মেঘবালিকার নিমন্ত্রণে পর্ব-১২

0
144

#মেঘবালিকার_নিমন্ত্রণে
#পর্ব-১২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

মাহির আজ এই মুহুর্তে প্রচন্ড ক্লান্তি অনুভব করলো। নিজেকে টেনে নিয়ে নিচে নামলো। সবার চিন্তিত মুখ দেখে তার ভ্রু কুঁচকে গেলো। তখনই সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো ইশান। হাঁপাতে হাঁপাতে মেহেরের সামনে এসে বলল,

‘পাইনি, হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেলো বুঝতে পারছি না।’

মাহির অবাক স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো,

‘কাকে নিয়ে কথা হচ্ছে?’

মমতা খান চিন্তিত স্বরে বললেন,

‘ইরা কিরকম দৌড়ে বের হয়ে গেলো বাবা। কাঁদছিল ও। তোমার আন্টি আঙ্কেল উপরে রেস্ট নিচ্ছেন। মেয়েটার ভালো মন্দ কিছু হলো কি না বুঝতে পারছি না।’

মাহির চমকে গেলো। মেহের ফুপিয়ে উঠলো,

‘আপুকে ফোনেও পাচ্ছি না ভাইয়া। আপুর কিছু একটা হয়েছে।’

ইশান অবাক হয়ে বলল,

‘মানে?’

‘আমি আপুকে মাঝরাতে বারান্দায় কাঁদছে দেখেছি। উনি সম্ভবত কিছু নিয়ে ডিপ্রেশনে থাকেন। আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি৷ উনি এড়িয়ে গেছেন।’

ইশান মৃদু চিৎকার করলো,

‘তুমি আমাকে তো কখনো বলোনি। আমার আপাটা চাপা স্বভাবের প্রচন্ড। কোনো কিছু নিয়ে টেনশনে থাকলে নিজ থেকে কখনোই বলবে না কাউকে। এবার তো আমার মারাত্মক চিন্তা হচ্ছে। নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে যা আমাদের অজানা।’

ইশান ফোন বের করে একের পর এক কল করতে লাগলো ইরাকে। ততোক্ষণে উপর থেকে নেমে এসেছেন ইরার মা বাবা। মেয়ের অবস্থা শুনে তারাও চিন্তিত হলেন। ইশান বের হয়ে যেতে যেতে বলল,

‘আমি বাসায় যাচ্ছি। দেখি আপা ওখানে গেছে কি না।’

মেহের দৌড়ে এসে বলল,

‘আমিও যাবো।’

‘কিন্তু, তোমার ভাইয়ের এনগেজমেন্ট হবে। তুমি কিভাবে..

কথা বললেন তাহসিন খান,

‘এনগেজমেন্ট কিছু ঘন্টার জন্যে স্থগিত থাক। তুমি একা নও আমরাও ইরাকে খুঁজবো।’

ইশান মেহেরকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মাহতাব মাহদিকে কোলে করে এগিয়ে এসে বলল,

‘গতকালও ইরাকে একটু অসুস্থ মনে হচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করাতে এড়িয়ে গেলো। আমি নিশ্চিত বাবা কিছু তো একটা হয়েছেই।’

‘গাড়ি বের করো আমরাও যাবো ইরার ফ্ল্যাটে। মাহির তুমি ইরার হসপিটালে গিয়ে খুঁজ নাও একটু।’

তাহসিন খান ও মাহতাব বেরিয়ে গেলেন। ইরার বাবা রুহুল আমিন বের হয়ে গেলেন মেয়েকে খুঁজতে। মাহির মুখে মাক্স পড়ে গাড়ি নিয়ে বের হলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

হসপিটালের কোথাও ইরাবতী নেই। মাহির ইশানকে ফোন করলো। ইশান বাচ্চাদের মতো করে ফুপিয়ে উঠে বলল,

‘আপনি একটু আমাদের বাসায় আসবেন মাহির ভাই?’

