মেঘ বলেছে তুমি আমার পর্ব-১৬

0
297

#মেঘ_বলেছে_তুমি_আমার❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ১৬
_______________

সময় ছুটলো সুর সুর করে। দেখতে দেখতে সেই বিয়ের সময় চলেই আসলো। সকাল থেকে বাড়ির ভিতর তোড়জোড় গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে আজ। ডেকোরেশনের লোকেরাও আর কিছুক্ষণের মাঝে আসলো বলে আজ রাতে গায়ে হলুদ হবে আর কাল বিয়ে। নীলয় এখন সুস্থ। তবে মন বড় অস্থির। যদিও এই অস্থিরতা কারণটা তার অজানা নয়।’

অহনা দাঁড়িয়ে আছে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। মনটা বড়ই অশান্ত লাগছে তার। সে কিছুতেই বিয়েটাতে মন বসাতে পারছে না বড্ড খারাপ লাগছে। অহনা মানতে না চাইলেও এটাই সত্যি অহনা না চাইতেও নীলয়কে ভালোবেসে ভয়ংকর এক অপরাধ করে বসে আছে। যার কারণে এমনটা হচ্ছে। অহনার বুক চিঁড়ে কান্না আসতে চাইছে কিন্তু সে কাঁদতে পারছে না। এই অসময়ে কারো আগমণে সে বড়ই অশান্ত। এমনটা তো ঠিক নয়। ভুল জেনেও নিজেকে সামলানো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে অহনার।’

দরজায় নক পড়লো কারো উত্তেজিত কণ্ঠের ছোঁয়া ভেসে আসলো কানে। সে বললো,

‘ ওই অহনা কেমন আছিস? এভাবে আমায় রেখেই একা একা বিয়ে করে নিচ্ছিস?’

কণ্ঠটা চেনা লাগতেই ধাপ করে পিছন ফিরে তাকালো অহনা। তার প্রাণপ্রিয় বেস্টু তাবাসসুম দাঁড়িয়ে আছে। যার সাথে প্রায় তিন’বছর যাবৎ যোগাযোগ বন্ধ ছিল অহনার। অহনা অবাক চেয়ে রইলো তাবাসসুমের মুখপানে। তাবাসসুম দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো অহনাকে। বললো,

‘ কি ভেবেছিলি না জানিয়ে বিয়ে করে নিবি আর আমি জানতেও পারবো না।’

অহনা কতক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না তার সামনে তাবাসসুম দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা আমেরিকা গিয়েছে তিন’বছর দাঁড়িয়েছে। ফ্যামিলিসহই গিয়েছিল ওখানে সেটেল্ড হয়ে থেকে গেছে ওরা। যেদিন গিয়েছিল সেদিন কি কান্না দুজনের। অহনা বিমূঢ় চেয়ে বললো তাবাসসুমকে,

‘ তুই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না ইয়ার।’

তাবাসসুম হাসে। মুচকি হেসে বলে,

‘ সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম বল,

উজ্জ্বল মাখা স্বরে বললো অহনা,

‘ দারুণ।’

অহনার কথা শুনেই মুখ কালো করে বললো তাবাসসুম,

‘ তবে আমি তোর ওপর রেগে আছি?’

‘ কেন?’

‘ কেন আবার এইভাবে বিয়ে করে নিচ্ছিস আর আমায় একবার জানানোরও প্রয়োজন মনে করলি না।’

অহনা নিরাশ স্বরে বললো,

‘ কিভাবে জানাতাম? তোর ফোন নাম্বার ফেসবুক একাউন্ট কোনোটাই তো ছিল না আমার কাছে।’

তাবাসসুম বিছানায় বসলো কাঁধের ব্যাগটা বিছানায় রেখে বললো,

‘ বুঝলাম। এবার দ্রুত যা তো আমার জন্য এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়।’

অহনা নির্বাক চেয়ে বললো,

‘ দাঁড়া আনছি।’

অহনা বেরিয়ে গেল। অহনার তাবাসসুমের এখানে হুট করে আসায় যেন স্তব্ধ বনে গেল তার একদমই ধারণার বাইরে ছিল আজ এই মুহূর্তে তাবাসসুম এখানে আসবে। কিন্তু ও বিয়ের বিষয়টা জানলো কি করে?’

‘ আমি জানিয়েছি।’

আচমকাই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে নীলয়ের কণ্ঠ কানে বাজতেই পুরো দমে চমকে উঠলো অহনা। অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,

‘ আপনি জানিয়েছেন কিন্তু কিভাবে?’

