মেঘফুল পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
260

উপন্যাস: মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৪৪

সারল্য খাবার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ায়। জাহ্নবীর পরনে তার মায়ের শাড়ি৷ মায়ের পরিহিত কোনো শাড়িতে এর আগে মা ছাড়া আর কাউকেই দেখেনি সারল্য। তার মনে হচ্ছে মায়ের শাড়ি শুধুই মায়ের। শাড়িটাতেই যেন একটা মা মা ব্যাপার আছে। জাহ্নবী শাড়িটা পরায় তার চেহারায় অন্যরকম মায়া এসে ভর করেছে৷

ম্লান হেসে সারল্য বলল, ‘আপনাকে শাড়ি পরতে দেখিনি কখনো।’
‘দেখেছেন। মনে নেই হয়তো।’
‘হয়তোবা। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি রুমে গেলে আপনি কি কিছু মনে করবেন?’
‘না।’

মুখে ‘না’ বললেও জাহ্নবী অবশ্যই কিছু মনে করবে। পান্নাবাহার তার সঙ্গে না বসলে ভালো লাগবে না তার। এত সুন্দর রাতটা সারল্য বিষণ্ণতায় কাটিয়ে দেবে, সেটা কী করে হয়!
পান্নাবাহার নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালে জাহ্নবী বলল, ‘আপনি আজ সারাদিন কিছু খাননি।’
থমকে দাঁড়াল সারল্য। পেছন ফিরে বলল, ‘খেয়েছি তো। দুপুরে বাসা থেকে খেয়েই বেরিয়েছি।’
‘আমার তো মনে হচ্ছিল আপনি সারাদিন কিছু খাননি।’
শুকনো হাসি দিয়ে সারল্য বলল, ‘কেন? আমার শাশুড়ী অসুস্থ বলে আমি খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়ে বসে আছি ভেবেছেন?’
সারল্য’র মা ছেলের হাত ধরে বললেন, ‘রাগ করিস না সোনা আমার। মাথা ঠাণ্ডা রাখ।’

সারল্য আবারও ম্লান হাসলো। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাসে ভেতরে জমা রাগটাকে ঝেড়ে ফেলে দিলো সে। তারপর নিজের ঘরে চলে গেল। বাকি খাবারটুকু নিঃশব্দে খেয়ে নিলো জাহ্নবী। সারল্য’র জন্য মন কেমন করছে। লোকটার জন্য সে কিছু একটা করতে পারতো যদি! এই ভেবে আক্ষেপ হয় তার।

খাওয়া শেষে সারল্য’র মা জাহ্নবীকে নিয়ে নিজের ঘরে এলেন। বললেন, ‘বসো মা। শার্লিন এসে তোমাকে রুমে নিয়ে যাবে। গেস্ট রুমে কেউ থাকে না। ভ্যাপসা গন্ধ হয়ে আছে। কিছু মনে করো না ‘
‘না খালা। অসুবিধা নেই। আমি আপনার সঙ্গে শুলে আপনার অসুবিধা হবে?
‘না না, আমার অসুবিধা নেই। তুমি অতিথি মানুষ। আমার সঙ্গে শুতে তোমার আপত্তি হয় কী না।’
‘আমার কোনো অসুবিধা নেই খালা। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারপর শোবো।’
‘আজকালকার মেয়েরা সবাইকে আন্টি বলে ডাকে। তুমি আমাকে খালা বলছো দেখে খুব অবাক হয়েছি জানো?’

কথাটা বলেই হাসলেন মহিলা। জাহ্নবী মুচকি হেসে বলল, ‘আপনাকে দেখেই আমার খুব আপন আপন লাগছিল। খালা খুব আপন একটা ডাক। আন্টি ডাকে সেই আপন আপন লাগাটা আসেনা।’
‘ঠিকই বলেছো। আমি শুয়ে পড়ি তাহলে মা?’
‘হ্যাঁ শুয়ে পড়ুন। আমি একটু ওনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।’
ইতস্তত করতে করতে শেষ অবধি কথাটা বলেই ফেলল জাহ্নবী। মহিলা বললেন, ‘ওর রুম তো ওপরে। আমার সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে কষ্ট হয় মা৷ শার্লিনকে ডেকে দেই দাঁড়াও।’
‘থাক তাহলে। কালকে কথা বলবো।’
‘কথা যখন বলা দরকার তখন না বলে পরে কী সেই কথার আনন্দ থাকে। তুমি ওপরে যাও। দ্বিতীয় রুমটাই সারল্য’র। খুঁজে না পেলে ডাকবে।’

জাহ্নবী বিস্মিত হয়। এই বয়সী একজন মায়ের অপূর্ব ভাবনা ওকে মুগ্ধ করেছে। মা নিশ্চয় তার ছেলের একাকীত্বে কষ্ট পান। নয়তো জাহ্নবী কথা বলতে চাওয়া মাত্রই ওনার মুখে এক ধরনের আলোর বিস্ফোরণ হল কেন!
‘ধন্যবাদ খালা। আপনাকে কষ্ট দিলাম।’ আমি দুইটা জরুরি কথা বলেই চলে আসবো।’

মহিলা কয়েকবার চোখ পিটপিট করলেন। চুলগুলো পরম যত্নে কাঁধের ওপর দিয়ে সামনে দুলিয়ে রেখে জাহ্নবী ঘর থেকে বের হল। ছোট্ট ডুপ্লেক্স বাড়ি। তবে আধুনিক যুগের বাড়িগুলোর মতো চাকচিক্যময় নয় মোটেও। অনেকটা হাল আমলের ডিজাইনে করা। সবখানে আভিজাত্যের ছাপ।