মাহির আসছি ফোন রেখে দিলো। গাড়ি ঘুরিয়ে যখন ইরাবতীর ফ্ল্যাটের ভবনটির সামনে পৌছালো তখন আকাশ থেকে ঝিরিঝিরি বর্ষণ নেমে গেছে। সে গাড়ি পার্ক করে দ্রুত গতিতে ইরার ফ্ল্যাটে এসে পৌছালো। দরজা খোলাই ছিল। ইশান ও মেহের কেমন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সোফাতে। মাহিরকে দেখে মেহের মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে উঠলো। মাহির বিচলিত কন্ঠে বলল,

‘ভাইয়া, বাবা, আঙ্কেল কোথায়?’

ইশানের থমথমে কন্ঠস্বর,

‘উনারা বাহিরে খুঁজতে গেছেন। রাত হয়ে গেছে। কে জানে কোথায় আছে আমার বোনটা।’

মেহের ঠোঁট উল্টে কেঁদে বলল,

‘তোমাকে কিছু দেখানোর ছিলো ভাইয়া।’

মাহিরের ভ্রু কুঁচকে গেলো,

‘কি?’

ইশান উঠে ইরার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,

‘এই রুমে আসুন একটু।’

মাহির মেহেরের দিকে তাকালো। তারপর ইশানের পেছনে গেলো। মেহেরও গেলো পিছু পিছু।

ইশান একটি ডায়েরি এগিয়ে দিলো মাহিরের দিকে। বলল,

‘আপা তার মনের গোপন কথা ডায়েরিতে লিখে রাখে। সেজন্য আমি ডায়েরি চেক করেছিলাম। আপনি যদি একটু পড়েন তো ভালো হয়।’

‘কি আছে এতে?’

মেহের উত্তেজিত হলো,

‘তুমি নিজেই দেখে নাও ভাইয়া।’

মাহির ডায়েরি খুলে বিছানায় বসলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো গুটিগুটি অক্ষরে লেখা তারিখটা।

১০ মে ২০২০,

‘আজ আমি অদ্ভুত কিছু একটা লিখতে চলেছি। যা নিয়ে কখনো লেখা হয়নি। একজন ব্যক্তিকে নিয়ে লিখবো।

গতকাল মধ্যরাতে আমার বেডরুমের বেলকনি দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন একজন ছায়া মানব। কারো নিঃশ্বাস নিজের মুখের উপর অনুভব করে আমি যখন চোখ মেলে তাকাই তখন চমকে যাইনি। তবে মনে মনে ভেবেছিলাম এরকম একজন মানুষ আমার বেডরুমে কিভাবে! মাহির খান! এ সময়ের স্বনামধন্য একজন ক্রিকেটার। একজন সেলিব্রেটি কি না আমার রুমে। তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম তিনি বিপদে পড়ে বেলকনি দিয়ে প্রবেশ করেছেন। আমি তাকে যথাসম্ভব আপ্যায়ন করলাম। তিনি যথারীতি কালো টয়েটো গাড়িতে করে সকালের নাস্তা করে চলে গেলেন। আমি ভেবেছিলাম বাঁচা গেলো। হসপিটালের লেট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি আমি বাঁচিনি, বরং মাহির খান নামক পুরুষের মধ্যে হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে। এমন অসম্ভব কিছু আমি কখনোই চাইনি। ধরা ছোঁয়ার বাহিরে যে তাকে কেন আমার ভালোবাসতে হলো!

২০ জুন ২০২১

আজ জন্মদিন। ইরাবতী আমিন নামক মেয়েটির। বাহিরে ঝিরিঝিরি বর্ষণ হচ্ছে। বর্ষণ আমার অনেক প্রিয়। কারণ এমনই একটি বর্ষণের রাতে সেই শুদ্ধতম পুরুষটির আগমন ঘটেছিল আমারই গৃহে। আমি জানি সে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে মাঠে ছক্কা মারতে ব্যস্ত। কিন্তু তিনি কি জানেন? দীর্ঘ এক বছর ধরে বর্ষণের মতো কেউ একজন তাকে ভেবে ভালোবাসা নামক বর্ষণ হয়ে ঝড়ে!

