মুগ্ধতায় মুগ্ধ পর্ব-২৩

0
747

#মুগ্ধতায়_মুগ্ধ❤️
#Labiba_Islam_Roja
#Part_23
.
🍁
রাতুল ভাইয়ার প্রপোজাল পাওয়ার পর থেকে এ নিয়ে আর কারো সাথে কোনোকথা বলে নি তিথি।চুপচাপ ঘরের এক কোণে বসে আছে।এ পর্যন্ত বহুবার এই নিয়ে মোহনা মুগ্ধতা খোঁচাখোঁচি করেও ওর মুখ থেকে কিছু বের করতে পারেনি।এদিকে বেচারা রাতুল ভাইয়া বড় দুশ্চিন্তা আর অশান্তি নিয়ে দিন কাটাচ্ছে।মুগ্ধর এক্সামও আজ শেষ এরপরই লন্ডন চলে যাবে ভাইয়া।কিন্তু তাঁর আগে যদি হ্যাঁ হয় তাহলে বলতে প্রবলেম কি বুঝি না।যতবার তিথির সামনে দাঁড়িয়েছি ততবারই ইগনোর করে চলে গেছে।তাই এখন আর ডিস্টার্ব করছি না।
.
মিতুল আর আফিফ ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে নেক্সট মান্থে।মুগ্ধতার বিয়েতে সকলেই উনাকে দেখেছে।ভারী মিষ্টি নম্র ভদ্র একটা মেয়ে।ওকে দেখলে যে কেউ পছন্দ করবে।আঙ্কেল মনে মনে এমনই একজনকে সবসময় চেয়ে এসেছেন।ফাইনালি পেয়েও গেলেন এ নিয়ে খুশির অন্ত নেই উনার।অন্যানার জন্য সমন্ধ দেখছেন।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই কুটনি বুড়িকে বাসা থেকে বিদায় করতে চান আঙ্কেল।আঙ্কেলের এমন সিদ্ধান্তে অধরা আপু একটু বেশিই খুশি হয়েছে।
.
আষাঢ় মাস!সারাদিন ধরে মুষলধারে ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি পরছে।থামার নাম গন্ধও নেই।বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি কে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করে চলেছি।সন্ধ্যার এখনও বেশ কিছুটা সময় বাকী।অথচ আকাশের অবস্থা জানান দিচ্ছে সন্ধ্যা নেমে গেছে।সকালে যাওয়ার সময় হাজারবার বলেও মুগ্ধকে ছাতা দিতে পারিনি।সেই নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই আমার।একটু বৃষ্টির ফোঁটা পরলেও গা কাঁপিয়ে জ্বর আসবে উনার।তখন কষ্ট টা কে পাবে।আমার ভাবনার মাঝেই গাড়ি এসে ঢুকে পরলো গেইটে।হঠাৎ হর্নের শব্দ শুনে চমকে উঠলাম।উনার গাড়িটা দেখতে পেয়েই অজানা খুশিতে নেচে উঠলো আমার মন।রুম থেকে ছাতা নিয়ে যাবো কি যাবো না ভেবে চলেছি আমি।আমার ভাবনার মাঝেই রুমে মাথা ঝারতে ঝারতে ঢুকলেন উনি।এসেই ধুম করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন।আলমারি থেকে টাওয়াল বের করে উনার সামনে দাঁড়ালাম আমি।মুচকি হেসে বললাম……

~~~এক্সামের পাঠ চুকলো।নাকি আরও বাকি।

আমার হাসির জবানে মুচকি হাসি উপহার দিলেন উনি।কপাল থেকে হাত সরিয়ে বললেন……

_____হুম!শেষ আজকে এই প্যারা নামক বস্তু থেকে মুক্তি পেয়েছি।কিন্তু আজ খারাপ লাগা কাজ করছে।যাকে বলে প্রচন্ড রকমের খারাপ লাগা।

আমি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি উনার দিকে।এক্সাম শেষ হলে সবাই যেখানে খুশিতে নাচানাচি করে সেখানে উনার প্রচন্ড খারাপ লাগছে।আমি জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি……

~~~কিন্তু কেন…?আরও ক’দিন এক্সাম দেওয়ার ইচ্ছে ছিলো নাকি…?