সারল্য’র ঘরের দরজায় শব্দ করে জাহ্নবী। সারল্য বলল, ‘দরজা খোলা আছে।’
দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল সে। বিছানায় বসে থাকা সারল্য চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার পরনে হাফপ্যান্ট ও খালি গা। বিব্রত ভঙ্গীতে সারল্য বলল, ‘আপনি!’
‘সরি বিরক্ত করলাম বোধহয়?’
‘না। আমি শুয়ে পড়েছিলাম।’
‘তাহলে চলে যাই।’
‘দাঁড়ান। বসুন।’

সারল্য একটা টিশার্ট পরতে পরতে জাহ্নবীকে বসতে বললো। তার রোমশ বুকের দিকে চোখ যেতেই জাহ্নবী অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। সারল্য বলল, ‘বসুন।’
বিছানার এক কোণায় বসলো জাহ্নবী। পুরো ঘরে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয় সে। বেড সাইট টেবিলের ল্যাম্প থেকে মৃদু আলো উৎসারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ঘরজুড়ে। জাহ্নবী’র খুব মন কেমন করে। এই ঘরটাকে তার খুব আপনার বলে মনে হয়।

সারল্য বলল, ‘চা খাবেন?’
‘না, এত রাতে আর চা খেতে চাই না।’
‘আমার রুমেই আছে চায়ের সরঞ্জাম। আপনি বসুন, আমি বানিয়ে দিচ্ছি।’
সারল্য চায়ের জন্য পানি গরম করতে লেগে গেল। জাহ্নবী বলল, ‘আপনি এখানেই থাকেন?’
‘হ্যাঁ। ডিভোর্সের পরে এখানে চলে এসেছি। মা একা থাকতে দেয় না।’
‘ডিভোর্সের পর একা থাকাই উচিৎ। নিজের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়।’
সারল্য চমকে উঠে বোকার প্রশ্ন করে বসলো, ‘আপনারও কী ডিভোর্স হয়েছে?’
‘না। আমি বিয়েই করিনি।’
‘ওহ সরি। ভুলেই গিয়েছিলাম।’

চায়ের কাপে গরম পানিতে একটা টিব্যাগ ছেড়ে দিয়ে সারল্য কাপটা এগিয়ে দিলো জাহ্নবীর দিকে। জাহ্নবী কয়েক মুহুর্ত সারল্য’র দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হল সারল্য’র চাহনিতে তীব্র বিষাদ। লোকটা ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছে। ওর বুকে দহন শুরু হয়। কেন এই মানুষটার কষ্ট ওকে এত পীড়া দেয়?

জাহ্নবী বলল, ‘আপনি রং চা বেশী পছন্দ করেন?’
‘ঝটপট বানানো যায় বলে পছন্দ করি।’
‘আপনার ঘরটা খুব সুন্দর। ছিমছাম, পরিপাটি।’

সারল্য চোখ তুলে তাকালো। তার চোখে বিস্মিত হওয়ার ছাপ স্পষ্ট। জাহ্নবী কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সারল্য বলল, ‘সে বলতো আমার রুমটা তার একটুও পছন্দ নয়। এই বাসায় এলে সবসময় রুমের ডেকোরেশন চেঞ্জ করা নিয়ে ঝগড়া হতো আমাদের।’

মাথা নিচু করে ফেলল জাহ্নবী। এর উত্তরে কীইবা বলা যায়। উদাসীন চোখে বিশাল জানালার দিকে তাকিয়ে থেকে সারল্য বলল, ‘আমার পুরনো ট্রেডিশনাল জিনিস ভালো লাগে। আর ওর ভালো লাগে মডার্ন ঝকঝকে ডিজাইনের সবকিছু। এটাই হয়তো স্বাভাবিক। আমি হলাম ক্ষ্যাত বাঙাল আর সে আমেরিকান স্মার্ট লেডি।’
‘উনি আমেরিকায় থাকতেন বুঝি?’
‘ওর জন্ম আমেরিকায়। ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন ঢাকায় চলে আসে। তবে ও সবসময় আমেরিকায় সেটেল্ড হতে চাইতো।’
‘এখন কোথায় থাকেন উনি?’
‘নিউ ইয়র্ক। ঢাকায় বেড়াতে এসেছে ওর মায়ের অপারেশনের জন্য। ও চেয়েছিল মাকে ওখানে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করতে। কিন্তু আম্মা দেশ ছেড়ে যেতে চান না। ওনার স্বামীর কবর এখানে। উনি শেষ দিন পর্যন্ত এখানেই থাকতে চান।’

জাহ্নবী চা শেষ করে বলল, ‘ধন্যবাদ চায়ের জন্য।’
সারল্য’র পাশে এসে দাঁড়াল জাহ্নবী। তার বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি এই কষ্টটাকে এখনো কেন আঁকড়ে ধরে আছেন? ছেড়ে দিন না তাকে। যাকে ছেড়ে দিয়েছেন, তার কষ্টটাকে কেন পুষে রেখেছেন মনে? ছেড়ে দিন। মনের বাঁধন খুলে দিন। ছোট ছোট ব্যাপার গুলোতে কষ্ট পাবেন না। নিজেকে হারাতে দেবেন না প্লিজ।’
‘আমি নিজেকে হারাই নি। মাঝেমাঝে সময় আমাকে খুব একাকী করে তোলে জাহ্নবী। আমার তো এমন হবার কথা ছিল না।’
‘আমাদের ভাগ্যে তাই ঘটে, যাতে আমাদের ভালো হয়। আমি একটা কথা বিশ্বাস করি, আল্লাহ যা করেন, সবসময় আমাদের ভালোর জন্যই করেন। এখানে কোনো দ্বিধা নেই। আপনি মনকে বেঁধে রেখেছেন। ছেড়ে দিন। পাখির মতো উড়তে দিন তাকে। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার নতুন করে বাঁচতে শিখুন। জীবন সবসময় একরকমভাবে চলবে না। মেনে নিতে শিখুন।’

সারল্য চুপ করে আছে। জাহ্নবী’র মনে শঙ্কা, পাছে বেশী বেশী বলে মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলে কী না!
সারল্য বলল, ‘সেই চেষ্টাই করি সবসময়।’
‘জানেন আমি কত একা?’

