#মেঘভেজা_দুপুরের_নিমন্ত্রণে_ফিরে_এসো
#পর্ব-১১
সারোয়ারকে কবে থেকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম জানেন? একবার শপিং এ গিয়ে আমার খুব ক্লোজ এক বান্ধবীর দেখা হলো। আমাকে অবাক করে দিয়ে সারোয়ার আমার সেই বান্ধবীর সাথে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলো যেন সে আমার বান্ধবীকে কতকাল ধরে চেনে। রীতিমতো ফ্লার্টিং করছিল সারোয়ার আর আমার বান্ধবী তাতে ভীষণ মজা পেয়ে আমাকে দেখছিল আর ওর সাথে তাল মেলাচ্ছিল। সেদিন বাড়ি ফিরে আমি কৌফিয়ত চাইতেই সারোয়ার আমাকে বোঝাল পুরো ব্যাপারটাই ফান। সে আমাকে ইর্ষান্বীত করতেই এমনটা করেছে যাতে আমাদের ভালোবাসা বাড়ে। আমি অবিশ্বাস নিয়ে অনেকক্ষণ সারোয়ারকে দেখেছিলাম। এরপর কিছুদিন পরেই আমার সেই বান্ধবীর ফোন-“তোর বর আমাকে বিরক্ত করছে। নিজের বরকে সামলে রাখতে না জানলে বিয়ে সংসার করছিস কেন? ছেড়ে দে।”
সাথে সারোয়ারের পাঠানো ম্যাসেজের স্ক্রিনশট। লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। হুট করে কেন এমন করছে সারোয়ার? কি সমস্যা ওর? বাসায় ফিরে ওকে ধরলাম। প্রথমে আমতা আমতা করলেও পরে স্বীকার করলো-“তুমি ব্যস্ত থাকো আমার একলা লাগে।”
“নিজে কেন কিছু করছো না সারোয়ার? অফিসে একদিন যাও তিনদিন যাও না। এদিকে আমি ঘরে বাইরে কাজ করতে করতে মরছি। এভাবে হয় না সারোয়ার। কবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে তুমি?”
সারোয়ার আমাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করলো-“বিজনেসটা মায়ের অনেক প্রিয়। এটাতেই মায়ের সময় কাটে। আমি সেখানে অযাচিত নাক গলাতে চাই না।”
“তাহলে নিজে কিছু করো। বিজনেস চাকরি যাই হোক কিছু একটা করো।”
“চাকরি করলে মা কষ্ট পাবে।”
আমি অবাকের চুড়ান্ত-“তাহলে কি আজীবন বেকার বসে থাকবে? এমন ইচ্ছে তোমার? আমাকে আগে বলোনি কেন?”
সারোয়ার মিষ্টি হেসে প্রবোধ দেয় আমাকে-“তুমি খামোখাই ভুল বুঝছো আমাকে। আচ্ছা ঠিক আছে, কাল থেকে রেগুলার অফিস করবো। এবার খুশি?”
আমি হতাশ হয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলি। আমার প্রতি ন্যুনতম সন্মান নেই সারোয়ারের মনে। থাকলে এসব করতে পারতোনা। এই সারোয়ারকে অচেনা লাগে আমার। যাকে চিনতাম সে অন্য কেউ। সে স্বপ্ন দেখাতে জানতো, নিজেও দেখতো। এই সারোয়ার স্বপ্ন দেখতে যানে না। আমি ধাক্কা খেলাম। বাবার কথাগুলো কানে বাজতে থাকলো। এই প্রথম মনে হলো ভুল করে ফেলেছি। বাবার কথা শোনা উচিত ছিল। কিন্তু কি আর করা। এমন ভুল করেছি যা শোধরানো বড় কষ্ট। আমি মনে মনে ছক কষি, দেখি সব দিক দিয়ে হার আমারই।
চুড়ান্ত আঘাত তখনও বাকী বুঝিনি। সারোয়ার রেগুলার অফিস শুরু করলে যেটা হলো ও অফিসে বেশি সময় দিতে লাগলো। রাত করে ফিরে শুয়ে পড়ে।আমি সন্ধ্যায় ফিরে ওর ফেরার অপেক্ষায় থাকতাম অথচ বেশিরভাগ দিন ও ফিরতো বারোটার পর। একদিন বললাম-“তোমার যেহেতু ফিরতে রাত হচ্ছে আমি তাহলে চেম্বার শুরু করি?”