‘ কিভাবে তা নয় পরে বলি।’

নীলয় বেরিয়ে গেল তার কি কোনো কিছু নিয়ে তাড়া ছিল ঠিক বোঝা গেল না। অহনা ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নীলয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে চলে গেল নিচে। লোকটা যে মজা করলো এটা ভেবে আর ভাবলো না।’
____

সন্ধ্যাজুড়ে বাড়ির উঠানটা চিকচিক করছে। গায়ে হলুদ শুরু হবে আর কতক্ষণের মাঝেই অহনাকে সাজানো হচ্ছে রুমে। এক অনুভূতি শূন্যহীন হয়ে আয়নার সামনে বসে আছে অহনা। তার পাশেই তাবাসসুম। হঠাৎই তাবাসসুম বললো,

‘ নীলয় তোর বাবার বন্ধু কখনো বলিসনি তো,

অহনা অবাক স্বরে তাকালো তাবাসসুমের দিকে। বললো,

‘ তুই ওনায় চিনিস?’

‘ হুম ওনার জন্যই তো আজ আমি এখানে আসতে পারলাম।’

তাবাসসুমের কথা শুনে যেন আরো বেশি হতভম্ব ফিল হলো অহনার। তার মানে সকালে নীলয় সাহেব সত্যি কথাই বলেছিল সেই তাবাসসুমকে জানিয়েছিল তার বিয়ের কথা। কিন্তু কিভাবে?’ অহনা অবাক স্বরে অহনাকে প্রশ্ন করলো,

‘ তোর সাথে ওনার পরিচয় কবে থেকে?’

‘ সে অনেক আগের থেকে আমি সে বছর আমেরিকান ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি ভাইয়া ওই ভার্সিটির সিনিয়র ছিলেন সে বছরই গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে বের হয়েছেন। ওনার সাথে ফেসবুকে কথা হতো প্রায় খুব ভালো বুঝলি। ভার্সিটিতে কোনো সমস্যা হলেও ওনায় জানাতাম আমায় খুব করতো শুধু আমায় নয় আরো অনেককেই হেল্প করতেন। তো কিছুদিন আগেই জানি উনি বাংলাদেশ এসেছেন তাও আমাদের এই উজিরপুরে তখনই তোর কথা বলি সে তো অবাক হয় সাথে আমিও যে নীলয় তোদের আত্মীয় হবে। আর ওনার জন্যই জানি তোর বিয়ে উপলক্ষে এখানে এসেছে ব্যস টিকিট কেটে চলে এসেছি। একটু ঝামেলা হয়েছিল যদিও তাও নীলয় আর বাবার জন্য মেনেজ হয়ে গেছিল। মা খুব আসতে চাইছিল কিন্তু ছোট ভাই তুহিনের শরীরটা খারাপ তাই আসতে পারেন নি। যাক ওসব বাদ দে আমিও কল্পনা করি নি এভাবে তোর বিয়েতে আসতে পারবো। যাক এসে তো পড়লাম এবার আর কোনো চিন্তা নেই দুলাভাইর টাকা কিভাবে হাতাতে হবে তাও ভেবে রেখেছি।’

শেষের কথাগুলো তাবাসসুম একটু জোরে বলায় আশেপাশের সবাই হেঁসে উঠলো। অহনাও সামান্য হাসলো।’

____

নিজ রুমের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে নীলয় বুকের ভিতর কোথাও যেন খুব যন্ত্রনা হচ্ছে। নীলয়ের খারাপ লাগছে শূন্যতারা হানা দিচ্ছে কি একটা বিচ্ছিরি বিষয়। লোকে জানলেও বা কি বলতো। নীলয় নিজেকে দমালো জোরে এক নিশ্বাস ফেললো। এমনটা হবে জানলে আমেরিকা ছেড়ে কোনোদিনও আসতো না নীলয়। কি একটা কাণ্ড যার বিয়ে খেতে আসলো তাকেই ভালো.. আর বললো না ভালোবাসা শব্দটা মনে মনে বলতেও যেন বাজে লাগছে। এমন সময় তার রুমে হানা দিল নীলয়ের বাবা উনি বললেন,

‘ নীলয়,

পিছন ঘুরে তাকালো নীলয় আজ বহুদিন পর তার বাবা তাকে ডাকলো। নীলয় পিছন ফিরেই বললো,

‘ হুম বলো,

‘ এখনও তৈরি না হয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

‘ কি আশ্চর্য! বিয়েটা আমার নয় বাবা অহনার তাই আমি দেরি করে বের হলেও কোনো সমস্যা নেই তুমি বরং মায়ের রুমে গিয়ে মায়ের হলো কি না দেখো।’

ছেলের ত্যাড়ার কথায় মাথা বিগড়ালো নীলয়ের বাবার। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না। তবে আজ কেন যেন ছেলেটাকে বড্ড বিষণ্ণ লাগছে নীলয়ের বাবার। কিছু কি হয়েছে ছেলেটার? চোখ মুখও কেমন যেন একটা হয়ে আছে। হয়তো জ্বর সেরে মাত্র উঠলো বলে এমন। নীলয়ের বাবা চলে গেলেন। নীলয় কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে রেডি হতে ব্যাগ খুললো।’
_____