সারল্য’র চোখে চোখ রেখে কথাটা বলে জাহ্নবী। সারল্য স্থিরচোখে জাহ্নবী’র চঞ্চল হয়ে ওঠা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে। জাহ্নবী বলল, ‘আমি জন্মের পর থেকে কোনো বন্ধু পাইনি। আমার মা কোনোদিনও আমাদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলেননি। একটা দেয়াল সবসময় আমাকে আর মাকে আলাদা করে রেখেছে। সেই দেয়াল কখনো ভাংবে না। এই একাকী আমি কিন্তু বেশ ভালো আছি। আমার অভাব, শূন্যতা গুলো তাদের মতো আছে। আমি ওদেরকে নিজের অঙ্গ বানিয়ে চলেছি এতদিন। কিন্তু এখন আমার সেই ধারণা ভেঙেছে। শূন্যতাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচা যায় না। মনের বাঁধন খুলে দিয়েছি আমি।’
সারল্য বলল, ‘আপনার কথাগুলো ভালো লাগল। বারান্দায় যাবেন?’
‘চলুন।’

দুজনে এসে দাঁড়ায় সারল্য’র ঘরের বারান্দায়। হঠাৎ ভীষণ চমকে ওঠে জাহ্নবী। সে বিস্মিত চোখে চারপাশে তাকায়। একি! এ তো তার কল্পনার সেই বারান্দা। যেখানে সে রোজ বৃষ্টিতে ভেজে, যার ওপরে খোলা আকাশ। একটা বড় আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসে থাকা তার একটা আপন মানুষ। চেয়ারের হাতলে থাকে পত্রিকা আর সিগারেটের অ্যাস্ট্রে। এই বারান্দায় এমন একটা চেয়ার থাকলেই হতো। আর মানুষটা? তার প্রিয় মানুষ তার নয়, তবে সেই মানুষটাই এখন তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে!

জাহ্নবী শিহরিত হয়। তার কল্পনার বারান্দাটা পেয়ে গেছে সে। শুধু মানুষটাকে পেয়ে যেত যদি! আর কক্ষনও জীবনে কিচ্ছু চাওয়ার ছিল না তার।
সারল্য বলল, ‘আমার যখন দমবন্ধ লাগে, এখানে এসে দাঁড়াই।’
‘কী সুন্দর বাতাস এখানে!’
‘জাহ্নবী, আপনাকে একটা কথা বলি?’
‘হুম, বলুন না।’
‘এই বয়সে এসে জীবনকে আপনার কী মনে হয়?’
‘কী মনে হয় বলতে?’
‘আমার কাছে জীবনটা চলে যাচ্ছে যাক, দিনগুলো ফুরাতে পারলেই হল, এমন মনে হয় আজকাল।’
‘একটা সময় আমারও এমন মনে হতো। আর এখন কী মনে হয় জানেন? নিজের পছন্দ অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে যে কাজটা করতে আমার ভালো লাগে, সেটা করতে ইচ্ছে করে। যে জিনিসে আমি আনন্দ পাই, সেটা করি। নিজেকে একটু ভালো রাখতে না পারলে দিনশেষে জীবনকে আর কী দিলাম?’
‘জীবনকে দিতে হবে? জীবন আমাদের কিছু দেবে না?’
‘না। নিজের জন্য নিজেকেই করতে হবে। নিজের ভালো লাগার কাজগুলো করুন, ভালো লাগবে। আচ্ছা, আপনার কী করতে ভালো লাগে?’

সারল্য খানিক্ষন চুপ থেকে বলল, ‘কী জানি! কী ভালো লাগে ভুলেই গেছি।’
‘টি মিট টোস্টে গিয়ে চা খেতে ভালো লাগে?’
‘হ্যাঁ লাগে।’
‘গান শুনতে?’
‘না।’
‘কবিতা ভালো লাগে?’
‘লাগে।’
‘আচ্ছা, আপনাকে একটা কবিতা শোনাই?’
‘ শোনান।’

জাহ্নবী ভাবে কোন কবিতা’টি সে শোনাবে সারল্যকে। ভাবতে ভাবতে পেয়েও যায় একটা কবিতা। ময়ূখ চৌধুরীর লেখা কবিতাটি আবৃত্তি শুরু করল জাহ্নবী-

তোমাকে দেখবো বলে একবার কী কাণ্ডটাইনা করেছিলাম
‘আগুন আগুন’ বলে চিৎকার করে
সমস্ত পাড়াটাকে চমকে দিয়ে
তোলপাড় ক’রে
সুখের গেরস্তালিতে ডুবে-যাওয়া লোকজনদের
বড়শি-গাঁথা মাছের মতো
বাইরে টেনে নিয়ে এলাম
তুমিও এসে দাঁড়ালে রেলিঙে

কোথায় আগুন?
আমাকে পাগল ভেবে যে-যার নিজের ঘরে ফিরে গেলো।
একমাত্র তুমিই দেখতে পেলে
তোমার শিক্ষিত চোখে
আমার বুকের পাড়ায় কী-জবর লেগেছে আগুন।

সারল্য মৃদু হেসে বলল, ‘ভালো লাগল শুনতে।’
কম্পনরত বুকে জাহ্নবী বলল, ‘জীবনে এই প্রথম আবৃত্তি করেছি।’
‘এ জন্যই গলাটা কাঁপছিল।’
‘শুধু গলার কাঁপুনিটাই দেখলেন?’
‘নাহ। আরও দেখলাম, একজন মানুষ আমার মন ভালো করে দিতে কী প্রচেষ্টাই না করছে। জীবনে প্রথমবার কবিতা আবৃত্তি করেছে। মন খারাপ করে থাকলে এখন আমার অপরাধ হবে।’

জাহ্নবী হাসলো। হাসির আওয়াজ নেই, তবে তার রেশ জাহ্নবীকে আন্দোলিত করলো। ভালো লাগছে তার। সে পেরেছে! সে পেরেছে সারল্য’র মন ভালো করে দিতে। নিজের জন্যই তার বিস্ময় জাগছে। নিজেকে বদলাতে পেরেছে সে। যে মেয়েটা সর্বক্ষণ মন খারাপ করে থাকত, আজকে সেই মেয়েটাই একজন মানুষের মন ভালো করে দিতে পেরেছে!

