গেলাম। বললাম, অনেকদিন পর দেখছো তাই এমন মনে হচ্ছে। বাদ দাও। কার বিয়েতে এসেছো তুমি? কোথায় যাবে?

মা হেসে বললেন, তোর রুমা আন্টির মেয়ে তিশা আছে না? ওর বিয়ে। আমাকে এক সপ্তাহ ধরে ফোন করে বলছে যেতে। বার বার করে বলেছে তোকে নিয়ে যেতে। তোর নাম্বার চেয়েছিল কিন্তু আমি দেই নি। বলেছি আমি সঙ্গে করেই নিয়ে যাবো। পরশু ওনার মেয়ের বিয়ে
তাই এসেছি।

মায়ের কথা শুনে সবার প্রথমে আমার মনে পড়লো অন্তরের কথা। এমন নয় যে অন্তরের কথা আমার আর কখনো মনে পড়ে নি। তার কথা আমার প্রতিদিনই মনে পড়ে। যখনই আমি আরশকে দেখি তখনই আমার তার কথা মনে পড়ে। আরশ তার থেকে কত আলাদা। যেখানে অন্তর একটা বাচ্চার জন্য আমাকে ডিভোর্স দিলো সেখানে আরশ তার বোনের জন্য নিজের সব সুখ বিসর্জন দিতে চেয়েছিল। দুটো মানুষের মধ্যে কত পার্থক্য! দুজন দু মেরুর মানুষ। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি আমি আরশকে পাওয়ার জন্য। আরশের চেয়ে ভালো আমাকে কেউ বুঝে না। সবসময় আমাকে গুরুত্ব দেন উনি। আমাকে বোঝার চেষ্টা করেন। আমার যত্ন নেন আর সবচেয়ে বড় কথা আমাকে ভালোবাসেন। আরশ আমাকে ভালোবাসেন। যদিও কখনো মুখে বলেন নি আমাকে। তবুও বুঝি আমি। ওনার আচরণেই প্রকাশ পায় আমাকে ভালোবাসেন উনি। আমাদের মা মেয়েদের বড্ড বেশি ভালোবাসেন উনি!

চলবে….