মৃদু হাসি দিয়ে উঠে বসলেন উনি।গোমড়া মুখ করে বললেন……

_____উহুম!স্টুডেন্ট লাইফের সবথেকে বিরক্তি আর অসহ্যকর সিস্টেমের নাম এক্সাম।কোনো স্টুডেন্টই এক্সাম দিতে ভালোবাসে না।আমিও তাঁর ব্যাতিক্রম নই।কিন্তু নিজেরদের যোগ্যতা যাচাই বাচাই করার জন্য হলেও এর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

~~~তাহলে মন খারাপ কেন আপনার….?

কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন…….

_______রাতুল,হৃদয় আর আমি আমরা বাল্যকাল থেকেই তিন বন্ধু একসাথে বড় হয়েছি।তারপর কলেজ এডমিশন নেওয়ার পর কি করে স্নেহা আর রিদিও জুটে গেলো।সেই থেকে সবাই একসাথে আছি।কিন্তু আজকের পর থেকে সকলের রাস্তা আলাদা।এরপর কারোর সাথে সেভাবে যোগাযোগ হবে না।সবাই ব্যস্ত হয়ে পরবে নিজেদের নিয়ে।চাইলেও সবসময় আর আগের মতো দেখা সাক্ষাৎ হবে না।দেখ না রাতুল দু’বছরের জন্য চলে যাচ্ছে।হৃদয় চাকরিতে জয়েন করবে।আমি মা’য়ের সাথে অফিস দেখাশোনা করবো।স্নেহা রিদি ওদেরও একদিন বিয়ে হয়ে যাবে।নিজের ক্যারিয়ার সংসার সব সামলে তারপর!তারপর কি আর সময় হবে!হবে না।কিন্তু এটা ঠিক মনে পরবে।মাসে ছ’মাসে দেখা হবে কথা হবে কিন্তু বাড়ি ফিরার তাড়া থাকবে বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন উনি।
.
উনার কথাগুলো একদম ঠিক।সত্যি এই সংসারের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে এক সময় মানুষ নিজের চাইতে আপন ভাবা মানুষ গুলোকেও ভুলে যায়।বা মনে রাখলেও কাজের চাপে নিজের ব্যস্ততায় সেভাবে মনে রাখতে পারে না।

____আচ্ছা বাদ দিন।এসব মনে করে কষ্ট পেয়ে লাভ নাই।টাওয়াল নিয়ে বিছানায় বসে উনার মাথা মুছতে ব্যস্ত হয়ে পরলাম আমি।আমার কান্ড দেখে তব্দা লেগে গেছেন উনি।নীরব দর্শকের মতো আমার কান্ড দেখে চলেছেন।আপনি আবার বৃষ্টিতে ভিজেছেন।সকালে পইপই করে বলেছিলাম ছাতা নিয়ে যেতে নিলেন না কেন….?

উনার প্রশ্নের উওরের আশায় বসে আছি আমি।কিন্তু মুখে কুলু পেতে আছেন উনি।আর অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।উনাকে এভাবে তাকাতে দেখে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলাম আমি।মুছা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম……

~~~আর কোনোদিন কথার অবাধ্য হবেন না।আর যদি হন তাহলে জ্বর আসলে রাস্তায় ফেলে আসবো তখন দেখবো কেমন লাগে।

হঠাৎ করো ভুবন কাঁপানো হাসির আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ালাম আমি।অপলকভাবে উনার দিকে তাকিয়ে আছি আমি।কি সুন্দর হাসি।