“কেন? রাত বিরাতে বাইরে থাকতে হবে কেন?”
“এই সময়টা বোড় লাগে আমার। কিছু করার থাকে না।”
“ঘরের কাজ করো, রান্না করো। কাজের তো অভাব নেই।”
“আমি ডাক্তার এটা জেনেশুনেই তুমি আমার সাথে সম্পর্ক করেছিলে সারোয়ার এখন এসব বলার মানে কি? বিসিএস দেইনি এখন যদি চেম্বার না করি, পড়ালেখা না করি তাহলে ডাক্তারি পড়াটাই বৃথা যাবে। তুমি সেটাই চাও বুঝি?”
সারোয়ার কথা বললো না। পরের সপ্তাহে বাসার কাছাকাছি হাসপাতালে চেম্বারে করতে শুরু করলাম। দু’ঘন্টার জন্য চেম্বার মানা করার কারণ নেই। সারোয়ার জানলেও কিছু বললো না। অল্পদিনেই আমার চেম্বার বেশ জমে উঠছে দিনকে দিন।
তবে সেই সাথে এটাও টের পাচ্ছিলাম আমাদের দু’জনার মধ্যকার ছন্দ হারিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট অনেক ঘটনা আজ আর মনে করতে চাই না। প্রতিটা ঘটনা আমাদের সম্পর্কের খুটি একটু একটু করে আলগা করেছে। পুরো ঘটনা থেকে একটা জিনিস খুব বুঝলাম, দশজনের অনিচ্ছায় একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে দু’জনকেই অনেক উদ্যোগী হতে হয়। বেশিরভাগ ছেলে হয়তো এই জায়গায় এসে হেরে যায়। সারোয়ার যতটা আগ্রহী হয়ে আমাকে বিয়ে করেছিল ততটা আগ্রহ যদি বিয়ে টিকিয়ে রাখতে করতো তাহলে আজ আমাদের সম্পর্ক অন্যরকম হতো। মধ্যবিত্ত মেয়েরা শেষ পর্যন্ত সংসার টিকিয়ে রাখতে চায় কিন্তু সফল হতে পারে খুব অল্প সংখ্যক। কেউ শেষ পর্যন্ত হেরে যায় নয়তো কেউ সব মেনে নিয়ে মুখ বুঁজে পড়ে থাকে। আমি এই দুইয়ের মাঝামাঝি অবস্থানে ছিলাম। আমি হেরে যেতেও রাজি ছিলাম না আবার মুখ বুঁজে পড়ে থাকতেও চাইছিলাম না। ওই সময়টা খুব বাজে কেটেছে আমার। বাবার বাড়ির সাথে সম্পর্ক আলগা। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া বাবার কাছে ফিরতে চাইনি তাকে সঠিক প্রমান না করতে। আরেকদিকে রঙ্গন ছিলো না। মেডিকেলে রঙ্গন ছাড়া আর কারো সাথে সেরকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো না আমার। কাজেই একাকিত্ব তীব্র ভাবে গ্রাস করলো আমাকে। এরমধ্যেই সারোয়ারের আরেকটা খবর আমাকে একেবারে রিক্ত করে দিলো। অফিসের এক মেয়ের সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আর সেটা নাকি বিয়ে পর্যন্ত গড়াবে। আমাকে ছেড়ে ওই মেয়েটাকে বিয়ে করবে সারোয়ার। আর এতে ওর মায়ের সমর্থন আছে। আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেলো। কার সাথে পরামর্শ করবো কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। অতঃপর বাধ্য হয়ে রঙ্গনকে ম্যাসেন্জারে নক দিলাম।
যে ছেলেকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম একদিন সেই ছেলেই আমার এক ডাকে সারা দিলো। ওকে জানালাম আমি দূরে কোথাও যেতে চাই। ও কি কোনভাবে হেল্প করতে পারে আমাকে? তখনও জানতাম না রঙ্গন দেশে ফিরেছে। সব শুনে সে আমাকে আশ্বাস দিলো কোন একটা ব্যবস্থা করবে। আমি যেন চলে আসি চিটাগং। কবে কখন ঘর ছাড়বো সেটা বলে দিলাম ওকে। এক জায়গায় যেয়ে ওর কোন এক পরিচিতের সাথে মিট করার কথা ছিলো আমার। সেদিন পালিয়ে সেখানে যেয়ে সারপ্রাইজ হলাম রঙ্গনকে দেখে। ঠিক যেমনটা আজ হলাম সারোয়ারকে দেখে।