গায়ে হলুদ রঙের শাড়ি চাপিয়ে হাতে, চুলে, গলায় ফুল দিয়ে তৈরি অলংকার পড়ে স্টেজে বসে আছে অহনা। মাত্রই তাকে এনে বসানো হয়েছে। তার সামনেই রয়েছে নানা পদের ফল আর মিষ্টি। ফলগুলোকে খুব সুন্দর ডিজাইন করে কেটে রাখা হয়েছে সামনে। কতদূরেই বাজছে সাউন্ড বক্স। গ্রামের সবাই এসে পড়েছে ইতিমধ্যে। কেউ পড়েছে শাড়ি, কেউ বা থ্রি-পিস। সাউন্ড বক্সের গানের তালে তালে নাচছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখনও অনুষ্ঠান শুরু হয় নি৷ গ্রামের আশেপাশে বড় ভাইয়েরাও আসবে এক্ষুণি। মূলত বিয়ে বাড়ির এই অনুষ্ঠানগুলো গ্রামের এই বড় ভাই, ছেলেপেলেরাই দেখেন। আহিরের বন্ধু বান্ধব, জহিরের বন্ধুরাও আসছে। পাশের বাড়ির রাজ্জাক কাকার বড় ছেলে আদিবরাও এসেছে। মানুষে পুরো চারপাশ ভরপুর। তাবাসসুম, অহনার বান্ধবীরাও সেজেগুজে এসে বসেছে অহনার পাশ দিয়ে। বড় বড় পাইপ লাইটের আলোতে পুরো চকচক করছে গ্রামের এই উঠানটা। শুধু বৃষ্টি না নামলেই হলো। হঠাৎই অহনার বুকের ভিতর দক দক করে উঠলো আশেপাশে তাকালো নীলয় কি আসছে তার সামনে। অহনা এক বিরক্তকর অনুভূতি নিয়ে বসে রইলো চুপচাপ এই অনুভূতি চায় না সে। এরই মাঝে সবার সামনে এগিয়ে আসলো নীলয়। পরণে হলুদ রঙের পাঞ্জাবী, সাদা পাজামা, হাতে ঘড়ি, চুলগুলো সুন্দর মতো সাজানো গোছালো তাকে দেখে সবাই বেশ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। বিশেষ করে তাবাসসুম, তাবাসসুম নীলয়কে দেখেই অহনার পাশ থেকে নেমে এসে ছুটে গেল নীলয়ের দিকে একগাল মিষ্টি হেঁসে বললো,

‘ তোমায় কি দারুণ দেখাচ্ছে নীলয় ভাইয়া?’

নীলয় হাল্কা হাসে শুধু। তাবাসসুমকে দু’পলক দেখে বলে,’তোমাকেও সুন্দর লাগছে।’

নীলয়ের কথা শুনে তাবাসসুম লজ্জা পেয়ে হেঁসে ফেলে।’

অতঃপর বলতে বলতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো অহনার গালে সবাই একটু একটু করে হলুদ লাগালো আর মিষ্টি ফল খাওয়ালো। সাথে হাতে মেহেন্দি লাগানোর তোড়জোড় পড়লো।’

গ্রামের ছোট বড় ছেলেমেয়েটা স্টেজের সামনে খোলা মাঠে নাচলো। কেউ চেয়ারে বসে, কেউ দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে দেখলো তা, কেউ মোবাইলে ভিডিও করে নিলো। এই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে নীলয় তাবাসসুম একসাথে ছিল পুরো সময় পাশাপাশি চেয়ারে বসে সারাক্ষণ গল্প করেছে। অহনা দেখেছে তা রাগ খারাপ লাগা দুটোই হয়েছে তবে তা প্রকাশ করতে নারাজ।’

নাচ গান হৈ-হুল্লোড় নিয়ে রাত দুটো পর্যন্ত গান বাজনা চললো। ডেকোরেশনের লোকেরা পেয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ কাটা শুরু করে দিয়েছে অনেক আগে। আস্তো একটা গরু জবাই করাও হয়ে গেছে অনেক আগে। গ্রাম শুদ্ধ সবাই কাজে ব্যস্ত। ঘরের ভিতর মা চাচিরাও কাজ করছে পুরো একসাথে। হাসি তামাশা আর আড্ডার মাঝে কাটছে তাদের সময়। তাবাসসুম লিলি বুশরাসহ আরো মেয়েরাও যোগ দিয়েছে তাতে। অহনা নিজ রুমে চলে গেছে অনেক আগে।’
____

বিষণ্ণ রাত। বাড়ি কর্নারে থাকা ছোট্ট সেই ছাদটায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে নীলয়। নিচে সবাই কাজ করছে। নীলয় এতক্ষণ স্বাভাবিক আর চুপচাপ থাকলেও এখন আর পারছে না। বুকের যন্ত্রনাটা যেন ধীরে ধীরে আরো বাড়ছে উফ আর সহ্য করা যাচ্ছে না।’

নীলয় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পিছন ঘুরলো এমন সময় হুট করে কে যেন এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে কেঁদে উঠলো আকস্মিকভাবে। নীলয় যেন থমকে গেল এক মুহূর্তে।’

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। আর গল্প কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবে।]

#TanjiL_Mim♥️