“চকচকে সাদা দাঁতের ফাঁকের এক চিলতে হাসি”
আহা!”এই হাসিটুকুই যে আমি বড্ড ভালোবাসি”…!!
.
.
মুগ্ধ আমাকে নিয়ে আজ বেড়াতে যাচ্ছে।তাই সেজেগুজে বেড়িয়ে পরেছি।মূলত মায়ের কথাতেই আমাকে নিয়ে বেড়িয়েছেন উনি।এতদিন উনার এক্সামের ঠ্যালায় কোথাও যাওয়া হয়নি।একদম ধম বন্ধকর পরিস্থিতি ছিলো।পার্কে বসে দুজনে গল্প করছি হঠাৎ আমাকে রেখে কিছুটা সামনে এগুলেন উনি।আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছি তখনই সামনে এসে দাঁড়ালো কেউ।তাঁকে দেখে চমকে গেলাম আমি।আদনান আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।সেদিনের পর আর কখনও ওর সাথে দেখা হয়নি আমার।।আমি কখনও চাই নি ওর মতো মানুষের ছায়া আমার আর মুগ্ধর জীবনে পরুক।আর কোনোদিন দেখা হোক।কিন্তু মানুষ সবসময় যা ভাবে তা কি আর হয়!হয় না তো।এখন অধরা আপুর কাছ থেকে শুনেছি খুব বড় বিজনেসম্যানের মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে।মূলত বাবার টাকা পয়সা দেখেই বিয়েতে রাজি হয়েছে।আদনান সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললো…….

_______আরে মুগ্ধতা তুমি এখানে….?এক্ষুণি যেই ছেলেটা গেলো সে কে…?নতুন বফ বুঝি….?

ওর কথায় মৃদু হাসলাম আমি।শান্ত কন্ঠে বললাম……..

~~~ দু’দুদিন পর পর জামা কাপড়ের মতো গার্লফ্রেন্ড পাল্টানোর স্বভাব তোমার হয়তো আছে কিন্তু আমার ধাতে এসব নেই।আর সেটা তুমি খুব ভালোভাবেই জানো।উনি আমার স্বামী।

_____মাই গড!বিয়ে করে নিয়েছো!তা কিভাবে ফাঁসালে নিশ্চয় তোমার ওই রূপের জালে আমার মতো ফাঁসিয়েছো।তা তুমি কে সেটা জানে!নিশ্চয় আমাকে যেভাবে পরিচয় গোপন করে ঠকাতে চেয়েছিলে সেভাবে ওকে…….

~~~ও রূপ আর টাকা দেখে ফাঁসার মতো ছেলে নয়।রূপ আর আভিজাত্য সারাজীবন কারোর ঠিকে না।ও মনটাকে ভালোবেসে আমার সব কিছু জেনেও আমাকে ভালোবেসেছে।স্ত্রী’র সম্মান দিয়েছে।অবশ্য তোমার মতো ছেলে এসব বুঝবে না।তুমি তো শুধু চেনো টাকা।টাকার লোভে পরে আমাকে তোমার প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছিলে।তারপর যখন জানতে পারলে আমি উনার মেয়ে নই তখন তোমার সব ভালোবাসা ফিকে হয়ে গেলো।সত্যি যেখানে টাকা থাকে না সেখানে তোমার মতো ছেলেরা ভালোবাসা পায় না।কারণ তোমার মতো ছেলেরা টাকার ভিতর সুখ খুঁজে বেড়ায় কিন্তু এটা বুঝে না টাকার সুখই সুখ নয়।মনের সুখই বড় সুখ।মুগ্ধ আমাকে নিয়ে মনের সুখে সুখী!