চলবে..

উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৪৫

অন্ধকার রাত্রিকে সাক্ষী রেখে হঠাৎ পান্নাবাহার বলল, ‘আপনার হাতটা ধরলে আপনি কি কিছু মনে করবেন?’
জাহ্নবী বিস্মিত হলো। দখিনা হাওয়ায় মাধবী লতার দোল খাওয়ার মতো হৃদয়টা দুলে উঠল তার। শীতল শব্দহীন একটা অনুভূতি তাকে আঁকড়ে ধরলো। শরীর বেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সেই অনুভূতিটা। পান্নাবাহার তার হাত ধরতে চাইছে! জাহ্নবীর বিশ্বাস হতে চায় না। দ্বিধাহীনভাবে সে হাত বাড়িয়ে দিলো তার পান্নাবাহারের দিকে।

সারল্য হাতটা ধরল। শক্ত করে মুঠোয় চেপে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বুক ভরে বড় বড় শ্বাস নিলো সে। প্রত্যেকটা দীর্ঘশ্বাসে ভেতর থেকে চাপা কষ্টগুলোকে দূর করে দিতে চেষ্টা করল। জাহ্নবী অবাক চোখে সারল্যকে দেখছে। চোখের পলক ফেলতে পারছে না।
সারল্য অনেক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে একইভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিলো। সে যখন চোখ মেলে জাহ্নবীর দিকে তাকালো, তখন জাহ্নবী দেখতে পেলো একজন অন্য মানুষকে। যার মুখে প্রশান্তি, কোথাও নেই কোনো কষ্টের ছাপ। কী ভীষণ নির্মলতায় চকচক করছে সারল্য’র চোখ দুটো।

জাহ্নবী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে শুধু একটা কথাই বলল, ‘আপনার মন ভালো হয়েছে?’
‘ভীষণ হালকা লাগছে জাহ্নবী। খুব শান্তি লাগছে। একদমই একা মনে হচ্ছে না নিজেকে।’
জাহ্নবী’র চোখ ছলছল করে উঠল। সিক্ত চোখ দুটো সে পান্নাবাহারকে দেখাতে চাইলো না। তাই মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইল।
সারল্য বলল, ‘আপনার হাত ধরার পর মনে হচ্ছে আমার মাঝে এখনও প্রাণের স্পন্দন আছে। কিছু মনে করেন নি তো?’
‘না। বন্ধুর আচরণে কিছু মনে করতে হয় না।’
‘আপনি আমার খুব ভালো একজন বন্ধু জাহ্নবী।’
‘আমিও সেটাই বিশ্বাস করি।’
‘আজ মনে হচ্ছে, এই বয়সে, এই স্টেজে এসে আমার আপনার মতো একজন বন্ধুকে ভীষণ প্রয়োজন ছিল। যে আমাকে বুঝবে, আমার কষ্টটাকে অনুভব করবে কিন্তু খোঁচা দেবে না।’
‘আপনার বন্ধুরা কি খোঁচা দেয়?’
‘ওরা হাসাহাসি করে, হাসির ছলে অনেক অসহ্যকর কথাই বলে। আমি যেসব ভুলতে চাই সেসব আরও বেশী বেশী মনে করিয়ে দেয়। সবাই না, তবে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় থাকলে দু একজন এরকম করবেই।’
‘সেই দু একজনের জন্য নিজের অশান্তি বাড়াবেন না।’
‘বাড়াবো না।’
‘আমার হাত ধরে বলছেন তো?’

সারল্য ফিক করে হেসে জাহ্নবীর হাতটা ছেড়ে দিলো। জাহ্নবী ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এ কী! কথা দিতে পারছেন না বলে ছেড়ে দিলেন?’
‘না। অনেক্ষণ ধরে আছি তাই।’
‘ভারী নাকি অনেক?’
এবার প্রাণভরে হাসি দিলো সারল্য। সরলতায় মাখামাখি হলো তার দুই চোখ, চাপদাড়িতে ভরা চিবুক আর গোলাপি ঠোঁট দুটো। শিরশির করা বাতাসের দোলা গায়ে লাগতেই জাহ্নবী’র মনে হল, এই মানুষটা তার ভীষণ আপন। যতটা আপন হলে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়া যায়!

তারা দুইজন অনেক রাত অবধি বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে রইল। গল্প করল এই শহরের ইট পাথরে ঘেরা ঘরবাড়ি, ঘরের ভেতর পাথুরে হয়ে যাওয়া মানুষের জীবন, আরও কত কী নিয়ে! এক পর্যায়ে সারল্য বলল, ‘আপনার ঘুম পেয়েছে তাইনা?’
‘না।’
‘কাল তো অফিস আছে। এখন ঘুমানো দরকার আপনার।’
‘হ্যাঁ, যাই।’

সারল্য জাহ্নবীর সঙ্গে বেরিয়ে এলো। গেস্টরুম দেখিয়ে দেবার সময় জাহ্নবী মুচকি হেসে বলল,, ‘ধন্যবাদ। কিন্তু আমি আজকে খালার সঙ্গে ঘুমাবো বলে এসেছি। উনি হয়তো অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছেন।’

জাহ্নবী সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগল। হঠাৎ ডাক দিলো পান্নাবাহার, ‘এই জাহ্নবী..’
জাহ্নবী চমকে উঠলো। মুহুর্তেই পেছন ফিরে তাকালো সে। সারল্য মৃদু হেসে বলল, ‘থ্যাংকস।’

এই একটা শব্দই তুমুলভাবে আন্দোলিত করল জাহ্নবীকে। হৃদয়ে সুখের অনুরণন নিয়ে সে সারল্য’র মায়ের ঘরে এলো। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। নিঃশব্দে ওনার পাশে শুয়ে পড়ল জাহ্নবী। মনটা বড্ড ফুরফুরে আজ। সারল্য’র মন ভালো করে দিতে পেরেছে সে। এরচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে, তার একজন মানুষ হয়েছে, যার সাথে মন খুলে কথা বলতে পারা যায়। মানুষ তো কতই আছে দুনিয়াতে, সবাই কী আর নিজের মানুষ হতে পারে!