‘এই মেঘলা দিনে একটা ঘরে থাকে না তো মন। কাছে যাবো কবে পাবো ওগো__তোমার নিমন্ত্রণ।’

আপনাকে মেঘবালিকার গৃহে নিমন্ত্রণ জানালাম মাহির। আপনি আসুন শিগগির আসুন। ‘আমার আপনি’ হয়ে।

আপনি শুধু আমার মাহির। শুধুই ইরাবতীর।

২৩ অক্টোবর ২০২১

‘প্রায় দেড় বছর পর আপনাকে দেখলাম। হসপিটালের সামনে যখন কালো টয়েটো গাড়িটা এসে থামলো, তখন আমি থমকে গেলাম। আপনি আসার সাথে সাথে বর্ষণও নিয়ে আসলেন। আপনি আগের থেকে আরও হ্যান্ডসাম হয়ে গেছেন দেখি মশাই। আপনি যেদিন আসেন সেদিন বর্ষণ নামে কেন বলুন তো?’

৩০ নভেম্বর ২০২১

আপনার পরিবারের সাথে ভাব জমিয়ে নিয়েছি জানেন। মেহেরের সাথে আমার টুকটাক কথা হয়। সেই বদৌলতে আজ আপনাকে দেখার জন্যে মেহেরের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আমি জানি আজ আপনি দেশে ফিরেছেন সকালে। আমাকে কি আপনার ধান্ধাবাজ মনে হচ্ছে? হিহি মনে করলে মনে করতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না।

৩০ নভেম্বর ২০২১ – রাত

আপনাকে দেখতে পারলাম না ভালো করে। মন খারাপ করে যখন বের হয়ে যাচ্ছিলাম তখন আপনাকে বাগানের কাছের বেলকনিতে দেখি। আপনি হাত নাড়ালেন। ব্যস অতটুকুই। মন ভরেনি। আপনাকে একদিন সামনে বসিয়ে মন ভরে দেখবো ক্রিকেটার।’

‘তারপর রয়েছে মাহিরকে নিয়ে আরও নানান কথা। কতো আবেগ কতো অনুভূতি। মাহির ডায়েরির প্রতিটি কথাতে হারিয়ে যাচ্ছিল। একটা মেয়ে তাকে এতো ভালোবাসে! তার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। মাহির পড়তে পড়তে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টিয়ে গেল।

১ জানুয়ারি, ২০২২

‘আজ আপনার জন্মদিন। উনত্রিশ তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা আপনাকে ‘মেঘবালিকার পুরুষ!’ ত্রিশতম জন্মদিন আসার আগে আমাকে আপনার করে নিন!’

পাতার পর পাতা উল্টালো। একটি পৃষ্ঠায় এসে মাহির স্থির হয়ে গেলো।

১০ মার্চ ২০২৩

আপনার আমার হওয়াটা হলো না। জীবনটা এতো জটিল কেন বলুন তো? আমরা যখনই কিছু সহজ ভাবি তখনই সেটা জটিল রুপ ধারণ করে কেন? আজ আমি আপনার চোখে আমার ও আমার পরিবারের জন্য স্পষ্ট ঘৃণা দেখেছি মাহির। ভালোবাসার মানুষের চোখে ঘৃনা দেখে আমার তখন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমার মস্তিষ্ক মেনে নিলো আপনার আমার এক হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু মন! তাকে কিভাবে মানাবো মাহির? সে তো প্রতিনিয়ত আপনাকে চায়। আমার এক তরফা ভালোবাসা কালের গর্বে হারিয়ে যাবে মাহির সেটা ভাবলেই আমার কান্না পাচ্ছে। পৃথিবী জানে ইরাবতী কাঁদতে জানে না। অথচ রাতের আঁধারে কাঁদার জন্য আমি একটি বুক খুঁজি। যে বুকে আমি নির্দ্ধিধায় কাঁদতে পারবো। যে বুকে মাথা রেখে বলে ফেলতে পারবো হাজারো মন খারাপের কথা। যে মানুষটাকে ইচ্ছে হলেই শুনিয়ে দিতে পারবো কেন আমার মন খারাপ হয় বার-বার? কেন আমি গুমরে মরি বুকের ভিতর!