আমার কথাগুলো শুনে মুখ ছোট করে ফেললো আদনান।গম্ভীরমুখে বললো……

_______অপমান করলে….?

~~~না তো!যা ডিজার্ব করো তাই বললাম।একটা কথা জেনে রেখ আদনান আজ যে টাকার পেছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছ কাল তোমার অঢেল টাকা থাকবে কিন্তু প্রকৃত সুখ পাবে না।টাকার সুখে সুখী থেকেও মনের অসুখে অসুখী থাকবে দেখে নিও তুমি।
.
.
বাসায় এসে খুব চুপচাপ হয়ে গেছেন মুগ্ধ।কিন্তু কেন সেটাই বুঝতে পারছি না।তবে কি আদনানকে দেখে এরকম করছেন উনি।তখন আমাদের কথার মধ্যেই চলে এসেছিলেন উনি।আর তখন আদনানের সাথে কথা হয়।আমার পরিচিত একজন বলে নিজের পরিচয় দেয় আদনান।তাঁরপর ওর সম্পর্কে আর কিছু জিজ্ঞেস করেননি উনি।আমিও আগ বাড়িয়ে বলিনি।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আদনান সম্পর্কে খোলামেলা উনার সাথে কথা বলবো আমি।কোনো লুকোচুরি নয়।ওপাশ ফিরে শুয়ে আছেন মুগ্ধ।আমি কিছু বলতে যাব তাঁর আগেই আমাকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর কন্ঠে বললেন উনি…….

______আদনান নামের ছেলেটা কি হয় তোমার….?

উনার প্রশ্ন করাটা খুব স্বাভাবিক।উনাকে সবটা জানানো আমার কর্তব্য।বিছানা থেকে উঠে বসে ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে স্থির কন্ঠে বললাম……

~~~আমার বয়ফ্রেন্ড!সে অনেক কাহিনী!শুনবেন আপনি।

বিছানা থেকে ধপ করে উঠে বসলেন উনি।মাথা নাড়িয়ে আশ্বস্ত করলেন শুনবেন উনি।আমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলতে লাগলাম।খুব মনযোগ সহকারে সবটা শুনলেন উনি।এই ঘটনা শুনে উনার মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখলাম না আমি।যেখানে এতগুলো কথা হঠাৎ শুনলেন সেই হিসেবে রিয়াক্ট করার কথা কিন্তু কিছুই করলেন না।উল্টে স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন…….

~~~জন্ম,মৃত্যু,বিয়ে এই তিনটা জিনিস মানুষের হাতে থাকে না।উপরওয়ালার ইচ্ছেতেই ঘটে।ওর সাথে তোমার বিয়ে হওয়ার নয় তাই হয়নি।আচ্ছা তুমি কি এখনও ওকে ভালোবাসো…..?

উনার এমন প্রশ্ন শুনে হতবাক আমি।যেখানে বিয়ের আগে প্রেম করেছি জেনে দশটা কথা শুনানোর কথা সেখানে এমন প্রশ্ন শুনে ভড়কে গেলাম আমি।এজন্যই বোধহয় উনি মুগ্ধ। আমার স্বামী!যিনি রোজ রোজ অবাক করেন আমায়।তাঁর এই অতীবও শান্ত স্বভাব উনার প্রতি আকৃষ্ট করেছে আমায়।বাধ্য করেছে ভালোবাসতে।কিছুটা সময় নিয়ে বললাম….

_______ভালোবাসা!সেটা কখনওই ওকে ভাসিনি আমি।শুধু তখন ভালোলাগা আর ভালোবাসার তফাৎ বুঝতে পারিনি।তখন ওর প্রতি ভালোলাগাটাকে ভালোবাসা ভেবে আকঁড়ে ধরতে চেয়েছি।কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ওটা ভালোবাসা নয় ভালোলাগা মাএ।

মুগ্ধতার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আমি। মুখের মধ্যে অদ্ভুত খুশির ঝিলিক ফুটে উঠলো আমার।তবে ছেলেটার প্রতি ভালোবাসা ছিলো না ওর।যদি থেকেও থাকে তাতেও সমস্যা নেই আমার।কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি।তুমি আমায় ভালোবাসো আর নাই বা বাসো আমি তো বাসি।এটাই আমার স্বার্থকতা….!!
.
.
#চলবে…….