সকালের নাস্তা খেয়ে নিজের ঘরে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে সামার। আগামীকাল তাদের ঢাকায় ফেরার কথা। আজকে সে অর্ণবকে সঙ্গে নিয়ে এলাকাটা ঘুরে দেখতে বের হবে। এখানে এসে যতটা খারাপ লাগবে ভেবেছিল সে, ততটা লাগছে না। বরং বেশ ভালো লাগছে সম্পূর্ণ নতুন এই এলাকা।

দরজা খোলার শব্দে মুখ ঘুরিয়ে সামার দেখল ঘরে পারভীন এসেছেন। তিনি ভেতরে প্রবেশ করেই দরজা বন্ধ করে দিলেন। এগিয়ে এলেন বিছানার কাছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা বলার জন্য এসেছেন এবং তা সিরিয়াস কিছু। সামার উঠে বসলো বিছানার ওপর।
পারভীন বললেন, ‘আজকে অর্ণবের কিছু আত্মীয় স্বজন আসবে তোকে দেখতে।’

সামার হঠাৎ জ্বলে ওঠা বিস্ফোরণের মতো বলে উঠল, ‘কেন? আমি কি সার্কাসের নায়িকা?’
‘চুপ কর। আস্তে কথা বল। ওর সঙ্গে তোর এনগেজমেন্ট হইছে সেটা ওর আত্মীয় স্বজন সবাই জানে। বোন কি ভাইয়ের বউকে দেখতে আসবে না?’
‘কিন্তু মা, আজকে না। আমি এখন এসব ঝামেলার জন্য প্রিপেয়ার্ড না।’
‘প্রিপেয়ার্ড কেউ থাকে না। তুই যখন বাসায় জানাইছিস তুই বিয়ে করতে চাস। আমরা তখন তো এরকম করে বলি নাই সামার। এখন মনে হইতেছে বাপ মা সন্তান জন্ম দিয়ে ভুল করছি।’

পারভীন রাগত মুখ করে বসে রইলেন। সামার কী উত্তর দেবে ভেবে পেলো না। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। সবাইকে আসতে বলো। আমি আজকে বাইরে ঘুরতে যাবো। সন্ধ্যা হয়ে যাবে বাসায় ফিরতে।’
‘এতটা বেশরম কেমন করে হইলি তুই? হবু শ্বশুরবাড়িতে এসে ওদের সামনে ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছিস। লজ্জায় মুখ দেখাতে পারিনা আমরা।’
‘যুগ পাল্টেছে মা। এখন আর আগের দিনের মতো ঘরের এক কোণে ঘোমটা টেনে বসে থাকার দিন নাই। যাইহোক, সবাইকে সন্ধ্যায় আসতে বলো। আমার সঙ্গে দেখা হলেই তো হবে তাই না?’

পারভীন কঠিন মুখ করে সামারের দিকে তাকালেন। নিজের পেটের মেয়েকেও তিনি বুঝতে পারছেন না। মেয়ে যাকে পছন্দ করে, যার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে, তার ব্যাপারে কিছু বললেই আবার রেগে যায়। মেয়েদেরকে নিয়ে কখনো শান্তি পেলেন না তিনি। পাছে সম্মানহানি হয়ে যায় কী না!

পারভীন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ভায়োলেট ভেতরে এসে জানতে চাইলো, ‘কী হয়েছে রে আপু? মা’র মুখ কালো কেন?’
‘মা’র মুখ সাদা কবে দেখেছিস? সবসময় মুখ কালো করেই তো রাখে।’
‘উল্টাপাল্টা কিছু বলেছিস?’
‘অর্ণবের কিছু মেহমান আসবে। মা চায় আমি বাসায় থাকি। আমি ঘুরতে যাবো শুনে রেগে গেছে।’

ভায়োলেট কোনো উত্তর দেয় না। সামারকে নিয়ে তার ভয় হয়। এই মেয়েটা খুব স্পষ্টবাদী। বাকি দুবোন মাকে কষ্ট দিয়ে কিছু বলতে না পারলেও সে ঠিক পারে। সবসময় সঠিক কথা মুখের ওপর বলে দিতে জুড়ি নেই সামারের। এতে কার কী আসে যায়, সেসব পরোয়া করেনা সে।
অর্ণবকে অনেক্ষণ ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সামার ফোন দিলো তাকে, ‘কই আপনি?’
‘এইতো বাজারে।’
‘বাসায় আসবেন কখন?’
‘পনেরো বিশ মিনিট লাগবে। গেস্ট আসবে তাই বাজার করছি।’
‘তারাতাড়ি আসুন। আমি রেডি হচ্ছি।’
‘রেডি হয়ে থাকুন, আমি এসেই বের হবো।’

অর্ণব বাসায় ফিরে দেখল তার অপেক্ষায় আছে সামার। অর্ণবকে দেখেই এগিয়ে এসে সামার বলল, ‘আমাদের আরও আগে বের হওয়ার কথা ছিল। এক জায়গায় নিয়ে যাবেন বলেছিলেন?’
অর্ণব ইতস্তত করতে করতে বলল, ‘আজকে সম্ভবত বের হতে পারবো না। কিছু মনে করবেন না প্লিজ। অনেকদিন পর আমার আপু আসছে, ভাগ্নী আসছে। আমি তো কাল ঢাকায় চলে যাবো। এরপর আর ওদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পাবো না। প্লিজ রাগ করবেন না।’