জানেন মাহির? আমার এতো ভালোবাসা আপনি কখনো জানবেন না সেটা ভাবতেই আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আপনি কি দারুণ ভাবে ঠকে গেলেন মাহির। ইরাবতীকে না পেয়ে ঠকে গেলেন। সাথে কি নিষ্ঠুরভাবে ইরাবতীর হৃদয় ভেঙে দিলেন। অথচ জানলেন না ইরাবতীর হৃদয় শুধু এবং শুধুমাত্র এক আপনার জন্যই ভাঙে আবার জোড়া লাগে!

পৃথিবীর নিষ্ঠুর নিয়মে আমি ফেঁসে গিয়ে আজ আপনাকে চিরতরে হারিয়ে ফেললাম। এইজন্য আমি পৃথিবীকে কখনো ক্ষমা করবো না। ক্ষমা করবো না আমার লুকোনো প্রেমিকা মনকে যে এখনো আপনার দহনে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত!

১৭ এপ্রিল, ২০২৩

আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে মাহির। আপনার সাথে অন্য কাউকে আমি কিভাবে মেনে নিবো! পৃথিবী এতো নিন্ঠুর কেন মাহির। আপনি এতো নিষ্ঠুর কেন!

১৮ এপ্রিল ২০২৩

একটু আগে মাহতাব ভাই এসে আপনার এনগেজমেন্টের দাওয়াত দিয়ে গেলেন। আমি মারা যাচ্ছি মাহির। শেষ হয়ে যাচ্ছি। বিধাতা এ কোন পরীক্ষায় ফেললেন আমায়! ‘মেঘবালিকার পুরুষ’ আর মেঘবালিকার রইবে না!

১৯ এপ্রিল ২০২৩

আপনি ত্রিশ বছরে পা রাখলেন মাহির কিন্তু আমায় ঘরে তুললেন না। বরং আজ জড়িয়ে যাবেন অন্য কারো সাথে! আপনার পড়ানো আংটি অন্য কারো আঙ্গুলে ঝলমল করবে। আপনি অন্য কারো দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাবেন। আমার এই দীর্ঘ অপেক্ষার কথা আপনি কখনো জানবেন না। পৃথিবী জানলো না ক্রিকেটার মাহির খানকে দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর ধরে এক তরফা ভালোবেসে ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছে ইরাবতী নামক দুঃখীনি!

তারপর আর লেখা হয়নি। শেষ তারিখটা আজকের। মাহির নেড়েচেড়ে দেখলো। খসে পড়লো কিছু একটা। সেটা হাতে নিয়ে দেখলো সে। তার একটি ছবি। যেটা শেষ পৃষ্ঠাতে রাখা ছিল। মাহির শেষ পৃষ্ঠাতে গেলো। সেখানে প্রগাঢ় প্রেম নিয়ে লেখা,

‘আপনি শুধুই আমার মাহির! মেঘবালিকার পুরুষ আপনি। আপনার আমার বাস্তবে প্রেম হয়নি। কিন্তু কল্পনায় আমি আপনার সাথে প্রেম করছি। পৃথিবীর সব প্রেমকে হার মানায় যে প্রেম? আপনার সাথে ও আমার ঠিক তেমনই প্রেম চলছে এখন। আমি দেখছি আপনি হাসছেন। মাঝে মধ্যে হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছেন আমার সামনে আসা কিছু চুল। কথার ছলে কি অসম্ভব ভালোবাসা নিয়ে ঠোঁট ভুলিয়ে দিচ্ছেন কপালে।’

মাহির দু’হাতে মুখ ঢেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মেহের ফুপিয়ে ডাকলো,

‘ভাইয়া..’

মাহির উঠে দাড়ালো।

‘তাকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে। আমি যাচ্ছি। কোনো খুঁজ পেলে জানাস।’

মাহির প্রস্থান করলো। বাহিরে তখন তুমুল বর্ষণ। মেহের ও ইশান একে অপরের দিকে তাকালো। মেহের চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো ‘চিন্তা করো না। কিন্তু চিন্তা কি কমে! সবার সাথে সাথে ইরাবতীর জন্য চিন্তা নামলো ক্রিকেটারের মনেও।

(চলবে)