একটু নাটক করতে হয়েছে আমাকে। ছোটকাল থেকে গোয়েন্দা গল্প পড়াটা কাজে লাগিয়ে একটা বুদ্ধি বের করেছি। সকালে মোমেনা খালাকে জোরে জোরে বলেছি আজ আমি সেমিনার এটেন্ড করতে চট্টগ্রামের বাইরে যাব। ফিরতে রাত হবে। তারপর তৈরি হয়ে বেরিয়ে এসে বসলাম বাসার কাছের এক রেস্টুরেন্টে যেখান থেকে বাসাটা সরাসরি দেখা যায়। তারপর অপেক্ষা করতে লাগলাম শিকারের। জানতাম এতে কাজ হবে। শিকারী টোপ গিলবে। মোমেনা খালাকেও বলা ছিলো। তাই তিতুনকে সাথে নিয়ে ওর দিদুনের বের হওয়ার খবর পাওয়ার সাথে সাথেই আমি ওদের পিছু নিয়েছি। বাসা থেকে খুব বেশি দূরে নয় হোটেলটা। ওরা রিক্সায় যাচ্ছিল আমি গাড়িতে ওদের পিছু নিলাম। এখন হোটেল আগ্রাবাদের পঞ্চম তলার ৫০৭ নং ডিলাক্স রুমটার সামনে দাঁড়িয়ে আমার হাত পা রীতিমতো কাঁপছে। ভাগ্যিস এখানে সারোয়ার নিজের নামটা ঠিক লিখেছে, কোন লুকোচুরির আশ্রয় নেয়নি। না হলে ওর রুম নাম্বার খুঁজে পাওয়া দূস্কর হতো। আমি দুরুদুরু বুকে দরজায় নক দিলাম। ভেতর থেকে সারোয়ারের গম্ভীর গলা ভেসে এলো-“কে?”
আমার শরীর কাঁপছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে সেই পরিচিত গলার স্বর শুনে অকারণ উত্তেজনায় বুকটা ধরফর করে উঠলো। সহসাই গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো না আমার। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সাহস করে পুনরায় দরজায় কড়া নাড়তেই এবার দরজাটা ফট করে খুলে গেলো। আমার সামনে সারোয়ার দাঁড়িয়ে আছে চোখে মুখে হাজারো বিরক্তিকর অভিব্যক্তি নিয়ে। কিন্তু আমাকে দেখা মাত্রই চেহারায় দ্রুত পরিবর্তন এলো। যেন হাজার ভোল্টের শক খেয়েছে সে। ফ্যাকাশে মুখে হতভম্ব ভাব নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সারোয়ার, আমার স্বামী, তিতুনের বাবা। দু’জন দু’জনকে দেখছি বিস্ময় নিয়ে। কোন আওয়াজ নেই ভেতর থেকে আমার শ্রদ্ধেয় শাশুড়ী মা বেরিয়ে এলেন-“সারোয়ার, কে এসেছে? রুম সার্ভিস নাকি? তিতুনের জন্য আইসক্রিম এনেছে, তাই না?”
বলতে বলতে আমার দিকে নজর পড়লো ওনার। চমকে উঠে বললেন-“তুমি! এখানে!”
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে দিলাম। সারোয়ারের চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলাম-“কেমন আছো সারোয়ার? এতোদিন পরে কোত্থেকে এলে জানতে পারি কি?”
★আসন্ন বইমেলা উপলক্ষে আমার দু’টো বই আসছে। একটা পলিটিকাল মার্ডার মিস্ট্রি থ্রিলার ‘অন্ধকারে জলের কোলাহল’ অন্যটা সমকালীন রোমান্টিক জনরার ‘আমি ডুবতে রাজি আছি’। চমৎকার বইদুটোর প্রি অর্ডার চলছে রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপে। আমার লেখা ভালো লাগলো বইদুটো সংগ্রহ করুন। আশাকরছি ভালো পড়ে নিরাশ হবেন না।★
চলবে—
© Farhana_Yesmin