সামার খানিক্ষন চুপ করে থেকে উত্তর দিলো, ‘ঠিক আছে। তবে আপনাকে আজ একটা কথা দিতে হবে।’
‘কী কথা?’
‘আপনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই সেটা সবার কাছে ক্লিয়ার করে দিতে হবে। নয়তো আমিই আজ সবকিছু বলে দেবো। কথাটা মনে থাকে যেন।’

চিন্তিত দেখালো অর্ণবকে। সামারের ব্যাপারে বাবা মা অনেক আশাবাদী। আত্মীয় স্বজন সবাই জানে সামার তার হবু বধূ। আজ অনেকেই আসবে ওকে দেখতে। সবার সামনে কী করে সে সত্যিটা বলে দেবে? বলার পর বাবা মায়ের সম্মানটাই বা দাঁড়াবে কোথায়? সে কিছু ভাবতে পারছে না।

দুশ্চিন্তায় দুপুর গড়িয়ে গেল। সামার এরমধ্যে আরও একবার রীতিমতো হুমকি দিয়েছে তাকে। অর্ণব ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেহমান এসেছে বাসায়। সবার সামনে সত্যিটা আজকে খোলাসা করতে হবে। তাদের এনগেজমেন্ট নামক নাটকটা পুরোটাই মিথ্যা, নেই কোনো পছন্দের ব্যাপারও।

দুপুরের খাবার খাওয়ার পর সবাই বসে বিশ্রাম নিচ্ছে আর আড্ডায় মেতে উঠেছে। সামারকে ঘিরে আজ হচ্ছে যত আড্ডা। অর্ণবের আত্মীয়রা সামারকে ভীষণ পছন্দ করেছে। কেউবা শোনাচ্ছে ছোটবেলায় অর্ণবের দুষ্টুমির কথা। এমন সময় সামার বলল, ‘আমি আপনাদেরকে একটা কথা বলতে চাই।’

সবাই তাকালো তার দিকে। ধক করে উঠল অর্ণবের বুক। সে সামারের মুখের দিকে তাকালো। সামার অর্ণবের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে এখনই সে বলে দেবে কথাটা। এমন সময় অর্ণব বলল, ‘আপনি একটু আসুন আমার সঙ্গে। কথা আছে।’

সবার মধ্য থেকে উঠে গেল সামার। অর্ণব নিজের ঘরে এসে তাকে অনুরোধ করে বলল, ‘আপনি এখনই সব বলে দিচ্ছেন? সবাই কত মজা করছে আপনার সঙ্গে। সবার মন খারাপ হয়ে যাবে।’
‘তাহলে? আর কতক্ষণ আমি জোকারের মতো অভিনয় করবো? সবাই রীতিমতো বউ বানিয়ে ফেলেছে আমাকে।’
‘আপনার কাছে হাতজোড় করছি। প্লিজ এখনই কিছু বলবেন না। আপনি আর দুটো দিন ধৈর্য ধরুন। আমরা ঢাকায় চলে গেলে আপনাকে কেউই বিরক্ত করবে না আর। ঢাকায় গিয়েই আমি সবকিছু ঠিক করে ফেলবো, কথা দিচ্ছি।’

সামার একটা নিশ্বাস ফেলে গম্ভীর হয়ে গেল। অর্ণবের বিনয়ী মুখের পানে চেয়ে সে কিছু বলতে পারল না। তাকে অনুরোধ করে হাত দুটো একসঙ্গে তুলে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব। সামার বলল, ‘ ঠিক আছে। আমরা আগামীকাল চলে যাবো। এরপরই যেন সবকিছু ঠিক করা হয়?’
‘আমি কথা দিয়েছি আপনাকে।’
‘আচ্ছা। এতদিনের পরিচয়ের সুবাদে আপনাকে এই সময়টুকু দিলাম।’
‘থ্যাংক ইউ সামার। থ্যাংক ইউ সো মাচ।’

অর্ণব ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল সামার। দুজন কিশোরী মেয়ে এসে সামারের পাশে বসে বলল, ‘মামী, মা আপনাকে ডাকছে।’

সামারের রাগ হল। ইচ্ছে করল খুব জোরে চেঁচিয়ে বলতে, ‘আমি তোমাদের মামী নই।’ কিন্তু বলতে পারলো না সে। রাগটা সংবরণ করে নিয়ে বলল, ‘মাথাব্যথায় আমি কথা বলতে পারছি না। গিয়ে বলো খুব খারাপ লাগছে আমার।’

মেয়ে দুটো ছুটে বেরিয়ে গেল। খানিকবাদেই অর্ণবের এক বোন এসে বসল তার পাশে, ‘আপনার শরীর নাকি খারাপ করেছে আপু? বাম এনে দেই?’

সামার উত্তর দিলো না। মুহুর্তেই ছুটে এলেন অর্ণবের মা। তিনি ব্যস্ততার সঙ্গে বললেন, ‘কই দেখি আমার মায়ের কী হইছে?’
সবার এত আদর, এত আধিখ্যেতা সামারের সহ্য হচ্ছে না। সে তবুও নিশ্চুপ হয়ে রইল। শুধু বলল, ‘একটু ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে।’

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সবাই। দরজা টেনে দিয়ে গেলেন অর্ণবের মা। হাফ ছেড়ে বাঁচল সামার। অনেক্ষণ ধরে সে এসব সহ্য করে যাচ্ছে। এবার একটু বিশ্রাম নিতে পেরে স্বস্তি হচ্ছে তার। সত্যি সত্যিই ঘুম এসে গেল চোখে।

তবে ঘুম ভাঙার পর সামার যা শুনলো, তাতে তার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। পারভীন জানালেন, আত্মীয় স্বজন অনেকেই আজ উপস্থিত আছে। আজকেই কাবিন সেরে ফেলতে চান অর্ণবের পরিবার। সামার নির্বাক চোখে পারভীনের দিকে তাকালো। ঘুমের রেশই কাটেনি তার। মসজিদে মাগরিবের আযান হচ্ছে। এই ভ্যাপসা গরমে বসে বসে এ কোন সংবাদ শুনলো সে! এইমুহুর্তে সবকিছু ভেঙে ফেলবে সে, সবকিছু।

চলবে..

মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৪৬

সামার একটা চিৎকার দিতে গিয়ে নিজেকে সংবরণ করল। বাড়িভর্তি মেহমানের সামনে চেঁচামেচি করে নিজেকে কুৎসিত প্রমাণের প্রয়োজন নেই। শান্ত গলায় সে পারভীনকে বলল, ‘একটা কথা তোমার জানা দরকার মা। তুমি ভুল করছো।’
‘আমি ভুল করছি মানে কী?’
‘মা, অর্ণবের সঙ্গে আমার কোনো পছন্দের সম্পর্ক নেই। তোমরা যা জানো সেটা ভুল জানো।’

পারভীন যেন আকাশ থেকে পড়লেন। অবিশ্বাসী চোখে তিনি সামারকে দেখছেন। তার মুখচ্ছবি দেখেই অনুমান করা যায়, এ কথাটা শোনার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না তিনি।

সামার বলল, ‘অর্ণবকে আমি কোনোকালেই পছন্দ করতাম না। আমি ওকে ভাইয়ের মতো দেখতাম, বা বলতে পারো বন্ধুর মতো। আমি একজনকে পছন্দ করি। তার ব্যাপারে অর্ণবকে বলেছিলাম যেন সে তোমাদেরকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে। তুমি আর বাবা দুজনেই অর্ণবকে পছন্দ করো, তাই ও হয়তো তোমাদেরকে সহজে রাজি করাতে পারবে। কিন্তু এখানে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। অর্ণব আমার কথা বুঝতে পারেনি। সে ভেবেছে আমি ওর সঙ্গে বিয়ের কথা বলতে বলেছি। এবার বুঝতে পেরেছো মা?’

পারভীন কঠিন মুখে তাকিয়ে রইলেন সামারের দিকে। তার পা কাঁপছে থরথর করে। এক্ষুণি হয়তো জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে যাবেন তিনি। সামারকে সামনাসামনি দেখতে পাচ্ছেন না, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

সামার মাকে ধরে ফেলল। মায়ের বাহু শক্ত করে ধরে বিনয়ের সুরে সে বলল, ‘মা, অর্ণব আমাকে অনুরোধ করেছিল যেন সত্যিটা কাউকে না বলি। তাহলে ওর বাবা মা কষ্ট পাবে। ও চেয়েছিল কিছুদিন যাওয়ার পর বাসায় জানাবে, আমার সঙ্গে ওর আর বনিবনা হচ্ছে না। এভাবে সবকিছু ম্যানেজ করে নেবে ও। প্লিজ তুমিও বিষয়টাকে চেপে যাও। কাউকে কিছু বলো না আমার লক্ষী মা। শুধু আজকের দিনের মতো বিয়েটা পিছিয়ে দাও। বলো ঢাকায় গিয়ে বিয়ে হবে।’

পারভীন আর কিছু শুনতে পাচ্ছেন না। ওনার মাথা ঘুরছে। ঝাপসা চোখে তিনি সামারকে ধরে রেখেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
মাকে বিছানার ওপর শুইয়ে দিলো সামার। ওর বুক কাঁপছে। হাই প্রেশারের রোগী পারভীন। আবার হার্ট অ্যাটাক না করে বসে! দ্রুত বাইরে গিয়ে ভায়োলেটকে ডেকে আনলো সে। দুইবোন মিলে মায়ের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করল।

পারভীন আস্তে আস্তে চোখ মেলে নিষ্পলক চোখে সামারের দিকে তাকালেন। সামার মায়ের হাত চেপে ধরে বলল, ‘মা, ঠিক আছো তুমি?’
অনেক্ষণ পর পারভীন মৃদু স্বরে বললেন, ‘আমাদের মান সম্মান নষ্ট করিস না সামার। তুই বিয়েটা করে ফেল।’
সামার আঁৎকে উঠে বলল, ‘এটা অসম্ভব। আমি তোমাকে সবই বললাম। তবুও এই কথা কীভাবে বলছো তুমি মা!’
পারভীন উত্তেজিত হলেন না। শান্ত গলায় বললেন, ‘তোর চাচা চাচী, নানুবাড়ি, দাদাবাড়ি, সব আত্মীয় স্বজনকে বলা হয়ে গেছে তোর এনগেজমেন্ট হইছে। সবাইকে কি উত্তর দেবো আমি?’
‘তাতে কি হয়েছে মা? বলবে ওই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দাওনি।’
‘জাহ্নবীকে নিয়ে কথা শুনতে শুনতে আমি আর পারিনা। তোরা আমাদের সম্মানটা আর নষ্ট করিস না সামার।’
সামার পারভীনের হাত ধরে অনুরোধের সুরে বলল, ‘আমরা তো খারাপ কিছু করছি না মা। বিয়ে করে সারাজীবন সংসার করবো আমরা। কাজেই এই সিদ্ধান্ত টা আমাদেরকেই নিতে দাও।’
পারভীন কিছু বললেন না। ওনার দুচোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সম্ভবত আত্মসম্মানবোধে আঘাত লেগেছে তার। কিংবা মেয়েকে নিজের পছন্দে বিয়ে দিতে না পারার দুঃখে তীব্র কষ্ট পাচ্ছেন।
তিনি বললেন, ‘তোরা যা ভালো মনে করিস তাই কর। আমি মরলে তোরাই দায়ী থাকবি।’

সামার ও ভায়োলেট বিদ্যুৎ শক খাওয়ার মতো চমকে উঠলো। পারভীন চোখ মুখ শক্ত করে রাখলেন। সারাজীবন অসুখী ছিলেন তিনি। সবকিছু থাকার পরও কখনো নিজেকে নিয়ে সুখী হতে পারেননি। মেয়েদের কাছাকাছি আসতে পারেননি কখনো। এই বয়সে এসে তার সবার প্রতি রাগ হয়, অকারণে অসহ্য লাগে সবাইকে। তিনি আবারও বলে ফেললেন সেই কুৎসিত বাক্যটি, ‘আজ যদি আমি মারা যাই, তুই আর জাহ্নবী দায়ী থাকবি। আমার মৃত্যু তোদের জন্যই হবে।’
এত নোংরা একটা বাক্য সামার হজম করতে পারলো না। মায়ের হাত ছেড়ে দিয়েছে সে অনেক আগেই। এবার পাশ থেকে উঠে পড়ল। ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল বাইরে। পারভীনের সঙ্গে সামারের সম্পর্কটা আর পাঁচটা মা মেয়ের সম্পর্কের মতো নয়। পারভীন কোনোদিনও পারেননি সামারকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করতে। সবসময় একটা অদৃশ্য দেয়াল তাদেরকে রেখেছে আলাদা করে। তা সত্ত্বেও সামার মায়ের এই কথাটি মেনে নিতে পারছে না।

কয়েক মুহুর্তের মাঝেই ঘরে প্রবেশ করল সামার। পারভীন অন্যদিকে মুখ করে রেখেছেন। সামারের চেহারায় কাঠিন্য ভর করেছে। ভায়োলেট এগিয়ে গেল তার দিকে। বোনকে কিছু বলার আগেই সামার স্পষ্ট গলায় বলল, ঠিক আছে। আমি অর্ণবকে বিয়ে করবো। কাজি ডাকতে বলো। বিয়ে আজকেই সম্পূর্ণ হবে।
পারভীন সামারের দিকে তাকালেন। ভায়োলেট কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বোনের হাত ধরতে যাবে, এমন সময় সামার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রান্নাঘরে অর্ণব তার মা ও বোনের সঙ্গে গল্প করছিল। সামার তার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াল, ‘আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।’
অর্ণব বিব্রতবোধ করে, মায়ের মুখের দিকে তাকায়। তাদের সামনে সামারের সঙ্গে যেতে লজ্জা করছিল তার। তবুও সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়াল।

সামার জানতে চাইলো, ‘আপনি কি জানেন আজকে আমাদের কাবিন?’
অর্ণব জানেনা কিছুই। তাকে জানানো হয়নি। কথাটা সামারের মুখে প্রথমবার শুনে যারপরনাই চমকে উঠলো সে, ‘মানে!’
‘মানে আজকে আমাদের বিয়ে।’
‘শান্ত হোন সামার। আমি বিষয়টা দেখছি। আপনি টেনশন করবেন না।’
‘কী দেখবেন? যা দেখার আগেই দেখা প্রয়োজন ছিল। এখন আর কিছু দেখার সময় নেই।’
‘আমি আংকেলকে সবকিছু খুলে বলবো। প্লিজ আপনি রাগ করবেন না।’
‘আপনি বিয়ের সব আয়োজন করতে বলুন। বিয়ে আজকেই সম্পূর্ণ হবে। আত্মীয় স্বজন আরও কাউকে ডাকার প্রয়োজন হলে ডাকতে বলুন। এরপর আর কোনো প্রোগ্রাম হবে না।’

অর্ণব স্তব্ধ হয়ে রইল খানিকক্ষণ। সামারের এই কাঠিন্যভাব দেখতে তার ভালো লাগছে না। সে সামারকে চায়, তবে এভাবে নয়।
অর্ণব বলল, ‘আমি এখনই মাকে সবকিছু খুলে বলবো সামার। আপনি রাগের মাথায় কিছু করবেন না প্লিজ।’
‘আপনাকে কি বলেছি শুনতে পাননি? বিয়ের আয়োজন করতে বলুন।’
‘আংকেল আন্টি আপনাকে কিছু বলেছে?’
‘সেসব আপনার না জানলেও চলবে।’
‘আমি ওনাদের সঙ্গে কথা বলি। আপনি একটু সময় দিন আমাকে।’
‘আমার ফ্যামিলির সঙ্গে আর কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই।’
অর্ণব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’
‘আন্টি কিছু বলেছে আপনাকে তাইনা? ওনাদের সঙ্গে রাগ করে আপনি এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।’
‘জীবনের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত চাইলেই নিজে নিজে নেয়া যায়না। পরিস্থিতি আপনাকে বাধ্য করবে সেসব সিদ্ধান্ত নিতে।’
‘আপনাকে আমি বাধ্য হতে বলছি না। আপনি দাঁড়ান। আন্টিকে যা বলার আমিই বলছি। আমাকে লাস্ট একটা সুযোগ দিন।’
অর্ণব সামারের আর কোনো কথা শোনার অপেক্ষায় রইলো না। দ্রুতপায়ে হাঁটতে হাঁটতে সে পারভীনের সঙ্গে কথা বলতে চলে গেল। বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সামার। সে এখন কী করবে? অর্ণবের কথা শুনে পারভীনের কেমন প্রতিক্রিয়া হয়, সেটা ভেবেই তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

দরজায় দাঁড়িয়ে অর্ণব বলল, ‘আন্টি আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।’
শোয়া অবস্থায় করুণ মুখে পারভীন তাকালেন অর্ণবের দিকে। তার মুখে বিষাদের তীব্র ছায়া। তিনি জানেন ছেলেটা কী বলতে এসেছে।

চলবে..